ঋগ্বেদ ০৬। ৪৮
ঋগ্বেদ সংহিতা । ৬ষ্ঠ মণ্ডল । সূক্ত ৪৮
প্রথম দশটি ঋকের দেবতা অগ্নি। একাদশ হইতে পাঁচটী ঋকের দেবতা মরুৎগণ। ষোড়শ হইতে চারিট ঋকের দেবতা পুষ। বিংশ ও একবিংশ ঋকের দেবতা পৃশ্নি। দ্বাবিংশ ঋকের দেবতা পৃশ্নি অথবা গর্গ ও পৃথিবী। বৃহস্পতির পুত্ৰ শংযু ঋষি।
১। হে স্তোতৃবর্গ! তোমরা প্রতি যজ্ঞে পুনঃ পুনঃ স্তোত্রদ্বারা শক্তিমান অগ্নির স্তব কর। আমরা সেই অমর সর্বদশী, বন্ধুর ন্যায় অম্বুকুল দেব অগ্নি র প্রশংসা করিতেছি।
২। আমরা শক্তিপুত্রের প্রশংসা করিতেছি, কারণ তিনি প্রকৃত পক্ষে আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন। হব্যবহনকারী সেই অগ্নিকে আমরা হব্য প্রদান করি। তিনি যেন সংগ্রামে আমাদিগের রক্ষক ও সমৃদ্ধিবিধায়ক হন। তিনি যেন আমাদিগের পুন্ত্রগণকে রক্ষা করেন।
৩। হে অগ্নি! তুমি অভীষ্টবৰ্ষী, জরা রহিত ও মহান; তুমি সমধিক দীপ্তিসহকারে প্রকাশ পাইতেছ। হে প্রদীপ্ত অগ্নি! তুমি অবিচ্ছিন্ন ভার সহিত বিরাজ করিতেছ। তুমি মনোজ্ঞ দীপ্তিসহকারে প্রজ্বলিত হও।
৪। হে অগ্নি! তুমি মহৎ দেবগণের যাগ কর; অতএব আমাদিগের যজ্ঞে নিরন্তর দেবগণের যাগ কর। তুমি আমাদিগের রক্ষার নিমিত্ত নিজ বুদ্ধি ও কাৰ্য্যদ্বারা দেবগণকে আমাদিগের অভিমুখে আনয়ন কর। তুমি তাঁহাদিগকে হব্যরূপ অন্ন প্রদান কর এবং স্বয়ং ইহা স্বীকার কর।
৫। তুমি যজ্ঞের গর্ভভূত; তোমাকে বসতীবরী অর্থাৎ সোমমিশ্রনার্থ জল, অভিধব পাষাণ ও অরণি কাষ্ঠ পোষণ করে। তুমি ঋগিগণ কর্তৃক বলপূৰ্ব্বক মথিত হইয়৷ পৃথিবীর অত্যুন্নত স্থানে অর্থাৎ দেবযজন দেশে প্রাজুভুতি হও।
৬। যে অগ্নি দীপ্তিদ্বার স্বর্গ ও পৃথিবীকে পূর্ণ করেন, যিনি ধূম সহকারে অন্তরিক্ষে উদিত হয়েন, দীপ্তিমান অভীষ্টবৰ্ষী সেই অগ্নি অন্ধকার রাত্রিতে তমোনাশ করিতে দৃষ্ট হন। দীপ্তিমান সেই অভীষ্টবৰ্ষী অন্ধকার রাত্রি সকলের উপর অধিষ্ঠান করেন।
৭। হে দেব, দেবগণের মধ্যে কনিষ্ঠ, প্রদীপ্ত অগ্নি! তুমি মনীয় ভ্রাতা ভরদ্বাজ কর্তৃক সন্ধুক্ষিত হইয়া আমাদিগকে ধন প্রদানপূর্বক, নিৰ্ম্মণ ও প্রবল দীপ্তিসহকারে প্রজলিত হও। হে প্রদীপ্ত অগ্নি! তুমি প্রজ্বলিত হও।
৮। হে অগ্নি! তুমি সমস্ত মনুষ্য লোকের গৃহপতি। হে বরুণতম অগ্নি! আমি তোমাকে শত হেমন্ত প্রজ্বালিত করিতেছি(১), তুমি আমাকে শত সংখ্যক রক্ষাদ্বারা পাপ হইতে রক্ষা কর। যাহারা ত্বদীয় স্তোতৃবর্গকে ধন প্রদান করে, তাহাদিগকেও রক্ষা কর।
৯। হে গৃহদাতা, বিচিত্র অগ্নি! তুমি আমাদিগের নিকট রক্ষাসহকারে ধন প্রেরণ কর, কারণ তুমি এই সমস্ত ধনের প্রেরক। তুমি শীঘ্র আমাদিগের সন্ততিগণকে সুপ্রতিষ্ঠিত কর।
১০। হে অগ্নি! তুমি সমবেত ও হিংসারহিত রক্ষাদ্বারা আমাদিগের পুত্র ও পৌত্রকে পালন কর। তুমি আমাদিগের নিকট হইতে দেবগণের কোপ ও মানবগণের বিদ্বেষ বিদূরিত কর।
১১। হে বন্ধুগণ! তোমরা নবীনতর স্তোত্র সহকারে দুগ্ধবতী ধেনুর নিকট আগমন কর এবং তৎপরে তাহাকে এরূপে বিমুক্ত কর, যাহাতে তাহার কোনরূপ হানি না হয় (২)।
১২। যিনি সহিষ্ণু, স্বাধীনতেজ, মরুৎগণকে অমরণ হেতু পয়োরূপ অল্প প্রদান করেন, যিনি বেগগামী মরুৎগণের মুখসাধনে তৎপর, যিনি বৃষ্টি জলের সহিত মুখবর্ষণ করিয়া অন্তরিক্ষ পথে পরিভ্রমণ করেন।
১৩। হে মরুৎগণ! তোমরা ভরদ্বাজের নিমিত্ত বিশ্বের দুগ্ধদাত্রী ধেনু ও সকল ব্যক্তির ভোগপৰ্য্যাপ্ত অন্ন, এই দুইটী মুখ দোহন কর।
১৪। হে মরুৎগণ! তোমরা ইন্দ্রের মহৎ কৰ্ম্মের অনুষ্ঠানকারী, বরুণের ন্যায় বুদ্ধিমান, অৰ্য্যমার ন্যায় এবং স্তুতিভাজন, বিষ্ণুর ন্যায় দানশীল; আমি ধন প্রদানার্থ তোমাদিগের স্তব করিতেছি।
১৫। যাহাঁতে মরুৎগণ শত সহস্র প্রকার ধন এক কালে আমাদিগকে প্রদান করেন, তজ্জন্ত আমি সম্পতি উচ্চরবকারী, অপ্রতিহত প্রভাব ও পুষ্টিদায়ক মরুৎগণের দীপ্তবলের স্তব করিতেছি। সেই মরুৎগণ যেন আমাদিগের নিকট গৃঢ় ধন প্রকাশিত করেন ও সমস্ত ধন সুলভ করেন।
১৬। হে পূষা! তুমি সত্বর আমার নিকট আগমন কর। হে দীপ্তিমান দেব! তুমি ভীষণ আক্রমণকারী শক্রগণের পীড়া বিধান কর। আমিও তোমার কর্ণ সমীপে উপস্থিত হইয়া তদীয় গুণ গান করি।
১৭। হে পূষা! তুমি কাকগণের আশ্রয়ভূত বনস্পতিকে অর্থাৎ পুত্র পৌত্ৰাদি সমম্বিত এই ঋষিকে উন্মুলিত করিও না(৩)। মদীয় নিন্দাকারীগণকে সৰ্ব্বতোভাবে নষ্ট কর। ব্যাধগণ সেরূপ পক্ষিগণের বন্ধনার্থ জাল বিস্তীর্ণ করে, তদ্রূপ শত্ৰুগণ যেন কোনরূপে আমাকে বন্ধন করিতে না পারে।
১৮। হে পূষা! দধিপূর্ণ, ছিদ্র রহিত স্থতির ন্যায়(৪) ত্বদীয় বন্ধুতা যেন সৰ্ব্বদা অবিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে।
১৯। হে পূষা! তুমি মর্ত্যগণকে অতিক্রম করিয়া অবস্থান করিতেছ। তুমি সম্পত্তি বিষয়ে দেবগণের সমকক্ষ। অতএব তুমি সংগ্রামে আমাদিগের প্রতি অমুকুল দৃষ্টি রাখিও। তুমি পূৰ্ব্বকালে মানবগণকে যেরূপ রক্ষা করিয়াছিলে, সম্প্রতি আমাদিগকে সেইরূপ রক্ষা কর।
২০। হে কম্পনবিধায়ী, সম্যকরূপে স্থতিভাজন মরুৎগণ! তোমাদিগের যে প্রশস্ত বাণী কি দেব, কি যজমান উভয়েরই বাঞ্ছিত ধন প্রণয়ন করে, তোমাদিগের সেই সদয় ও হুনৃত বাণী আমাদিগের পথ প্রদর্শক হউক।
২১। যে মরুৎগণের কার্য্যসকল দীপ্তিমান সূর্য্যের ন্যায় সহসা অন্তরিক্ষে ব্যাপ্ত হয়, সেই মরুৎগণ দীপ্ত, শক্রবিজয়ী, পূজনীয়, শত্রুনাশক বল ধারণ করেন। সে শত্রুনাশক বল সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রশস্ত।
২২। একবার মাত্র স্বর্গ উৎপন্ন হইয়াছে; একবার মাত্র পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে; একবার মাত্র পৃষ্ণির দুগ্ধ দোহন করা হইয়াছে। ইহা ব্যতীত তৎসদৃশ আর উৎপাদিত হয় নাই।
—————–
(১) মনুষ্যের পরমায়ুর সীমা একশত বৎসর।
(২) মরুদ্দৈবতাত্বাৎ মরুতাং যাগার পয়ো দোগ্ধুমিতি শেষঃ। অথবা মরুতাং মাতা প্রশ্ন্যাখ্যা মাধ্যমিকা বাগ্ধেনুঃ। সায়ণ।
(৩) ঋষিঃ পুত্রপৌত্রসহিতমাস্থানং বহুপক্ষ্যাশ্রয়বনস্পতিত্ত্বেন রূপয়ণ্ তস্যানুদ্ধার মাশাস্তে। সায়ণ।
(৪) অর্থাৎ দধি রাখিবার জন্য চর্ম্মাধার। সেকালে চর্ম্মপাত্রের অনেক ব্যবহার ছিল, সোম, সূরা বা দধি তাহাতে স্থাপিত হইত। ঋগ্বদের অনেক স্থানে তাহার নিদর্শন পাওয়া যায়।