পিছনে পায়ের শব্দ – ২১

২১.

ভোরে মর্নিং ওয়াকের জন্য বেরিয়ে কর্নেল পোর্টিকোয় পিউকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। মর্নিং দময়ন্তী শুনে সে ঘুরে দাঁড়াল। একটু হাসল। মর্নিং ফাদার ক্রিসমাস। বাট হোয়াই দময়ন্তী?

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, পামকিন ফেস।

 আমার?

হু। একটি চঞ্চল হাসিখুশি মেয়ের মুখে হঠাৎ এই রাশভারী ভাবের সঙ্গে ‘দময়ন্তী’ ফিট করে যায়। কর্নেল বাইনোকুলার তুললেন চোখে। বাউন্ডারি ওয়ালের ধারে ঋজু ও শ্রেণীবদ্ধ গাছ কুয়াশার কম্বল কাঁধে সন্ন্যাসীদের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

পিউ আস্তে বলল, রাত্তিরে ঘুম হয়নি। বড্ড বোর করছে, জানেন? আর কী। সব অদ্ভুত শব্দ। সারা রাত!

তুমি কি জগিং ছেড়ে দিলে?

 পিউ তেতো মুখে বলল, ফানি! বুড়োদা আমাকে পিয়ালির ভয়ে অ্যাভয়েড করে চলছে। আসলে এভরিহোয়্যার দা কানট্রিগার্লস আর জেলাস। আইওয়ায় আমার একটা অদ্ভুত এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল, জানেন? স্টুড়স বেশির ভাগই ফার্মারদের ছেলেমেয়ে। ভীষণ কনজারভেটিভ। কর্নেল! আপনি আমার কথা শুনছেন না।

আ মিসটিরিয়াস বার্ড, ডার্লিং! ওই শোনো!

আমি কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

ইউরোপে প্রাচীন যুগে ধারণা ছিল মেয়েরা প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে। প্রকৃতির কথা বুঝতে পারে। বলে কর্নেল পুবের লনে এগিয়ে গেলেন। পাখিটা গাছের আড়ালে কুক্ কুক করে ডাকছে। এদিকে একসময় ফুলবাগান ছিল। বর্মি। বাঁশের সভ্য দেহশ্রীতে বন্যতার হিংস্র চেহারা, পামগাছগুলি ধূসর জীর্ণ স্তম্ভ, লতাগুল্মে মাকড়সার জাল এবং শিশিরের ফোঁটাগুলি প্রাকৃতিক কোমল কারুকার্য। সহসা মনে হয় এই পরিবারের পুরনো আভিজাত্যের চিহ্নগুলি ক্রমে ক্রমে ঢেকে ফেলেছে প্রকৃতি। পতনের স্বরলিপি চারদিকে।

পিউ দেখল কর্নেল ঝোপের ভেতর দিয়ে উত্তরে চলেছেন, চোখে বাইনোকুলার। তারপর থমকে দাঁড়ালেন। বাইনোকুলার নামিয়ে সামনে কিছু দেখতে থাকলেন। একটু পরে ঝুঁকে কী একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলেন।

পিউ শিশির বাঁচিয়ে সাবধানে পা ফেলে কাছে গেল। বলল, মাই গুডনেস! এদের গাড়ি ছিল?

ঝোপের ভেতর একটা মোটরগাড়ির কঙ্কাল দেখিয়ে কর্নেল বললেন, পোর্টিকো দেখেই সেটা তোমার বোঝা উচিত ছিল।

আপনার হাতে ওটা কী?

মোমবাতি। কর্নেল হাসলেন। অরণ্যদেব ফেলে দিয়েছে।

হোয়াটস দ্যাট!

 দ্যাটস দ্যাট!

দ্যাটস দ্যাট। কর্নেল ঘুরে খিড়কির দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। জংধরা কবজা, কপাটে মাকড়সার জাল। আগড়টা টুটাফাটা এবং হুকের মাথাটা কবে ভেঙে গেছে। কোনও মতে আটকানো আছে আগড়টা। কর্নেল আগড় নামিয়ে কপাট টানলেন। খানিকটা ফাঁক হল। ঝোপঝাড় ঝাঁপিয়ে পড়েছে দরজার ওপর। কর্নেল কাত হয়ে গলে গেলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন। দরজার ফাঁকে কবেকার ওপড়ানো কয়েকটা গুল্ম নেতিয়ে পড়ে আছে। দেখার পর পোড়ো জমিটায় হাঁটতে থাকলেন।

পিউ বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

অরণ্যদেবের খোঁজে।

 পিউ দরজা গলিয়ে বেরুল। এদিকটায় বসতি নেই। বাঁদিকে লম্বাটে সেই জলা। কর্নেলের পিছু পিছু হাঁটছিল সে। বলল, আপনি সত্যিই অদ্ভুত মানুষ। আপনি তো রাণুদির হাজব্যান্ডকে অরণ্যদেব বলতেন। তাই না? বাট হি ইজ ডেড।

তুমি নাকি রাত্তিরে বাড়ির ভেতর কী সব অদ্ভুত শব্দ শুনেছ?

শুনেছি। পিউ হেসে ফেলল। আপনি কি বলতে চান সেগুলো রাণুদির হাজব্যান্ডের ভূতের শব্দ?

কী শব্দ শুনেছ বলো?

কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। আরও কী সব শব্দ। বিবি জেগেছিল। ওকে বললুম। ও বলল, কিছু না। ঘুমো।

তখন রাত কটা?

ঘড়ি দেখিনি। তবে মিডনাইট। কোথায় মাইক বাজছিল। কারা রাস্তা দিয়ে গান গাইতে গাইতে গেল। বার্থটাইম অফ জেসাস না? এখানে একটা ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটি আছে–ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। পিউ হাঁটতে হাঁটতে বলল, কলকাতায় থাকলে কী এনজয় করতুম ভেবে খারাপ লাগছিল। আই মিল্ড দা হ্যাপি ক্রিসমাস।বুড়োদার সঙ্গে রাণুদির ঝগড়া। এদিকে জামাইবাবুর বিপদ। দাদামশাই বলছিলেন, ক্রিসমাসে প্রচুর কেক পাঠায় ওঁর ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেন্ডরা। রাত্তিরে স্পেশাল মেনু হয় প্রত্যেক বছর। এবার কিছুই হল না। বুড়োদার কাছে ক্রিসমাস ক্যারলের টেপ আছে। কিন্তু দাদামশাই কাল দুপুর থেকে কেমন ফেরোশাস হয়ে গেছেন। ধমক দিয়ে বললেন, নো নয়েজ। চুপচাপ শুয়ে পড়ো সব। পিউ ফিক করে হাসল। বুড়োদার ঘরে কিন্তু টেপ বাজছিল–আস্তে। আমি যেতুম। কিন্তু বিবি আমাকে যেতে দিল না। আসলে বিবিও ধরে নিয়েছে বুড়োদার সঙ্গে আমি… সিলি! আমি বিবি নই। আই অ্যাম ফ্র্যাংক, কর্নেল! বিবির মতো যেখানে সেখানে ঝুলে পড়ি না। আবার তাকে প্যাক দিয়ে কাট করি না। এখন বিবি হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে, দ্যাটস আ ডেঞ্জারাস গেম।

জলার উত্তর ঘুরে উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, হু। ডেঞ্জারাস গেম ওই দেখ।

কী? পিউ চমকে উঠল।

 সামনে স্টেশন রোড। এবং আমরা কোথায় এসে পড়েছি লক্ষ করো!

 পিউ এগিয়ে গিয়ে বলল, এখানেই তো জামাইবাবুর গাড়িটা ছিল। কাঁচগুলো পড়ে আছে।

সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর রাস্তায় গেলেন। বললেন, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ এবং আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলুম, এই দুটো জায়গায় একটা স্ট্রেইট লাইন টানা যাক। কেমন তো? এবার লেটস্ ড্র আ ট্রাঅ্যাঙ্গল। একটা ত্রিভুজ। এ বি সি কোণ। তুমি ত্রিভুজের শীর্ষ কোণ এ-তে গিয়ে দাঁড়াও। যাও! রাস্তার ধারে পিপুলগাছটার কাছে। পিউ একটু অবাক হয়ে নির্দেশ পালন করছিল। কর্নেল হাতের ইশারায় বললেন, বাঁ দিকের রাস্তার ওপর। ব্যস্। ওখানেই দাঁড়াও। ওটা ‘এ’ কোণ।

ব্যাপারটা কী?

তুমি অনির্বাণ সোম। বলে কর্নেল তাঁর রিভলভার বের করলেন।

পিউ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হোয়াটস দ্যাট?

দ্যাটস দ্যাট, ডার্লিং! কর্নেল রিভলভার তাক করেই নামিয়ে জ্যাকেটের ভেতর ঢোকালেন।

পিউ শুকনো মুখে বলল, আমার ভীষণ ভয় করছে। আপনি…

কর্নেল হাত তুলে বরাভয়ের মুদ্রা এনে হাসলেন, তোমাকে সাহসী ভেবেছিলুম!

আমার সত্যি ভয় করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।

তুমি অনির্বাণ। আমি প্রিয়। কর্নেল তার দিকে এগিয়ে গেলেন। পিপুলগাছটার তলায় একটা পাথর পড়ে আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে গাছটার গুঁড়ি দেখতে থাকলেন। মাটি থেকে ফুট ছ-সাত উঁচুতে একটা সরু ফাটল। দুপাশে কালচে ছোপ। পাথরে উঠে ছুরি বের করলেন। ফাটলটা খুঁচিয়ে একটু চওড়া করে বাঁ হাতের তালু পাতলেন এবং ছুরির ডগা দিয়ে কী একটা বের করলেন।

পিউ দম আটকানো গলায় বলল, কী?

প্রিয়র পয়েন্ট টোয়েন্টি টু রিভলভারের গুলি। কর্নেল পাথরটা থেকে নেমে পিউকে গুলিটা দেখালেন। বললেন, কাজেই বুঝতে পারছ, প্রিয়র গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল।

 পিউ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

কর্নেল ডাইনে ঝোপের দিকে আঙুল তুলে বললেন, এবার ত্রিভুজটা কল্পনা করো। ওটা সি কোণ। প্রিয় ছিল বি কোণে। সি কোণে ছিল অরণ্যদেব। গণনাথ সেন কারেক্ট। অরণ্যদেব অনির্বাণকে প্রিয় ভেবেছিল, কারণ তার হাতে জ্বলন্ত টর্চ। প্রিয় এবং অরণ্যদেব ঠিক একই মুহূর্তে গুলি ছোঁড়ে অনির্বাণের দিকে। তাই দুটো গুলির শব্দ একটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। জাস্ট আ কোইনসিডেন্স!

পিউ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল অরণ্যদেব-অরণ্যদেব করছেন। কে সে?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটু হাসলেন। কাল রাতে লোডশেডিংয়ের সময় সে আমার ঘরে হানা দিয়েছিল। মুখে অরণ্যদেবের মুখোশ। নাকের ডগায় রিভলভারের নল সে প্রত্যাশাই করেনি। পালিয়ে গেল।

মাই গড। আমার ভয় করছে।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, আরও ভয় পাইয়ে দিই। সেরাতে অরণ্যদেব প্রিয়কে গুলি করে মারতে এসেছিল চারুভবনের খিড়কি দিয়ে। সে তক্কে তক্কে ছিল। প্রিয় দ্বিতীয়বার চুপি চুপি গেট দিয়ে বেরিয়ে যায় গাড়ি থেকে তার রিভলভার আনতে। কিচনির ডাক বড়ো ভয়ঙ্কর, সে তো শুনেছ ডার্লিং। প্রিয় বেরুলে সেও চুপি চুপি খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে আসে। ভুল করে অনির্বাণকে গুলি করে পালিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে ভুলটা সে টের পায়। প্রিয়কে ফিরতে দেখেছিল। সিওর।

পিউ নার্ভাস হাসল। আই অ্যাম নট সো সিওর। তবে বুড়োদা বলছিল, রামলাল কবুল করেছে…

তার কথার ওপর কর্নেল বললেন, এগেন গণনাথ সেন ইজ কারেক্ট। রাজেশ শর্মা বাংলোয় পাশের ঘরে ছিল। সে অনির্বাণ এবং প্রিয়র সম্পর্কের ব্যাপারটা আড়ি পেতে শুনে থাকবে। এবার ঘটনাটা সাজানো যাক। প্রিয় কোম্পানির আরেক ব্ল্যাকমেলার। রামলালকে দিয়ে রাজেশ তার গাড়ির ব্রেক বিগড়ে দিয়েছিল। কাজেই ধরে নিয়েছিল অ্যাকসিডেন্টে প্রিয় মারা পড়বে। ওই বাঁকের মুখে বাঁদিকে নীচের জলাটা দেখতে পাচ্ছ। যে-গাড়ি ব্রেক ফেল করেছে, সেই গাড়ি বাঁকের মুখে রাস্তার বাঁদিকের ঢালে পৌঁছুলেই গড়িয়ে পড়ার সেন্ট পারসেন্ট চান্স। তোমাকে বলেছিলুম, সব রাস্তা বা রেললাইনেরও বাঁকের মুখে একটা দিক ঢালু রাখা হয়। স্পিডের মুখে ব্যালান্স বজায় রাখাই এর উদ্দেশ্য। যাই হোক, বাংলো থেকে অনির্বাণ বেরিয়ে আসার পর রাজেশ বেরোয়। সে এখানে পৌঁছেই অনির্বাণের ডেডবড়ি দেখতে পায়। রাজেশের ভয় পাওয়ার কথা। কারণ গণনাথের বডিগার্ড মার্ডার্ড! গণনাথের কী রিঅ্যাকশন হবে সে জানে না। সে রামলালকে ডেকে এনে বডিটা গঙ্গার দহে ফেলে দিয়ে যায়। দু-দুটো বডি দহে ফেলার পর এটা তার অবসেশনে পরিণত হয়েছিল। তা ছাড়া দহটার প্রচুর বদনাম। মৃত্যুর ফাঁদ–আর ওই কিচনি।

পিউ চার্জ করল। ইঞ্জিনের ভেতর রিভলভার গেল কী করে?

বলছি। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, চারুভবনে তখন অরণ্যদেব ভাবনায় পড়ে গেছে। তার চেষ্টা ব্যর্থ। অনেক ভেবে সে ঠিক করে, প্রিয়কে এই মার্ডারের সঙ্গে জড়াতে হবে। সে খিড়কি দিয়ে আবার চলে আসে এখানে। নিশ্চয় ডেডবডিটা না দেখে সে অবাক হয়েছিল অথবা হয়তো লক্ষই করেনি। তার একটাই কাজ ছিল, গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিনের ভেতর অস্ত্রটা রাখা। ক্লিয়ার?

এমনভাবে বলছেন, যেন সব স্বচক্ষে দেখেছেন।

ডার্লিং! সমস্ত ফ্যাক্ট আমাকে এই থিওরিতে পৌঁছে দিয়েছে। এই কেসে আমি ইনডাক্টিভ এবং ডিডাক্টিভ দুই পদ্ধতিই অবলম্বন করেছি। কারণ আমার চারপাশে প্রচুর তথ্যও ছড়ানো ছিল। কুঠিবাড়ির জঙ্গলের ভেতর একটা গাছ তোমাকে দেখাব। গাছটাতে কেউ টার্গেট প্র্যাকটিস করত। সেটা আবিষ্কার করার পরই আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল চারুভবনের দিকে। তারপর চারুভবন থেকে বিজয়ের একটা রিভলভার নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে আমার অনিবার্যভাবে মনে পড়ে গেল বোসসায়েবের উইলের কথা। প্রথমে আমার মনের সামনে এসে দাঁড়াল বারীন রায়–রাণুর প্রেমিক।

কথায় বাধা দিয়ে পিউ শক্ত মুখে বলল, অত বুঝি না। এবার মার্ডারারকে ধরিয়ে দিন।

কর্নেল কিছুক্ষণ বাইনোকুলারে হাঁসের ঝাঁক দেখার পর বিষণ্ণ মুখে বললেন, বড় ডেলিকেট পয়েন্ট পিউ! জীবনে কখনও এমন স্পর্শকাতর অবস্থার মুখোমুখি হইনি। আমার সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা। না পারি গিলতে না পারি ওগরাতে। নাহ্, তুমি তোমার জামাইবাবুর জন্য ভেবো না! প্রিয় বুদ্ধিমান। তাকে বাঁচিয়ে দেবে একটা সাইকেল।

সাইকেল! কী বলছেন?

সাইকেলটা আমার ঘরে আছে। প্রিয় প্রমাণ করতে পারবে, কোম্পানি তাকে বিপদে ফেলার জন্যই একটা লাইসেন্সহীন বেআইনি অস্ত্র তার গাড়ির ভেতর রেখেছিল।

এক্সপ্লেন! অরীন্দ্রের ভঙ্গিতে পিউ চার্জ করল।

কাল রাতে সাইকেলটা পার্ট বাই পার্ট খুলেছি। খোলার সময় অরণ্যদেবের আবির্ভাব। যাই হোক, প্রিয় সাইকেলটা সাত্যকিকে উপহার দিয়েছিল। রঙ বদলে নিতে বলেছিল সতর্কতার জন্য। তুমি নেলপালিশ ব্যবহার করো কি?

নাহ্। বিবি করে।

নেলপালিশের রঙ তোলার জন্য থিনার ব্যবহার করা হয়। সাবর্ণীর কাছে চেয়ে নেব। ঘসলেই মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানির ‘রেড স্টার’ বেরিয়ে পড়বে। সিওর!

ভ্যাট! আসল কথা বলছেন না! আপনাকে বুড়োদার সিওরে পেয়েছে।

সাইকেলের রডের ভেতর লম্বাটে পুরিয়ায় নার্কোটিক্স ভরা আছে, ডার্লিং! কর্নেল চাপাস্বরে বললেন। মুখে কৌতুক ঝলমল করছিল হাল্কা নরম রোদে। হাজার-হাজার সাইকেল চালান যায় বিদেশে। কিছু সাইকেল চোখে পড়ার মতো বেঢপ গড়নের। বাতিল হয়ে যায়। সেগুলোতে সম্ভবত বিদেশী কোম্পানিরই এজেন্ট নার্কোটিক্স ভরে ফেরত পাঠায়। এখান থেকেও নিশ্চয় কিছু পাঠানো হয়। আফিঙ বা চরস। আগামী মার্চে বোম্বে ডকে তা ধরা পড়বে। সিওর।

বড্ড বেশি সিওর বলছেন। বি কেয়ারফুল, কর্নেল!

হেরোইন, ব্রাউন সুগার, এল এস ডি–এসব কখনও দেখেছ?

পিউ ব্যস্ত হয়ে উঠল। আই নো। আই নো। আমার এক বয়ফ্রেন্ড তো… বলেই সে থেমে গেল। সামনে বাঁকের দিকে আঙুল তুলল। বুড়োদা আজ এত্তো দেরিতে জগিংয়ে বেরুল যে?

কর্নেল বাইনোকুলারে দেখে নিয়ে বললেন, ভগীরথ দৌড়ে আসছে। কী ব্যাপার, এস তো দেখি।

কাছাকাছি হলে ভগীরথ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রাণুদিদি আপনাকে ডাকল। কী হইয়েছে বড়বাবুর। সবকুছু ভাঙছেন তোড়ছেন। হামি ভি সামহাল দিতে পারল না। এই দেখেন, হামরেভি মারলেন।….

সাবর্ণী লনের রোদে দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল বললেন, কী হয়েছে জানো?

 সাবর্ণী বাঁকা মুখে বলল, কে জানে! এদের কিছু বোঝা যায় না। আমি আজই চলে যাব।

হলঘরের সিঁড়িতে উঠতে উঠতে কর্নেল অরীন্দ্রের চ্যাঁচামেচি শুনতে পেলেন। হুলিয়া বের করব। সব এয়ারপোর্টে খবর দেব। ছেড়ে দে রাণু। ছাড় বলছি! সুশি! আভি নিকাল যা!

কর্নেল অরীন্দ্রের ঘুরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড, ছত্রখান। অরীন্দ্রকে রাণু এবং সুশীলা জাপটে ধরে আছে। দুজনেই কান্নাকাটি করছে। কর্নেলকে দেখে অরীন্দ্র তেড়ে এলেন। ইউ আর হোপলেস কর্নেলসায়েব! আপনাকে আমি ডেকে এনেছিলুম একটা কাজে। আর আপনি খালি পাখির পেছনে ছোটাছুটি করেই কাটালেন।

বলে অরীন্দ্র হাতের মুঠোয় দলাপাকানো একটা কাগজ ছুঁড়ে দিলেন কর্নেলের দিকে। কর্নেল কুড়িয়ে নেবার আগেই বললেন, সাত্যকি পালিয়ে গেছে?

অরীন্দ্র জানালায় গিয়ে দু-হাতে দুটো রড মুঠো করে ধরলেন। এদিকে পিছন ফিরে আছেন। তাঁর মুখের একটা পাশে নরম রোদ পড়েছে। ভিজে চোখ।

রাণু ভাঙা গলায় বললেন, গতকাল ঠাকুর্দা ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। অ্যাডভোকেট সিনহাবাবুর মুহুরি কানে ফুসমন্তর ঢেলেছিল। টাকা পেলে নাকি পুলিশ প্রিয়র নামে চার্জশিট আটকে রাখবে।

কর্নেল দলা পাকানো চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, সাত্যকি টাকাগুলো নিয়ে পালিয়েছে?

অরীন্দ্র না ঘুরে প্রায় গর্জন করলেন, সায়েবদের সঙ্গে ঘুসি লড়তে গেছে। দিনের পর দিন রাণুকে দিয়ে আমাকে.. ওর পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দেব। রাণু, আমার ছড়ি খুঁজে দে!

পিউ বলে উঠল, বুড়োদা অ্যামেরিকা যাবে বলত আমাকে। কিন্তু ফানি! ওই টাকায় কী হবে? হি নিডস আ লট অব মানি!

অরীন্দ্র ঘুরে দাঁড়ালেন। বিকৃত মুখে বললেন, তুমিও কম যাও না! তুমিও ওকে অ্যামেরিকা-অ্যামেরিকা করে তাতে! ই-উ-উ! আঙুল তুললেন অরীন্দ্র। ইউ আর রেসপন্সিবল ফর দিস স্ক্যান্ডাল।

পিউ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দু হাত নেড়ে একটা ভঙ্গি করে বলল, সিলি টক! তারপর সে জোরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অরীন্দ্র কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন বুঝতে পারছি বিজয়ের চোরাই রিভলভারটা বুড়োই কোনও ডাকু-গুণ্ডাকে বেচে দিয়েছে। অ্যামেরিকা যাওয়ার খরচপত্তর ও নিশ্চয় পিউয়ের কাছে জেনে নিয়েছিল। রাণু! সুশি! দ্যাখ, ছড়িটা কোথায় ফেললুম। আই মাস্ট রির্পোট টু দা পোলিস।

কর্নেল বললেন, বোসসায়েব! অ্যামবিশন কোনও-কোনও মানুষকে অন্ধ শক্তির হাতের পুতুল করে তোলে। হি বিকামস আ ডেঞ্জারাস অ্যাডভেঞ্চারার!

নো ফিলসফি! বলে অরীন্দ্র নিজেই ছত্রখান জিনিসপত্রের ভেতর ছড়ি খুঁজতে ব্যস্ত হলেন।

 কর্নেল বললেন, বোসসায়েব! আপনি গঙ্গাস্নানে যান। চিত্ত শুদ্ধ করে আসুন। সারা জীবনের অভ্যাস ত্যাগ করা ঠিক নয়। আপনি ফিলসফি বললেন। এটাই ক্রুড রিয়্যালিটি। মানুষের মস্তিষ্কে বুদ্ধি জিনিসটার বিকাশে সাহায্য করেছিল মানুষের দুটো হাত। নরবানর নরে পরিণত হয়েছিল। সেই বুদ্ধির সবটাই যদি আবার হাতে গিয়ে জড়ো হয়, নর তা হলে ফের নরবানরে পরিণত হবেই। ব্যাক টু দা নেচার আর কী! রাণু, ঠাকুর্দাকে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাও। বোসসায়েব! প্লি-ই-জ…

কর্নেল বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। রিভলভারটার লাইসেন্স ছিল না। দ্বিতীয়ত সাত্যকির হাতে গ্লাভস থাকে। তার আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না। কাজেই আইনত কোনও ভাবেই তাকে অনির্বাণ সোমের খুনী প্রমাণ করা যাবে না। হুঁ, এখন বোঝা যাচ্ছে, সাত্যকি সাইকেল-রহস্যটা জানত। প্রিয় নিজের বিপদের কথা ভেবেই তুরুপের তাস হিসেবে ওটা সাত্যকিকে দিয়েছিল। সাত্যকি নিজেই কর্নেলকে সাইকেলের ভুতুড়ে শব্দের কথা বলেছিল। হঠাৎ একটু শিউরে উঠলেন কর্নেল। কাল রাতে মেইন সুইচ অফ করে সে তাকে কি নিছক ভয় দেখাতেই গিয়েছিল? নিজের দুটো হাত ছাড়া এ বাড়িতে নিঃশব্দে কাকেও হত্যার অস্ত্র এই মরিয়া অবস্থায় আর কী থাকতে পারে তার? সে টের পেয়েছিল, কর্নেলের চোখ পড়েছে তার দিকে। কুঠিবাড়ির জঙ্গলের– সেই গাছটার কথা কাল রাতে খাওয়ার টেবিলে রাণুর সামনে বলেছিলেন রাণুর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্যই। বারীন রায় তাঁর মাথায় ছিল। কিন্তু রাণু যে রাতেই ভাইয়ের কানে কথাটা তুলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তার মানে, রাণুও টের পেয়েছিল তার ভাই কী করেছে। রাণুকে সাত্যকির ঘুসি মারার এটাই তা হলে আসল কারণ। একজন ঘুসিলড়িয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল, রক্তের কথা সাত্যকিই পুলিশকে বলেছিল!

লনের রোদে সাবর্ণী ও পিউ চুপি চুপি কথা বলছিল। কর্নেলকে দেখে ছবি হয়ে গেল। কর্নেল তাদের দিকে পা বাড়িয়েছেন, সহসা সেই রহস্যময় পাখিটা আবার ডেকে উঠল। অসহ্য! পাখিটা কদিন থেকে তার সঙ্গে অদ্ভুত লুকোচুরি খেলছে। একটা চ্যালেঞ্জ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে!

গেটের পাশে বর্মি বাঁশের ঝাড়টার পাশ দিয়ে যেতে পায়ে কী একটা জড়িয়ে গেল। বাইনোকুলার নামিয়ে দেখলেন, ঘাসের ভেতর একটা মুখোশ। সেই অরণ্যদেবের মুখোশ।

মুখোশটা মাড়িয়ে দিলেন কর্নেল। পাখিটা কি তাকে ডেকে নিয়ে যেতে চায় প্রকৃতির গভীর, গভীরতর কোনওখানে, যেখানে রক্ত ও অশ্রুর কোনও পৃথক মূল্য নেই।

পিছনে পায়ের শব্দ।

কর্নেল ঘুরে দাঁড়ালেন। বেলিংটন জেভিয়ার। মাথায় ক্রিসমাস ক্যাপ, পরনে পুরনো স্যুট, দুহাতে একটা ছোট্ট ট্রে রঙিন কাগজে ঢাকা। হ্যাপি ক্রিসমাস স্যার! বেলিংটন জেভিয়ার উজ্জ্বল মুখে হাসলেন। মাই হাম্বল গিফ্ট ফর ইউ! আপকে লিয়ে রোজি ইয়ে কেক বানায়িরাত ভর। লড়কি! তুম ভি আ যাও। পিউয়ের দিকে ঘুরলেন জেভিয়ার। কাম অন লড়কি! দিস রোজ-বোকে ফর ইউ। লো! আও, আও!

কর্নেল জেভিয়ারের দিকে এগিয়ে গেলেন। পিউ দৌড়ে গেল গোলাপের তোড়াটি নিতে। অরীন্দ্র ও রাণু পোর্টিকোর বারান্দা থেকে নামছেন এতক্ষণে। গঙ্গাস্নানে যাবেন। সাবর্ণী এখনও ছবি হয়ে আছে…