দু’নম্বর চাবি – ৬

০৬.

 সেই সন্ধ্যায় প্রায় এক ঘণ্টা পরে কালীপদ ফিরে এসে বলেছিল, বড়বাবুকে চিঠি দিলুম। উনি ফোন করে বললেন, ডি আই জি সায়েবকে এখন অফিসে পাওয়া গেল না। রানীমার খবর দিয়ে রাখছেন। অফিসের লোক খবর পৌঁছে দেবে।

 রাত্রে খাওয়ার সময় রানীমা বললেন, অরবিন্দ খবর পেলে ঠিকই এসে যাবে। কিন্তু চাবির ব্যাপারে কোনও কথা যেন ওকে বলবেন না।

কর্নেল বললেন, না। আমি শুধু ওঁর কাছে বাচ্চুবাবুর ব্যাপারে পুলিশের হাতে কী ইনফরমেশন আছে, সেগুলোই জানতে চাইব। অবশ্য অরবিন্দবাবু আমার নাম শুনে থাকতেও পারেন। কারণ এখানে আসবার আগে আমি পুলিশের ওপরমহলে ঠিক জায়গায় জানিয়ে এসেছি, যাতে প্রয়োজনে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য পাই। অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়।

কথায় কথায় ভটচাযমশাইয়ের আমাশার কথা এসে গেল। রানীমা বললেন, হরেকেষ্টর সব ভাল। শুধু নানান শুচিবায়ুতে ভোগে।

বললুম, ওঁর অসুখটা আন্ত্রিক নয় তো? তা হলে কিন্তু ভয়ের কথা।

না। আমাশা ওর বারোমাসের ব্যাধি। রানীমা হাসতে হাসতে বললেন, কবরেজি মতে, আমাশা হলেই নাকি জোলাপ খেতে হয়। ওর জোলাপ ইসবগুলের ভুষি। সব সময় কিনে এনে রাখে।

এই সময় বাইরে কালীপদর হাঁকডাক শোনা গেল। ঠাকুরমশাই! ওদিকে নয়। সিডবেড নষ্ট করলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। পুকুরপাড়ে যান। চলুন আমি ঘাটে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।

রানীমা মুখে কাপড়চাপা দিয়ে বললেন, বড় নোংরা হরেকেষ্ট! এদিকে বেজায় ভীতু। দিনদুপুরে ভূত দেখতে পায়।

খাওয়ার পর রানীমার কাছে বিদায় নিয়ে আমরা আমাদের ঘরে এলুম। রাত প্রায় দশটা। কর্নেল বললেন, শুয়ে পড়ো জয়ন্ত! ভোরে তোমাকে নিয়ে বেরবো।

বললুম সর্বনাশ! এই প্রচণ্ড শীতের ভোরে?

জগিং করতে করতে যাব। দেখবে, শীত কেমন জব্দ হয়ে যাচ্ছে।

আপনার মিলিটারি বডি।

কর্নেল হাসলেন। সারেংডির জঙ্গলের মুখে একটা টিলা আছে। সেই টিলায়, উঠে সূর্যোদয় দেখব। দেখে এসেছি, নদীর ওপর পুরনো কাঠের ব্রিজটা কংক্রিটের ব্রিজ হয়েছে। বিহারের আদিবাসীরা ব্রিজ পেরিয়ে বিজয়গড়ের বাজারে বেচাকেনা করতে আসে। নদীটা ওয়াটার ড্যামের জন্য ওখানে নেহাত ঝরনার রূপ নিয়েছে। জলের সেই স্বচ্ছতাও নেই। তবে দু’ধারে পাথরের ফাঁকে বুনো ফুল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।

এবং প্রজাপতি!

হ্যাঁ। প্রজাপতি। তবে শিশির না শুকোলে প্রজাপতিরা বেরোয় না।

 সেই টিলাটা এখান থেকে কত দূরে?

মাত্র তিন-সওয়া তিন কিলোমিটার।

আর কিছু বললুম না। মশারি খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে কম্বল মুড়ি দিলুম। কর্নেল চেয়ারে বসে চুরুট টানতে থাকলেন। মনে মনে ঠিক করলুম, কর্নেল যতই টানাটানি করুন। ভোরে আমি কিছুতেই বিছানা ছেড়ে বেরুব না। ভোরে এই এলাকায় যা বিচ্ছিরি কুয়াশা দেখেছি!

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত!

সাড়া দিলুম না। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলুম।

কর্নেল বললেন, তুমি ঘুমোওনি জয়ন্ত! বুঝতে পারছি ভোরে আমার সঙ্গে বেরুতে তোমার বেজায় অনিচ্ছা। ডার্লিং! টিলায় উঠে সূর্যোদয় দেখার কথা তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। একটু চিন্তা করলেই তুমি বুঝতে পারতে, ঘন কুয়াশার মধ্যে সূর্যোদয় দেখা সম্ভব নয়।

অগত্যা মুখ খুলতে হল। তা হলে সারেংডির টিলার মাথায় কষ্ট করে চড়ার দরকারটা কী?

কর্নেল হাসলেন। চাপাস্বরে বললেন, টিলাটার মাথায় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ছোট্ট একটা বাংলো আছে। বাংলোতে এক ভদ্রলোক আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।

কে তিনি?

সাসপেন্সটা ভাঙছি না। তুমি গিয়েই দেখবে। বলে কর্নেল উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর পোশাক বদলাতে গেলেন বাথরুমে। মশারির ভেতর থেকে দেখলুম, নাইট ড্রেস পরে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বড় আলোটা নিভিয়ে দিলেন। কিটব্যাগ থেকে কী সব বের করে টেবিলে ঝুঁকে বসে রইলেন। হাতে আতস কাঁচ। ওঁর পিঠের দিকটা চোখে পড়ছিল। তাই বুঝতে পারলুম না আতস কাঁচ দিয়ে কী দেখছেন।…

.

শীতকালের ভোর ছ’টায় বিছানা ছেড়ে ওঠা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু কর্নেল একটা সাসপেন্সের টোপ ঝুলিয়ে রেখেছেন সামনে। কর্নেল পোশাক পরে তৈরি ছিলেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলুম। বেরিয়ে গিয়ে দেখলুম কাল ভোরের মতোই গাঢ় কুয়াশা সব কিছু ঢেকে রেখেছে। বারান্দায় কালীপদকে দেখে বুঝলুম, তাকে কর্নেল বলে রেখেছেন। কারণ গেটে রাত্রে তালা দেওয়া থাকে। সে তালা খুলে দিয়ে বলল, সারারাত ঠাকুরমশাই জ্বালাতন করেছেন। একা বেরুনোর সাহস নেই। শেষ রাত্তিরে অসুখ কমেছে হয়তো। আর ডাকাডাকি করেননি।

মোরাম রাস্তায় কর্নেল জগিংয়ের ভঙ্গি করে বললেন, নাহ। বড় বাজে রাস্তা। পাথর উঁচিয়ে আছে। এ বয়সে ঠ্যাং ভাঙতে রাজি নই।

প্রায় দু’কিলোমিটার এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে ব্রিজ পাওয়া গেল। ডাইনের সংকীর্ণ রাস্তাটা গেছে টমসায়েবের বাংলোর দিকে। সেই টিলাটা কালো হয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছিল সেটা। ব্রিজ পেরিয়ে কর্নেল বললেন, এবার ধীরে-সুস্থে যাওয়া যেতে পারে।

কিছু দূর হাঁটার পর পিচ রাস্তা পাওয়া গেল। কর্নেল বললেন, যে রাস্তায় এলুম সেটাও পিচ হয়ে যাবে। কবে হবে বলা অবশ্য কঠিন। দুই রাজ্যের সরকারের মধ্যে বোঝাঁপড়া হয়ে গেছে। জনসায়েব বলছিল, দুই রাজ্যের পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়াররা মাপজোক করে ফেলেছেন। সারেংডি ফরেস্টে ট্যুরিস্টদের জন্য বাংলো তৈরি হচ্ছে। আট বছর আগে সারেংডিতে প্রচুর জন্তু-জানোয়ার দেখে গেছি। এখন নাকি কদাচিৎ তাদের দেখা যায়। চোরাশিকারিদের যা উৎপাত।

পিচ রাস্তা থেকে সংকীর্ণ একটা রাস্তা বাঁক নিতে নিতে টিলায় উঠেছে। এতক্ষণে টিলার মাথায় গাছপালার ফাঁকে ছোট্ট একটা বাংলো চোখে পড়ল। মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ছাত্র জীবনেই ট্রেনিং নিয়েছিলুম। কর্নেলের সঙ্গী হয়ে তা মাঝে মাঝে কাজে লাগে। কর্নেলের তো সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা আছে। রাস্তাটা ছেড়ে ঝোপ-জঙ্গল আর পাথরের ভেতর দিয়ে বাংলো লক্ষ করে দু’জনে সোজা উঠে গেলুম।

তারপর কাঠের বেড়ার ধারে ধারে সাবধানে এগিয়ে গেটের সামনে গেলুম। পুবদুয়ারি টালিতে ছাওয়া বাংলোর বারান্দায় চেয়ারে বসে কেউ দু’হাতে কাপ ধরে চা খাচ্ছিলেন। মাথায় হনুমান টুপি। পরনে সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট। আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। অমনি তাকে চিনতে পারলুম। প্রাইভেট ডিকেটটিভ কে কে হালদার।

বললুম, কী আশ্চর্য! হালদারমশাই, আপনি এখানে?

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আর কইবেন না। ক্লায়েন্ট আমারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইতেছে। কী ঠাণ্ডা জায়গা! দুইখান কম্বলেও শীত যায় না। হোল নাইট ঘুম হয় নাই।

কর্নেল বললেন জয়ন্তকে, কেমন একখানা সাসপেন্স দিলুম।

 বললুম, তা দিলেন বটে! আমি কল্পনাও করিনি হালদারমশাইকে এখানে দেখতে পাব।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চৌকিদার কানে কালা। বয়সে বুড়া। চা করতে বলে আসি। কফি নাই কর্নেল স্যার! চা-ই খান। আমার মাথার ঠিক ছিল না। ক্লায়েন্টের লগে-লগে আইয়া পড়ছি।

কর্নেল বললেন, ব্যস্ত হবেন না। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

নাহ্। কাইল রাত্রে মিট করবে কইছিল। আর পাত্তা নাই।

বলে হালদারমশাই বাংলোর পেছন দিকে চলে গেলেন। টালি-চাপানো বাংলোয় পাশাপাশি মাত্র দুটো ঘর। বারান্দায় কাঠের যেমন-তেমন একটা টেবিল আর দুটো নড়বড়ে চেয়ার। দেয়াল ঘেঁষে সিমেন্টের বেঞ্চ। ভীষণ ঠাণ্ডা। ক্লান্তির জন্য সেখানে বসতে যাচ্ছিলুম, কর্নেল বললেন, এই চেয়ারে বসো জয়ন্ত। এটা আমার ভার সহ্য করতে পারবে না। আমি বেঞ্চে বসি।

বললুম, এই সাসপেন্সের অর্থ হয় না। কাল বিকেলে রাজবাড়িতে ফিরে বললেই পারতেন যে

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, শীতের ভোরে হাঁটার কষ্টটা কেমন পুষিয়ে গেল বলো!

বুঝতে পারছি, কাল বেড়াতে গিয়ে হালদারমশাইয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল।

কর্নেল হাসলেন। হয়েছিল মানে, ওয়াটার ড্যামের ধারে জঙ্গল থেকে একটা নীল সারস উড়ে এদিকে আসছিল। তাকে বাইনোকুলারে ফলো করে দেখি এই বাংলোর সামনে হালদারমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। তক্ষুণি এসে হাজির হয়েছিলুম। উনিও তোমার মতো আমাকে এখানে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। আমরা তো ওঁকে বলে আসিনি কোথায় যাচ্ছি।

হালদারমশাই এসে গেলেন। চেয়ারে বসে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কাইল রাত্রে ক্লায়েন্টের এখানে আমার লগে মিট করার কথা ছিল। আসে নাই। কী করি। কন কর্নেল স্যার?

ওয়েট করুন। আমি কাল বিকেলে আপনাকে বলেছিলুম, নলপাহাড়ির বাংলোতে আপনার ক্লায়েন্টের দাদা ফ্যামিলি নিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছে। আজ রবিবার। বিকেলে জনসায়েব চিত্তরঞ্জন ফিরে যাবেন। সে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আইভি এ তল্লাটে আসার রিস্ক নেবে না।

হালদারমশাই রুমালে নাক মুছে বললেন, মেমসায়েব কইছিল, রাত্রে কে তারে নাকি মোটর সাইকেলে লইয়া আইবে।

বলেছে যখন, তখন আইভি আসবে। জনসায়েব চলে যাওয়ার পর অন্ধকার নামলেই সে আসতে পারবে। বিজয়গড়েও যেখানে আইভি আছে, সেখান থেকে দিনের বেলায় বাইরে বেরুনো তার পক্ষে নিরাপদ নয়। অলকে নিখোঁজ হওয়ার কেসে পুলিশ তাকেও যে খুঁজছে। আপনাকে তো সবই বলেছি। বলে আমার দিকে তাকালেন। জয়ন্ত ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানার জন্য উৎসুক। হালদারমশাই বলবেন, নাকি আমি বলব?

গোয়েন্দামশাই একটু হেসে বললেন, আপনি কন। আমার মুড নাই।

 কর্নেল আমাকে যে ঘটনা শোনালেন, তার বিবরণ এই :

শুক্রবার রাত দশটায় আমরা যখন হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলুম, তখন হালদারমশাইও তার বাড়িতে ক্লায়েন্ট মেমসায়েবের ফোনের প্রতীক্ষা করছিলেন। সওয়া দশটা নাগাদ মেমসায়েব তাকে ফোন করে জানায়, তারা স্বামী-স্ত্রী শেয়ালদার হোটেল ছেড়ে রিপন স্ট্রিটে আসছিল। সেখানে মেমসায়েব অর্থাৎ আইভির স্বামী জেমস বিশ্বাসের এক আত্মীয় থাকে। কিন্তু ট্যাক্সি না পেয়ে দু’জনে রিকশাতে চেপে আসছিল। মৌলালিতে ট্রাফিক সিগনাল না পেয়ে রিকশা বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ আইভির গলায় হ্যাঁচকা টান পড়ে। সেই পরচুলাপরা লোকটাই হবে, যদিও রিকশার হুড তোলা ছিল বলে তাকে আইভি দেখতে পায়নি লকেটশুদ্ধ চেনটা ছিনতাই করে ভিড়ে উধাও হয়ে যায়। আইভি হালদারমশাইকে বলে, এই লকেটটা খুব দামী। যে ‘স্কাউড্রেল’ ওটা হাতানোর জন্য তাদের অনুসরণ করে কলকাতা এসেছিল, সে বিজয়গড়ের লোক। কারণ আইভি যখন বিজয়গড়ে খ্রিস্টান মিশন স্কুলে শিক্ষিকা ছিল, তখন তাকে সে বহুবার দেখেছে। কিন্তু তার পরিচয় জানে না। তার পরিচয় জানবার জন্যই আইভি প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য চেয়েছিল। এখন লকেটটাও সে উদ্ধার করতে চায়। তাই হালদারমশাই যদি তার সঙ্গে বিজয়গড়ে যান, তার পুরো ফি সে দেবে। পুরো ফি কত, তা-ও সে জানতে চায়। হালদারমশাই রহস্যের গন্ধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই তিনি তাকে বলেন, কাজ সফল হলে ম্যাডাম যা খুশি তাই দেবেন। তারপর কথামতো শনিবার ভোর ছটায় হালদারমশাই হাওড়া স্টেশনে যান। ‘মেমসায়েব’ বলেছিল সে একা যাবে। তার পরনে থাকবে। জিনসের প্যান্ট-জ্যাকেট, লাল শার্ট আর চুলে লাল স্কার্ফ জড়ানো। সেখানে গিয়েই মুখোমুখি পরিচয় হয় ক্লায়েন্টের সঙ্গে। তার বয়স বাইশ-তেইশের মধ্যে বলে। মনে হয়েছিল হালদারমশাইয়ের। ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে পৌনে দশটায়। আসানসোল পৌঁছেছিলেন দু’জনে। তারপর ট্রেন বদলে অণ্ডাল জংশন হয়ে। গৌরাঙ্গডিহিতে পৌঁছান বেলা দেড়টা নাগাদ। তারপর মেমসায়েব তাঁকে বলে, বিজয়গড়ে থাকার মতো তেমন হোটেল নেই। তিনি বাসে চেপে বিজয়গড় গিয়ে সেখান থেকে এক্কাগাড়ি ভাড়া করে যেন সারেংডি বনবাংলোয় চলে যান। চৌকিদারকে টাকা দিলেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওখানে সচরাচর কেউ থাকে না। খালি ঘর পাওয়া যাবে। আর আইভি তার সঙ্গে রাত দশটা নাগাদ গিয়ে দেখা করে আসবে। বিজয়গড়ে সে একা সন্ধ্যার বাসে যাবে। ওখানে তার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে। সেই বন্ধুর স্বামীর নাম যোশেফ। যোশেফের মোটর সাইকেল আছে। কাজেই তার অসুবিধে নেই। তারপর হালদারমশাইকে কী করতে হবে, সে রাত দশটা নাগাদ এই বাংলোতে এসে জানাবে….

ইতিমধ্যে চা এসে গিয়েছিল। চা খেতে খেতে মনে পড়ল, শেয়ালদার হোটেলে থাকার সময় সন্ধ্যাবেলায় পরচুলাপরা লোকটা আইভির চেন ধরে টান দিয়েছিল এবং আইভি হোটেলের সিঁড়িতে ওঠার সময় লকেটটা মুঠোয় চেপে ধরেছিল। এটা হালদারমশাইয়ের মুখে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে বসে শুনেছিলুম। তাই বললুম, হিরে বসানো লকেট নাকি?

হালদারমশাই বললেন, ক্লায়েন্ট সে সম্পর্কে কিছু বলে নাই। শুধু কইছিল, দ্যাট ওয়াজ এ ভেরি ভ্যালুয়েবল অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল অর্নামেন্ট।

বললুম, হিস্টোরিক্যাল–ঐতিহাসিক? কর্নেল!

কর্নেল আমার বক্তব্য আঁচ করে শুধু বললেন, হাঃ! তুমি ঠিকই ধরেছ।

তা হলে তা গলায় ঝুলিয়ে বেড়াত কেন আইভি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, যে-কারণে রানীমা সিন্দুকের চাবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন।

হালদারমশাই বললেন, সিন্দুকের চাবি? সিন্দুক ক্যান?

 হালদারমশাই! সেকেলে অভিজাত বা রাজ-জমিদারদের বাড়িতে সিন্দুক থাকে। এ কোনও নতুন কথা নয়।

বললুম, কর্নেল! বাচ্চুর উপহার। তাই না?

কর্নেল বললেন, তাছাড়া আর কী?

হালদারমশাই বললেন, ক্লায়েন্টের লগে কথা কইয়া বুঝছি, সে এই এরিয়ায় গোপনে থাকতে চায়।

হ্যাঁ। সে এলে তাকে সতর্ক করে দেবেন, পুলিশ তাকে খুঁজছে। কথাটি আবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলুম।

হালদারমশাই একটু অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু অরে দেখলে বুঝবেন মুখোন খুব ইনোসেন্ট। এক্কেরে ইয়ং এজ। শি ইজ নট এ ক্রিমিন্যাল। চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মুখ দেইখ্যাই কইয়া দিতে পারি ইনোসেন্ট, না ক্রিমিন্যাল।

বুঝলেন না? সব পুলিশ তো আপনার মতো নয়। বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি। আপনি বিশ্রাম করুন। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে সম্ভবত আজ সন্ধ্যার পরই আপনার দেখা হবে। লকেটের ব্যাপারটাতে গুরুত্ব। দেবেন। তাকে বলবেন, এই লকেট সে কোথায় কার কাছে কীভাবে পেয়েছিল, সে সব খুলে না বললে আপনি ওটা উদ্ধার করে দিতে পারবেন না।

আশা করি, আগামীকাল আপনি রাজবাড়িতে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন। এই চব্বিশটা ঘণ্টা আপনি কষ্ট করে একা থাকুন। একা থাকা আপনার দরকার। তবে সাবধানে থাকবেন। খুব সাবধানে। বিশেষ করে বিকেলের পর থেকে কাল সকাল পর্যন্ত। কুয়াশা আর অন্ধকার শত্রুপক্ষকে সুযোগ দেবে।

গোয়েন্দাপ্রবর শ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, হঃ…

আমরা দুজনে এবার ঘোরালো পথ দিয়ে নেমে এলুম।’কর্নেল বললেন, জনসায়েব গাড়ি নিয়ে সারেংডি ফরেস্টে বেড়াতে গেল। চলো! এই সুযোগে বাংলোর চৌকিদার শিউপুজনের সঙ্গে একটু গল্প করা যাবে।

ততক্ষণে সূর্য উঠেছে এবং কুয়াশা পাতলা হয়ে গেছে। নদীর ব্রিজে গিয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে নলপাহাড়িতে টমসায়েবের বাংলোটা দেখে নিলেন।

এই বাংলোটা টিলার গায়ে। তাই রাস্তাটা সোজা উঠে গেছে গেটে। কর্নেলকে দেখে চৌকিদার এগিয়ে এসে সেলাম দিল। বলল, ছোটসাব তো আভি জঙ্গল চলিয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা শিউপুজন; একটা কথা জানতে চাইছি। ঠিক ঠিক বললে বখশিস পাবে।

শিউপুজন হাসল। কর্নিলসাব! আপনি বড়াসাবের দোস্ত। বড়াসাব জিন্দা থাকলে কেত্ত খুশি হতেন। উনহি না আছে তো কী হয়েছে? কী পুছ করবেন, করুন। আমি ঠিক ঠিক জবাব দিবে।

শিউপুজন! গত কালীপুজোর রাতে তুমি কি বাংলোয় ছিলে?

সামতক ছিল হামি। বিকেলে আইভি মেমসাব এক্কাগাড়ি চেপে আসল। ছোটাসাব আসলেন না। তো হামি উনহির কাছে ছুট্টি লিয়ে বিজয়গড় চলিয়ে গেল। বহু বালবাচ্চা আছে। কালীপূজা দেখবে।

কখন ফিরে এসেছিলে?

এই টাইমে। আইভি মেমসাবকে খুব পেরেসান মালুম হল। হামি ঠিক সমঝালাম! রাতমে উনহির সাথে রাজবাড়ির হারামি লড়কা বাচ্চুবাবু জরুর ছিল। কাহে কী, আইভি মেমসাব একেলা আসলে বাচ্চুবাবু ভি আসবে। হামি ছোটা আদমি কর্নিলসাব! হামি নোকর আছি, আইভি মেমসাব ঔর বাচ্চুবাবু ভি হামাকে বকশিস দিত। ছোটসাবকে হামি কুছু বলিনি। পুলশকে ভি বলিনি। আপনি বড়াসাবের দোস্ত কর্নিলসাব। আপনাকে সব বললাম।…