পিছনে পায়ের শব্দ – ১৪

১৪.

বরুণ মারা গেছে? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। বরুণ তাকে বলেছিল, কোম্পানি যেখানে তাকে পাঠাচ্ছেন, সেখানে যেতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ এনিথিং রং সামহোয়্যার। কর্নেল তাকে বলেছিলেন, এটা বরুণ একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এটা এমন একটা চ্যালেঞ্জ, যার মোকাবিলা করার ক্ষমতা বা বুদ্ধিসুদ্ধি বরুণের ছিল না। নিভে যাওয়া চুরুটটা। জুতোর তলায় ঘসটে নেভালেন কর্নেল। আহ, বরুণের নয়, এ তারই একটা ব্যর্থতা। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের দিকেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। কিন্তু কে সেই অদৃশ্য প্রতিপক্ষ?

পিউ কর্নেলকে লক্ষ করছিল। ধরা গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। খালি ভাবছি, জামাইবাবুর ভাগ্যে কী ঘটত। এখন আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আসলে কোম্পানির গাড়িটাই বাজে। ঠিকমতো সারানো হয়নি।

সাত্যকি বলল, সিওর। ওদের সাইকেলের মতোই রদ্দি মাল। পুলিশকে খবর দিতে গেলুম যখন, ওরা ঠিক তা-ই বলল। বরুণবাবু নাকি গাড়িটা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। নিয়েই স্টার্ট দিয়ে কাট করেন।

কর্নেল লনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সাবর্ণীর কাছে গেলেন। বললেন, তুমি তো হাসপাতালে গিয়েছিলে। বরুণের তখন জ্ঞান ছিল?

সাবর্ণী আস্তে বলল, ছিল, আমাকে চিনতে পারল।

কী বলল?

ডাক্তার ওকে কথা বলতে বারণ করছিলেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। সাবর্ণী কাঁপা কাঁপা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ওর কথা থেকে বুঝতে পেরেছি, গণাদার সঙ্গে ইরিগেশন বাংলোয় দেখা করে ফিরে যাচ্ছিল। পথে হঠাৎ ব্রেক ফেল। স্টিয়ারিংও কাজ করছিল না। তখন ঝাঁপ দেয়।

সাবর্ণী অন্যমনস্কভাবে চুপ করলে কর্নেল বললেন, আর কিছু?

পিছনে কাকে আসতে শুনেছিল। তারপর নাকি কে তাকে জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তারপর কী হয়েছিল জানে না। ডাক্তার আর কথা বলতে দিলেন না। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন।

পিউ কাছে এসে বলল, বুড়োদা আর পিয়ালিকে নিয়ে আমি যখন গেলুম, তখন বরুণদা ডেড। আর, দ্যাট স্কাউন্ডেল গণাদা বিবির সঙ্গে নির্লজ্জের মতো কথা বলছে। বিবির উচিত ছিল ওকে অ্যাভয়েড করা।

সাবর্ণী চটে গিয়ে বলল, শাট আপ! সব তাতে ফোঁপরদালালি করবিনে।

 পিউ গ্রাহ্য করল না। বলল, আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল গণাদা। আমি কিন্তু কথা বলিনি।

কর্নেল সাবর্ণীকে বললেন, গণনাথবাবু তোমাকে কী বলছিলেন?

একটু চুপ করে থাকার পর সাবর্ণী বলল, সেই একই কথা। কিছু করার ছিল না। পুলিশ কেস। পুলিশই নাকি প্রিয়কে ফাঁসিয়েছে। গণাদা নাকি বিশ্বাস করে না প্রিয় মার্ডার করেছে। আনুদার অনেক শত্রু ছিল।

পিউ ফুঁসে উঠল, হিপোক্রিট!

কোথাও গাছপালার আড়ালে কুক কুক করে একটা পাখি ডাকছিল। কর্নেল বাইনোকুলারে পাখিটা খুঁজতে থাকলেন। একটা ব্যর্থতার বোধ খচ খচ করছে। মনের ভেতর। বরুণ কেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করল না, নাকি সময় পায়নি–কোনও কারণে ব্যস্ত ছিল? আহত অবস্থায় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ঝোপের আড়ালে কেউ তাকে নিয়ে গিয়েছিল। কেন? জেভিয়ার বলছিলেন, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি খোঁড়া বুড়ো মানুষ। পালিয়ে যান। কেউ বরুণকে খতম করে ফেলতে চাইলে রাস্তার ওপরই কাজটা করতে পারত। ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়ে গেল কেন? তারপর সম্ভবত সে জেলেদের সাড়া পেয়ে পালিয়ে যায়। তা হলে সে-ই কি “কিচনি”? পিউ গতকাল বলছিল, কিচনি হয়তো কোনও বুনো হিংস্র জন্তু। হতেও পারে। কিন্তু হিংস্র জন্তুর মোটরগাড়ির ওপর আক্রোশ কেন? কাচ ভাঙচুর করে কেন সে? দুবার গাড়ির ব্রেকফেল করার ব্যাপারটার মধ্যে দুটো মিল। দুবারই ইরিগেশন বাংলো থেকে ফেরার পথে ঘটনাটি ঘটে এবং অদ্ভুতভাবে কাচ ভাঙা হয়। অবশ্য বরুণের ক্ষেত্রে থানায় আটকে রাখা গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমনও হতে পারে, গাড়িটা ঠিকমতো সারানো হয়নি। গ্যারেজ থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল গাড়িটা। তারপর বরুণ ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ঠিকঠাক চলছে দেখে আবার গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করায়নি। নাকি করিয়েছিল? এবার কর্নেলকে খুব সাবধানে এগোতে হবে। কাচ ভাঙাটা বড়ো অদ্ভুত। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে জল ঘোলা করার মানে হয় না।

পাখিটা কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কর্নেল হতাশ হয়ে বাইনোকুলার নামালেন। বুকের ওপর ঝুলতে থাকল। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন রাণু। মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর গম্ভীর। বললেন, ঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা হয়নি আপনার?

কর্নেল একটু হাসলেন। হয়েছে। তোমার ঠাকুর্দা আমার ওপর খাপ্পা হয়ে একা স্টেশনে চলে গেলেন।

ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী গণ্ডগোল বাধাবেন কে জানে! বলে রাণু ডাক দিলেন, ভগীরথ! চেয়ারগুলো দিয়ে এস। আর সুশিকে বলো, কফি দিয়ে আসুক কর্নেল সায়েবকে।

কর্নেল বললেন, বসব না। বেরুব। তবে কফি খাব।

পিউ চঞ্চল হয়ে বলল, আমরা বসব। রোদ্দুরটা অসাধারণ। পিয়ালি, চলে এস। বুড়োদা! কাম অন! কর্নেল, কোথায় বেরুবেন আবার? বসুন না প্লিজ। মুড চটে গেছে। লেটস টক অ্যাবাউট সাম আদার থিংস। আপনার মিলিটারি লাইফের গপ্প বলুন কর্নেল!

ভগীরথ কয়েকটা বেতের চেয়ার এনে দিল। সাবর্ণী চলে গেল দেখে পিউ ঠোঁট উল্টে কঁধ নাড়া দিল। চাপাস্বরে বলল, শি ইজ অলওয়েজ স্ট্রেঞ্জ। কর্নেল, প্লিজ আপনি বসুন।

কর্নেল বসে বললেন, কফিটা বসেই খাওয়া যাক। এগারোটা বাজে। একটা ড্রাগন প্রজাপতি না ধরে ফিরছি না।

ড্রাগন প্রজাপতি! পিউ জিজ্ঞেস করল। সে আবার কী?

মাফিয়া লিডার বলতে পারো। নিরীহ প্রজাপতিদের মৌভাণ্ডার লুঠ করে।

সাত্যকি বলল, এই শীতে প্রজাপতি? ফাদার ক্রিসমাস? হাসালেন!

পিউ বলল, কাল বিকেলে আমি প্রজাপতি দেখেছি। কর্নেল ধরতে পারলেন না।

সাত্যকি বলল, ফাদার ক্রিসমাসের পাল্লায় পড়লে তুমি অনেক কিছু দেখতে পাবে। কাল কিচনির ডাক শুনেছ। এরপর সত্যিই কিচনিও দেখতে পাবে।

পিয়ালি একটু হেসে বলল, “সিওর’ বললে না?

সাত্যকি তার দিকে তাকাল। চোখে হেসে বলল, ওক্কে। সিওর।

সুশীলা হন্তদন্ত কফি আনল। মুখটা রাণুর চেয়ে গম্ভীর। কর্নেলকে সসম্ভ্রমে কফির পেয়ালা দিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, হম বোলি কর্নিলসাব! শুনা? উও আদমি মর গেয়া।

হ্যাঁ সুশীলা। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন। কিচনি বেচারার রক্ত চুষে খেয়েছে। তো আমার ঘর তালাবন্ধ করে রেখেছ তো?

সুশীলা মাথা নাড়ল। সাত্যকি চাপাস্বরে সকৌতুকে বলল, ভগীরথদা ভেতর ভেতর রেগে গেছে, জানেন? পায়ে হেঁটে বাজারে যেতে হয়েছে আজ। সারাক্ষণ গজগজ করছে, আজিব বাত!

পিউ একটু অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?

সাত্যকি হাসল। ফাদার ক্রিসমাস তার জাদুঘরের জন্য আমার সাইকেলটা সিলেক্ট করেছেন। কলকাতায় ফিরে ওঁর জাদুঘরটি অন্তত দেখে এসো। ফুল অফ স্ট্রেঞ্জ থিংস। ছাদের বাগানটিও তাই। স্ট্রেঞ্জ প্ল্যান্টসে ভর্তি। অর্কিড কাকটাস। হরিব সব গড়ন। দেখলে আনক্যানি ফিলিং হয়।

পিউ অন্যমনস্কভাবে বলল, সত্যি, আমার খুব বোর করছে এখানে। তোমরা না থাকলে আমি কেটে পড়তুম। বিবিকে তার বরের জন্য অবশ্য থাকতেই, হত। তবে কিছু বলা যায় না। জামাইবাবুর জামিন পেতে দেরি হলে দেখবে সে কাট করেছে।

কর্নেল কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলি। তোমরা গপ্প করো।

পিউ বলল, সত্যিই কি প্রজাপতি ধরতে যাচ্ছেন আপনি?

সত্যিই।

 আমি যাব আপনার সঙ্গে।

 সরি ডার্লিং! এধরনের কাজে সঙ্গী থাকলেই প্রবলেম। তোমরা গল্প করো।

আপনার একবার হাসপাতালে যাওয়া কিন্তু উচিত ছিল। সম্ভবত গণাদা এখনও সেখানে আছে। পিউ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল। গণাদার সঙ্গে আপনার কথা বলা উচিত।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, যথাসময়ে বলব।

আমিনগঞ্জ যাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়ে মত বদলালেন কর্নেল। খ্রিস্টান বসতির দিকে হাঁটতে থাকলেন। আসন্ন ক্রিসমাসে রাস্তায় রঙিন কাগজের ঝালর টাঙাচ্ছে যুবক-যুবতীরা। বেশির ভাগই আদিবাসী। কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আছে এখনও। তারা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চেয়েছে। এক সময়ের আভিজাত্য ক্ষয়টে হয়ে গেছে, তবুও। বাংলো ধাঁচের বাড়িগুলি প্রকৃতির করতলগত এবং জরাজীর্ণ। রাস্তা ছেড়ে মাঠ ঝোপ-জঙ্গল হয়ে বেলিংটন জেভিয়ারের বাড়ির কাছে পৌঁছলেন কর্নেল।

জেভিয়ার তার গোপালবাগানের শেষ দিকটায় কাঁটার বেড়া মজবুত করছিলেন। ঢালু দিকটায় নীচের জলায় যাওয়ার জন্য ছোট্ট গেট। সেখানে গিয়ে কর্নেল একটু কেসে সাড়া দিলেন। জেভিয়ার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে পেলেন। নিষ্পলক নীলচে চোখ।

একটু পরে খিক খিক করে হেসে উঠলেন। ইউ! ওয়েল, আ যাইয়ে। রোজ গার্ডেন দেখনা চাহতা তো দেখিয়ে। লেকিন উও লড়কি কঁহা?

কর্নেল ভেতরে গিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ও আপনাকে খুব ভয় পায় মিঃ। জেভিয়ার!

জেভিয়ার আরও হেসে বললেন, হ্যাঁ। আমাকে দেখে কেউ কেউ ভয় পায়। তিনি অভ্যাসমতো হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছিলেন। আসলে আমার চেহারায় জংলি ছাপ ক্রমশ গাঢ় হয়ে পড়ছে। পড়ারই কথা। আর, হাতের এই ধারালো কাটারি। মহাশয়, বনজঙ্গলে ঘুরতে হলে নিরস্ত্র থাকা উচিত নয়।

মিঃ জেভিয়ার, তখন আপনি ওই রাস্তায় কী দেখতে গিয়েছিলেন?

 আপনি খুব কৌতূহলী।

আশা করি, দুর্ঘটনায় পড়া গাড়িটা দেখতেই গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আপনার বাইনোকুলার আছে। আপনি দূরদর্শী।

 লোকটি মারা গেছে হাসপাতালে। শুনেছেন কি?

জেভিয়ার বুকে ক্রশ এঁকে বললেন, প্রভু যিশু তার আত্মাকে শান্তি দিন।

লোকটি মৃত্যুর আগে বলেছে, দুর্ঘটনার পর কেউ তাকে টানতে টানতে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছিল।

জেভিয়ার একটু হাসলেন। কিচনি, মহাশয়, কিচনি।

জেলেরা এসে পড়ায় কিচনি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।

 লোকটা বলেছে?

হ্যাঁ।

 জেভিয়ার একটু চমকে উঠে বললেন, কিচনিকে কি সে দেখতে পেয়েছিল?

পেয়েছিল।

 জেভিয়ার চটে গেলেন। মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা।

 কেন মিথ্যা মিঃ জেভিয়ার?

কিচনিকে কেউ দেখতে পায় না। আমি সারারাত ঘুরে বেড়াই। তার ডাক শুনেছি। একবারও দেখতে পাইনি। জেভিয়ার গলার ভেতর বললেন, কিচনি যখন জানতে পারে, কারও কোনও বিপদ ঘটতে চলেছে, তখন সে ডাকে। সাবধান করে দেয় মানুষকে।

আপনার মেয়ে যখন মারা যায়, কিচনি ডেকেছিল কি?

জেভিয়ার মুখ নামিয়ে বললেন, ডেকেছিল।

আপনার মেয়ের এক সহকর্মী কেয়া সেনের মৃত্যুর সময়?

 ডেকেছিল। কিন্তু কেন এসব কথা, মহাশয়? আপনার উদ্দেশ্য কী?

আপনার মেয়ের খুনিকে ধরা।

জেভিয়ার মুখ তুললেন। আপনি মিলিটারি অফিসার। কর্নেল। আপনি পুলিশ নন। আর আমার মেয়ে যদি সত্যি খুন হয়েই থাকে, পুলিশ তার খুনিকে ধরবে না। পুলিশকে আমি বিশ্বাস করি না। দয়া করে আমাকে আপনি ঘাঁটাবেন না। পুলিশ কেন খুনিকে ধরবে না মিঃ জেভিয়ার? বোসসায়েবের নাতিকে তো ধরেছে!

এসব বিষয়ে আর একটি কথাও নয়। আপনি দয়া করে আসুন, মহাশয়।

 মিঃ জেভিয়ার দু’বারই গাড়ির কাঁচগুলো কেউ ভেঙেছে। কিচনি কেন কাচ ভাঙে? গাড়ির ওপর তার কেন রাগ?

জেভিয়ার হাত নেড়ে বললেন, চলে যান! চলে যান! নইলে আপনি আমার মৃত্যুর কারণ হবেন। আমাকে বাঁচতে দিন দয়া করে। তাঁর কণ্ঠস্বর বিকৃত হল। আমি স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। আর কদিনই বা বেঁচে আছি? আমাকে শান্তিতে মরতে দিন। আপনি আর আমার কাছে আসবেন না, আপনি যে-ই হোন। ঈশ্বরের দোহাই! প্রভু যিশুর দোহাই! চলে যান।

জেভিয়ার দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। শিশুর মত কাঁদতে থাকলেন। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন। লোকটির জন্য কষ্ট হয়। খোঁড়া মানুষ। দেখাশোনার কেউ নেই। কিন্তু এবার উনি নিজের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন। এটা একটা ভাববার কথা। ক্লিফটনকুঠির কাছে গিয়ে কর্নেল দেখলেন, ছাদে একঝাক ট্যুরিস্ট দাঁড়িয়ে আছে। ছবি তুলছে। ভাঙা ফটকের ধারে মহুয়াগাছের তলায়। একটু দাঁড়ালেন। তারপর চত্বর পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ধ্বংস ক্রুপের একটা অংশ ঢালু হয়ে গঙ্গায় নেমেছে। সেখানে ঘনঝোপ, উঁচু-নিচু গাছ, লতাপাতার ঝালর। ওখানেই অক্টোবরে ড্রাগন-প্রজাপতি দেখেছিলেন।

খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেন। একখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। বড় বড় পাথরের চাই পড়ে আছে। তার মধ্যিখানে একটা গাছ। গাছটা থেকে একটা কাঠবেড়ালি নেমে এল। সেদিকে তাকালেন কর্নেল। তারপরই একটু অবাক হলেন।

গাছটার গুঁড়িতে জায়গায়-জায়গায় শুকনো কাদার ছোপ। উই ধরেছে জ্যান্ত গাছে? কাছে গিয়ে আরও অবাক হলেন। দু-তিনটে জায়গায় গোল করে কাদা সাঁটা এবং শুকিয়ে গেছে। বাকিগুলো ঝরে পড়েছে। একটাকে ছাড়িয়ে নিতেই সরু-ফাটল এবং গর্তের চিহ্ন চোখে পড়ল। দুপাশে কালচে ছোপ। আতস কাচ বের করে সেটা দেখেই চমকে উঠলো। প্যান্টের পকেট থেকে ছুরি বের করে সেই অংশটা খুঁড়তে থাকলেন। ছুরির ডগায় একটা সরু প্রায় তিনকোনা সিসের– টুকরো বেরিয়ে এল। হাতের চেটোয় রেখে আতস-কাচ দিয়ে পরীক্ষা করার পর বুঝলেন পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি বুলেটের ডগা। রিভলভারের গুলি!

হুঁ, কেউ টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে এই গাছটাতে। কে সে? প্রিয়গোপাল নয় তো?

চোরা রিভলভার কিনেছিল যে, তার পক্ষে গোপনে এভাবে লক্ষ্যভেদে হাতপাকানো কখনই অসম্ভব নয়। আত্মরক্ষার জন্যই কি? নাকি প্রতিহিংসাবশে বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিককে হত্যার জন্য?

পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে। ঘন ঘাস চারপাশে। কোনও জুতোর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে হাত পাকানোর উপযুক্ত জায়গা। এই জঙ্গল থেকে স্টেশন রোড দূরে। কুঠিবাড়িও একটু দূরে। দহের পেত্নীর ভয়ে এখানে কারও আসার সম্ভাবনাও নেই। কাছাকাছি কোনও বসতিও নেই।

 ভবনে যখন ফিরলেন, তখন কর্নেল ক্লান্ত। এ বয়সে উত্তেজনা মানুষকে ক্লান্ত করে। রহস্যের জট আরও পাকিয়ে গেল। খেই ধরে এগোতে গিয়ে আরেকটা খেই বেরিয়ে এল। দুটোকে মেলানো যায় না। অথচ একই জটের জন্য ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে।

দরজার তালা খুলে সুশীলা জানতে চাইল কর্নিলসায়েব স্নান করবেন কি না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি ভুলে গেছ সুশীলা, জলকে আমি বিল্লির চেয়ে বেশি ভয় পাই। আমার স্নানের শুভদিন আগামী কাল। আর জলটা খুব বেশি গরম হওয়া চাই।

সুশীলা যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে দিলেন কর্নেল। বাড়িটা ভীষণ স্তব্ধ। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সিসের টুকরোটার সঙ্গে প্রিয়র রিভলভারের একটা বুলেট বের করে ডগাটা মিলিয়ে দেখলেন। নাহ, পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি বুলেট হলেও এই রিভলভারের বুলেট নয়। গাছের বুলেটটা অন্য রিভলভারের। কর্নেল টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিভিয়ে জিনিসগুলো কিটব্যাগে সামলে রেখে দরজা খুললেন। টুপি এবং জ্যাকেট হ্যাঁঙ্গারে রেখে ইজিচেয়ারে বসলেন। তারপর একটা চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজলেন। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।

পিউ এল। সাত্যকির নকল করে বলল, ফাদার ক্রিসমাস কি ড্রাগন বাটারফ্লাই ধরতে পারলেন?

নাহ ডার্লিং! ওরা অসম্ভব ধূর্ত।

পিউ সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে বলল, ওটা কি সত্যি কলকাতা নিয়ে যাবেন আপনি?

দেখা যাক।

সে সাইকেলটার কাছে গিয়ে হ্যাঁন্ডেল ধরে নাড়াচাড়া করে বলল, ফিনিশিংটা বাজে। কিন্তু এটা জাদুঘরে রাখার যোগ্য ভাবছেন কেন? ইট ইজ জাস্ট অ্যান অর্ডিনারি টাইপ।

সাত্যকির সাজেশন।

বুড়োদা একটা পাগল। পিউ চাপাস্বরে বলল, পাগল এবং গোঁয়ার। একটু আগে রাণুদির সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করছিল। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইনে। তবে প্রথমে এদের ফ্যামিলিকে যতটা অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট ভেবেছিলুম, এরা তা নয়।

কর্নেল তাকালেন। কেন?

পিউ একটু চুপ করে থাকার পর আস্তে বলল, বাইরে মডার্ন, ভেতরে মিনমাইন্ডেড অ্যান্ড সেলফিশ। দিদির সম্পর্কে বড় বাজে আলোচনা করে। কানে আসে। আমি আর এখানে থাকছি না।

কর্নেল হাসলেন। তুমি পুরোপুরি আর্বান পার্সন! তোমার এখানে ভাল না লাগারই কথা।

পিউ ক্ষুব্ধভাবে বলল, দিদির নামে রাণুদি স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছেন। আর পিয়ালির কাছে শুনেছি, রাণুদির নামেও যে একসময় খুব স্ক্যান্ডাল রটেছিল?

.