পিছনে পায়ের শব্দ – ২

০২.

 চিয়ার্স বলে গণনাথ গেলাস তুলে ধরলেন। চশমার পুরু কাচ ভেদ করে চোখ থেকে উজ্জ্বল হাসি ঠিকরে পড়ছিল। চুমুক দিয়ে বললেন, কী হল রে তোর? উত্তর না পেয়ে ফের চুমুক দিলেন। রাশভারি বেঁটে গাব্দা মানুষ। অনির্বাণ দু হাতের মুঠোয় গেলাস চেপে ধরে বসে ছিল। দৃষ্টি সোনালি পানীয়ের দিকে। গণনাথের দ্বিতীয় চুমুকের পর সে নিজের গ্লাসে চুমুক দিল। তারপর বলল, শুওরের বাচ্চা!

আমাকে বলছিস?

নাহ। অনির্বাণ টেবিলে রাখা গণনাথের বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টেনে নিল। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিঙ তৈরির চেষ্টা করে বলল, আমার মুড নষ্ট হয়ে গেছে, বিলিভ মি গণাদা!

গণনাথও সিগারেট ধরালেন। তোর মুড বলে কোনও বস্তু আছে নাকি? কিন্তু ব্যাপারটা কী?

অনির্বাণ আরেক চুমুক টেনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বলল, আই মাস্ট কিল দা ডার্টি ডগ।

গণনাথ একটু ঝুঁকে এলেন টেবিলের ওপর। তুই কি প্রিয়র কথা বলছিস?

বলছি।

কিন্তু তার সঙ্গে তোর দেখাই হয়নি! তা ছাড়া সে-বেচারা হঠাৎ ভূতের মতো তোকে পেলই বা কেন?

অনির্বাণ তেতোমুখে বলল, তুমি মাইরি যত নাটের গুরু! আই ভেরি মাচ ডাউট, তুমি ওকে জানিয়েছিলে এখানে আসছ। আমার আসার কথাও বলেছ।

শাট আপ! গণনাথ ধমক দিলেন। মাতলামি করবিনে। ড্যামের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

বাট দিস ইজ সিরিয়াস গণাদা! প্রিয় এখানে কেন?

সে আমি কেমন করে জানব? বলে গণনাথ খিক খিক করে হাসলেন। আনু! আপন গড়, প্রিয়র শালীকে আমি কুসমির রোলটা দেব।

তোমার পাঠা। তুমি ন্যাজে কাটবে না মুড়োয়, সে নিয়ে আমি ডোন্ট বদার। তৃতীয় চুমুক দিল অনির্বাণ। এবার সিগারেটের ধোঁয়ার রিঙ বানাতে পারল। বাঁকা হাসল সে। লুকিও না গণাদা! প্রিয়র বস তোমার ছবির ফাইন্যান্সার। পিউ আমাকে বলেছে।

প্রিয়র সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?

অনির্বাণ আস্তে বলল, বোঝা যাচ্ছে তুমি আমার কথা ওদের বলেছ।

গণনাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, প্রিয়র সঙ্গে তোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার ব্যাপারটা জড়াবিনে আনু! 

অনির্বাণ একটা জোরালো চুমুক দিয়ে হেলান দিল। সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, শুওরের বাচ্চা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি, শালীকে টোপ করতে নিয়ে এসেছে।

ফিক করে হাসলেন গণনাথ। তুই তো দিব্যি টোপ গিলে ফেলেছিস প্রায়।

 ধুস! কে কাকে গিলতে পারে?

বিবিকে গোঁয়ার্তুমি করে হাতছাড়া করেছিস। পিউকে করিসনে। গণনাথ. হাসতে লাগলেন। আমার ধারণা, পিউ তার দিদির মতো ট্রেচারাস নয়। স্ট্রেইট অ্যান্ড ওপেন। আমার তেমন বয়স আর ইমোশন থাকলে..না রে! পিউ সত্যি। বড়ো ভাল মেয়ে।

মাতলামি তুমিই করছ কিন্তু!

তুইও কর। বাপের জন্মে স্কচ খেয়েছিস? খা। এই নে! গণনাথ ওর গেলাসটা প্রায় কেড়ে নিয়ে খানিকটা ঢাললেন। সোড়া-ওয়াটার যত্নে মিশিয়ে বললেন, আমার মেজাজ চাঙ্গা হয়ে গেছে লোকেশন দেখে। ওয়াটার ড্যাম, টিলা-পাহাড়, নদীর চর, হাঁসের ঝাক। নেচারকে কীভাবে ছবিতে আনি দেখবি।

অনির্বাণ বলল, মর্নিঙে তুমি পিউদের ওখানে যাবে নাকি?

 যাব। পিউ যা বলল, ওই রকম একটা পুরনো বাড়িও তো আমার চাই।

বুঝতেই পারছ আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

গণনাথ একটু গম্ভীর হলেন। না। বিবি না থাকলে কথা ছিল। তুই আমাকে তত ক্যালাস ভাবছিস কেন?

তারপর ওই শুওরের বাচ্চাটার এই ইরিগেশন বাংলোয় যাতায়াতের চান্স বাড়বে। অনির্বাণ সোজা হয়ে বসল। কাজেই আমি মর্নিঙে কাট করছি।

হাত বাড়িয়ে ওর জ্যাকেট আঁকড়ে গণনাথ বললেন, তোর মাথা খারাপ? আমাকে একা ফেলে চলে যাবি?

অনির্বাণ গলার ভেতর বলল, তোমার ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না কিছু।

 মিটিমিটি চোখে হেসে গণনাথ বললেন, তুই থাকলে ওই ফেঁপরদালাল প্রিয় আমার তত কাছে ঘেঁসবে না। ক্লিয়ার?

নাহ্। আমি ওসবে নেই। বুঝি না।

হাঁদা! মোহনলালজি, ধর কথার কথাই বলছি, প্রিয়কে আমার ব্যাপার। স্যাপার বুঝে নিতেও পাঠাতে পারেন। মানে, সত্যিই আমি ছবি করতে চাইছি, নাকি অসীম হারামজাদার মতো মুভি ক্যামেরা দেখিয়েই হাজার দশেক…ও! তুই তো ব্যাকগ্রাউন্ড জানিস না। লেট মি এক্সপ্লেন।

অনির্বাণ বলল, ছাড়ো! মাইরি গণাদা, তুমি পেটে-পেটে এত! শ্বাস ছাড়ল সে। সিগারেট অ্যাসট্রেতে ঘসটে নিভিয়ে বলল, ওকে। প্রিয়কে আমি তোমার ত্রিসামানায় ঘেঁসতে দেব না।

তোর কিছু করার দরকার না হতেও পারে। তুই আমার সঙ্গে আছিস, এই যথেষ্ট।

অনির্বাণ মাতালের হাসি হাসল। কিন্তু ভেবে দেখ, তোমার ফাইন্যান্সারকে শালা গিয়ে বিগড়ে দিলে?

গণনাথ হেসে ফেললেন। অতটা এগোলে তুই আছিস কী করতে?

অনির্বাণ আরেকটা সিগারেট টেনে নিয়ে বলল, বিবিকে পুরো বিধবা করাটা ঠিক হবে না। তবে হাফ-বিধবা করা চলে। সে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এল গণনাথের দিকে। চোখ নাচিয়ে ফের বলল, বলো তো কালই ওকে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারি। দেব নাকি?

 মাতাল হয়ে গেছিল তুই! চুপ কর। গণনাথ নিজের গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন। অন্য কথা হোক। লোকেশন, স্যুটিং প্রোগ্রাম। হারে, তুইতো চিত্রনাট্য পড়েছিস। কুসমির রোলে পিউ চলে না?

চলে। যদি শুওরের বাচ্চা বেগড়বাই না করে।

ভ্যাট। পিউকে তুই কী বুঝেছিস?

শি ইজ চার্মিং অফ কোর্স! অনির্বাণ সিরিয়াস ভঙ্গি করে বলল। একটু জংলি-জংলি ভাবও আছে। তবে তুমি তো গুরুদেব মাইরি! কত বেড়ালকে বাঘিনী বানিয়েছ। কই, ঢালো!

আর খাসনে।

ছাড়ো। তিন পেগও হয়নি। ঢালো!

গণনাথ অল্প একটু ঢেলে প্রায় আধবোতল সোডা-ওয়াটার মিশিয়ে দিলেন। তারপর নিজের গেলাস হাতে নিয়ে পশ্চিমের জানালায় গেলেন। পর্দা সরাতেই ঠাণ্ডা হাওয়া তাকে ছুঁল। ওদিকটায় নীচে ড্যাম। কাছে ও দূরে এদিক-ওদিকে কুয়াশার ভেতর আলো জুগজুগ করছে। ড্যামের জলে নক্ষত্রের অজস্র টুকরো। গুনগুন করে গান গাইতে থাকলেন গণনাথ।

একটু পরে টের পেলেন অনির্বাণ নিজেই হুইস্কি ঢালছে। বললেন, মারা পড়বি। ডিনারে হেভি মুর্গির মাংস আছে, ডোন্ট ফরগেট।

অনির্বাণ হাসল। দুটো দিন বৈ তো নয়, গুরু। কলকাতায় তুমি আমাকে স্কচ খাওয়াচ্ছ, এ দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না।

তুই নেমকহারাম! বলে গণনাথ ড্যামের দিকে ঘুরলেন। একটু পরে মুখ না ঘুরিয়েই বললেন, হ্যাঁ রে আনু! বিবি তোর হাত ফসকাল কী করে? প্রিয় কেড়ে নিল, দ্যাট আই ডোন্ট বিলিভ!

প্লিজ গণাদা! আর তেতো করো না। মুড এসে গেছে। শি ইজ আ হোর!

গণনাথ ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, তুই বিবিকে…ছিঃ!

হুঁউ, তুমি বড়ো মর‍্যালিস্ট। অনির্বাণ মাতালের হাসি হাসল। গায়ে ফোস্কা পড়ল যেন। কিন্তু হোরকে কী দেবী বলে পুজো করব? তুমি কী জানো ওর? পুঁথি খুলব?

গণনাথ কাছে এসে বললেন, পিউকে সব বলে দেব।

বয়ে গেল! বুড়ো আঙুল নাড়ল আনির্বাণ। সে মাতাল হয়েছে একটু। জড়ানো গলায় বলল, পিউয়ের সঙ্গে বড় জোর ওপর-ওপর একটু…আই মিন জাস্ট ফ্লার্টিং…তবে রিয়্যালি শি ইজ লাভলি! সো সিম্পল! জান গণাদা, তখন ঝাউগাছগুলোর আড়ালে হঠাৎ আমার সঙ্গে একা পড়ে যেতেই…ওঃ! ওই যে কী বলে, সে একটা চরম মুহূর্ত এসে গিয়েছিল।

গণনাথ মুখে দুষ্টুমি এনে চাপা স্বরে বললেন, বিবিকে প্রিয় লুঠে নিয়েছে। তুই পিউকে নে। আমি কথা দিচ্ছি, কোঅপারেট করব।

সে-কথায় কান না দিয়ে অনির্বাণ বলল, চরম মুহূর্ত বললুম। তুমি মাইরি ধরতেই পারলে না। আমি বলতে চাইছিলুম, কোনও-কোনও সময়ে সুন্দর। ইনোসেন্স গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সে শুকনো হাসল হা হা শব্দে। তোমায় যদি বলি, বিবির মধ্যেও এটা ছিল? সে নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকাল। আমিই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলুম।

গণনাথ তার চুল খামচে ধরে বললেন, আর একটা কথা নয়। দে, গেলাস দে। আমারই ভুল হয়েছে।

কিসের ভুল? কেমন গ্লাসনস্ত চালিয়ে যাচ্ছি দেখ তুমি! সে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। আহ্, জেন্টলম্যান হও, গুরু। বসো ভদ্রলোকের মতো।

গণনাথ ওর গেলাসের পানীয় ঝটপট নিজের গেলাসে ঢেলে একটু তফাতে গেলেন। বললেন, শীত না হলে এখন তোকে কুঠিবাড়ির ছাদে গিয়ে তুলতুম। মাথা ঠিক হয়ে যেত।

আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে অনির্বাণ বলল, সেটা আবার কী জিনিস?

সুইসাইড করার জায়গা।

মাই গড! তুমি আমায় মরতে বলছ?

 বলাই ষাট! গণনাথ হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁলেন। কাল দুপুরে ওই লোকেশনটাও তোকে দেখিয়ে আনব। মাথা ঘুরে যাবে। কুঠিবাড়ির পেছনকার দেয়ালের নীচেই গঙ্গা! অজিতদা ক্রেনের সাহায্য একটা মারপিটের সিকোয়েন্স তুলেছিল। সে এক হরিবল এক্সপিরিয়েন্স।

অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দম আটকে আসছে। একটু বাইরে ঘুরে আসি।

 যাসনে। ভীষণ ঠাণ্ডা। ড্যামের হাওয়া ডিসেম্বরে। হাড় খুলে যাবে।

অনির্বাণ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সে টলছিল। পর্দা জোরে দুলতে থাকল। গণনাথ ঘড়ি দেখে গেলাস শেষ করতে মন দিলেন। একটু পরে অনির্বাণের হাক শোনা গেল, কে এখানে? চৌকিদার! দেখ তো ওটা কে?

গণনাথ উঠে কিটব্যাগ থেকে টর্চ নিয়ে বেরুলেন। লনের শেষে নিচু পাঁচিলের দিকে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে অনির্বাণ। বললেন, কী রে আনু?

চৌকিদার টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে দৌড়ে গেল। বাংলোর বারান্দার আলো লনের খানিকটা ছুঁতে পেরেছে মাত্র। কুয়াশার পর্দা চারদিকে। গণনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

চৌকিদার রামলাল নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে কাউকে ধমকাচ্ছিল। হেঁয়াপর ক্যা করতা এত্তা রাতমে? ভাগো! ভাগো!

অনির্বাণ ফিরে এসে লনের মাঝামাঝি দাঁড়াল। গণনাথ বললেন, কে?

কে জানে!

চৌকিদার হাসতে হাসতে বলল, পাগলা সাহাব স্যার! দিন ঔর রাত সবহি এক বরাবর। খালি ঘুমতে রহে! লেংড়া আদমি। ক্রাচপর নকলি পাও! হায়রে মালুম হোয় কি, আসলি পাঁও রনেসে ক্যা করতা উও?

গণনাথ বললেন, ও। সেই বুড়ো সায়েব।

জি। বেলিংটান সাহাব। পুরানা টৌন কি পাস ছোটিসি কোঠি। কভি হোঁশ, কভি বেহেশ…

তুম খানাকা বন্দোবস্ত করো রামলাল!

 জি, জরুর।

চৌকিদার পেছনের দিকে কিচেনে চলে গেল। গণনাথ বললেন, কী রে? তুই বুঝি ভেবেছিলি প্রিয় এসে ওত পেতেছে?

অনির্বাণ জুতোর ডগায় একটা নুড়ি ঠেলে দিয়ে বলল, তা হলে তো বিবি বিধবা হতই।

তুই কিন্তু সত্যি ভয় পেয়েছিলি! তোর গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছিল।

কী আশ্চর্য লোক তুমি মাইরি! আনির্বাণ চটে গেল। অন্ধকার রাতে ওই পাঁচিলের ওপর একটা মানুষের মাথা। চুপ করে থাকব?

হিম পড়ছে। উঠে আয়। বলে গননাথ ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।…

অনির্বাণের নিয়মিত মদ খাওয়ার নেশা নেই। কদাচিৎ সংসর্গ কি পরিবেশে তার খাওয়াটা হয়ে যায়। বেশি খেয়ে ফেললে সহ্য করতেও পারে না। তখন কিছুদিন প্রায় একটা প্রতিজ্ঞায় অটল থাকে। এ রাতে তত বেশি না খেলেও যেন অনেকটা নেশা হয়েছিল। মুর্গির মাংসের ডিনারে কিংবা আর কোনও কথা বলতেই বড়ো অনিচ্ছা, সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় গণনাথ তাঁর ছবির স্ক্রিপ্ট পড়ছিলেন, হাতে জটার পেম। মাঝে মাঝে তার দিকে ঘুরে বলছিলেন, ঘুমোলি? ও আনু! ঠিক আছে। ঘুমো।

অনির্বাণ চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়েছিল। সে দেখেছে, মদ্যপানের পর অনেকেই বেশ ঘুমিয়ে পড়ে। তার একেবারে উল্টো। অবশ্য বেশি নেশা হয়ে গেলে অন্য কথা এবং সে-অবস্থাকে ঠিক ঘুম বলা চলে না, একটা কদর্য ধরনের আচ্ছন্নতা। তা হলেও এ রাতে তেমনটা দরকার ছিল। উঠে গিয়ে আবার খাবে কি না, তাও ঠিক করতে পারছিল না। সমস্যা হল, যতবার অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করছে, তার ফাঁকে হঠাৎ-হঠাৎ প্রথমে পিউ এবং তার পিছনে বিবি এসে যাচ্ছে। ব্রিজের কাছে পিউকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার এখানে আসার আনন্দ আর আনুষঙ্গিক সমস্তটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। পিউ বিবির প্রতীক। দুই বোনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা তার জানা। হঠকারিতায় অমন একটা চিঠি লিখেছিল বিবিকে। বিবি সেটা পিউকে জানাবেই, ধরে নিয়েছিল অনির্বাণ। কিন্তু এখানে আজ তাকে দেখামাত্র পিউয়ের তীক্ষ্ণ চিৎকার ‘আনুদা’ এবং ছুটে আসা, পাখি যেভাবে কোনও গাছের দিকে উড়ে যায়! নাহ, পিউ চিঠির ব্যাপারটা জানে না। জানলে তার হাত ধরে ড্যামের ধারে ছুটোছুটি করত না। হুঁ, অনির্বাণকে পেয়ে বসেছিল পিউ। বিকেলের আলোয় নরম ও সুন্দর একটা ইনোসেন্স অনির্বাণকে ভাবাচ্ছিল, জীবনের কিছু কিছু ভাল ব্যাপার এখনও আছে, আবিষ্কার করে নিতে হয় অথবা দৈবাৎ আবিষ্কৃত হয়ে যায়।

পিউয়ের সঙ্গে যারা ছিল, নিশ্চয় বিরক্ত হয়েছে পিউয়ের ওপর। মফস্বলের ছেলেমেয়ে সব। বিশেষ করে ওই মহিলা, পিউ বলছিল রাণুদি, কেমন, চোখে অনির্বাণকে দেখছিলেন। দৃষ্টিটা ছুরির ডগার মতো ধারালো। পিউ জানে, অনির্বাণ ওদের আত্মীয়বাড়িতে যাবে না। তবু চোখে ঝিলিক তুলে অবাধে বলল, আনুদা! তুমি তো বরাবর আনপ্রেডিক্টেবল পার্সন। কাজেই তুমি যদি মাই ডিয়ার গণাদার সঙ্গে চারুভবনে হাজির হও, নাথিং উইল হ্যাঁন। তোমার ইচ্ছে। রাণুদি মানে মহিলাটি কী ভাবলেন কে জানে! এই সব মফস্বলি মহিলা ধুরন্ধর এবং নীতিবাগীশ। অনির্বাণ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।

গণনাথ ঘুরে বললেন, ঘুম হচ্ছে না? আর পেগটাক খাবি নাকি?

অনিবাণ সাড়া দিল না। আচ্ছা, যদি প্রিয়গোপালের হাতে পড়ে থাকে চিঠিটা? পড়তেও পারে। ওর এ ধরনের স্বভাব আছে, অনির্বাণ বুঝতে পারে। বিবি ওর সঙ্গে বিয়ের আগে একদিন কথায়-কথায় আভাসে বলেছিল, নিজের কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেল করে প্রিয়গোপাল। ঠিক ব্ল্যাকমেল কথাটা বলেনি। বলেছিল, কোম্পানির ভেতরকার অনেক কিছু ও জানে। তাই ওর কোম্পানিতে এত দাপট এবং প্রমোশনের পর প্রমোশন। হুঁ, ব্যাপারটা ব্ল্যাকমেলই দাঁড়াচ্ছে। একজন ব্ল্যাকমেলার নিজের স্ত্রীর নামে যাওয়া চিঠিপত্র, বিশেষ করে বিবির মতো স্ত্রীর, নিশ্চয় না পড়ে ছাড়বে না। তো পড়ে থাকলে আরও ভাল। জ্বলে মরুক ভেতর-ভেতর। তারপর একটা কিছু ঘটুক। ঘটে যাক।

এই সময় বাইরে কাছাকাছি গাড়ির শব্দ শোনা গেল। তার একটু পরে লনের নুড়িপাথরে পায়ের শব্দ। অনির্বাণ চোখ খুলল। গণনাথের মন স্ক্রিপ্টে। দরজায় টোকার শব্দে চমকে উঠে বললেন, রামলাল?

দাদা, আমি।

 গণনাথ ব্যস্তভাবে উঠে বললেন, কে?

আমি প্রিয়গোপাল।

গণনাথ হাসিমুখে এগিয়ে দরজা খুললেন। অনির্বাণ দ্রুত ঘুরে কম্বল মুড়ি দিল। প্রিয়গোপাল ঘরে ঢুকে বলল, আশাপুরায় গিয়েছিলুম। লালজির সঙ্গে ট্রাঙ্ককলে কথা বলছিলুম। শুনলুম আপনি ক্লিফটনগঞ্জে ইরিগেশন বাংলোয় উঠেছেন। প্রিয়গোপাল একটু হাসল। রাত এগারোটায় জ্বালাতন করতুম না। কিন্তু জানালায় আলো দেখলুম। চৌকিদারকে ডেকে জিজ্ঞেস করার পর সিওর হয়ে তবে নক করেছি।

না, না। তোমায় অত কৈফিয়ত দিতে হবে না। গণনাথ টেবিলের কাছে এলেন। বসো। তবে দুঃখিত, শীতের রাতে চাকফির বদলে স্কচ দিয়ে রিসিভ করতে চাইলে দোষ দিও না। কাম অন!

চেয়ারে বসে হাত নাড়ল প্রিয়গোপাল এবং একই সঙ্গে জিভ কেটে বলল, আমার চলে না, ইউ নো দ্যাট। আর ইয়ে, বেশিক্ষণ ডিসটার্ব করব না।

গণনাথ ভুরু কুঁচকে বললেন, তোমার লালজির কোনও মেসেজ আছে মনে হচ্ছে?

জাস্ট একটা কথা। সে কাল হলেও চলে। এমন কিছু জরুরি নয়।

 সিগারেট খাও।

থ্যাঙ্কস। ছেড়ে দিয়েছি।

ব্রিলিয়্যান্ট! গণনাথ হাসলেন। বলো শুনি!

 প্রিয়গোপাল ঘরের ভেতরটা দেখছিল। অনির্বাণের বিছানার দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, কে?

গণনাথ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট। হু, তোমার লালজির কথাটা বলো।

হাই তুলে প্রিয়গোপাল বলল, তেমন কিছু না। আপনার টাকাকড়ির দরকার হলে আমায় লক্ষ রাখতে বলেছেন। আমি উঠি, গণাদা!

সে উঠে দাঁড়ালে গণনাথ বললেন, বউ-শ্যালিকাসহ এসেছ। তোমার বউয়ের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। শ্যালিকাকে ছিনতাই করেছিলুম। লোকেশন স্পটে খুব ছুটোছুটি হল। তোমার দাদামশাইয়ের বাড়িটার কথা শুনে ভাল লাগল। মর্নিঙে যাচ্ছি। থেকো।

প্রিয়গোপাল জিভ কেটে বলল, এই রে! আমাকে ভোর ছটায় আমিনগঞ্জে যেতে হবে। ঠিক আছে। আপনার কোনও অসুবিধে হবে না। বিবি আছে। পিউ আছে। দাদামশাইও অসাধারণ মানুষ! সে দরজার দিকে এগিয়ে ঘুরে বলল ফের, দুপুরের দিকে দেখা হবে। বলে যাব, আপনারা ওখানেই লাঞ্চ খাবেন। আচ্ছা চলি!

একটু পরে বাইরে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হলে তখন কম্বল থেকে অনির্বাণ মুখ বের করল। গণনাথ মুচকি হেসে বললেন, কী বুঝলি?

তুমি ওকে বললেই পারতে কে আমি!

তোকে প্যাঁচার মতো লুকোতে দেখলুম যে!

ওর মুখ দেখতে আমার ঘেন্না হয়। অনির্বাণ রুষ্টভাবে বলল। কিন্তু তোমার মাইরি মাথায় কিছু নেই। ব্যাটাচ্ছেলে তো পিউয়ের কাছে জানবে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে।

এক্সপ্ল্যানেশন আমি দেব। তুই ঘুমো।

ধুশ ঘুম। অনির্বাণ উঠে পড়ল। আজ রাতেই আমার সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

সে জোরে দরজা খুলে বেরুলে গণনাথ ডাকলেন, আনু!

অনির্বাণ সাড়া দিল না। লনের ঠাণ্ডা নুড়িতে তার পায়ের এলোমেলো শব্দ শোনা গেল। গণনাথ চাপাস্বরে বললেন, আমারই ভুল! তারপর শান্তভাবে স্ক্রিপ্টের পাতা ওল্টালেন। বাইরে ড্যামের দিকে এতক্ষণে একটা রাতপাখি ডেকে উঠল। তার একটু পরে শেয়ালের ডাক ভেসে এল। ঘরের ঠাণ্ডা বেড়ে যাচ্ছে টের পেয়ে গণনাথ দরজায় গেলেন। পর্দা তুলে আস্তে ডাকলেন, আনু! কিন্তু কোনও সাড়া না পেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

.