পিছনে পায়ের শব্দ – ৪

০৪.

ভোর ছটায় গেট থেকে জগিংয়ের শুরুতে পিউ বলল, হেভি ফগ বুড়োদা।

এই হেভি? সাত্যকি বলল। জ্যানুয়ারিতে তো…হেই! ইউ অর গোয়িং ক্যাস্ট।

ইউ আর টপ টু বটম ইয়াংকি!

তালে পা ফেলতে ফেলতে সাত্যকি ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকাল। ইয়াংকি কেন?

জ্যানুয়্যার বললেন! ফ্যাস্ট বললেন!

 ও! সাত্যকি হাসল। বাট…নো টক প্লিজ! উই মাস্ট ফলো দা নর্মস্।

ইয়া!

কুয়াশা এত গাঢ় যে কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। যে-সব গাছ রাস্তার ওপর ডালপালা মেলেছে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির ঝরাচ্ছিল। কিছুটা এগিয়েই সাত্যকি বুঝতে পারছিল তার গতি কমাতে হবে এবং পিউ নিয়মিত জগিংয়ে সম্ভবতঅভ্যস্ত নয়।

একটু পরে পিউ গতি বাড়াল। মুখে ধারালো হাসি। কাম অন ম্যান!

 উই আর জাস্ট রানিং!

 নো টক প্লিজ! দা নর্মস।

ইয়া! বাট…দ্যাটস্ নট জগিং।

ওক্কে। পিউ অগত্যা গতি কমাল।

একটা গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় এবার ঝরঝরিয়ে বৃষ্টির মতো শিশির পড়ল। পিউ আপনমনে বলল, বৃষ্টি! ফাইন!

সাত্যকি বলল, নাহ। শিশির!

 অ্যাত্তো বেশি? আই ডোন্ট বিলিভ!

এগেন ব্রেকিং দা নর্মস

পিউ দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ সাত্যকি ঝোঁকের মুখে এগিয়ে গিয়েছিল। টের পেয়ে সেও থামল। হাসতে হাসতে বলল, রেস্ট নিন। আই অ্যাম কামিং ব্যাক।

পিউ আঙুল তুলে বলল, জামাইবাবুর গাড়িটা।

দেখেছি! কিন্তু আপনি হাঁপিয়ে পড়েছেন। :

 ভ্যাট! কলকাতায় রোজ লেকের ধারে পাক্কা দু রাউন্ড বাঁধা। পিউ এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়িটার দিকে। হঠাৎ চমকানো গলায় বলল, এ কী! এমন করে গাড়ির কাচ ভাঙল কে? দেখুন, দেখুন!

সাত্যকি ঝোপের দিকে এগিয়ে এল। গাড়ির সামনে পেছনে পাশে সব কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। সে বলল, প্রিয়দা লুকিয়েছে, বুঝলেন? পাছে আমরা। হইচই করি। সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। দৈবাৎ বেঁচে গেছে। দেখছেন ব্যাপারটা? আমার ধারণা, ট্রাক-ফ্রাকের সঙ্গে কলিসন। তাই না?

আমার তা মনে হচ্ছে না!

কেন বলুন তো?

চারদিকের কাচ ভাঙল কী ভাবে?

সাত্যকি হাসল। একই ট্রাক ব্রেক ফেল করা গাড়িটাকে চারদিক থেকে চুঁ মেরেছে আর কী! জাস্ট ইমাজিন দা সিন।

পিউ গাড়িটার চারদিকে ঘুরে এসে বলল, বড়িতে ধাক্কার কোনও চিহ্নই নেই। তা ছাড়া জামাইবাবুর ভার্সানের সঙ্গে মিলছে না। গাড়ির মুখ রাস্তার দিকে ঘুরে গেছে। এটা মিস্টিরিয়াস না? ওই ঝোপটা দেখুন। ওখানে গিয়ে আটকেছিল। স্ট্যাম্পড়।

ধাক্কা খেয়ে ঘুরে গেছে। একটা পর একটা ধাক্কা। ট্রাক ড্রাইভার ড্রাংক ছিল আর কী!

ভ্যাট! আপনি ব্যাপারটা ভাল করে দেখছেন না!

সাত্যকি সিরিয়াস ভঙ্গিতে গাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখে বলল, একটা এক্সপ্ল্যানেশন মাথায় আসছে। বলব?

কী? পিউ আনমনে প্রশ্নটা করল।

 কেউ বা কারা রাস্তার ধারে গাড়ি পড়ে থাকতে দেখে চুরির চেষ্টা করেছিল। না পেরে রাগে কাঁচ-ফাচ গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। আনাড়ি চোরেদের কীর্তি! হয়তো ভেতরে মালফাল আছে ভেবেছিল।

পিউ ব্যাখ্যাটি মেনে নিয়ে বলল, ভাগ্যিস পরে কোনও এক্সপার্টকে এনে এঞ্জিন খুলে নিয়ে যায়নি! পি জি সায়েবের কোম্পানি যা কিপটে।

সাত্যকি মুখ দিয়ে একরাশ ভাপ ছেড়ে বলল, তা হলেও প্রিয়ার কোম্পানির গাড়ি! ডোন্ট ওরি! চলুন, অন্তত ক্যানেল অব্দি ঘুরে আসি। পা নিসপিস করছে।

সে একখানে দাঁড়িয়ে জগিংয়ের ভঙ্গি শুরু করল। পিউ গাড়ির কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তার পিচে ঘন ঘাস ঠেলে এসেছে। হঠাৎ পায়ের সামনে ঘাসের ওপর ঝুঁকে পড়ল পিউ। বুড়োদা! দেখুন তো! আমার মনে হচ্ছে…ও মাই! ব্লাড নাকি?

ব্লাড? ইমপসিবিল! প্রিয়দার গায়ে কোনও আঁচড়ই লাগেনি।

আহ্! দেখুন না প্লিজ!

অগত্যা সাত্যকি দেখতে গেল। শিশিরভেজা ঘন ঘাসের ওপর কয়েক জায়গায় একটু করে লালচে ছোপ টলটল করছে। সাত্যকি পরীক্ষা করে দেখে বলল, দিস অলসো আই ক্যান এক্সপ্লেন!

ব্লাড মনে হচ্ছে না?

পিউয়ের কণ্ঠস্বরে ছটফটানি ছিল। সাত্যকি হাসতে হাসতে বলল, ব্লাড হোক বা নাই হোক, উই আর গেটিং এক্সাইটেড। এনিওয়ে, কাচ ভেঙেছে যারা, তাদেরই কারও ব্লাড।

কিন্তু গাড়ির গায়ে ব্লাড নেই কেন?

 ভাঙা কাচ ছিটকে এসে ওদের কারও হাতে-টাতে লেগেছিল। ছেড়ে দিন। সময়মতো প্রিয়দা এসে গাড়ির ব্যবস্থা করবে। চলুন, ক্যানেল-ব্রিজে ঘুরে আসি ততক্ষণ।

 আবার দুজনে জগিং শুরু করল। কুয়াশা একটু ফিকে হয়েছে। কনকনে হিম মুখে ঝাপটা মারছে। পিউ মাথায় জড়ানো রেশমি স্কার্ফটা বরাবর টেনে দিচ্ছিল মুখের দুপাশে। সাত্যকির মতো ভাপ ছাড়ছিল। সাত্যকি ইচ্ছে করেই গতি কমিয়েছে। কিন্তু পিউয়ের পক্ষে আর জোর দেখানো সম্ভব ছিল না। অভ্যাস নেই নয়, পরিবেশ আলাদা হলে মন এবং শরীরও অন্যরকম হয়ে যায় যেন।

ক্যানেলের ব্রিজের মুখে কুয়াশায় একটা মূর্তি ভেসে উঠল। মাথায় জাবদা মাংকি ক্যাপ, গলায় আঁটো করে মাফলার জড়ানো, হাতে দস্তানা, চোখে চশমা, পরনে জ্যাকেট এবং আঁটো প্যান্ট। বেঁটে মোটাসোটা মানুষ।

পিউ নাকি?

ডাক শুনে পিউ থমকে দাঁড়াল। সাত্যকি থামল না। ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। পিউ বলল, গণাদা! মাই গুডনেস! তুমি মর্নিংওয়াক করো নাকি? ভবে যায় না। এই হেভি ফগের মধ্যে তুমি…!

পিউ একটু হাঁফাতে হাঁফাতে জোরালো একখানা হাসি দিল। গণনাথ হাসলেন না। চাপাস্বরে বললেন, হ্যাঁ রে! তোদের ওখানে রাত্তিরে কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

পিউ অবাক হয়ে বলল, গণ্ডগোল! কেন? তুমি কি বলছ বুঝতে পারছি না।

আনু রাত প্রায় সওয়া এগারোটা নাগাদ মাতাল অবস্থায় বাংলো থেকে বেরিয়েছে। গণনাথ ভাঙা গলায় বললেন। তারপর আর পাত্তা নেই। হোল নাইট আমি জেগে আছি ওর জন্য।

পিউ ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। একটু পরে বলল, আনুদা তো আমাদের ওখানে যায়নি!

তুই সিওর? মানে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর..

হাত নাড়ল পিউ। নাহ্। যায়নি। জামাইবাবু ফিরল, তখন প্রায় বারোটা।

বারোটা! কিন্তু আমাকে মিট করে গেল জাস্ট এগারোটায়। এটুকু রাস্তা গাড়িতে যেতে একঘণ্টা লাগল? তুই ভুল করছিস।

পিউ জোর দিয়ে বলল, নৌ। নীচের হলঘরের ওয়ালক্লকে তখন বারোটা বাজছিল। ভগীরথদা ওকে ওপরে রেখে গেল। তবে একঘণ্টা লাগার কারণ আছে। বুঝতে পেরেছি।

গণনাথ সিগারেট বের করে বললেন, পথে কিছু…।

বলছি। পিউ বিরক্ত হয়ে বলল। বলতে দেবে তো? গাড়ির ব্রেক ফেল করেছিল, ঝোপে ধাক্কা মারে। খুব বেঁচে গেছে জামাইবাবু। তারপর হেঁটে ফিরেছে। তুমি তা জান, পি জি সায়েব এক পা হাঁটতে পারে না!

সিগারেট জ্বেলে গণনাথ বললেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না আনু কোথায় যেতে পারে?

পিউ হাসল। বিবির মুখ দেখার চান্স আছে বলে কেটে পড়েছে। ট্রেনে বা বাসে।

কী বলছিস? ওর ব্যাগ-ফ্যাগ সব পড়ে আছে বাংলোয়।

আনুদাকে তুমি এখনও চেন না দেখছি! হি নাথিং কেয়ারস ফর। বিশেষ করে ব্যর্থ প্রেমে ফিউরিয়াস।

অনিচ্ছায় হাসলেন গণনাথ। তুই বড্ড পেকে গেছিস।

বাট দিস ইজ টুথ। আই নো।

হুঁ, তুই তো জানবিই। কিন্তু কোনও মানে হয় বল পিউ? গণনাথ পা বাড়ালেন। আয়, বড্ড ঠাণ্ডা। বাংলোয় গিয়ে কফি খাবি। তারপর তোকে নিয়ে গাড়ি করে বেরুব। তোর পি জি সায়েব বলেনি আমাকে লাঞ্চের নেমন্তন্ন করে এসেছে?

কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে পিউ একটা ভঙ্গি করল শুধু।

আয়, তোর সঙ্গীকেও ডেকে নে। নাইস চ্যাপ। কী যেন নাম?

 বুড়োদা। সরি, সত্যকি। কিন্তু একটা কথা গণাদা, ওকে তুমি ডাকবে। ও যদি যায়, তবে আমি যাব। কেন বুঝতে পারছ তো? পিউ চোখে হাসল। ম্যানার্স, গণাদা!

গণনাথ আবার গম্ভীর হলেন। ব্রিজে সাত্যকি রেলিঙে একটা কনুই রেখে নীচের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। গণনাথ এবং পিউকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। গণনাথকে নমস্কার করে বলল, দাদা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন?

না রে ভাই! আমার গরুটি হারিয়েছে। খুঁজতে বেরিয়েছিলুম।

 পিউ হেসে উঠল। থামো! কলকাতা ফিরে আনুদাকে বলব, গণাদা তোমায় গরু বলেছে।

সাত্যকি বলল, এনিথিং রং?

গণনাথ বলার আগে পিউ বলে দিল, আনুদা রাত্তিরে উধাও।

 হু ইজ হি?

 নাও বোঝাও। কাল বিকেলে যাকে বক্সিং বোঝাচ্ছিলেন, তাকে এরই মধ্যে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কারণ সে আপনাকে রাগিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, বক্সিং-টক্সিং রিয়্যাল লাইফে ইউজলেস!

সাত্যকি শুকনো হাসল। ও! অনির্বাণবাবু। তবে ইউ আর নট কারেক্ট পিউ। আমি রাগিনি। উনিই রেগে অস্থির। একটু অ্যাংগ্রি টাইপ যেন।

 ইয়া। অ্যাংগ্রি ম্যানরা যা হয়। গণাদার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে….

গণনাথ বাধা দিলেন। নাহ্। একটুও ঝগড়াঝাটি হয়নি। সাত্যকিবাবু, বাংলোয় আসুন। স্ট্রং কফি খেয়ে আপনাদের গাড়িতে পৌঁছে দেব।

সাত্যকি বিনয়ে বলল, দাদা! চা কফি-সিগারেট আমার চলে না। তবে বললেন যখন, যাচ্ছি। অবশ্য গাড়িতে আমি চাপব না। পেছন পেছন দৌডুব।

বাংলোয় পৌঁছে গণনাথ রামলালকে ডেকে কফি করতে বললেন। তারপর ঘরে ঢুকে পিউকে অনির্বাণের বিছানা দেখালেন। জাস্ট লুক! হতচ্ছাড়া যেমন বেখে গেছে তেমনি অবস্থায় আছে।

পিউ লক্ষ করে বলল, কম্বলটার অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয় ঝগড়া হয়েছে। তুমি না বললেও শুনব না। বুড়োদা! দেখছেন? হঠাৎ রেগে গিয়ে কম্বল থেকে বেরুলে তবেই কম্বলের পজিশন এমন হতে পারে!

গণনাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই মহা গোয়েন্দা!

পিউ অনির্বাণের বিছানার চারদিকে ঘুরে বলল, আই হ্যাভ মাই আইজ মাই ডিয়ার গণাদা!

সাত্যকি সায় দিয়ে বলল, আছে। বুঝলেন দাদা? প্রিয়দার গাড়িটা যেখানে পড়ে আছে, সেখানে ঘাসের ওপর রক্তের দাগ। অ্যান্ড পিউ ডিসকভার্ড ইট! আমি তো দেখতেই পেতুম না।

গণনাথ চমকে উঠে বললেন, রক্তের দাগ?

পিউ বলল, গাড়ির কাচ-ফাচ কিচ্ছু নেই। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে কারা। বুড়োদা বলছে চোর। তা-ই হবে।

কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে? খুব আস্তে টেনে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন গণনাথ।

সাত্যকি হাসল। সমস্ত কাচ। কিন্তু সিওর, অ্যাকসিডেন্ট নয়। প্রিয়দা ইনট্যাক্ট আছে। ব্রেক ফেল করে ঝোপে ধাক্কা মেরেছিল। তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে।

গণনাথ চশমার ভেতর থেকে নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন, প্রিয় কাচ ভেঙে যাওয়ার কথা বলেনি? ধাক্কা মারলে তো কাচ ভাঙতেই পারে।

পিউ ড্যামের দিকের জানালায় গিয়ে বলল, যাবার পথে দেখে যেও।

 কিন্তু রক্তটা এল কোত্থেকে?

সাত্যকি হাতের গ্লাভস খুলে টেবিলে রেখে আঙুলের ব্যায়াম করতে করতে বলল, দ্যাট ইজ অলরেডি এক্সপ্লেনড। চোরেরা গাড়ি নিয়ে না যেতে পেরে রাগের চোটে কাচ ভেঙেছে। কাঁচের টুকরো ছিটকে এসে হাতে-ফাতে লেগেছে। সিওর!

গণনাথ চুপ করে রইলেন। রামলাল ট্রেতে কফি দুধ চিনি চামচ কাপ-প্লেট সুন্দর করে সাজিয়ে এনেছিল। পিউ হাতের পশমি গ্লাভস খুলে বলল, আমার ব্ল্যাক কফি। বুড়োদা, আমার অনারে জাস্ট ওয়ান অর টু সিস্! প্লি-ই-জ!

সাত্যকি মাথা নাড়ল। আপনার অনারে এখন ড্যামে সাঁতার কাটতে বলুন, আই উইল ডু দ্যাট।

পিউ চোখে হাসি এনে বলল, বাট ইউ আর টপ টু বটম ইয়াংকি! ব্ল্যাক কফি ছাড়া ইয়াংকি হয় না!

আপনি স্টেটসে ছিলেন মনে হচ্ছে?

গণনাথ অন্যমনস্কভাবে কফিতে দুধ মেশাচ্ছিলেন। চেষ্টাকৃত কৌতুকে বললেন, ওর দাদা-বউদির কাছে দিন-চারেক ছিল শুনেছি। কোথায় যেন রে?

শাট আপ! পিউ ফুঁসে উঠল। মাসকে দিন কোরো না।

গণনাথ একটু রিলিফ চাইছিলেন রাতের টেনশন থেকে। বললেন, এনিওয়ে, চার মাসেই ও ইয়াংকি-ফিয়াংকি চিনে গেছে। তবে ফেরার পর আরও মাস চারেক ওর ইন-ডেথ নলেজের চোট খেতে খেতে আমরা অনেকেই জেরবার হয়েছিলুম।

সাত্যকি পিউকে দেখছিল। বলল, সেই! তো মাত্র চার মাস কেন?

শোনা কথা। গণনাথ কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ওর দাদা নিয়ে গেল পড়াশুনোর জন্য আর ও নাকি হলিউড-হলিউড করে অস্থির। কোথায় ওয়েস্ট কোস্টে হলিউড, কোথায় ইস্ট কোস্টে…জায়গাটার নাম কী যেন? বল্ পিউ!

পিউ কাপ তুলে বলল, ছুঁড়ব গণাদা! তুমি বলেছিলে আমি হিস্টেরিক টাইপ। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!

 সাত্যকি কাপে একটু লিকার ঢেলে ফর ইওর অনার বলে চুমুক দিল। তারপর তেতো গেলার ভঙ্গি করল মুখে। কাঁধে ঝাঁকুনি দিল।

গণনাথ আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুঝলি পিউ? আমার মনে হচ্ছে না আনু কলকাতা চলে গেছে। বলে উঠে গেলেন অনির্বাণের বিছানার দিকে। বালিশ তুলে দেখে বললেন, এই দেখ ওর সিগারেট দেশলাই! এক মিনিট। ওর কিটব্যাগটা দেখাচ্ছি তোকে।

কিটব্যাগের চেন খুলে কয়েকটা গোটানো জামা-প্যান্ট, একটা পুলওভার বের করলেন গণনাথ। পাশের চেন খুলে একটা ছোট্ট নোটবই, জটার পেন, দুটো চিঠি বেরুল। তারপর বেরুল মানিব্যাগ। গণনাথ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, পিউ! আনু কলকাতায় যায়নি এগুলো তার প্রমাণ।

সাত্যকি সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ! মানিব্যাগ রেখে কলকাতা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দাদা, আমার মনে হচ্ছে, এখনই টাউনশিপে গিয়ে পুলিশকে জানানো দরকার। এরিয়ায় ক্রিমিনালদের প্রচণ্ড উৎপাত হয়েছে আজকাল। কিছু বলা যায় না। সঙ্গে টাকা থাকা বরং সেইফ। টাকা না পেল তো রেগে স্ট্যাব করে গঙ্গায় ফেলে দিল।

পিউ বলল, ইউ আর গোয়িং টু-উ ফার! গণাদা! বুড়োদা আনুদাকে জানে না, বাট ইউ নো হিম ওয়েল।

গণনাথকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বললেন, কিন্তু ও ড্রাঙ্ক ছিল, সেটাই প্রবলেম।

একটু ইতস্তত করে পিউ আস্তে বলল, আনুদার আছে ফায়ার আর্মস দেখেছি।

থাকতে পারে। আমি দেখিনি। গণনাথ এসে কফিটুকু এক চুমুকে শেষ করলেন। তারপর পা বাড়িয়ে বললেন, ফায়ার আর্মস পকেটে নিয়ে কেউ বিছানায় শুতে যায় না।

পিউ উঠে গিয়ে অনির্বাণের বিছানাটা খুঁজতে শুরু করল। তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর হতাশ ভঙ্গিতে বলল, যত দোষ তোমার গণাদা! যাকে ট্যাক্স করতে পারবে না, তাকে সঙ্গে কেন আনলে? যদি বা আনলে, তাকে ড্রাঙ্ক অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দিলে কেন? সমস্ত রেসপন্সিবিলিটি কিন্তু তোমার।

তুই ঠিকই বলেছিস, পিউ! কিন্তু…..

 গণনাথ থেমে গেলে পিউ বলল, কিন্তুটা কী? আনুদা ফিল্মের কী বোঝে যে তাকে সঙ্গে না আনলে চলত না? তোমার একটা কিছু মোটিভ ছিল। নিশ্চয় ছিল।

মাথা খারাপ করিস নে পিউ! আমাকে ভাবতে দে।

 সাত্যকি উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাভস পরছিল। বলল, আপনি থানায় খবর দিন, দাদা। দেরি করা ঠিক নয়।

রামলাল বারান্দায় বসে রোদের প্রতীক্ষা করছিল। ওরা বেরুলে সে একটু কেশে গণনাথের উদ্দেশে বলল, স্যার! কৈ বুরা না সমঝাইয়ে তো হম কুছ বোলনে চাহতা।

গণনাথ তার দিকে তাকালেন। পিউ থমকে দাঁড়াল। সাত্যকি লনে নেমে নুড়ির ওপর জগিংনাচ নাচতে থাকল। নুড়িগুলি খড়খড় শব্দে নড়তে লাগল।

কাঁচুমাচু মুখে রামলাল বলল, রাতমে হম কিনিকি আওয়াজ শুনা।

গণনাথ অবাক হয়ে বললেন, কিচনি?

জি হাঁ। লিটনসাবকা কোঠিকি বিচমে কিনি রতি স্যার। পানিমে ছুপা রহতি। কভি কভি চিল্লাতি! রামলাল করুণ হাসল। সবকো পুছকে দেখিয়ে সাচ কি ঝুট। তো কিচনি জব চিল্লাতি, কোই না কোই আদমিকা জান জাতা। উনহিকো পুছিয়ে। মালুম হো জায়গা! সে তর্জনী তুলল সাত্যকির দিকে।

সাত্যকি শুনছিল। একটু হেসে বলল, সুপারস্টিশন দাদা! কিচনি হচ্ছে জলের পেত্নী! ঠাকুর্দার কাছে শুনবেন।

পিউ দ্রুত বলল, হুঁ, কাল রাত্তিরের সাত নম্বর গল্পের জাস্ট ইনট্রো। কিন্তু আনুদা নাম্বার ওয়ান মামদো। ডোন্ট ওরি গণাদা! এমনও হতে পারে, টাউনশিপে কোনও বন্ধু আছে ওর। তোমার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে…

আহ। বলছি ঝগড়া হয়নি। বলে গণনাথ লনের ওধারে গ্যারেজঘরের দিকে গেলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটের কাছে এলেন। রামলাল গিয়ে গেটটা পুরো খুলে দিল। পিউ সামনে উঠে বসল। সে উইন্ডোতে মুখ বার করে সাত্যকির দিকে তাকাল। সাত্যকি গাড়িতে যাবে না। পেছন থেকে গলাটা চড়িয়ে বলল, দাদা! সোজা থানায় চলে যান।

রাস্তায় পৌঁছে গণনাথ বললেন, হুট করে থানায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। বুঝলি পিউ? আমি অন্য একটা অ্যাঙ্গল থেকে চিন্তা করছি। আগে প্রিয়র সঙ্গে কথা বলে দেখি, সত্যি কী ঘটেছিল রাত্তিরে। খামোকা হইচই বাধানো উচিত নয়। বিশেষ করে তোর এ পয়েন্টটা আমার মনে ধরেছে। বাউণ্ডুলে হতভাগার কোথায় যে বন্ধু নেই, বলা কঠিন। গতবার কিরিবুরুতে গেলুম বাঙালি উদ্বাস্তু নিয়ে ডকুমেন্টারি তুলতে। গিয়ে অবাক। অন্তত এক ডজন বন্ধু বেরুল ওর।

পিউ মাথায় জড়ানো স্কার্ফ ঠিক করে নিয়ে বলল, আনুদা বরাবর তোমার বডিগার্ড।

সে কথায় কান না করে গণনাথ বললেন, প্রিয়র গাড়িটা দেখিয়ে দিবি। লক্ষ রাখ।

কুয়াশা কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। বাঁদিকে সূর্য ওঠার আভাস। ক্লিফটনের কুঠিবাড়ি টিলা পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পিউ বলে উঠল, রোখো। রোখো! এখানেই তো গাড়িটা ছিল। ম্যাজিক? যা বাব্বা! গাড়িটা উধাও হয়ে গেল?

গণনাথ গাড়ি দাঁড় করালেন। পিউ ব্যস্তভাবে নেমে গেল। সেই ছত্রখান ঝোপঝাড়। অজস্র কাঁচের টুকরো আর কুচি ছড়ানো অনেকটা জায়গা জুড়ে। গণনাথ নেমে গিয়ে বললেন, হুঁ! কিন্তু রক্তের দাগ কোথায় দেখেছিলি?–

পিউ ঝুঁকে ঘাস দেখছিল। সোজা হয়ে বলল, ম্যাজিক! কিছু নেই। আশ্চর্য তো!….

.