পিছনে পায়ের শব্দ – ১৬

১৬.

কেয়ার ডায়রিটা বন্ধ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। কালো সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ন্যায়শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্ব বলে একটা কথা আছে। যা যেমনটি দেখাচ্ছে, তা বস্তুত তেমনটি নয়। এটা একটা ডায়রি বই। কিন্তু এতে কোনও ডায়রি নেই। আছে কিছু টাকার অঙ্ক লেখা। কেনাকাটা, পিসেমশাইকে টাকা পাঠানো, ব্যাঙ্কে কত জমা দেওয়া হল, এইসব হিসেব। হিসেব প্রবণতা কি সব চাকুরে মেয়েরই থাকে? এটা একটা সমীক্ষাযযাগ্য বিষয়। শোনা যায়, মেয়েরা নাকি পুরুষের তুলনায় হিসেবি। সত্যি কি? অরীন্দ্রের সংসার চালায় রাণু। তার কি কোনও হিসেবের খাতা আছে?

অবভাসতত্ত্বের প্রশ্নটা ফিরে এল। কেয়া সেন এবং রোজি জেভিয়ারের হিসেব বই আর ওই কালো সাইকেলটার মধ্যে আপাতদৃষ্টে সুদূরতম সম্পর্ক থাকার কথা নয়। অথচ…

বন্ধ দরজায় শব্দ এবং অরীন্দ্রের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কর্নেলসায়েব কি শুয়ে পড়েছেন?

কর্নেল দরজা খুলে বললেন, রাত নটায় আমার শুয়ে পড়ার কথা নয়। কখন ফিরলেন?

অরীন্দ্র বসলেন। একটু পরে বললেন, আধ ঘণ্টা আগে। প্রচণ্ড টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলুম। বাসে গেলে ভাল করতুম। দু’ঘণ্টা ট্রেন লেট। আজ ঠাণ্ডাটাও বেড়েছে। ফিরে এসে ধকল সামলাতে সময় গেল।

প্রিয়র সঙ্গে দেখা হল?

অরীন্দ্র আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ। আপনাকে বলতে এলুম, লিভ ইট। প্রিয়র ফাঁসি হোক। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। যে পাপ করেছে, হি মাস্ট বি পানিল্ড।

কর্নেল হাসলেন। প্রিয় বলল সে গুলি ছুঁড়েছিল?

হ্যাঁঃ। তার নাকি মাথার ঠিক ছিল না। গাড়ির কাচ ভাঙা দেখে…ছেড়ে দিন। ও মরুক। ওর বউকে বলছি, বাবাকে গিয়ে ধরুক, জামাইকে বাঁচাবেন। অরীন্দ্র তেতো মুখে বললেন, আপনি ব্যাপারটা ভাবুন একবার। ভদ্রলোককে খবর দেওয়া হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত সাড়াশব্দ নেই। আফটার অল, জামাই!

আমার ধারণা, মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নয়।

জানি। মেয়ে তার অমতে প্রিয়কে বিয়ে করেছে। তাই বলে এমন একটা বিপদে…উনি আবার নাকি অধ্যাপক! সায়েবি চালে থাকেন। ইউরোপ-আমেরিকায় লেকচার দিতে যান। ছোট মেয়েকে আমেরিকায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। বলে অরীন্দ্র এতক্ষণে সাইকেলটা দেখতে পেলেন। খাপ্পা হয়ে বললেন, এ ঘরে সাইকেল ঢোকাল কে? নিশ্চয় ভগীরথ? ওই আরেক মাথামোটা গবেট! এত বড় বাড়িতে ওই রদ্দি জিনিসটার জায়গা হল না। শেষে আপনার ঘরে ঢোকাল। দেখাচ্ছি মজা।

অরীন্দ্র উঠতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বললেন, সাইকেলটা আমিই রেখেছি। বোসসায়েব!

অরীন্দ্র হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনি সাইকেল চেপে প্রজাপতি ধরতে যাবেন নাকি?

দেখা যাক।

ওটা কি একটা সাইকেল? বুড়ো ওটা ভগীরথকে দিয়েছে। ভগীরথ যখন সাইকেল চেপে যায়, মনে হয় ঠ্যাং-ভাঙা টাট্ট! অরীন্দ্রের স্বাভাবিক মেজাজ ফিরে এল। প্রিয়র কোম্পানির রিজেক্টেড মাল। বুড়োকে প্রেজেন্ট করেছিল। বুড়ো নিজেই সাইকেল। দুটো ঠ্যাং দুই চাকা, লক্ষ করেছেন? সবসময় গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কী যেন কথাটা?

জগিং।

হ্যাঁ, জগিং! বলে আবার একটু গম্ভীর হলেন অরীন্দ্র। যাই হোক, বড় টায়ার্ড। আমি শুয়ে পড়ব সকাল-সকাল। আপনি আর প্রিয়র ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। আপনি তো জানেন, আই অ্যাম আ ম্যান অব স্ট্রং মর্যাল প্রিন্সিপল।

রোজি জেভিয়ার এবং কেয়া সেনের মৃত্যুরহস্যের কথা আপনি বলেছিলেন বোসসায়েব!

অরীন্দ্র উত্তেজিতভাবে বললেন, ওটা আর রহস্য রইল কোথায়? অনির্বাণের মৃত্যুরহস্য যখন জানা গেল, তখন ও-দুটো ঘটনার আর কি ইমপর্টান্স রইল? কোনও লিংক রইল কি? ভেবে দেখুন। প্লিজ লিভ ইট।

অরীন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন, রাণু হঠাৎ অসুস্থ হয়েছে শুনলুম?

বাথরুমে পা হড়কে পড়ে সামান্য উন্ডেড। অরীন্দ্র গলার ভেতর বললেন। যেমন বুড়ো তেমনি রাণু। দুজনেই সবসময় জগিং করে বেড়ায়।

অরীন্দ্র বেরুলে কর্নেল বললেন, একটা কথা বোসসাহেব।

বলুন।

প্রিয় কি বলল কোর্টে কবুল করবে?

অরীন্দ্র বাঁকা হাসলেন। চার্জ করেছিলুম, সে সৎসাহস আছে তোর? কোর্টে বলতে পারবি কথাটা? তখন বলল, অ্যাডভোকেট বারণ করেছেন। অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথাটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উনি বললেন, আত্মরক্ষার জন্য গুলি ছুঁড়লে সাজার চান্স কম। কিন্তু প্রব্লেম হল, রিভলভারটার যে লাইসেন্স নেই!

মিসাইল এক্সপার্টদের রিপোর্ট এসেছে পাটনা থেকে?

 অ্যাডভোকেট বললেন, দু’একদিনের মধ্যে এসে যাবে।

অরীন্দ্র চলে গেলে কর্নেল দরজা বন্ধ করে দিলেন। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে রোজিকে লেখা সেই চিঠিটায় মন দিলেন। রোজি এবং কেয়ার ব্যাপারে অরীন্দ্রের ধারণা সত্যি হত, যদি না এই চিঠিটা আবিষ্কার করতেন কর্নেল। কেউ রোজিকে টাকা দিতে ডেকেছিল। তার নামের আদ্যক্ষর কে অথবা আর। আর যদি হয়, তা হলে কি রাজেশ শর্মা–আশাপুরা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার? একবার আশাপুরা যাওয়া দরকার। কেয়া কার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল এখানে, এ-ও একটা জরুরি প্রশ্ন। সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আবার অবভাসতত্ত্ব মাথায় এল। কর্নেল সাইকেলটার দিকে তাকালেন। বনোয়ারিলাল বলছিলেন, হাজার হাজার সাইকেলের ভেতর কিছু সাইকেল লোডিং-আনলোডিংয়ের সময় ড্যামেজ হয়ে যায়। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটাও তা-ই, কিন্তু গড়নটা কেমন বেঢপ। কালো। রঙে ঢাকা পড়লেও বোঝা যায়, ফিনিশিং ভাল ছিল না। অসংখ্য এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেলের মধ্যে ড্যামেজ এবং বাতিল হওয়া সাইকেলগুলো সবই কি এই সাইকেলটার মতো বেঢপ গড়নের? কর্নেল হতাশ বোধ করলেন। জীবনে কখনও এমন জটিল গোলকধাঁধায় ঢোকেননি। চোখ বুজে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন। কামড়ানো চুরুট থেকে ধোঁয়ার ফালি জানালার দিকে যেতে যেতে এঁকেবেঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে। জলার দিক থেকে কোনও শীতকাতুরে শেয়ালের ডাক ভেসে এল…

কর্নেল ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পিচরাস্তায় পা দিয়েছেন, পিছনে পিউয়ের সাড়া পেলেন। আজ কুয়াশা নেই তত। বললেন, তুমি কি আজ আমাকেই তোমার জগিংয়ের সঙ্গী করতে চাও, ডার্লিং?

পিউ বলল, নাহ্। মুড নেই।

সাত্যকিকে তুমি ত্যাগ করলে, নাকি সাত্যকি তোমাকে ত্যাগ করল?

হি ইজ আ ব্রুট, আই টোল্ড ইউ দ্যাটু। সত্যি বলছি কর্নেল, আমি ভীষণ ভী-য-ণ শম্।

মাই গুডনেস! তুমি কি ওর সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করেছ নাকি?

 আমি তত আনসিভিলাইজড নই।

সাত্যকি তোমাকে ডাকেনি?

ডেকেছিল। বললুম, মুড নেই। পিউ আস্তে বলল, চলুম। আপনাকে দেখিয়ে দিই কোথায় জামাইবাবুর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। জায়গাটা আপনার দেখা। দরকার।

হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, ভাই-বোনে কাল কী নিয়ে বেধেছিল জানতে পেরেছ?

কারও পার্সোনাল ব্যাপারে আমার মাথাব্যথা নেই। এদের ফ্যামিলিটা কেমন অদ্ভুত। বাইরে বাইরে মডার্ন পালিশ, ভেতরে একেবারে প্রিমিটিভ–গাঁইয়া! আমি কল্পনাও করতে পারিনি…পিউ থেমে গেল হঠাৎ।

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললেন, ক্রিসমাস গেম! ক্রিসমাস… জিগজ্যাগ! অসাধারণ!

হাঁসের ঝাঁক দেখে আপনি কী আনন্দ পান?

আনন্দ অনির্বচনীয়, ডার্লিং! হিমালয় অঞ্চলের হাঁস সাইবেরিয়ান হাঁসের মতো পালাই পালাই ভাব নিয়ে দায়সারা তীর্থ করতে আসে না। লুক, লুক! ভোরের আকাশকে চাবুক মারছে কেউ।

কর্নেল! চলুন না আজ বার্ডস্যাংচুয়ারি দেখে আসি। সেদিনই গণাদার গাড়িতে যাওয়া যেত। রাণুদি বললেন, ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। চান্স মিস করলুম। তারপর তো আনুদা মার্ডার হয়ে গেল। পিউ শ্বাস ছাড়ল জোরে।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, গণনাথবাবুর গাড়িতে যাওয়া যেত কবে?

যে-রাতে আনুদা মার্ডার হয়, সেদিন বিকেলে ইরিগেশন ক্যানেলের ওখানে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ দেখি গণাদার গাড়ি। লোকেশন দেখতে এসেছে বলল। আপনাকে তো অলরেডি বলেছি সে-কথা।

বয়স! কর্নেল একটু হাসলেন। আজকাল সব কথা মনে থাকে না। হুঁ, তুমি বলছিলে বটে, ওয়াটারড্যামের পার্কে খুব ছোটাছুটি করেছ! সাবর্ণী তোমার আণুদাকে দেখে রিঅ্যাক্ট করেনি?

বিবি আমাদের সঙ্গে যায়নি। দাদামশাই তাকে ওই কুঠিবাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গণাদার গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিল। বিবি আর দাদামশাই তার অনেক আগে বাড়ি ফিরেছিলেন।

তোমার আনুদা সঙ্গে আসেনি নিশ্চয়?

 নাহ। বিবিকে দেখতে আসবে নাকি? পিউ বাঁকা হাসল। বিবি ওকে প্যাক দিয়েছে, আর ও আসবে বিবিকে দেখতে? আর, গণাদা তো পুরো ব্যাপারটা জানে। আনুদা আনপ্রেডিক্টেবল এলিমেন্ট ছিল ঠিকই। কিন্তু গণাদা তাকে আসতে দেবে কেন? সিন ক্রিয়েট হওয়ার চান্স ছিল না? তাছাড়া গণাদাও আনুদাকে ভয় পেত। রাণুদি আর আমি আসতে বললুম গণাদাকে। বলল, পরে যাবে। তার মানেটা বুঝতে পারছেন?

গণনাথবাবুর ড্রাইভার পৌঁছে দিয়েছিল তোমাদের?

 গণাদার ড্রাইভার নেই। নিজেই ড্রাইভ করে। ভীষণ কিপটে।

 তাহলে কে পৌঁছে দিয়েছিল?

কে একটা লোক। চিনি না। জাস্ট অ্যান অর্ডিনারি টাইপ। তবে ভাল ড্রাইভ করে।

রামলাল?

 পিউ তাকাল। একটু পরে বলল, হ্যাঁ। গণাদা রামলাল বলে ডাকছিল মনে পড়ছে। আপনি চেনেন?

কর্নেল আবার আকাশ দেখতে দেখতে বললেন, বড্ড বেশি লাল। তবে রামলালেও একটি আর আছে। কিন্তু সে কি ইংরেজিতে চিঠি লিখতে পারে? প্রব্লেম!

বুঝলুম না।

আমিও বুঝি না। চেজিং আফটার সো মেনি রেড হেরিংস।

ভ্যাট! আপনার সবসময় হেঁয়ালি। বলে পিউ থমকে দাঁড়াল। ডাইনে তাকিয়ে রইল।

কর্নেল ঘুরে বললেন, রহস্যজনক কিছু দেখতে পাচ্ছ কি?

সেই জায়গাটা খুঁজছি। পিউ এগিয়ে গেল রাস্তার ধারে ঘন ঝোপগুলোর দিকে। তারপর এক টুকরো কাচ কুড়িয়ে নিয়ে বলল, এই যে এখানে। দেখতে পাচ্ছেন তো এই ঝোপগুলো না থাকলে জামাইবাবুর কী সাংঘাতিক অবস্থা হত?

কর্নেল তার কাছে গেলেন। অজস্র কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে ঘাসে। চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন, প্রিয় বুদ্ধিমান। কিন্তু এই ঝোপগুলোও তাকে বাঁচাতে পারত না, যদি স্টিয়ারিংও অকেজো হয়ে থাকত। স্টিয়ারিং তাকে বাঁচিয়েছে। তা না হলে কী ঘটত লক্ষ করো! লুক ডার্লিং!

কর্নেল ঝোপের ভেতর গিয়ে দাঁড়ালেন। পিউ তার কাছে গিয়ে বলল, কী?

রাস্তাটা ওখানে বেঁকে গেছে। বাঁকের মুখে সব রাস্তার বাঁপাশ একটু ঢালু রাখা হয়। গতিশীল কোনও জিনিস হঠাৎ বেঁকে গেলে ব্যালান্স হারায়। সেই ব্যালান্স বজায় রাখতেই এই ব্যবস্থা। প্রকৃতির নিয়ম আমরা বদলাতে পারি না, পিউ! নিয়মটা জেনে তাকে নিয়ন্ত্রণ করি।

পিউ হাসল। আপনি মাঝে মাঝে বড্ড ফিলসফি আওড়ান।

জিভ কেটে মাথা নেড়ে কর্নেল বললেন, সায়েন্স ডার্লিং, সায়েন্স!

কিন্তু ব্যাপারটা কী?

বাঁকের বাঁদিকে জলাটা দেখতে পাচ্ছ না? ওই জলার ধার দিয়ে আমরা সেদিন রাস্তায় উঠেছিলুম। পিউ দেখে নিয়ে একটু চমকে ওঠার ভঙ্গিতে বলল, জামাইবাবু জোর বেঁচে গেছে!

হুঁ! স্টিয়ারিং অকেজো হয়ে গেলে গাড়িটা এই ঝোপে ঢোকানো যেত না। বাঁকের মুখে গিয়েই টাল খেয়ে জলে পড়ার চান্স ছিল। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রাখলেন ফের। একটু পরে সেটা নামিয়ে বললেন, প্রিয় বেঁচে গেল দেখে যে তাকে অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়ে মারতে চেয়েছিল, সে একটা জিনিস শেখে। স্টিয়ারিংকেও অকেজো করে দিতে হবে। বরুণের বেলায় দুটো কাজই সে করেছে। তাই বরুণ বাঁচেনি।

পিউ তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল দম আটকানো গলায় বলল, জামাইবাবুকে মারতে চেয়েছিল? কী বলছেন আপনি!

কর্নেল কোনও জবাব না দিয়ে ঝোপঝাড়ের আরও ভেতরে ঢুকলেন। বাইনোকুলারে জলাটা দেখে নিয়ে ফিরে এলেন পিউয়ের কাছে। বললেন, বড্ড বেশি শিশির।

আপনি আমার কথার উত্তর দিলেন না!

 দিয়েছি।

পিউ জেদি ভঙ্গিতে বলল, আনুদা ছাড়া জামাইবাবুর আর কোনও শত্রু ছিল না। কিন্তু বরুণদার অ্যাকসিডেন্টের আগেই আনুদা ডেড। সত্যিই ইউ আর চেজিং আফটার আ রেড হেরিং।

কর্নেল রাস্তায় হাঁটতে থাকলেন।

পিউ সঙ্গ নিয়ে বলল, কোম্পানির গাড়ি মানেই রদ্দি জিনিস। এদের সাইকেলটার মতো, পোলিশ ইজ কারেক্ট।

কুঠিবাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন কর্নেল। বললেন, সাত্যকি ফিরে আসছে।

পিউ শক্ত মুখে বলল, আই ডোন্ট বার অ্যাবাউট হিম।

ডার্লিং! ঘুসি-লড়িয়েরা একটু গোঁয়ারটাইপ হয়।

 তাই বলে দিদির গায়ে হাত তুলবে?

আমার ধারণা, ঘুসি-লড়িয়েদের মধ্যে একটা অন্ধ শক্তি কাজ করে। অন্ধ এবং আদিম শক্তি কোনও-কোনও সভ্য মানুষের মধ্যে এখনও থেকে গেছে। অ্যানথ্রপয়েড গ্রুপ যে ক্রমশ হোমোসেপিয়েন এবং তারপর হোমোসেপিয়েন সেপিয়েন হতে পেরেছে, তা শুধু দুটো হাতের সাহায্যে। মানুষের হাত সভ্যতার মূল উপাদান। মানুষের হাত থেকেই ইনটেলিজেন্সের উদ্ভব। লেট মি এক্সপ্লেন…।

পিউ বিরক্ত হয়ে বলল, ও-ও কর্নেল! প্লি-ই-জ!

সাত্যকি পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হাত নেড়ে গেল। কর্নেল হাসলেন। দেখলে তো? সাত্যকি হাত দিয়ে আমাদের সম্ভাষণ করে গেল। হাত কথা বলে ডার্লিং! হাত জিনিসটা সামান্য ভেবো না। যে পৃথিবীকে তুমি দেখছ, মানুষের হাতের ছাপ তার আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। মানুষ যা কিছু করে, তাতে তার হাতের ছাপ থেকে যায়।

ইউ আর আ স্ট্রেঞ্জ পার্সন, ইনডিড।

সরি ডার্লিং! কর্নেল আবার হাঁটতে থাকলেন। সবে হাল্কা সোনালি আলোর রঙ পড়েছে পারিপার্শ্বিক ধূসরতায়। একটু পরে বললেন, তুমি বার্ড-স্যাংচুয়ারি। দেখতে যেতে চাইছিলে। যাব। তবে তার আগে একবার ইরিগেশন বাংলোয় যেতে চাই। গণনাথবাবুর সঙ্গে আলাপের ইচ্ছা।

পিউ দাঁড়িয়ে গেল। আমি আপনার সঙ্গে যাব না। ক্যানেল ব্রিজে ওয়েট করব।

ঠিক আছে।

আপনি বেশি দেরি করলে আমি কাট করব কিন্তু।

নাহ্। দেরি হবে না।

 পিউ ব্রিজে পৌঁছে জলের দিকে ঝুঁকে রইল। কর্নেল বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। গেটের কাছে পৌঁছুলে রামলাল হন্তদন্ত এসে স্যালুট ঠুকল। পরনে খাকি পশমি ওভারকোট। মাথায় আঁটো মাফলার। আইয়ে, আইয়ে কর্নিলসাব!

ফিল্ম ডাইরেক্টর সেনসাব উঠা?

জি। আজ শ্যুটিং হোগি, মালুম।

 শর্মাজি?

 রামলাল তাকাল। একটু পরে বলল, কাল শৰ্মাসাব আশাপুরা গয়ে হেঁ।

হাম সেনসাবকা সাথ মিলনা চাহতা, রামলাল!

এক মিনিট ঠর যাইয়ে!

রামলাল চলে গেল বাংলোর বারান্দায়। কর্নেল গেটের ভেতরে ঢুকলেন। গণনাথ সেনকে বেরুতে দেখলেন বারান্দায়। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে সহাস্যে। বললেন, নমস্কার মিঃ সেন! অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আপনার মতো প্রখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপের সুযোগ ছাড়তে পারলুম না।

বারান্দায় উঠেই কর্নেল তাকে একটি কার্ড দিলেন। গণনাথ কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘দা নেচারিস্ট’ মানে?

নেচার অবজার্ভার। কর্নেল বারান্দার বেতের চেয়ারে বসলেন। প্রকৃতিপ্রেমিক বলতে পারেন।

আপনি কোথায় উঠেছেন?

ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। বনজঙ্গলে টো-টো করে ঘুরতে আসি।

রামলাল কর্নেলকে আপ্যায়নের জন্য কিচেনের দিকে চলে গেল। গণনাথ একটু হেসে বললেন, আপনি রিটায়ার্ড কর্নেল। নর্থ ইন্ডিয়ায় দেখেছি সামরিক অফিসাররা রিটায়ার করে ফার্ম-টার্ম করেন কান্ট্রিসাইডে। আপনি এই এরিয়ায় তেমন কিছু করলেও পারেন। করে ফেলুন। সিরিয়াসলি বলছি। সত্যিই বিউটিফুল ন্যাচারাল স্পট। ছবিতে ডিটেলস ধরতে চাইছি।

আপনার ছবির কাজ কতদূর এগোলো?

 সামান্যই। মধ্যে দুটো মিসহ্যাপের জন্য…

শুনলুম। আপনার ইউনিটের এক ভদ্রলোক নাকি খুন হয়েছেন এবং খুনি নাকি ধরাও পড়েছে। কী ব্যাপার বলুন তো?

গণনাথ অন্যমনস্কভাবে বললেন, আজকাল যা হচ্ছে। নারীঘটিত ব্যাপার। মাঝখান থেকে আমার টাইম অ্যান্ড মানি দুই-ই লস। ফাইন্যান্সার বিগড়ে গেলেই প্রব্লেম। ওঁদের এক অফিসার আবার গত পরশু রাত্তিরে অ্যাক্সিডেন্টে মারা পড়েছেন। ড্রাংক অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি ভাবনায় পড়ে গেছি। পর-পর দুটো মিসহপ।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আস্তে বললেন, শুনলুম দুটো কেসেই একটা কমন ব্যাপার পুলিশ লক্ষ করছে–গাড়ির ব্রেক ফেল। আপনি আপনার গাড়ি সম্পর্কে সাবধান হোন, মিঃ সেন!

গণনাথ চমকে উঠেছিলেন। বললেন, কী বলতে চান আপনি?

 কর্নেল আরও আস্তে বললেন, আপনি বিপন্ন মিঃ সেন!

তারপর বারান্দা থেকে নেমে লনের নুড়িতে শব্দ তুলতে তুলতে চলে এলেন। গণনাথ পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছেন! রামলাল কিচেনে কর্নিলসাবের জন্য কফি তৈরিতে ব্যস্ত..

.