দু’নম্বর চাবি – ৮

০৮.

 কর্নেলের কথা শুনে ডি আই জি অরবিন্দ বোস একটু হেসে বললেন, আপনি শিওর যে আজ রাতে একটা নাটক হবে?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, খানিকটা শিওর। আসলে আজ রাতে আমি একটা ফাঁদ পেতে রাখব ঠিক করেছি। অন্তত নাইনটি নাইন পারসেন্ট চান্স আছে যে, ফঁদে লোকটা পা দেবে।

লোকটা! বোসসায়েব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কর্নেলসায়েব! আমি হেঁয়ালি পছন্দ করি না।

আপনার থাকার সুযোগ যখন নেই, তখন কথাটা হেঁয়ালি হয়েই থাক। পরে যথাসময়ে জানতে পারবেন।

বোসসায়েব কিছুক্ষণ গোঁফে তা দেওয়ার পর বললেন, আমি দিদার কাছে শুধু এটুকু শুনেছি যে তার জীবন নাকি বিপন্ন। দিদাও খুলে কিছু বলেননি। আমি রাজবাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প বসাতে চাইলুম। তাতেও তার আপত্তি। যাই হোক। এটা স্পষ্ট, দিদাকে কেউ মার্ডার করতে পারে। হা–তাকে মার্ডার করলে সিংহবাহিনী মেলা কমিটির হাতে রাজবাড়িটা চলে যাবে। বাচ্চুর বাবা তার শেয়ার দাদামশাইয়ের জীবদ্দশায় বেচে টাকা নিয়েছিলেন। এদিকে বাচ্চু বেঁচে নেই। তা হলে আপনার সোকলড ‘লোকটা’ মেলা কমিটির প্রভাবশালী চাঁইদের ভাড়া করা কিলার। এই তো?

কর্নেল হাসলেন। আপনার অঙ্কটা ঠিক হতেই পারে। তবে আপনাকে খবর দিয়ে এখানে আপনার উপস্থিতি চেয়েছিলুম একটা মাত্র কারণে। তা হল, বাচ্চু যে সত্যি খুন হয়েছে, তার সলিড প্রমাণ আপনার হাতে কতটা আছে তা জানা। কিন্তু শুধু জানতে পারলুম, আপনাদের সোর্স টমসায়েবের বাংলোর কাছে রাস্তায় খানিকটা রক্ত আর একপাটি জুতো দেখেছিল। অথচ বাচ্চুর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দূরে কোথাও জঙ্গলের মধ্যে বা পাহাড়ে পুঁতে ফেললে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই এরিয়ায় ভূ-প্রকৃতির যা অবস্থা, তা তো আপনি নিজেও দেখছেন। দিদা বলছিলেন, আপনি আগেও এসেছেন। অবস্থা তত কিছু বদলায়নি। তবু পুলিশের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হয়নি।

আচ্ছা মিঃ বোস, টমসায়েবের মেয়ে আইভির সঙ্গে বাচ্চুর নাকি মেলামেশা ছিল। আইভিকে নিশ্চয় পুলিশ জেরা করেছে?

অরবিন্দ বোস গম্ভীর মুখে বললেন, সেই মেয়েটাই তো বাচ্চুর সর্বনাশের কারণ। তার দাদা জন তাকে চিত্তরঞ্জন টাউনশিপে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দাদার অমতে মেয়েটা একজন দেশি খ্রিস্টানকে বিয়ে করেছিল। সেই লোকটা আবার চোর-জোচ্চোর টাইপ। অফিসের টাকা চুরি করে ফেরার হয়েছে। ওদের দুজনের নামেই হুলিয়া জারি করা হয়েছে।

তা হলে আইভিকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি?

নাহ্। আইভিকে পেলে কিছু ক্লু বেরিয়ে আসত। এমনকি আমার সন্দেহ, আইভিকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে বাচ্চুকে মারা হয়েছে। আপনাকে খুলেই বলছি, কালীপুজোর দিন বিকেলে আইভি তার বাবার বাংলোয় এসেছিল। একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে সে এসেছিল। সেই গাড়ির মালিক লামিয়া নিজেই পুলিশকে কথাটা জানিয়েছিল। তারপর আইভির নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়।

বিজয়গড়ে মুসলিম মহল্লা আছে। আপনার কথা শুনে মনে পড়ল।

আছে। এখান থেকে কাছেই। বিজয়গড়ে ঢোকার মুখে বাঁদিকে দেখতে পাবেন।

কর্নেল বললেন, শর্টকাটে রাজবাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে যাওয়া যায়। তাই না মিঃ বোস?

হ্যাঁ। তবে ওদিকে গেলে মুসলিম গোরস্তান পড়বে।

কর্নেলকে উত্তেজিত দেখাল। বললেন, গোরস্তানটা আমি দেখেছি। আট বছর আগের কথা। ওখানে এক ঝাক লাল ঘুঘু দেখেছিলুম।

এতক্ষণে ডি আই জি সায়েবের মুখে হাসি ফুটল। বললেন, আপনার কিছু হবির কথা শুনেছি।

হ্যাঁ। লাল ঘুঘু এখন প্রায় বিরল প্রজাতির পাখি বলা চলে। ওরা দল বেঁধে থাকে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।

ভাবলুম, হয়তো এখনই বাইনোকুলার নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু তারপর উনি বসলেন। চাপাস্বরে বললেন, মিঃ বোস! আপনি একটা ইনফরমেশন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে যেতে পারবেন?

বলুন!

কালীপুজোর দিন মুসলিম মহল্লার কেউ মারা গিয়েছিল কি না। মারা গিয়ে থাকলে তার কবর কোনটা। আপনি লোক্যাল থানার কোনও অফিসার পাঠিয়ে কথাটা জেনে নিতে পারেন।

অরবিন্দ বোস আবার কর্নেলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর একটু হেসে সোয়েটারের ভেতর হাত ভরে একটা সেলুলার ফোন বের করলেন। অ্যান্টেনা টেনে উনি পশ্চিমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফোনের বোতাম টিপে একটু পরে চাপা গলায় কথা বলতে থাকলেন। তারপর হাতের ঘড়ি দেখে একটু জোরে বললেন, আই অ্যাম স্টার্টিং অ্যাট টু ও’ক্লক শার্প।… ও কে। থ্যাঙ্কস।…

অ্যান্টেনা ফোনে ঢুকিয়ে ফোনটা আবার সোয়েটারের ভেতর চালান করে বোসসায়েব বললেন, আমার গাড়িতে রেডিও ট্রান্সমিশনের ব্যবস্থা আছে। তবে এই কর্ডলেস ফোনটা তিন কিলোমিটারের মধ্যে ব্যবহার করা যায়। দেশটা তো এখনও আমেরিকা হয়ে ওঠেনি। এনিওয়ে, আপনার উদ্দেশটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয় কর্নেলসায়েব।

কর্নেল বললেন, একটা চান্স নিচ্ছি মাত্র।

অরবিন্দ বোস হঠাৎ নড়ে বসলেন। মাই গড! আপনি কি ভাবছেন–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিলেন। জাস্ট এ চান্স! শুধু ইনফরমেশনটা পেলেই যথেষ্ট।

মে বি ইউ আর রাইট।

যদি আমার অঙ্কটা মিলে যায়, তা হলে অগত্যা আমাকে আজ রাত্রে নয়, আগামীকাল রাত্রে ফাঁদটা পাততে হবে।

ডি আই জি সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, দিদার কাছে যাই। তো যদি আপনি আমাকে আগামীকাল রাত্রে পেতে চান, কালীকে থানায় পাঠিয়ে আমার বাড়িতে মেসেজ দিতে বলবেন। মেসেজ না পেলে আমি কিন্তু আসছি না। আই। হ্যাভ লট অব থিংস টু ডু ইউ নো!

উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম, ভদ্রলোক একটু গোঁয়ার টাইপ। এমন টোনে আপনার সঙ্গে আজ পর্যন্ত কোনও মহারথীকে কথা বলতে শুনিনি। সি বি আইয়ের ডিরেক্টর পর্যন্ত আপনাকে সম্মান করেন।

কর্নেল হাসলেন। না, না! উনি আমাকে অসম্মান করেননি। আসলে উনি চাইছিলেন, তুরুপের তাসটা যেন ওঁকে দেখাই। এটা মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল জয়ন্ত!

কিন্তু হঠাৎ কবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন?

 চেপে যাও। স্পিকটি নট।

 কিছুক্ষণ পরে কালীপদ এসে বলল, স্নানের জল গরম করা হয়েছে স্যার!

কর্নেল বললেন, আজ আমি স্নান করছি না। জয়ন্ত করবে।

বললুম নাহ্। ইচ্ছে করছে না।

কালীপদ হাসতে হাসতে বলল, তা হলে জলটা আমার ভোগে লাগুক। বোসসায়েবও স্নান করবেন না। ওঁর ড্রাইভার চান করতে চায় তো ঠাণ্ডা জলেই করুক।…

আজ খেতে একটা বেজে গেল। বোসসায়েব রানীমার সঙ্গেই বেশি কথা বললেন। মেলা কমিটিতে যত প্রভাবশালী লোকই থাক, রাজবাড়ি উনি তাদের হাত থেকে বাঁচাবেন। বরং বাড়িটা ওঁর দিদা যদি উইল করে সরকারকে দানের ব্যবস্থা করেন, এটা একটা কলেজ হতে পারে। রানীমা সকৌতুকে বললেন, সবাই আমার মৃত্যুর দিন গুনছে। দেখলেন তো কর্নেলসায়েব!

খাওয়ার পর বেসিনে হাত ধুয়ে বোসসায়েব বারান্দায় গেছেন, সেই সময় পি পিঁ শব্দ কানে এল। উনি সোয়েটারের ভেতর হাত ভরে সেলুলার ফোন বের করে অ্যান্টেনা টেনে সাড়া দিলেন। দেখলুম, রানীমা তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত! চুরুট টানার আগে কোনও কথা নয়।

আমরা ঘরে ঢুকেছি, এমন সময় ফোন কানের কাছে রেখেই বোসসায়েব এলেন। ক্রমাগত উনি হু, ও কে ইত্যাদি বলে যাচ্ছিলেন। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। বোসসায়েব ফোনটা সোয়েটারের ভেতর ঢুকিয়ে কর্নেলের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, ইউ আর রাইট কর্নেলসায়েব। এস আই রামশরণ শর্মাকে ওরা কবরটা দেখিয়ে দিয়েছে। ওরা ভিড় করে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিল। শর্মা ওদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। বাট দে উইল নট অ্যালাউ এনিবডি টু–

কর্নেল দ্রুত বললেন, দ্যাট আই নো মিঃ বোস!

দেখবেন মশাই, যেন হাঙ্গামা না বাধে! বলে ডি আই জি বেরিয়ে গেলেন।…

অভ্যাসমতো ভাতঘুম দিতে গিয়ে কালকের মতোই পুরো ঘুমের কবলে পড়েছিলুম। কালীপদর ডাকে চারটেয় উঠে বসতে হল। কালীপদ চা দিয়ে বলল, কর্নেলসায়েব বেরিয়েছেন।

বোসসায়েব?

উনি দুটোর সময় চলে গেছেন। রানীমা এত করে বললেন, থাকলেন না। আসানসোলে কী কাজ আছে। বোসসায়েব বড় একগুঁয়ে মানুষ।

পাঁচটা বাজতে না বাজতে রাজবাড়িতে আলো জ্বলে উঠল। তার একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন। কালীপদ ওঁর জন্য কফির ব্যবস্থা করতে গেল। বললুম, কোথায় গিয়েছিলেন আজ?

লাল ঘুঘুর ঝাঁক দেখতে।

মুসলিম কবরখানায় নাকি?

হ্যাঁ।

তারপর?

তারপর আবার কী?

সেই কবরটা দেখে এসেছেন কি না বলুন?

কর্নেল হাসলেন। এস আই রামশরণ শর্মা বুদ্ধিমান! মাটির কটার কাছে খেলার ছলে গাছের পাতা ছিঁড়ে ছড়িয়ে রেখেছিলেন। যাই হোক, কাছাকাছি একটা ঝোঁপের ভেতর একপাটি চপ্পল পেয়েছি। সেটা কিটব্যাগে প্লাস্টিকের মোড়কে আছে। মজাটা হল, চপ্পলটার পেছনের স্ট্র্যাপ মজবুত। তাই পা থেকে খুলে যায়নি অন্য পাটির মতো।

হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। এবার বললুম, বুঝে গেছি। বাচ্চুবাবুর ডেডবডি

চুপ!

কালীপদ এসে বলল, কফি রেডি ছিল। জয়ন্তবাবু চা খেয়েছেন। এবার কফি খান। পাঁপরভাজা এনেছি।

জিজ্ঞেস করলুম, ভটচাযমশাইয়ের কী অবস্থা?

দুপুরে দেখলুম, কাঁচকলা সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। লেবু চাইলেন। গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে এলুম। তবে চেহারা দেখে মনে হল, একটু সুস্থ হয়েছেন। এ বেলা উপোস করবেন বলছিলেন।

কালীপদ চলে যাচ্ছিল। কর্নেল তাকে ডাকলেন। কালীপদ! শোনো।

বলুন স্যার?

 তোমার কি মনে আছে বাচ্চুবাবু কেমন জুতো পছন্দ করত?

কালীপদ অবাক হয়ে বলল, কেন স্যার?

এমনি জিজ্ঞেস করছি।

 স্যান্ডেল বা চপ্পল পরতেন। কখনও পামসু বা বুট পরতে দেখিনি।

পেছনে স্ট্রাপ দেওয়া চপ্পল?

 আজ্ঞে। ওঁর ঘরেই তো কত নমুনা আছে। লক্ষ্য করেননি?

 হ্যাঁ, হ্যাঁ। লক্ষ্য করেছিলুম। ঠিক আছে।

কালীপদ সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে চলে গেল। বললুম, ছ্যা ছ্যা! ওই জুতো আপনি কিটব্যাগে ভরে রেখেছেন?

রক্তের ছিটে কোথাও আছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। হয়তো বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। রক্তের ছিটে কালো হয়ে গেছে। তবু চেষ্টা করব। তারপর ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

একটু ভেবে নিয়ে বললুম, টমসায়েবের বাংলো থেকে কবরখানা তো বেশ দূরে। বাচ্চুর লাশ বয়ে আনা এবং টাটকা কবরে ঢোকানো কষ্টসাধ্য কাজ। একজনের পক্ষে কি সম্ভব?

কর্নেল দাড়ি থেকে কী একটা ফেলে দিয়ে বললেন, নাহ্। অন্তত দু’জন লোক দরকার। খুনীর সঙ্গী ছিল। একজন হতে পারে। দু’জনও হতে পারে।

এই সময় বাইরে দূরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কর্নেল উঠে গিয়ে উত্তরের একটা জানালা খুললেন। তারপর জানালাটা বন্ধ করে বললেন, মোটর সাইকেলের শব্দ। সম্ভবত যোশেফ আইভিকে নিয়ে সারেংডির বাংলোয় গেল।

বললুম, আপনি যাবেন না?

 নাহ। যোশেফকে বলা আছে, হালদারমশাইকেও মোটর সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে রাজবাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ওর মোটর সাইকেলে ডাবল কেরিয়ার আছে। একাধিক সঙ্গী নিয়ে ঘোরে কি না।

রানীমাকে তা হলে বলে রাখা উচিত।

ব্যস্ততার কিছু নেই। সময়মতো বলব, আমার একজন গেস্ট আসার কথা। তবে রাতের খাওয়া হালদারমশাই ওখানেই খেয়ে নেবেন। যোশেফকে বলে দিয়েছি।…

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো। রানীমাকে কথাটা এবার বলে আসি। কালীপদ দেখছি এ ঘরের তালাচাবি টেবিলে রেখেছে। তালা এঁটেই বেরুব।

বললুম, আমি গিয়ে কী করব? নড়তে ইচ্ছে করছে না।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, একা থাকলে কাল সন্ধ্যার মতো ভয় পেয়ে ফায়ার আর্মস বের করবে। কী দেখতে কী দেখে হয়তো গুলি ছুঁড়ে বসবে। আমি রিস্ক নিতে চাই না। তুমি মিথ্যে একটা সিন ক্রিয়েট করো।

ওঁর কথায় একটু চটে গিয়ে বললুম, কাল সন্ধ্যায় আমি ভূত না দেখলেও মানুষ দেখেছিলুম, সেটা তো সত্যি। মানুষটা যে ভটচাযমশাই, তা-ও সত্যি। উনি না হয়ে রানীমার শত্রুপক্ষের কেউ ওভাবে চুপি চুপি ফুলবাগানে ঘাপটি পেতে থাকতেও পারত। কাজেই আমি সিন ক্রিয়েট করতে বাধ্য হয়েছিলুম।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, নাহ। রানীমার কাছে একটা গুরুত্বপুর্ণ কথা জানতে যাচ্ছি। তুমিও স্বকর্ণে শুনলে মাথা পরিষ্কার হবে। রহস্যের একটা জট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

তালা এঁটে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ফুলবাগানের ওদিকটা দেখতে দেখতে গেলুম। আলোর সীমানা শেষে বাউন্ডারি ওয়াল অব্দি আবছা আঁধার। কর্নেল যা-ই বলুন, আমার মনে হচ্ছিল কেউ বা কারা ওখানে ঘাপটি পেতে বসে গোপন চক্রান্ত করছে।

ডাইনিং রুমের সামনে কালীপদ দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল তাকে বললেন, কালীপদ! রানীমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।

কালীপদ বলল, রানীমা আপনাকে ডেকেছেন। আপনাদের দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। যান। উনি অপেক্ষা করছেন।

রানীমার ঘরের পর্দা সরানো। উনি ইজিচেয়ারে শাল মুড়ি দিয়ে বসেছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, বসুন।

আমরা বসলুম। তারপর কর্নেল বললেন, আগে আমার কথাটা বলে নিই। আমার এক বন্ধু সারেংডি ফরেস্টে বেড়াতে এসেছেন। ফরেস্ট বাংলোয়, তিনি উঠেছিলেন। কিন্তু বাংলোর অবস্থা খুব খারাপ। তাই উনি আজ রাত্রেই চলে আসতে চান। আমাদের ঘরে অন্তত একটা খাঁটিয়া হলেই ওঁর থাকার ব্যবস্থা করা যায়। আপনার অনুমতি পেলে

রানীমা দ্রুত বললেন, কোনও অসুবিধে নেই। পাশের ঘরেও উনি থাকতে পারেন।

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, তা হলে খুলেই বলি। তিনি একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। এখন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন কলকাতায়। নাম মিঃ কে কে হালদার। ওঁকে আমার কাজের সুবিধার জন্যই আসতে বলেছিলুম।

রানীমা সোজা হয়ে বসলেন। তা হলে ওঁকে জঙ্গলে ফেলে রেখেছেন কেন? এটা উচিত হয়নি।

ওঁকে বাইরে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আপনার শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে উনি কাজ করতে পারেন।

রানীমা একটু হেসে বললেন, কথাটা শুনে ভাল লাগল। আমি জানতুম, আপনি একটা হেস্তনেস্ত না করে যাবেন না। তো কালীকে ওঁর জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলি।

না। উনি খেয়ে আসবেন। বলে কর্নেল উঠে দরজার উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে নিলেন। তারপর বললেন, আপনার বলার কথা পরে শুনছি। আগে আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিন। প্রশ্নটা এখানে এসেই করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন আমি একটু বিভ্রান্ত ছিলুম। যাই হোক, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি বাচ্চুবাবুকে সিন্দুকের এক নম্বর চাবি কী ভাবে দিয়েছিলেন? শুধুই কি চাবিটা দিয়েছিলেন? নাকি চাবিটা কোনও জিনিসের ভেতর লুকনো ছিল?

রানীমা বললেন, ঠিক এই কথাটা বলার জন্যই আপনাকে ডেকেছি। স্যাকরা ডেকে একটা সোনার চেন এবং একটা মোটা লকেট তৈরি করিয়েছিলুম। লকেটের ভেতরটা ছিল খালি। একটু অড সাইজ। একটা দিকে জোরে চাপ দিলে ভোলা যায়। তার ভেতর সিন্দুকের এক নম্বর চাবি ছিল। চাবিটা এক ইঞ্চি লম্বা। পেতলের চাবি। দেখাচ্ছি।

বলে তিনি পেটের কাছ থেকে খুদে ব্যাগ বের করে দ্বিতীয় চাবিটা দেখালেন।

কর্নেল বললেন, এবার আমার কাছে সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেল। এরপর কী করণীয়, কাল আপনার সঙ্গে আলোচনা করব।…