বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ৪

০৪.

 নতুন জায়গায় গেলে আমার যা হয়। ঘুম আসতে চায় না। মশার উপদ্রব নেই। গরমও নেই। কারণ ঘরটা এয়ারকন্ডিশন্ড! রহস্যভেদী টেবিলবাতির আলোয় কী সব লেখালেখি করছিলেন, বোঝা গেল না। একবার দেখলাম, আস্তেসুস্থে উঠে বাথরুমে ঢুকলেন। সেই সময় বাইরে খুব চাপা যান্ত্রিক গরগর শব্দ শুনতে পেলাম। বাথরুমের দরজা বন্ধ বলে শব্দটা আর শোনা গেল না। পাশ ফিরে ঘুমুনোর চেষ্টা করলাম। বাথরুম খুলে উনি যখন বেরুচ্ছেন তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবার সেই শব্দ। ঘুরে বললাম-বাইরে যেন গাড়ির শব্দ শুনলাম?

কর্নেল শুধু বললেন–হুঁ।

কোনও অফিসার এলেন নাকি?

–আসতেই পারেন। কর্নেল টেবিলে ঝুঁকে পড়লেন। ফের বললেন–তেমন হোমরা-চোমরা কেউ এলেও এ ঘর ছাড়তে হবে না আমাদের। কারণ বাকি ঘরটাও এয়ারকন্ডিশন্ড।

এই বাংলোর এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্র নতুন মনে হচ্ছে।

—কেন?

–তেমন শব্দ করছে না। আপনার মনে পড়ছে? দরিয়াগঞ্জ বাংলোয় সারারাত কী শব্দ! শেষে বন্ধ করে জানালা খুলে দিতে হলো। চিন্তা করুন, তখন অক্টোবর মাস। কী মশা! কী মশা!

–কথা বললে আর ঘুমই আসবে না ডার্লিং।

–এমনিতেই ঘুম আসছে না।

বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করে এসো। বাঘ-ভালুক নেই। কৃষ্ণপক্ষ হলেও এতক্ষণে চাঁদ ওঠার কথা। বরং নদীর ধারে চলে যাও। মুগ্ধ হবে।

–আপনিও চলুন না!

–আমার হাতে জরুরি একটা কাজ। ছেড়ে গেলে খেই হারিয়ে যাবে।

একটু ইতস্তত করে উঠে পড়লাম। বেরুতে যাচ্ছি, কর্নেল বললেন–সঙ্গে টর্চ নিয়ে যাও। আর–তোমার ফায়ারআর্মসটা কি এনেছ?

–হ্যাঁ। ফায়ারআর্মস কী হবে?

-পাগলের পাল্লায় পড়লে তাকে ভয় দেখাবে। বলা যায় না, আবার কোনও পাগল পালিয়ে আসতে পারে। সাবধান! কর্নেল হাসছিলেন। কিংবা ধরো, বিষাক্ত সাপের পাল্লায় পড়লে অস্ত্রটা কাজ দেবে। গ্রীষ্মে সাপ বেরুনো স্বাভাবিক।

সাপের কথা ভেবেই রিভলভার আর টর্চ নিলাম। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি, ভোলা পাশের ঘরের দরজা থেকে সবে বেরুচ্ছে। আমাকে দেখে সে সেলাম। দিয়ে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল–কোথায় যাবেন স্যার?

–ঘুম আসছে না। নদীর ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।

–এত রাতে নদীর ধারে যাবেন?

–কেন? বাঘ-ভালুক তো নেই।

ভোলা কাচুমাচু মুখে হাসল।সাড়ে এগারোটা বাজে স্যার! জঙ্গল জায়গা। ওদিকটায় একসময় শ্মশান ছিল শুনেছি। রাতবিরেতে একা বেরুবেন? সঙ্গে যেতাম। বরং। কিন্তু কলকাতা থেকে এক সায়েব-মেমসায়েব এলেন এখুনি। ওই দেখুন ওনাদের জিপগাড়ি। চা-কফি খাবেন-টাবেন। আমার স্যার এই এক জ্বালা!

বারান্দা ঘুরে উত্তরে যাচ্ছি, ভোলা ফের বলল–গেটে তালা আছে স্যার! খুলে দিচ্ছি চলুন।

 ছোট্ট গেটের তালা খুলে দিল ভোলা। দুধারে ঝোপঝাড়। ঢালু হয়ে একফালি পায়ে-চলা পথ নেমে গেছে। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গেলাম। সামনে ফাঁকা ঘাসে-ঢাকা জমি। তারপর নদী। নদীটা ছোট। বালির চড়া পড়েছে। কিন্তু জল আছে। খুব ধীরে স্রোত বইছে। টর্চ নিভিয়ে আধখানা চাঁদের আলোয় আদিম প্রকৃতির রূপ দেখছিলাম।

সাপের ভয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে পায়ের চারদিকে টর্চের আলো ফেলছিলাম। একটু পরে ঘাসজমি থেকে নদীর শুকনো ঢালু খাড়ি দিয়ে নেমে বালির চড়ায় চলে গেলাম। হালকা এলোমেলো বাতাস বইছিল। বালিও শুকনো। বসে পড়লাম। ভোলা শ্মশানের কথা বলায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভূতে না বিশ্বাস করলেও ভূতের ভয় আছে। তা ছাড়া এই আদিম প্রকৃতিতে নিশুতি রাতে আবছা জ্যোৎস্নায়– সবকিছুই কেমন রহস্যময় মনে হয়। কোথাও রাতপাখি ডেকে উঠল। একটু পরে মাথার ওপর দিয়ে ক্রাও ক্রাঁও করে উড়ে গেল পাচা। সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, নদীর ওপারে গাছপালার ভেতর লালচে আলোর বিন্দু জুগজুগ করছে।

কেউ সিগারেট টানছে। কিন্তু এত রাতে জঙ্গলে এমে কেউ সিগারেট টানছে, এটা অস্বাভাবিক মনে হলো। ওপারে তো কোনও বসতি নেই। কোনও বাংলোও নেই যে আমার মতো কোনও বাইরের লোক অনিদ্রার কারণে বেড়াতে বেরুবে। চোরাই কাঠচালানকারী নয় তো?

একবার ভাবলাম, গিয়ে চার্জ করব। কিন্তু বালির চড়ার নীচে আন্দাজ পনের কুড়ি মিটার চওড়া জল। জলটা কত গভীর জানি না। এখান থেকে টর্চের আলোও অতদূর পৌঁছুবে না। খামোকা লোকটা সতর্ক হবে এবং পালিয়ে যাবে।

গুড়ি মেরে এপারে চলে এলাম। পাড়ে উঠে ঘাসজমি পেরিয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখলাম। একটা ছায়ামূর্তি সিগারেট টানতে টানতে জলের ধারে এল। সিগারেটটা জলে ছুঁড়ে ফেলল। জলের গভীরতা নিশ্চয় কম। কারণ সে জল পেরিয়ে বালির চড়ায় উঠল।

জ্যোৎস্নায় তাকে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। কোনও গ্রাম্য লোক নয়। পরনে প্যান্ট-শার্ট এবং হাতে লাঠির মতো কী একটা আছে। নদীর ঢালে এগিয়ে এসে সে ওটা কাঁধে তুললে বুঝতে পারলাম, ওটা বন্দুক।

পা টিপে টিপে বাংলোয় ওঠার রাস্তায় একটা ঝোঁপের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লাম। বন্দুকধারী লোকটার গতিবিধি সন্দেহজনক! সে এসে আমার নাকের উগা দিয়ে বাংলোর গেটে চলে গেল। একটু থমকে দাঁড়াল গেটের কাছে। তারপর টর্চ জ্বালল এতক্ষণে। সম্ভবত গেট খোলা দেখে সে অবাক হয়েছে।

তারপর সে গেট খুলে ঢুকে গেল এবং এবার আমাকে অবাক করে চেঁচিয়ে ডাকল–ভোলা! অ্যাই ভোলা।

ভোলার সাড়া পাওয়া গেল–কে? কাশেমবাবু নাকি?

কাশেমবাবু! তার মানে ফরেস্টগার্ড কাশেম, যার কথা ভোলা বলছিল। এ ও বলছিল, কাশেমের ডিউটি আছে নদীর ওপারে। সব রহস্য মাঠে মারা গেল। এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে।

ভোলা বলছে–নদীর ধারে কলকাতার এক সায়েবের সঙ্গে দেখা হয়নি? উনি তো কিছুক্ষণ আগে বেড়াতে বেরুলেন।

বনরক্ষী বলছে–কাকেও তো দেখলাম না।

–সে কী! সর্বনাশ! উনি গেলেন কোথায়? কর্নেল সায়েবকে খবর দিই।

–সেই কর্নেলসায়েব এসেছেন নাকি?

–হ্যা! ওনার সঙ্গেই এসেছেন আরেক সায়েব।

 বনরক্ষী চাপা গলায় বলে উঠল–টিকটিকি পাঠিয়েছে নাকি ওপর থেকে? সর্বনাশ হয়েছে। ভোলা। সেনসায়েবের আসার কথা! আসেননি?

–এসেছেন। এবার সঙ্গে মেমসায়েবও এসেছেন।

ওরা কথা বলতে বলতে ফুলবাগান পেরিয়ে বাংলোর বারান্দার দিকে যাচ্ছিল। বনরক্ষীর মুখে ‘টিকটিকি’ এবং ‘সর্বনাশ হয়েছে’ এই দুটো কথা শুনেই আমি সাড়া দিতে গিয়ে চুপ করেছিলাম। প্রথমে রহস্য নেই ভেবেছিলাম। কিন্তু রহস্য একটা আছে দেখা যাচ্ছে।

বারন্দা ঘুরে গিয়ে আমাদের রুমের দরজায় আস্তে নক করলাম। ভেতর থেকে কর্নেল বললেন–খোলা আছে।

ভেতরে ঢুকে চাপা গলায় বললাম–একটা অদ্ভুত ব্যাপার।

-পাগল, নাকি ভূত?

-নাহ্। বলে কর্নেলকে সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ দিলাম।

শোনার পর কর্নেল হাসলেন।-কাঠপাচার হবে ডার্লিং। কোনও এক সেনসায়েব সম্ভবত কাঠপাচার চক্রের চাঁই। বনরক্ষী কাশেমের সঙ্গে তার যোগসাজশ আছে বোঝা যাচ্ছে। সেনসায়েব চতুর লোক বলেই সঙ্গে মেমসায়েবকে এনেছে। সেই মেমসায়েব যে তার বউ, এ কথা হলফ করে বলা কঠিন।

-ভোলাও এর সঙ্গে যুক্ত।

জয়ন্ত, প্রাণের দায়ে বা চাকরির দায়ে আজকাল অনেক মানুষকে সব জেনেও মুখ বুজে থাকতে হয়।

-পুলিশে এখনই গিয়ে খবর দিয়ে আসা উচিত। হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে ওরা।

কর্নেল টেবিলের কাগজগুলো গুছিয়ে বললেন–কাঠপাচারের চেয়ে আমি এখন একটা মন্দিরের রহস্য দামী মনে করছি।

মন্দির। মন্দির কোথা থেকে এল?

 বরকধঝ কচতটপ থেকে!

–অ্যাঁ?

–হ্যাঁঃ।

 দরজায় নক করল কেউ। কর্নেল বললেন–খোলা আছে।

ভোলা ঢুকেই আমকে দেখে হাসল।–এসে গেছেন! ওঃ খুব ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম স্যার! গার্ড কাশেম এইমাত্র নদীর ওপার থেকে এল। জিজ্ঞেস করলে বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি।

কর্নেল বললেন–গার্ডরা রাতবিরেতে তোমাকে জ্বালাতে আসে দেখছি!

 ভোলা বিব্রতমুখে বলল–হ্যাঁ, স্যার! ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, চা খাব।

কাশেম চা খেতে এসেছে?

 –আজ্ঞে! বলে ভোলা বেরুনোর জন্য ঘুরল।

 –পাশের ঘরে কে এসেছেন ভোলা?

–সেনসায়েব স্যার! মিনিস্টারের সঙ্গে ওনার খাতির আছে। মিনিস্টার আমাদের কুমারচকের রাজবাড়ির লোক স্যার। তা তো জানেন! মাঝে মাঝে আসেন সেনসায়েব। এবার সঙ্গে মেমসায়েবও এসেছে।

-ঠিক আছে! তুমি এসো। এবার আমরা শুয়ে পড়ব।

দরজা লক করে কর্নেল শুয়ে পড়লেন। তারপরই ওঁর নাক ডাকা শুরু হলো! বরকধঝ-কচতটপ-এর সঙ্গে একটা মন্দিরের কী সম্পর্ক বুঝতে পারছিলাম না। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম।…।

ঘুম ভাঙতে বেলা হয়েছিল। কর্নেল যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ভোলাকে বলে চা-বিস্কুট খাওয়া গেল। তারপর উত্তরের বারান্দায় গিয়ে বেতের চেয়ারে বসে কর্নেলের প্রতীক্ষা করছিলাম। নব ফুলবাগানে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। কাজ শেষ করে সে উঠে দাঁড়াল। আমাকে দেখে সেলাম দিয়ে বলল– কর্নেল-সায়েব নদীর ওপারের জঙ্গলে পাখি দেখতে গেছেন। দেখুন, কখন ফেরেন। সেবার এসে সারাটা দিন জঙ্গলে ঘুরেই কাটালেন। এদিকে আমরা ভেবে সারা।

কথা বলতে বলতে সে সিঁড়িতে এসে বসল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে চাপাস্বরে বলল–কাল অনেক রাতে কলকাতা থেকে সেনসায়েব নামে এক সায়েব এসেছেন। মাঝে মাঝে আসেন বেড়াতে। এবার সঙ্গে ওনার মেমসায়েবও এসেছেন। ভোরবেলা দেখলাম, সেনসায়েব জিপগাড়ি নিয়ে একা বেরিয়ে গেলেন। আবার একটু আগে দেখলাম, কুমারচকের ঝন্টুবাবুর ছেলে এসে মেমসায়েবকে। নিয়ে নদীর ধারে গেল। কী যে চলছে সব, বুঝি না!

নব সকৌতুকে নিঃশব্দে হাসছিল। লোকটি আমুদে প্রকৃতির। বললাম কী চলছে বলে মনে হচ্ছে তোমার?

–ঝন্টুবাবু সেবার সেনসায়েবকে ফাঁসিয়েছিল। নব ফিসফিস করে বলল– জঙ্গল থেকে গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। শুনেছি, সেনসায়েব নানা জায়গায় কাঠগোলার মালিকদের কাছে টাকা খায়। মিনিস্টারের পেয়ারের লোক স্যার। যতবার আসে, কয়েক ট্রাক করে কাঠ চালান যায়। থানা-পুলিশ চুপ করে থাকে। সেবার ডি এফ ও ছিলেন কড়া লোক। ঝন্টুবাবুদের গিয়ে ধরলেন। ওনারা মিটিং করলেন। তারপর বংশীতলার মোড়ে ঝন্টুবাবুরা লোক জুটিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাক ধরলেন। পুলিশ গেল। সেনসায়েব গতিক বুঝে সটকানোর তালে ছিলেন। পুলিশ এসে ধরল। পরে অবিশ্যি ছেড়ে দিয়েছিল। সায়েবসুবোলোক স্যার! তাতে মিনিস্টারের চেনাজানা। কিন্তু পরে বোধকরি ঝন্টুবাবুর সঙ্গে মিটমাট করে নিয়েছে। তা না হলে সেনসায়েব যখন তখন আর আসছেন কী করে? এদিকে দেখুন ঝন্টুবাবুর ছেলের সঙ্গে মেমসায়েবের চেনাজানা।

ঝন্টুবাবু কে?

–ওই যে পাগলাগারদ করেছেন। কী যেন নামটা…..

–শচীন মজুমদার?

–নব হাসল–হ্যাঁ, স্যার! চেনেন নাকি?

নাম শুনেছি। ওর ছেলের নাম কী?

–বিলুবাবু। এ তল্লাটের ডাকসাইটে গুণ্ডা স্যার! বি এ পাশ। মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ায়। কিন্তু যত খুনে মস্তান, সব ওর চেলা। মোটর সাইকেলে চেপে এল। সেনসায়েবের রুমে ঢুকল। একটু পরে মেমসায়েবকে নিয়ে এই গেট দিয়ে বেরুল। আপনি তখন বোধকরি ঘুমিয়ে ছিলেন।

নব হঠাৎ উঠে গেল। বাংলোর পশ্চিমে গাছপালার আড়ালে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছিল। সে সেই দিকে চলে গেল।

একটু ইতস্তত করে উঠে পড়লাম। এই কৌতূহল অশালীন স্বীকার করছি। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা বোঝার নেশা পেয়ে বসেছিল। একটা রোমান্টিক ঘটনার আড়ালে কিছু নেই তো?

ঘরে গিয়ে ফায়ারআর্মসটা নিয়ে এলাম। উত্তরে নদীর দিকের গেটে যাচ্ছি, ভোলা দৌড়ে এল।–ব্রেকফাস্ট রেডি স্যার! কর্নেল সয়েব কখন ফিরবেন ঠিক নেই। আমি বাজার করতে যাব।

বললাম–এখনই আসছি। তুমি বাজারে গেলে নবকে বলে যেও। বেড়ালের হাত থেকে ব্রেকফাস্ট পাহারা দেবে।

বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, ভোলা আমাকে এখন ওদিকে যেতে দিতে চাইছে না। একবার ঘুরে দেখলম, ভোলা কেমন চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নদীর ধারে কেউ কোথাও নেই। বালির চড়া পেরিয়ে গেলাম। কাল রাতে টের পেয়েছিলাম, নদীর জলের গভীরতা কম। দিনের আলোয় দেখলাম, কালো স্বচ্ছ জল কোনওক্রমে বালি ছুঁয়ে ছটফট করে বয়ে যাচ্ছে। পায়ে স্লিপার ছিল। খুলে হাতে নিয়ে প্যান্ট একটু গুটিয়ে ওপারে গেলাম। এ পাড় খুবই ঢালু। ঝোপঝাড় চিরে একফালি পায়ে-চলা পথ এগিয়ে গেছে ঘন এবং উঁচু জঙ্গলের ভেতরে।

সতর্ক দৃষ্টি ফেলে হাঁটছিলাম। কিছুটা চলার পর আবছা কথাবার্তা কানে এল। ডানদিক থেকে। বিশাল একটা বটগাছ অজস্র ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তলায় প্রকাণ্ড সব ইট-কংক্রিটের চাঙড়। কোনও আমলে বাড়ি বা মন্দির ছিল নিশ্চয়। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল, একটা প্রকাণ্ড চাঙড়ের ওপর বসে কথা বলছে, নিশ্চয় সেই মেমসায়েব এবং একজন শক্তসমর্থ গড়নের যুবক। মেমসায়েবের পরনে জংলি ছাপের শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউস। যুবকটির পরনে জিনসের প্যান্ট, লাল গেঞ্জি। বটের ঝুরির আড়ালে গুঁড়ি মেরে সাবধানে তাদের প্রায় কাছাকাছি চলে গেলাম। একটা ঝোঁপের আড়ালে বসলাম। মিটার দশেক দূরত্বে ওরা বসে আছে। ওদের পিঠ দেখতে পাচ্ছি। সামনের ঝুরিটা একটা বাধা সৃষ্টি করছে। কিছু আর তেমন লুকোবার জায়গা নেই।

দৃশ্যটা সিনেমায় দেখেছি। বাস্তব জীবনেও এমন ঘটতে পারে ভাবিনি। তবে নাহ, ওরা গান গাইছে না। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে।

ঠিক এই সময় আমার ডানদিকে কোথাও চাপা শব্দ হলো। শুকনো পাতায় হাঁটাচলার মতো। হঠাৎ দেখি, লতাপাতা ঢাকা জুপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ। যুবক-যুবতী এমনই প্রেমোন্মত্ত যে কিছু টের পাচ্ছে না। লতাপাতার ভেতর থেকে এবার একটা মাথা দেখা গেল। সে খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল। তারপর সাংঘাতিক চমকে উঠলাম। লোকটার হাতে একটা ভোজালি।

সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার বের করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম–এক পা নড়লে গুলি করব।

খুনে লোকটা এক লাফে স্কুপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। বেঁকের মাথায় একটা গুলি ছুড়লাম। দু-তিন সেকেন্ডের ঘটনা। যুবক-যুবতী ছিটকে সরে গিয়েছিল। এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সামনে গেলাম বীরের ভঙ্গিতে।

যুবকটি ভুরু কুঁচকে বলল–থ্যাংকস।

—আপনি কি বিলুবাবু?

 হ্যাঁ। আপনি কে?

–আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। একজন সাংবাদিক। এখানে বেড়াতে এসেছি।

–আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন আপনি। আমি বোকার মতো একটা ফাঁদে ধরা দিতে এসেছিলাম। বলে সে ‘মেমসায়েবের’ দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল।

 ‘মেমসায়েব’ কঁদো-কঁদো মুখে বলে উঠল–বিশ্বাস করো বিলু! আমি জানতাম না

-শাট আপ! আর একটা কথা বললে শেষ করে দেব। আমার নাম বিলু! বলে সে জিনসের পেছন পকেট থেকে একটা খুদে রিভলবার বের করল। আমার দিকে ঘুরে বলল–আমারও ‘মেশিন’ আছে দাদা! কিন্তু আমি ভাবিনি, গোপন কথা আছে বলে এখানে ডেকে এনেও। দাঁড়াও। দেখছি তোমার হাজব্যান্ড শালাকে। শুওরের বাচ্চার বডি যদি আজই না ফেলে দিই তো ঝন্টু মজুমদারের ঔরসে আমার জন্ম হয়নি।

সে প্রায় দৌড়ে চলে গেল হিংস্র প্রাণীর মতো। মেমসায়েব দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। বললাম-কে আপনি?

কান্না থামছে না দেখে খাপ্পা হয়ে বললাম-ন্যাকামি ছাড়ুন। কে আপনি? ঠিক ঠিক জবাব না পেলে আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। শুনলেন তো আমি সাংবাদিক। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে এই জঙ্গলে চোরা কাঠপাচারের তদন্তে এসেছি। আপনিও দেখছি এর সঙ্গে জড়িত। আপনি সত্যি কথা না বললে আপনার ছবিও ছেপে দেব কাগজে। বুঝতে পারছেন কী বলছি?

 ‘মেমসায়েব’ এবার রুমালে চোখ মুছে মাথা নাড়লেন। করুণ মুখে বললেন বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না।

–আপনার নাম কী?

নীতা সেন। আমি কুমারচকেরই মেয়ে।

–আপনার স্বামীর নাম?

সুকমল সেন। আপনি আমার সব কথা শুনলে বুঝতে পারবেন, সত্যি আমি কিছু জানি না। বিলু আমাকে অকারণে ভুল বুঝে গেল। আমার ভয় করছে। আপনি আমাকে বাংলোয় পৌঁছে দিন প্লিজ!

চারদিক দেখে নিয়ে বললাম–চলুন।

বটগাছটা পেরিয়ে গিয়ে নীতা কান্নাজড়ানো গলায় বলল–আমি জানি, আমার স্বামী তোক ভালো নয়। আমার জীবনটাকে নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু আমার যাবার কোনও জায়গা নেই। মরতে ভয় করে। নইলে কবে মরে যেতাম।

আপনি বললেন কুমারচকের মেয়ে। ওখানে কেউ নেই আপনার?

–দূর সম্পর্কের এক কাকা আছেন। কিন্তু তিনি গরিব মানুষ। আমার দায়-দায়িত্ব নেননি। কলকাতায় আমার মামা ছিলেন। সেখানে পাঠিয়ে দেন। মামা মরার আগে আমার এই সর্বনাশ করে গেছেন।

কুমারচকে আপনার সেই কাকার নাম কী?

–চণ্ডিপ্রসাদ দাশগুপ্ত।

একটু অবাক হয়ে বললাম–চণ্ডীবাবু? মানে যিনি সাবরেজেস্ট্রি অফিসে কাজ করেন?

-হ্যাঁ। আপনি চেনেন?

 –সাংবাদিকদের অনেক খোঁজ রাখতে হয়। তো আপনার বাবার নাম?

বাবা..নীতা ঢোক গিলে কান্না সামলে বলল–বাবা বেঁচে থেকেও ডেডম্যান। মা তো আমার ছেলেবেলায় মারা যান। আমার বাবা ফ্রিডম-ফাইটার ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে মাকে বিয়ে করেন। বেশ ছিলেন। বছর পনের আগে একটু করে পাগলামির লক্ষণ দেখা গেল। তারপর একেবারে পাগল হয়ে গেলেন।

উত্তেজনা চেপে বললাম–আপনার বাবার নাম দেবীবাবু?

 নীতা আবাক হয়ে বলল–আপনি চেনেন? কোথায় দেখেছেন বাবাকে?

–দেখিনি। নাম শুনেছি। ফ্রিডম ফাইটারদের বইয়ে সম্ভবত।

নদীর ধারে এসে পৌঁছেছি ততক্ষণে। নীতা ব্যাকুলভাবে বলল–আপনি বিলুর কথা বিশ্বাস করলেন?

–বিলু সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব আছে। বিলু কেন বিয়ে করেনি আপনাকে?

হঠাৎ আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমি কলকাতায় মামার বাড়িতে আছি। বিলু জানত না। পরে জানতে পেরে রেগে গিয়েছিল। কিন্তু আমার তো কিছু করার ছিল না। বিয়ের পর এই প্রথম এতদিনে কুমারচকে আসা হলো আমার। জানতাম না হঠাৎ আমার স্বামী এখানে নিয়ে আসবে।

–বিলু কী করে খবর পেল আপনি এসেছেন?

ভোরে আমার স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি ভোলাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। ভোলা আমাকে ছেলেবালায় দেখে থাকবে। তবে চিনতে পারেনি। তাই ওকে টাকা দিয়ে গোপনে পাঠিয়েছিলাম।

–আপনার গোপন কথাটা বলতে আপত্তি থাকলে শুনব না। তো

–আপত্তি নেই জয়ন্তবাবু। আমি স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওকে ডেকেছিলাম। বিলু দুর্ধর্ষ ছেলে। আমার বিশ্বাস ছিল, ও আমাকে ওই বাস্টার্ডটার হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যে শয়তানের হাতে আমি পড়েছি, সে যে কত ধূর্ত, তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। এখন আমার ভীষণ ভয় করছে। আপনি আমাকে বাঁচান জয়ন্তবাবু।

নীতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বললাম–সিনক্রিয়েট করবেন না। চলুন দেখি, আমার বৃদ্ধ সঙ্গী ভদ্রলোক ফিরেছেন কিনা। উনি একজন মস্তবড় ট্রাবলশুটার। মুশকিল আসানও বলতে পারেন।

ঢালু পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। পেছনের দিকে আচমকা হাসির শব্দ শুনে ঘুরে দেখি, স্বয়ং দাড়িওয়ালা মুশকিল আসান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বাইনোকুলার তখনও ধরা এবং বুকে ক্যামেরা ঝুলছে। পিঠের কিটব্যাগে প্রজাপতি ধরা নেটের স্টক বেরিয়ে আছে। মাথার টুপিতে শুকনো পাতা, মাকড়সার জাল আটকানো।

কাছে এসে বললেন–পুরো ঘটনাটি বাইনোকুলারে দেখেছি। হ্যাঁ– ভোজালিওয়ালা আততায়ীর ছবিও ক্যামেরায় ধরেছি। চিন্তা করো না ডার্লিং। ক্রুপের মাথায় ঘাপটি পেতে বসে একটা ধূর্ত প্রজাপতির ছবি তুলবার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দুই যুবক-যুবতীর কথাবার্তার শব্দ। তারপর হ্যাঁ, আততায়ী আমার মাত্র কয়েক গজ নীচে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ক্যামেরা তো রেডি ছিল। ক্লিক করল। তবে একটা কথা জয়ন্ত। খামোকা গুলি খরচ করো না কখনো। লাইসেন্স রিভলভারের গুলি খরচ করলে কৈফিয়ত দিতে হয় আইনত। পুলিশকে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হয় এমন কী ঘটেছিল যে তোমাকে গুলি ছুঁড়তে হয়েছে।

ব্যস্তভাবে বললাম–কর্নেল ইনিই মিসেস সেন এবং সেই দেবীবাবুর মেয়ে।

কর্নেল হাসলেন।–বরকধঝ কচতটপ।

নীতা চমকে উঠল–আপনি জানেন?

 কর্নেল আস্তে বললেন–হুঁ।…

.