বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ৬

০৬.

 রিকশায় আসতে আসতে কর্নেল আমাকে খবরের কাগজে উন্মাদ আশ্রম সম্পর্কে লেখার পূর্ব-পরিকল্পনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। বসতি এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে নদীর ধারে কুমারচক উন্মাদ আশ্রম। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। ভেতরে-বাইরে উঁচু-নিচু গাছপালা। প্রকাণ্ড গেট। তার দুধারে কয়েকটা একতলা সারবন্দি ঘর। রিকশাওলাকে তার দাবিমতো ভাড়াসহ বখশিস মিটিয়ে কর্নেল বললেন–আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কখন ফিরব, ঠিক নেই।

রিকশাওলাকে এই কথাটা বলার কারণ, সে সারাপথ ঘ্যানঘ্যান করছিল, স্টেশনে সন্ধ্যার ট্রেন ধরিয়ে দিতে পারবে এবং স্টেশনে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা তার জানা।

বেজার মুখে সে চলে গেল। এলাকাটা নিরিবিলি সুনসান। গেটে বাইরে থেকে তালাবন্ধ। বাঁদিকে বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক সিগারেট টানছিলেন। দৃষ্টি আমাদের দিকে। আমরা তাঁর কাছে গেলে গম্ভীর মুখে বললেন– আলুমটর চটরপটর কাঁচকলা কানমলা…ইটকেল বিটকেল পাটকেল থুঃ!

অমনি ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। তার হাতে ছুরি। বলল–এখনও তুমি যাওনি?

ছুরি উঁচিয়ে আসতেই ভদ্রলোক নীচে লাফ দিয়ে পড়লেন। বাঁচাও! বাঁচাও! খুন করলে বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে উধাও হয়ে গেলেন। লোকটা হাসতে হাসতে ঘুরেই আমাদের দেখতে পেল। বলল–আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

কর্নেলের পরামর্শমতো বললাম–আমরা আসছি কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে। আশ্রমের সেক্রেটারি শচীনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

–একটু বসতে হবে তা হলে। উনি চারটে নাগাদ আসেন।

 পাশের ঘরটা ওয়েটিং রুম গোছের। পরিচ্ছন্ন এবং সোফাসেটে সাজানো। কয়েকটা বুককেস আছে। দেয়ালে বিখ্যাত নেতাদের ছবির সঙ্গে সম্ভবত স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি। লোকটি আমাদের বসিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল ঘুরে-ঘুরে ছবিগুলো দেখছিলেন। তারপর দেখি, উনি ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করেছেন।

এই সময় ধুতি পাঞ্জাবিপরা এক প্রবীণ ভদ্রলোক এলেন–আপনারা নিউজপেপার থেকে আসছেন?

বললাম–আজ্ঞে হ্যাঁ।

বলে আমার আইডেন্টিটি কার্ডটা ঝটপট বের করে ওঁকে দেখালাম। উনি বললেন–হ্যাঁ। প্রতাপ বলছিল, কাগজের লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। আমাদের পাবলিসিটি দরকার। এ যুগে পাবলিসিটি ছাড়া কোনও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না।

–আপনিই কি সেক্রেটারি শচীনবাবু?

 ভদ্রলোক হাসলেন।না। আমার নাম গণেশ দেবনাথ। আমি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। শচীনের আসার সময় হয়ে এল। বলে উনি কর্নেলের দিকে তাকালেন।উনি আপনাদের ফটোগ্রাফার?

কর্নেল নমস্কার করে সহাস্যে বললেন বলতে পারেন। তবে ফ্রিল্যান্স করি। সত্যসেবক দয়া করে আমার দু-একটা ছবি ছাপে-টাপে। আসলে ছবি তোলা আমার হবি।

গণেশবাবু ওঁর কথার ভঙ্গিতে হেসে আকুল হলেন। তারপর বললেন–বিখ্যাত নেতাদের ছবি তো সর্বত্র ফলাও করে ছাপা হয়। অথচ যারা সত্যিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছেন, তাদের ছবি কেউ ছাপে না।

কর্নেল বললেন–এই ছবিগুলো কাদের, কাইন্ডলি যদি পরিচয় করিয়ে দেন। জয়ন্ত, তুমি নোট করা! হা–এই যে দেখছি প্রদোষ অধিকারী, অমরেশ রায়, সত্যসাধন কুণ্ডু, পরিতোষ লাহিড়ি, দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্ত, শচীন্দ্র মজুমদার-হা, এই তো আপনারও ছবি আছে। আর এঁকে চিনতে পারছি। প্রতাপ সিংহ মিনিস্টার।

গণেশবাবু সগর্বে বললেন–আসলে কুমারচক এলাকায় ১৯৪২ সালের আগস্ট বিপ্লবের বিপ্লবী আমরা। আমি, প্রতাপ আর শচীন্দ্র বেঁচেবর্তে আছি। আমরা তিনজন মাত্র সুস্থ শরীরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম। বাকি যারা ছিল, কেউ জেলেই মারা পড়েছিল, কেউ ছাড়া পেল পাগল অবস্থায়, কেউ পরে পাগল হয়ে গেল। সে এক বিশাল ইতিহাস। স্বাধীনতাযুদ্ধের অলিখিত অজ্ঞাত অধ্যায়।

বললাম–অমরেশ রায়ের বাংলায় আগস্ট বিপ্লব বইটা পড়েছি।

–পড়েছেন? কোথায় পেলেন? গণেশবাবু নড়ে বসলেন।–বইটার কথা শুনেছিলাম। অমরেশ কলকাতায় গিয়ে বাড়ি-টাড়ি কিনেছিল। কোত্থেকে অত পয়সা পেয়েছিল কে জানে? নিজের পয়সায় বই ছেপেছিল। প্রথমে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য এই আশ্রম খুললাম আমরা, ও মাঝে মাঝে আসত। তারপর আশ্রম উঠে গেল। এই উন্মাদ আশ্রম করলাম।

বললাম আপনাদের আশ্রমের প্রচারপুস্তিকা পড়েছি।

–পড়েছেন? তা তো পড়বেন। আপনারা জানালিস্ট। তো যা বলছিলাম, উন্মাদ আশ্রম করার পর অমরেশ এখানে আসা ছেড়ে দিল। কেন তা জানি না। তবে আশ্চর্য ব্যাপার! গত রোববার কাগজে পড়লাম, কোন পাগলের হাতে খুন হয়ে গেছে। সেদিনই এখানে সংবর্ধনা সভায় ওর আসার কথা ছিল। তারপর আরও আশ্চর্য ব্যাপার, পরিতোষেরও আসার কথা ছিল। সে-ও নাকি পাগলের হাতে খুন হয়ে গেছে। সেই পাগল কে জানেন? ওই যে ছবি দেখছেন। দেবীপ্রসাদ। বদ্ধ পাগল অবস্থায় এখানে ভর্তি হয়েছিল। হঠাৎ গরাদ বেঁকিয়ে কী করে বের হয়ে গেল কে জানে! তারপর তার কাণ্ড দেখুন। দু-দুজন সহযোদ্ধাকে খুন করে ফেলল। তবে পালানোর পর ভেবেচিন্তে আমরা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কাগজে। কারণ দেবী একজন গার্ডকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সেলে ঢোকানো হয়েছিল। ডাণ্ডাবেড়িরও

কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন–দেবীবাবু কি না জানি না, একজন পাগলকে পুলিশ শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আ্যারেস্ট করেছে গতকাল। নাম জিজ্ঞেস করলে বলেবরকধঝ-কচতটপ।

গণেশবাবু লাফিয়ে উঠলেন।–দেবী! দেবী! ওকে তাহলে ধরেছে পুলিশ! কাগজে তো দেখলাম না আজ।

বললাম–আমরা কাগজের লোক। পুলিশসোর্সে খবর পেয়েছি। পরে বেরুবে খবর।

গণেশবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন বাঁচা গেল। শচীন আসুক। জেনে খুশি হবে।

কর্নেল বললেন–দেবীবাবু একটা পদ্য আওড়ান শুনেছি আমরা। ওহে মৃত্যু– তুমি মোরে কি

–হ্যাঁ পদ্যটা দেবীর খুব প্রিয় ছিল। বুঝলেন না? আসলে একজন বিপ্লবী তো। ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারের ধকল সামলাতে পারেনি। সুস্থ অবস্থায় জেল থেকে বেরুল। বিয়ে করল। আশ্রম থেকে আমরা ওর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল।

এই সময় চায়ের কেটলি এবং কয়েকটা কাপ নিয়ে সেই লোকটি ঢুকল। বলল–বড়বাবু খবর পাঠিয়েছেন আজ আসতে পারবেন না আপিসে।

গণেশবাবু বললেন–ঝন্টু আসবে না?

–আজ্ঞে। কেতো খবর দিয়ে গেল। লোকটি চাপাস্বরে বলল–বিলুবাবু কী ঝামেলা করেছে। পুলিশ তাকে ধরেছিল। থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। কেতো বলছিল। বলে লোকটি চলে গেল।

ওই ছেলেই ঝন্টুকে ডোবাবে। বলে গণেশবাবু আমাদের দিকে ঘুরলেন। শচীন আসবে না। চা খান আপনারা। তারপর আমিই আশ্রমের কাজকর্ম সম্পর্কে কথা বলব। একটু ভালভাবে লিখবেন যেন।

কর্নেল বললেন–আশ্রমের ভেতরটা দেখতে চাই আমরা। ছবি তুলতে চাই। আজকাল তো জানেন রঙিন ফটোফিচারের যুগ।

চায়ে চুমুক দিয়ে গণেশবাবু বললেন–সব দেখাচ্ছি। যত ইচ্ছে ছবি তুলুন।

–দিনের আলো থাকতে থাকতে ছবি তুলতে হবে কিন্তু। আশ্রমের ভেতর গাছপালা আছে। ছায়া ঘন হলে কালার্ড ছবি ভাল আসবে না।

দ্রুত চা শেষ করে গণেশবাবু উঠলেন। হাঁকলেন–নিবারণ!

 সেই লোকটি এল। গণেশবাবু বললেন–হসপিটালগেটের তালা খুলে দে। আমরা ওই গেট দিয়ে ঢুকব। আমরা ঢুকলে পরে আবার তালা আটকে দিবি। ওখানেই ওয়েট করবি বাবা। আমাদের যেন গারদে বন্দী করে রাখবি না। আসুন আমার সঙ্গে।

গণেশবাবু হাসতে হাসতে বেরুলেন। বড় গেটের ডানদিকের ঘরগুলো ডিসপেনসারি। এ-ঘর থেকে ও-ঘর করে গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে একটা করিডরে পৌঁছুলাম। সামনে ছোট গেট। মোটা লোহার গরাদ আঁটা। নিবারণ তালা খুলে দিল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোলা জায়গায় গেলাম। নিবারণ তালা এঁটে দিল। একটু অস্বস্তি হল আমার।

আশ্রমেরই পরিবেশ। ফুলবাগান। বড়বড় গাছের গোড়ায় বেদি। কোনও কোনও বেদিতে কেউ শুয়ে আছে একটা ঠ্যাং তুলে। কেউ ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে। ঘাসের ওপর একজন গড়াগড়ি খাচ্ছে আর হেসে অস্থির হচ্ছে। গণেশবাবু বললেন–মেন্টাল পেশ্যান্ট। তবে পাগল বলা চলে না। ওই দেখুন, এদের ওপর নজর রাখার জন্য গার্ড আছে।

কর্নেল ছবি তুলছিলেন। গণেশবাবু সমানে বকবক করছিলেন। আমি ‘নোট’ নিচ্ছিলাম। একটা প্রতিমূর্তির কাছে গিয়ে গণেশবাবু বললেন–আমাদের পৃষ্ঠপোষক প্রতাপ সিংহের ঠাকুঁদা কুমার বাহাদুর মণীন্দ্র সিংহ। এঁর বাবা ছিলেন রাজা বিজয়েন্দ্র নারায়ণ সিংহ। ভেবে দেখুন। ব্রিটিশের অনুগত রাজপরিবারের বংশধররা পরে হয়ে উঠলেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী! আশ্চর্য না? : সায় দিলাম। কর্নেল ছবি তুলতে তুলতে প্রতিমূর্তির পেছনে বোগানভিলিয়ার আড়ালে অদৃশ্য হলেন। গণেশবাবু খেয়াল করেননি। আবার বকবকানি শুরু হলো। বোগানভিলিয়ার ঝোপ পেরিয়ে গিয়ে কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বললাম আপনাদের গারদ কোথায়? মানে–যেখানে বিপজ্জনক উন্মাদদের রাখা হয়?

–ওই তো। গণেশবাবু বাঁদিকে কয়েকটা সারবন্দি একতলা ঘর দেখিয়ে দিলেন। বারান্দা আছে সামনে। তারপর গরাদের সারি। ভেতরটা আঁধার দেখাচ্ছে। দূর থেকে।

কর্নেলকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে গণেশবাবু হাসলেন। আপনাদের ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক অলরেডি হাজির। আচ্ছা, ভদ্রলোকের বয়স কত বলুন তো? একেবারে সায়েবদের মতো চেহারা। সাদা দাড়ি। অথচ দিব্যি শক্তসমর্থ মানুষ। শরীরচর্চা করতেন নাকি? আমিও একসময়–মানে, আমাদের সহযোদ্ধারা সকলেই একসময় শরীরচর্চা করতাম। বিপ্লব করতে হলে সুস্বাস্থ্য চাই। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন–গীতা পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা উত্তম। নাকি মিসকোট করলাম? বয়স স্মৃতি নষ্ট করে। হা–গীতার চেয়ে ফুটবল শ্রেষ্ঠ।

হাসি চেপে বললাম–ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক সাকাসের খেলোয়াড় ছিলেন একসময়।

–তা-ই! হাসতে হাসতে গণেশবাবু পা বাড়ালেন।–তো তিনজনকে গারদে রাখা হয়েছিল। একজনের কথা তো বলেছি–দেবীপ্রসাদ। আরেকজন গদাধর পাল। স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমাদের প্রিয় গদাইদা। বড় কষ্ট হয় মনে জয়ন্তবাবু! কিন্তু উপায় নেই। ইটপাটকেল ছুঁড়ে কেলেঙ্কারি করে। অগত্যা ওকে আটকাতে হলো।

–আরেকজন?

 গণেশবাবু থমকে দাঁড়ালেন।–ঝন্টু, মানে শচীন আজ সকালে বলছিল, কাল রাতে নাকি একজনকে গারদে ঢোকানো হয়েছে। আমি তাকে দেখিনি। নিশ্চয় ডেঞ্জারাস হয়ে উঠেছিল কোনও রুগী। চলুন, গিয়ে দেখি।

কর্নেল বারান্দা থেকে নেমে এলেন। গম্ভীর মুখে বললেন–ছবি তোলা শেষ আপাতত। আমি ওই গাছতলায় গিয়ে বসি। জয়ন্ত গিয়ে দেখ, ইন্টারভিউ নিতে পার নাকি!

বারান্দায় উঠেই আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। সামনেকার সেলের ভেতর কালিঝুলিমাখা ছেঁড়া শার্ট আর হাফপেন্টুল পরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই।

আমি কিছু বলার আগেই হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললেন–বরকধঝ কচতটপ! তারপর লম্ফঝম্ফ নেচে আওড়ালেন–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়! বরকধঝ-কচতটপ…বরকধঝ কচতটপ…

সর্বনাশ! গোয়েন্দা ভদ্রলোক কি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন? আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

গণেশবাবু খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন–এ যে দেখছি দেবীপ্রসাদের এক জুড়ি! ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো? অ্যাই! কে তুমি? নাম কী? দেবীকে চেনো তুমি?

পাশের সেলের পাগল গদাইবাবু গরাদ আঁকড়ে হুঙ্কার দিলেন–চো-ও-প শালা। কড়মড় করে মুণ্ডু চিবিয়ে খাব। চিনি না? ন্যাকামি হচ্ছে? দেবীশালাকে আমি চিনি না?

গণেশবাবু হালদারমশাইয়ের সামনে থেকে সরে গদাইবাবুর সামনে গেলেন। কী গদাইদা? কেমন আছ? চিনতে পারছ তো আমাকে?

–চো-ও-প শালা! একবার কাছে আয়। তোর মুণ্ডু কড়মড় করে চিবিয়ে খাই! আয়, আয়!

হালদারমশাই এই সুযোগে চোখ টিপে আমাকে ইশারায় কিছু বললেন। বুঝতে পারলাম না। গণেশবাবু তখন গদাইবাবুকে নিয়ে পড়েছেন।–গদাইদা! আমি গণেশ। তোমার ভালর জন্যই তোমাকে এভাবে রাখা হয়েছে।

গদাইবাবু গর্জন করলেন–চো-ও-প! তারপর দাঁত কিড়মিড় করে ভয় দেখাতে থাকলেন।

গণেশবাবু দুঃখিত মুখে বললেন–বুঝলেন জয়ন্তবাবু? এই গদাইদার নামে ব্রিটিশ সরকার হুলিয়া জারি করেছিল। জ্যান্ত বা মরা অবস্থায় ধরে দিলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। মৌরী নদীর ব্রিজে মিলিটারি ট্রেন উল্টে দিয়েছিল যারা, গদাইদা তাদেরই একজন। আজ তার কী অবস্থা দেখুন!

বললাম–আপনি ছিলেন না সেই দলে?

–পরিকল্পনার সময় সঙ্গে ছিলাম। তবে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আমাদের হাতে খবর ছিল বার্মা ট্রেজারির সোনাদানা টাকাকড়ি থাকবে ট্রেনে। কিন্তু ট্রেনের সেই কামরাটা নাকি নদীতে পড়েছিল। খুঁজে পাওয়া যায়নি।

–দেবীবাবু ঘটনাস্থলে ছিলেন?

-হ্যাঁ। দেবী, পরিতোষ, অমরেশ গদাইদা আর ঝন্টু ছিল। চলুন, যেতে যেতে বলছি। ঝন্টুর কাছে শোনা কথা। ট্রেজারির মাল নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রতিমূর্তিটার কাছে গিয়ে কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বেলা পড়ে এসেছে। হালদারমশাইয়ের ব্যাপার দেখে ভড়কে গেছি। গণেশবাবুর কথায় কান নেই। হালদারমশাই পাগলাগারদে তা হলে সত্যি ঢুকলেন বা জোর করে তাকে ঢোকানো হলো! মারধর অত্যাচার ইলেকট্রিক শক–কত কী চলে শুনেছি পাগলদের ওপরে। কিন্তু ওঁকে দেখে মনে হলো না তেমন কিছু ঘটেছে।

গণেশবাবু বললেন–ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?

বেগতিক দেখে বললাম–পাখির ছবি তোলার ভীষণ বাতিক। আপনাদের আশ্রম এরিয়ায় প্রচুর পাখি আছে। কোথাও কোনও পাখির ছবি তুলেছেন হয়তো।

–গার্ডদের কারও পাল্লায় পড়লে খামোখা অপমানিত হবেন। ভুল হয়ে গেছে। গার্ডদের জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। বলে গণেশবাবু হাঁক দিলেন–মধু! হারাধন! পরেশ! কেউ আছ নাকি এখানে?

কোনও সাড়া না পেয়ে গণেশবাবু হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দেখি, খাকি হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরা কজন লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এবং কর্নেল তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করে আছেন এবং ঘাসের ওপর তাস ছড়িয়ে পড়ে আছে। বোঝা যায়, গার্ডরা তাস খেলতে বসেছিল।

গণেশবাবু থমকে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন।

–দেখছেন কাণ্ড! এবার চলুন, হসপিটালের অবস্থা দেখবেন। পনেরটা বেড। দুজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান আছেন। কেউ বেতন নেন না। প্রতাপ ব্যবস্থা করে দিয়েছে লোকাল গভর্মেন্ট হসপিট্যাল থেকে এসে ওঁরা ভলান্টারি সার্ভিস দেন। ‘

–আশ্রমের রোগীরা কি সবাই ফ্রিডম-ফাইটার?

–হ্যাঁ। গভর্মেন্ট হসপিট্যালে মেন্টাল ওয়ার্ড আছে। কিন্তু আমরা শুধু ফ্রিডম ফাইটার বা তাদের আত্মীয়স্বজনেরই চিকিৎসা করি।

–আগে তো দুঃস্থ ফ্রিডম-ফাইটারদের আশ্রমদান, সেবাযত্ন এসব করতেন শুনেছি। কিন্তু তারপর শুধু মানসিক রুগীদের জন্য আশ্রম করলেন কেন?

গণেশবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন–শচীনের আইডিয়া। কেন? কাজটা কি ঠিক হয়নি?

না, না। একটা মহৎ কাজ।

ফটোগ্রাফার ভদ্রলোককে ডাকুন এবার। অভ্যাসবশে ডেকে ফেললাম– কর্নেল!

গণেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন–ওঁর নাম কর্নেল নাকি?

-না মানে, আমরা ওঁকে ঠাট্টা করে ওই নামে ডাকি। ওঁর নাম এন সরকার।

কর্নেল এসে বললেন-জয়ন্ত, তোমার হয়েছে? এখনই না বেরুলে ট্রেন ফেল করব।

গণেশবাবু বললেন-কর্নেলবাবু! মেন্টাল ওয়ার্ডের ছবি নেবেন চলুন।

–এই যাঃ! ফিল্ম তো শেষ। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন সওয়া পাঁচটা বাজে। বাজার হয়ে কুমারচকের বিখ্যাত সরপুরিয়া নিয়ে যাব। সওয়া ছটায় ট্রেন। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

গণেশবাবু নিরাশ হয়ে বললেন–আচ্ছা।..

বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় পৌঁছে বললাম–হালদারমশাইয়ের কীর্তি দেখলেন? বরাবর দেখছি, একটা-না একটা কেলেঙ্কারি বাধাবেনই। ওঁকে উদ্ধার করা দরকার ছিল।

কর্নেল হাসলেন–উদ্ধারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।

–কিন্তু উনি পাগল সাজতে গেলেন কেন?

 –আমারই পরামর্শে।

–খুব বিপজ্জনক পরামর্শ।

একটু রিস্ক ছিল। কিন্তু আমি আসলে শচীনবাবুর রিঅ্যাকশন বুঝতে চেয়েছিলাম। এটা আমার পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাস করেছি।

–কী পরীক্ষা?

–বরকধঝ-কচতটপ কোনও পুরনো রহস্যের চাবিকাঠি কিনা জানতে চেয়েছিলাম। এবার জানলাম ঠিক তা-ই। আরও জানলাম শচীনবাবু রহস্যের জট ছাড়াতে পারেননি। পারলে দেবীবাবুকে আটকে রেখে চাপ দিতেন না। দেবীবাবু ছিলেন শেষদিকের সেলে। সেলটা দেখে নিয়েছি। গরাদ বাঁকিয়ে পালানো অসম্ভব। কেউ গার্ডদের কাউকে কিংবা ওই নিবারণকে ঘুষ খাইয়ে ওঁকে নিয়ে পালিয়েছিল কলকাতায়। তারপর ওঁর সাহায্যে অমরেশ এবং পরিতোষ দুজনকেই খুন করেছে।

–খুনের মোটিভ কী?

বরকধঝ-কচতটপ রহস্যের চাবিকাঠি সম্ভবত ওই দুজনই জানতেন। অমরেশবাবুর স্ত্রীকে লেখা চিঠির কথা মনে পড়ছে? দেখা করতে বলার উদ্দেশ্য ছিল সাংঘাতিক। অত্যাচার চালিয়ে গোপন কথাটি আদায় করা। দেবীবাবু, শচীনবাবু এবং খুনী যে ভাবে হোক, রহস্যটা জানত। কিন্তু জট ছাড়াতে পারেনি। দেবীবাবু বদ্ধ পাগল। তার কাছে গোপন কথাটি আদায় করা সম্ভব নয়। দেবীবাবুর গায়ে অত্যাচারের চিহ্ন আছে। অরিজিৎ বলছিল। কিন্তু অত্যাচার চালিয়েছিলেন আসলে শচীনবাবু। এরপর তো দেবীবাবু হাতছাড়া হয়ে গেলেন। তখন মিনিস্টারকে দিয়ে এখানে অমরেশ ও পরিতোষকে সভায় আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছিলেন শচীনবাবু। স্বয়ং মিনিস্টার ওঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ায় ওঁরা আসতে রাজি হন। তখন খুনী দেখল, অবস্থা অন্যদিকে গড়াচ্ছে। শচীনবাবুর সঙ্গে ওদের রফা হওয়ার চান্স আছে। অতএব দেবীবাবুকে দিয়ে উত্ত্যক্ত করে বাইরে এনে পরপর দুজনকে খুন করল খুনী।

শিউরে উঠে বললাম–তা হলে শচীনবাবু হালদারমশাইয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছেন। আরও চালাবেন।

নাহ। হালদারমশাইয়ের সেলে গতরাতে শচীনবাবু ঢুকেছিলেন। হাতে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার যন্ত্র ছিল। আমার পরামর্শমতো হালদারমশাই সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে বলেন, ‘Break the Jaw. Catch the Top.’ বরকধঝ-কচতটপ।

–অ্যাঁ? বলেন কী!

–হ্যাঁ। ওটাই বরকধঝ-কচতটপ। ব্রেক দা জ, ক্যাচ দা টপ। জ মানে চোয়াল। কিন্তু এর অন্য মানেও আছে ন্যারো এন্ট্রান্স ভোর। সংকীর্ণ প্রবেশপথ। তা হলে দাঁড়াচ্ছে সংকীর্ণ প্রবেশপথ অর্থাৎ দরজা ভেঙে ওপরের জিনিসটা ধরো। বার্মা ট্রেজারির সেই সিন্দুকরহস্য।

অবাক হয়ে বললাম–আমিও তো বলেছিলাম এটা গুপ্তধন রহস্য।

–যাই হোক। হালদারমশাই বললেন, কথাটা শুনে শচীনবাবু খুশি হন। হালদারমশাই তাকে পাগলামির ভঙ্গিতে বলেছেন, আজ রাত বারোটায় ওঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন। ব্যস, ডিটেকটিভদ্রলোক খুব আদরে আছেন এবং খুশিমতো পাগলামির অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি ফাঁদটা ভালই পেতেছি।

একটা খালি সাইকেল রিকশা পাওয়া গেল রাস্তার মোড়ে। কর্নেল বললেন শচীন মজুমদারের বাড়ি চেনো?

রিকশাওয়ালা বলল–হ্যাঁ। কাছেই। ওই তো দেখা যাচ্ছে।

কর্নেল বললেন–আচ্ছা, ওখান দিয়ে গেলে থানা দূরে পড়বে কি?

তা একটু পড়বে।

–ঠিক আছে। চলো।

দশ টাকা লাগবে স্যার!

ঠিক আছে।

রিকশা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–থাক পরে দেখা করব’খন। থানার কাজটা সেরে নিই আগে।

রিকশা চলতে থাকল। বললাম–হঠাৎ মত বদলালেন যে?

কর্নেল বললেন–তোমাকে বরাবর বলেছি ডার্লিং, ভাল রিপোর্টার হতে চাইলে ভাল অবজার্ভার হওয়া দরকার। সেনসায়েবের জিপ দাঁড়িয়ে আছে শচীনবাবুর বাড়ির সামনে। নাম্বার ভোরবেলা টুকে রেখেছিলাম।

–সে কী! বিলু তো ওঁর ওপর খেপে আছে। হামলা করতে গিয়েছিল ফরেস্টবাংলায়।

–বিলুর বাবার জিগরি দোস্ত। ব্যাপারটার রফা করতে এসে থাকবেন। বাবা যার রক্ষাকর্তা, ছেলে আর তার গায়ে হাত ওঠাবে না। নেহাত একটা ভুল বোঝাবুঝি, বলে মিটে যাবে। বিলুর মতো ছেলের অনেক শত্রু থাকা সম্ভব নয় কি?

–যাই বলুন, ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।

–আমারও। কিন্তু কী আর করা যাবে? বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন।

একটু পরে বললাম-থানায় গিয়ে আবার সেই ছোটবাবুর পাল্লায় পড়লেই কেলেঙ্কারি। থানায় না গেলে নয়?

চলো তো!

সরকারি এলাকায় পৌঁছে রিকশাওলা বলল–এটুকু হেঁটে যান স্যার! থানার সামনে আমি যাব না।

–কেন হে? থানাকে এত ভয় কিসের?

আজ্ঞে স্যার! খামাকো ঝামেলা করে।

নাকি তোমার লাইসেন্স নেই?

লাইসেন আছে বৈকি স্যার! মালিকের নামে লাইসেন আছে। আমরা মালিকের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে প্যাসেঞ্জার খাটাই। পুলিশ সব জেনেও হাঙ্গামা করে।

–প্যাসেঞ্জার খাটিয়ে এই নাও দশ টাকা।

 কর্নেল হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলেন–মফস্বলে এসে আজকাল কতরকম অভিজ্ঞতা হয়। বলে বাইনোকুলারে কী দেখতে থাকলেন। বেলা পড়ে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে। এখন কী দেখছেন কে জানে!

বললাম কী হলো? চলুন।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–একটা শামুকখোল পাখি। ওদিকে একটা ঝিল আছে। এতদূরে চলে এসেছে পাখিটা। সাহস আছে বটে। চলো।

থানার উঁচু বারান্দা থেকে একজন অফিসার হন্তদন্ত নেমে এলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন–ডি আই জি সায়েবের মেসেজ পেয়েছি বেলা দুটোয়। ফরেস্টবাংলোয় গিয়ে শুনি, আপনি বেরিয়েছেন। এদিকে এক মস্তানকে নিয়ে আজ হাঙ্গামা। ফরেস্টবাংলোয় গিয়েছিল হামলা করতেজাস্ট আমি চলে আসার পর। ওখানে আর্মড কনস্টেবল অলরেডি ছিল। তবু খবর পেয়ে আবার অফিসার আর ফোর্স পাঠালাম। আর বলবেন না কর্নেলসায়েব। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে!

কথা বলতে বলতে আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন উনি। কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন।–অফিসার-ইন-চার্জ রমেন পালিত। জয়ন্তর কথা কি তোমাকে বলেছিলাম কখনও? বলেছিলাম নিশ্চয়। ভুলে গেছ। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক। যাই হোক, তুমি যে এখনও বদলি হওনি, এটাই আশ্চর্য! মিনিস্টারের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলেছ নাকি? কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।

–আপনার আশীর্বাদ! এক মিনিট। আপনি তো কফির ভক্ত। বাসা থেকে আনাচ্ছি।

কফির হুকুম দিয়ে রমেনবাবু একটা খাম বের করলেন।রেডিও মেসেজ। আপনার জন্য। এটা নিয়েই গিয়েছিলাম বাংলোয়।

সেই ছোটবাবুর কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিল। বললাম না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশকে কিছু বলতে নেই। কর্নেলেরই পরামর্শ এটা।…

.