বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ৭

০৭.

 পুলিশের জিপ কর্নেলের কথা মতো ফরেস্টবাংলোর কাছাকাছি আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল। শ’দুয়েক মিটার আমরা হেঁটে এলাম। কর্নেলকে এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম–রেডিও মেসেজে কী আছে?

কর্নেল টর্চের আলোয় চারদিক দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন। বললেন– দেবীবাবুর লোহার ডাণ্ডায় রক্তের চিহ্ন লেগে আছে। ওটাই মার্ডার উইপন।

চমকে উঠলাম। তা হলে উনিই মার্ডারার? আপনার থিওরি যে উল্টে গেল।

নাহ। দেবীবাবুর অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে আভাস পাওয়া গেছে, কেউ গত পরশু রোববার বিকেলে ডাণ্ডাটা ওঁকে প্রেজেন্ট করেছিল। সে খুব ভাল লোক। তা ছাড়া সে-ই নাকি ওঁকে পাগলাগারদ থেকে উদ্ধার করেছিল। কলকাতা নিয়ে গিয়েছিল গাড়ি চাপিয়ে। কাজেই আমার থিওরি পাকা।…

.

বাংলো কাল সন্ধ্যার মতো নিরিবিলি নিঝুম। পুলিশপাহারা নেই দেখে বুঝলাম, বিলুকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার পর সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে। আমাদের দেখে ভোলা হন্তদন্ত ছুটে এল। সে কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন–সব শুনেছি। তুমি কফি নিয়ে এসো।

কর্নেল ঘরে ঢুকে গেলেন। আমার বদ্ধ ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে পড়লাম। আজ সন্ধ্যায় বাতাস উঠেছে জোরালো। চারদিকে রহস্যময় শনশন শব্দ। নব মালী এসে সেলাম দিল। তার দিকে তাকালে, সে মুচকি হাসল। বললাম–কী নব? হাসছ কেন?

–একটু আগে সেনসায়েব এসেছিলেন। মেমসায়েব কখন নাকি হাওয়া হয়ে গেছে। আমাদের খুব তম্বি করে চলে গেলেন। নব চাপাস্বরে বলল ফের– বিলুবাবুর সঙ্গেই বোধকরি কেটে পড়েছে কখন। ভোলাদা দেখে থাকবে। বলছে না। সেনসায়েব থানায় খবর দিতে গেলেন হয়তো। কিন্তু আর কি ফেরত পাবেন? বিলুবাবুর হাতে যা যায়, আর তা ফেরত আসে না। বিলুবাবুর বাবার হাতে থানা পুলিশ। শুনলাম, ছেলেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। ও! আপনারা যাওয়ার পর কী সাংঘাতিক ঝামেলা হলো, বলিনি।

কর্নেলের মতোই বললাম–সব শুনেছি।

–শুনেছেন? তা হলে তো আর কথাই নেই। বলে নব চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। বললেন–জয়ন্ত, আপাতত ঘণ্টা দুয়েক বাথরুমে ঢোকা নিষিদ্ধ। এটা এখন ডার্করুম। ফিল্ম রোলটা ওয়াশ করতে দিয়ে এলাম। শিগগির প্রিন্ট দরকার। বাথরুমে যেতে চাইলে ভোলাকে বলো। স্টাফদের জন্য ওদিকে একটা বাথরুম আছে। যাবে নাকি?

দরকার নেই। কিন্তু এখনই ছবির প্রিন্ট জরুরি হয়ে উঠল কেন বস্?

কর্নেল জবাব দিলেন না। টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। ভোলা কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। বেতের টেবিলে রেখে কাচুমাচু মুখে বলল–একটু আগে সেনসাহেব এসেছিলেন। মেমসায়েব কোথায় গেলেন জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি বলিনি কিছু। আপনি বারণ করেছিলেন। সেনসায়েব আমাদের বকাবকি করে চলে গেলেন আবার। পুলিশে খবর দিতে গেলেন। পুলিশ এসে আমাকে জেরা করলে বিপদ। কী বলব স্যার?

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–পুলিশ আসবে না, তোমাকে জেরা করতে।

ভোলা গাল চুলকে বলল–আমি শুধু ভাবছি মেমসায়েবের খাওয়া-দাওয়া হয়নি।

–মেমসায়েব আমার ঘর থেকে পালিয়ে গেছে।

–সে কী স্যার! কী করে পালালেন?

বাথরুমের ভেতরকার দরজা খুলে চলে গেছে। যাই হোক, এ নিয়ে তোমার চিন্তার কারণ নেই।

ভোলা চাপাস্বরে বলল–আমারই ভুল। মেমসায়েব আমাকে সকালে একটা চিঠি দিয়ে আসতে বলেছিল বিলুবাবুকে। আপনাকে না বলে অন্যায় করেছি স্যার।

জানি। তুমি তোমার কাজ করো। রাত সাড়ে নটার মধ্যে ডিনার খাব।

 ভোলা অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল কিচেনের দিকে। কর্নেল কফি খেতে খেতে চুরুট ধরালেন। বললাম–’ব্রেক দা জ, ক্যাচ দা টপ’ যে ‘বরকধঝ কচতটপ’, কী করে বুঝলেন তা আমাকে বলেননি। অথচ কলকাতায় বসেই ওই জট ছাড়িয়ে হালদারমশাইকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন–তোমাকে চমকটা সময়মতো দিতে চেয়েছিলাম। সেই গোপন মিলিটারি রেকর্ডসংক্রান্ত বইয়ে পড়েছিলাম, ওই কথা দুটো রেঙ্গুনের ট্রেজারির সিন্দুক খোলার সূত্র। পড়তে পড়তে মাথায় এসে গেল, কথা দুটোর ‘বরকধঝ-কচতটপ’ হয়ে ওঠার চান্স আছে। কিন্তু ভেবে দেখ, নদীর জলে আছড়ে পড়া লাগেজ ভ্যান বা পার্শেল ভ্যান থেকে সিন্দুকটা খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া দরজা লক করা ছিল। জলের ভেতর ভ্যান কেটে বের করা : সে মুহূর্তে অসম্ভব। লেফটন্যান্ট কর্নেল টেডি স্যামসন কোর্টমাশালের সময় স্বীকার করেছিলেন, ব্রিজ থেকে এক মাইল দুরে ট্রেনের গতি মন্থর হয়েছিল। আধমাইল আসার পর ট্রেন থেমে যায়। তখন উনি এবং গার্ড নেমে গিয়ে দেখেন, লাইনের ওপর গাছের ডালপালা পড়ে আছে। ড্রাইভার দূর থেকে তা দেখতে পেয়েছিল। সে ভেবেছিল, ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গাছ ভেঙে পড়েছে লাইনের ওপর। তখনই সোলজারদের ডেকে সেগুলো সরানো হয়।…কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–অমরেশবাবুর বইয়ে লেখা আছে, ব্রিজের ওপর ফিসপ্লেট সরানোর জন্য সময় নিতে তাদেরই আরেকটা দল লাইনে ওই অবরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। এবার চিন্তা করে দেখ জয়ন্ত। গার্ডের লাগোয়া কামরার ভ্যানের মধ্যে ট্রেজারির সিন্দুক। এদিকে কিছুক্ষণের জন্য গার্ড বা টেডি স্যামসন সেখানে নেই। গার্ডের কামরায় সেন্ট্রী থাকলে সে-ও কৌতূহলবশে দেখতে যেতে পারে কী হয়েছে। সেই সুযোগে ভ্যানের লক ভেঙে সিন্দুক নামিয়ে নেওয়া কি অসম্ভব ছিল? অমরেশবাবুর বইয়ে ‘সেই ভ্যান অন্বেষণে ছুটিয়া’ কথাটা অসম্পূর্ণ। পরের পাতা নেই। আমার ধারণা, তখন ছুটে ওরা গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপর খবর পান সিন্দুক ইতিমধ্যে হস্তগত হয়েছে। ওই পাতাটা খুবই দরকার ছিল।

বললাম–আপনি বলছিলেন বরকধঝকচতটপ-এর সঙ্গে মন্দিরের সম্পর্ক আছে।

অমরেশবাবুর বইয়ে নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতর একটা মন্দিরের উল্লেখ আছে। ওটা ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। আজ সকালে নদীর ওপারে বটতলার কাছে যে পটায় আমি চেপেছিলাম ওটাই সেই মন্দির। হালদারমশাইকে বলেছি, শচীনবাবুকে ওখানে আজ রাত বারোটায় নিয়ে যাবেন। শচীনবাবু জানেন ওটাই ছিল তাদের আস্তানা। কাজেই তিনি দাঁও মারার জন্য খুব উদগ্রীব।

একটু চুপ করে থেকে বললাম–’ব্রেক দা জ’। জ মানে আপনি বলছিলেন সংকীর্ণ প্রবেশপথ বা দরজা। একটা সিন্দুকের আবার দরজা হয় নাকি? ডালা থাকে সিন্দুকের।

কর্নেল বললেন–আক্ষরিক বাংলা অর্থ ধরছ কেন? ইংরেজি ‘জ’র অর্থব্যঞ্জনা হলো অন্যরকম। সিন্দুকের ক্ষেত্রে ‘জ’ বলতে বোঝায় ওপরে ও নীচের জুড়ে থাকা একটা ছোট্ট অংশ। মানুষের মুখের ওপরকার এবং নীচের চোয়াল যেমন জুড়ে থাকে এবং হাঁ করলে খুলে যায়। জ’র আক্ষরিক অর্থ চোয়াল। এবার সিন্দুকের সেইরকম চোয়াল কল্পনা করো–যা ন্যারো এন্ট্রান্স’ও বলা চলে। বোঝা যাচ্ছে, এই সিন্দুকের ডালা অন্য ধরনের। জ ভাঙার পর ‘টপ’ ধরতে হবে। বড়জোর বলা যায়, ‘টপ’ ধরলে সিন্দুকটা পুরো ভোলা যাবে। টপ জিনিসটা কী, এখনও অবশ্য জানি না।

এই সময় বাঁদিকে জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ির আলো দেখা গেল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–এসো, ঘরে ঢুকে পড়ি। সেনসায়েব আসছেন মনে হচ্ছে।

ঘরে ঢুকে ঠাণ্ডায় আরাম পেলাম। এয়ারকন্ডিশনার চালু ছিল। কর্নেল বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। আমি ঘামে ভেজা পোশাক বদলে নিলাম।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে। বললেন–চমৎকার ডেভলাপ হয়েছে। দেখা যাক প্রিন্টগুলো কেমন হয়। পোর্টেবল ফটো ওয়াশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সরঞ্জাম সঙ্গে থাকলে কত সুবিধে হয়। পেপালারয়েড ক্যামেরা বেরিয়েছে আজকাল। সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট বেরিয়ে আসে। কিন্তু ছবি শিগগির নষ্ট হয়ে যায়।

বললাম–সত্যি সেনসায়েবের গাড়ি এল কিনা বেরিয়ে দেখব নাকি?

নাহ। ওঁর মুড খারাপ। চুপচাপ বসে থাকো। বরং বিছানায় লম্বা হও। খুব ঘোরাঘুরি হয়েছে। বিশ্রাম করে তৈরি হয়ে নাও। আজ রাতদুপুরে সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চার……

.

রাত এগারোটা নাগাদ আমাদের ঘরের দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল গিয়ে দরজা খুললেন। ভোলার সাড়া পেলাম। গতরাতে বনরক্ষী কাশেমের সঙ্গে ভোলার গোপন সম্পর্ক আঁচ করার ফলে ভোলাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই কর্নেলের বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও বেরিয়ে গেলাম।

ভোলা চাপাস্বরে বলছিল–কিছুক্ষণ আগে সেনসায়েব নদীর ঘাটের দিকের গেট খুলে দিতে বললেন। ওনার সঙ্গে কাশেম ছিল। দুজনে চলে যাওয়ার পর মেমসায়েব এসেছেন।

কর্নেল পাশের ঘরের দরজার দিকে এগোচ্ছেন, দরজা খুলে নীতা বেরুল। ওর হাতে একটা স্যুটকেস। কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। কর্নেল বললেন–তোমার জিনিসপত্র নিতে এসেছ। হুঁ আমি জানতাম তুমি আসবে। তাই ভোলাকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলাম। তোমার চণ্ডীকাকা কোথায়?

নীতা ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। নতমুখে বলল রাস্তায় অপেক্ষা করছেন।

কর্নেল হাসলেন।–আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাত্রে সেনসায়েব বেরুবেন, তোমার চণ্ডীকাকা জানতেন।

–আমি চলি।

–এক মিনিট। অমরেশ রায়ের লেখা বইটা তুমি আমাকে দিয়ে যাও। আমি জানি, সেনসায়েবের কাছে বইটা ছিল। তোমার চণ্ডীকাকা সেই বইটা খুঁজে নিয়ে যেতে বলেছেন। তুমি সেটাও নিয়ে যাচ্ছ।

নীতা ফুঁসে উঠল।–বইটা চণ্ডীকাকারই। কাকা বলেছেন। বইটার পাতায় নাকি কাকার নামও লেখা আছে।

না। চণ্ডীবাবুই টাকার লোভে বইটা তোমার বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে সেনসায়েবকে দিয়েছিলেন। কর্নেল এক পা এগিয়ে ফের বললেন–এতদিনে চণ্ডীবাবু আঁচ করেছেন বইয়ে কী আছে। কিন্তু বইটা না দিয়ে গেলে তোমার যাওয়া হবে না, নীতা! তোমার ভালর জন্য বলছি। সিন ক্রিয়েট কোরো না। তোমার চণ্ডীকাকা একটা সাংঘাতিক রিস্ক নিচ্ছেন। ওঁকে সাবধান করে দিও।

নীতা একটু ইতস্তত করে কাঁধে ঝোলানো তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা বই বের করল। কর্নেলের পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর হনহন করে নেমে গেল লনে। একটু পরে তাকে ছায়ার আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখলাম।

কর্নেল বইটা কুড়িয়ে নিলেন। বইটা বাঁধানো। কিন্তু জরাজীর্ণ বাঁধাই। ভোলা বলে উঠল–ওই যাঃ! চাবি দিয়ে গেলেন না মেমসায়েব।

কর্নেল বললেন–ওই দেখ, রুমালের গিটে বাঁধা চাবি ঝুলছে লকে। হকচকিয়ে গিয়ে রুমালটাও ফেলে গেল নীতা। জয়ন্ত, রুমালটা তুমি রাখো। ফেরার সময় সুযোগ পেলে উপহার দিয়ে যাবে নীতাকে। ভোলা! তোমার ছুটি। গিয়ে শুয়ে পড়ো।

কর্নেল হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। ভোলা চাবিটা খুলে সত্যি সত্যি রুমালটা আমাকে দিতে এল। বললাম–তুমি রাখো!

ভোলা মুচকি হেসে বলল-রুমের ডুবলিকেট চাবি আমাদের কাছেই থাকে স্যার! কিন্তু সেনসায়েব কাল রাত্তিরে সেটাও চেয়ে নিয়েছিলেন। মেমসায়েবের কাছে নাকি একটা চাবি থাকা দরকার। ওনার কথা অমান্য করতে পারি? তবে ব্যাপারটা কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল দরজার ফাঁকে মুখ বের করে বললেন–ভোলা! শুয়ে পড়ো গে। জয়ন্ত! চলে এসো। রুমালটা কৈ? রুমালটা নিয়ে এসো জয়ন্ত!

অগত্যা রুমালটা ভোলার কাছ থেকে নিতে হলো। ভোলা চলে গেল বাংলোর পিছনে তার কোয়াটারের দিকে। ঘরে ঢুকে দেখি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী বইটা খুলে ঝুঁকে পড়েছেন। বললেন–হ্যারানো ১৩৩-১৩৪ পাতা এই বইয়ে বহাল তবিয়তে আছে। তবে হাতে সময় কম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেরুতে হবে।

–কী আছে ওই দুটো পাতায়?

সংক্ষেপে বলছি। কর্নেল বইটা ওর কিটব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখে বললেন–অমরেশবাবুরা জলে নামতে যাচ্ছিলেন, সেইসময় দেবীপ্রসাদ এসে ওদের খবর দেন, সিন্দুক হস্তগত হয়েছে। একজন গোরা সেন্ট্রি গার্ডের কামরায় ছিল। সে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরাশায়ী করেছেন ওঁরা। তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে। গার্ডের কামরায় টেডি স্যামসনের ফোলিও ব্যাগের সন্ধান পান। ব্যাগে চাবি ছিল। ভ্যান খুলে ছোট্ট সিন্দুকটা খুঁজে বের করতে সময় লাগেনি। সিন্দুক নিয়ে বিপ্লবীরা জঙ্গলে ঢোকেন। দেবীপ্রসাদ সেন্ট্রির পিঠে তখনও বসে আছেন। হাতে ছুরি। তাকে উনি তখনও জেরা করছেন, সিন্দুকের চাবি ভ্যানের চাবির সঙ্গে আছে কিনা! সেন্ট্রি বারবার বলছে, বরকধঝ-কচতটপ। দেবীবাবু বরাবর ওইরকম গোঁয়ার এবং অপ্রকৃতিস্থচিত্ত মানুষ ছিলেন। পরিতোষ লাহিড়ি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে দৌড়ে এসে দেবীপ্রসাদকে টেনে নিয়ে যান। যাবার আগে দেবীপ্রসাদ সেন্ট্রিকে খুন করেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, টেডি স্যামসন কিন্তু কোর্টমাশালের সময় সেন্ট্রির হত্যাকাণ্ড বেমালুম চেপে যান। সম্ভবত নিজেকে শাস্তি থেকে বাঁচাতেই। কারণ ওঁর গার্ডের কামরা ছেড়ে ছুটে যাওয়া উচিত ছিল না। যাই হোক, অমরেশের তথ্য অনুসারে গার্ড ছিলেন বাঙালি এবং তিনিই ছিলেন বিপ্লবীদের ইনফরমার।

–সিন্দুক সম্পর্কে আর কী লিখেছেন অমরেশবাবু?

ইস্পাতের চাদরে মোড়া সিন্দুক অনেক চেষ্টা করেও খোলা যায়নি। তখন ওটা মন্দিরের কাছে পুঁতে রাখা হয়। পরদিন তো এলাকা জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় এবং মিলিটারি নামিয়ে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়। সবাই নানা জায়গায় ধরা পড়েন। এদিকে পরদিন থেকে মৌরী নদীতে প্রবল বন্যা। যাই হোক, বহু বছর পরে জেল থেকে বেরিয়ে আর কেউ জায়গাটি খুঁজে বের করতে পারেননি। কারণ বছরের পর বছর বন্যা হয়েছে। জঙ্গল ঘন হয়েছে। ভাঙা মন্দির আরও ভেঙে বন্যার স্রোতে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। এবার অমরেশের বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশটা বলি। একদিন পরিতোষ ওঁকে বলেন, সেন্ট্রির কথাটা বরকধঝ কচতটপ নয়। সম্ভবত Break the Jaw, Catch the Top! কিন্তু বহুবার গিয়ে গোপনে খোঁড়াখুঁড়ি করে সিন্দুক খুঁজে পাননি ওঁরা। শেষবার গিয়েছিলেন গভীর রাতে। দুজনে একটা জায়গা পালাক্রমে খুঁড়ছেন। হঠাৎ সেখানে হাজির হন তাদের এক সহযোদ্ধা। তাঁর হাতে বন্দুক ছিল। গুলি ছুঁড়ে তাড়া করেন দুজনকে। অমরেশ চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু বইয়ে তার নাম লেখেননি। এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই সহযোদ্ধার নাম শচীন মজুমদার। চলো! এবার বেরুনো যাক…

বাংলোর দক্ষিণের সদর গেট দিয়ে আমরা বেরুলাম। ততক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে মোড় নিলেন কর্নেল। একটু পরে নদীর ধারে পৌঁছলাম। এখানে বালির চড়া সমতল। তাই জলটা ছড়িয়ে গেছে। জুতোর তলা। ভেজানো ঝিরঝিরে স্রোত মাত্র। ওপারে গিয়ে ঝোপঝাড় ঠেলে কর্নেল গুঁড়ি মেরে এগোলেন। ওঁকে অনুসরণ করছিলাম। হঠাৎ কানে এল, সামনে কোথাও কারা। কথা বলছে।

আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হালদারমশাইয়ের কণ্ঠস্বর কানে এল।Break the Jaw. Catch the Top! বরকধঝ-কচতটপ।

কেউ বলল–সাট আপ! জায়গাটা দেখাও। নইলে দেখছ তো হাতে কী আছে?

–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।

–অ্যাই ব্যাটা! শুধু জায়গাটা দেখিয়ে দে। ছাড়া পাবি। নইলে পাগলামি ঘুচিয়ে দেব।

–দেবীদা জানে……দেবীদা জানে….দেবীদা জানে…

–তবে যে বলছিলি তুই জানিস?

–আমিও চিনি…আমিও চিনি…আমিও চিনি…

–চুপ! চিনিয়ে দে এক্ষুণি।

–খি খি খি! আগে সরপুরিয়া খাওয়াও! সরপুরিয়া খাব। চাঁদের আলোয় বসে খাব। সিন্দুকের পিঠে বসে খাব। খি খি খি। সরপুরিয়া খেতে ভাল। চাঁদের আলো দেখতে ভাল।

ঠিক আছে। ফিরে গিয়ে খাওয়াব। আগে সিন্দুক বের করি। তবে তো।

ততক্ষণে আমরা আরও এগিয়ে গেছি। সেই ভাঙা মন্দিরের স্কুপের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় ‘পাগল’ হালদারমশাই নাচানাচি করছেন। তার সামনে একজন তাগড়াই চেহারার লোক। পরনে প্যান্টশার্ট। একহাতে টর্চ আছে। জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে টর্চটা। অন্য হাতে সম্ভবত কোনও অস্ত্র। সেটা হালদারমশাইয়ের দিকে বারবার তাক করছে সে। হালদারমশাই নির্বিকার নৃত্য করছেন। দৃশ্যটা হাস্যকর বটে, কিন্তু ভয়ঙ্করও।

–এই শেষবার বলছি। দশ গোনার মধ্যে চিনিয়ে না দিলে জবাই করে ফেলব। রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…ফোর..ফাইভ…

হালদারমশাই মাটিতে পা ঠুকে বললেন-হেইখানে…হেইখানে…হেইখানে। দেবীদা কইছিল হেইখানে।

লোকটা হাসল–যাচ্চলে! তুই কোন জেলার লোক রে? বরিশালে জন্ম নাকি?

–হঃ! দেবীদা কইছিল হেইখানে। Break the Jaw. Catch the Top! বরকধঝ-কচতটপ।

–ঠিক আছে। এখানে যদি পোঁতা না থাকে, বুঝতে পারছিস কী হবে?

–হঃ কতা! বুঝছি।

–চল্। ফেরা যাক।

সরপুরিয়া খাওয়াইবেন কতা!

 খাওয়াব চল।

হঠাৎ স্তূপের কাছ থেকে একটা ছায়ামূর্তি গুঁড়ি মেরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। তার হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল। হালদারমশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর গর্জে উঠলেন–তবে রে হালার পো! ঘুঘু দেহিছ, ফান্দ দ্যাহো নাই।

হালদারমশাই দুহাতে দ্বিতীয় লোকটাকে জাপটে ধরলেন। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। আমি উসখুস করছিলাম। কর্নেল চিমটি কেটে চুপ করে থাকতে ইসারা করলেন। প্রথম লোকটা টর্চ কুড়িয়ে নিতে ঝুঁকেছে, কাছাকাছি একটা গাছের আড়াল থেকে আরেকটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। প্রথম লোকটা টের পেয়েই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল–কে?

–ইউ ট্রেচারার্স! আমাকে বসিয়ে রেখে তুমি স্পটে চলে এসেছ? তবে মরো!

সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল টর্চ জ্বেলে চিৎকার করে বললেন–তার আগে তোমার খুলি উড়ে যাবে। ফায়ারআর্মসটা ফেলে দাও বলছি।

তারপর এদিক-ওদিক থেকে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল। আশ-পাশের গাছ থেকে ধুপধাপ শব্দে কারা নামল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন–হালদারমশাই! কাশেমকে পুলিশের জিম্মায় দিয়ে উঠে পড়ুন।

–হঃ। বলে উঠে দাঁড়ালেন হালদারমশাই।

দেখলাম, পুলিশের অফিসার ইনচার্জ রমেন পালিত এগিয়ে গিয়ে একটা ফায়ারআর্মস কুড়িয়ে নিলেন। বললেন–সুকমল সেন! আপনাকে দুটো মার্ডার এবং একটা অ্যাটেম্পট ফর মার্ডারের চার্জে অ্যারেস্ট করা হলো। তাছাড়া আপনার নামে এই রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কাঠপাচারের সঙ্গে ইনভলভড় থাকার জন্যও অনেক অভিযোগ আছে। আর শচীনবাবু! দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্তের উপর অত্যাচার এবং ষড়যন্ত্রমূলক কাজের জন্য আপনার নামেও অভিযোগ আছে। দুঃখিত আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।

শচীনবাবু বললেন–ভুল করবেন না মিঃ পালিত। আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।

–আছে। দেবীবাবুর মেয়ে নীতাদেবী আজ থানায় গিয়ে আপনার নামে অভিযোগ করে এসেছেন। দেবীবাবুর ওপর আপনি যথেষ্ট অত্যাচার করেছেন। কলকাতা-পুলিশও আমাদের মেসেজ পাঠিয়েছে।

শচীনবাবু হুমকি দিলেন–প্রতাপকে জানালে আপনার বিপদ হবে মিঃ পালিত।

কর্নেল বললেন–হয়তো প্রতাপবাবু খুশিই হবেন এতে। তিনি স্থানীয় এম এল এ এবং মন্ত্রী। আপনাদের কাজকর্মে তার পলিটিক্যাল ইমেজ নষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। চিন্তা করে দেখুন শচীনবাবু! একসময় আপনিই কাঠপাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তারপর সুকমল সেনের সঙ্গে আপনার রফা হয়েছিল। কিসের রফা তাও বলছি। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনে লুঠকরা রেঙ্গুন ট্রেজারির সিন্দুকের খোঁজ দিতে চেয়েছিলেন এই সুকমল সেন। দেবীবাবুর জামাই হয়েছেন সেনসায়েব। অতএব আপনার পক্ষে ওঁর ফাঁদে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেনসায়েবও জানেন না কোথায় সেটা পোঁতা আছে। তবে কাঠপাচারের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের জড়িত থাকার আসল কারণ এই জঙ্গলে রাখা সিন্দুক অনুসন্ধান। ইতিমধ্যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইকে পাগল সাজিয়ে এখানে পাঠিয়ে আমি অমরেশ রায় এবং পরিতোষ লাহিড়ির হত্যারহস্যের সূত্র খুঁজতে চেয়েছিলাম। দৈবাৎ নীতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। তখন জানলাম, আসল খুনী কে। পাগল শ্বশুরকে টোপ করেছিলেন জামাই। কিন্তু নিছক সন্দেহের বশে অত্যন্ত অকারণ দু-দুটো নরহত্যা করে ফেললেন এই জামাই ভদ্রলোক। মিঃ সেন! অমরেশবাবু বা পরিতোষবাবু কেন, কেউই জানতেন না কোথায় সিন্দুক পোঁতা আছে।

সেনসায়েব বাঁকা হাসলেন।–আপনি জানেন তাহলে।

-হ্যাঁ। জেনেছি। আজ সকালেই আবিষ্কার করেছি। মিঃ পালিত! আসামীদের থানায় নিয়ে যান।…

বাংলোয় ফিরে হালদারমশাই দুঃখিতভাবে বললেন–অহম্ ড্রেস চেঞ্জ করব ক্যামনে? পূর্ণিমা হোটেলে আমার ড্রেস আছে। আনবে কেডা?

কর্নেল হাসলেন।–আপাতত জয়ন্তের পাঞ্জাবি-পাজামা পেয়ে যাবেন। স্নান করেও নিতে পারেন। বাথরুমে যান। ধুলোময়লায় নোংরা হয়ে আছেন।

হালদারমশাই বললেন–হঃ। ঠিক কইছেন। গা ঘিনঘিন করতাছে।

উনি বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। বললাম–সব বোঝা গেল। কিন্তু বিলুকে খুন করতে গিয়েছিল কে?

কর্নেল বললেন–আমার কথাটা ভুলে গেছ ডার্লিং। বলেছিলাম সেই খুনির আসল টার্গেট নীতাও হতে পারে। হা–নীতাই বটে। তবে নীতাকে মেরে সে নিশ্চয় বিলুকেও রেহাই দিত না। বিলু গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পেত বলে মনে হয় না। দুজনকেই মরতে হতো।

–কিন্তু লোকটা কে?

 কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে দিলেন। বললেন–লোকটাকে কিছুক্ষণ আগে টর্চের আলোয় দেখেছ। এবার দেখ তো, চিনতে পারো কি না?

ছবিটা দেখেই বললাম–ফরেস্টগার্ড কাশেম না?

-হ্যাঁ। সেনসায়েবের চেনা কাশেম। সেনসায়েব এবার নীতাকে নিয়ে এসে খতম করতে চেয়েছিলেন। কারণ নীতা তার অনেক অপরাধের সাক্ষী। বিশেষ করে অমরেশ এবং পরিতোষকে হুমকি দেওয়া চিঠিগুলো নীতার হাতের লেখা। নীতাকে চিঠি লিখতে বাধ্য করতেন সুকমল সেন। অমরেশবাবুর স্ত্রীকে লেখা চিঠির হস্তাক্ষর এবং আমাকে আজ লিখে-যাওয়া চিঠির হস্তাক্ষর হুবহু এক।

চমকে উঠে বললাম-তা-ই বটে। চিঠির হস্তাক্ষর দেখে চেনা লাগছিল।

কর্নেল কিটব্যাগের চেন খুলে বললেন–তুমি তো জানো, আমার বাড়িতে জেরক্স মেশিন আছে। নন্দিনীর দিয়ে-যাওয়া ইনল্যান্ড লেটারের জেরক্স কপির সঙ্গে বাথরুমে রেখে যাওয়া নীতার চিঠির হস্তাক্ষর মিলিয়ে দেখ।

কর্নেল চিঠি দুটো বের করে দিলেন। মিলিয়ে দেখে বললাম–হ্যাঁ। একই হস্তাক্ষর।

হালদারমশাই বাথরুম থেকে উঁকি দিয়ে বললেন–জয়ন্তবাবু! পাজামা পাঞ্জাবি!

কিছুক্ষণ পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ সেজেগুজে বেরুলেন। কর্নেল বললেন ভোলাকে ডেকে আনো জয়ন্ত! হালদারমশাইয়ের শোবার ব্যবস্থা করা দরকার। ডিনারের ব্যবস্থা করা যাবে না। তবে ভোলার ভাঁড়ারে পাঁউরুটি সন্দেশ মিলতেও পারে।

হালদারমশাই জোরে হাত নেড়ে বললেন–নাহ্। যাই গিয়া।

–সে কী। এত রাত্রে কোথায় যাবেন?

–পুর্ণিমা হোটেলে। ওনারের লগে মামা-ভাগনা সম্বন্ধ করছি। ভাগ্না চিন্তায় আছে।

–কিন্তু এখন কি ওখানে মিলের ব্যবস্থা হবে?

 হালদারমশাই সহাস্যে বললেন–শচীনবাবু জামাই আদরে ডিনার সার্ভ করছেন। খিচুড়ি, ডিমসেদ্ধ, পাঁপড়ভাজা, চাটনি। যাই গিয়া! মর্নিংয়ে আসব।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে বেরিয়ে গেলেন!…

ভোরে কর্নেলের তাড়ায় ঘুম থেকে উঠতে হলো। ভোলা আমার জন্য বেড টি এবং কর্নেলের জন্য কফি দিয়ে গেল। তারপর কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরুলেন। গ্রীষ্মের প্রত্যূষে বনভূমির অপার্থিব সৌন্দর্য আছে। এই প্রথম সেই সৌন্দর্য দেখলাম। সদ্য ঘুম ভেঙে পাখিরা ডাকাডাকি করছে। গাছপালার মধ্যে যেন জেগে ওঠার স্পন্দন। হালকা বাতাসে অজানা ফুলের সৌরভ! সেই স্কুপের মাথায় উঠে কর্নেল বললেন–দেখে যাও!

ঝোপঝাড় ঠেলে ওঁর কাছে গিয়ে দেখি, কর্নেল নুয়ে-পড়া ঝোপ-লতাপাতা সরাচ্ছেন। একহাত চওড়া একটা ফাটলের ভেতর অন্ধকার ছমছম করছে। কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। গভীর ফাটলের তলায় কী একটা কালো জিনিসের কোণের অংশ দেখা যাচ্ছে। বাকিটা মাটির ভেতর ঢাকা পড়েছে। বললাম–ওটাই কি সেই সিন্দুক?

কর্নেল বললেন–সিন্দুকের একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ওটা আইনত সরকারি সম্পত্তি। ওটার হদিস পুলিশকে এবার দেওয়া দরকার। এক মিনিট!

বলে কর্নেল স্তূপের মাথা থেকে কয়েকটা চাঙড় ফাটলে গড়িয়ে ফেললেন। ঢাকা পড়ল গুপ্তধন। তারপর ঝোপ-লতাপাতাগুলো আগের মতোই টেনে ফাটলটা ঢেকে দিলেন।

বাংলোয় ফিরে এসে কর্নেল বললেন–নীতার সেই রুমালটা সঙ্গে নাও ডার্লিং!

–ভ্যাট! কী যে বলেন?

–বা রে! রুমালটা ওকে ফেরত দিতে হবে না? এই বৃদ্ধের হাতে কোনও যুবতীর রুমাল শোভা পায় না! চলো! ফেরার পথে হালদারমশাইকে পূর্ণিমা হোটেল থেকে নিয়ে আসব। সাড়ে দশটার ট্রেনে কলকাতা ফিরব একসঙ্গে।

নাক বরাবর জঙ্গলের ভেতর হেঁটে স্টেশন রোডে পৌঁছুলাম। বললাম– সেনসায়েব নীতাকে খুনের জন্য কাশেমকে পাঠিয়েছিলেন! পুলিশকে এটা বলবেন না? এটা ওঁর সেকেন্ড মাডার-অ্যাটেম্পট।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ছবিটা তো নিয়ে যাচ্ছি সেজন্যই।

একটা খালি রিকশা দাঁড় করিয়ে আমরা উঠে বসলাম। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। একখানে হঠাৎ বললেন–রোখো! রোখো!

সাইকেল-রিকশা থেমে গেল। কর্নেল চোখ টিপে হেসে বললেন–সকালের আলোয় যুবক-যুবতীদের নিভৃত প্রেমালাপ এই কদর্য পৃথিবীকে স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপহার দেয়, ডার্লিং! ওই দেখ। উঁহু, ওদিকে নয়। পার্কের দিকে তাকাও।

পাশেই একটা পার্ক। কোনার দিকে বেঞ্চে ফুলের ঝোপের আড়ালে দুটিতে বসে আছে। পাশে দাঁড় করানো মোটর সাইকেল। বললাম–কী আশ্চর্য!

–নাহ্। এটাই স্বাভাবিক! যৌবন যৌবনকে এমনি করে টানে। তবে দার্শনিকরা বলেছেন, প্রেম এসে মানুষের ভেতরকার হিংস্র পশুকে তাড়িয়ে দেয়–প্রেম এত শক্তিমান!

–কিন্তু নীতা তো পরস্ত্রী!

–হুঁ। আপাতত পরকীয়া প্রেম বলা চলে। তবে সরকার ডিভোর্স আইন চালু করেছেন। কাজেই ডার্লিং! তোমার চিন্তার কারণ নেই। যাও, রুমাল ফেরত দিয়ে এসো।

কী বলছেন? ওই মস্তানটার কাছে আমি যাব?

–হ্যাঁ। বিলু মস্তান-টস্তান বটে। তবে আশা করি, নীতা ওকে জব্দ করতে পারবে। মেয়েরা এটা পারে, জয়ন্ত! যাও! রুমালটা দিয়ে এসো।

নাহ। আপনি যান।

 কর্নেল রিকশাওলাকে বললেন–এক মিনিট। আসছি।

বলে বৃদ্ধ রহস্যভেদী আমার হাত থেকে রুমাল নিয়ে পার্কে ঢুকে পড়লেন। রিকশাওলা অবাক হয়ে বলল–কী হলো স্যার? বুড়োসায়েব কোথায় যাচ্ছেন? আমার যে লেট হয়ে যাচ্ছে।

বললাম–ভেবো না। বুড়োসায়েব পুষিয়ে দেবেন। তবে উনি কার কাছে যাচ্ছেন জানো তো? শচীনবাবুর ছেলে বিলুবাবুর কাছে। চেনো না বিলুবাবুকে?

রিকশাওলা অমনি ভড়কে গিয়ে শুধু উচ্চারণ করল–অ।

–অ নয়। বরকধঝ কচতটপ।

 আজ্ঞে?

হাসতে হাসতে বললাম–কিছু না।…