দু’নম্বর চাবি – ৪

০৪.

একটু পরে বুঝতে পারলুম, রানীমা এসেছিলেন দোতলায় বাচ্চুর ঘরের চাবি দিতে। চাবিটা দিয়ে তিনি চলে গেলেন। বললুম, ভটচাযমশাইয়ের ঘরে গোয়েন্দাগিরির কারণ কী?

কর্নেল বললেন, নিছক কৌতূহল।

 বললুম, দুঃখিত বস্! বিশ্বাস করতে পারছি না।

কর্নেল হাসলেন। তুমি বস্ বলাটা ছাড়ো তো! লালবাজারের ডিকেটটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ির দেখাদেখি এই বদ অভ্যাসটা তুমি রপ্ত করেছ। অরিজিতের বলার মধ্যে একটা মজা থাকে। জয়ন্ত। তুমি ওই টোনে শব্দটা উচ্চারণ করতে পারো না! আগে ওর কাছে ট্রেনিং নিও।

নেব খন। কিন্তু ভটচাযমশাইয়ের মতো

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, আকাট বামুনের ঘরে ঢুকে আকাট মূর্খ। বনে গেছি জয়ন্ত। আমার বোঝা উচিত ছিল, সাত্ত্বিক হলেও ঘোর শাক্ত উনি। তাই খাঁটিয়ার তলায় কারণবারির বোতল থাকতেই পারে।

অবাক হয়ে বললুম, উনি মদ খান?

কারণবারি বলো! তবে এতে দোষ নেই। শাস্ত্রে দেবতাকে উৎসর্গ করা কারণবারি পান বৈধ। ভেবে দেখ, নিঃসঙ্গ জীবনে একটু-আধটু রসকষ ছাড়া শান্তি মেলে না।

ওটা ছাড়া আর কিছু দেখলেন কি না বলুন?

একটা ধারালো খাঁড়া দেখলুম। এমন পরিবেশে ওটা আত্মরক্ষার কাজে লাগবে। অবশ্য ওই খাঁড়া দিয়ে রাজবাড়ির পক্ষ থেকে পাঁঠাবলি হয় সম্ভবত; রীতিমতো ঐতিহ্যশালী একটা খড়গ।

বলে কর্নেল বারান্দার নীচের লনে হাঁটতে থাকলেন। তারপর হঠাৎ থেমে গুঁড়ি মেরে মৃত এবং ভেঙেপড়া ফোয়ারার পাশে গিয়ে ক্যামেরা বার করলেন। ওখানে মরসুমি ফুলের সমারোহ। ক্যামেরার শাটার টিপে উনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন ‘কনিষ্ক কানাসে’ প্রজাপতি। পাঁচ সেন্টিমিটার ডানার দৈর্ঘ্য। এর বৈশিষ্ট্য ঘন নীল রঙের তলায় ফিকে নীল কারুকাজ। সাধারণ নেটিভ প্রজাতি হলেও সৌন্দর্য আসামান্য। এদের ধরা কিন্তু সহজ নয়।

বেগতিক দেখে বললুম, আমি ড্যাম টায়ার্ড। ঘুম পাচ্ছে।

চলো। এবার দোতলায় বাচ্চুবাবুর ঘরটা দেখা যাক।

হলঘরের দরজা খোলা ছিল। লক্ষ্য করলুম, এক সময় এখানে পোর্টিকো ছিল। পুরোটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বারান্দায় গেলুম। উঁচু থেকে দক্ষিণে ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গলের ওধারে বিজয়গড় গ্রামের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। অলকেন্দু ওরফে বাচ্চুর ঘরের তালা খুলে কর্নেল বললেন, জানালাগুলো খুলে দাও জয়ন্ত!

জানালাগুলো খুলে ঘরটা দেখে অবাক হলুম। মেঝেয় লাল কার্পেট। সুদৃশ্য বেডকভারে ঢাকা নিচু খাট। দেয়ালে প্রায় নগ্ন ফিল্ম হিরোইনদের কাট-আউট। একটা টি ভি। টেপ রেকর্ড বাজানোর বৃহৎ ডেক। দু’ধারে মাইক্রোফোন বক্স। কাঁচের আলমারিতে কতরকমের পুতুল মেমসায়েব আর নগ্ন নারীমূর্তির ভাস্কর্য। টেবিলের ওপর সাজানো রঙিন ইংরেজি পত্রিকা। প্লে বয় নামক কুখ্যাত বা বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকাও আছে। দেয়ালে সেলার। কাঁচের ভেতর সাজানো হুইস্কি রাম জিন আর ওয়াইনের বোতল। বললুম, রানীমা এগুলো ফেলে দেননি এটাই আশ্চর্য!

কর্নেল দেয়ালে একটা ছবি দেখছিলেন। বললেন, এটাই বাচ্চুবাবুর ছবি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বোকাসোকা। কিন্তু দেখতে সুন্দর।

বললুম, ফিল্মের হিরোদের মতো বোকা-সোকা চেহারা!

হিরোরা বোকা নয়, জয়ন্ত! ওটা তোমার ঈর্ষা।

ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখেই বিব্রত বোধ করলুম। অলকেন্দু সত্যি সুন্দর। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে মেয়েদের মতো অত প্রসাধন সামগ্রী কেন? কতরকমের এসেন্সের ছোট-বড় বোতল। কর্নেল চারদিকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কখনও হাঁটু ভাঁজ, কখনও অর্ধব শরীর, কখনও জুতোর ডগায় ভর করে আলমারির ওপরটা দেখতে ব্যস্ত। একটু পরে তিনি বললেন, এই ঘরের চাবি বাচ্চু রানীমাকে দিয়ে যায়নি। এটা ডুপ্লিকেট চাবি। অথবা রানীমা নিজেই এ ঘরের তালা ভেঙে নতুন তালা এঁটেছেন। কারণ ঘরের ভেতর আলমারি, ওয়াড্রব আর সেলারের চাবি, এই চাবির সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। এক মিনিট! শুধু সেলারটা দেখার কৌতূহল হচ্ছে।

কর্নেল তার পকেট থেকে সেই চাবির গোছা বের করলেন। কোনও চাবি কাজে লাগল না। তখন তিনি জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে–ড্রাইভারের মতো দেখতে একটা সূচলো জিনিস বের করলেন। এতক্ষণে বুঝতে পারলুম তিনি তৈরি হয়েই নীচের ঘর থেকে বের হয়েছিলেন।

সেলারের তালাটা হয়তো ভেঙে গেল। তালাটা কাঠের ফ্রেমে বসানো ছিল। কাঁচের পাল্লা খুলে কর্নেল প্রথমে নীচের থাকে মদের বোতলগুলোর পেছনে হাত দিলেন। তারপর দ্বিতীয় থাকে। শেষে তৃতীয় থাকের পেছন থেকে একটা ছোট অ্যালবাম বেরিয়ে এল। অ্যালবাম খুলেই কর্নেল বললেন, বাহ। বাচ্চুর ভ্রমণের ছবি। বন্ধু বান্ধবসহ পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র তীরে তোলা ছবি। সঙ্গিনীও আছে। দিশি তরুণী। প্রেমিকা তো বটেই।

তারপর একটা পাতা খুলে তিনি বললেন, জয়ন্ত। সম্ভবত আইভির ছবি এটা।

উঁকি মেরে দেখলুম, এক তরুণী মেমসায়েবের কাঁধে হাত রেখে বাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে।

পরের পাতায় পাওয়া গেল মেমসায়েবের পোর্ট্রেট। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আইভির বটে। ছবির ওপর সই করা আছে আই জে নিউসন। অক্টোবরের তারিখ। এই ছবিটা চুরি করলুম। বলে তিনি ছবিটা বের করে নিলেন সাদা সেলোফেনের স্বচ্ছ মোড়ক থেকে। কয়েকটা পাতার পর বাচ্চুর একটা ছবি পাওয়া গেল। সেটাও তিনি বের করে নিলেন। তারপর অ্যালবামটা সেলারে যথাস্থানে রেখে পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলেন।

বললুম, আট বছর আগে আপনি তো এই ঘরে ছিলেন। তখন কি সেলার ছিল?

নাহ্। এসব আসবাব নতুন। তখন ছিল সেকেলে আসবাব। প্রকাণ্ড এবং উঁচু পালঙ্ক ছিল। এবার বাথরুমটা দেখা যাক।

বাথরুমের দরজায় তালা আঁটা নেই। কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, নাহ্। বাথটাব। শাওয়ার। গিজার। মডান গ্যাজেটে সাজানো।

বললুম, বাচ্চুবাবু না বলে বাসায়েব বলা উচিত। আগাপাশতলা মড।

হ্যাঁ। আমাদের দেশের নিউ জেনারেশনের একটা অংশ যে-কালচারে আক্রান্ত, তার নমুনা তা হলে যক্ষপুরী-তেও পাওয়া গেল। বলে কর্নেল বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

তরপর উত্তরের জানালায় গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত বিরল প্রজাতির সারস ও সেই কানে কমগোঁজা কেরানি পাখি বা সেক্রেটারি বার্ড দেখতে থাকলেন। উত্তরের ঠাণ্ডা হিম হাওয়া ঘরের ভেতর নেচে বেড়াচ্ছিল। খাটের পাশে নিচু টেবিলে রাখা দিশি-বিদেশি পত্রিকাগুলোর মতো উড়ছিল। হঠাৎ একটা পত্রিকার ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ উড়ে খাটের ওপর পড়ল। পশ্চিমের জানালা গলিয়ে পালানোর আগেই সেটা ধরে ফেললুম। তারপর বললুম, কর্নেল! একটা চিঠি। ম্যাগাজিনের ভেতর থেকে উড়ে যাচ্ছিল।

কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে উত্তরমুখী হয়ে থেকেই বললেন, পড়ো! শুনতে পাব।

পড়লুম :

‘প্লিজ মিট মি নিয়ার দা বাংলো টু নাইট অ্যাট টেন ও ক্লক। দিস ইজ আর্জেন্ট। আই জে এন’

কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললেন, আইভি সবুজ কালি পছন্দ করে। একই সিগনেচারপেনে লেখা।

বললুম, রানীমা তন্ন তন্ন খুঁজেছিলেন বলছিলেন—

 উনি খুঁজেছিলেন সিন্দুকের চাবি। কোনও চিঠি খোঁজেননি।

আপনিও খোঁজেননি। দৈবাত এটা পাওয়া গেল।

কর্নেল হাসলেন। আমি একটা থিয়োরি দাঁড় করিয়ে প্রমাণ খুঁজে বেড়াই। ডিডাকটিভ মেথড। এর উল্টে ইনডাকটিভ মেথড ধরে এগোলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার ব্যাপার হবে। আমার থিয়োরি হঠাৎ পাওয়া কোনও তথ্য নড়বড়ে করে দেয়। তখন অন্য থিয়োরি দাঁড় করাই অথবা আগের থিয়োরি বদলে ফেলি। যাই হোক, চিঠিটা আমার থিয়োরিকে দুর্বল করে দিল।

থিয়োরিটা কী ছিল?

কর্নেল মুখে হাসি রেখে বললেন, এখন থিয়োরি নিয়ে বকবক করার চেয়ে স্নান সেরে নেওয়া স্বাস্থ্যকর।

বলে তিনি জানালা বন্ধ করতে থাকলেন। আমিও জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত হলুম। তারপর বললুম, পত্রিকাগুলোর পাতা খুঁজলে আরও কিছু বেরতে পারে।

হয়তো পারে। তবে কথাটা কি জানো? ওইসব গা ঘিন ঘিন করা অশ্লীল পত্রিকার পাতা ওল্টানোর ইচ্ছা আমার ছিল না। হ্যাঁ, আমিও কিছু কিছু ব্যাপারে ভটচাযমশাইয়ের মত শুচিবায়ুগ্রস্ত।

আপনি প্রখ্যাত রহস্যভেদী। রহস্যভেদের স্বার্থে নোংরা ঘাঁটতে হতেই পারে।

কর্নেল দরজায় তালা এঁটে বললেন, ডার্লিং! তুমি আমাকে আজ বড় বাগে পেয়ে গেছ। আসলে আমার ইচ্ছে ছিল না তোমার মতো যুবকের সামনে এ ধরনের অপকর্ম করি। তোমার মনে আছে কি? কলকাতার হেস্টিংস এলাকার ক্রিকটন রোডে টয় পিস্তলের নলের ভেতর পাওয়া সেক্স-ফিল্মের প্রিন্টগুলো তোমাকে দেখাইনি। ফিল্ম স্টার চিত্রা দত্তেরও সম্মান রক্ষা করেছিলুম।

চুপচাপ ওঁকে অনুসরণ করলুম। বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলুম ফুলবাগানের ধারে একটা ঢাকা ইঁদারার পাশে একটা গুমটিঘরের মতো ঘর। দরজা খুলে কালীপদর বউ জবা দাঁড়িয়ে আছে এবং ঘরটার ভেতর পাম্পিং মেসিন চলছে।

বললুম, আমি ভেবেছিলুম বিজয়গড় থেকে জলের লাইন আনা হয়েছে রাজবাড়িতে।

কর্নেল বললেন, ফোয়ারাটা দেখেও বুঝতে পারোনি বাড়িতেই জলের ব্যবস্থা আছে?

ফোয়ারাটার অমন অবস্থা কেন? মেরামত করে চালু করলে সুন্দর দেখাত। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলের বাগান।

ভটচাযমশাই বলছিলেন না আর সে-রাজত্ব নেই? ফোয়ারা চালু রাখার অনেক ঝক্কি।

কথা বলতে বলতে আমরা হলঘরে নেমে এলুম। কর্নেল স্টাফকরা একটা বাঘের পেছনে বিশাল পেন্টিং দেখিয়ে বললেন, ওই ছবিটা রাজা আদিত্যকান্তি সিংহের। ছবিটা আঠারো শতকে একজন ডেনিশ চিত্রকর এঁকেছিলেন। ওই দেখ, পড়া যাচ্ছে তারিখটা। এইটিন্থ মার্চ, ১৭১২ এ ডি। পলাশীর যুদ্ধের পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আঁকা। কুমার বাহাদুরের একটা সংগ্রহশালা দেখেছিলুম। প্রচুর পুরনো পেন্টিং আর ভাস্কর্য ছিল। জানি না সেগুলো রানীমা কোথাও দান করেছেন কি না।

আমরা ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরে কালীপদ এসে বলল, জল গরম করা হচ্ছে স্যারেরা স্নান করে নেবেন।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা কালীপদ, রাজবাড়ির একটা ঘরে অনেক ছবি আর মূর্তি ছিল। সেগুলো এখনও আছে?

কালীপদ বলল, কিছু কিছু আছে স্যার!

বাকিগুলো কোথায় গেল?

কালীপদ চাপাস্বরে বলল, কী আর বলব স্যার? বাচ্চুবাবুর গুণের কথা বলে শেষ হবে না। একটা-দুটো করে কোথায় নিয়ে যেতেন। আমাকে শাসাতেন। তার বন্ধুরা সব বিজয়গড়ের গুণ্ডা-মস্তান। অথচ সবাই ভদ্রলোকের ছেলে। দিনকাল কী হয়েছে ভাবুন!

রানীমা তো টের পেতেন?

প্রথমে পাননি। যখন পেলেন, তখন অর্ধেক নিপাত্তা হয়ে গেছে। ডবল তালা এঁটে রেখেছেন।

রানীমার ডাক শোনা গেল, কালী! ও কালী!

কালীপদ চলে গেল।…

কর্নেল ঝটপট ছবি দুটো, চিঠিটা এবং তার গোপনে তালা খোলার চাবিগুলো কিটব্যাগে ভরে রাখলেন। জ্যাকেটের ভেতর থেকে স্ত্র-ড্রাইভার জাতীয় জিনিসটাও ঢোকালেন। বললুম, আপনি দেখছি রীতিমতো সেজেগুজেই বেরিয়েছেন। কিন্তু আপনি কি জানতেন গোপনে কোনও তালা খুলতে হবে?

এ কোনও নতুন ব্যাপার নয় জয়ন্ত! আমার কিটব্যাগে অনেক কিছু থাকে। সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা। কাটাতারের বেড়া কাটার অস্ত্র থেকে শুরু করে প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে আঙুলের ছাপ নেওয়ার সরঞ্জাম..কী নেই? পেরেক, গোঁজ, হাতুড়ি, এমন কি ফার্স্ট এডের খুদে বাক্স। যাই হোক, নিয়ম ভঙ্গ করে আজ আমি স্নান করব।

কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে একদিন স্নান করেন। বাকি সময় তিনদিন অন্তর একদিন। অনেক সময় পনেরো-কুড়িদিন স্নান না করেও দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন। আবার কী? সামরিক জীবনের অভ্যাস।…

সাড়ে বারোটায় রানীমার পরিচর্যায় খাওয়া-দাওয়ার পর অভ্যাসমতো কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। কর্নেল বারান্দায় রোদে বসে চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম ভাঙল কালীপদর ডাকে।

সে চা এনেছিল। কম্বল থেকে বেরিয়ে বললুম, কর্নেল কোথায়?

কালীপদ বলল, ড্যামের জলে হাঁস দেখতে গেছেন। এদিকে এক কাণ্ড!

কী কাণ্ড?

 ঠাকুরমশাই এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। এসেই দেখেন ওঁর ঘরের তালায় চাবি ঢুকছে না।

ঠাকুরমশাই মানে ভটচাযমশাই?

আজ্ঞে। কালীপদ হাসল। খামোকা হইচই বাধালেন। ঘরে কিছু চুরি যায়নি।

উনি কোথায় এখন?

 রানীমার সঙ্গে কথা বলছেন। ঝোড়ো কাক-হয়ে ফিরেছেন। আসানসোলে বোনের বাড়িতে ছিলেন। হাবভাব দেখে মনে হল বোনের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। রানীমা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। খুলে কিছু বলছেন না।

হাসতে হাসতে কালীপদ চলে গেল। চারটে বাজে। শীতের দিনের আলোর রং এখানে একেবারে ফিকে লাল। চা খেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে বারান্দায় গেলুম। দেখলুম, ভটচাযমশাই সেই মার্কামারা ফতুয়া গায়ে বারান্দায় সিঁড়িতে বসে আছেন। থামের গায়ে হেলান দিয়ে রানীমা তার সঙ্গে কথা বলছেন। একটু পরে রানীমা ঘরে ঢুকলেন। তখন ভটচাযমশাই নীচে নেমে আমার দিকে ঘুরলেন। তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে বললেন, নমস্কার জয়ন্তবাবু! আপনারা এসে গেছেন দেখছি।

নমস্কার করে বললুম, কালীপদ বলছিল আপনার ঘরে নাকি চোর ঢুকেছিল?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু রানীমা বিশ্বাস করছেন না।

কিছু চুরি গেছে নাকি?

চুরি কী যাবে? আছেটাই বা কী? একটা স্যুটকেসে খানকতক জামাকাপড়। কয়েকখানা তৈজস দ্রব্য। আর একটা কেরোসিন কুকার। ব্যস!

তা হলে চোর ঢুকল কেন?

ভটচাযমশাই তুম্বো মুখে বললেন, বুঝতে পারছি না। তালায় চাবি ঢোকাতে গিয়ে দেখলুম ঢুকছে না। জোরে নাড়া দিলুম। তখন খুলে গেল।

এমন হতে পারে চোর ভেবেছিল কিছু দামি জিনিস পাবে!

হাঃ। বলে হরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য গেটের দিকে তাকালেন। এবার মুখে হাসি ফুটল। কর্নেলসায়েব আসছেন। ওঁর যা স্বভাব। পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ানো।

কর্নেল ভেতরে এসে বললেন, আরে! এই তো আপনি এসে গেছেন। আপনার জন্য খুব ভাবছিলুম। রানীমা অবশ্য বলছিলেন, আসানসোলে বোনের বাড়ি হয়ে আসবেন। তা আপনার চেহারা অমন হয়ে গেছে কেন? অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?

ভটচাযমশাই বললেন, না। দু দুবার ট্রেন জার্নি। বোনের বাড়িতে অশান্তি। জামাইবাবু লোকটা হাড়বজ্জাত। এত সাহস? আমার সামনে আমার বোনকে যাক গে ওসব কথা। আপনি ঠিক ধরেছেন। হঠাৎ আমাশা হয়ে একেবারে দুর্বল করে ফেলেছে। গৌরাঙ্গডিহিতে এক কবরেজ আছেন। তার ওষুধ খেতে খেতে এলুম। আমি তো বিলিতি ওষুধ খাই না জানেন।

আমি বললুম, ওঁর ঘরে তালা ভেঙে নাকি চোর ঢুকেছিল!

 কর্নেল বললেন, সর্বনাশ!

ভটচাযমশাই বললেন, না না। কিছু চুরি যায়নি।

আপনি গায়ে চাদর জড়ান শিগগির। শীত করছে না?

হরেকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বাঁকা হেসে বললেন, আমার গায়ের চামড়া মোটা। মায়ের ইচ্ছায় শীত-গ্রীষ্ম আমার কাছে এক।

বলে তিনি হঠাৎ পেট চেপে ধরে হন হন করে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বললুম, সারসের ছবি তুলতে পেরেছেন?

কর্নেল বললেন, নাহ। বেজায় ধূর্ত। সেক্রেটারি বার্ডের ছবি তুলতে গিয়ে দেখি বাংলোয় জনসায়েব সপরিবার এসেছে গাড়ি নিয়ে। আমাকে চিনতে পেরে কথা বলল।

আইভির কথা জিজ্ঞেস করেননি?

হু। জন একটু খাপ্পা হয়ে বলল, আইভি চিত্তরঞ্জনে একটা স্কাউড্রেলকে বিয়ে করেছে। তার নাম জেমস্ বিশ্বাস। জনের কথায় নেটিভ স্কাউন্ড্রেল। জনের সঙ্গে আর বোনের কোনও সম্পর্ক নেই। বলে কর্নেল বারান্দায় উঠে এলেন। চাপা স্বরে ফের বললেন, জেম্স্ বিশ্বাসের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে। কথায় কথায় জেনে নিলুম। আমার প্রথম থিয়োরি এবার পুরো ধসে পড়ল জয়ন্ত। নতুন থিয়োরি মাথায় এসেছে। ডি আই জি অরবিন্দ বোসের সঙ্গে আমার শিগগির যোগাযোগ করা দরকার।

আমিও চাপাস্বরে বললুম, আইভি বাচ্চুকে চিঠি দিয়ে রাত্রে ডেকেছিল। তারপর

কর্নেল বললেন, চুপ! কালীপদ! কফি না চা আনছ?

কালীপদ বারান্দায় ট্রে হাতে আসছিল। বলল, কফি স্যার! আপনি কফির ভক্ত তা কি জানি না?