দু’নম্বর চাবি – ২

০২.

 সেদিন সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে পুলিশ সূত্রে পাওয়া একটা খবর লিখছি, সেই সময় কর্নেলের ফোন এল। জয়ন্ত! তুমি কি ব্যস্ত?

বললুম, তত কিছু ব্যস্ত নই। খবর বলুন?

কর্নেলের হাসি ভেসে এল। তোমার লেখার মতো খবর নয়। হালদারমশাই কিছুক্ষণ আগে ফোনে বললেন, মেমসায়েব তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।

তারপর?

তারপর আর কিছু জানি না। তবে আমাদের আজ রাত দশটা পনেরোর ট্রেনে রওনা হতে হবে। টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। অতএব তুমি এখনই সল্টলেকে তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে তৈরি হয়ে এসো।

আমি কিন্তু তৈরি হয়েই এসেছি কর্নেল! শুধু গাড়িটা রাখার প্রবলেম।

নো প্রবলেম। আমার গ্যারাজটা তো খালি। আমার ল্যান্ডরোভার গাড়িটা বেচে দিয়ে নতুন গাড়ি কেনা হয়ে উঠল না। তো যে ভদ্রলোককে গ্যারাজে গাড়ি রাখতে দিয়েছিলুম, তিনি অন্যত্র বাড়ি করে চলে গেছেন। কাজেই হা! তুমি যত শিগগির পারো চলে এসো। ছাড়লুম।…

সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়লুম। চিফ অব দি নিউজ ব্যুরো সত্যদাকে আভাস। দিয়ে এলুম, কর্নেলের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে বেরচ্ছি। সত্যদা খুশি হয়ে বললেন, বড় মাছ ধরলে ডাবল ইনক্রিমেন্ট। পুঁটিমাছ হইলে ইনক্রিমেন্ট স্টপ। আমি যা কইলাম বুড়ারে কইয়ো।

রাস্তায় জ্যাম ছিল। নভেম্বরের সন্ধ্যা। কলকাতায় শীত পড়েনি। আবহাওয়া মনোরম। ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে পয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল। অথচ অফিস থেকে হেঁটে গেলে কুড়ি মিনিটের বেশি লাগে না।

ব্যাগেজ কাঁধে লটকে ড্রয়িং রুমে ঢুকলুম। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে ব্যাগেজের ভারে হাঁপিয়ে উঠেছিলুম। দেখলুম, হালদারমশাই এসে গেছেন। হাতমুখ নেড়ে কথা বলছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হেভি মিস্ট্রি জয়ন্তবাবু!

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাগে অত সব কী নিয়েছ?

বললুম, তেমন কিছু না। তবে খানকতক বই নিয়েছি। বইগুলোর ওজন এত হবে, বুঝতে পারিনি।

বই? বই কী হবে?

পড়ব। কারণ আপনি পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের পেছনে ছুটে বেড়াবেন, এ তো জানা কথা। তখন বই পড়ে সময় কাটাব।

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, বইগুলো রেখে যাও। এটা না ভ্রমণ নয়, জয়ন্ত! তোমার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মসটা নিয়েছ তো?

 তা অবশ্য নিয়েছি।

তা-ই যথেষ্ট। বলে কর্নেল হালদারমশাইয়ের দিকে ঘুরলেন। তাহলে লোকটা আপনাকে লিটার্যালি ল্যাং মেরে পালিয়ে গেল?

হঃ। বলে হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিলেন। জায়গাটা স্লিপারি। জুতো স্লিপ না করলে পড়তাম না। হালার চুল না ধইরা জামার কলার ধরা উচিত ছিল। হালা যে পরচুলা পরছে, বুঝি নাই।

হালদারমশাই তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ঝাকড় মাকড় পরচুলা বের করে দেখালেন।

বললুম, কেসটা কী হালদারমশাই?

পরে আমার মুখে শুনে নিও। হালদারমশাই! আপনি তা হলে আর দেরি না করে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আবার দেখা করুন। তারপর যা করার তা আপনাকে বলেছি। হ্যাঁ, পরচুলাটা দিয়ে যান।

হঃ। যাই গিয়া। বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ পরচুলাটা দিয়ে সবেগে প্রস্থান করলেন।

ষষ্ঠীচরণ আমার জন্য কফি আনল। কর্নেল তাকে বললেন, ন’টায় ডিনার খেয়ে আমরা বেরুব। রিস্ক নেব না। বাবুঘাটে লঞ্চে চেপে হাওড়া স্টেশনে যাব। ব্রিজে জ্যাম হতে পারে।

কফি খেতে খেতে বললুম, হালদারমশাই কার কাছে ল্যাং খেয়ে পরচুলা পেলেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, নিউসন দম্পতি শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে আছে। হালদারমশাইকে সন্ধ্যা ছ’টায় ডেকেছিল মিসেস নিউসন। সেখানে গেলে মিসেস নিউসন ঘর থেকে বেরিয়ে নিচের একটা গলিতে হালদারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আসে।

ঘরে কথা না বলে রাস্তায় কেন?

জানি না। তো গলিতে ওঁরা যেই নেমেছেন, একটা লোক আচমকা মিসেস নিউসনের গলার মিহি চেন ধরে ফেলে। চেনে একটা লকেট আছে। হলদারমশাই ছিনতাইকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। লোকটা তার পায়ে লাথি মারে। উনি আছাড় খান। তবে চুলটা ছাড়েননি। লোকটা তক্ষুণি পালিয়ে যায়। চুলটা হালদারমশাইয়ের হাতে থেকে যায়। সেটা তো দেখলে!

তারপর?

হালদারমশাই লক্ষ্য করেন, মিসেস নিউসন চেনের লকেটটা মুঠোয় চেপে ধরে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হালদারমশাই তাকে অনুসরণ করেন। তখন সে বলে, আপনি ঘণ্টা দুই পরে এসে দেখা করবেন।

ঘণ্টা দুই পরে কেন?

খুঁজে পেয়ে বললুম, তাকটার মাথায়

তা জানি না। হালদারমশাই ওখানে ঘণ্টা দুই সময় কাটাতে পারতেন। তা না করে তিনি আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন। কেন জানেন? পরচুলাটা দেখাতে। অদ্ভুত মানুষ! ওখান থেকে ফোন করে জানাতে পারতেন। তবে আপাতদৃষ্টে পরচুলাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার।

বলে কর্নেল তার ভেতরটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আতস কাঁচ দিয়ে দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, হ্যাঁ। গুরুত্বপূর্ণ। হালদারমশাই এটা এনে ভুল করেননি দেখছি। আসলে তখন উনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ওঁকে জানিয়েছিলুম সাড়ে ন’টায় আমি বেরোচ্ছি। তাই উনি রিস্ক নেননি। ছুটে এসেছিলেন।

কী আছে ওটার ভেতর?

একটু লাল ছোপ। লোকটার মাথায় হয়তো ঘা বা ফোঁড়া আছে।

হতাশ হয়ে বললুম, তা হলে ওটা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসুদ্ধু লোকের মাথা খুঁজে বেড়াতে হবে, কার মাথায় ঘা বা ফোঁড়া আছে।

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না! মুখের চুরুট নিভে গিয়েছিল। টেবিলে অ্যাসট্রেতে রেখে পরচুলাটা খবরের কাগজ ছিঁড়ে একটা মোড়ক বানালেন। তারপর বললেন, আমি তৈরি হয়ে নিই।

কর্নেল ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন বাজল। ফোন তুলে সাড়া দিতে গিয়ে মনে পড়ল, কর্নেলের বেডরুমে এটার এক্সটেনশন লাইন আছে। তারপরই হালদারমশাই এবং কর্নেল দু’জনের কথাবার্তা আমার কানে এল। ফোন। রেখে দিলুম না। শোনা যাক না ব্যাপারটা।

কর্নেল স্যার! হালদার কইতাছি।

পাবলিক বুথ থেকে মনে হচ্ছে হালদারমশাই?

ঠিক ধরছেন। মেমসায়েব আবার ভ্যানিশড।

হোটেল থেকে চলে গেছেন?

 হ্যাঁ। কী ফালতু ঝামেলায় পড়া গেল। কী করি কন তো?

হয়তো ভয় পেয়ে মেমসায়েব আবার কোথাও গিয়ে উঠেছে। আপনার কার্ডে বড়ির নাম্বার তো আছে। আপনি বাড়ি চলে যান। আমার ধারণা মেমসায়েব আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ছাড়ি?

গোয়েন্দামশাইয়ের আর কোনও সাড়া এল না। টেলিফোন রেখে দিলুম। একটু পরে কর্নেল পদার ফাঁকে উঁকি মেরে চোখ কটমটিয়ে বললেন, আড়িপাতা ব্যাড হ্যাবিট।

হেসে ফেললুম! আড়ি পেতে একটু মজা পেলুম বস্! হালদারমশাই জীবনে বোধহয় এমন মক্কেলের পাল্লায় পড়েননি।

কর্নেলও হেসে ফেললেন। এত ওঁকে বলি, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখুন। উনি বলেন, আমি একাই একশো। এখন দেখো, যদি ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকত তাকে উনি শেয়ালদার ওই হোটেলে রেখে আসতে পারতেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেমসায়েবকে ফলো করত। নাহ। আর দেরি করা ঠিক নয়।

রাত সাড়ে ন’টায় বেরিয়েছিলুম দু’জনে। কর্নেলের নির্দেশে বইগুলো রেখে আসায় আমার ব্যাগেজ হালকা হয়েছিল। কর্নেলের গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। পিঠেআটা কিট ব্যাগ। তার চেনের ফাঁকে প্রজাপতি ধরা নেটের হ্যাঁন্ডেল ছাতার বাঁটের মতো বেরিয়ে আছে। মাথায় যথারীতি টুপি পরেছেন। গায়ে জ্যাকেট চড়িয়েছেন। আমাকেও শীতের পোশাক পরতে হয়েছিল। বিজয়গড় এলাকায় নাকি এখনই প্রচণ্ড শীত। কর্নেলের হাতে আর একটা ব্যাগ দেখে বুঝতে পেরেছিলুম, ওতে জঙ্গলে যাবার পোশাক-আশাক তো আছেই, উপরন্তু ওঁর ফটোপ্রিন্টের সরঞ্জামও আছে। একটা বাথরুমকে সর্বত্র উনি ডার্করুমে পরিণত করে ফেলেন। ট্রেন ছেড়েছিল ঠিক দশটা পনেরো মিনিটে। ফার্স্ট ক্লাসে রিজার্ভড কুপে দুটো বার্থ ওপরে-নীচে। নীচে কর্নেল। ওপরে আমি। উল্টোদিকে এক মারোয়াড়ি দম্পতি। কর্নেল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা চিত্তরঞ্জন স্টেশনে নামব। অণ্ডাল হয়ে যেতে ট্রেন বদলানোর ঝামেলা আছে। দিল্লিগামী মেল ট্রেন। তাই মধ্যে মাত্র দুটো স্টপ। বর্ধমান আর আসানসোল। তারপরের স্টপ চিত্তরঞ্জন। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছনোর কথা।

ট্রেন জার্নিতে আমার ঘুম হয় না। বার তিনেক বাথরুমে গিয়েছিলুম। একবার বাথরুম থেকে এক যুবতী মেমসায়েবকে দেখে চমকে উঠেছিলুম। পরনে জিনস, লাল শার্ট, জিনসের জ্যাকেট। আইভি নয় তো? পরে দেখি আর এক যুবতী মেমসায়েব এসে তার সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় কিচিরমিচির জুড়ে দিল। দু’জনেই সিগারেট ধরাল। আর একবার এক ধারালো চেহারার ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা যুবককে দেখে ভেবেছিলুম, আইভির সেই সঙ্গী নয় তো? আমাকে নিরাশ করে এক বাঙালী যুবতী একটি বাচ্চাকে নিয়ে কুপ থেকে বেরিয়ে তাকে বলেছিল, বাবুইকে বাথরুমে নিয়ে যাও তো!

ট্রেন আসানসোল ছাড়িয়ে যাবার পর করিডর খাঁ খাঁ নিঝুম। সব কুপের দরজা বন্ধ। বাথরুম থেকে এসে শুয়ে পড়েছিলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। নেমে পড়ো। চিত্তরঞ্জন এসে গেল। পনেরো মিনিট লেট।

নির্জন প্ল্যাটফর্মে দু’জনে নেমে একটা চায়ের স্টলে গেলুম। কিন্তু চা এখনই মিলবে না। কর্নেল একটা খালি বেঞ্চে বসে বললেন, ফ্লাস্ক আনতে ভুলে গেছি। ষষ্ঠী বরাবর ফ্লাস্কে কফি তৈরি করে রাখে। সে-ও ভুলে গেল?

এই সময় কেটলি আর প্লেটে মাটির ভাড় সাজিয়ে প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্ত থেকে এক চাওয়ালা এসে গেল। সারাক্ষণে আঁচে বসিয়ে রাখা কেটলির তরল পদার্থের স্বাদ তীব্র হিম শেষরাতে অমৃত মনে হচ্ছিল। দেখলুম কর্নেলও তারিয়ে তারিয়ে সেই অমৃত পান করে চুরুট ধরালেন। বললেন, এক ঘণ্টা অপেক্ষা করো। স্টেশনের বাইরের রাস্তায় বিজয়গড় যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। মিনিট চল্লিশ লাগার কথা। তবে আট বছর আগে যে অবস্থা ছিল, এখন তা বদলে যেতেই পারে। তুমি সাংবাদিক। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা দেখার আমন্ত্রণ পাওনি কখনও?

বললুম, হ্যাঁ। বছর পাঁচেক আগে এসেছিলুম। ওহ্! হরিবল অভিজ্ঞতা!

 কেন?

ইঞ্জিন তৈরির কারখানায় ঢুকে কানের অবস্থা–ওহ আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এই ভয়ঙ্কর শব্দের মধ্যে যারা কাজ করে, তারা কি যন্ত্রমানুষ হয়ে আছে? কারখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে একখানা ঝঝালো রিপোর্টাজ লিখেছিলুম। সত্যি কর্নেল। বিদেশেও কলকারখানা দেখে এসেছি। এ দেশের কলকারখানায় মানুষকে নিঙড়ে ছোবড়া করে দেওয়া হয়। একেবারে–যাকে বলে ডিহিউম্যানাইজেশন

কর্নেল আমার কথার ওপর সহাস্যে বললেন, বিহারি শীতের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তুমি বক্তৃতা শুরু করলে ডার্লিং! এই স্থানটি কিন্তু বিহার। তা জানো তো? কয়েক পা হেঁটে উত্তরে গেলেই পশ্চিমবঙ্গ। যাই হোক, তুমি গা গরম করতে থাকো।

বললুম, নাহ্! তত কিছু ঠাণ্ডা লাগছে না। আসলে সেই স্মৃতিটা বড্ড তেতো।

কিছুক্ষণ পরে একটা ডাউন ট্রেন এল। একদল আদিবাসী ভিড় করে নামল। তারপর তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে চলে গেল। নানা বয়সের মানুষ। ওরা হাঁটতে হাঁটতেই যাবে, তা বোঝা যাচ্ছিল। ততক্ষণে চায়ের স্টলের একটি লোক কেরোসিন স্টোভ ধরিয়ে কেটলি চাপিয়েছে। কর্নেল তা লক্ষ্য করে বললেন, আর এক ভাঁড় চা খেয়ে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব।

চাওয়ালার কাছে খবর নিয়ে জানা গেল, বিজয়গড় যাওয়ার বাস এখন সকাল সাতটায় ছাড়ে। কারণ গত বছর জঙ্গলের রাস্তায় ভোরের বাসে ডাকাতি হয়েছিল। তারপর থেকে সময় বদলানো হয়েছে। তবে যদি আমরা আগে যেতে চাই, ট্রাক পেতে পারি। বিজয়গড়ের ওদিকে একটা পাথরখাদান আছে। কয়েকটা ট্রাক মজুরদের নিয়ে ভোরবেলা সেখানে যায়। বিকেলে ফিরে আসে পাথরকুচি বা স্টোন চিপস নিয়ে।

সৌভাগ্যক্রমে একটা ট্রাকে জায়গা পাওয়া গেল। তখনও কুয়াশা-মেশানো আঁধার চরাচর ঢেকে রেখেছে। অসমতল খোলা মাঠ, চড়াই-উতরাই, তারপর টানা জঙ্গল পেরিয়ে আবার ঢেউখেলানো মাঠ এবং আদিবাসী বসতি পেরিয়ে যাওয়ার পর দিনের আলো ফুটল বটে; কিন্তু কুয়াশা এত গাঢ় যে পরিবেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। একখানে ট্রাকটা থেমে আমাদের নামিয়ে দিল। সেখানে ছোট বাজার। ড্রাইভার বলল, ইহাসে আধা কিলোমিটার। পায়দল মাত্ যাইয়ে। রিকশা-টাঙ্গা, সব কুছ মিলেগা ইহা।

ড্রাইভারটি খুবই ভদ্র। কিছুতেই ভাড়া নিল না। বখশিস হিসেবেও না। কর্নেল বললেন, চিনতে পেরেছি। জায়গাটার নাম উরনপুর। আট বছর আগে এখানে জঙ্গল ছিল। আদিবাসীদের হাট বসত। আরে আশ্চর্য! টিলার গায়ে কত ইটের বাড়ি উঠেছে।

তিনটে ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার এবং তিনদল মজুর হই হই করে চায়ের দোকানগুলোতে গিয়ে ভিড় জমাল। কর্নেল একটা সাইকেল রিকশ ডেকে উঠে বসলেন। আমি তার প্রকাণ্ড শরীরের চাপে সেঁটে গেলুম। কর্নেল বললেন, বিজয়গড় রাজবাড়ি। কত ভাড়া নেবে?

রিকশাওয়ালা বলল, বিশ রুপৈয়া।

 ঠিক হ্যায়।

ততক্ষণে কুয়াশার গায়ে রক্তিম রোদ পড়েছে। দু’ধারে গাছের সারি। তার। ফাঁকে অনাবাদি মাঠের ওপর নানা গড়নের প্রকাণ্ড সব পাথর পড়ে আছে। কিছুটা চলার পর ফসলের জমি চোখে পড়ল। রাস্তাটা পিচের এবং মসৃণ। বুঝলুম এটাই বাস রাস্তা। ট্রাকগুলো যাবে অন্যদিকে।

ক্রমে একটা শহরের অস্পষ্ট ছবি সামনে ফুটে উঠল। রিকশা বাঁদিকে সংকীর্ণ খোয়াঢাকা পথে বাঁক নিল। কর্নেল বললেন, কিছু চেনা যাচ্ছে না। মাত্র আট বছরে এত বেশি পরিবর্তন। অবশ্য সবখানেই এমনটি হয়েছে।

এবার রিকশাওয়ালা নেমে রিকশা ঠেলতে থাকল। কিছুটা চড়াই। তারপর সমতল পথ। কিন্তু দুদিকে শুধু ধ্বংসাবশেষ, পাথর আর ঝোপ-জঙ্গল। কর্নেল গাইডের ভঙ্গিতে বললেন, প্রাচীন বিজয়গড়ের স্মৃতিচিহ্ন লক্ষ্য করো জয়ন্ত! এটা একটা ঐতিহাসিক জায়গা।

মোরাম রাস্তাটা সোজা এগিয়ে গেছে। ডাইনে ঘুরেই দেখি, সামনে একটা ভেঙেপড়া তোরণ। রিকশাওয়ালা বলল, আগেয়া সাব!

ভাড়া মিটিয়ে কর্নেল পা বাড়ালেন! ভাঙা তোরণের পর কাঠের বেড়া। কর্নেল সেখানে গিয়ে ডাকলেন, কালীপদ! কালীপদ!

একজন প্রৌঢ় দৌড়ে এসে কর্নেলকে দেখে গেট খুলে সেলাম দিয়ে বলল, আসুন স্যার! রানীমা বলেছেন আপনি যে কোনও সময়ে এসে পড়বেন।

তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ দেখছি!

আপনাকে কি ভুলতে পারি স্যার?

বাঁদিকে একটা পুরনো দোতলা লম্বাটে বাড়ি। ইতালীয় ভাস্কর্যের আদলে তৈরি। ডানদিকে পোড়ো ফোয়ারা এবং ঝলমলে ফুলবাগান। সামনে পূর্বে একটা মন্দি। মন্দিরের দিক থেকে এক বৃদ্ধা ছড়ি হাতে এগিয়ে আসছিলেন। তাঁর সাদা চুল খোলা। সদ্য স্নান করে মন্দিরে হয়তো পুজো করতে গিয়েছিলেন। তার পেছনে ঘোমটাটানা একুট যুবতী মেয়ে। কালীপদ চেঁচিয়ে উঠল, রানীমা! কর্নেলসায়েব এসেছেন!

বৃদ্ধা করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, আমি জানি। চিঠি পেয়ে আপনি না এসে পারবেন না।

কর্নেল বললেন, আপনি কেমন আছেন বলুন?

বৃদ্ধা হাসলেন। লিখেছি তো সে কথা। আমাকে আপনি যে কষ্ট করে দেখতে এলেন, তার চেয়ে বড় কথা আমি আপনাকে দেখতে পেলুম। ওরে কালী। কর্নেলসায়েবের ঘর গুছিয়ে রেখেছিস তো?

কালীপদ বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ রানীমা!

কর্নেলসায়েব! আগে গিয়ে রেস্ট নিন। জবা! তুই আমার সঙ্গে আয়। তোকে দেখিয়ে দিই কীভাবে কফি তৈরি করতে হয়। ওরে! কর্নেলসায়েব কফির খুব ভক্ত।

কর্নেল বললেন, আমার চিঠি পেয়েছেন তো?

 বৃদ্ধা পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। হরেকেষ্ট ফিরলে তো চিঠি পাব।

সে কী! উনি এখনও ফেরেননি?

না। হয়তো আসানসোলে বোনের বাড়িতে গেছে। বলছিল, ফেরার পথে ওখান হয়ে আসব। বললুম, তা আসিস। কর্নেলসায়েব আমার চিঠি পেলেই হল। বলে আমার দিকে তাকালেন। এই ছেলেটিকে তো চিনতে পারলুম না?

কর্নেল বললেন, এর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক।

কে জানে কেন, তখনই বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলুম। উনি আশীর্বাদ করে বললেন, কালী! এঁদের নিয়ে যা।

কালীপদ আমাদের নিয়ে যেতে যেতে চাপাস্বরে বলল, রানীমার কাছে আবার উড়ো চিঠি এসেছে। এই নিয়ে তিনবার। উনি নিজেই বলবেন সব কথা। তবে আপনাকে দেখে আমার সাহস বেড়ে গেল স্যার …