পিছনে পায়ের শব্দ – ১০

১০.

 হোটেল পারিজাতের কার পার্কে গাড়ি রেখে বরুণ লাউঞ্জে গিয়ে ঢুকল। বেচুবাবু বিশাল লাউঞ্জের এককোণে বারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে গ্লাস। বরুণকে দেখে হাসলেন। এটু গরম হইয়া লন দত্তসায়েব! তারপরে আমার মা লক্ষ্মীরে দর্শন দিবেনখন। ক্যান কী হালার ঠাণ্ডায় প্রাণ খুলিয়া কথা কওন যায় না।

বরুণ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, নাহ্ বেচুবাবু! আমাকে আমিনগঞ্জে ফিরতে হবে। রাউন্ড দা ক্লক কাজ চলেছে। শ্রাবন্তী কত নম্বরে?

দুইশো দুই। সেকেন্ড ফ্লোরে দুই নম্বর। কী কারবার। এক ফ্লোরে দশখান করিয়া রুম। তার লগে হান্ড্রেড জুড়িয়া গ্ল্যামার দ্যাখাইতে চায়। বেচুবাবুর প্রকাণ্ড শরীর হাসির ধাক্কায় নড়বড় করতে থাকল।

এক পেগ পেটে পড়লে বেচুবাবুর মেজাজ খুলে যায়। এমনিতে সব সময় ব্যস্ত এবং কাজের লোক। সব কিছুতে কড়া নজর। গণনাথ সেন বরাবর যোগ্য লোককেই বেছে নেন। বরুণের ইচ্ছে করছিল কিছুক্ষণ কথা বলতে এবং গরম হতেও। কিন্তু প্রায় ছটা বাজে। এখনই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

চারতলা এই হোটেলটা টাউনশিপের উত্তরপ্রান্তে ওয়াটারড্যামের কাছাকাছি। এদিকটা নিরিবিলি সুনসান। কিন্তু জল ছুঁয়ে আসা বাতাস প্রচণ্ড হিম ছড়াচ্ছে। তাছাড়া কুয়াশা। চওড়া রাস্তার ধারে আলোগুলো যেন ভূতের চোখ।

শ্রাবন্তী নীলচে হাউসকোট পরে করিডরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল। বরুণকে দেখে বলল, আমি ভাবছিলুম এতক্ষণ তুমি আমিনগঞ্জে। গাড়ি ডেলিভারি পেলে?

বরুণ বলল, হ্যাঁ। সেজন্যই একটু দেরি হয়ে গেল। পুলিশের হাতে কিছু পড়লেই ঝামেলা। ফের গ্যারেজে নিয়ে যেতে হল। এখন সব ঠিক।

শ্রাবন্তী মেয়েটিকে বলল, ওক্কে ববি! ট্রাই ইওর লাক এগেন!

ঘরে ঢুকে বরুণ বলল, কে ও?

শ্রাবন্তী একটু হাসল। এই হোটেলে রিসেপশনে থাকে। ফিল্মে নামবার সখ হয়েছে। বসো! চা বলব, না কফি?

বরুণ বসে বলল, কিছু না। যাওয়ার আগে তোমাকে ফের একবার দেখতে এলুম। তখন কথা বলার সুযোগ পাইনি। এভরিথিং অলরাইট তো?

শ্রাবন্তী গম্ভীর হয়ে বলল, নাহ। তুমি যা বলেছিলে। সামথিং রং এনিহোয়্যার!

 তার মানে?

বিকেলে এতক্ষণ তো শুটিং দেখলে। কিছু বুঝতে পারনি? শ্রাবন্তী বিছানায় বসে চাপাস্বরে বলল, গণাদার কিছু বুঝতে পারছি না, জানো? সত্যিই কি ছবি করবেন, নাকি তোমার কোম্পানিকে ব্লাফ দিয়ে টাকা মারার মতলব?

বরুণ সিগারেট ধরিয়ে বলল, কেন একথা মনে হচ্ছে তোমার?

ছবির কী স্টোরি, মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। শ্রাবন্তী হতাশ ভঙ্গিতে বলল। সারাটা দিনে মাত্র তিনটে শট। স্ক্রিপ্ট আছে। দেখতে দেবেন না গণাদা। তাছাড়া বলছেন, ছবিতে হিরো-হিরোইন বলে কোনও ব্যাপার নেই। তার চেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার, একটা আজেবাজে লোকের খবরদারি।

কে সে?

চিনি না। লোকাল লোক বলে মনে হল। অবাঙালি। বলেই শ্রাবন্তী নড়ে উঠল। এই! তুমি তো ওর সঙ্গে কথা বলছিলে তখন। তোমাকে সিগারেট দিল। বেঁটে, হোঁতকা মতো। ভিলেনটাইপ চেহারা।

তুমি মিঃ শর্মার কথা বলছ? বরুণ হেসে উঠল। আরে! উনি তো রাজেশ শর্মা। আমাদের আশাপুরা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। কী খবরদারি করছিলেন উনি?–

শ্রাবন্তী বিরক্ত মুখে বলল, ছাড়ো! যাই হোক, পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে। হোক্স।

বরুণ মিটিমিটি হেসে বলল, আমি ইচ্ছে করলেই গণাবাবুকে বসিয়ে দিতে পারি, জান?

থামো! খালি মুখেই রাজাউজির মারতে ওস্তাদ। শ্রাবন্তী হঠাৎ কণ্ঠস্বর বদলাল। এই! তুমি গণাদার কাছে কায়দা-ফায়দা করে জেনে নাও না, আমার সত্যিকার রোলটা কী। আজ আর আমিনগঞ্জ না-ই বা ফিরলে?

তোমার মাথা খারাপ? তোমাকে বলেছিলুম, বনোয়ারিজির সঙ্গে আমার টোক্কর লাগবে। অলরেডি লেগে গেছে। বরুণ সিগারেটের ধোঁয়ার রিঙ পাকাল এবং রিঙটার দিকে তাকিয়ে বলল, তবে আমি প্রিয় নই এবং আমার পক্ষে আছেন গিরিধারীজি। এক্সপোর্ট কোয়ালিটির মাল বলতে কী বোঝায়, বনোয়ারি ব্যাটাছেলের কোনও ধারণাই নেই।

শ্রাবন্তী যথারীতি ওর গোঁফ টেনে দিল। স্টপ ইট! পিকিউলিয়ার অফিসগিরি সবসময়। আমি দেখেছি, কিছু কিছু লোক থাকে, সবসময় অফিস নিয়ে বকবক করে।

বরুণ গোঁফে হাত বুলিয়ে বলল, আমার যন্ত্রণা তুমি কী বুঝবে! বলেছিলুম, সামথিং ইজ রং এনিহোয়্যার এবং একটু আগে তুমিও তা-ই রিপিট করলে। এই দু’দিনেই আমার অস্বস্তি বেড়ে গেছে আরও। কোম্পানি…

আহ্! আবার সেই কথা।

বরুণ হাসল। ওকে! গণাবাবুকে আমি দেখছি। দেখব। আমি ওর কাছে পুরো স্ক্রিপ্ট দাবি করব। বলব, লালজির অর্ডার। গণবাবুর টিকি আমার হাতে বাঁধা। ডোন্ট ওয়ারি।

শ্রাবন্তী একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, আচ্ছা, তোমার বন্ধুর মার্ডার কেসের কী হল?

প্রিয়কে এখনও জামিন দেয়নি। বরুণ আস্তে বলল, ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে প্রিয়র বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। আনু, মার্ডার হয়েছে, এতে বিবি খুব খুশি। বিবি একটা বাজে মেয়ে। আর ওর মুখোমুখি জীবনে হব না। গেলুম তো ইনসাল্টিং টোনে কথাবার্তা। তক্ষুনি চলে এলুম।

প্রিয়বাবুকে জামিন দিচ্ছে না কেন?

মার্ডার কেস। নন-বেলেবল। তবে তার চেয়ে সিরিয়াস পয়েন্ট হল, কোম্পানির ওই গাড়িটা প্রিয় যে গ্যারেজে দিয়েছিল, সেই গ্যারেজের লোকেরা গাড়ির ভেতর একটা ফায়ারআর্মস পায়। পুলিশকে গোপনে খবর দেয়। এবার বুঝতে পারছ, প্রিয়র বাঁচার চান্স নেই?

কিন্তু গণাদা বলছিল অনির্বাণবাবু ওয়াজ স্ট্যান্ড টু ডেথ।

ও জানে না। বরুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল। গণাবাবু তো নিজের তালে আছে। একটা আনু গেলে ওর কী? আরেকটা জুটিয়ে নেবে। হয়তো নিয়েছে। থানার ও সি ভদ্রলোক বললেন, মর্গের রিপোর্ট আজ পাওয়া গেছে। বুকের ভেতর হাড়ের খাঁজে ফায়ারআর্মসের একটা গুলি আটকে ছিল। জাস্ট ইমাজিন হোয়াট হ্যাড হ্যাপন্ড!

শ্রাবন্তী শিউরে উঠল। সর্বনাশ! গুলি করে মেরেছিল?

হুঁ, বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। বরুণ ঘড়ি দেখে বলল, উঠি। বরং যাবার পথে ঘুরে একবার গণাবাবুকে ইরিগেশন বাংলোয় মিট করে যাই। তোমার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নেওয়া দরকার। তাছাড়া কোম্পানির অফিসার হিসেবে আমারও একটা দায়িত্ব আছে। তুমি হোক্স বললে!

এই! তুমি যেন ওকে বোলা না আমিই তোমাকে অতিয়েছি বা হোক্স ফোক্স বলেছি। শ্রাবন্তী ফিসফিসিয়ে উঠল। প্লি-ই-জ, এমন কিছু কোরো না, যাতে গণাদা…।

তাকে থামিয়ে বরুণ বলল, আরে! আমাকে অত বোকা ভাবছ কেন? যাতে সত্যিকার একটা ছবি হয় এবং তুমিই হিরোইন হও, আমি ট্যাক্টফুলি সেই লাইনে এগোব। আচ্ছা, চলি।

নীচে লাউঞ্জে গিয়ে বরুণ দেখল, বেচুবাবু বারের একটা চেয়ারে বসে আছেন তুলোর বস্তার মতো। হাতের মুঠোয় গেলাস। তার কাছে একবার যাবে ভাবল বরুণ, গেল না। হোটেলটা পশ্চিমী আভিজাত্যে রঙচঙে। দেশী-বিদেশী সায়েবসুবো-মেমদের আনাগোনা আছে। বিদেশীরা সম্ভবত ট্যুরিস্ট। বেরুতে গিয়ে হঠাৎ বরুণের মনে হল, এখান থেকে কলকাতায় ট্রাঙ্ককল করে মোহন। লালজিকে একটু আভাস দিয়ে রাখা উচিত। নইলে পরে যদি কোনও গণ্ডগোল বাধে, তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। বনোয়ারিলাল কোম্পানিকে ফাঁসাবে।

কিন্তু সে এ হোটেলে বাইরের লোক। শ্রাবন্তীর সাহায্য ছাড়া ফোন করা যাবে না। আবার শ্রাবন্তীর কাছে ফিরে যেতে হয়। বরুণ অন্যমনস্কভাবে। রিসেপশনের দিকে তাকাল। সেই মেয়েটিকে দেখতে পেল, যে একটু আগে শ্রাবন্তীর সঙ্গে কথা বলছিল। কী নাম যেন…ববি! বরুণ স্মার্ট হয়ে রিসেপশনে গেল। বলল, হাই!

ববি বলল, হাই!

বরুণ অমায়িক হেসে বলল, আই থিংক, ইউ ওয়্যার টকিং উইথ দা. ফিল্মস্টার শ্রাবন্তী গুহ।

ইয়া। আই স ইউ দেয়ার। ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?

বরুণ অন্তরঙ্গ হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, শ্রাবন্তী আপনার কথা বলছিল। আপনি তো বাঙালি? বাংলা ছবিতে নামতে চান যখন, আই অ্যাম সেন্ট পার্সেন্ট সিওর।

হুঁউ। আমার নাম ববি রায়।

আমি বরুণ দত্ত। যে কোম্পানি গণনাথ সেনের ছবির ফাইন্যান্সার, তারই একজন অফিসার।

ববির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মিষ্টি হেসে বলল, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?

আমার কোম্পানিকে কলকাতায় একটা আর্জেন্ট ট্রাঙ্ককল করতে চাই। যদি প্লিজ…

শ্রাবন্তীদির ঘর থেকেও করতে পারতেন। নো প্রব্লেম।

 কথাটা এইমাত্র মনে পড়ল। ও বড্ড ক্লান্ত তাই ওকে গিয়ে আর বিরক্ত করতে চাইনে।

ববি ব্যস্তভাবে বলল, নো প্রব্লেম। আমি অপারেটরকে বলে দিচ্ছি।

সে রিসিভার তুললে বরুণ পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে তার সামনে রাখল। বলল, সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অফিসে থাকেন। কাজেই পাওয়া যাবে।

ববি অপারেটরকে কিছু বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল। বলল, আপনি প্লিজ ওখানে একটু ওয়েট করুন। লাইন পেয়ে যাবেন। দা হোটেল পারিজাত ইজ আ ফাইভ স্টার হোটেল, ইউ নো আমরা কিছু সুবিধে পেয়ে থাকি। আপনি বসুন না প্লিজ!

রিসেপশন কাউন্টারের কাছাকাছি একটা প্রকাণ্ড থাম ঘিরে সুদৃশ্য গোলাকার আসন। বরুণ এমন জায়গায় বসল, যেন বেচুবাবুর চোখে না পড়ে। ববির হাবভাবে সে বুঝতে পারছিল, মেয়েটি ফিল্মের স্বপ্নে অস্থির। হায়, বেচারা যদি জানত ওর চেহারা তেমন কিছু আহামরি নয়! বড়ো জোর ঝিয়ের রোলে মানাবে। রং মেখে সেজে আছে। এই যা।

একদঙ্গল সায়েব-মেম এল। ববি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের বিদায় করার পর বরুণকে বলল, আপনার অসুবিধে হচ্ছে না তো? এখনই লাইন পেয়ে যাবেন। সে ফের এক ঝলক হাসল এবং হাসলে অবশ্য তাকে মন্দ দেখায় না। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

স্বচ্ছন্দে।

আপনারা তো ফাইন্যান্সার। আপনারা কাকেও রেকমেন্ড করতে পারেন না–জাস্ট কথার কথা বলছি, ধরুন…

বরুণ ঝটপট বলল, শ্রাবন্তী আপনার কথা আমাকে অলরেডি বলেছে।

 প্লিজ একটু দেখবেন।

 নিশ্চয়। এখনই তো আমি গণনাথবাবুর কাছ হয়ে যাব। আপনার কথা ওঁকে বলে যাব।

ববি রায় আহ্লাদে বিহ্বল হল। আবার রিসিভার তুলে চাপা স্বরে অপারেটরকে বকাবকি করতে থাকল। এই সময় বেচুবাবু বরুণের কয়েক হাত তফাত দিয়ে হাতির মতো চলে গেলেন। বরুণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাকে দেখতে পেলে বেচুবাবু আর এখান থেকে উঠতেন না এবং ট্রাঙ্ককলে যা বলতে চায়, শুনে ফেলতেন। ধূর্ত লোক।

বরুণ জানে, বাইরে এমন এলেবেলে চালচলন, কিন্তু অসম্ভব চতুর মানুষ। কলকাতায় সম্প্রতি একটা দশতলা সৌধ বানিয়েছেন।

একটু পরে রিং হতেই ববি রিসিভার তুলে উত্তেজিত হয়ে বরুণের দিকে একটা হাত নাড়ল। বরুণ গিয়ে ফোন নিল। কোম্পানির অফিসেই লাইন দিয়েছে। সে বলল, আমি দত্ত বলছি ক্লিফটনগঞ্জ থেকে। দত্ত…বরুণ দত্ত। …হ্যাঁ, মোহনলালজিকে দিন। আর্জেন্ট।..লালজি? বরুণ বলছি। ছবির ব্যাপারটা..না, না। প্লিজ কথাটা শুনুন আগে। সামথিং ফিশি…কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অজিতবাবুর মতো…হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি পারমিশন দিন, আমি চার্জ করে স্ক্রিপ্টের একটা জেরক্স কপি..শর্মাজিকে? কিন্তু উনি তো…আচ্ছা। বাই দা বাই, বনোয়ারিজি আবার বিলো দা গ্রেড…আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি।

বরুণ আস্তে ফোন রেখে দেখল, ববি তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, এনিথিং রং স্যার?

বরুণ আড়ষ্টভাবে হাসল। নাহ! আচ্ছা, চলি।

আমার কথাটা মনে রাখবেন কিন্তু।

বরুণ জোরে বেরিয়ে এল। লনে নামতেই তীব্র হিম তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু মেজাজ গরম হয়ে গেছে মালিকের কথা শুনে। যা চলছে, চলবে–এর মানেটা কী? স্ক্রিপ্ট নাকি রাজেশ শর্মা দেখেছেন। উনি কী বোঝেন ফিল্মের? বোঝা যাচ্ছে, মালিক শর্মাজিকে সত্যিই খবরদারির দায়িত্ব দিয়েছে। আবার বনোয়ারির ব্যাপারে নাক না গলাতে বলল। তোমার পাঁঠা, তুমি লেজে কাটবে না কোথায়, বরুণ দত্তের কী? শুধু শ্রাবন্তীর লাক ভেবে দুঃখ হচ্ছে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বরুণের মনে হল, ভাগ্যিস গাড়িটা আজ পাওয়া গিয়েছিল। নইলে এই এলাকার বাসের যা কদর্য অবস্থা, খুব অসুবিধেয় পড়ত। আগে কাঁচগুলো বসানোর পর গ্যারেজের মেকানিকরা ব্রেক এবং ইঞ্জিন মেরামত করেছিল। তখনই নাকি ফায়ারআর্মসটা আবিষ্কার করে এবং পুলিশকে জানায়। পুরো মেরামত তখন হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে বরুণ এ অবস্থায় গাড়ি ফেরত পেত না। এটাই শেষ পর্যন্ত তার সান্ত্বনা।

থানায় পুলিশের সঙ্গে কথা বলে সে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছে। গোড়ার দিকে পুলিশ তত গা করেনি। করলে সেদিনই গাড়িটা সিজ করত। ফায়ারআর্মস পাওয়ার পর পুলিশ একটু মন দেয়। শেষে আজ সকালে মর্গের রিপোর্ট পেয়ে এবার তৎপর হয়ে উঠেছে। কোম্পানির গাড়ি। তাই ফেরত দিল। কোনও সাধারণ লোকের হলে অনেক ঝামেলা করত পুলিশ। তবে এই এলাকায় লালজিদের খুব প্রভাব আছে, টের পেয়েছে সে।

ড্যামের ধারে চওড়া নতুন রাস্তায় আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল বরুণ। মোড়ে পৌঁছে হঠাৎ তার মেজাজ চড়ে গেল। মালিক যা বলল, বলুক। গণনাথকে একটু থ্রেট করে এলে গায়ের ঝাল মেটে। অজিত ভদ্র সেবার মাত্র দশ হাজার। হাতিয়েছিলেন। গণনাথ সেন তার কয়েকগুণ হাতাবেন মনে হচ্ছে। সত্যি বলতে কী, বিকেলে মিনিট কুড়ি ড্যামের পেছন দিকটায় শ্যুটিং দেখে তার মনে হচ্ছিল, ছেলেখেলা না কী? রোদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, অথচ স্পট ঠিক হচ্ছে না। শেষে একটা স্টিল ছবি নিল শ্রাবন্তীর। পেছনে জল, গাছের ডালে একটা হাত। চালাকি! মুভি ক্যামেরা আর কিছু লোকজন দেখিয়েই টাকা মারার তাল।

বরুণ ব্রেক কষল। সামনে পুরনো ঝড়ঝড়ে সেই রাস্তাটা। স্টেশন রোড। তা হলে ইরিগেশন বাংলোর কাছে চলে এসেছে ঝোঁকের মাথায়।

বাংলোর বাইরে গাড়ি রেখে সে লনের নুড়িতে ইচ্ছে করেই বিচ্ছিরি শব্দ তুলে এগিয়ে গেল। রামলাল বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সায়েব লোক দেখে সেলাম দিল। বরুণ বলল, গণনাথ সেন কৌন ঘরমে হ্যায়?

রামলাল ঘরটা দেখিয়ে দিল।

দরজা খোলা ছিল। বরুণ পর্দার এধারে দাঁড়িয়ে বলল, আসতে পারি গণনাথবাবু?

কে?

আমি বরুণ দত্ত।

 গণনাথ পর্দা সরিয়ে বললেন, আরে দত্তসায়েব যে! আসুন, আসুন। আমি ভাবছি, এতক্ষণ আপনি আমিনগঞ্জে।

ঘরের ভেতর ক্যামেরাম্যান ভোম্বলবাবু এবং একজন অচেনা যুবক। বরুণ ধরেই নিল, নতুন বডিগার্ড গণনাথ সেনের। সে গম্ভীর মুখে বসল।

গণনাথ তার আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বরুণ বলল, নাহ্। জাস্ট একটা প্রাইভেট কথা বলেই চলে যাব। কনফিডেন্সিয়্যাল।

ভোম্বলবাবু এবং সেই যুবকটি বেরিয়ে গেল। গণনাথ বললেন, শট ডিভিসনে ব্যস্ত ছিলুম। কাল চরে শ্যুটিং প্রোগ্রাম। আপনি থেকে যান দত্তসায়েব। পিকনিক এবং শ্যুটিং। খুব এনজয় করবেন।

গণনাথ বরুণকে সিগারেট দিতে এলে সে বলল, থ্যাংকস। তারপর আস্তে বলল, গণনাথবাবু, আপনি কি সত্যিই ছবি করছেন, না এটা একটা ফাঁদ?

গণনাথের চোখ দুটো চশমার ভেতর জ্বলে উঠল। হোয়াট ডু ইউ মিন?

আনুকে আপনি এখানে মারতে এনেছিলেন। আবার কাকে মারতে চান গণনাথবাবু?

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। কী বলতে চান আপনি?

যা বলতে চাই, আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন।

গণনাথ একটু পরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি আপনার এসব কথা শর্মাজিকে বলছি। বরং তাকে ডেকে আনি। আপনার কোম্পানি ফাইন্যান্সার। সেজন্য কোম্পানির হয়ে শর্মাজি আছেন এখানে। কিন্তু আপনার এভাবে ইন্টারফেয়ার করার পয়েন্টটা কী। আই অ্যাম রিয়্যালি শকড়। ওয়েট আ মিনিট প্লিজ!

গণনাথ বেরিয়ে গেলেন। বরুণ শক্ত হয়ে বসে রইল। শর্মাজির সামনা সামনি ফয়সালা হোক, ক্ষতি কী? কোম্পানির স্বার্থেই তো সে এটা করছে।

একটু পরে গণনাথ ফিরে এলেন। সরি! শর্মাজি একটু আগে বেরিয়েছেন। যাই হোক, আপনি আগে মাথা ঠাণ্ডা করুন। খুলে বলুন, কী হয়েছে। আমি ফ্র্যাঙ্কলি কথাবার্তা বলা পছন্দ করি। বলুন।

যা বলার, বলেছি। ইউ আর ব্ল্যাকমেলিং মাই কোম্পানি। আই নো দো সিক্রেট টুথ। বলে বরুণ উঠে দাঁড়াল এবং বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

ওয়াটারড্যাম বাঁদিকে, দুধারে গাছের সার। চওড়া মসৃণ রাস্তায় আলো আছে। কিন্তু কুয়াশায় ধূসর। সামনে কিছু দূর গেলে আমিনগঞ্জের হাইওয়ে পেয়ে যাবে বরুণ। খুব স্পিডে এগোচ্ছিল সে। মোড়টা সামনে। ব্রেকে পায়ের চাপ দিয়েই চমকে উঠল। ব্রেক কাজ করছে না। সঙ্গে সঙ্গে সে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তারপরই টের পেল, স্টিয়ারিংও অকেজো। গাড়ির চাকা পিচ ছেড়ে নামতেই সে দরজা খুলে ঝাঁপ দিল। সহজাত বোধজনিত প্রতিক্রিয়া।

যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল সে। ঠাণ্ডা হিম শক্ত পিচের প্রচণ্ড আঘাতে তার শরীরের একটা দিক অবশ, অন্যদিকে তীব্র যন্ত্রণা। সে উঠবার চেষ্টা করল। ডান হাত ডান পা নিঃসাড়। শুনল, গাড়িটা ড্যামের জলে গিয়ে সশব্দে পড়ছে। নিঝুম প্রকৃতিতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা আলোড়ন। তারপর আবার গাঢ় স্তব্ধতা।

মাথার বাঁদিকটা কেটে রক্ত গড়াচ্ছে। বরুণ বাঁ হাতে রক্ত মুছে রক্ত দেখতে থাকল। সেই সময় পিছনে গাছপালার আড়ালের কোথাও কী শব্দ! শব্দটা চাপা এবং কেউ শুকনো পাতায় হেঁটে এলে যেমন শব্দ হয়। ঘুরে দেখার চেষ্টা করল বরুণ। শরীর ঘোরানো যাচ্ছে না। মাথা ঘোরাতেও যন্ত্রণা। অদ্ভুত শব্দটা তার দিকে এগিয়ে আসছে পিছন থেকে। তার আততায়ী ছাড়া আর কে হতে পারে? সে সত্যিই ফাঁদে পা দিয়েছিল।

আততায়ীর হাতে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে বরুণ চোখ বুজল। শব্দটা তার পিঠের কাছে এসে থেমেছে। সে মৃত্যুর তীব্র গন্ধে আচ্ছন্ন। কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু বলতে পারল না। মৃত্যুর গন্ধটা কুয়াশা হয়ে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল।…

.