পিছনে পায়ের শব্দ – ১১

১১.

সাত্যকি ঘরে ঢুকে বলল, হাই ফাদার ক্রিসমাস! গ্র্যান্ডপা এসে গেছেন। পামকিন ফেস। সুবিধে করতে পারেননি মনে হচ্ছে। বলে সে পিউয়ের দিকে তাকাল। তোমাকেও পামকিন দেখাচ্ছে। হোয়াটস রং? চলে এস। হাসতে হাসতে মারা পড়বে। সিওর।

পিউ দুই কাঁধ নেড়ে একটা ভঙ্গি করল। কর্নেল বললেন, যাও পিউ। সাত্যকি নিশ্চয় টিভির কথা বলছে। টিভি জিনিসটা অনেক দুঃখে মানুষ মাথা খাটিয়ে বের করেছে। নিরানন্দ পৃথিবীতে হাসির একটি বোমা। জাস্ট ক্র্যাক দা নব অ্যান্ড লাফ! হা হা হো হো হি হি–এনতার হাসো। রামগরুড়ের ছানাদের জন্য ব্রহ্মাস্ত্র ডার্লিং!

সাত্যকি হাসল। ওর জামাইবাবুর জন্য স্টার্ভ টু ডেথ ব্যাপার। সত্যি বলছি। প্রিয়দা শুনলে খুশি হবে। এমন শ্যালিকা দেখা যায় না।

পিউ ফুঁসে উঠল, জোক করবে না বুড়োদা!

সরি! বলতে ভুলে গেছি। পিয়ালি তোমাকে ডাকতে বলল।

সে নিজে আসতে পারল না?

সাত্যকি চাপাস্বরে বলল, ফাদার ক্রিসমাসের ঘরে আউটসাইডারদের ঢোকা বারণ। দিদির অর্ডার। চলে এস। আরে! সত্যি পিয়ালি তোমাকে ডাকছে।

পিউ উঠে দাঁড়াল এবং চুপচাপ বেরিয়ে গেল। সাত্যকি বলল, কর্নেল! আমার সাইকেলটা নিয়ে প্রব্লেমে পড়েছি।

কী প্রব্লেম?

সাত্যকি হাসল। প্রিয়দার গিফট। ওর কোম্পানির তৈরি। নাকের ডগা কুঁচকে সে ফের বলল, এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেল নাকি। বোগাস। সাইকেল চাপা পছন্দ করি না। কিন্তু প্রিয়দা রাগ করত না নিলে। ওরে বাবা! যখনই চাপি, কী সব ভুতুড়ে সাউন্ড হয়। প্রথম প্রথম পাত্তা দিতুম না। এখন মনে হচ্ছে। সামথিং রং!

কাল সকালে তোমার সাইকেলটা একবার দেবে তো। চেপে দেখব।

মাই গুডনেস! সাত্যকি চোখ বড় করে বলল। আপনি চাপলে তো ওটা মড় মড় করে ভেঙে যাবে। সিওর।

কর্নেল হাসলেন। সিওর নয় ডার্লিং! যাই হোক, তোমার ঠাকুর্দা আসার আগে সুশীলাকে বলো আরেক রাউন্ড কফি দিতে।

এটা সিওর। বলে সাত্যকি চলে গেল। ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছিল। সব সময় জগিং ওর।

একটু পরে অরীন্দ্র এলেন। সঙ্গে সুশীলা। অরীন্দ্র বললেন, কোনও অসুবিধে হয়নি তো!

কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, সুশীলা! আজ হম কোঠিবাড়িকি জঙ্গলমে কিচনিকি আওয়াজ শুনা।

সুশীলা চমকে উঠে বলল, হায় রাম! তব কুছু তো খতরনাক হবে। কোই আদমির জানভি যাবে কর্নিলসাব। যব কিচনি চিল্লাতি, তব জরুর কিসিকা খুন গিরেগা।

অরীন্দ্র রুষ্ট মুখে বললেন, নাও! ওর রামকদুনি শুরু হল। এবার সারা বাড়ি হুলুস্থুল বাধিয়ে বেড়াবে। যাও, রাণু একলা আছে।

সুশীলা কাঁচুমাচু মুখে চলে গেল। কর্নেল বললেন, ওকে বকলেন বটে। তবে মনে হচ্ছে, আপনিও ভয় পেয়ে গেছেন বোসসায়েব!

অরীন্দ্রর হাতে প্রকাণ্ড কাপে কফি। চুমুক দিয়ে বললেন, ভয় নয় রাগ। প্রিয়র জামিন দিল না সেসনকোর্ট। আপনাকে বলেছিলুম বডিতে স্ট্যাব করার চিহ্ন ছিল। ওটা মেছো কুমির বা বোয়াল জাতীয় মাছের কামড়। জলের ভেতর পাথর পড়ে আছে। তারও চোট লেগেছে। মর্গের রিপোর্টের কপি পাওয়া গেছে। বুকের ভেতর একটা হাড়ের খাঁজে গুলি আটকে ছিল।

গুলি! কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। রিভলভার না পিস্তলের?

তা লেখা নেই। অ্যাডভোকেটের কাছে কপি আছে। দেখলুম লেখা আছে, শট ডেড বাই ফায়ার আর্মস। হার্টে গুলি ঢুকেছিল। ইনস্ট্যান্ট ডেথ। অরীন্দ্র মাথা নাড়লেন। শিবের সাধ্য নয়, বাঁদরটাকে বাঁচায়। কেন বলছি, তা-ও শুনুন। এফ আই আর দু’বার লিখেছে পুলিশ। দ্বিতীয়টা আরও তদন্তের পর লিখেছে। প্রিয়র গাড়ির ভেতর নাকি পিস্তল না রিভলভার পাওয়া গেছে। এখন কেসটা নিয়েছে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। মিশাইল এক্সপার্টরা গুলিটা নিয়ে গেছে পাটনায়। যদি একই পিস্তল বা রিভলভারের গুলি হয়, প্রিয় গেল।

কর্নেল সুশীলার রেখে যাওয়া কফির পেয়ালা তুলে বললেন, প্রিয়র বউয়ের সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। পিউকে ডাকতে পাঠিয়েছিলুম। ফিরে এসে বলল, মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে।

অরীন্দ্র চাপাস্বরে বললেন, মেয়েটা ভাল নয়। রাণু আসা অব্দি বলছে। আমিও স্টাডি করেছি। প্রিয় ভুল করেছে। তবে পিউ খুব ভাল মেয়ে। সরল এবং ইনোসেন্ট। বলে নড়ে বসলেন অরীন্দ্র। আরেকটা সাংঘাতিক কথা আপনাকে বলাই হয়নি। অনির্বাণ সোম বিবি আর প্রিয় দুজনকেই শাসিয়ে একটা চিঠি লিখেছিল এখানে আসার আগে। আমিনগঞ্জে প্রিয়কে অ্যারেস্ট করার পর ওর পকেটে নাকি সেটা পাওয়া গেছে। কাজেই পুলিশের দিক থেকে মার্ডারের মোটিভ ইজ এসটাব্লিশড়। প্রিয়কে আর আমি বাঁচাতে পারব না। তবে আই অ্যাম আ ম্যান অফ স্ট্রং প্রিন্সিপল, আপনি জানেন। প্রাইমা ফেসি কেসে দেখা যাচ্ছে, প্রিয় মার্ডারার। যদি সত্যিই তা-ই হয়, তার ফাঁসি হোক। কিন্তু রোজি জেভিয়ার এবং কেয়া সেনের মৃত্যুর ঘটনা কি মিসটিরিয়াস নয়?

কর্নেল একটু হাসলেন। মর্গের রিপোর্টে নিশ্চয় কোনও সন্দেহজনক কিছু ছিল না। কাজেই আপনার সন্দেহ অমূলক হতেই পারে। সবই হয়তো কোইনসিডেন্স বোসসায়েব!

আমি বিশ্বাস করি না।

কেন?

কেউ রোজি এবং কেয়াকে কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেও তো পারে। সেটা মার্ডার হলেও মর্গের রিপোর্টে সন্দেহজনক কিছু থাকার কথা নয়। বলুন, ঠিক বলছি কি না?

হুঁ, তা অবশ্য ঠিক। দহের জলে প্রচুর পাথর পড়ে আছে।

অরীন্দ্র শক্ত মুখে বললেন, তা ছাড়া প্রিয় আমাকে বলেছে, অনির্বাণ সোমের মাইনে জোগাত ওদের কোম্পানি। এখানেই স্টার্টিং পয়েন্ট, কর্নেল! আমার ধারণা, অনির্বাণ ব্ল্যাকমেইল করত প্রিয়র কোম্পানিকে। ওই ফিল্মডাইরেক্টার ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনি ভাব জমান। আপনি তো ভাব জমাতে ওস্তাদ। আপনি ওই ভদ্রলোককে বাজিয়ে দেখুন। এমন তো হতেই পারে, উনি আনুকে এখানে মার্ডার্ড হওয়ার সুযোগ দিতেই সঙ্গে এনেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন। বডিগার্ড বলুন বা যা-ই বলুন, কাছের মানুষ। সে বেঘোরে মারা পড়ল, আর ভদ্রলোক দিব্যি নির্বিকার হয়ে শ্যুটিঙে মেতে উঠলেন?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, বরুণ দত্তও তা-ই বলছিল।

কে সে?

প্রিয়র কোম্পানির এক অফিসার। শুনলুম সে প্রিয়র স্ত্রীর সঙ্গে আজ বিকেলে দেখা করতে এসেছিল।

অরীন্দ্র শ্বাস ছেড়ে বললেন, আই সি! রাণু বলল কে একজন এসেছিল প্রিয়র কোম্পানি থেকে। আমি এ বাড়িতে আর আউটসাইডার অ্যালাউ করব না।

বোসসায়েব! বরুণ আমাদের সহযোগী। প্রিয় তাকে বলে রেখেছিল আমার। সাহায্য নেওয়ার কথা। প্রিয় আঁচ করেছিল সে কোনও বিপদে পড়বে। আপনি কলকাতা যাবার আগে বরুণের কাছেই আমি অনির্বাণকে খুনের দায়ে প্রিয়কে গ্রেফতারের কথা শুনেছিলুম।

অরীন্দ্র তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে বললেন, সমস্যা হল, আপনি সব কথা একসঙ্গে বলেন না। অর্ধেক আপনার পেটে থেকে যায়। নাকি ও একরকম খেলা?

বয়স বোসসায়েব, বয়স! আপনারও কি একই ব্যাপার হয় না? বয়স স্মৃতিকে গুলিয়ে দেয়।

অরীন্দ্র হাসবার চেষ্টা করলেন। আমার চেয়ে আপনার বয়স কম।

দু-তিন বছরের তফাত এ বয়সে তফাতই নয়। কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। আসলে আপনার মন একমুখী। আমার বহুমুখী। আমি জ্যাক অব অল ট্রেডস। তাই সমস্যা। প্রকৃতিরহস্য থেকে অপরাধ রহস্যে ছোটাছুটি..অবশ্য দুটোর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। আমরা, মানুষেরা যা ক্রাইম মনে করি, প্রকৃতিতে তা স্বাভাবিক ঘটনা। এই যা পার্থক্য।

অরীন্দ্র কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, আজ সারাটা দিন যা গেছে আপনার ফিলসফি শোনার মুড নেই। চলুন, প্রিয়র বউকে বাজিয়ে দেখবেন। আমার তর সইছে না। খালি মনে হচ্ছে, কোনও ভাইটাল ব্লু বিবির কাছেই আছে। হয় সে জেনে গোপন করে আছে, নয় তো বুঝতে পারছে না সেটা কী? উঠুন!

কর্নেল অগত্যা উঠলেন। একটু হেসে বললেন, অনেকে এমন থাকে। সে জানে না যে, সে কী জানে।

অরীন্দ্র সায় দিয়ে বললেন, ঠিক তা-ই। তবে আগে বলে রাখি, প্রিয়র বউ খুব কম কথা বলে। আর ওই মাথা ধরার ছল। রোজই যখন-তখন মাথা ধরে। চালাকি বুঝি না?

ওপরতলায় উঠতে অন্দরমহলের ভেতর একটা আলাদা সিঁড়ি আছে। সেটা হলঘরেরটার মতো কাঠের নয়, কংক্রিটের এবং নতুন। সংকীর্ণ করিডরের দুধারে ঘর। সাত্যকির ঘরে টিভির আওয়াজ এবং সাত্যকির চড়া গলায় কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। কর্নেল অন্তত বার তিনেক “সিওর’ শুনলেন। অরীন্দ্র যেতে যেতে হল্লাটা শুনে বিরক্ত হয়ে চাপাস্বরে বললেন, পালোয়ান! পৃথিবী ডুবলেও ওর হাঁটু জল। এদিকে বুদ্ধির ঘরে ঢুটু। যতীন ওকে মিশনারি স্কুল কলেজে পড়িয়ে সায়েব বানাতে চেয়েছিল। সায়েব হয়েছে বটে, তবে ছাতুখোর সায়েব।

কর্নেল বললেন, খুব ছাতু খায় নাকি? ছাতু এই এরিয়ার লোকেরা খুব খায় দেখেছি।

ডিমের ছাতু। অরীন্দ্র তুম্বো মুখে বললেন, রোজ সকালে চারটে করে কঁচা ডিম খায়। আর বালির বস্তায় ঘুসি। কিন্তু আজ অব্দি তো দেখলুম না কোথাও ঘুসি লড়ে একটা অন্তত ট্রফি আনল। ইনভিজিবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। ভাবতে পারেন? আমার ধারণা, এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। বিজয়েন্দু ওর মাথাটা খেয়ে গেছে।

অরীন্দ্র সাবর্ণীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, বিবি! আমরা তোমার সাক্ষাৎপ্রার্থী। তার চোখে ধূর্ত হাসির ঝিলিক। কর্নেলের দিকে তাকালেন। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি। ফের বললেন, সঙ্গে গেস্ট আছেন বিবি!

ভেতর থেকে সাড়া এল, আসুন দাদামশাই!

অরীন্দ্র প্রথমে, তারপরে কর্নেল ঢুকলেন, সাবর্ণী খাটে সদ্য উঠে বসেছে। চুল গোছাতে গোছাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বসুন। আমার আবার মাথা ধরেছে। তাই চুপচাপ শুয়ে ছিলুম।

আলাপ করিয়ে দিই। ইনিই আমার সেই প্রখ্যাত বন্ধু–যাঁর কথা তোমাকে বহুবার বলেছি। স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সাবর্ণী নমস্কার করল। কর্নেল একটা চেয়ারে বসে সহাস্যে বললেন, বোসসায়েবের নাতবউকে আমি কিন্তু তুমিই বলব। আর একটা কথা। জান তো, তুমি আমারই ঘরটা দখল করে আছ?

সাবর্ণী আস্তে বলল, একটু আগে রাণুদি আমাকে আপনার আসার কথা বলেছেন। আপনি এসে এ ঘরেই থাকতেন, তা-ও বলেছেন। আপনি আপনার ঘর দখল করতে পারেন। এ ঘরটা আমার পছন্দ নয়।

অরীন্দ্র ভুরু কুঁচকে কপট হেসে বললেন, পছন্দ নয়? বাড়ির এটা সব চাইতে ভাল ঘর। দক্ষিণ এবং পশ্চিম খোলা। শীতের দিনে টু-থার্ড সময় ধরে রোদ্দুর। তুমি তো ভারি অকৃতজ্ঞ মেয়ে!

কর্নেল বললেন, যার মাথা ধরেছে, তাকে বকাবকি করতে নেই বোসসায়েব। তাতে মাথাব্যথা আরও বেড়ে যায়। তবে শ্রীমতী বিবির এ ঘর পছন্দ না। হওয়ার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি।

অরীন্দ্র কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন, কী কারণ?

 এই ঘর থেকে কিচনির গর্জন শোনা যায় রাতবিরেতে।

শুনেছ নাকি বিবি?

 সাবর্ণী বলল না। আমি ওসব বিশ্বাস করি না। গেঁয়ো সুপারস্টিশন।

কর্নেল মুখে গাম্ভীর্য এনে বললেন, কিচনিটা যদি তোমাকে রাতবিরেতে আক্রমণ করতে আসে, তোমার ভয়ের কারণ নেই। তোমার কাছে প্রিয়র একটা ফায়ার আর্মস আছে গুলি ছুঁড়বে।

অরীন্দ্র নড়ে উঠলেন। সাবর্ণী চমকে উঠে তাকাল। তার নাসারন্ধ্র স্ফীত। দম আটকানো ভাব মুখে। তারপর অরীন্দ্র চার্জ করলেন, প্রিয়র ফায়ার আর্মস আছে তোমার কাছে? তুমি আমাকে বলেনি!

সাবর্ণী চুপ করে রইল। মুখটা নিচু। কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিবি, অস্ত্রটা আমি একবার দেখতে চাই। উঁহু, তোমার অত অবাক হওয়ার কারণ নেই। আমি অন্তর্যামী নই। আমার নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট পিউ এই খবর পাচার করেছে।

অরীন্দ্র ব্যস্তভাবে বললেন, পিউ? কী আশ্চর্য কথা! কই, বের করে দেখি। কিন্তু কর্নেল, তা হলে প্রিয়র গাড়ির ভেতর যে অস্ত্রটা পাওয়া গেছে, সেটা কার? সব যে আরও জট পাকিয়ে গেল।

সাবর্ণী খাটের গদির তলা থেকে কাগজের মোড়কে জড়ানো অস্ত্রটা বের করে কর্নেলকে দিল। কর্নেল খুলে দেখে বললেন, পয়েন্ট টোয়েন্টি টু রিভলভার দেখছি। এটার লাইসেন্স থাকা সম্ভব নয়। কারণ এটা চীনা। বোঝা যাচ্ছে, প্রিয় আত্মরক্ষার জন্য এটা জোগাড় করেছিল। একটু অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু একটা বুলেট ফায়ার করা হয়েছে। আশ্চর্য তো! প্রিয় তোমাকে কি বলেছিল সে কাকেও গুলি করেছে?

সাবর্ণী শক্ত মুখে আস্তে বলল, সে রাতে ও আবার বেরিয়ে গিয়েছিল। টর্চ ফেলে এসেছে নাকি। কিন্তু ফিরে এসে বলল, টর্চটা পায়নি। তবে সে টর্চের জন্যই যায়নি, গিয়েছিল এইটে আনতে।

অরীন্দ্র রুষ্ট হয়ে বললেন, কাকে গুলি ছুঁড়েছিল হতভাগা বলেনি সে কথা?

 সাবর্ণী একটু পরে বলল, স্কাউলেটাকে গুলি করে মেরেছে বলেছিল।

অরীন্দ্র আরও খাপ্পা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তোমাদের দু বোনের পেটে পেটে এত কথা। আমাকে কিছু বলেনি। এদিকে আমি খামোকা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি। মরুক হতচ্ছাড়া। কর্নেল! ছেড়ে দিন। লেট হিম গো টু দা হেল। বলে তিনি জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। জুতোর শব্দটা বেশ জোরালো।

কর্নেল বললেন, প্রিয় তোমাকে বলেছিল গুলি ছুঁড়েছে?

সাবর্ণী বলল, হুঁ। বেশ করেছে, মেরেছে। আনুদা একটা জানোয়ার।

 কিন্তু ডেডবডি গঙ্গার দহে কীভাবে পড়ল? প্রিয় ফেলে দিয়ে এসেছিল?

প্রিয় বলেছিল, গুলি করেই পালিয়ে এসেছে।

 তা হলে ডেডবডি সে গঙ্গায় ফেলতে যায়নি?

 নাহ। সাবর্ণ নির্বিকার মুখে বলল। আমার স্বামীকে আমি জানি। বাই চান্স, হয়তো কেঁকের বশে বা আত্মরক্ষার জন্য সে গুলি ছুঁড়তে পারে। কিন্তু তার নার্ভ অত শক্ত নয় যে বডি গঙ্গায় ফেলতে যাবে। তা ছাড়া আনুদার বডি বয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা ওর নেই।

প্রিয়র পোশাকে রক্তের ছাপ দেখেছিলে?

 নাহ্।

প্রিয় কেন গুলি করেছিল বলেনি তোমাকে?

সাবর্ণী একটু পরে শান্তভাবে বলল, প্রিয় গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে দেখেছিল কে টর্চ জ্বেলে তার গাড়ি দেখছে। গাড়ির কাচ ভাঙা। ঝোপের আড়ালে গিয়ে সে আনুদাকে চিনতে পেরেছিল। আনুদা তার গাড়ির কাচ ভেঙেছে ভেবে রাগ হয়েছিল। কিন্তু সাহস করে সামনে যেতে পারেনি। তারপর আনুদা গাড়ির কাছ থেকে চলে যাচ্ছে, তখন প্রিয় চুপিচুপি গিয়ে ফায়ার আর্মসটা বের করে। কিন্তু আনুদা টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। টর্চের আলো ফেলে। ভয় পেয়ে প্রিয় গুলি করে। তবে ওকে মেরে ফেলতে চায়নি। ভয় পাইয়ে দিতেই গুলি ছুঁড়েছিল। কিন্তু গুলি আনুদার গায়ে লাগে। পড়ে যায়। প্রিয় তখুনি পালিয়ে আসে।

কর্নেল রিভলভারটা কাগজে মুড়ে বললেন, টর্চটা কোথায় গেল তা হলে? সাত্যকি আর পিউ কোনও টর্চ পড়ে থাকতে দেখেনি ওখানে।

সার্বণী বলল, ভোরে গাড়ি গ্যারেজে পাঠাতে প্রিয় ভগীরথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। টর্চটা কুড়িয়ে পায় কিন্তু ভগীরথ কোনও রক্তের ছোপও দেখেনি। দেখলে বলত। পিউ আর সাত্যকি শুধু রক্তের ছোপ দেখেছিল।

তুমি জেল হাজতে প্রিয়র সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?

সাবর্ণী মাথা নাড়ল। তারপর বলল, দাদামশাই যেতে দিচ্ছেন না। বলছেন, স্ক্যান্ডাল বাড়বে।

তোমার দেখা করতে ইচ্ছে হয় না?

 হয়। আসলে ও আমাকে সতর্ক থাকতে বলে। ওকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। সেজন্য ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দাদামশাই সেকেলে মানুষ। কিছুতেই যেতে দেবেন না। বলছেন, স্ক্যান্ডাল রটবে। বুঝি না। আপনি ওঁকে বলুন না প্লিজ।

বলব। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এটা তোমার কাছে থাকা ঠিক নয়। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট তদন্তে নেমেছে শুনলুম। এটা আমি রাখছি। গভর্মেন্টকে সাহায্য করি বলে আমার কিছু অফিসিয়্যাল ইমিউনিটির ব্যবস্থা আছে।

রাখুন। আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল ওটা নিয়ে। ভাবছিলুম কোথাও ফেলে দিয়ে আসব।

নাহ্। তাতে রিস্ক ছিল। আচ্ছা, চলি। আবার দেখা হবে।

শুনুন।

কর্নেল ঘুরে দাঁড়ালেন।

বরুণ দত্তকে তো আপনি চেনেন। আজ সে এসেছিল। আপনি আসবেন বলছিল। তাড়া ছিল বলে চলে গেল। বরুণকে আমি কিছু বলিনি। কিন্তু ও নিজে থেকেই বলল, প্রিয় নাকি তাকে বলেছিল, তার এবার কোনও বিপদ হতে পারে। তাই আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে এসেছিল। সত্যি কি?

সত্যি।

সাবর্ণী শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আনুদা একটা স্কাউন্ড্রেল। তাকে প্রিয় মেরেছে। আমি খুশি। কিন্তু প্রিয়র বিপদ হওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আনুদার দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা ছিল, সেটা ঠিক। কিন্তু বরুণ বলল, প্রিয় নাকি ওর কোম্পানির দিক থেকে বিপদের ভয় করেছিল। তবে…সে থেমে গেল হঠাৎ।

হুঁ, বলো।

সাবর্ণী চাপাস্বরে বলল, আপনাকে বলা দরকার। আমার বরাবর সন্দেহ, কোম্পানিকে প্রিয় ব্ল্যাকমেল করত। সম্ভবত কোনও গোপন ইনফরমেশান তার। হাতে ছিল। বরুণও তাই বলল। সেজন্যই নাকি কোম্পানি ওকে ডিফেন্ড করছে না। প্রিয় জেলে আটক থাকলে নাকি কোম্পানি নিরাপদ। বরুণই বলল। দায়ে না ঠেকলে প্রিয় তো সব কথা খুলে বলে না আমাকে।

বরুণ বলল, প্রিয় জেলে আটক থাকলে কোম্পানি নিরাপদ?

সাবর্ণী মাথা নাড়ল। একটু পরে বলল সে, বরুণ কিছু টের পেয়ে থাকবে। আপনি তার সঙ্গে দেখা করুন। ও বলছিল আপনার কথা। কিন্তু তার আগে আপনি খুঁজে বের করুন কে আনুদার বডি গঙ্গায় ফেলল। কেনই বা ফেলল?..

.