পিছনে পায়ের শব্দ – ৯

০৯.

 ভাঙা ফটকের পর কুঠিবাড়ির চত্বর জুড়ে ইটপাথরের অজস্র স্তূপ। প্রতিটি স্তূপ ঝোপঝাড় এবং রঙিন ফুলে সাজানো। কোনওটিতে বৃক্ষলতার নিবিড় ঝালর। পিউকে অবাক করে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ জেভিয়ার! হোয়্যার আর ইউ?

কাছাকাছি কেউ রাগী স্বরে বলে উঠল, কুত্তাকা বাচ্চা! আই মাস্ট শো ইউ হু অ্যাম আই। টেক ইট! টেক ইট!

এবার ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ সর সর শব্দ শোনা গেল। কর্নেল ডানদিকে কয়েকটা স্তূপ পেরিয়ে গিয়ে বললেন, হ্যাল্লো মিঃ জেভিয়ার! আই হোপ ইউ আর অলরাইট?

পিউ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে হাসতে হাসতে বলল, কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি সেই পাগলাসায়েব!

বেলিংটন জেভিয়ারের বগলে ক্ৰাচ, হাতে একটা লম্বা ধারালো কাটারি। বুনো কুলের ঝোপে কোপ মারছিলেন। ঘুরে রুষ্টমুখে বললেন, মাত্ হাসো। ঔর মুঝকো পাগল মাত বোলো। হম গির গেয়া ঔর তুম হাসতি? বেশরম লড়কি!

কর্নেল বললেন, মিঃ জেভিয়ার! হোয়াট হ্যাপনড?

জেভিয়ার তাঁর মাথা থেকে পা অব্দি দেখে নিয়ে বললেন, হম ঠিক হ্যায়। আই ওয়াজ ট্রাইং টু প্লাক দা প্লামস ইউ সি। ওয়াইল্ড প্লামস। লেকিন বহুত মিঠা। আ যাইয়ে! লড়কি, তুম ভি আ যাও। লেকিন মুঝকো পাগল মাত বোলো।

পিউ ওঁর হাতের কাটারিটার দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে বলল, সরি মিঃ জেভিয়ার! প্লিজ ট্রাই টু রিমেম্বার, দা আদার ডে উই মেট ইচ আদার নিয়ার দা ওয়াটার ড্যাম।

ইজ ইট? জেভিয়ার ঢোলা নোংরা কোটের দু’পকেটে পাকা কুল ছিঁড়ে ভরতে ব্যস্ত হলেন। তুম মুঝকো পাগল বোলি। হাঁ, কভি কভি এইসা হো জাতা। বলে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। চাপাস্বরে বললেন, আপ শুনা স্যার কিচনিকি আওয়াজ? হম শুনা। জেরাসা নার্ভাস হুয়া। হম যব ইহা পর চুঢ়নেকা। কোশিশ কিয়া, উও চিল্লায়ি! মাই গড! দেন শি ওয়াজ ট্রাইং টু পুশ মি। হমনে গির গেয়া ঔর চিল্লায়া। কিঁউ কি, দেয়ার মে বি সামওয়ান টু হেল্প। ইউ নো, দা ট্যুরিস্টস।

জেভিয়ার বুকে ক্রস আঁকলেন। আই মাস্ট নট স্ট্যে হেয়ার। যব কিচনি চিল্লাতি, কিসিকো জান জাতা। লেট আস লিভ দা প্লেস। লড়কি, তুম ভাগো! বলে ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। তারপর কর্নেলের কাছে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। জাস্ট নাও আই রিমেম্বার! ইউ…আই থিংক আ রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। ব্রিগেডিয়ার? অর মেজর..লেফটন্যান্ট?

কর্নেল।

হাঁ হাঁ। কর্নেল! ইউ ওয়েন্ট টু মাই প্লেস উইথ দ্যাট ওল্ড বেঙ্গলি জেন্টলম্যান। হম শুনা, উনকা কোই গ্র্যান্ডসন পকড় গেয়া! ফানি! জেভিয়ার হেসে উঠলেন।

কর্নেল বললেন, হোয়াই ইউ সে ফানি মিঃ জেভিয়ার?

আই নো। দেখ লিয়া। ফানি চ্যাপ!

 উড ইউ প্লিজ এক্সপ্লেন মিঃ জেভিয়ার?

 কিচনি চিল্লাতি ঔর উও কার ছোড় কর ভাগতা। কুত্তাকা মাফিক ভাগ জাতা।

হোয়াট ওয়্যার ইউ ডুইং দেয়ার?

দ্যাস্টস মাই পার্সোনাল বিজনেস। কিসিকো নেহি বোলেগা হম্‌।

কর্নেল প্যাকেটের পকেট থেকে চুরুটকেস বের করে সামনে খুলে ধরলেন। মাই গিফ্ট টু ইউ অন দা ইভ অব হ্যাপি ক্রিসমাস।

জেভিয়ার চুরুটগুলোর দিকে অন্তত আধ মিনিট তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফিক করে হাসলেন। থ্যাংকস্ স্যার! লেকিন হম দোঠো লেগা। টু! বলে দুটো আঙুল দেখালেন। ওয়ান ফর ক্লিফটন। সমঝা? উও মেরা দোস্ত হ্যায়!

ইউ মে টেক মোর মিঃ জেভিয়ার!

নো। ওনলি টু। বলে জেভিয়ার দুটো চুরুট তুলে নিলেন। একটা কোটের ভেতর শার্টের পকেটে চালান করে দিলেন। অন্যটা কামড়ে ধরে ফের বললেন, থ্যাংকস্!

কর্নেল লাইটার জ্বেলে ওঁর চুরুটটি ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, ওয়েল মিঃ জেভিয়ার। দা ফানি চ্যাপ ইজ নট সো মাচ বোল্ড টু কমিট আ মার্ডার!

হাঁ। মার্ডার অফুল্যি নিডস্ সাম কারেজ। জেভিয়ার খক খক করে কাসতে কাসতে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, বাট আই অ্যাম নট সো সিওর।

হোয়াই?

জেভিয়ার পাগলাটে হাসি হেসে বললেন, জেসাস নোজ হোয়াট হ্যাঁনড। বহুত আন্ধেরা থি। লেকিন হম ফায়ার আর্মস কি আওয়াজ শুনা। হম ভাগা। ইউ সি, আই ক্যান্ট ট্যাকল আ পার্সন উইথ ফায়ার আর্মস।

বাট দা ভিকটিম ওয়াজ স্ট্যাবড টু ডেথ।

বুড়ো আঙুল কাঁধের ওপর তুলে কুঠিবাড়ির দিকটা দেখিয়ে জেভিয়ার বললেন, দা ক্রোকোডাইলস। দে আর অলওয়েজ হাংগ্রি ইউ নো। কোই বডি মিলতা তো খা লেতা। ঔর পানিমে বহুত পাথর ভি হ্যায়।

জেভিয়ারকে অনুসরণ করে কর্নেল বললেন, অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট দা কার? অল দা গ্লাসেস ওয়্যার স্ম্যাশড।

জেভিয়ার গতি বাড়িয়ে বললেন, মাই ডটার রোজি ওয়াজ স্ট্যান্ডিং দেয়ার। গো টু হার গ্রেভ অ্যান্ড পুছিয়ে আই অ্যাম নট সিওর। অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ড ক্লিফটন। এভরি নাইট আই গো দেয়ার ফর আ চ্যাট উইদ দা ফেলা। উসকো ভি পুছিয়ে। বাট নট নাও। কিচনি চিল্লায়ি। শি ইজ হিজ মিসট্রেস! সামটাইমস শি বিকামস্ ভায়োলেন্ট। লড়কি। জলদি ভাগো!

জেভিয়ার দ্রুত উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর পিউকে বললেন, কী বুঝলে?

পিউয়ের মুখে বিস্ময় আর বিরক্তির ছাপ ওতপ্রোত। চাপা শ্বাস ছেড়ে বলল, শুধু বুঝলুম, আপনি জানতেন হে হে বলে কে চাঁচাচ্ছে।

কর্নেল কুঠিবাড়ির বাউন্ডারিওয়ালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এই হে্লপ হেলপ্ চ্যাঁচানির সূত্রেই গত অক্টোবরে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। কুরুডি ফরেস্টের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ এই আর্তনাদ। খোঁড়া মানুষ। গর্তে পড়ে গিয়েছিলেন। তবে লক্ষ করেছি, লোকজনের সাড়া পেলে অনেক সময় ইচ্ছে করেই এটা করেন। জাস্ট ফর আ ফান।

পিউ একটু পরে বলল, লোকটাকে আমার খারাপ লাগে। ওয়াটারড্যামের ওখানে একটা পার্ক আছে। সেখানে আনুদা আর আমি কথা বলছি, হঠাৎ ঝোপের মধ্যে একটা মুখ। চোখ দুটো জন্তুর মতো।

মিঃ জেভিয়ার?

হ্যাঁ। হি ওয়াজ ফলোয়িং আস। আনুদা ভাগিয়ে দিল। কুৎসিত গাল দিতে থাকল আনুদাকে। শাসাল। বলেই পিউ হঠাৎ চমকানো স্বরে ডাকল, কর্নেল!

উ? হুঁ! বলো।

হি ইজ আ মিসটিরিয়াস ম্যান। আপনি জানেন? রাণুদি বলছিল, পাগলাসায়েবের মেয়েকে কে মার্ডার করে কুঠিবাড়ির নীচে গঙ্গার ওই খাদে ফেলে দিয়েছিল। রাণুদিই বলছিল, সুইসাইড নয়। মার্ডার।

শুনেছি। লম্বা টাড় জমিতে উঠে কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন। তারপর আবার চোখে বাইনোকুলার।

ওর হাতের কাটারিটা লক্ষ করেছেন?

তুমি কি বলতে চাইছ জেভিয়ারসায়েব তোমার আনুদাকে খুন করেছেন?

পিউ জোর দিয়ে বলল, কিছু অসম্ভব নয়। সেদিনই মনে হচ্ছিল আনুদাকেই ও ফলো করে বেড়াচ্ছে। এমন তো হতেই পারে, ভুল করে আনুদাকেই ওর মেয়ের কিলার ভেবেছিল। তারপর দেখুন, বুড়োদা আর আমি জামাইবাবুর গাড়ির কাছে খানিকটা রক্ত দেখেছিলুম।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, সরি ডার্লিং! তোমার থিওরির ভিত্তিটা নড়বড়ে। জেভিয়ারসায়েব রোগাভোগা বুড়োমানুষ। ক্রাচ ছাড়া এক পা চলতে পারেন না। অনির্বাণবাবুকে কাটারির কোপে খুন করাটা, ধরে নিচ্ছি, ওঁর পক্ষে সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু…

রিভেঞ্জ। পিউ শক্তমুখে বলল। অন্ধকারে আচমকা কাটারির কোপ মেরেছিল বুকে।

তারপর বডিটা বয়ে নিয়ে গিয়ে জলে ফেলে দিয়েছিলেন! কর্নেল হাসলেন। দৃশ্যটা কল্পনা করো, ডার্লিং!

পিউ একটু দমে গিয়ে বলল, ওয়েল! এমন হতে পারে, জামাইবাবু গাড়ি থেকে তার ফায়ার আর্মস নিতে এসে দেখেছিল আনুদা মার্ডারড। তখন জামাইবাবুই নিজেকে মার্ডারের দায় থেকে বাঁচাতে বডিটা ফেলে দিতে গিয়েছিল।

তাহলে তোমার জামাইবাবুর পোশাকে প্রচুর রক্তের দাগ থাকা উচিত।

পিউ গম্ভীর হল। একটু ভেবে বলল, লক্ষ করিনি। আচ্ছা, এমন যদি হয়, জামাইবাবু বডির পা দুটো ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল?

সেক্ষেত্রে সারা পথে প্রচুর রক্তের ছোপ থাকার কথা।

হুঁ। কিন্তু পুলিশ এসব কথা ভাবেনি। খুঁজেও দেখেনি। পিউ উৎসাহে বলতে থাকল। গাড়ির কাছে আমি আর বুড়োদা রক্ত দেখেছি শুনেই পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে গেল। জামাইবাবু তখন আমিনগঞ্জে। জিপ হাঁকিয়ে গণাদার সঙ্গে গিয়ে দুম করে অ্যারেস্ট করে ফেলল। আর দিদিও পুলিশের জেরার চোটে নার্ভাস হয়ে বলে দিল, দু’জনের মধ্যে শত্রুতা ছিল। তাও ভাগ্যিস ফায়ার আর্মসটার কথা বলে ফেলেনি। কর্নেল! আমার ধারণা, বডিটা শর্টকাটে নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আপনি মর্নিঙে এসে ওইদিকটা খুঁজবেন। আমিও আসব আপনার সঙ্গে।

পিউ আঙুল তুলে সম্ভাব্য শর্টকাটটা দেখাল। কর্নেল টাড় জমি থেকে নেমে বললেন, গপ্পের ডিটেকটিভদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকা চাই-ই। তোমার সে কোয়ালিফিকেশন আছে।

পিউ চটে গেল। আপনি আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না! স্টিল ইউ আর জোকিং, কর্নেল।

উঁহু! তোমার এই থিওরিটা মন্দ না। তবে কি জান, কাটারিতে কারও হুঁড়ি ফাসালে অকুস্থলেও প্রচুর রক্ত থাকার কথা। কিন্তু তুমি আর সাত্যকি সামান্য একটু রক্ত দেখেছিলে। তাই না?

হেভি ফগ ছিল। তা ছাড়া গাড়ির সমস্ত কাচ ভাঙা। খুঁটিয়ে লক্ষ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। আই ওয়াজ টেরিবলি এক্সাইটেড। বলে পিউ থমকে দাঁড়াল। সামনে নিচু জমিটা একটা জলা। সে বলল, আপনার শর্টকাট করা হল না। মনে হচ্ছে, রাস্তাটা অ্যাভয়েড করা যাবে না।

কর্নেল জলায় একটা সারস পাখি দেখছিলেন। তারপর জলার ধারে ধারে হাঁটতে থাকলেন। পিউ বলল, এই মার্শল্যান্ডটা না থাকলেও শর্টকাটে আমরা গিয়ে বাড়ির পেছনদিকে উঠতুম। ওদিকটা ঢোকা যাবে না। ডাকলেও কেউ শুনতে পাবে না। বাইরে-ভেতরে বিচ্ছিরি জঙ্গল। আমাদের রাস্তা দিয়ে ঘুরে গেটে যেতেই হবে।

তা তো হবেই। তবে অ্যাডভেঞ্চারটা মন্দ হল না। কী বলো? পিছনে পায়ের শব্দ এবং কিচনির গর্জন।

পিউ খানিকটা দূরে উঁচু রাস্তাটা দেখছিল। হঠাৎ হেসে ফেলল সে। ওই দেখুন, বুড়োদা আমাদের দেখতে পেয়েছে। ও জানে না কী হারাল।

হুঁ। পিছনে পায়ের শব্দ এবং কিচনির গর্জন!

অ্যান্ড দ্যাট মিসটিরিয়াস ম্যান! বলে পিউ সাত্যকির উদ্দেশে হাত নাড়তে থাকল।

সাত্যকি সাইকেলের সিটে বসে রাস্তার পিচে একটা পা ঠেকিয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। পিউয়ের হাত নাড়ায় তার কোনও সাড়া নেই। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, সাবধান পিউ! ওর মধ্যে এখন দু-দুটো লি-র সমাবেশ। মহম্মদ আলির লি এবং ব্রুস লির লি।

পিউ এতক্ষণে মন খুলে হাসতে পারল। আপনি দারুণ বলেছেন কিন্তু। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভায়োলেন্ট হয়ে আছে। হি ইজ আনপ্রেডিক্টেবল, ইউ নো! গেল আপনাকে রিসিভ করতে, পড়ল ব্রুস লির পাল্লায় এবং ফরগট হিজ মিশন। কিন্তু আমি খালি ভাবছি, থানায় গিয়েছিল কি না।

কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল বললেন, হ্যাল্লো ডার্লিং! তোমার সঙ্গিনীকে চুরি করেছিলুম। ইনট্যাক্ট ফেরত দিলুম। এরপর আর তোমার উদ্বেগের কোনও কারণ থাকা উচিত নয়।

পিউ একটা ঝোপ আঁকড়ে ঝটপট রাস্তায় উঠে গেল। বলল, নিশ্চয় থানা থেকে আসছ?

সাত্যকি গম্ভীর মুখে বলল, এবার যেতুম। সিওর।

কিন্তু তুমি কি গুরু বদলালে?

অভ্যাসমতো সে বলল, সিওর। বলেই চার্জ করল, তার মানে? কর্নেল আস্তেসুস্থে রাস্তায় উঠে বললেন, সাত্যকি, তুমি কিচনির গর্জন মিস করেছ। পিউকে জিজ্ঞেস করো। কী দারুণ অ্যাডভেঞ্চার সারাটা পথ। অবশ্য তোমারও কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। গণনাথ সেনের ছবির শুটিংয়ে নিশ্চয় ব্রুস লি-টাইপ মারপিট ছিল?

সাত্যকি হেসে ফেলল। আপনারা আসুন! আমি গিয়ে দিদিকে খবর দিই। গিয়েই তো বলবেন, আগে কফি, তারপর কথাবার্তা। নো কফি নো টক।

সে প্যাডেলে পা রাখলে পিউ বলল, ওয়েট! তুমি শুটিং দেখছিলে?

কী করব? ভাবলুম তুমি স্টেশন থেকে ওখানে গিয়ে জুটেছ।

পিউ খাপ্পা হয়ে বলল, আশ্চর্য! তুমি কী করে ভাবলে আমি নির্লজ্জের মতো ওই ছাইপাঁশ দেখতে যাব?

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, নো কফি নো টক। সাত্যকি, তুমি এগোও। রাণুকে বলো, কড়া কফি। সাংঘাতিক একটা অ্যাডভেঞ্চারের পর কফিটা একটু কড়া হওয়া দরকার।

সিওর। বলে সাত্যকি সাইকেলে প্রায় উড়ে গেল।

পিউ গম্ভীর হয়ে বলল, বুড়োদা শুটিং দেখছিল আপনি কী ভাবে টের পেলেন?

কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ধ্যান ভেঙে স্টেশন থেকে এখানে পৌঁছুতে ওর এত বেশি সময় লাগার কথা নয়। সাইকেল নিয়ে তোমার খোঁজে ওর বনবাদাড় ভেঙে ছোটাছুটির সম্ভাবনা নেই। তুমি থানার কথা বলছিলে। থানা উল্টোদিকে টাউনশিপ এরিয়ায় এবং সে থানায় যায়নি বলল। কাজেই এতখানি সময় কোথায় সে কাটাতে পারে? আমাকে রিসিভ করতে গিয়ে যে ব্রুস লি-র পাল্লায় পড়ে, ফেরার পথে ওয়াটারড্যামে শুটিং তার পক্ষে সমান একসাইটিং ব্যাপার। হিসেব ডার্লিং, হিসেব!

গেটে রাণু দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেলকে প্রণাম করে বললেন, সুশীলাকে বলছিলুম ট্রেন লেট। বুড়ো এসে বলল, ট্রেন লেট ছিল না। আপনি পিউকে নিয়ে উধাও হয়েছিলেন! রাণু হাসলেন। বুড়োর জামাইবাবুও বাড়ি ফিরে বলত, কর্নেলসায়েবকে জঙ্গলে হারিয়ে এলুম। খুঁজতে লোক পাঠাও। আমি বলতুম, পাখির বাসায় বসে চুরুট টানছেন। কোথায় চলে গেল সে সব দিন! রাণু শ্বাস ফেললেন। তাকে নিস্তেজ দেখাচ্ছিল। পোর্টিকোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, পিউ! তুমি ওপরে যাও তো ভাই। সুশীলাকে বলো, কর্নেলসায়েব এসে গেছেন। তারপর পিউ চলে গেলে আস্তে বললেন, এবার হয়তো আপনার একটু অসুবিধে হবে। আপনার ঘরটাতে প্রিয়রা উঠেছে। নীচের গেস্টরুমটা অবশ্য খারাপ লাগবে না। বেশ নিরিবিলি ওদিকটা। ঘরে বসেই প্রচুর পাখি দেখতে পাবেন। সেবার এসে ওদিকটা দেখে আপনি বলেছিলেন, চিড়িয়াখানা!

গেস্টরুমটা বাড়ির নীচের তলায় উত্তর-পশ্চিম কোণে। উত্তরে এক টুকরো খোলা বারান্দা। বারান্দার নীচে একসময় ফুলের বাগান ছিল। এখন খিড়কির দরজা পর্যন্ত ঘন জঙ্গল। লতাগুল্মের ঘন বুনোটে সন্ধ্যার রঙ লেগেছে। ওদিকের দরজাটা খুলে তখনই বন্ধ করে দিয়ে রাণু সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। কর্নেল পিঠ থেকে কিটব্যাগ খুলে টেবিলে রেখে বললেন, অক্টোবরে এসে চলে যাওয়ার দিন তোমাকে বলেছিলুম, খুব শিগগির হয় তো আবার আমাকে ক্লিফটনগঞ্জে আসতে হবে। মনে পড়ছে?

রাণু বললেন, পড়ছে। তবে আপনার প্রজাপতি ধরার প্রোগ্রাম জেনে রাখুন বাতিল। ঠাকুর্দা আপনাকে সে-সুযোগ দেবেন না। প্রিয় এসে যা উটকো ঝামেলা বাধিয়েছে, বলার নয়। কিন্তু ঠাকুর্দা পারেনও বাবা এ বয়সে। প্রিয় অ্যারেস্ট হওয়ার পর নিজেই কলকাতা দৌড়ুলেন আপনার কাছে। আমি বললুম, বুড়োকে পাঠান। নয় তো ট্রাঙ্ককল করুন। শুনলেন না। তারপর সারাটা দিন একবার থানা একবার সেই আশাপুরায় কোন উকিলের বাড়ি। এই বয়সে এমন ছুটোছুটির ধকল। আমার বড্ড ভয় করছে কর্নেল!

বলে রাণু দরজায় একবার উঁকি মেরে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, প্রিয়র বউকে দেখামাত্র বুঝেছিলুম কী একটা গণ্ডগোল আছে। ঠিক তা-ই। আপনি ওকে চেপে ধরুন, সব বেরিয়ে পড়বে। আমি বলছি না প্রিয়র খুনখারাপি করার ক্ষমতা আছে। একেবারে বোকা ছেলে। বোকা বলেই ওর বউ ওকে ফাঁসিয়েছে। আপনি জানেন? পুলিশ ঠাকুর্দাকে বলেছে, যে লোকটা খুন হয়েছে, তার সঙ্গে প্রিয়র বউয়ের খারাপ সম্পর্ক ছিল। শুনে তো আমি অবাক। ছি ছি। কী ঘেন্নার কথা! পুলিশই বলেছে, লোকটা বিবিকে এখানে ফলো করে এসেছিল। আপনি তো এসব বিষয়ে এক্সপার্ট মানুষ। তা হলে বুঝুন কী হয়েছে।

কর্নেল ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে বললেন, কী হয়েছে বলে তোমার ধারণা?

রাণু আগের মতো চাপা গলায় বললেন, প্রিয়র বউয়ের সঙ্গে রাজ্যের সব ছেলেছোকরার আলাপ। কিছুক্ষণ আগে একজন এসেছিল। দু’জনে চুপিচুপি কী সব কথাবার্তা হল। তারপর চলে গেল। জিজ্ঞেস করলে বলল, প্রিয়র অফিসের। লোক। তা হলে দেখুন মক্ষিরানীর পেছনে-পেছনে আরও অনেকে এসে জুটেছে। আমার মনে হচ্ছে, যে লোকটা এসেছিল, তাকে দিয়েই প্রিয়র বউ খুনটা করিয়েছে। করিয়ে প্রিয়কে বিপদে ফেলেছে। রাণু বিকৃত মুখে ফোঁস করে। জোরে শ্বাস ছাড়লেন।

সুশীলা হন্তদন্ত এল এতক্ষণে। টেবিলে কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে রেখে কর্নেলকে প্রণাম করে বলল, ভাল আছেন তো কর্নিলসাব?

কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে বললেন, দেখি কেমন কফি করেছ। তারপর বলব কেমন আছি।

সুশীলা ঘোমটা টেনে কাচুমাচু হাসল। রাণু ব্যস্তভাবে বললেন, দেখি ভগীরথ ফিরল নাকি।

সুশীলা বলল, আভি ফিরল দিদি। আপনি আসেন। আপনাকে জলদি যেতে বলছে।

কর্নেল বললেন, তোফা! সুশীলা, বহুত আচ্ছি কফি বানাতি তুম।

সুশীলা খুশি হয়ে রাণুকে অনুসরণ করল। একটু পরে পিউ এল। সে ধুপ করে একটা চেয়ারে বসে বলল, অদ্ভুত ব্যাপার! দিদি বলল, কিছুক্ষণ আগে জামাইবাবুর অফিসের এক কলিগ এসেছিল। বরুণ দত্ত নাম। আমারও খুব চেনা। কিন্তু সে এখানে কেন? দিদি আমাকে বলল, এমনি দেখা করতে এসেছিল। আমার তা মনে হয় না।…

.