প্রস্তাবনা
আজ রাতেও আবার সেই উপদ্রব।
“ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়?
সে ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।”–তারপর বিকট সেই অট্টহাসি। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
একেবারে জানালার বাইরে এই বদমাইসি এবং ঠিক এই সময়টাতে কে জানে। কেন লোডশেডিং হচ্ছে কদিন থেকে। জুন মাসের অসহ্য গরম। হাতপাখ নাড়তে নাড়তে সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছে, হঠাৎ কাল রাতের মতোই ছিঁড়ে গেল। তারপর জানালায় একটা ছায়া মুখ। চাপাস্বরে কেউ বলে উঠল-বরকধঝ-কচতটপ বরকধঝ-কচতটপ।
–তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে! পাগলামির নিকুচি করেছে। বলে অমরেশ উঠে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি আবার হা-হা করে হাসছে কাল রাতের মতোই।
কাল রাতে ধমক দিয়েছিলেন অমরেশ। পাগলাটা কেটে পড়েছিল। কিন্তু আজ রাতে ধমক, শাসানি তর্জন-গর্জনেও কাজ হল না। বিছানায় মাথার কাছে টর্চ ছিল। টর্চ জ্বেলে ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
পাশের ঘরে নন্দিনী চীনা লণ্ঠনের আলোয় একটা প্রেমের উপন্যাস পড়ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এখন যাকে বলে রিল্যান্সিং মুড। তা ছাড়া রগরগে প্রেমের কাহিনী এই উৎকট গরমকে ভুলিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট।
বাবার চ্যাঁচামেচি এবং দরজা খুলে বেরুনোর শব্দ আবছা তার কানে এসেছিল। বিরক্ত হয়ে বলল–কোনও মানে হয়?
সেকেলে বিশাল খাটে সুধাময়ীর বুকে হাতপাখাটা চুপচাপ পড়ে আছে। ঘুমের ওযুধ খান ৰাময়ী। নন্দিনী আবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে, তার বাবার মতো জোরে না হলেও মায়ের নাক ডাকে। নন্দিনীর কথায় নাক ডাকা থেমে গেল। ঘুমজড়ানো গলায় বললেন–বংকার মাকে বলিস খবর দেবে।
নন্দিনী হেসে ফেলল। কী বংকার মা বংকার মা করছ! বাবার কীর্তি দ্যাখ গিয়ে।
–হুঁ। বলে সুধাময়ী পাশ ফিরলেন।
শহরতলির এই পাড়াটা নিঝুম সুনসান এখন। শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। পিছনের বস্তিতে অনেক রাত অব্দি কী সব হই-হুঁল্লোড় চলে। তারপর সম্ভবত লোকেরা ক্লান্ত হয়েই ঘরে-বাইরে যে যেখানে পারে, শুয়ে পড়ে। পাশের রাস্তার ওধারে সম্প্রতি কয়েকটা নতুন বাড়ি হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে-ওখানে খানাখন্দ, ডোবা ঝোপজঙ্গল এবং পোপাড়ো ঘাসজমি। তার ওধারে কী একটা কারখানা হবে নাকি। বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি হয়ে গেছে। শুওরের খোঁয়াড়, গোরু মোষের খাটাল, তারপর একটা খাল পেরিয়ে গেলে রেলকলোনি এবং রেলইয়ার্ড।
নন্দিনী বইয়ের পাতায় চোখ রাখল বটে, কিন্তু মন বাবার দিকে। কাল রাতে এক পাগলা নাকি বাবাকে খুব জ্বালিয়েছে। এ ঘর থেকে পাগলার পদ্য আওড়ানো শোনা গিয়েছিল। এ রাতে নন্দিনী অতটা খেয়াল করেনি। পাগলার কণ্ঠস্বর বেশ নাটকীয় ধরনের। যাত্রাদলের অভিনেতা ছিল হয়তো। ভাবতে মজা লাগে, রাত বিরেতে একটা লোক মৃত্যুকে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে! পদ্যটা পরিচিত মনে হয় নন্দিনীর। কোথায় যেন পড়েছে, মনে করতে পারেনি।
নন্দিনী টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত একটা পনের বাজে। বাবা ফিরছে না। পাগলাটাকে এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে নাকি। বাবারও অবশ্য একধরনের পাগলামি আছে। রাতদুপুরে বাড়ির পাশে কুকুরেরা ঝগড়া বাধালে ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়ে। পাড়াছাড়া করে ফেরে।
পুরনো আমলের একতলা বাড়ি। একটুকরো উঠোন আছে। উঠোনের কোনায় টিউবেল আছে। শিউলি জবা চাঁপাফুলের গাছ আছে। লণ্ঠনটা হাতে করে নন্দিনী দরজা খুলে বারান্দায় বেরুল। আস্তে ডাকল–বাবা!
তার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বস্তিটা নাকি রাজ্যের চোর-ডাকাত-ছিনতাইবাজের ডেরা। আশে-পাশে ভদ্রলোকদের বাড়িতে একসময় নাকি রাতবিরেতে খুব চোর পড়ত। নন্দিনীর ছোটবেলায় তাদের বাড়িতেও চোর ঢুকেছিল, মায়ের কাছে গল্পটা অনেকবার শুনেছে। কিন্তু তার মনে পড়ে না কিছু। বরং তার ধারণা, বস্তির লোকগুলো বেশ ভদ্রই। কখনও ওখানকার কোনও ছেলে-ছোকরা তার পিছনে লাগেনি। বরং ভদ্রলোকদের বাড়ির রকবাজরা তার পিছনে শিস দিয়েছে। অশালীন কথা আওড়েছে।
তা হলেও নন্দিনীর অবচেতনায় বস্তিবাসীদের সম্পর্কে গোপন একটা আতঙ্ক আছে। এই মুহূর্তে জবাগাছের আড়াল থেকে যদি চোর-ডাকাত বেরিয়ে আসে?
নন্দিনী লক্ষ্য করল, উঠোনের সদর দরজা বন্ধ। তার মানে, বাবা বসার ঘর খুলেই বেরিয়েছে। তার বাবা প্রাক্তন স্কুলটিচার। শোবার ঘরের সবখানে বই ঠাসা। বাইরের বসার ঘরেও তিনটে আলমারি ভর্তি বই। ওই ঘরে বাবা একসময় একদঙ্গল ছাত্র পড়াত। নিজের বয়সের ক্লান্তি আর নন্দিনীর মায়ের অসুখ-বিসুখ এইসব নানা কারণে টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল আর বাবাকে আগের মতো বই পড়তেও দেখে না নন্দিনী। চুপচাপ গুম হয়ে বসে থাকেন অমরেশ।
বারান্দায় রাখা একটা নড়বড়ে টেবিলে চীনা লণ্ঠনটা রেখে নন্দিনী দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। পাগলাটার পাল্লায় পড়ে বাবাও কি পাগল হয়ে গেল? সে একবার ভাবল, বসার ঘর দিয়ে গিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখবে। কিন্তু এবার তার রাগ এসে গেল। চোর-ডাকাত ঢুকে পড়ুক। তার কী?
রাগের বশেই সে লণ্ঠনটা তুলে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এতক্ষণে বিদ্যুৎ এসে গেল। বারান্দায় চল্লিশ ওয়াটের বাতিটা সারারাত জ্বলে। ঘরে টেবিলবাতিটা জ্বলে উঠল। ঘড় ঘড় শব্দে পুরনো সিলিং ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। এবার আর মাকে ওঠানো দূরের কথা, একটুও জাগানো যাবে না।
আলো আসার পর এতক্ষণে এলাকার নিঝুম ঘোরটাও কেটে গেছে। কাছাকাছি কোথাও কুকুর ডাকল। নন্দিনী বসার ঘরে চলে গেল। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে। সে সুইচ টিপে এ ঘরের আলো জ্বালল। তারপর দরজায় উঁকি দিল। এক চিলতে বারান্দা ছিল একসময়। কিন্তু রকবাজদের জন্য ভেঙে দিতে হয়েছিল। জায়গাটা ঢালু করে বাঁধানো। কাঁচ আর অজস্র পেরেকের ডগা উঁচিয়ে আছে। কয়েক ধাপ সংকীর্ণ সিঁড়ি করা হয়েছে দরজার নীচে। সিঁড়িতে নেমে রাস্তার দুধারে তাকিয়ে কাকেও দেখতে পেল না নন্দিনী।
শুধু একটা ঘেয়ো কুকুর আস্তেসুস্থে হেঁটে চলছে। বাঁদিকে বস্তির গলির মোড়ে কুকুরটা গিয়ে তাড়া খেল। একদঙ্গল কুকুর চ্যাঁচামেচি করে তাকে তাড়িয়ে পাড়াছাড়া করতে গেল।
কিন্তু বাবা কোথায় গেল? নন্দিনীর অস্বস্তি হচ্ছিল। পাশের বাড়ির তারাজেঠুকে ডাকবে ভাবল। কিন্তু অমরেশ এক পাগলের পিছনে তাড়া করেছেন, এই ব্যাপারটা বড় হাস্যকর। তারাজেঠু যা লোক, রঙ চড়িয়ে গল্প রটিয়ে বেড়াবেন সবখানে। বাবার প্রেসটিজ থাকবে না। এমনিতেই তো অনেকে আজকাল তার বাবাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে।
বিরক্ত আর খাপ্পা নন্দিনী উঠে এসে দরজা বন্ধ করল। কিন্তু ঘরের আলোটা নেভাল না। সে তার বাবার শোবার ঘরে গিয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে দিল। ফ্যানটার সুইচ টেপা ছিল। সেটা ঘুরছে। শূন্য বিছানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নন্দিনী নিজের ঘরে ফিরল। দরজা এঁটে দিল।
চীনা লণ্ঠন নিভিয়ে টেবিলবাতির সুইচ অফ করে সে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বাবা এলে ডাকাডাকি করবে। করুক। এই পাগলামির কোনও মানে হয়?
কিন্তু নন্দিনীর ঘুম আসছিল না। টেবিলঘড়ির আবছা টিকটিক শব্দ কানে আসছিল। অমরেশের ডাক শোনার জন্য সে কান খাড়া করে আছে। অমরেশের ফেরার নাম নেই।…
.