পিছনে পায়ের শব্দ – ১৮

১৮.

সাত্যকির সেন্টিমেন্টে লাগতেই পারে। পিয়ালি তার প্রেমিকা। পিউ তার সঙ্গে জগিং করে, তার ঘরে আড্ডা দেয়, কি মেলামেশা করে–পিউয়ের মতো মড টাইপ মেয়ে, যে নিজেকে ‘পার্সন’ ঘোষণা করে কথায় কথায়, সে নিঃসংকোচে তার কাঁধে বা হাতে হাত রাখতেও পারে। তার মানে এই নয় যে, পিউ তার প্রেমে পড়েছে, অথবা সাত্যকিও পিয়ালিকে ছেড়ে পিউয়ের প্রেমে পড়েছে। ভুল বোঝাবুঝি এখানেই হয়েছে সম্ভবত। রাণুর মধ্যে গ্রাম্যতা আছে, কর্নেল লক্ষ করলেন। পিউয়ের সঙ্গে ভাব আছে বলায় সাত্যকি খেপে গিয়েছিল। গোঁয়ার দুর্দান্ত প্রকৃতির ছেলে সে। ঘুসিলড়িয়ে হয়ে ওঠাই তার স্বপ্ন। একজন ঘুসিলড়িয়ের জীবনে তার শরীরটাই হয়ে উঠতে পারে দুটো হাতের মুঠি। এক মুঠি দিয়ে নিজেকে বাঁচাও, অন্য মুঠি দিয়ে অন্যকে মারো। যুগপৎ ডিফেন্স অফেন্স প্রক্রিয়া। গণনাথ যেমন লিখেছিলেন কেয়াকে, ক্যামেরা আমার কলম, তেমনই সাত্যকির বেলায় তার দুটি হাত তার মন। মনে ঘা লাগলেই তার দুটি হাত কাজ করে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সময়মতো দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে–অথবা নিয়েছে। তাড়া থাকায় কর্নেল বেশি কিছু জানতে চাননি।

তা হলে প্রিয়র রিভলভারটা বিজয়েন্দুর!

তা যদি হয়, তা হলে গাড়ির ভেতরে পাওয়া রিভলভার বা পিস্তলটা অনির্বাণের কি? পিউ গণনাথকে চার্জ করছিল, উনিই অনিবার্ণের খোঁজে বেরিয়েছিলেন এবং তার কিটব্যাগ থেকে অস্ত্রটা খুঁজে নিয়েছিলেন। এতে একটা যুক্তি আছে। গণনাথ জানেন, যে কোনও মুহূর্তে তার বিপদ হতে পারে। তাই সশস্ত্র বেরিয়েছিলেন। সম্ভবত প্রিয়র গাড়ির কাছে গিয়ে অনির্বাণ সোমের ডেডবডি দেখতে পান। তখন প্রিয়কে ফাঁসানোর জন্য অস্ত্রটা গাড়ির ইঞ্জিনের। ভেতর রেখে দেন। হুঁ, পিউ একটা পয়েন্ট তুলেছে।

আর ব্ল্যাকমেলাররা প্রতিদ্বন্দ্বী পছন্দ করে না। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কোম্পানির পক্ষ থেকেও দ্রুত সহযোগিতা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। অনির্বাণের ডেডবডি গণনাথ নিজে বয়ে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার দহে ফেলতে না পারেন, কারও সাহায্য নেওয়া কি অসম্ভব? রামলাল আছে। অভাবী লোক। তাগড়াই বলিষ্ঠ গড়ন। বখশিসের লোভে কাজটা তাকে দিয়েও করানো যায়। রাজেশ শর্মাও ছিলেন বাংলোয়। পিউ হয়তো ঠিকই ধরেছে।

প্রিয়র রিভলভারটা চীনা। কাজেই, ওটার লাইসেন্স থাকতে পারে না। বিজয়েন্দুও কি একটা বেআইনি রিভলভার আলমারিতে রেখেছিল? অবশ্য অরীন্দ্র বসু প্রভাবশালী মানুষ ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে। তা ছাড়া বিহার মুলুকের কারবার। কাগজে প্রায়ই বন্দুকবাজির খবর বেরোয়। জাতপাতের দাঙ্গায় বেপরোয়া বন্দুকবাজি চলে।

কর্নেল জানেন, অস্ত্র আইন অনুসারে লাইসেন্সড আর্মসের লাইসেন্স প্রতি বছরের শেষে রিনিউ করাতে হয়। শিকারী বিজয়ের মৃত্যুর পর অরীন্দ্র তদ্বির করে নাতজামাইয়ের স্মৃতি হিসেবে সেগুলো রাখার জন্য নিজের নামে লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু রিভলভারটা…

চমকে উঠলেন কর্নেল। রিভলভারটা রাণু দেখেননি, অরী তো দেখেছেন। বিজয়েন্দুর অস্ত্র তার চেনার কথা। তিনি যে প্রকৃতির মানুষ, তখনই হই-চই বাধিয়ে বসতেন। অথচ তার প্রতিক্রিয়াটা সেদিক থেকে ঘটল না। কেন?

নাকি চেপে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা–কোনও কারণ আছে চেপে যাওয়ার?

কাল আশাপুরা থেকে ফেরার পর থেকে অরীন্দ্র কেমন বদলে গেছেন। বলছেন, ছেড়ে দিন। এটা একটু অস্বাভাবিক। নীতিবোধ যত কড়া হোক, প্রিয় তাঁর মেয়ের একমাত্র সন্তান।…

আ গেয়া সাব। রিকশোওলা রিকশো দাঁড় করাল। উও দেখিয়ে লালজিকা সাইকিলকি দুকান।

পশ্চিমবাংলার মফঃস্বল শহরগুলোর তুলনায় বিহারের শহর আজকাল অনেকখানি আধুনিক জেল্লায় ঝলমলে। অনেক বেশি স্মার্ট। মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানির সাইনবোর্ডটাও দেখার মতো। একেবারে ওয়েস্টার্ন ডিজাইনের শো-রুম, সেলস কাউন্টার, অফিস নিয়ে লম্বাটে বাড়ি। সামনে খোলা চত্বরে কিছু বাগিচা। এনিটা আশাপুরার এক্সটেনশন এরিয়া। জংশনের রেলইয়ার্ড দেখা যায় সামান্য দূরে। তার ওধারে গঙ্গা।

কর্নেল শোরুমের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। নানা ধরনের সাইকেল নানা রকমভাবে সাজানো। একেক ভঙ্গিতে একেক গতিছন্দের আভাস। ডিজাইনারের শিল্পবোধ প্রশংসাযোগ্য। এক অনবদ্য ব্যালে রূপ নিয়েছে শোরুমে। কর্নেলের মুখেচোখে মুগ্ধতা ফুটে উঠল। প্রকৃতিতে মাঝে মাঝে যে কারুকর্ম দেখেন, তার প্রতিবিম্ব। মানুষ যা কিছু করে, সবই প্রকৃতির অনুকরণ। সেলগ্রুমে ঢুকলেন। কিছু খদ্দেরের ভিড় আছে। আজকাল সবখানেই দেহাতি মানুষজনের নিদেনপক্ষে একটা সাইকেল চাই-ই। কর্নেলকে দেখে এক সেলসম্যান আইয়ে আইয়ে করে ছুটে এল। সে ধরেই নিয়েছিল এই বুড়ো সায়েব লোক তার নাতি-নাতনীর জন্মদিনে উপহার কিনতে এসেছেন। বাচ্চাদের সাইকেলের শো-রুমের দিকে যেতে অনুরোধ করল। কর্নেল ভারিক্কি চালে বললেন, মিঃ রাজেশ শর্মাকা সাথ দেখা করেঙ্গে।

লোকটিও গম্ভীর হয়ে বলল, অফিস হ্যায়। অফিসমে যাইয়ে!

অফিস ওয়েস্টার্ন মডেলের। কয়েকটি কম্পিউটারও আছে টেবিলে-টেবিলে। সামনে স্মার্ট চেহারার যুবক ও যুবতী। রোবোটের মতো যান্ত্রিক আচরণ। কোনও বেয়ারা নেই দিশি আপিসের মতো। কর্নেল এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিলেন। আস্তে একটু কাসলেন। তখন এক যুবতী মার্কিন আনুনাসিক উচ্চারণে বলল, ক্যান আই হেল ইউ স্যার?

মিঃ রাজেশ শর্মা…

হি ইজ ন্যাও আউট্রা স্টেশন।

 মিস কেয়া সেন…

যুবতী কলিগদের দিকে তাকিয়েছিল। হু ইজ শি?

সবাই মুখ তাকাতাকি করছিল। এক যুবক একটু হেসে বলল, সরি টু ইনফরম ইউ শি ইজ ডেড।

ও মাই গড! কর্নেল চমকে ওঠার ভঙ্গি করলেন।

 আ ট্র্যাজিক অ্যাকসিডেন্ট, সো ফার আই নো।

 আবার সবাই কাজে মন দিল। কোণের দিকে এক যুবতী আপনমনে টাইপ করছিল। কর্নেল তার কাছে গেলে সে মুখ তুলল। কর্নেল বললেন, আই ওয়ান্ট টু মিট দা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। তারপর নিজের নেমকার্ডটা দিলেন।

প্লিজ ওয়েট আ মিনিট। বলে সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকল। কিন্তু এক মিনিট নয়, আধ মিনিট পরেই সে বেরিয়ে কর্নেলকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। একটা সুশৃঙ্খল যান্ত্রিকতা ম্যানেজার রাজেশ শর্মাকেই চিনিয়ে দিচ্ছে সম্ভবত।

এ ঘরে ঢুকেই কর্নেল বোর্ডে নামটা দেখে নিয়েছিলেন। বি এন দুবে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। টাই-স্যুট পরা গুফো লোক। বনোয়ারিলালের উল্টো বলা চলে। কর্নেলকে একটু অবাক করে ইংরেজিতে বললেন, আমিনগঞ্জ থেকে গতকাল বনোয়ারিজি ফোনে আমাকে বলেছেন, কলকাতার এক কর্নেলসায়েব রেসিং সাইকেল কিনতে আসতে পারেন। আপনি শোরুমে দেখুন। পছন্দ হয়ে যাবে। এক্সপোর্ট কোয়ালিটির চেয়ে স্থানীয় বাজারে আমরা যা বেচি, সেগুলো অনেক ভাল। স্থানীয় প্রতিযোগিতায় না টিকতে পারলে বিদেশের মুখ তাকিয়ে কোনও লাভ নেই। দেশের বাজারে বছরে প্রায় বিশ লাখ বিক্রি হয়। সেখানে বিদেশে আর কত? কদাচিৎ দেড় থেকে দু লাখ। চা বলি?

কর্নেল মাথা নাড়লেন। ধন্যবাদ! আমার পরিচিত একটি মেয়ে কেয়া সেন আপনাদের এখানে কাজ করত। সে বলেছিল, ওর কোম্পানির সাইকেল কিনলে একটু সুবিধে করে দেবে। তো শুনে দুঃখ পেলুম, সে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কী করে দুর্ঘটনা ঘটল জানেন কি? আহা, বড়ো ভাল মেয়ে ছিল।

 দুবে বাঁকা হাসলেন। সে মোটেও ভাল মেয়ে ছিলনা।

সে কী! কেন একথা বলছেন?

কারণ আছে বলেই বলছি। যাই হোক, চলুন। আপনাকে সাইকেল দেখাই। দূরে উঠে দাঁড়ালেন। বনোয়ারিজির চেনা লোক আপনি। দরদামে অসুবিধে হবে না। কেয়া সেনের চেয়ে বোয়ারিজির কথা আমার কাছে মূল্যবান।

দুবে অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠলেন। কর্নেল বসে রইলেন। বললেন, কেয়ার ব্যাপারটা…

তার কথার ওপর দুবে ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনি সাইকেলের চেয়ে কেয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। বনোয়ারিজি আমাকে বলেছেন।

আমার খুব চেনাজানা মেয়ে ছিল, মিঃ দুবে!

দুবে বসলেন। তারপর টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে এসে আস্তে বললেন, আপনি এলে বনোয়ারিজি আমাকে একটা বোঝাপড়া করে নিতে বলেছেন। তবে আপনার সৌভাগ্য, শর্মাজি বাইরে। না হলে বোঝাপড়াটা অন্য ধরনের হত।

কর্নেল তাকালেন। কোনও কথা বললেন না।

দুবে সেই রকম বাঁকা হাসলেন। কেয়ার ব্যাপারে কিছু প্রমাণ করা যাবে না।

কর্নেল চুরুট বের করে ধরালেন। তারপর বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আমরাও বুঝতে পারছি না আপনি কেন এতদিন পরে কেয়ার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন। দুবে সোজা হয়ে বসলেন। কেয়ার এক আত্মীয় আমিনগঞ্জে ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। কিন্তু তার সাহস নেই বা সাধ্যও নেই ডিটেকটিভ ভাড়া করে।

মিঃ দুবে, আমি ডিটেকটিভ নই। কথাটা একটা গালাগালি। শুনলে দুঃখ পাই।

দুবে একটু মেজাজ দেখিয়ে বললেন, বোঝাপড়ায় আসুন। তবে একটা শর্ত, কে আপনাকে ভাড়া করেছে, জানা দরকার।

তার আগে আমার জানা দরকার, বোঝাপড়া বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি!

টাকাকড়ি। দুবে ড্রয়ার থেকে একশো টাকার নোটের একটা বান্ডিল বের করে টেবিলে রাখলেন। এবার বলুন!

কর্নেল একটু হাসলেন। তা হলে বোঝা গেল, কেয়া সেনের মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা নয়।

ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ হবে না। কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। আমরা শুধু জানতে চাই কে আপনাকে ভাড়া করেছে। দুবে নোটের বান্ডিলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরলেন। যেন মুখের ওপর ছুঁড়ে দেবেন।

দুঃখিত মিঃ দুবে! ভাড়া কথাটাও গালাগাল।

আপনি দেখছি গভীর জলের মাছ। দুবে নোটের বান্ডিলটা তুলে বললেন, এতে দশ হাজার টাকা আছে। আপনার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। আমরাও প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নিই। সব কোম্পানিই নেয়। কাজেই বুঝতে পারছেন, এর অর্ধেক দিলে আমরা তথ্যটা পেয়ে যাব। আপনি ভুল করলেন। ঠিক আছে। আসুন!

কর্নেল মুখটা যতটা সম্ভব তুম্বো করে বললেন, আপনারাও ভুল করলেন। আমাকে, ডিটেকটিভ বললেন। কথাটা বিশ্রী গালাগালি। অপমানজনক।

তারপর বেরিয়ে এলেন। জোরে হেঁটে সেলস্ কাউন্টার পেরিয়ে চত্বরে নেমেছেন, পিছনে কেউ ডাকল, হ্যাল্লো মিস্টার!

ঘুরে দেখলেন দুবে হন্তদন্ত আসছেন। কর্নেল দাঁড়ালেন। দুবে কাছে এসে চাপাস্বরে বললেন, শিগগির আশাপুরা ছেড়ে চলে যান। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আর কখনও…।

হাত তুলে কর্নেল বললেন, শাসানোর জন্য কষ্ট করে ছুটে আসার দরকার ছিল না মিঃ দুবে! সেটা আমি বুঝে গেছি।

দুবে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। আমাদের লোক আপনাকে একঘণ্টা পরে আশাপুরায় দেখলে খতম করে ফেলবে। পুলিশের ভরসা করবেন না। চলে যান।

কর্নেল কাচুমাচু মুখ করে ঘড়ি দেখলেন। বললেন, ঠিক আছে। বরং একটা রিকশো করে বাস স্টেশনে চলে যাই দুবেজি। পথে শুধু এক বন্ধুকে দেখা করে যাব। কথা দিচ্ছি, একঘণ্টার বেশি সময় নেব না।

দুবে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল একটা সাইকেলরিকশো থামিয়ে উঠে বসলেন। চাপাস্বরে বললেন, জলদি চনা ভাই। আদালতমে জানা পড়ে।

ঘুরে দেখলেন, দুবে তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে শাসালেন বটে, একটু ধাঁধায় পড়ে গেছেন। কেয়ার মৃত্যু সম্পর্কে কোম্পানির এখনও একটা স্পর্শকাতর জায়গা রয়ে গেছে। সে কি কেয়ার আরেক আত্মীয় বোম্বে ডক এরিয়ার কাস্টমস অফিসার এস এন সেনের কারণেই? গণনাথ সেনকে ছবির টাকা জোগান দিয়ে কোম্পানির দুটো লাভ হচ্ছে। গণনাথের মুখ বন্ধ থাকছে এবং কালো টাকার একটা সদগতি হচ্ছে।

কিন্তু সত্যেন সেন সম্ভবত এখনও জানেন না, কেয়া দুর্ঘটনায় মারা যায়নি এবং তাকে হত্যাই করা হয়েছে। কর্নেল একটু ভেবে নিলেন। দুবাইয়ের কনসাইনমেন্টটা তুরুপের তাস। যথাসময়ে ওটা খেলতে হবে। মালটা বোম্বে ডকে পৌঁছাক আগে। নয় তো সব খেলা ভেস্তে যাবে।

এবং তারও আগে দরকার তার ধারণাটি সত্যি কি না নিশ্চিতভাবে জানা। তা না হলে অপ্রস্তুত হবেন কর্নেল।

একটু পরে লক্ষ করলেন রিকশোর সামনে এবং পেছনে দুজন যুবক সাইকেল চেপে যাচ্ছে। একই সাইকেল, ‘রেডস্টার’। মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি। একটু সতর্ক হলেন কর্নেল। কোর্ট এলাকায় পৌঁছে দেখলেন, ওরা একটা শিরীষগাছের তলায় সাইকেল দাঁড় করিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসল। দু-জনেরই পঁচিশের মধ্যে বয়স। আজকাল বদমাইসির জন্য পালোয়ান দরকার হয় না। রোগাভোগা ছেলে-ছোকরা নির্বিকার মুখে খুনখারাপি করে। দুবে তার মতো বুড়োথুড়ো টিকটিকির জন্য তাগড়াই খুনে পাঠাননি আর কী! কর্নেল আপন মনে একটু হাসলেন। বার লাইব্রেরির দিকে যেতে যেতে একজনকে মহিমাবাবুর কথা জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, উও দেখিয়ে উনকা মুহুরিবাবু। উনকো পুছিয়ে। বার লাইব্রেরির বারান্দায় মহিমারঞ্জন সিনহার মুহুরিবাবু দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বাঙালি। কর্নেলকে ঘুপচি একটা ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি। সেটাই সিনহাবাবুর আদালতি আপিস।

খবর পেয়ে অ্যাডভোকেট সিন্‌হা ব্যস্তভাবে এলেন। নমস্কার, নমস্কার! বোসসায়েব আপনার কথা বলেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হল। বসুন স্যার!

কর্নেল বললেন, বসব না। তাড়া আছে।

সে কী! প্রিয়বাবুর সঙ্গে মিট করে যান এখনই আমার ক্লার্ককে দিয়ে পারমিশান আনিয়ে নিচ্ছি। প্রিয়বাবু আপনার সঙ্গে মিট করতে চান। জেলহাজত বেশি দূরে নয়। ওই যে গির্জাঘর দেখছেন, তার পেছনে।

পাটনা থেকে মিসাইল এক্সপার্টদের রিপোর্ট এসেছে?

সিনহাবাবু বিরক্তমুখে বললেন, সি আই ডি ইন্সপেক্টরের কথায় মনে হল, এসেছে। কিন্তু চার্জশিট দেওয়ার আগে কপি তো পাওয়া যাবে না। এটাই প্রব্লেম। এস ডি জে এমের কোর্ট থেকে নিতে হবে। বোঝেন তো স্যার, আইন কানুনের টেকনিক্যাল ব্যাপার। তবে পয়সা ছাড়লে…যাক গে। তারক, কর্নেল সায়েবের জন্য চা নিয়ে এস।

নাহ্। চা খাব না। একটু নিরিবিলি কথা বলতে চাই, মিঃ সিনহা!

বেশ তো! চলুন! আমারও অবশ্য একটু তাড়া আছে। লাঞ্চের পর এজলাসে একটা হিয়ারিং আছে। আগামীকাল কোর্ট বন্ধ। ক্রিশমাসের পরব।

আদালত এলাকাটি বিশাল। এখানে-ওখানে থকথকে ভিড়। মানুষজনের জীবনের একটা নিষ্ঠুর ও কঠিন বাস্তবতাকে যে-কোনও আদালতের চৌহদ্দিতে পা দিলেই আঁচ করা যায়। মানুষকে বড়ো স্বার্থপর দেখায়। একটা মেহগনি গাছের তলায় গিয়ে কর্নেল বললেন, শুনলুম প্রিয় বলেছে সে গুলি ছুঁড়েছিল?

বলেছেন। তবে কোর্টে তা বলবেন না। আইনজীবী একটু হাসলেন। আমার তো মনে হল, দাদামশাইকে চটিয়ে দিয়ে জোক করছিলেন। বোসসায়েবকে তো জানেন! স্ট্রং মর্যালিস্ট মানুষ। বার বার এসে জিজ্ঞেস করছেন, বল তুই মেরেছিস নাকি। যাই হোক, ওটা কথার কথা।

গাড়িতে যে ফায়ার আর্মস পাওয়া গেছে, বডিতে পাওয়া গুলি সেটার না হলে প্রিয় বেঁচে যাবে। তাই তো?

অবশ্যই। আইনজীবী একটু গম্ভীর হলেন। ওটা পয়েন্ট বত্রিশ রিভলভার। একটু সমস্যা হবে যদি গুলিটা ওটারই হয়। কিন্তু তাতেও পুলিশ বেশি দূর এগোতে পারবে না। গাড়িতে মার্ডার উইপন পেল কখন, এটা দেখতে হবে তো! গাড়ি যখন গ্যারেজে ছিল, তখন পেল এবং পেল কারা? না–গ্যারেজের লোকে। কর্নেল সায়েব! প্রিয়বাবুকে আমি খালাস করিয়ে আনব। সারকামস্টেন্সিয়্যাল এভিডেন্স এই কেসে খুব উইক। প্রিলিমিনারি হিয়ারিঙের পর কেস সেসনে যাবে। যাক না। কেসের ভিত্তিটাই নড়বড়ে। একটা চিঠি দিয়ে মার্ডারের মোটিভ এস্টাব্লিশ করবে? ফুঃ।

কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, সি আই ডি পুলিশের কাছে শুধু অন্তত একটা কথা জানতে পারলে ভাল হত। গুলিটা কত পয়েন্ট রিভলভারের? ম্যানেজ করা যায় না এটা? সিনহাবাবু মুচকি হেসে বললেন, খুউব যায়। তবে একটু সময় লাগবে স্যার! আজকাল কত ইমপর্ট্যান্ট ফাইল অফিস থেকে বেমালুম নিপাত্তা হয়ে যাচ্ছে, তো এই সামান্য ব্যাপার। জাস্ট অ্যান ইনফরমেশন। আপনি বোসসায়েবের বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন।

বোসসায়েব কাল এসেছিলেন শুনলাম। প্রিয়র মামলা আর লড়তে চান না বলছিলেন।

খুব হাসলেন আইনজীবী। বরাবর ওই রকম মানুষ। তিন পুরুষ ধরে ওঁদের তিন পুরুষের আইনের লড়াই লড়ে আসছি স্যার! ওঁদের বংশের মতিগতি এ রকমই। আফটার অল নাতি-একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে। তাকে ফেলতে পারেন কখনও? আপনি বোসসায়েবের বুজম ফ্রেন্ড। আপনিও লক্ষ করে থাকবেন। মুখেই নাতি-নাতনীদের শাসান, কাকেও এক পাই পয়সার প্রপার্টি দেব না–সব লিখে দেব কোনও আশ্রমের নামে। তো লাস্ট সেপ্টেম্বরে বললুম, বোসসায়েব, বয়স তো অনেক হল। প্রপার্টির একটা বিহিত করে ফেলুন। বললেন, নাতনী রাণু ছাড়া কাকেও কিছু দেবেন না। কদিন পরে এসে বললেন, উইল লিখুন।

প্রপার্টির উইল রাণুর নামে একা?

না, না। শুনুন তো! উইল লেখা হল। রেজিস্ট্রি হল। কাল এসে বলেছেন, উইল খারিজের অ্যাপ্লিকেশন করুন। নতুন উইল লিখুন। প্রিয় খুনি। ওকে এক পয়সা দেব না।

আইনজীবী আবার হাসতে লাগলেন। কর্নেল বললেন, তাহলে রেজিস্টার্ড উইলে প্রিয়কেও প্রপার্টি দেওয়া আছে?

তিন নাতি-নাতনীর মধ্যে সমান সমান শেয়ার। সিনহাবাবু চাপাস্বরে বললেন। প্রপার্টি কম নয়। বসত বাড়ি ছাড়া সুদে-আসলে লাখ দশেক প্রায়। সব ভাল ভাল জায়গায় লগ্নি করা আছে। বছরে প্রচুর সুদ।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, উইলে কোনও বিশেষ শর্ত আছে নাকি?

আছে। বোসসায়েবের জীবদ্দশায় কেউ মারা গেলে বাকি দু’জনে হাফ হাফ পাবে।

চলি মিঃ সিনহা! কর্নেল পা বাড়ালেন। আপনি ওই ইনফরমেশনটা একটু শিগগির পাঠাতে চেষ্টা করবেন…।

কর্নেল একটা রিকশো ডাকতে যাচ্ছেন, তিরিক্ষি চেহারার যুবকটি চায়ের দোকান থেকে উঠে এল তার দিকে। একজন চাপা গলায় বলল, আবে শালে বুঢ়টে! এক ঘণ্টে হো গেয়া জলদি ভাগ।

কর্নেল করুণ মুখে বললেন, ভাস্তা হ্যায় বাবা! কৃপাসে একঠো রিকশা বোলাকে দো না! আভি জরুর বাসস্ট্যান্ড জায়েগা।

সে তখনই একটা রিকশা ডাকল। রিকশোওলা তার চেনা। তাকে হুকুম দিল, আবে ঝাকু! ইয়ে বুঢঢেকো বাসস্ট্যান্ড পচা দো। জাস্তি ভাড়া মাত লেনা বে! এক রুপৈয়া! হাঁ?…

.