পিছনে পায়ের শব্দ – ১৩

১৩.

 সুশীলা ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল। মুখটা গম্ভীর। কর্নেল বললেন, সুশীলা! খবর পেয়েছ তো কিচনি কী করেছে?

সুশীলা ভয় পাওয়া মুখে আস্তে বলল, শুনা কর্নিলসাব! এক আদমিকা জান লেনেকা কোশিশ কি। বহত খুন গিরা। হম বোলি কর্নিলসাব, জব কিচনি চিল্লাতি, কোই খতরনাক হো জাতা।

তোমাদের বুড়োবাবু কি এখনও ঘুমোচ্ছেন নাকি?

 গঙ্গা-আস্নান করতে গেছেন রাণুদিদির সোঙ্গে।

ছোট বুড়োবাবু এখনও ঘুসি লড়ছে বুঝি? ওকে বলো আমি ডাকছি।

 সুশীলা একটু হাসল। আজ বহত লড়তে হে। বালু টুট গেয়া কর্নির্লসাব।

সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে সাত্যকি এল। বসে তেতেমুখে বলল, অকারণ ছুটোছুটি করে মরলুম। থানা অলরেডি খবর পেয়ে গিয়েছিল। বডি হসপিটালে।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর আস্তে বললেন, মারা গেছে নাকি?

নাহ্! তবে জেনে রাখুন পাগলাসায়েবের মতো একটা ঠ্যাং কাটা যাবে। সিওর।

তুমি সব তাতেই সিওর।

সরি! অভ্যাস হয়ে গেছে। বলে সাত্যকি একটু সিরিয়াস হল। ক’জন জেলে রাত্তিরে লুকিয়ে ড্যামে মাছ ধরতে গিয়েছিল। ফেরার সময় ওঁকে জঙ্গলে উন্ডেড অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিল। তখন জ্ঞান ছিল না ভদ্রলোকের। তারাই বডিটা তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে দেয়। হাসপাতালের ডাক্তার খবর দেয় থানাতে। পুলিশ এখন, লোকগুলোকে নাকি খুঁজছে। বুঝুন অবস্থা! একটা মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সেটা কোনও ব্যাপার নয়। ড্যামের ওখানে জঙ্গলে তারা কী করছিল, এই নিয়ে মাথাব্যথা। শেষে পুলিশের কনফ্লুশন, নিশ্চয় চুরি করে মাছ ধরতে গিয়েছিল। কাজেই তারা ক্রিমিন্যাল!

তুমি হাসপাতালে যাওনি?

 গিয়েছিলুম। অবস্থা সাংঘাতিক। তবে জ্ঞান ফিরেছে। দেখেই চলে এলুম।

 তোমার সাইকেলটা নিয়ে এস এবার।

 আনছি। তবে মিস্ট্রিটা সলভ করতে হবে কিন্তু!

করব। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেল?

সাত্যকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, প্রিয়দার গুলতাপ্পি। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি না হাতি! বিদঘুঁটে স্ট্রাকচার। বিচ্ছিরি ভুতুড়ে আওয়াজ দেয়। পালিশ চটে গিয়েছিল। প্রিয়দা বলেছিল, শিগগির রঙ করে নিস। শেষে ভগীরথদাকে দিয়ে রঙ করিয়ে নিয়েছি তাতে ভুতুড়ে আওয়াজটা আরও বেড়ে গেছে।

কী রঙ করিয়েছ?

কাল লক্ষ করেননি?

 মনে পড়ছে না। বয়স ডার্লিং, বয়স! কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন।

 ব্ল্যাক।

 হুঁ, ব্ল্যাক ঘুসিলড়িয়ে মহম্মদ আলি তোমার গুরু।

 নাহ্। টাইসন আমার হিরো এখন। ব্রুনোকে শুইয়ে দেবে দেখবেন। বলে সাত্যকি জগিংয়ের তালে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। রোজির নোটবইটাতে কিছু কেনাকাটার হিসেব আর ঠিকানা লেখা। হলদে কাগজটার পাঠোদ্ধারে আবার মন দিলেন। হাতে আতস কাচ নিলেন এবার।

ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনের মতো হস্তাক্ষর। তলাকার অক্ষরটা আর অথবা কে। কিন্তু আতস কাচ এতক্ষণে কথাগুলোর আভাস দিতে পারল। সি মি নিয়ার দা সি এইচ অ্যাট সিক্স ও ক্লক। কাম অ্যালোন। দিস ইজ আর্জেন্ট। পেমেন্ট ইজ রেডি।

কাগজটা পকেটে ঢোকালেন কর্নেল। আতস কাঁচটাও। সি এইচ কি ক্লিফটন হাউস? তা হলে এই চিঠি পেয়েই রোজি যায় এবং…

কর্নেল চমকে উঠলেন। কেয়া সেনকেও কি একইভাবে ডেকেছিল আততায়ী? কেন? কে সে? অথবা যেমনটা ভাবছেন, তেমন নয়। হরফটা যদি কে হয় এবং সে কেয়া সেন হয়? কেয়া তাকে কোনও গোপন পেমেন্টের জন্য ডেকেছিল এবং কেয়া কারও হাতের পুতুল ছিল এবং পরে কেয়া বেগড়বাঁই করায় সে-ও মারা পড়ে–এমনও তো হতে পারে! নিশ্চিত হওয়া যাবে কেমন করে? একটা গুরুত্বপূর্ণ রহস্যজট নিঃসন্দেহে। এটা ছাড়াতে পারলে অনেকটা এগোনো যায়। তবে এটা ঠিক, রোজি চিঠিটা রেখে দিয়েছিল। হেঁড়েনি। টাকার লোভে না জেনে সে ফাঁদে পা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও বিপদ ঘটতেও পারে ভেবে একটা সূত্র রেখে গিয়েছিল। যুক্তির দিক থেকে এ সিদ্ধান্ত সঠিক। এবার কেয়া সেনের দিকে এগোনো দরকার। রোজির নোটবইয়ে কেয়ার বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে। সে ছিল আমিনগঞ্জের বাঙালি পরিবারের মেয়ে। অক্টোবরে যখন কর্নেল এসে ঘটনাটি শুনেছিলেন, তখন যদি এতটুকু আভাস পেতেন যে, রোজির মতো কেয়াও আত্মহত্যা করেনি, ওটা হত্যাই, তা হলে হয়তো আরও একটা হত্যা এবং হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াত না। কিন্তু এ-ও আশ্চর্য, রোজির বাবা কেন বিশ্বাস করেন না যে তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছিল?

সাত্যকি সাইকেলটা দরজার সামনে রেখে বলল, আপনার কলকাতার জাদুঘরে নিয়ে রেখে দেবেন। আ স্ট্রেঞ্জ বাইসি!

অ্যান্ড মিসটিরিয়াস। দেখেই বুঝতে পারছি।

সিওর। সাত্যকি অভ্যাসে বলেই জানতে চাইল, মিস্ট্রিটা কী বলুন তো?

আগে এটা ঘরে ঢোকাও।

সাত্যকি দু-হাতে তুলে ঘরে ঢোকাল।

কর্নেল বললেন, যে-কোনও কালো জিনিসই রহস্যময় ডার্লিং! তিনি সাইকেলটা দেখতে থাকলেন। দেখতে দেখতে পকেট থেকে আতস কাচ বের করলেন।

সাত্যকি ভুরু কুঁচকে বলল, ফানি।

সাত্যকি! সাইকেলটা সত্যিই ফানি। এটা আমার জাদুঘরে রাখার উপযুক্ত জিনিস।

ওক্কে! আপনি নিয়ে যাবেন। তবে ভগীরথদা একটু ক্ষুণ্ণ হবে। ঠাকুর্দার ফাইফরমাস খাটতে এটা তার খুব কাজে লাগে। ঠাকুর্দা আপনার ফ্রেন্ড, ওঁকে ম্যানেজ করবেন। ভগীরথদাকে অ্যায়সা দাবড়ানি দেবেন ঠাকুর্দা, সিওর!

কর্নেল বললেন, সুশীলাকে বলল এঘরের দরজায় তালা এঁটে রাখে যেন। আমি বেরুচ্ছি।

সত্যি মিসটিরিয়াস তা হলে। বলে সাত্যকি ধুপ ধুপ পা ফেলে চলে গেল। কর্নেলের পরনে এখন আঁটো পাতলুন, জ্যাকেট, মাথায় নীলচে রোদটুপি। গলায় ঝুলছে ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার। হাতে প্রজাপতি ধরা জালের স্টিক। স্টেশন রোডে পৌঁছে বাইনোকুলারে দেখে নিলেন ইরিগেশন বাংলোর সামনে একটা ছোট ভিড়। দুটো লিমুজিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। একটা পুলিশভ্যান সবে চলে গেল। শ্যুটিং আজ বন্ধ তা হলে।

ক্লিফটনের কুঠিবাড়ির ছাদে গিয়ে উঠলেন কর্নেল। কিছুক্ষণ গঙ্গার চর এবং হাঁসের খেলা দেখলেন। খাড়া দেয়ালের দিকে ঝুঁকে নীচের দহ দেখতে থাকলেন। সর্বনাশা মৃত্যুফাঁদটা দেখলেই গা শিরশির করে। তারপর ঘুরলেন ইরিগেশন বাংলোর দিকে। লিমুজিন দুটো চলে যাচ্ছে ওয়াটার ড্যামের পাশের রাস্তা দিয়ে টাউনশিপের দিকে। লনে দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হুঁ, গণনাথ সেন আজ শুটিং বাতিল করেছেন।

কর্নেল ছাদ থেকে নেমে ইরিগেশন বাংলোর দিকে হাঁটতে থাকলেন। ক্যানেলব্রিজে পৌঁছেছেন, তখন বাংলোর লনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটি একটা গাড়িতে চেপে গেট দিয়ে বেরুচ্ছে। চৌকিদার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল। গাড়িটা উতরাইয়ে নামলে সে গেট বন্ধ করে দিল।

পিউয়ের কাছে গতকাল সন্ধ্যায় গণনাথের চেহারার বর্ণনা পাওয়া গেছে। বেঁটে, উজ্জ্বল, খাড়া নাক, চোখে পুরু কাঁচের চশমা। কিন্তু যে-দুজনকে দেখলেন, প্রায় একই গড়নের লোক এবং দুজনেরই চোখে চশমা। আজকাল নিছক চেহারা দেখে বাঙালি-অবাঙালি চেনা সহজ নয়। গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কর্নেল বাংলোর গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। একজোড়া দোয়েলের ছবি তোলার ভঙ্গিতে ক্যামেরা তাক করলেন। তারপর চোখে বাইনোকুলার রেখে এদিক-সেদিক দেখা, গেটে পৌঁছুনোর জন্য নেচারিস্ট-সুলভ কয়েকরকম হাবভাব রামলাল হাঁ করে তাকিয়ে এক বুড়ো সায়েবলোকের মধ্যে এখানকার পাগলা সায়েবকেই দেখছিল যেন। সে ফিক করে হাসলও।

কর্নেল গেটের সামনে গেলে সে বলল সাব! মেরাভি এক তসবির খিঁচিয়ে।

 কর্নেল সত্যিই তার দিকে ক্যামেরা তাক করে শাটার টিপলেন।

রামলাল খুশি হয়ে বলল, একঠো হমকো ভেজ দেনা, সাব! তো আপ কঁহাসে আতা?

কালকাত্তাসে।

 মালম, আপ ট্যুরিস্ট হেঁ?

হাঁ। কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, তুম রামলাল সিং?

চৌকিদার হাসল। জি। লেকিন আপ ক্যায়সে জানতা সাব?

তুম ডিফেন্সমে থে রামলাল?

রামলাল অবাক হয়ে গেল। জি হাঁ। তো আপ ক্যায়সে..

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তুম উও সাবলোগোকে স্যালুট দিয়া–হম দেখা। মিলিটারি স্যালুট হম পছনতা, রামলাল! উও সিরফ দুসরা কিসিমকি স্যালুট। তো বাত ইয়ে হ্যায় কি, হম এক রিটায়ার্ড কর্নেল। ইয়ে দেখো মেরা কার্ড।

নেমকার্ডটা হাতে নিয়ে দেখার পর রামলাল এবার জোরালো একখানা স্যালুট ঠুকল। তারপর সসম্ভমে গেট খুলে বলল, আইয়ে কর্নিলসাব! অন্দর আকে বৈঠিয়ে।

 কর্নেল লনে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তাজ্জব রামলাল! তুম মিলিটারিমে থে। লেকিন ইয়ে মামুলি নোকরি করতা। ইয়ে ঠিক নেহি।

শ্বাস ফেলে রামলাল বলল, বদ নসিব হুজুর কর্নিলসাব। থোড়াসা গলতি কিয়া তো মেরা সার্টিফিকেটমে কালা দাগ দে দিয়া। জো কামমে থে, উও কাম নেহি মিলে। তো ক্যা করু? ঔর দেখিয়ে, ম্যায় হু কেয়ারটেকার। লেকিন সবহি মুঝকো চৌকিদার বোলতে হেঁ।

ডিফেন্সমে ক্যা কাম করতে থে তুম?

ভেহিকলসমে মেকানিক থে হুজুর কর্নিলসাব!

 কর্নেল তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মেকানিক?

 জি।

আফসোস কি বাত।

রামলাল কাকুতিমিনতি করে বলল যে, সে তার সব ‘পেপ্পার-উপ্পার’ নিয়ে হুজুর কর্নিসাবের কাছে যাবে। উনি যেন তার সার্টিফিকেটটা শুধরে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই ‘ছোটা আদমিকে নোকরি’ তার বরদাস্ত হচ্ছে না। কিন্তু বউ কাচ্চা বাচ্চার মুখ চেয়ে তাকে অপমান সহ্য করে এখানে পড়ে থাকতে হয়েছে। এটাই যে জুটেছে, সে তার ভাগ্য। আশাপুরার এক সাইকেল কোম্পানির ‘মেনিজারসাব’ তাকে এটা জুটিয়ে দিয়েছিলেন। এই তো এখনই ফিল্মওয়ালা সেনসাবের সঙ্গে উনি হাসপাতালে গেলেন। ওঁদের কোন এক জানপহচান আদমি গতরাতে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে আছেন। রামলালের মতে, আজকাল সায়েব-লোকেদের খুব পয়সা হয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট হবে না? দিনভর ফিল্মের শুটিং হচ্ছে আর রাতের বেলা বাংলোয় মদের আসর। তো রামলালের কী করার আছে? সে বখশিস পায়। মদ এনে দেয় টাউনশিপ থেকে। তবে সায়েবলোকেরা তাকে গাড়ি দেয় মদ আনতে। পাক্কা তিন-সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব।

এরপর রামলাল তার ডিফেন্সে থাকার সময় থোড়াসা গলতি নিয়ে পট খুলল। কর্নেল নিচু দেয়ালের কাছে গিয়ে বাইনোকুলারে ওয়াটার ড্যামের পাখি দেখতে থাকলেন। বার্ড স্যাংচুয়ারি সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। সেটা অনেক দূরে উত্তর-পশ্চিম কোণে। জলের মধ্যে টিলাগুলো দেখার পথে আড়াল তুলেছে। সামনের টিলায় অক্টোবরে একটা সেক্রেটারি বার্ড দেখেছিলেন। ক্যামেরায় টেলিলেন্স জুড়তে গিয়ে পাখিটা উধাও হয়ে যায়।

হুজুর কর্নিলসাব! জেরা কৃপাসে…

 হাত তুলে কর্নেল আশ্বস্ত করলেন রামলালকে। জরুর! কালকাত্তা জাকে দেখা করো এক হপ্তাকা বাদ।

কর্নেল গেটের দিকে হাঁটতে থাকলেন। রামলাল তার পেছনে। তার আর্জি শেষ হচ্ছে না। কর্নেল বুঝলেন, লোকটা এখান থেকে যেন চলে যেতে পারলে বেঁচে যায়। গেটের কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন, সাইকেল কোম্পানিকি মেনিজারসাবকা নাম?

শর্মাজি, স্যার! রাজিশ শর্মা। বহত বড়া আদমি।

কব আয়া শর্মাজি?

 ফিল্মওয়ালা সেনসাব জোদিন আয়া! এহি বাংলো উনহিনে বন্দোবস্ত কিয়া। রামলাল চাপাস্বরে বলল, মালুম, সেনিমা-উনিমা বানানেকা সব রূপেয়া উনহি দেতে হেঁ।

কর্নেল দাঁড়ালেন। বললেন, হম শুনা রামলাল, সেন-সাবকা কোই আদমি খুন হো গেয়া! সাচ?

কিচনি, কর্নিলসাব! রামলাল মুখে ভয়ের ছাপ এনে বলল। লিটন-সাহাবকা উও কোঠিকি বিচমে কিচনি রহতি। আদমিকা খুন পিতি। তো জব কিচনি চিল্লাতি, তব কোই আদমিকা জান জাতা। স্যার! হম শুনা, কাল সামকোভি কিচনি চিল্লায়ি। ঔর দেখিয়ে এক আদমিকা অ্যাকসিডেন্ট হুয়া। জান জাতে জাতে বাঁচ গেয়া। লেকিন বহুত খুন পি লিয়ি কিচনি।

রামলালের কিচনিবৃত্তান্তে কান ঝালাপালা। কর্নেল চলে এলেন। রামলা আবার তার আর্জি স্মরণ করিয়ে দিল। প্রায় পঞ্চাশ মিটার লম্বা ঢালু রাস্তার ধারে দোয়েল দুটো আবার পোজ দিচ্ছিল ঝোপের উগায়। কর্নেলের ছবি তোলার আগ্রহ নেই দেখে উড়ে গেল। গণনাথ সেনের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হল না। পরে সুযোগ পাওয়া যাবে। তবে রামলালের সঙ্গে আলাপ হল, এটা মন্দ না। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে এবড়োখেবড়ো স্টেশন রোডে পৌঁছুলেন। হঠাৎ মনে হল, সত্য জিনিসটাই হয়তো এমন, আরও পাঁচটা ফালতু জিনিসের মধ্যে পড়ে থাকে।

ওয়াটারড্যামের রাস্তাটার কাছে এসে একটু দাঁড়ালেন। সেক্রেটারি বার্ডটিকে দেখার প্রবল ইচ্ছে দমন করতে একটু সময় লাগল। আজই আমিনগঞ্জ যাওয়া জরুরি। কেয়া সেনের বাড়ি, তারপর একবার প্রিয়র কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশন ম্যানেজার গিরিধারীজির সঙ্গে আলাপ করে আসতে হবে। কিন্তু বরুণ বাঁচবে তো? ওই গাড়িটাকে কিচনিতে পেয়েছে যেন। তবে ভাববার কথা, পিচে পড়ার পর বরুণ কেন আহত অবস্থায় নীচের জঙ্গলে ঝোপের আড়ালে গিয়েছিল। লুকোতে গিয়েছিল কি? তা-ই যদি হয়, সে আঁচ করেছিল শিগগির তার আততায়ী এসে পড়বে। সাবর্ণীর কাছে খবর পাওয়া মাত্র হাসপাতালে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। অথচ সে-মুহূর্তে রোজির নোটবই এবং সেই চিঠিটা তাকে বেশি টানল। হিসেবে ভুল হওয়াটা এতক্ষণে টের পাচ্ছেন– ওই বাংলোয় যাওয়ার পরে। কিন্তু সত্যিই তো তিনি অন্তর্যামী নন। তাছাড়া বরুণের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে রোজির সূত্র অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা ঘটনা ঘটে। কিন্তু তার পিছনে থাকে অজস্র উপাদান এবং ঘটনাটি সেগুলিরই পরিণতি। বরাবর তার এই তত্ত্ব চমৎকার কাজ দিয়েছে। কোনও হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীর পিছনে দৌড় নোর চেয়ে নিহত লোকটির পিছন দিকে হাঁটলে দেখা যাবে, হত্যাকারী আসলে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

বাইনোকুলারে অরীন্দ্র ধরা পড়লেন। কালো ছড়িটি হাতে হন্তদন্ত আসছিলেন। কর্নেলকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

কাছাকাছি পৌঁছে কর্নেল বললেন, একই গাড়ির পরপর দুবার ব্রেকফেল এবং খুনখারাপি। কাজেই বোসসায়েবের উত্তেজনার কারণ আছে।

অরীন্দ্র গম্ভীর মুখে বললেন, ঘটনাটা শুনলুম। কিন্তু আমি আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। চলুন, আশাপুরায় জেল হাজতে বোকা বাঁদরটাকে জেরা করবেন। সাড়ে এগারোটায় ট্রেন। আশাপুরায় খেয়ে নেওয়া যাবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি রাতে বলছিলেন, ছেড়ে দিন। লেট হিম গো টু দা হেল। না, না–আপনি মন থেকে বলেননি। আফটার অল আপনার একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে। মেয়ে বেঁচে থাকলে অমন কড়া কথা শুনে দুঃখ পেত।

অরীন্দ্রের চোখের কোণে জলের ফোঁটা। হাতের চেটোয় মুছে আস্তে বললেন, আই অ্যাম আ ম্যান অব স্টং মর্যাল প্রিন্সিপল। কিন্তু কেন যেন মনে। হচ্ছে, প্রিয় সত্যিই খুন করেনি। বউয়ের কাছে বীরত্ব জাহির করতে মিথ্যা করে বলেছে, গুলি ছুঁড়েছে। কেন এসব কথা মনে হচ্ছে জানেন? প্রিয় ছোটবেলা থেকে ভীষণ ভীতু। তা ছাড়া আমার নাতি! আমি তাকে স্টাডি করেছি। আর যা-ই করুক, নরহত্যা তার পক্ষে অসম্ভব।

কিন্তু মর্গের রিপোর্টে গুলির কথা আছে।

অরীন্দ্র জোর দিয়ে বললেন, সেটা অন্য ফায়ার আর্মসের। পাটনা থেকে রিপোর্ট আসুক। দেখবেন, আই অ্যাম কারেক্ট। খুনি হারামজাদা ওর গাড়ির ভেতর যে অস্ত্রটা রেখেছিল, গুলিটা তা থেকেই ছোঁড়া হয়েছিল। সেটা নাকি পয়েন্ট বত্রিশ ক্যালিবারের। আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।

প্রিয়র রিভলভারটা আনলাইসেন্সড। কর্নেল চুরুট বের করে ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তবে যদি বডিতে পাওয়া গুলিটা পয়েন্ট বত্রিশ ফায়ার আর্মসটার না হয় প্রিয় বেঁচে যাবে।

অরীন্দ্র ছড়িসুদ্ধু হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ঠাকুরের ইচ্ছা। চলুন!

বোসসাহেব! প্রিয়র কাছে আগামীকাল যাব বরং। এখনই একবার হসপিটালে যাওয়া দরকার। বরুণ দত্তের কাছে একটা কথা যেভাবেই হোক, আমার জানা দরকার। পিউরা যখন গেল, তখন আমিও গেলে পারতুম। কিন্তু…আরে! আপনি…প্লিজ বোসসায়েব! আমার কথা শুনুন।

অরীন্দ্র পিছন ফিরে গোঁ ধরে বললেন, নাহ্। আমি গিয়ে হতভাগাকে চার্জ করব। কাল রাত থেকে আমার মাথাখারাপ। একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।

বলে তিনি হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। কর্নেল জানেন, ওঁর বরাবর এই গো-ধরা স্বভাব। এমনিতে সজ্জন, আলাপী, রসিক। কিন্তু রেগে গেলে বেপরোয়া।

রিকশো ছাড়া হসপিটালে যেতে সময় লাগবে। কর্নেল ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জের দিকে চললেন। চারুভবনের গেটের কাছাকাছি পৌঁছুলে সাত্যকি চেঁচিয়ে তাকে ডাকল, হাই ফাদার ক্রিসমাস!

সাবর্ণী লনে দাঁড়িয়ে আছে। পিউ, পিয়ালি এবং সাত্যকি গেট থেকে রাস্তায় এল। সাত্যকি কিছু বলার আগে পিউ বলে উঠল, কর্নেল! বরুণদা ইজ ডেড। আমার বড্ড খারাপ লাগছে, জানেন?

.