পিছনে পায়ের শব্দ – ৩

০৩.

 সাবর্ণী অরীন্দ্রের জমাট আসর থেকে কখন উঠে গেছে, পিউ ছাড়া কেউ লক্ষ করেনি। খানছয়েক মারাত্মক ভূতের গল্পের পর তিনি বললেন, কিন্তু এগুলো তত কিছু না। ক্লিফটন সায়েবের কুঠিবাড়িতে একবার জ্যোৎস্নার রাতে…সাবর্ণী, খাদটা তো দেখেছ?

তারপর সাবর্ণীর চেয়ার খালি দেখে বললেন, কী আশ্চর্য! কখন উবে গেল?

পিউ হাসল। এমনও হতে পারে, ওখানে যে বসে ছিল, সে আপনার সেই পোড়ো খনির পেত্নী। আই মিন, আপনি বেড়াতে গিয়ে রিয়্যাল নাতবউকে মিস করেছেন। ভগীরথদাকে খুঁজতে পাঠান।

সবাই হেসে উঠল। তারপর অরীন্দ্র বললেন, তোমরা গাড়িতে ঘুরেছ। ও পায়ে হেঁটে ঘুরেছে। টায়ার্ড হওয়া স্বাভাবিক। তো যা বলছিলুম।

রাণু বললেন, রাত হয়ে গেছে। পিয়ালিদের বাড়িতে ভাববে। বুড়ো, তুই। যাবি, না ভগীরথদাকে পাঠাব?

পিয়ালি নার্ভাস হাসল। কাকেও যেতে হবে না!

পিউ বলল, তোমায় দেখে বোঝা যাচ্ছে অবস্থা শোচনীয়। মাইন্ড দ্যাট, ছ’খানা ভূত!

পিয়ালি বলল, ভ্যাট! সব বানানো। হাজারবার শোনা পেটেন্ট গল্প।

অরীন্দ্র কপট শাসিয়ে বললেন, গল্প? ঠিক আছে। রাস্তায় একা বেরিয়ে দেখ। কী হয়।

রাণু উঠে বললেন, আর নয়। খুব হয়েছে। বুড়ো, তুই যা বরং। আমি দেখি, সুশি কী করছে।

রাণু কর্ত্রীর গাম্ভীর্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিয়ালি উঠে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ পিউ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, বাড়িতে রিং করে বলে দাও না আমার। কাছে থাক।

অরীন্দ্র প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। সাত্যকি বলল, এই এরিয়ায় ফোন কোথায়? টাউনশিপে সবে এক্সচেঞ্জ হয়েছে।

সরি। পিউ পা বাড়িয়ে বলল, তা আপনি ওদের বাড়ি খবর দিয়ে আসুন না, ও আমার কাছে থাকছে।

সাত্যকি একটু হাসল। আপনি কলকাতায় নেই, প্লিজ ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। এতক্ষণে মাসিমা বোধহয় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

পিউ ওদের অনুসরণ করে বলল, ব্যস্ত হবার কী আছে? পিয়ালি, তুমি কিছু বলে আসনি?

পিয়ালি শুধু মাথা দোলাল। অরীন্দ্র শব্দ করে আসন ছেড়ে বললেন, একটা ব্যাকগ্রাউন্ডও আছে ডিয়ারি! বলব’খন। সে যা দিন গেছে, বলার নয়। তোমাদের বয়সী মেয়েরা দিনদুপুরেও একা বেরুতে পারত না।

সাত্যকি বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার সবতাতেই বাড়াবাড়ি।

পিউ ঘুরে বড় চোখে তাকিয়েছিল অরীন্দ্রের দিকে। অরীন্দ্র একটু গম্ভীর। ছড়ি হাতে অন্যদিকের দরজা দিয়ে বাথরুমে গেলেন। পিউ সিঁড়ির দিকে চলতে চলতে আস্তে বলল, কী ব্যাপার সাত্যকিদা?

পিয়ালি হেসে ফেলল। বুড়োদা বলো। খুশি হবে।

ওক্কে। বুড়োদা। পিউ এগিয়ে পিয়ালির কাঁধে হাত রাখল। মেয়েরা বেরুতে পারত না, এতেও কড়া ভূতের গন্ধ! সত্যিই! ক্লিফটনগঞ্জে এভরিথিং থ্রিলিং। বুড়োদা, বলুন না!

সাত্যকি কাঠের সিঁড়িতে নেমে বলল, ভূতটুত নয় পরপর দুটো সুইসাইড ঘটলে যা হয়। এরিয়াটা তো দেখলেন। সুপারস্টিশনের ডিপো। আর আমার ঠাকুর্দা ভদ্রলোকের পরিচয় নিশ্চয় পেয়ে গেছেন।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে পিউ বলল, আপনাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যাচ্ছি না আই মিন, আই শুড নট!

পিয়ালি দ্রুত বলল, চলে এস। বুড়োদার মতো বডিগার্ড সঙ্গে।

তার চোখে ঝিলিক ছিল। সাত্যকি ঘুসি পাকিয়ে আস্তে তার পিঠে ছুঁল। গেটের বাইরে আমি কিন্তু যাচ্ছি না। মাইন্ড দ্যাট। তারপর খাদের ভূত তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জলকেলি করুক।

অসভ্য!

 পিয়ালি কাঠের সিঁড়িতে প্রায় দৌড়ে নামতে থাকল। সাত্যকি ঘুরে পিউয়ের দিকে হাসিমুখে একবার তাকিয়ে আস্তে পা বাড়াল। নীচের হলঘরে ওরা অদৃশ্য হলে পিউ একটা চাপা শ্বাস ছেড়ে সরে এল।

অরীন্দ্র তাকে ডাকছিলেন। কিচেন ডাইনিং ঘর দোতলায়। জাস্ট আ মিনিট বলে পিউ সাবর্ণীর ঘরে ঢুকল। এ ঘরটা দক্ষিণমুখী বিশাল বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। সেকেলে ছাদের খড়খড়ি দেওয়া প্রকাণ্ড জানালা। আষ্টেপৃষ্ঠে অলঙ্কৃত খাটটাও বেশ উঁচু।

পিউ দেখল সাবর্ণী খাটের ওপর পশ্চিমের একটা জানালার কাছে চেয়ার পেতে বসে আছে। পায়ের শব্দে ঘুরেছিল সে। টেবিলল্যাম্পের আলোর বাইরে থাকায় সে অস্পষ্ট। পিউ সুইচ টিপে উজ্জ্বল আলোয় ঘর জ্বালিয়ে দিলে সে বিরক্ত হয়ে বলল, আহ্! নিভিয়ে দে।

পিউ গিয়ে পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, সামথিং ইজ রং বিবি!

 বকিস না। মাথা ধরেছে। আহ, ছাড়!

তুই কি পি জি-র গাড়ির হেডলাইট দেখার জন্য সময় গুনছিস? পিউ পাশ কাটিয়ে জানালার গরাদ ধরল এবং ইশ বলে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। ঠাণ্ডা লাগছে না তোর? কী? কথা বলছিস না কেন?

বলছি তো মাথা ধরেছে।

পিউ হাসল। আনুদার এখানে আসার চান্স নেই। আর যদি আসে, আসবে। সে তোর সঙ্গে কথা বলবে না, তুইও তার সঙ্গে বলবি না। ব্যস! একটু পরেফের বলল, তোর পি জি একটু চমক খাবে অবশ্য। তবে ভয় পাবে না। কারণ বুঝতে পারছিস তো? পি জির বস গণাদার ছবির ফাইন্যান্সার।

সাবর্ণী আস্তে বলল, তোকে কে বলল?

পি জি স্বয়ং। আবার কে?

আমি জানতুম না!

সে কী! পিউ অবাক হয়ে তাকাল দিদির দিকে। মর্নিঙে আমাকে বলে গেল গণাদা আসার কথা। ইরিগেশন বাংলো বুক করেছে। ছবির লোকেশন দেখতে…মাই গুডনেস! মনে হচ্ছে পি জি যেভাবে হোক সম্ভবত জানত, আনুদা আসতে পারে গণাদার সঙ্গে। তাই তোকে ব্যাপারটা বলেনি। পি জি তোকে ভয় পায়, জানিস তো? তুই যেমন আনুদাকে।

সাবর্ণী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সবতাতে তোর ফোপরদালালি। বেরো! কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

সাবর্ণী কোণের ওয়ার্ডরোব থেকে নাইটি বের করছিল। পিউ তাকে লক্ষ করছিল। একটু পরে বলল, আনুদাকে তোর সম্পর্কে একটু খোঁচা দিয়েছিলুম। রিঅ্যাক্ট করল না। আনুদা…

শাট আপ! থাপ্পড় খাবি।

 বিবি! তুই মিথ্যা ভয় পেয়েছিস।

 সাবর্ণী চটে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দরজার দিকে রাণুর সাড়া এল। কই গো সব, খেতে আসবে না কি? সাড়ে দশটা বেজে গেল।

ঘরে এলেন রাণু। ফের বললেন। প্রিয় এখনও ফিরল না যখন, মনে হচ্ছে আশাপুরায় থেকে যাবে। আজকাল রাতবিরেতে রাস্তায় একা গাড়ি নিয়ে কেউ বেরুতে সাহস পায় না। তোমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলের অবস্থা জানি না। এই সেদিনই তো এক মারোয়াড়ি ভদ্রলোকের গাড়ি আটকে রাহাজানি করল। লোকাল পুলিশ দেখেও কিছু দেখে না। এস তোমরা!

সাবর্ণী নরম একটু হেসে বলল, রাণুদি প্লিজ! আমি রাত্তিরে কিছু খাব না। ভীষণ মাথা ধরেছে।

রাণু ব্যস্ত হলেন। মাথা ধরেছে বলে খেতে হবে না? ট্যাবলেট খেয়ে নাও।

না রাণুদি! প্লিজ।

পিউ বাঁকা হাসল। বুঝলেন না রাণুদি? বিয়ে করলেই মেয়েরা মহিলা হয়ে যায় এবং পতিদেবতা না খেলে পত্নীদেবীর খাওয়া বারণ হয়।

রাণু হাসি চেপে বললেন, সে-সব আগের দিনে ছিল-টিল। এই যে আমাকে দেখছ! বুড়োর জামাইবাবু ছিলেন নামকরা শিকারী। বাঘের খবর পেলে সেই বাঘ যতক্ষণ না মারতে পারছেন, বাড়ি ফিরছেন না। খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা। আমি কিন্তু দিব্যি খেয়েদেয়ে পান চিবোতুম। আর এখনও তো দেখছ, নিয়ম-টিয়ম মানি না। সবই খাচ্ছি-টাচ্ছি। এস।

সাবর্ণী মুখে কাকুতি ফুটিয়ে বলল, বিশ্বাস করুন, কিছু খেলে বমি হয়ে যাবে।

পিউ কোনও কথা না বলে রাণুর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। রাণু একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে। তা হলে তোমরা দু বোনে এ ঘরে শোবে। প্রিয়র আসার চান্স নেই আর। যদি আসে, তখন বরং পিউ আমার ঘরে চলে যাবে।

সাবর্ণী আস্তে বলল, একা থাকতে আমার অসুবিধে হবে না।

না, না। শরীর খারাপ। তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একা শোবে না। রাণু দরজার দিকে এগিয়ে হঠাৎ ঘুরলেন। আর একটা কথা। দরজা-জানালা ঠিকমতো বন্ধ করে শোবে। কেউ ডাকলে হুট করে দরজা খুলে দিও না। পাশের ঘরে আমি শুই। ঘুম কবে চলে গেছে চোখ থেকে। দরকার হলে ডেকো। কেমন?

সাবর্ণী তাকিয়ে রইল। রাণু চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে সে শাড়ি ছেড়ে পুরু নীল নাইটিটা পরে নিল। একটু ইতস্তত করে সায়া খুলে কোনার দিকে টুলে রাখা প্রকাণ্ড সুটকেসটার ওপর ছুঁড়ে ফেলল। দম আটকানো অবস্থা হঠাৎ। ব্রেসিয়ারের পেছনকার ক্লিপ খুলে জোরে শ্বাস ফেলল সে। তারপর আবার পশ্চিমের সেই জানালার ধারে গিয়ে বসল। বাইরে হিম অন্ধকারে চেনাজানা পৃথিবী নিশ্চিহ্ন, আবছা সেই কালো খাদটা মনে ভেসে এল, খুব কাছে চলে এসেছে যেন। ঠোঁট কামড়ে ধরল সে। হঠাৎ আবার সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি, পিছনে অনির্বাণ এসে দাঁড়িয়েছে, সামনে খাদ। দ্রুত ঘুরল পিছনে। ভাবল, দরজা বন্ধ করবে নাকি। পিউ এসে ডাকলে খুলবে।

উঠতে গিয়ে দূরে গাড়ির হেডলাইট চোখে পড়ল সাবর্ণীর। কামনা করল, যেন প্রিয়গোপাল হয়। এ রাতে প্রিয়গোপাল তার কাছে চরম আশ্রয় হয়ে উঠেছে। তার ইচ্ছা করছিল, প্রচণ্ডভাবে একটা আত্মসমর্পণের পর যা ঘটে ঘটুক, অনির্বাণের চিঠিটা প্রিয়গোপাল পড়ুক বা না পড়ুক, সব কিছু খুলে বলবে সে। আবেগে অস্থির সাবর্ণী আলোটা দেখছিল। ক্রমশ বেঁকে এদিকে আসছে। অসহ্য রকমের দেরি করছে পৌঁছুতে। অবশ্য রাস্তাটা ভাল না। বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বাউন্ডারি ওয়ালের ওধারে পোড়ো জমি, ঝোপঝাড় এবং কিছু উঁচু গাছ। তার ওধারে রাস্তাটা। চাপা গরগর শব্দে গাড়িটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে। তখন সাবর্ণী দক্ষিণের জানালায় গেল। কিন্তু গাড়িটা তাকে হতাশ করে বসতি এলাকার ভেতর ঢুকে গেল। শব্দে মনে হল খালি ট্রাক।

সাবর্ণী রাগ করে দরজা বন্ধ করল।

কিছুক্ষণ পরে বাইরে পিউয়ের গলা শোনা গেল। কপাটে একটু খুটখুট শব্দও। বিবি!

তুই কিন্তু একা শুচ্ছিস। আমি রাণুদির ঘরে চললুম। বিবি! শুনলি কি বললুম?

সাবর্ণী দরজা খুলে বলল, শুবি তো অত চেঁচানোর কী আছে?

পিউ হাসল। তোকে সাহস দিচ্ছি আর কী! রাণুদি ইনসিস্ট করছিলেন। ম্যানেজ করেছি। ওঁর ঘরে আলাদা বেড়ে নির্ঝঞ্ঝাট শোব বাবা! বিবাহিতা মহিলাদের পাশে শাওয়ার কথা ভাবা যায় না! গুড নাইট!

সে চলে গেলে রাণু এলেন। তোমার বোন তোমার কাছে শোবে না। আবার, আমি যে তোমার কাছে শোব, তাতেও ওর আপত্তি! বলে, ক্লিফটনসায়েবের ভূত ঘাড় মটকাবে। তো বললুম, তা হলে তোমার দাদামশাইয়ের ঘরে গিয়ে শোও…হাসতে লাগলেন রাণু। চাপাস্বরে বললেন, ফের, বলে কী, বুড়োমানুষের প্রেমের চেয়ে ক্লিফটনের ভূত অনেক ভাল। তো এক কাজ করা যায়। তুমিও আমার ঘরে আসতে পারো। আমার খাটটা বড়। অসুবিধে হবে না। কী?

নাহ। আপনারা শোন। আমার অসুবিধে হবে না।

রাণু একটু ইতস্তত করে বললেন, নীচে ভগীরথ থাকে। প্রিয় এলে গেট খুলে দেবে। যা বলেছি, হুট করে দরজা খুলে দিও না। এ তোমাদের কলকাতা শহর নয়, জংলি এলাকা।

হঠাৎ জোরালো মিউজিক শোনা গেল ওপাশের ঘরে। রাণু বললেন, বুড়োর টেপ বাজানো শুরু হল। শুনতে শুনতে ঘুমোবে। নাও, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। পিউ! কোথায় যাচ্ছ?

বুড়োদার ঘরে নাচতে।

সাবর্ণী উঁকি দিয়ে দেখল, পিউ ওপাশের একটা ঘরে ছটফটিয়ে ঢুকে গেল। এখানে এসে বড় বেশি মাতামাতি করছে পিউ। সাবর্ণী একটু বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ করল। নিঝুম শীতের রাতে এমনিতেই সব কিছু অস্বাভাবিক নিষ্প্রাণ লাগে এবং এ ধরনের স্তব্ধতার সঙ্গে পরিচয়ও নেই সাবর্ণীর। আবছা মিউজিকের শব্দটা ঠাণ্ডা জমাট স্তব্ধতাকে করাতচেরা করছে। সে সেদিকে কান রাখল। ওয়েস্টার্ন কিছু বাজছে টেপে। পিউ কি সত্যিই নাচবে? সাত্যকি ছেলেটিকে ভাল লেগেছে সাবর্ণীর। ভোরে কুয়াশার ভেতর জগিং করে এসে ঝুলন্ত বালির বস্তায় দমাদ্দম ঘুসি চালাচ্ছিল। পিউ প্রশংসার চোখে দেখছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দৃশ্যটা চোখে পড়েছিল সাবর্ণীর। কাল ভোরে পিউ ওর সঙ্গে জগিং করতে বেরুলেও অবাক হবে না সাবর্ণী। কিন্তু পিউ সত্যি বাড়াবাড়ি করছে। আর একটা দিন থাকলে পিয়ালির রিঅ্যাক্ট করার সম্ভানা। সাবর্ণীর খারাপ লাগল ভাবতে! একে তো নিজের একটা বিচ্ছিরি সমস্যা। পিউ বাড়তি ঝামেলা বাধাতে চলেছে।

ঘরের পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটো করে জানালা। দক্ষিণে দুটো জানালার মাঝামাঝি ডিমালো সেকেলে আয়না লাগানো ড্রেসিংটেবিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে আলগোছে চিরুনি টানতে থাকল সাবর্ণী। তারপর মুখে ক্রিম ঘরে নিজেকে কিছুক্ষণ দেখার পর সুইচ টিপে উজ্জ্বল দেয়ালবাতিটা নেভাল। টেবিলের আলোটা এতক্ষণ ধরে জ্বলেছে! এগিয়ে গিয়ে সুইচ অফ করে নিজের সাহস যাচাই করতে চাইল সে।

গাঢ় অন্ধকার সহসা তাকে গিলে নিয়েছিল এবং যেন সেই খাদটাতে সে পড়ে যাচ্ছে, এমন আতঙ্কে সুইচ অন করল। তারপর পশ্চিমের খোলা জানালাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল। দক্ষিণের জানালার ওধারে চওড়া ব্যালকনি। উঁকি মেরে দেখল নীচের লনে হলুদ আলো পড়েছে। আলোর ছটা গেটের দিকে এগিয়ে মিলিয়ে গেছে। গেটটা স্পষ্ট দেখা যায় না। ব্যালকনি অন্ধকার দেখে খারাপ লাগল সাবর্ণীর। আলোটা সারারাত জ্বালিয়ে রাখলে কী এমন বেশি খরচ হয়! দুটো জানালাই বন্ধ করে খাটে এসে বসল সে। পা দুটো হিমে জমে গেছে। মোজা পরবে কি না ভাবল। কিন্তু পরল না। কম্বলের ভেতর পা ঢুকিয়ে খাটের বাজুতে হেলান দিল। সাত্যকির ঘর থেকে পপ মিউজিক শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভোকাল উন্মাদনা। ওর ঘরে গিয়ে সময় কাটালে ভাল হত, যতক্ষণ না প্রিয়গোপাল আসে।

সাবর্ণীর বিশ্বাস, সে আসবে। পিউ যা বলল, তাতে তা-ই মনে হয়। অনির্বাণ এখানে আসতে পারে। প্রিয়গোপাল তা যদি আঁচ করে থাকে, সাবর্ণীর কাছাকাছি থাকাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। নেহাত কাজের দায়ে বেরুতে হয়েছে। তাই দাদামশাইকে আভাসে কিছু বলে গেছে, এতে সাবর্ণী নিঃসন্দেহ। বিকেলে অরীন্দ্র ভালমন্দ দেখা, ‘বডিগার্ড’ এসব কথা তুলেই হঠাৎ থেমে গেলেন। কিন্তু কী বলেছে সে অরীন্দ্রকে? যা-ই বলুক, অরীন্দ্রই বা কী ভাবে তা নিয়েছেন? গল্পের আসর থেকে হঠাৎ সাবর্ণী চলে গেল। তারপর আর খোঁজখবর করার তাগিদ নেই ওঁর। হঠাৎ সাবর্ণী ওঁর মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে যেন। তাকে ঘৃণা করা চলে এমন কিছু কি?

উত্তেজনায় সাবর্ণী নড়ে উঠল। ঠিক এ ধরনের আচরণের জন্যই সে প্রিয়গোপালকে মনে মনে ঘৃণা করে। ওর চেহারা হাব-ভাব দেখে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই কত কুটিল প্রকৃতির মানুষ। দাদামশাই ভদ্রলোকটিও কি। তাই?

কতক্ষণ পরে দরজার ধাক্কার সঙ্গে পিউয়ের গলা শুনে সাবর্ণী সাড়া দিল। তারপর দরজা খুলতেই প্রিয়গোপাল ধুড়মুড় করে ঢুকে মাতালের মতো টলতে। টলতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। হাতের ব্রিফকেস সশব্দে নীচে রাখল। পিউ চোখে ঝিলিক তুলে চলে গেলে প্রিয়গোপাল দম আটকানো গলায় বলল, দরজা বন্ধ করো! নাহ্! আগে এক গ্লাস জল এনে দাও।

টেবিলে জগভর্তি জল আর গেলাস ছিল। সাবর্ণী জলের গেলাস দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কী একটা ঘটেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছিল না। প্রিয়গোপাল জল খেয়ে খালি গেলাস সাবর্ণীর হাতে দিয়ে কাতর একটু হাসল। একটা টেরিফিক এক্সপিরিয়েন্স হল! আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট। বলে সে প্যান্টের বেল্ট ঢিলে করে দিল। দাদামশাই বরাবর বলেন। আমি বিশ্বাস করতুম না। বাপস!

সাবর্ণী ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে?

ইরিগেশন বাংলোয় গণাদা আছে খবর পেয়ে মিট করতে গেলুম। প্রিয়গোপাল মুখে একটা ভয়ের ভঙ্গি এনে বলল। ফেরার সময় ক্লিফটনের কুঠিবাড়ির কাছাকাছি এসে হঠাৎ দেখি ব্রেক কাজ করছে না। ভাগ্যিস রাস্তা খারাপ, তাই স্পিড খুব কম ছিল। রাস্তার ধারে ঝোপে ঢুকিয়ে দিলাম। ধাক্কা বিশেষ লাগেনি। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে কী করব ভাবছি, হঠাৎ কুঠিবাড়ির দিকে কী একটা হরি চিৎকার…আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট, ফেরোসাস অ্যান্ড ক্র্যাকড ভয়েস। এনিওয়ে, আমি গাড়ি ফেলে রেখে চলে এসেছি। কাকেও কিছু বললুম না। তুমিও বলবে না। জাস্ট পথে গাড়ি খারাপ হেঁটে এসেছি। যাও, দরজা বন্ধ করো। একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।

সাবর্ণী একটু হাসল শুধু। শব্দহীন এই হাসিতে অবিশ্বাস ছিল।

 প্রিয়গোপাল চাপাস্বরে বলল, বিলিভ মি বিবি! আরও একটু আছে। টর্চটা গাড়িতে থেকে গেছে। সেটা যে নেব, সে খেয়ালও নেই। কিছুটা এগিয়েছি, হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দ। থমকে দাঁড়ালুম। অন্ধকার। ঘুরে কাকেও দেখতে পেলুম না। আবার হাঁটছি। কিছুক্ষণ পরে আবার পায়ের শব্দ। সাহস করে বললুম, কে? সাড়া পেলুম না। নাহ, কানের ভুল নয়। বিলিভ মি প্লিজ, বাড়ির গেটে ঢুকছি, তখনও। সামবডি ওয়াজ ফলোয়িং মি। সিওর বিবি! আপন গড় বলছি। ঠিক শুকনো পাতায় পা ফেললে যেমন শব্দ হয়…

তুমি পোশাক ছাড়ো। আমি সুশিদিকে ওঠাচ্ছি। জল গরম করে দেবে। বলে সাবর্ণী পা বাড়াল দরজার দিকে।

প্রিয়গোপাল উঠে দাঁড়াল। বলল, একা বেরিও না। চলো, আমিও যাই।

সাত্যকির ঘরে মিউজিক থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িটা ভীষণ স্তব্ধ হয়ে গেল…

.