দু’নম্বর চাবি – ৭

০৭.

কর্নেল টিলার মাথায় অশ্বত্থাগাছে সেক্রেটারি বার্ড বা কেরানি পাখিটাকে দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয়েছিলেন। বাংলোর উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে নেমে একটু দূরে ওয়াটার ড্যাম চোখে পড়ল। ঢালে জঙ্গল থাকায় তখন চোখে পড়েনি। কর্নেল বললেন, থাক্। এ বেলা আর ওদিকে নয়। ফেরা যাক।

হাঁটতে হাঁটতে বললুম, শিউপুজন লোকটিকে সরল আর ভিতু মনে হল।

কর্নেল বললেন, তুমি ওকে চেনেন না। ও সরলও নয়, ভিতুও নয়। মাসে এ বাজারে পাঁচশো টাকা মাইনেতে সংসার চালানো কঠিন। তাই রোজগারের নানা ফিকিরে থাকে। বখশিসের লোভে আমাকে যা বলল, অন্য লোককেও তা-ই বলতে ওর দ্বিধা হবে না। তাছাড়া শিউপুজন গোপনে বাংলো ভাড়া দেয়–শনিবার ও রবিবার এই দু’দিন বাদে। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। একটা লোক এই জনহীন বাংলোয় একা রাত কাটায়। কাজেই সে সাহসী। টমসায়েবের কবর আছে। বাংলোর লনের কোণে। ব্যাপারটা এবার চিন্তা করো! ভূতের ভয়ও তার নেই।

তা হলে টাকা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করাও যায়?

নিশ্চয় যায়। তবে ওসব কথা আপাতত থাক। কফির জন্য মন ছটফট করছে।

কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।

 রাজবাড়ির গেটের বাইরে কালীপদ একা দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল বললেন, কী কালীপদ? এখানে কী করছ?

কালীপদ চাপাস্বরে বলল, আজ আবার সেই উড়ো চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছি। আপনারা চলে গেলেন। তারপর আমি ফুলবাগানে কাজ করে জল-টল দিয়ে বাজার করতে বেরুচ্ছি, দেখি চিঠিটা পড়ে আছে।

রানীমাকে দিয়েছ তো?

আজ্ঞে। বলে সে ভেতরে ঢুকল। রানীমা বলছিলেন, কর্নেলসায়েবকে এ বাড়িতে দেখেও কার এত সাহস যে এখনও উড়ো চিঠিতে হুমকি দিচ্ছে?

কর্নেল হাসলেন। উড়ো চিঠি দেওয়া তো আমি আটকাতে পারব না। তুমি শিগগির কফির ব্যবস্থা করো কালীপদ! আর ভটচাযমশাই কেমন আছেন?

খুব কাহিল অবস্থা। পুজো করতে পারেননি। খাঁটিয়ায় মড়ার মত শুয়ে আছেন।

আমাদের ঘরে তালা দেওয়া ছিল না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলুম, সব জানালা খোলা আছে। উত্তরের জানালা দিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা আসছিল। তাই উত্তরের দুটো জানালা বন্ধ করে দিলুম। তারপরই চোখে পড়ল, কর্নেলের বিছানার পাশের টেবিলে এক টুকরো ছোট্ট পাথরের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা কাগজ পড়ে আছে। বললুম, কর্নেল! এটা কী?

কর্নেল হাসলেন। আবার কী? আমাকেও উড়ো চিঠিতে হুমকি দিয়েছে। দেখি!

পাথরে বাঁধা চিরকুটটা খুলে উনি পড়লেন। তারপর আমাকে দিলেন। দেখি, একই লাল ডটপেনে লেখা চিঠি :

‘পত্রপাঠ চলে যাও। নতুবা নরবলি হবে। দেবীর রক্ততৃষ্ণা জেগেছে। বাঁচতে চাও তো শীঘ্র পালিয়ে যাও।‘

 কর্নেল চিঠিটা নিয়ে রানীমাকে লেখা আগের তিনটে চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বললেন, একই হাতের লেখা। মনে হচ্ছে, একটু ভয় পেয়েছে। তাই দেবীর। নাম করে হুমকি দিয়েছে।

উনি চিঠিগুলো কিটব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন। বললুম, উত্তরের জানালা তো বন্ধ ছিল। কে খুলল?

কর্নেল বললেন, বিছানা পরিপাটি গুছোনো আছে দেখতে পাচ্ছ না? কালীপদ বা তার বউ হয়তো জানালা খুলে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে কালীপদ কফির ট্রে নিয়ে এল। তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ওই জানালা কি তুমি খুলে দিয়েছিলে?

কালীপদ বলল, আজ্ঞে না। বউ আপনাদের ঘর পরিষ্কার করছিল। সে-ই খুলেছে। কেন স্যার?

বললুম, বড্ড ঠাণ্ডা আসছিল।

আজ্ঞে, রানীমার এই হুকুম আছে। সে শীত হোক কি বর্ষা হোক। ঘরের বাতাস বের করে না দিলে নাকি অসুখ হবে। আপনারা গিয়ে দেখে আসুন। রানীমা উত্তরের জানালা খুলে বসে আছেন। কালীপদ একটু হাসল। উনি মোটাসোটা মানুষ তো! শীতে ওঁর আরাম। গরমে শুধু হাঁসফাঁস করে বেড়ান। দু’বেলা চান করেন। এই শীতে ভোরবেলা চান করে মন্দিরে যান। ভাবুন!

কালীপদ চলে গেল। কর্নেলের কফি পান দেখে মনে হল, সত্যি ওঁর কফির জন্য মন ছটফট করছিল। কফি শেষ করে উনি বললেন, তুমি বসো জয়ন্ত! আমি একবার ভটচাযমশাইকে দেখে আসি। বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভাববেন, একবারও ওঁকে দেখে এলুম না। কার রাত্রেও একবার গিয়ে খবর নেওয়া উচিত ছিল।

কর্নেল চলে গেলেন। আমি ধীরেসুস্থে কফি খাচ্ছিলুম। সেই সঙ্গে বিস্কুট, পটাটোচিপস আর চানাচুর সাবাড় করছিলুম। আমার খিদে পেয়েছিল খুব।

খাওয়ার পর নীচের লনে গিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে রইলুম। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, কর্নেল মন্দিরের চত্বর থেকে বেরিয়ে ফুলবাগানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ফোয়ারা এবং ইঁদারার পাশে পাম্প-ঘরের আড়ালে তিনি অদৃশ্য হলেন। কালীপদ হাসিমুখে ডাইনিং রুমের বারান্দা থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। তারপর সে-ও ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল।

তারপর প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গেল। বুঝলুম, কর্নেল এবং কালীপদ ক্যাকটাস নিয়ে আলাপ করছেন। জবা বারান্দা থেকে বলল, রানীমা খেতে বলছেন সায়েবদের। ন’টা বেজে গেছে।

রানীমাকেও দেখলুম মোটা ছড়ি হাতে বারান্দার একটা থামের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ডাকলেন, কালী। কথা শুনতে পাচ্ছিস না?

কর্নেলকে এতক্ষণে দেখতে পেলুম। পেছনে কালীপদ। কর্নেল কালীপদকে কিছু বললেন। সে লন হয়ে আমার কাছে চলে এল। বলল, ব্রেকফাস্ট করে আসুন স্যার। আমি দরজা বন্ধ করে এখানে থাকছি।

ডাইনিং রুমে খেতে বসে কর্নেল বললেন, ভটচাযমশাইয়ের শেষ রাত্রে জ্বর এসেছিল। ছেড়ে গেছে। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বরং ওঁর কবরেজমশাইকে ডেকে আনা উচিত ছিল।

 রানীমা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। মুখটা আজ খুবই গম্ভীর। তিনি বললেন, কালী বাজারে গিয়ে ভবেশ কবরেজকে খবর দিয়ে এসেছে। এতক্ষণে তার আসা উচিত ছিল। ভবেশের এত গরজ কেন বুঝি না। ওদিকে অরবিন্দকে খবর দেওয়া হল। এখনও তার পাত্তা নেই। আগে খবর পেলেই চলে আসত। গাড়ি আছে। ড্রাইভার আছে। বর্ধমান থেকে আসতে কতক্ষণই পা লাগে?

কর্নেল বললেন, মিসেস সিংহ বড় বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি এবার ঠিক পথে বা বাড়িয়েছি।

রানীমা ঘরে ঢুকে বললেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না কর্নেলসায়েব! আমার রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। আপনি পাশে আছেন। এখন আমার আর কোনও চিন্তা নেই। চিন্তা শুধু নিজের রং ডিসিশন নিয়ে। বাচ্চুকে এ বাড়ি ঢোকাব, না এসব ঝামেলা হবে। তার বাবা-মায়ের কাছে আমি চিরকালের জন্য অপরাধী থেকে গেলুম।

রানীমার চোখে জল এসেছিল। চোখ মুছে বেরিয়ে গেলেন।

যাওয়ার পর কর্নেল ও আমি নিজেদের ঘরে ফিরে এলুম। কালীপদ একটু হেসে বলল, কুমড়োপটাশটা দেখলেন তো! কী পেল্লায় হয়ে গেছে। ওটার টব বদলাতে হবে।

কর্নেল বললেন, রানীমা বলছিলেন ভবেশ কবরেজমশাই এখনও কেন আসছেন না!

দশটার আগে আসতে পারবেন না। খুব নামকরা কবরেজ। দূর-দূরান্ত থেকে বিলিতি পাস ডাক্তারদের কাছে সর্বস্বান্ত হয়ে কত রোগী ওঁর কাছে এসে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকছে। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আচ্ছা কালীপদ, বিজয়গড়ে তো বেশ কিছু খ্রিস্টান আছে?

কালীপদ বলল, তা আছে। ওরা আলাদা পাড়ায় থাকে। ক’ঘর অ্যাংলো সায়েব মেমও আছে। আদিবাসী খ্রিস্টানের সংখ্যাই বেশি।

তুমি যোশেফ নামে কাকেও চেনো?

আজ্ঞে খুব চিনি। কালীপদ একটু হাসল। বাচ্চুবাবুর সঙ্গে তার ভাব ছিল। মাঝে মাঝে বাচ্চুবাবুর সঙ্গে রাজবাড়িতে আসত। একের নম্বর ফাটকাবাজ। বউয়ের রোজগার খায়। বউ হল গে মিশন ইস্কুলের মাস্টারনী। বাচ্চুবাবু নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করেছিল। কিন্তু যোশেফের পেছনে নারায়ণবাবুর পার্টি আছে। নারাণবাবু ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন। তবু হাল ছাড়েননি।

এই সময় গেটের দিকে কেউ ডাকল, কালী! ও কালীপদ!

কালীপদ দেখে বলল, কবরেজমশাই এসেছেন।

 শোনো। আমরা একটু বেরচ্ছি। তুমি দরজায় তালা এঁটে দিয়ো। কেমন?

 আজ্ঞে। বলে কালীপদ দৌড়ে গিয়ে গেট খুলতে গেল।

দেখলুম, রোগাটে চেহারার এক ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। কেরিয়ারে একটা মোটাসোটা ব্যাগ। কালীপদ তাকে বলল, সোজা ঠাকুরমশাইয়ের ঘরে চলে যান কবরেজমশাই।…

একটু পরে আমরা বেরলুম। ধ্বংসস্তূপের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে মোরাম রাস্তায়, তারপর বড় রাস্তায় গেলুম। একটা খালি সাইকেল রিকশা দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন, খ্রিস্টানপাড়া যাব।

বাঙালি রিকশাওয়ালা বলল, দশ টাকা লাগবে স্যার!

ঠিক আছে। তুমি যোশেফ নামে কাকেও চেনো?

 রিকশাওয়ালা হাসল। তাকে বিজয়গড়ে কে চেনে না স্যার? মার্কামারা লোক।

বিজয়গড়ের বাজার পেরিয়ে রিকশা ডানদিকে ঘুরে অলিগলি রাস্তায় চলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে একটা গির্জা বাড়ি দেখতে পেলুম। খ্রিস্টানপাড়া বেশ সাজানো-গোছানো মনে হল। একটা করে ছিমছাম বাড়ি আর সামনে ফুলবাগান। একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াল। একতলা বাড়িটার গেটে নেমপ্লেট আছে। ‘জে ডি’সুজা’। তার তলায় ‘এম ডি’সুজা’। কর্নেল বললেন, পর্তুগিজ বংশধর মনে হচ্ছে।

গেটে কলিং বেলের স্যুইচ টিপলেন। একটু পরে একজন ফ্ৰকপরা আদিবাসী কিশোরী বারান্দায় বেরিয়ে বলল, সাবলোক বাহার গেয়া।

কর্নেল বললেন, মেমসাবকো বোলাও।

কর্নেলের চেহারা দেখে সে সম্ভবত খ্রিস্টান এবং পাদ্রিসায়েব ভেবেছিল।

কারণ কথাটা শুনে সে বুকে ক্রশ এঁকে মাথা একটু ঝাঁকিয়ে বলল, কঁহাসে আয়া আপলোগ?

দুমকা মিশনসে।

তামাটে রঙের একজন মেমসায়েব পর্দা তুলে দরজায় উঁকি দিচ্ছিল। তার পরনে সোয়েটার এবং স্কার্ট। হাঁটু থেকে মোজা পরা। কর্নেল বললেন, মর্নিং মিসেস ডিসুজা! আই হ্যাভ কাম টু মিট ইয়োর হাজব্যান্ড মিঃ যোশেফ। আই অ্যাম কর্নেল এন সরকার।

আর ইউ কামিং ফ্রম ডুমকা মিশন?

ইয়া।

মিসেস ডিসুজা সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, যোশেফ হ্যাজ নাথিং টু ডু উইদ এনি খ্রিস্টায়ান মিশন।

হি হ্যাজ অ্যাপ্লায়েড ফর এ জব।

ইজ ইট ও মাই গড! হোয়াই শুড হি ডু দ্যাট? ইউ হ্যাভ কাম টু এ রং ম্যান আই থিংক্‌।

প্লিজ টেল হিম দ্যাট–

হি ইজ নট অ্যাট হোম নাও। ইউ মে ফাইন্ড আউট হিম ইন দ মার্কেট এরিয়া। বলে মিসেস ডিসুজা ভেতরে ঢুকে গেলেন।

আদিবাসী কিশোরীটি ঝাঁটা হাতে নীচের ফুলবাগানে নেমে এল। তারপর বলল, ডাব্বকা চায় দুকানমে দেখিয়ে।

কর্নেল চুপচাপ পা বাড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে বললুম, আইভির এ বাড়িতে থাকার কথা।

কর্নেল বললেন, আছে। ডানদিকের ঘরের জানালার পর্দার ফাঁকে তার নাক দেখলুম!

নাকটা যে আইভির, তা কী করে বুঝলেন?

কর্নেল হাসলেন। নাকের আমি নাকের তুমি নাক দিয়ে যায় চেনা। সুকুমার রায়ের পদ্যে অবশ্য গোঁফ আছে। আসলে পোর্তুগিজ নাক আর ইংলিশ নাকের তফাত আছে। যাই হোক, সেটা অ্যানথ্রোপোলজির আওতায় পড়ে।…

বাজার এলাকায় গিয়ে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে ডাব্বর চায়ের দোকানের খোঁজ পাওয়া গেল। সেখানে একটা মোটর সাইকেলও দেখলুম। ব্যাগি সোয়েটার আর জিনস পরা এক যুবক মোটর সাইকেলটার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। মাথায় একরাশ বিশৃঙ্খল চুল। কানে রিং। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তো বটেই, আমার ধারণামতে পর্তুগিজ বংশধর। কর্নেল গিয়ে তাকে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং মিঃ যোশেফ।

সে কড়া চোখে তাকাল। ইয়া?

কর্নেল তাকে তার নেমকার্ড দিলেন। সে কার্ডটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

আই হ্যাভ সামথিং টু নো ফ্রম ইউ।

 হোয়াট্টাবাউট দ্যাট?

 কর্নেল আস্তে বললেন, অ্যাবাউট ইয়োর ফ্রেন্ড বাচ্চু।

যোশেফ চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে বলল, ইউ আর আ ন্যাচারালজিস্ট।

 আ রিটায়ার্ড কলোনেল। হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট বাচ্চু?

প্লিজ লেট আস টক সামহোয়্যার প্রাইভেটলি।

যোশেফ সন্দিগ্ধ দৃষ্টে একটুখানি তাকিয়ে থাকার পর বলল, ও কে! কাম উইদ মি।

কর্নেল আমাকে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো জয়ন্ত!

যোশেফ কয়েক পা এগিয়ে একটা ঝাকড়া গাছের তলায় দাঁড়াল। তারপর দু’জনের মধ্যে প্রায় মিনিট দশেক কথাবার্তা হল। লক্ষ্য করলুম, যোশেফকে প্রথমে যতটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, তা ক্রমশ কমে গেল এবং সে স্বাভাবিক হয়ে গেল।

কালের সঙ্গে ফিরে এসে সে বলল, ও কে কর্নেল সরকার দ্য ন্যাস্টি ডগস নো হাউ টু বার্ক। বাট দে ডু নট নো হাউ ট বাইট।

থ্যাঙ্কস যোশেফ! গুড বাই।

 বাই!

কর্নেল একটা সাইকেল রিকশা ডেকে বললেন, রাজবাড়ি।

রিকশাতে চেপে বললুম, কী কথা হল?

যথাসময়ে জানতে পারবে। মুখটি বুজে থাকো।…

রাজবাড়িতে ঢুকে দেখি, একটা মোটরগাড়ি বটতলায় দাঁড়িয়ে আছে। কালীপদ বলল, বোসসায়েব এসে গেছেন। রানীমার ঘরে আছেন এখন।

কর্নেল বললেন, দরজা খুলে দাও। ঘরে ঢুকে একটু রেস্ট নিই।

কালীপদ দরজায় তালা এঁটে রেখেছিল। খুলে দিয়ে বলল, বোসসায়েব রানীমাকে বলছিলেন, আপনার নাম ওঁর জানা। উনি বিকেলেই চলে যাবেন। আপনার সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যস্ত। তা স্যার, যোশেফের দেখা পেলেন?

হ্যাঁ। কবরেজমশাই কী বলে গেলেন?

ওষুধ দিয়ে গেলেন। ঠাকুরমশাইকে হাঁটাচলা করতে বারণ করলেন।…

একটু পরে কর্নেলের মতো তাগড়াই চেহারার গুঁফো এক ভদ্রলোক এসে নমস্কার করে বললেন, আমার সৌভাগ্য! লেজেন্ডারি ফিগার কর্নেলসায়েবকে চর্মচক্ষে দর্শন করলুম। আমি অরবিন্দ বোস। বর্ধমান রেঞ্জের ডি আই জি।

কর্নেল তাঁকে অভ্যর্থনা করে বসিয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আপনাদের সোর্স থেকে জেনেছেন, বাচ্চুবাবু নাকি আর বেঁচে নেই। সেই সোর্স কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

অরবিন্দ বোস বললেন, বিশ্বাসযোগ্য। সে কালীপুজোর পরদিন ভোরবেলায় সাইকেলে চেপে নদীর ওপারে একটা আদিবাসী বস্তিতে মজুর ডাকতে যাচ্ছিল। টমসায়েবের বাংলোর নীচে গিয়ে সে রাস্তার ওপর অনেকটা রক্ত দেখতে পায়। একটা রক্তমাখা চপ্পলও পড়েছিল। কিন্তু সে পুলিশকে ভয়ে কিছু জানায়নি। বুঝতেই পারছেন, সাধারণ মানুষেরা পুলিশকে এমনিতে এড়িয়ে চলে। ফেরার সময় সে রক্ত দেখেছিল। কিন্তু চপ্পলটা ছিল না। সেদিন রাত্রি থেকে আকাশ মেঘলা ছিল। দুপুর নাগাদ বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে রক্তটা ধুয়ে যায়। আমরা টমসায়েবের বাংলোর চৌকিদারকে জেরা করেছিলুম। সে কিছু বলতে পারেনি। সে কালীপুজোর রাত্রে বিজয়গড়ে তার বাড়িতে ছিল। তার প্রমাণ পেয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাচ্চুর বন্ধুদেরও অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাদের কাছে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

কর্নেল বললেন, আপনি নাকি বিকেলে চলে যাচ্ছেন?

আমাকে আসানসোল যেতে হবে। একটা বড় হাঙ্গামা হয়েছে গত রাত্রে। তবে আমি লোকাল পুলিশকে আপনার কথা বলে যাব। সবরকমের সাহায্য আপনি পাবেন।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আপনি আজ রাত্রে থাকলে একটা নাটক দেখতে পেতেন।