পিছনে পায়ের শব্দ – ২০

২০.

সুশীলা কফি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, সুশীলা! আজ ফিরভি কিচনি চিল্লায়ি!

সে চমকে উঠে ঘুরে কপালে দু’হাত ঠেকাল। হায় রাম! ফিরভি কিসিকা জান জায়েগা।

হমনে উনকো বাঁচা দিয়া, সুশীলা!

তার মুখে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপোড়েন খেলছিল। ফিসফিসিয়ে উঠল সে, তব ঔর কিসিকা খতরনাক হোগা, কর্নিলসাব! তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, আপভি হোঁশিয়ার রহনা।

বলেই সে চলে গেল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন। আজ সারাটা দিন খুব ধকল গেছে। চমকপ্রদ নাটকীয় কিছু ঘটনা ঘটেছে। একেকটি ঘটনায় একটি জটিল রহস্যের একেকটি স্তর উন্মোচিত হয়েছে, তা ঠিকই। কিন্তু ফলের ভেতর শক্ত আঁটির মতো একটা জায়গা রয়ে গেল। বিজয়েন্দুর অস্ত্রটা!

রাণু বলছিল, প্রিয় তার বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিককে খুন করার জন্য শালীকে দিয়ে ওটা হাতিয়েছিল। রাণু প্রিয়র পয়েন্ট বাইশ চীনা রিভলভারটা দেখেনি। কিন্তু অরীন্দ্র তো দেখেছেন। নাতজামাইয়ের অস্ত্রগুলো তাঁর চেনার কথা। যদি সত্যিই ওটা বিজয়ের হত, তার মতো মানুষ হইচই বাধিয়ে বসতেন। অথচ তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে ঘটল না।

নাকি কোনও স্ক্যান্ডালের ভয়ে অরীন্দ্র ব্যাপারটা চেপে গেলেন?

 পিউ বলছিল, পিয়ালির কাছে সে শুনেছে, একসময় রাণুর নামে স্ক্যান্ডাল রটেছিল। তার সহজ মানে রাণু কারও সঙ্গে প্রেম করত। কে সে! পিউকে পিয়ালির পেছনে লাগানো দরকার। কারণ গণনাথ বলেছিলেন, খুনী প্রিয় ভেবেই ভুল করে আনুকে মেরেছে। গণনাথের মতে, রাজেশ শর্মা খুনী এবং আপাতদৃষ্টে এর যুক্তি তো অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু বিজয়ের একটা ফায়ার আর্মস নিখোঁজ হওয়া বড় গোলমেলে ব্যাপার।

কর্নেল নড়ে বসলেন। অরীন্দ্রের উইলের কথা মনে পড়ে গেল। তার জীবদ্দশায় একজন ওয়ারিশের মৃত্যু হলে বাকি দুজন সম্পত্তি পাবে। প্রিয় মারা পড়লে সম্পত্তি পাচ্ছে রাণু ও সাত্যকি। রাণু বিধবা অতএব সবটাই কার্যত সাত্যকিই পাচ্ছে। আবার প্রিয় মারা পড়লে তার মৃত্যুর দায় চাপানো যায় তার কোম্পানির ওপর। কারণ কোম্পানির একটা রহস্যময় কারবার আছে এবং প্রিয় সেটার গোপন তথ্য জানত। কোম্পানিকে সে ব্ল্যাকমেল করত। ব্ল্যাকমেলারকে কোম্পানি চুপ করিয়ে দিতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক।

প্রিয় যে কোম্পানির গোপন তথ্য জানত এবং কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেল করত, সে-কথা কি রাণু বা সাত্যকির জানা সম্ভব? প্রিয় সাত্যকিকে ওই। সাইকেলটা দিয়েছিল। রঙ বদলে নিতে বলেছিল। সাত্যকির পক্ষে কথাটা জানা কি সম্ভব?

কিন্তু সাত্যকি গোঁয়ার, আত্মমগ্ন, নিছক অ্যাথলেট টাইপ ছেলে। তার একমাত্র স্বপ্ন ঘুসি-লড়িয়ে হওয়া। তার সমস্ত বুদ্ধিসুদ্ধি দুটো হাতে গিয়ে জড়ো হয়েছে। দুটো হাতই তার চরম অস্ত্র। কুঠিবাড়ির জঙ্গলে গিয়ে বিজয়ের ফায়ার আর্মস নিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করা–প্রিয়কে হত্যার জন্য, তার চরিত্রের সঙ্গে মানাচ্ছে না। এই কাজটার মধ্যে একটা নিখুঁত পরিকল্পনা আছে। অনবদ্য চাতুর্য আছে।

প্রিয় সে রাতে আনুকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়েছিল। তার চীনা রিভলভারের একটা ফায়ার করা বুলেটও আছে। ওদিকে বেলিংটন জেভিয়ার মাত্র একবারই গুলির শব্দ শুনেছিলেন।

তারপর আনুর ডেডবডি গঙ্গায় পাওয়া গেল। ঘটনাস্থলে নয়।

কর্নেল হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিলেন। জীবনে এমন জটিল রহস্যের পাল্লায় পড়েননি। চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে দাড়িতে অভ্যাসমতো আঙুলের চিরুনি টানতে থাকলেন।

 বাইরে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কেউ নাচের ছন্দে নামছে। চোখ খুলে দরজার দিকে তাকালেন কর্নেল। পিউ ঘরে ঢুকে উত্তেজিতভাবে বলল, দা মিট্রি ইজ সলভড, কর্নেল! আ হ্যাপি নিউজ অন দা ইভ অফ হ্যাপি ক্রিসমাস! দা মার্ডারার ইজ কটু রেডহ্যান্ডেড। দাঁড়ান, বুড়োদাকে ডাকি। সব ডিটেলস শুনবেন।

কর্নেল একটু হাসলেন। তুমি নিশ্চয় রামলালের কথা বলছ, ডার্লিং!

পিউ ধুপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ভ্যাট। আপনাকে যে একটা সাসপেন্স দেব, তার উপায় নেই।

রামলাল কি কবুল করেছে সে তোমার আনুদাকে খুন করেছে!

পিউ মাথা নাড়ল। তা কেউ করে? কিন্তু বুড়োদা বলল, পুলিশ খুব ধোলাই দিয়েছে। ধোলাইয়ের চোটে বলে ফেলেছে, সে জামাইবাবুর গাড়ি–তারপর বরুণদা যখন সেই গাড়িটা পেল, দুবারই গাড়ির ব্রেক আর স্টিয়ারিং বিগড়ে দিয়েছিল।

বলেনি সে অন্য একজনের হুকুমে এ কাজ করেছিল?

বুড়োদাকে ডেকে আনি। আমি অত ডিটেলস শুনিনি! বলে পিউ উঠে দাঁড়াল।

বসো। কথা আছে।

পিউ ফের বসে বলল, আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ভী-য-ণ টায়ার্ড।

হুঁ, টায়ার্ড। কর্নেল মুখটা করুণ করে বললেন, তবে সেজন্যও না। আজ দুই ছোকরার হাতে খুব হেনস্থা হয়েছি। আর বোলো না! আশাপুরায় গিয়েছিলুম। গিয়ে এক বিপদ। তবে হিন্দি ভাষার এই একটা অনবদ্য ঐশ্বর্য আছে, ডার্লিং! কাকেও গালাগালি দিতে হলে হিন্দির তুলনা নেই। আফটার অল, ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের বাহন। গালমন্দও একটা ভাব। তারও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য আছে। হিন্দিতে সেটা যত স্পষ্ট ফোটে, পৃথিবীর আর কোনও ভাষায় তা ফোটে কি না সন্দেহ। তোমার মনে পড়তে পারে, পাগলাসায়েব বলেছিলেন, দা ফানি চ্যাপ কুত্তাকা মাফিক ভাগ জাতা! এই হিন্দি অংশটা তুমি ইংরেজি কি বাংলায় বললো। ওই অসাধারণ ব্যঞ্জনাটি ফুটবে না। ডার্লিং! আজ সত্যিই আশাপুরা থেকে ‘কুত্তাকা মাফিক ভাগ জাতা’ ঘটেছে আমার বরাতে। আমার লেজ নেই। কুকুরের মতো লেজ থাকলে লেজ গুটিয়ে যেত! ওঃ! কী অপমান এই বুড়োবয়সে!

পিউ হাঁ করে শুনছিল। বলল, কে তারা?

যারাই হোক, কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বললে যেমন রাগ হয়, বুড়োকে বুড়ো বললেও হয়তো তেমনই রাগ হয়। কিন্তু বুঢঢে এবং তার সঙ্গে ‘আ বে’ প্লাস ইংরেজির ব্রাদার-ইন-ল ইন হিন্দি!

পিউ হেসে ফেলল। আপনি সত্যিই অদ্ভুত মানুষ। আপনার কাছে ফায়ার আর্মস থাকে। রাণুদির মুখে শুনেছি আপনার গায়ে নাকি ভীষণ শক্তি এ বয়সেও। ওদের মাথা দুটো ঠুকে দিলেন না কেন?

কর্নেল জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সিন ক্রিয়েট করতে চাইনি। যাই হোক, চারুভবনের খবর বলো।

পিউ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, অ্যাজ ইট ইজ। দাদামশাই পামকিন ফেস। বেশি কথা বলছেন না। রাণুদি তো কথা বলাই বন্ধ করেছেন। খালি বুড়োদা নৰ্মাল। দিদি আগামীকাল চলে যাবে বলে রেডি হচ্ছিল। বড়োদার কাছে রামলাল ধরা পড়ার খবর শুনে মত বদলেছে। জামাইবাবুর শিগগির নাকি ছাড়া পাওয়ার চান্স আছে। বুড়োদাই বলল।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, তুমি রাণুর স্ক্যান্ডাল রটার কথা বলেছিলে।

হুঁ। পিয়ালি চুপি চুপি বলেছিল। পিউ চাপাস্বরে বলল, রাণুদির সঙ্গে একটা লোকাল লোকের প্রেম-ট্রেম ছিল। দাদামশাই তাকে পছন্দ করতেন না বলে তার সঙ্গে রাণুদির বিয়ে দেননি। হি ওয়াজ আ স্কুল টিচার। সেজন্য বুড়োদার জামাইবাবু–শিকারী ভদ্রলোক রাণুদিকে একবার গুলি করতে গিয়েছিলেন।

এখন সে কোথায় আছে বলেনি পিয়ালি!

রাণুদির হাজব্যান্ডের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আপনি পিয়ালির কাছে ডিটেলস শুনবেন। পিউ তেতো মুখে বলল, এদের ফ্যামিলিতে প্রচুর স্ক্যান্ডাল আছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। প্রথম দিন এসে তো ভী-য-ণ ভাল লেগেছিল। অথচ… এরা আবার দিদির নামে যা-তা বলে। আমার সম্পর্কেও আড়ালে বিচ্ছিরি রিমার্ক পাস করে। গেঁয়ো সুপারস্টিশাস এলিমেন্টস! পিউ হঠাৎ হাসল। অ্যান্ড দ্যাট কিচনি!

আজ আবার কিচনির ডাক শুনেছি, পিউ!

পিউ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অ্যান ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল! সিওর।

সাবধান ডার্লিং! তোমাকে সাত্যকির ‘সিওর’ ভূতটা পেয়েছে।

বুড়োদার মুখে কথাটা দারুণ লাগে, বলুন।

হুঁ। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?

বুড়োদার ঘরে।

নাচতে?

ভ্যাট! টিভিতে আজ ব্রুনো এবং টাইসনের ইন্টারভিউ!

তারা কারা?

 পিউ চোখ বড় করে বলল, আপনি জানেন না! হেভিওয়েট বক্সার। সরি কর্নেল, আপনি সেই মহম্মদ আলির যুগে পড়ে আছেন। আলি ইজ সাফারিং ফ্লম পার্কিনসনস ডিজিস।

আমার ভয় হচ্ছে ডার্লিং, তোমাকেও না সাত্যকি বালির বস্তার সঙ্গে লড়িয়ে দেয়!

নৌ। আই লাইক টু ডান্স। পিউ চোখে উজ্জ্বল হাসল। ড্যান্সিং ইজ দা ভয়েস অব মাই বডি।

বাই দা বাই, যে রাতে অনির্বাণ খুন হয়, তুমি বলেছ, খুব নেচেছিলে!

সো হোয়াট? কর্নেলের মুখে কৌতুক ছিল না দেখে পিউ আবার চার্জ করল, কেন ওকথা বলছেন?

জাস্ট আ কোয়েশ্চন। সে-রাতে যখন শুতে গেলে, মনে আছে?

পিউ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর বলল, ঘড়ি দেখিনি। জামাইবাবু ফেরার পর মাত্র মিনিট দশেক রাণুদি টেনে নিয়ে গেলেন জোর করে।

সাত্যকি নাচছিল কি?

ভ্যাট! ওর নাচ মানে জগিং। নাচতে জানে নাকি? ওর অ্যাম্বিশন বক্সিংয়ে ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ন হবে। পিউ হাসতে হাসতে পা বাড়াল। অ্যামেরিকা সম্পর্কে ওর প্রচুর ইন্টারেস্ট। বলে কী জানেন? গ্র্যান্ডপার জন্য ওর কিছু হল না। দ্যাট ওল্ড ফেলো ওকে কোথাও যেতে দেবে না।

বাইরে অরীন্দ্রের সাড়া পেয়ে পিউ ঠোঁটে আঙুল রেখে কর্নেলকে ইশারা করেই বেরিয়ে গেল।

অরীন্দ্র ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে বসলেন। ছড়িটা দুপায়ের ফাঁকে রেখে হাতলটা দুহাতে চেপে ধরে বললেন, সিনহাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ। কর্নেল পোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ঘসতে ঘসতে বললেন, ওঁর মতে কোনও প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স থাকলেও সেসনে টিকবে না। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দুর্বল। রিভলভারটা তো পুলিশ খুঁজে বের করেনি। করেছে গ্যারেজের লোকে। কাজেই ওটা প্ল্যান্টেড হতে পারে। বাকি রইল চিঠি। যে খুন হয়েছে, ওই চিঠিটা তারই লেখা। ওটা দিয়ে খুনের মোটিভ এস্টাব্লিশ করা যাবে না।

আজ ইরিগেশন বাংলোর চৌকিদার রামলালকে ধরেছে পুলিশ। শুনেছেন তো?

তা শুনেছি। কাজেই প্রিয়র ফাড়া কেটে গেছে, বলা যায়।

অরীন্দ্র একটু কেসে গলা পরিষ্কার করে বললেন, কিন্তু এদিকে একটা মিসটিরিয়াস ব্যাপার ঘটেছে। একত্রিশে ডিসেম্বরে মধ্যে বিজয়ের ফায়ার আর্মসের লাইসেন্স রিনিউ করাতে হবে। আপনি তো জানেন, ওগুলো আমার নামে লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছিলুম। বিজয়ের স্মৃতি! তো দুপুরে ওর ঘরে গেলুম। লাইসেন্সের কাগজপত্র ও-ঘরেই আলমারিতে রাখা আছে! কিন্তু…

দেখলেন রিভলভারটা নেই।

অরীন্দ্র চমকে উঠলেন। নিস্পলক তাকিয়ে রইলেন।

রাণু আজ সকালে আমাকে বলেছিল। তবে ওর ধারণা প্রিয়র রিভলভারটাই সেটা।

অরীন্দ্র জোরে মাথা নাড়লেন। রাণু ভুল বলেছে।

 রাণু অবশ্য প্রিয়র রিভলভারটা এখনও দেখেনি।

আমি দেখেছি। অরীন্দ্র চাপাস্বরে বললেন। বিজয়েন্দুরটা হলে আমি তখনই বলতুম।

বিজয়েন্দুর রিভলভারের কি লাইসেন্স আছে!

অরীন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, আপনাকে গোপন করা। অন্যায়। ওটার কোনও কাগজপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজে পাইনি। তখন বুঝতে পেরেছিলুম, ওটা বিজয়েন্দু কারও কাছে কিনেছিল। এই এরিয়ায় ফায়ার আর্মস ঘরে-ঘরে। লাইসেন্সের তোয়াক্কা করে না কেউ। কাগজে প্রায়ই দেখবেন জাত পাত জমিজমা নিয়ে বন্দুকবাজি হচ্ছে। যাই হোক, অনেকবার ভেবেছি কোথাও। ফেলে দিয়ে আসব। কিন্তু বিজয়ের স্মৃতি! আপনি তো জানেন, ওকে আমি কী স্নেহ করতুম। তা ছাড়া ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে আমার প্রভাব আছে। আপনি তো দেখলেন, পুলিশ বাড়ি সার্চ করতে পর্যন্ত এল না–আসেনি। আসার পয়েন্টও অবশ্য নেই। নেহাত ওই গবেট বুড়োটা রক্তের কথা পুলিশকে বলে না ফেললে কিছুই হত না–আপনি জেনে রাখুন। পুলিস এসে লনে দাঁড়িয়ে প্রিয়র বউকে দু একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে গেল। অরীন্দ্র দু’হাতের মুঠোয় ধরা ছড়ির। বাঁটে চিবুক রেখে বললেন, প্রিয়র গাড়িতে অস্ত্র পাওয়া গেছে শুনেও আমার মাথায় আসেনি কিছু। আজ হঠাৎ আবিষ্কার করলুম, ওটা নেই। রাণু কান্নাকাটি করতে লাগল। ওর কাছেই সব ঘরের চাবি থাকে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সাত্যকিকে জিজ্ঞেস করেছেন?

হুঁউ। ও খেপে গেল। ওকে তো জানেন। আস্ত বনমানুষ। দুটো হাতের মুঠো বাগিয়ে বলে কী, হাত থাকতে তার ফায়ার আর্মসের দরকার হবে না।

কর্নেল হাসলেন। সম্ভবত ‘সিওর’-ও বলেছে।

অরীন্দ্র কষ্টে হাসলেন। তারপর বললেন, নাহ্। সাত্যকির বন্দুক-পিস্তলে কোনও নেশা নেই। ওকে বলেছি, অন্তত মাঝে মাঝে তেল-ফেল দিয়ে পরিষ্কার করার কাজটা নে। ও তা-ও করবে না। অগত্যা আমাকেই কাজটা করতে হয়। অস্ত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

একটু পরে কর্নেল বললেন, এ রহস্যের সমাধান করতে হলে আপনার সাহায্য চাই।

এ কী অদ্ভুত কথা বলছেন! অরীন্দ্র একটু চটে গেলেন। সব রহস্যের সমাধানের জন্যই তো আপনার কাছে গিয়েছিলুম। আমি সাহায্য করব না, ভাবলেন কী করে?

বোসসায়েব, আমার একটা প্রশ্ন আছে। কিন্তু প্রশ্নটা ডেলিকেট বলেই ও-কথা বলেছি।

অরীন্দ্র চার্জ করলেন, করুন প্রশ্ন।

রাণুর সঙ্গে একজন স্কুলটিচারের সম্পর্ক নিয়ে স্ক্যান্ডাল রটেছিল। কে তিনি? অরীন্দ্র আস্তে বললেন, বারীন–বারীন রায়।

তিনি এখন কোথায় আছেন?

কে জানে! তানি খেয়ে কেটে পড়েছিল। বাউণ্ডুলে, লক্ষ্মীছাড়া টাইপ। পদ্য-দ্য লিখত।

কবি বলুন!

অরীন্দ্র রুষ্ট মুখে বললেন, কবি-টবি বুঝি না। আপনার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বলুন। ফ্র্যাংকলি আলোচনা করব।

তার সঙ্গে রাণুর বিয়ে দিতে কী বাধা ছিল?

অরীন্দ্র একই মেজাজে বললেন, তখন যতীন বেঁচে নেই। বুড়ো স্কুলে পড়ে। বিহারের মাটি অন্য রকম মাটি। এ মাটি হাতের মুঠোয় রাখতে হলে বন্দুকবাজি করতে হয়। ন্যাকা মেয়েমুখো স্কুল টিচার দিয়ে এ কাজটা চলে না। আমি খুঁজছিলুম একজন বন্দুকবাজ নাতজামাই, যে এসে আমার পাশে দাঁড়াবে। তো পিয়ালির ঠাকুর্দা ছিল ডাক্তার। তার সঙ্গে কনসাল্ট করতুম। তার কাছে। খোঁজ পেলুম বিজয়েন্দুর। ভাগলপুরের ছেলে। ওর বাবাও ছিল নামকরা শিকারী। তখন বাবা-মা বেঁচে নেই। কাকা রেলের গার্ড। তার সঙ্গে…

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, এসব কথা অনেকবার বলেছেন, বোসসায়েব!

অরীন্দ্র ভুরু কুঁচকে বললেন, কোনটা বলিনি?

 বারীনবাবুর কথা।

বলার মতো নয় বলেই বলিনি প্রশ্ন করলেন, বললুম।

 এখনও রাণুর সঙ্গে বারীনবাবুর কোনও যোগাযোগ আছে কি না..

অ্যাবসার্ড! রাণু তা হলে কবে বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। ও নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে।

কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, বিজয়েন্দু একবার রাণুকে গুলি করে মারতে গিয়েছিল।

অরীন্দ্র হাসবার চেষ্টা করলেন। আমার সিলেকশন ঠিক হয়নি। বিজয়েন্দু জংলি, গোঁয়ার। আর রাণুকে তো দেখে আসছেন এতদিন। বাঘের সঙ্গে বাঘিনীর লড়াই! এর মধ্যে বারীন-টারীন নো ফ্যাক্টর।

বাইরে সুশীলা সাড়া দিল। ভোজন করতে ডাকল রাণুদিদি। আপনারা আসেন। রাত হয়ে গেল।

অরীন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। চলুন! আজ একসঙ্গে খাব বলে রেখেছি রাণুকে। দরকার মনে করলে ওকে বাজিয়ে দেখতে পারেন। সেজন্য আমি কিছু মনে করব না। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন ফের, হঠাৎ কেন এসব কথা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু আভাস অন্তত দিন।

কর্নেল আস্তে বললেন, কিছু না। নিছক কৌতূহল।

অরীন্দ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন।

দোতলার কিচেনের লাগোয়া ডাইনিং রুমে টেবিল সাজিয়ে রাণু দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুখে গাঢ় অন্যমনস্কতার ছাপ। কর্নেল বললেন, পিউ সাত্যকি সাবর্ণী– ওরা খাবে না?

রাণু বললেন, ওরা টিভি দেখছে। আমরা সবাই পরে বসবখন।

অরীন্দ্র বললেন, ক্রিসমাসের রাতে প্রতিবার স্পেশাল মেনু হয়। আমার ক্রিশ্চিয়ান বন্ধুদেরও ডাকি। কিন্তু এবার আমাদের আনহ্যাপি ক্রিসমাস!

কর্নেল সহাস্যে বললেন, কেক দেখতে পাচ্ছি। দ্যাটস অল।

বুড়োকে দিয়ে আনিয়েছি। রাণু ঠাকুর্দার পিছনে দাঁড়িয়ে চেয়ারের দুদিকে হাত রেখে বললেন। আপনি তো কখনও ক্রিসমাসে এখানে আসেননি! খুব ধুমধাম হয়। পুজোর মতোই।

অরীন্দ্র চুপচাপ খাচ্ছিলেন। কর্নেল ব্রিটিশ আমলে কলকাতার ক্রিসমাসের গল্প করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, আশাপুরা থেকে ফিরে খ্রিস্টানপাড়ার স্টপে নামলুম। ওখানে তিষ্ঠোনো দায়। মাইকের চোটে কান ঝালাপালা। তখন প্রায় সওয়া চারটে বাজে। হঠাৎ একটা লাল ঘুঘুর আঁক দেখতে পেলুম। রেয়ার স্পেসি আজকাল। ঝকটা ফলো করলুম! কুঠিবাড়ির ছাদে গিয়ে বসল। সেখানে গিয়ে আপনার ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা।

অরীন্দ্র তাকালেন।

বেলিংটন জেভিয়ার। কর্নেল হাসলেন। পাগলা মানুষ। সব সময় টো-টো করে ঘোরেন। আবোল-তাবোল কথাবার্তা। তারপর হঠাৎ বললেন, কুঠিবাড়ির জঙ্গলে একটা অদ্ভুত গাছ আছে দেখবেন। নিয়ে গেলেন দেখাতে।

অরীন্দ্র বললেন, কী গাছ?

চিনতে পারলুম না কিন্তু সত্যিই অদ্ভুত। কেউ রিভলভারের টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে গাছটার গুঁড়িতে। ছুরির ডগায় খুঁচিয়ে একটা গুলি বের করেছি।

এলাকার কোনও ডাকু-গুণ্ডা হবে। অরীন্দ্র গলার ভেতর বললেন। বিজয়েন্দু বলত, সে-ও ওইভাবে হাতের টিপ ঠিক করত ছেলেবেলায়। ক্লিফটনগঞ্জে আজকাল ডাকু-গুণ্ডার রাজত্ব।

গুলিটা পয়েন্ট থার্টি টু বোরের রিভলভার থেকে ছোঁড়া হয়েছিল।

অরীন্দ্র রাণুর দিকে তাকালেন। রাণু শুকনো মুখে বললেন, বুড়োর জামাইবাবুর রিভলভার হারানোর কথা আমি কর্নেলসায়েবকে বলেছি।

অরীন্দ্র জল খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত মুখে বললেন, ভগীরথ চুরি করে কাউকে বেচেছে–আই ভেরি মাচ ডাউট। ঘরের শত্রু বিভীষণ কথাটা ফেলনা নয়। ওকে চার্জ করব।

কর্নেল বললেন, প্লিজ বোসসায়েব! আপনি ও নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমার ওপর ছেড়ে দিন।

একঘণ্টা পরে কর্নেল নেমে এলেন তাঁর ঘরে। তিনি বাড়িতে থাকলে সুশীলা এ ঘরে তালা আঁটে না। ঘরে ঢুকে হঠাৎ কর্নেলের মনে হল, গুলিবিদ্ধ গাছটার কথা বলা কি ঠিক হল? চুরুট ধরিয়ে দরজা বন্ধ করে তিনি সাইকেলটার দিকে তাকালেন। বনোয়ারিজির কথাগুলো মনে ভেসে এল। হাজার-হাজার সাইকেলের মধ্যে বিশ-পঁচিশটা বাতিল করে দেয় বিদেশী কোম্পানি। লোডিং-আনলোডিং-এ ড্যামেজ হওয়া স্বাভাবিক। বাতিল সাইকেল ফেরত এলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। ড্যামেজ? নাকি ওই রকম বেঢপ গড়নের জন্যই বাতিল হয়?

চোখে পড়ার মতো গড়ন! ফেরত এলে পার্ট বাই পার্ট খুলে মেরামত করে… কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। প্রিয় এটা সাত্যকিকে দিয়েছিল এবং রঙ বদলাতে বলেছিল। ফেরত আসবে বলেই কি গড়ন ওইরকম করা হয়? উঠে গিয়ে কিটব্যাগটা খুললেন কর্নেল। একটা রেঞ্জ আর একটা প্লাস বের করলেন। তারপর সাইকেলটা খুলতে শুরু করলেন। শীতের রাতে শরীরে ঘাম জমছে। জ্যাম হয়ে গেছে পার্টগুলো। ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিলেন। বড়ো কষ্টসাধ্য কাজ। বরং একজন মেকানিককে ডেকে কাল দিনের দিকে কাজটা করানো উচিত। কিন্তু তীব্র একটা কৌতূহল তাকে পেয়ে বসেছে। আবার একবার বিশ্রাম নিতে এলেন চেয়ারে। ঘড়ি দেখলেন। বারোটা পাঁচ।

হঠাৎ আলো নিভে গেল।

লোডশেডিং। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ছোট্ট টর্চটা বের করলেন। জঙ্গলে এবং ফেরার পথে অতক্ষণ জ্বলার ফলে আলো কমে গেছে। সুশীলা একটা মোম রেখেছিল। কোথাও নেই। কিটব্যাগে মোম রাখেন কর্নেল। ঝটপটকিটব্যাগ খুললেন। আশ্চর্য, একটাও নেই। সহসা মনে হল, তিনি নিরাপদ নন। পশ্চিমের জানালার একটা কপাট খোলা ছিল। দ্রুত বন্ধ করে দিলেন। প্রিয়র রিভলভারটা সারাক্ষণ তার জ্যাকেটের ভেতর বাঁ পকেটে থাকে। নিজেরটা ডান পকেটে। নিজেরটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের দরজায় টোকার শব্দ হল। ওদিকটায় এক টুকরো খোলা বারান্দা। নীচে ঘন উঁচু ঘাস, তারপর খিড়কির দরজা পর্যন্ত গাঢ় জমাট লতাগুল্ম। কর্নেল বললেন, কে?

কোনও সাড়া এল না। আবার টোকার শব্দ হল তিনবার।

একটা চ্যালেঞ্জ! কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এসেছে কেউ! ক্ষীণ আলোয় মরচে ধরা ছিটকিনিটা খুলে আগড়টা নামাতেই বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ এল। কর্নেল ছিটকে একপাশে সরে গেলেন। একটা মুখোশ-পরা লোক একটু ঝুঁকেই সোজা হল। কর্নেলের রিভলভারের নলটা নিমেষে মুখোশের ওপর যেতেই সে একলাফে পিছিয়ে গেল এবং বারান্দা থেকে নেমে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে বাড়ির আড়ালে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। চেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। তারপর মনে পড়ল, মুখোশটা আজকাল প্রচুর দেখা যায়। অরণ্যদেবের মুখোশ।

মিনিট দশেক পরে আলো জ্বলে উঠল। ঘর চুরুটের ধোঁয়ায় ভরে গেছে। পশ্চিমের জানালাটা পুরো খুলে দিলেন কর্নেল।…

.