পিছনে পায়ের শব্দ – ১৭

১৭.

 কর্নেলকে দেখে পিউ ঠোঁটের কোনায় হাসল। পাত্তা দিল না তো? আমি। জানতুম।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ভড়কে দিয়েছি।

 পিউ ভুরু কুঁচকে তাকাল। হোয়াট্‌স দ্যাট?

দ্যাটস্ দ্যাট, ডার্লিং! চলো দেখি, টাঙা বা সাইকেলরিকশো পাই নাকি। বার্ড-স্যাংচুয়ারি অনেকটা দূরে।

পিউ বাংলোর দিকে ঘুরে চাপাস্বরে বলল, কর্নেল! গণাদা কামিং!

কর্নেল পালানোর ভঙ্গি করে বললেন, জগিং পিউ! কোনও কোনও সময়ে জগিং খুব কাজে লাগে।

তার মুখে কৌতুক ঝলমল করছিল। পিউ বলল, আপনাকে কিন্তু সার্কাসের জোকার দেখাচ্ছে! আপনি কি সত্যি জগিং করবেন নাকি?

কর্নেল তার হাত ধরে টানলেন। বার্ড-স্যাংচুয়ারি পরে। আপাতত ক্লিফটন হাউস চলো!

পিউ গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে গেল। লেট মি ফেস হিম।

গণনাথ ক্যানেলব্রিজে পৌঁছে ডাকছিলেন, ও মশাই! শুনুন, শুনুন।

কর্নেল বাইনোকুলারে আকাশ দেখতে থাকলেন। গণনাথ কাছে এলে পিউ হিসহিস করে বলল, একটু ভদ্রতা করে তোমার কথা বলা উচিত গণাদা! জানো উনি কে?

গণনাথ শক্ত মুখে বললেন, প্রিয়কে বাঁচানোর জন্য তোমরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এনেছ। কিন্তু ভদ্রলোকের কী সাহস যে আমাকে থ্রেটন করতে যান?

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, ছি ছি মিঃ সেন! ডিটেকটিভ কথাটা বিচ্ছিরি গালাগাল। আমি একজন নেচারিস্ট।

থামুন মশাই! আপনার নেমকার্ড আমি পুলিশকে দিচ্ছি। একজন কর্নেল বলে নিজের পরিচয় দেওয়া সাংঘাতিক ক্রাইম, সেটা আপনার জানা উচিত। গণনাথ দুপা এগিয়ে বললেন, আর এই ছদ্মবেশ!

কী সর্বনাশ। আপনি কি আমার দাড়ি মেড ইন চিৎপুর ভাবছেন নাকি?

গণনাথ রুক্ষস্বরে বললেন, আমি ফিল্মমেকার। মেক-আপের ব্যাপার আমাকে বোঝাতে আসবেন না।

পিউয়ের নাসারন্ধ্র স্ফীত। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিল। ফেস করে বলল, গণাদা, ইউ আর গোয়িং টু ফার।

গণনাথ তাকে গ্রাহ্য করলেন না। কর্নেলকে চার্জ করলেন, আমায় ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না মশাই। বলুন কেন?

তাকে থামিয়ে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, জানি। আপনার এক ভাই এস এন সেন বোম্বে ডক এরিয়ার হাইর্যাংকিং কাস্টম্স্ অফিসার। কাজেই মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানি আপনাকে ঘটাবে না। কিন্তু মানুষমাত্রেই একচক্ষু হরিণ মিঃ সেন।

গণনাথের তেজ উবে গেল। ন্যাতানো কাকতাড়ুয়ার মতো দেখাচ্ছিল তাকে। একটু পরে আস্তে বললেন, দেন ইউ আর আ প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

আবার আপনি আমাকে গাল দিচ্ছেন কিন্তু!

গণনাথ ভাঙা গলায় বললেন, দেন হু আর ইউ?

 কার্ডে যা লেখা আছে, আমি তা-ই।

আপনি দেখছি ডিপওয়াটার ফিশ! ওক্কে! গণনাথ কঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, দেখুন, ফ্র্যাংকলি বলছি। প্রিয়র মতো আমি এই কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেল করি না। কোম্পানি আমাকে ছবি করার টাকা দিচ্ছে, তা ঠিক। আর এও ঠিক, আমি একটা আর্টফিল্ম করতে চাই। কোম্পানির সঙ্গে আমার রফা হয়েছে গিভ অ্যান্ড টেক প্রসেসে। ওরা মাল এক্সপোর্ট করবে। বোম্বেতে কাস্টমস্ আজকাল বড় ঝামেলা করে। সেটা যাতে না হয় আমি সত্যেনকে যেন একটু বলে রাখি। দ্যাটস মাছ। এর মধ্যে কোনও লুকোচুরি নেই।

 কোম্পানি কি ঠিক এই রফা অনুসারেই আপনার বডিগার্ড অনির্বাণবাবুর মাইনে জোগাত?

দ্যাটস্ আ টোটাল লাই। আপনার সোর্স মিথ্যাবাদী।

কর্নেল চুরুট বের করে ধরালেন। বললেন, কেন আপনার বডিগার্ড দরকার হয় মিঃ সেন?

গণনাথ মাথা নেড়ে বললেন, এগেন ইউ আর মিসইনফর। আনু আমার বডিগার্ড ছিল না। সে বেকার ছেলে। তাকে স্নেহ করতুম। হ্যাঁ আনু ফেরোসাস টাইপ ছিল। পিউ চিনত ওকে। জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু আমি বডিগার্ড রাখব কেন? পিউ, বল্ তুই!

পিউ মুখ ঘুরিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। কর্নেল চুরুট কামড়ে ধরে একটু হাসলেন। এনিওয়ে। মিঃ সেনকে এ বৃদ্ধের সদুপদেশ, যখনই গাড়ি নিয়ে বেরোবেন, ব্রেক-স্টিয়ারিং ঠিক আছে কি-না দেখে নেবেন।

আবার সেই কথা? আমার কোনও বিপদ হবে না।

এবার পিউ আস্তে বলল, আনুদার কাছে শুনেছিলুম, তুমি কোন ফিন্যান্সারকে নাকি ফসিয়েছিলে। সে জন্য ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরো। আমি দেখেছি আনুদার একটা ফায়ার আর্মস ছিল!

গণনাথ হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ছিল তো সেটা গেল কোথায়?

জামাইবাবুর গাড়িতে যেটা পাওয়া গেছে, সেটাই হবে। পিউ চার্জ করার ভঙ্গিতে বলল, নিশ্চয় তুমি সে-রাত্তিরে আনুদার খোঁজে বেরিয়েছিলে। হয় সেটা আনুদার সঙ্গে ছিল, নয় তো তুমি ওর ব্যাগ থেকে নিয়ে এসেছিলে। জামাইবাবুকে ফাঁসানোর জন্য গাড়ির ভেতর রেখে দিয়েছিলে।

তুই একটা পাগলি। প্রিয়র সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা?

কর্নেল হা-হা করে হেসে বললেন, তা হলে পিউয়ের সিদ্ধান্ত, মিঃ সেন ডেডবডিটা ফেলে দিয়ে এসেছিলেন!

গণনাথ সায় পেয়ে বললেন, বলুন আপনি! কী বলছে তা জানে না। আনুর বডি বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে? দ্যাখ পিউ তুই আগাগোড়া ছিলি সেদিন। আমি প্রথমে পুলিশকে প্রিয়র কথা বলেছিলুম কি না বল। অনেস্টলি বল! কে বলল রক্তক্ত, গাড়ির কাঁচভাঙা, এসব কথা?

পিউ বলল, বুড়োদার বুদ্ধিসুদ্ধি না থাকতে পারে, তুমি ট্যাক্স করলেই পারতে!

ইম্পসিবল! পুলিশ রক্তের কথা শুনেই জিপ ছোটাল। আই ওয়াজ হেলপূলেস! গণনাথ মুখে দুঃখের ছাপ এনে বললেন। তাও প্রিয় বেঁচে যেত। কারণ গাড়ির ওখানে রক্তের দাগ তখন ছিল না। কিন্তু প্রিয়র পকেটে আনুর লেখা চিঠি, তারপর গাড়ির ভেতর ফায়ার আর্মস! আমি কী করতে পারি?

কর্নেল বললেন, ফায়ার আর্মসটা কি আপনি দেখেছেন মিঃ সেন?

নাহ্। গণনাথ মাথা নেড়ে বললেন, এটা একটা পুলিশ কেস! ভুলে যাবেন না। সবটাই ওদের হাতে।

আপনি অনির্বাণবাবুর ফায়ার আর্মসটা দেখেছেন নিশ্চয়?

নেভার। ছিল, জানতুম–দ্যাটস মাচ। আমি ছবি ছাড়া কিছু বুঝি না। অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। আপনি আমাকে যাই ভাবুন। আই অ্যাম টপ টু বটুম্ আ ফিল্মমেকার। গণনাথ সিগারেটটা পিচে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, সে জন্যই আপনার হঠাৎ ওই অদ্ভুত কথাটা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলুম। তারপর আমার রাগ হল। চার্জ করতে ছুটে এলুম। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি!

থ্যাংকস মিঃ সেন! চলি। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন। পিউ এগিয়ে গেল।

গণনাথ ডাকলেন, শুনুন।

 বলুন মিঃ সেন।

আনুর কিলারকে আপনি খুঁজে বের করতে পারলে ইউ উইল বি রিওয়ার্ডেড!

আমি নেচারিস্ট, মিঃ সেন! ডিটেকটিভ নই। আই রিপিট, কথাটা গালাগালি।

ইউ আর আ স্ট্রেঞ্জ ম্যান!

আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

বেশ। কিন্তু এই কেসে আপনার কী ইন্টারেস্ট?

 প্রিয়র দাদামশাই আমার বন্ধু।

গণনাথ শুকনো হেসে পা বাড়ালেন। কর্নেল তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। পিউ সামান্য এগিয়ে একটা ঝোপ থেকে ফুল ছিঁড়ছে। হঠাৎ কর্নেল ডাকলেন, মিঃ সেন! আর একটা কথা। কেয়া সম্পর্কে।

গণনাথ দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেন।

কেয়া সেনকে আপনি চিনতেন। সম্পর্কে আপনার বোন ছিল সে।

 কিছুক্ষণ পরে গণনাথ বললেন, ইউ নো মেনি থিংস।

 ইয়া। দ্যাটস মাই হবি–টু নো অ্যাবাউট দা পিপল হু আর কিলড!

 কেয়া ওয়াজ নট কিলড। জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট।

 কেয়াকে ধাক্কা মেরে কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ইউ নো দ্যাট ওয়েল!

গণনাথ নিষ্পলক তাকালেন। পুরু চশমার কাঁচে সোনালি রোদ্দুর ঠিকরে পড়ল।

কর্নেল একটু হাসলেন। কেয়া তার কোম্পানির কিছু গোপন তথ্য জানত। মৃত্যুর আগে সেই আপনাকে আপনার ছবির ফিন্যান্সার জুটিয়ে দিয়েছিল। কারেক্ট?

গণনাথ কোনও জবাব দিলেন না।

কেয়ার দেওয়া গোপন তথ্যের জোরে তো বটেই, তা ছাড়া আপনার এক আত্মীয় এস এন সেন বোম্বে ডকে কাস্টমস অফিসার-আপনিও মোহনলাল গণেশলাল কোম্পানিকে দোহন করে আর্ট ফিল্মের খেলায় নেমেছেন এবং এ জন্যই আপনার বডিগার্ড দরকার হয়। কর্নেল আঙুল তুললেন বাংলোর দিকে। আপনার নতুন বডিগার্ড নজর রেখেছে। লুক! কিন্তু মিঃ সেন, মানুষ স্বভাবত। একচক্ষু হরিণ। বড্ড বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন। সে জন্যই বলেছি, আপনি বিপন্ন।

গণনাথ একটু কাসলেন। কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করলেন। কিন্তু বললেন না।

ইটস আ ডেঞ্জারাস গেম, মিঃ সেন!

বলে কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। কিছুটা এগিয়ে একবার ঘুরে দেখলেন, গণনাথ ব্রিজের রেলিং ধরে নীচে জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। পিউ খুশিখুশি মুখ করে বলল, হেভি দিয়েছেন কর্নেল! সত্যিই আপনি এক আশ্চর্য মানুষ। রাণুদি আপনার সম্পর্কে বলত। আমি ভাবতুম, গল্প! সে হাসতে লাগল। হেভি শ! এক্কেবারে ফ্ল্যাট হয়ে গেছে গণাদা।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, এ বয়সে উত্তেজনা মানুষকে ক্লান্ত করে। বার্ড স্যাংচুয়ারি আজ বরং থাক, ডার্লিং! খিদেও পেয়েছে। ফেরা যাক।

পিউ বলল, আমারও মুড নেই। বিবিকে গিয়ে কতক্ষণে সব বলব তাই ভাবছি। কিন্তু তা হলে দেখুন, আমি বলেছিলুম গণাদা হিপোক্রিট। মিলে গেল!

কর্নেল রাস্তার ধারে ঝোপে একটা প্রজাপতি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। হাতের স্টিক থেকে নেট বেরুতেই প্রজাপতিটা উড়ে গেল। ধূসর রঙের প্রজাপতি, ডানায় কালো এবং লাল ফুটকি।

পিউ বলল, আপনার সেই মাফিয়া লিডার নাকি? ও কর্নেল!

 নাহ।

আপনাকে ভীষণ পামকিন দেখাচ্ছে কিন্তু!

 হোয়াটস দ্যাট, ডার্লিং?

বুড়োদার টার্ম। কী আশ্চর্য! আপনাকেই তো বলছিল ঠাকুর্দার পামকিন ফেস!

হুঁ, মনে পড়ছে। তোমাকেও বলেছিল পামকিন ফেস।

বাট নাও আই অ্যাম হ্যাপি। আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। ফিরে গিয়ে বুড়োদার ঘরে টেপ চালিয়ে দেব। ব্রেকড্যান্স, কর্নেল! ফানি বাট একসাইটিং! ড্যান্স টিল ইউ ডাই।

গণনাথ সেনের লেখা চিঠিটা কেয়ার কিটব্যাগ থেকে আত্মসাৎ করার পর থেকে যে উত্তেজনা জমে উঠেছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটার ফলে এই ক্লান্তি। ঘরে ফিরে আবার চিঠিটা খুলে পড়লেন কর্নেল! স্পষ্ট করে কিছু না লিখলেও আভাস আছে, কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছবির জন্য টাকা ঢালতে রাজি হয়েছেন। সে জন্য কেয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাকে বলেছিলাম, ক্যামেরা আমার কলম। দেখবে কী করি। তবে তুমি সাবধানে থেকো। আমিও তোমার কথামতো সাবধানে এগোব। তুমি সত্যেনের কথাও বলেছিলে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সত্যেন বোম্বের ডাক এরিয়ার চার্জে আছে। তোমার কোম্পানির বড় কর্তা হাতে স্বর্গ দেখলেন। কাস্টমসের এস এন সেন আমার ভাই শুনে প্রচণ্ড খাতির হল। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ রইলাম। দেখিয়ে দেব আর্ট ফিল্ম বলতে কী বোঝায়…ইনল্যান্ড চিঠিটা সেপ্টেম্বরে লেখা। কেয়া মারা যায় অক্টোবরের গোড়ায়। বোকা মেয়ে!

অরীন্দ্র এলেন। দুঃখিত মুখে বললেন, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হচ্ছে না। বেড়ানো হচ্ছে না। মনমেজাজ ভাল নেই। চুপচাপ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। আজ কতদূর ঘুরলেন?

ইরিগেশন বাংলো পর্যন্ত। রাণুর শরীর কেমন?

অরীন্দ্র আড়ষ্টভাবে হাসলেন। শি ইজ অলরাইট। আসছে দেখা করতে।

আজ গঙ্গাস্নানে যাননি?

সব ছাড়তে পারি, ওটা নয়। রাণুরও তা-ই। আছাড় খেয়ে কপালের একটা পাশ একটু ফুলে উঠেছিল। এখন কমে গেছে। অরীন্দ্র কর্নেলের দিকে তাকালেন। আপনাকে বড় গম্ভীর দেখাচ্ছে। কী ব্যাপার?

কর্নেল পোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ঘসে নিভিয়ে বললেন, একবার আশাপুরা যাব। আপনার সেই অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা দরকার।

অরীন্দ্র একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আপনি সহজে ছাড়তে চাইবেন না, আই নিউ দ্যাট। ঠিক আছে। লিখে নিন, এম আর সিনহা। মহিমারঞ্জন সিনহা। বাঙালি। আপনার কথা বলেছি ওঁকে। হুঁ–এইট, চুড়িওয়ালা লেন, আশাপুরা। এটা বাড়ির ঠিকানা। গিয়ে আর বাড়িতে পাবেন না। কোর্টের বার লাইব্রেরিতে পেয়ে যাবেন। খুব নামকরা ল’ইয়ার। এক সময় হোল বিহারে উকিল ডাক্তার এসব বলতে শুধু বাঙালিই বোঝাত। এখন আর বাঙালির সে রোয়াব নেই। টিমটিম করে জ্বলছে। বুড়ো আর রাণু প্রায়ই আমাকে সাধে, কলকাতায় চলে যাই ঘরবাড়ি বেচে। মাথা খারাপ? আমি মরলে তোরা যাস। তার আগে নয়। আপনি যাই বলুন, কলকাতা আস্ত একটা পাগলা গারদ। গেলেই আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যায়। অবশ্য আপনার নার্ভ স্ট্রং।

কর্নেল বললেন, বাসেই যাই বরং।

হুঁ। বাস ভাল। কিন্তু বড্ড ভিড় হয়। সে জন্য আমি ট্রেনে যাই। সময় লাগুক, কমফোর্টেব জানি!

বেরুনোর সময় রাণু এলেন। বাঁ কপালের একখানে ইঞ্চিটাক বাদামি রঙের ছোপ লক্ষ করলেন কর্নেল। সাত্যকির ঘুসির চিহ্ন। ছেলেটা গোঁয়ার। ঘুসি লড়িয়েরা এমনই হয় নাকি। কর্নেল বললেন, সুশীলা বলছিল জ্বর। পরে শুনলুম বাথরুমে আছাড় খেয়েছে। একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো। পিউয়ের মতো। জগিং করতে হলে রাস্তাই নিরাপদ।

রাণু একটু হাসলেন। আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

একটুও না। খাসা রেখেছে। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, একবার আশাপুরা। ঘুরে আসি।

অরীন্দ্র গাড়ি বারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে রইলেন। রাণু কর্নেলকে এগিয়ে দিতে গেলেন। লনে গিয়ে আস্তে বললেন, প্রিয়র কীর্তি তো শুনেছেন ঠাকুর্দার কাছে। প্রিয় বলেছে, সে-ই গুলি করে মেরেছে লোকটাকে। ঠাকুর্দাকে তো জানেন। খুব টনটনে নীতিবোধ। ওই যে বলেছেন, আমি আর ওতে নেই, তো নেই-ই।

সেই পাখিটা আবার কুক্কু করে ডাকছে কোথায়। বাইনোকুলারে তাকে খুঁজতে থাকলেন কর্নেল। মনে হচ্ছে, মাথার ভেতর দিক থেকে কাকটা আসছে। প্রকৃতি বিস্ময়কর ধ্বনিপুঞ্জ সাজিয়ে রেখেছে সবখানে। মানুষ তা সাধ্যমতো কুড়িয়ে নিয়েছে। মানুষের ভাষা জিনিসটাই আসলে লক্ষ বছর ধরে প্রাকৃতিক ধ্বনিপুঞ্জ থেকে তিলে তিলে সংগৃহীত। পাখিটা এবার অন্য কোথাও ডাকছে। কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন, রেয়ার স্পেসিস্? আশ্চর্য লাগে। মানুষের নাকের ডগায় কত বিস্ময়কর জিনিস থেকে যায়, খেয়াল থাকে না।

রাণু কথাটায় কান দিলেন না। আরও চাপাস্বরে বললেন, প্রিয়র আসল কীর্তি এখনও ঠাকুর্দা জানেন না। জানলে. কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। তাই ভয়ে চুপ করে আছি। চলুন, বলছি।

গেটের কাছে গিয়ে কর্নেল তার দিকে তাকালেন। পাখিটা সমানে ডাকছে। অথচ খুঁজে পেলেন না।

রাণু বাড়ির দিকটা দেখে নিলেন। মুখে উত্তেজনা থমথম করছে। ফিসফিস করে বললেন, প্রিয়র ওই পিস্তলটা, বউকে যেটা লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল শুনলুম…

ওটা পিস্তল নয়, রিভলভার।

তা-ই। আমি ওসব চিনি না। রাণু তেতো মুখে বললেন, তবে প্রিয়র দোষ নেই। ওই হারামজাদি মেয়েটাই–প্রিয়র বউ প্রিয়কে তাতিয়েছিল, এখন বুঝতে পারছি। ঠাকুর্দার ওই এক রোগ। কলকাতা থেকে আধুনিকা নাতবউ এল। অমনি তাকে ফ্যামিলির হিসট্রি শোনাতে বসলেন। তারপর এ ঘর থেকে সে ঘর সঙ্গে নিয়ে ধনসম্পত্তি দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। আপনার অরণ্যদেবের ঘরে পর্যন্ত ঢোকালেন।

বিজয়েন্দুকে কর্নেল ঠাট্টা করে ‘অরণ্যদেব’ বলতেন। রাণু হঠাৎ থেমে গেলে বললেন, হুঁ বলো।

রাণু মুখ আরও বিকৃত করে বললেন, প্রিয় এতদিন এসেছে। জানে ও ঘরে বন্দুক-পিস্তল আছে। কখনও ও ঘরে ঢোকেনি। ওই মক্ষীরানীই জিনিসটা কখন হাতিয়ে প্রিয়কে দিয়েছিল ওই লোকটাকে খুন করতে।

রিভলভারটা? বলে কর্নেল আবার বাইনোকুলারে পাখিটাকে খুঁজলেন। পাখিটা তার সঙ্গে কি লুকোচুরি খেলতে চায়?

আপনি খেয়াল করে শুনছেন না আমার কথা। রাণু অভিমানী স্বরে বললেন। ওটা বুড়োর জামাইবাবুর রিভলভার। সব ঘরের চাবি থাকে আমার কাছে। রাত্তিরে বালিশের তলায় রাখি। কাল ঠাকুর্দার মুখে প্রিয়র কাছে রিভলভার না পিস্তল ছিল শুনে একটু সন্দেহ হল। ঘর খুলে আলমারি দেখলুম। আপনি তো দেখেছেন, কাঁচের আলমারিতে সব সাজানো আছে। রাইফেল তিনটে আছে। দোনলা একনলা বন্দুক দুটো আছে। শুধু ওইটে নেই। প্রথমে সন্দেহ হল পিউকে। সে আমার ঘরে শুয়েছিল। পিউকে দিয়ে চাবি চুরি করিয়ে বিবি ওটা হাতায়নি তো? বিবির যা মেজাজ। কেলেঙ্কারি বাধাবে–চোরের মায়ের বড় গলা! তাই চুপি চুপি বুড়োকে বললুম সব কথা। বললুম, পিউয়ের সঙ্গে তোর খুব ভাব হয়েছে। কোনও ছলে জেনে নে তো পিউয়ের কাছে। আর অমনি বুড়ো রেগে বোম। পিউয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে বলেছি! আমাকে মারতে এল।

কর্নেল হাসলেন। মেরেও বসল, বলো। তোমার কপালের ওই দাগটা।

রাণু গুম হয়ে বললেন, ঠাকুর্দা জানলে সর্বনাশ হবে। আপনি আমার ভরসা। বলে চোখ মুছলেন। কী বলব? নিজের ভাই। ঠাকুর্দার কিছু হলে ও ছাড়া তো এ সংসারে আমার আর কেউ নিজের বলতে নেই… ।

.