পিছনে পায়ের শব্দ – ৫

০৫.

গণনাথের গাড়ি দেখতে পেয়ে সাবর্ণী নেমে এসেছিল। পিউ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে বলল, পি জি সায়েবের গাড়ি ভ্যানিশ, বিবি! তার চাইতে মিসটিরিয়াস ব্যাপার….

তাকে থামিয়ে সাবর্ণী বলল, গ্যারেজে নিয়ে গেছে। সবতাতেই চ্যাঁচামেচি করিস না তো।

গণনাথ গাড়ি থেকে বেরিয়ে বললেন, ইশ! একেবারে মেটামরফসিস, সক্কালবেলায় বুঝি পরী সাজতে হয় আজকাল?

সাবর্ণী তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

আরে! গণনাথ একটু হাসলেন। হুঁ, বিয়ের বাসি প্রণাম। তবে আশীর্বাদ অলরেডি আগাম বাই পোস্ট পাঠিয়েছিলুম। আসলে তখন আমার লেটেস্ট ছবির এডিটিং চলছে। প্রাণান্তকর অবস্থা।

পিউ প্রিয়গোপালের গাড়ির ভাঙা কাচ এবং রক্তের ব্যাপারটা বলতে উগ্রীব। কিন্তু বলার মুখেই বাধা পেয়ে রেগে গেছে। পোর্টিকোর সিঁড়িতে জোরালো পায়ের শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকে গেল। সাবর্ণী বলল, আমার ঘরে চলুন। প্রিয় বলে গেছে, আপনারা আসবেন।

অনেক আগে এসে গেলুম। গণনাথ তাকে অনুসরণ করে বললেন। একটা ঝামেলায় পড়েছি। বলছি। হ্যাঁ রে, বাড়ির লোকজন এখনও ঘুমুচ্ছে নাকি?

নাহ। দাদামশাই তার নাতনিকে নিয়ে গঙ্গাস্নানে গেলেন। ও! তুমি রাণুদিকে তো দেখেছ কাল বিকেলে। আমাকে তাতাচ্ছিল। আমার অত পুণ্যটুন্যের দরকার নেই বাবা! কী সাংঘাতিক শীত এখানে!

প্রিয় কতক্ষণ আগে বেরিয়েছে?

প্রায় ঘণ্টাখানেক। সঙ্গে ভগীরথকে নিয়ে গেছে টাউনশিপের কোন গ্যারেজে যাবে।

 গণনাথ ওপরে উঠে ব্যালকনিতে গেলেন। বললেন, বাড়িটা বনেদি। ছবির কাজে লাগানোর উপযোগী। কিন্তু যা অবস্থা, ছবিটবি করার প্ল্যান, হয়তো শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যাবে।

কেন?

গণনাথ বললেন, গত রাত থেকে আনু হঠাৎ নিপাত্তা। খুব ভাবনায় পড়ে গেছি।

সাবর্ণী আগ্রহ দেখাল না। বলল, ঘরে এসে বসুন। আমি চায়ের কথা বলে আসি।

গণনাথ ঘরে ঢুকে বললেন, পরে হচ্ছে। তোর সায়েব না ফেরা পর্যন্ত ডিসিশন নিতে পারছি না।

কিসের?

আনুর ব্যাপারে থানায় যাব কি না। গণনাথ দক্ষিণের জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন।

ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, প্রিয় তোকে ওর গাড়ির অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে কী বলেছি, বলবি?

সাবর্ণী উঁচু খাটে হেলান দিয়ে শান্ত চোখে তাকাল। বলল, ব্রেক ফেল করায় ঝোপে গাড়ি ঢুকিয়েছিল। তারপর হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। বলে সে বাঁকা হাসল। একটু ভৌতিক টাচ অবশ্য দিয়েছে। কী একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনেছিল নাকি। টেরিফিক ক্র্যান্ড ভয়েস!

ইজ ইট? গণনাথ সোজা হয়ে বসলেন। প্রিয় বলছিল তোকে? আশ্চর্য তো! বাংলোর চৌকিদারও বলল রাত্তিরে ভুতুড়ে চিৎকার শুনেছে। আচ্ছা, প্রিয় তোকে বলেছিল ওর গাড়ির কাঁচ-ফাচ ভেঙে গেছে?

নাহ। কে বলল কাচ ভেঙেছে?

পিউ আর সাত্যকি দেখেছে। আমিও ভাঙা কাচ পড়ে থাকতে দেখলুম। প্রিয় কি উন্ডেড হয়েছিল?

সাবর্ণী একটু অবাক হয়ে বলল, নাহ্। গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। কেন বলুন তো?

পিউ আর সাত্যকি দুজনেই রক্ত দেখেছিল ঘাসে। গণনাথ উদ্বিগ্ন মুখে বললেন। কিন্তু এখন দেখে এলুম রক্তের চিহ্ন নেই। গাড়ি নিশ্চয় গ্যারেজে নিয়ে গেছে প্রিয়। কিন্তু রক্তের দাগ….তুই পিউকে ডেকে জিজ্ঞেস কর।

সাবর্ণী নড়ল না। বলল, এ সবে আমার মাথাব্যথা নেই। প্রিয় ফিরুক। জিজ্ঞেস করবেন।

গণনাথ সিগারেটে জোরে টান দিয়ে বললেন, অবশ্য গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় চাকায় রক্তের দাগগুলো মুছে যেতেও পারে। কিন্তু আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। রাত্তিরে প্রিয় আমার সঙ্গে দেখা করে বাংলো থেকে চলে আসার একটু পরে আনু বেরুল। মোটামুটি ড্রাঙ্ক। তারপর আর ওর পাত্তা নেই।

সাবর্ণী ভুরু কুঁচকে এবং ঠোঁট কামড়ে ধরে শুনছিল। ফেস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, তা হলে প্রিয় ওকে মার্ডার করেছে।

আহ্। আমি কি তা-ই বলছি?

 থানায় যাচ্ছেন না কেন? কেউ নিপাত্তা হলে লোকে তো আগে থানায় যায়।

গণনাথ কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানার পর আস্তে বললেন, তোর বোঝা উচিত কেন যাচ্ছি না। গেলে পরে যা জেনেছি, সমস্তটা আমাকে পুলিশের কাছে বলতে হবে। আফটার অল, আনুর ব্যাপারে আমি কম্পপ্রামাইজ করতে পারব না, ইউ শুড় নো দ্যাট বিবি! আনু আমাকে অনেক সাংঘাতিক ব্যাপার থেকে বাঁচিয়েছে। আনুর একটা কিছু হওয়া মানে আমি বিপন্ন। সো মাচ আই ক্যান টেল ইউ। কাজেই প্রিয়র মুখ থেকে আমি জানতে চাই অ্যাকচুয়্যালি হোয়াট হ্যাঁপ!

সাবর্ণীর চোখ দুটো জ্বলে উঠেছিল। একটু চুপ করে থাকার পর গলার ভেতর বলল, আপনি ইনডিরেক্টলি আমাকেই শাসাচ্ছেন কিন্তু!

তুই যদি গায়ে পেতে নিস, আমার বলার কিছু নেই। গণনাথ হাসবার চেষ্টা করলেন। আর যাই করি, আনুর সঙ্গে তোর সম্পর্কের কথা আমি পুলিশের কাছে তুলব না। তবে রাতের ব্যাপারটা আমার কাছে খটকা লাগছে।

পিউ ট্রেতে চা আর স্নাক্স আনল। সাত্যকিকে দরজায় দেখা গেল। সে উঁকি মেরে বলল, দাদা! এসে গেছি। জাস্ট আ মিনিট। আমি আসছি।

পিউ গণনাথ এবং সাবর্ণীকে দেখে নিয়ে বলল, এত বেশি সিরিয়াস হবার মতো কিছু ঘটেনি। বিবি! আমি চা-ফা করতে জানি না। কতটা লিকার কতটা দুধ কতটা চিনি এসব হিসেব মহিলারা জানেন। তা ছাড়া আমি চা খাই না।

সে বেরিয়ে গেলে সাবর্ণী চা তৈরি করে গণনাথকে দিল। গণনাথ বললেন, তুই খাবি না।

নাহ্। কিন্তু তুমি তো ভারি অদ্ভুত খবর নিয়ে এলে!

রাগ করিস না বিবি! সত্যি আনুর কিছু একটা ঘটলে আমি বিপন্ন। গণনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, কেন বিপন্ন, তোকে তা বলা যাবে না। প্রত্যেকের জীবনে কিছুনা-কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। এনিওয়ে! গ্যারেজটা কোথায় জানতে পারলে ভাল হত। প্রিয়র সঙ্গে মিট করা দরকার। খোঁজ নিয়ে দেখ তো, তোদের সেই ভগীরথ ফিরেছে নাকি।

ফেরেনি। ফিরলে সাড়া পেতুম। সাবর্ণী দক্ষিণের জানালায় গিয়ে অকারণ উঁকি দিল। তারপর ঘুরে বলল, আচ্ছা গণাদা!

বল।

ওই লোকটার বিপদের কথা তুমি ভাবছ কেন? সে তো নিজেই একটা সাংঘাতিক বিপদ।

আমার কেন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে! আনু আনপ্রেডিক্টেবল এলিমেন্ট, তা ঠিক। কিন্তু প্রিয় তোকে বলেছে ওখানে একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনেছে। বাংলোর চৌকদারও বলছিল শুনেছে। আমি ভাবছি, চিৎকারটা আর্তনাদ কিনা! তাছাড়া প্রিয়র গাড়ির কাছে রক্তের দাগ ছিল।

সাবর্ণী আঙুল খুটতে খুঁটতে বলল, চিৎকার শুনে প্রিয় খুব ভয় পেয়েছিল। এল যখন, তখন ভীষণ নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে। জল খেল। অবশ্য এটাকে যদি কাকেও মার্ডার করে আসার লক্ষণ বলতে চাও, বলতে পার। শুনেছি, মরিয়া। হয়ে উঠলে যে-কেউ বাইচান্স মার্ডার করে ফেলতেই পারে। প্রিয় যদি তা-ই করে থাকে, আমি কিন্তু খুশি হব।

গণনাথ ওর চোখে চোখ রেখে বললেন কেন? প্রিয়র সঙ্গে তোর বিয়েতে আনু তে বাধা দেয়নি। বিয়ের পরও তোর পিছনে লাগতে আসেনি।

এসেছিল! তুমি তো ওর মালিক। তোমায় দেখানো উচিত।

সাবর্ণী শক্ত মুখে কথাটা বলে কোনার টেবিলের দিকে গেল। একটা কিটব্যাগের ভেতর থেকে হ্যান্ডব্যাগ বের করে খুলল। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। হ্যান্ডব্যাগটা তন্নতন্ন খুঁজে কিটব্যাগের ভেতরটা খুঁজতে থাকল।

গণনাথ বললেন, কী খুঁজছিস?

 চিঠিটা…অদ্ভুত তো! চিঠিটা কাল মনিঙেও দেখেছি। নেই কেন?

কার চিঠি?

তোমার পোষা জানোয়ারের। সাবর্ণী ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর হ্যান্ডব্যাগ আর কিটব্যাগ সশব্দে মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলল। আগুনজ্বলা চেহারা।

গণনাথ বললেন, সিন ক্রিয়েট করিস না। এখানে আয়। বোস! কাম অন! বিবি!

এ ঠিক পিউয়ের কাজ। দেখাচ্ছি মজা! বলে সাবর্ণী জোরে বেরিয়ে গেল।

পুবের ছোট্ট ব্যালকনিতে বালির বস্তায় সাত্যকি দমাদ্দম ঘুসি চালাচ্ছিল। পিউ দাঁড়িয়ে তাকে নিঃশব্দে লড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করছিল। সাবর্ণীকে দেখে ঘুরল। সাবর্ণী রাগী মুখে বলল, শুনে যা। কথা আছে।

পরে শুনব। ফোর্থ রাউন্ড হয়ে গেল!

সাবর্ণী তাকে হিড়হিড় করে টেনে সাত্যকির ঘরে ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আমার একটা চিঠি নিয়েছিস তুই?

পিউ চোখ বড় করে বলল, চিঠি! আমি তোর চিঠি…ইমপসিবল! কী বলছিস তুই?

নিশ্চয় নিয়েছিস। লুকিয়ে আমার চিঠি পড়া অভ্যাস তোর আছে।

শাট আপ বিবি! আই অ্যাম হিস্টেরিক, ইউ নো।

সাবর্ণী একটু দমে গিয়ে বলল, কিন্তু চিঠিটা যাবে কোথায়! আমার হ্যান্ডব্যাগে তুই ছাড়া হাত দেবে কে?

পি জি দেবে। বলে পিউ বারান্দায় চলে গেল। সাত্যকির অন্যদিকে মন নেই। ঘুরে পিউকে দেখে একটু হাসল শুধু। আসলে এতক্ষণ পরে সে পিউকে দেখতে পেয়েছিল। এর আগে পিউ ছিল তার কাছে অস্তিত্বহীন।

সাবর্ণী তার ঘরে ফিরলে গণনাথ বললেন, তুই সত্যি সিন ক্রিয়েট করে বেড়াচ্ছিস! এ বাড়ির লোকেরা কী ভাববে? বলছি, চুপচাপ বস। তারপর….অবশ্য সেটা তোরই ইচ্ছে, আভাসে বলতে পারিস আনু কী এমন কথাবার্তা লিখেছিল তোকে।

গণনাথ ঘড়ি দেখলেন। সাবর্ণী বসল না। টুলে রাখা সুটকেসটা খুলতে ব্যস্ত হল। সাবর্ণীর এমন হয়, একখানে রাখা জিনিস অন্যখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই আনমনা স্বভাব তার ছোটবেলা থেকেই আছে। কখনও কখনও এটা বেড়ে যায়। অনির্বাণের চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে তো বেড়েছেই। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

গণনাথ বললেন, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না বিবি! আনুর চিঠিটা যদি এত খারাপ, তা হলে ওটা ছিঁড়ে না ফেলে সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?

সাবর্ণী আস্তে বলল, ও শাসিয়েছিল চিঠিতে। জানো তুমি?

 তোকে, নাকি তোর পি জি সায়েবকে? মার্ডার করবে লিখেছিল নাকি?

দুজনকেই। তা ছাড়া লট অব ডার্টি ওয়ার্ডস। সাবর্ণী কেঁদে ফেলল। ও জানোয়ার। নীচ!

গণনাথ শুকনো হাসলেন। কোনও মানে হয়?

হয়। প্রিয়র কোনও ক্ষতি হলে চিঠিটা আমি পুলিশকে দেব বলে রেখেছিলুম।

গণনাথ আবার সিগারেট ধরালেন। গলার মাফলারটা খুলে ফেললেন। সাবর্ণী কান্না সামলে স্যুটকেসের কাপড়চোপড় একটার পর একটা মেঝেয় ফেলতে থাকল। একটু পরে দরজার বাইরে ভগীরথের সাড়া পাওয়া গেল। সে বলল, উনহি সিংজির গারিজ থেকে দুসরা গাড়ি লিয়ে আমিনগঞ্জ চলিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন কী, মেমসাবকে বোলো, কখন ফিরব কুছু ঠিক না আছে।

গণনাথ উঠে দাঁড়ালেন সঙ্গে সঙ্গে। ভগীরথ এতক্ষণে তাকে দেখতে পেয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম দিল। গণনাথ ব্যস্তভাবে বললেন, চলে গেল প্রিয়!

ভগীরথ হাসল। আপনার কথা ভি বললেন আমাকে। সেনিমার ডারেক্টর সাব আসলে দেখভাল করতে বললেন। কুছু অসুবিস্তা হবে না বড়াসাব! দাদামোশা ভি আমাকে বলেছেন আপনার কথা।

সে চলে গেলে গণনাথ ধপাস করে বসলেন চেয়ারে। মুখে হতাশা ও বিরক্তির গাঢ় ছাপ। ডাকলেন, বিবি!

সাবর্ণী ফেলে দেওয়া কাপড়চোপড় আবার মোটামুটি ভাজ করে সুটকেসে ভরছিল। চিড় খাওয়া গলায় আস্তে আস্তে বলল, বলো!

প্রিয় ইজ টু সমার্ট। গণনাথ রুষ্টভাবে বললেন। কাল রাত্তিরে সিওর একটা কিছু ঘটেছিল। গাড়ির কাচ ভাঙা, রক্ত-উক্ত….আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুজনে মারামারি করেছে। আনু ড্রাঙ্ক অবস্থায় একেবারে ফর্মে থাকে না। না। আমি বলছি না প্রিয়র কাকেও মার্ডার করার ক্ষমতা আছে, বিশেষ করে আনুকে। তবে এমনও হতে পারে, চোট খেয়ে আনু ওখানেই কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমার আগে সেটা খুঁজে দেখা দরকার। তুই সাত্যকিকে ডেকে দে! ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। লোকাল ছেলে। এরিয়াটা চেনে।

সাবর্ণীকে এখন বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। নিষ্প্রাণ মূর্তি হয়ে বেরিয়ে গেল।

সাত্যকির ঘরে টিভি দেখছিল পিউ। ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। ভলম কমানো। সাবর্ণীকে গ্রাহ্য করল না। সাবর্ণী বলল ঠাকুরপো কোথায়? জবাব দিল না পিউ। নির্বিকার মুখ, দৃষ্টি টিভির দিকে। সাবর্ণী পুবের ব্যালকনিতে সাত্যকিকে দেখতে পেল না। তখন সে কিচেনে গেল।

কিচেনে সাত্যকি একটা কাঁচের গেলাসে হলুদ রঙের গাঢ় এবং তরল কী খাদ্য চামচ দিয়ে ঘাঁটছিল। সাবর্ণীকে দেখে একটু হাসল সে। সাবর্ণী বলল, অরেঞ্জ স্কোয়াশ?

গেলাস তার দিকে বাড়িয়ে সাত্যকি বলল, নাহ্। খাবেন নাকি?

গন্ধ টের পেয়ে সাবর্ণী নাকে হাত রাখল। সাত্যকি হাসতে হাসতে বলল, এগ-স্কোয়াশ বলতে পারেন। আমার মর্নিং ড্রিঙ্ক। সে তার পায়ের কাছে, আবর্জনা রাখা প্ল্যাস্টিকের বড় বালতিটা দেখিয়ে দিল। কয়েকটা ডিমের টাটকা খোসা।

সাবর্ণী অবাক হয়ে বলল, কাঁচা ডিম খাও তুমি?

 ইয়া! সাত্যকি বাঁ-হাত তুলে চারটে আঙুল দেখাল। বলল, চারটে ডিম, একটু নুন। আমার জামাইবাবুর ট্রেনিং। উনি তো জঙ্গলে গিয়ে খিদে পেলে কাঁচা মাংসও খেতেন। আপন গড়!

তোমায় গণাদা ডাকছেন। শিগগির এস।

সরি! দেখছেন? দাদার কথা এক্কেবারে মনে নেই। বলে সাত্যকি গেলাসে চুমুক দিল।

সাবর্ণীর বমিভাব এসে গেল। সে ডিম খায়। কিন্তু এভাবে চারটে কঁচা ডিম খাওয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না। কিচেন থেকে বেরিয়ে সে দেখল, রাণু গঙ্গাস্নান করে ফিরছেন। পেছনে অরীন্দ্র। রাণুর পরনে সরু নকশিপাড় কোরা তাঁতের শাড়ি। অরীন্দ্রের পরনে পাটভাঙা ধবধবে ধুতি আর গায়ে ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরী শাল জড়ানো। সাবর্ণীকে দেখে তিনি চোখ নাচিয়ে বললেন, গেলে না মেমসায়েব। গঙ্গাস্নানে পুণ্য না হোক, কোনও-না-কোনও দিন কিছু থ্রিল পাওয়া যায়। বঞ্চিত হলে। কৈ, আমার পুঁচকি মেমটা কোথায়? শি উইল বি ইন্টারেস্টেড।

রাণু চোখ বড় করে বললেন, আজ আবার একটা খেয়েছে। আমরা দেখতে গিয়েছিলুম। তাই একটু দেরি হল। পুলিশ এসে গেছে। হুজুগে লোকও আছে। বটে বাবা! বডিটা যে ভাল করে দেখব….

বডি! সাবর্ণীর মুখ দিয়ে কথাটা ঠেলে বেরিয়ে গেল বুদবুদের মতো এবং ফেটে গেল।

অরীন্দ্র মুচকি হেসে বললেন, ক্লিফটন সায়েবের প্রেতাত্মার কীর্তি। অজ্ঞ লোকেরা বলে, কুঠিবাড়ির নীচের সেই ভয়ঙ্কর খাদে কিচনি আছে। লোক্যাল টার্ম। জলের পেত্নী আর কী! তবে এবারকারটা মেয়ে নয়, পুরুষমানুষ।

সাবর্ণী চুপচাপ একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘরে ফিরে এল।

গণনাথ বললেন, সাত্যকিকে পেলি?

সাবর্ণী কোনও জবাব না দিয়ে পশ্চিমের জানালায় চলে গেল। দু হাতে ঠাণ্ডা হিম রড মুঠোয় চেপে ধরল।

গণনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তভাবে বললেন, তোর কিছু বোঝা যায় না। আমি যাচ্ছি।

সাবর্ণী না ঘুরে বলল, কুঠিবাড়ির নীচে গঙ্গায় একটা বডি পাওয়া গেছে।

কী বললি? গণনাথ গলার ভেতর বললেন, বডি? মানে ডেডবডি?

সেই সময় পিউ ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটানি তুলে ঘরে ঢুকল। বলল, গণাদা! খবর আছে। রাণুদিরা গঙ্গার ধারে একটা ডেডবডি দেখে এসেছেন। তোমার এক্ষুণি গিয়ে দেখা উচিত। কিছু বলা যায় না।

গণনাথ বেরিয়ে গেলেন। পিউ তাকে অনুসরণ করল। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছুলে পিছন থেকে সাত্যকির সাড়া এল। সে হন্তদন্ত আসছিল। সঙ্গ নিয়ে বলল, দিদি যা ডেসক্রিপশন দিল, মনে হচ্ছে অনির্বাণবাবু। সিওর….

.