সেই ভক্তিমতী রানী রাসমণিও নেই, অনুগত সেবক মথুরবাবুও নেই। এখনকার কর্তাদের জমিদারি মেজাজ, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নিয়ে তাঁরা বিশেষ মাথা ঘামান না। রামকৃষ্ণ পরমহংস অসুস্থ হয়ে পড়লেও খোঁজখবর নিলেন না কর্তারা। দিন দিন ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে, সারাদিন ধরে মানুষ আসে, তারা দর্শন চায়, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কথা বলতে বলতে গান আসে, এক একসময় ভাবাবেশে মূৰ্ছা যান। ইদানীং পরমহংসের শরীর কৃশ হয়ে আসছে, হঠাৎ হঠাৎ কাশির দমক আসে, তখন খুবই দুর্বলতা ও যন্ত্রণা বোধ করেন। একদিন ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তাঁর ইষ্ট দেবীর উদ্দেশে বলে উঠেছিলেন, এত লোক কি আনতে হয়? একেবারে ভিড় লাগিয়ে দিয়েছিস। লোকের ভিড়ে নাইবার খাবার সময় পাই না। একটা তো ফুটো ঢাক, রাতদিন এটাকে বাজালে আর কদিন টিকবে?
মন্দিরের মালিকপক্ষ মনোযোগ না দিন, রামকৃষ্ণের অবস্থাপন্ন ভক্তরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। দু-একজন ডাক্তার দেখে বলেছেন, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, এ অসুখের নাম ক্লার্জিম্যানস সোর থ্রোট, বেশি কথা বললে এরকম হয়। কিন্তু ডাক্তারদের ওষুধে উপশম হয় না, ব্যথা বাড়ছেই। ক্রমশ। একদিন তাঁকে গাড়িতে করে তালতলায় এনে বিখ্যাত ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখানো হল। এই দুর্বল শরীরে তাকে বারবার কলকাতায় আনা যায় না, আর ব্যস্ত চিকিৎসকরাও দক্ষিণেশ্বরে যেতে চাইবেন না। দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণের ঘরখানিও স্বাস্থ্যকর নয়, স্যাঁতসেতে, অবিরাম গঙ্গার জলো হাওয়া আসে। প্ৰাতঃকৃত্য সারবার জন্য তাঁকে অনেকটা দূরে যেতে হয়, তাতে তাঁর এখন কষ্ট হয়।
রামকৃষ্ণের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য ভক্তরা তাকে কলকাতায় এনে রাখবেন ঠিক করলেন। বাগবাজারে গঙ্গার ধারে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। এক সকালবেলা দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে চললেন রামকৃষ্ণ পরমহংস, প্রায় তিরিশ বছর যে ঘরটিতে ছিলেন সেখানে পড়ে রইল তাঁর টুকিটাকি জিনিসপত্র। মন্দিরের অন্যান্য সেবাইত ও কর্মচারীরা বেশ অবাক হয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রামকৃষ্ণ ঠাকুর নিজের ঘরখানা ছেড়ে বাইরে থাকতে চাইতেন না কখনও। আজ যেন বেশ গরজ করে চলে যাচ্ছেন, একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না।
বাগবাজারের বাড়িটি তাঁর পছন্দ হল না। গঙ্গার ধারেই বেশ নিরিবিলি পরিবেশে বাড়ি, কিন্তু সেখানে পা দিয়েই তিনি বললেন, এখানে থাকব না! আমাকে কি গঙ্গাযাত্রা করতে এনেছে নাকি?
হনহন করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়!
রামকান্ত বসু স্ট্রিটে রামকৃষ্ণের সংসারী ভক্তদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলরাম বসুর বাড়ি। এ বাড়ি রামকৃষ্ণের চেনা, তিনি অনেকবার এসেছেন, এখানে অনেক লীলা হয়েছে। আপাতত সেখানেই থাকা হবে ঠিক হল। জমিদার বলরাম বসু আভূমি প্ৰণত হয়ে গুরুকে বরণ করলেন।
কাছাকাছি অনেক ভক্ত আছে, এখানেই যাওয়া-আসার সুবিধে। একশো নম্বর শ্যামপুকুরে স্ট্রিটে বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান স্কুল, মহেন্দ্র মাস্টার সেখানকার প্রধান শিক্ষক, যখন তখন চলে আসতে পারেন, আর বাগবাজার থেকে হেঁটেই চলে আসলেন গিরিশ।
নটচুড়ামণি গিরিশের মানসলোকে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে এর মধ্যে।
সেই চৈতন্যলীলা দেখার পর রামকৃষ্ণ থিয়েটারে গেছেন বেশ কয়েকবার। তাঁর ব্যক্তিত্বের কিছু একটা মোহ আছে, চুম্বকের মতন তিনি টেনেছেন গিরিশকে। এককালের মহা নাস্তিক ও দাম্ভিক গিরিশ আস্তে আস্তে নরম হয়ে এসেছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হয়েছে, কিন্তু গুরুবাদ তাঁর দু চক্ষের বিষ। সবাই বলে ঠিকমতন গুরু না পেলে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায় না। গুরুকেই ঈশ্বরজ্ঞান করতে হয়, তা শুনলেই গিরিশের গা জুলে ওঠে। মানুষ কী করে ঈশ্বর হবে। সামান্য মানুষের পায়ের কাছে মাতা ঠোকা তো ভণ্ডামি।
একদিন তিনি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, গুরু কী?
মুচকি হেসে বলেছিলেন, তোমার গুরু হয়ে গেছে!
গিরিশ প্রথমে বুঝতে পারেননি। কে তাঁর গুরু, ইনিই নাকি? যতবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়, ততবারই তিনি গিরিশকে একটু একটু করে বাঁধছেন, তা গিরিশ টের পান, তবু তাঁর মন মানতে চায় না। মাতাল যেমন মাঝে মাঝেই মাথা ঝাঁকিয়ে নেশা কাটাতে চায়, তেমনই গিরিশও এক একবার বিশ্বাস ও আত্মসমৰ্পণ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে দারুণ দুরন্তপনায়। রামকৃষ্ণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন, গভীর রাতে মদ খেয়ে হল্লা করেছেন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে, যা তা খিস্তি-খেঁউড় করেছেন রামকৃষ্ণের সামনে। একদিন তো নেশার ঝোঁকে রামকৃষ্ণের বাপান্ত করতেও ছাড়েননি, তবু সব মেনে নিয়েছেন রামকৃষ্ণ। উগ্ৰ চন্ড গিরিশকে এমন ক্ষমাসুন্দর চক্ষে তো আগে আর দেখেনি কেউ! গিরিশের নাটক চালানো, মদ্যপান, বেশ্যা সংসর্গ এর কোনওটার ওপরেই নিষেধ আরোপ করেননি রামকৃষ্ণ। গিরিশকে তাঁর চাই, যেকোনও শর্তে। গিরিশ তাঁকে বকলমা দিক, তাতেই তার সব পাপ কেটে যাবে, তাকে পূজা বা ধ্যানও করতে হবে না। এমন কথা কোনও সাধক আগে বলেছে?
তারপর গিরিশ হঠাৎ গুরু বিষয়ে সংকটের একটা সহজ সমাধান করে নিলেন। মানুষ কখনও মানুষের আধ্যাত্মিক গুরু হতে পারে না, কোনও মানুষের পায়ে মাথা ঠেকানো যায় না, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর যদি মানুষ রূপে অবতীর্ণ হন। তা হলে তো আর সংশয় থাকে না! গিরিশ ঠিক করে নিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস সাধারণ মানুষ নন, তিনি ঈশ্বরের অবতার। যিনি রাম, তিনিই কৃষ্ণ, ইদানীং রামকৃষ্ণরূপে মর্ত্যধামে লীলা করতে এসেছেন। গিরিশ সেই অবতারের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছেন।
নরেন্দ্র এবং আরও কয়েকজন ভক্ত অবশ্য রামকৃষ্ণের এই অবতারত্ব মানে না। তারা গুরুকে ভালোবাসে, তাকে একজন মহান মানুষ মনে করে, কিন্তু অবতার-টবতার কিছু না।
যিনি ঈশ্বরের অবতার, তিনি রোগভোগের কষ্ট পাবেন কেন? তিনি তো এসব কিছুই ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর বা তার অবতারদের দুটি স্পষ্ট লক্ষণ থাকে। তাঁরা কখনও বৃদ্ধ হন না। কোনও ব্যাধি তাদের স্পর্শ করতে পারে না। হিন্দু দেবদেবীরা চিরযুবা, চিরযুবতী। শ্ৰীরামচন্দ্র কিংবা শ্ৰীকৃষ্ণের কখনও জ্বরজারি হয়েছে কিংবা পেটের ব্যথায় কাতরাতে হয়েছে, তা অকল্পনীয়। কিন্তু রামকৃষ্ণ বরাবরই পেটরোগা, যখন তখন বাহ্যে যান, কিছুদিন আগেই আছাড় খেয়ে একটা হাত ভেঙেছিলেন, প্লাস্টার করতে হয়েছিল। সবই সাধারণ মানুষের মতন। এখন তো গলার ব্যথায় এক এক রাত্তিরে ঘুমই হয় না।
বিশ্বাসটাই যাঁদের যুক্তি, সেই ভক্তরা মনে করেন, সবই প্রভুর লীলা। অসুখটাও লীলা। তিনি ইচ্ছে করেই রোগযন্ত্রণা ভোগ করছেন, এবং এরও কোনও তাৎপর্য আছে।
আজকাল খ্রিস্টানি মতের প্রভাব অনেকের ওপরেই পড়েছে। যিশুর সঙ্গে তুলনা এসেই যায়। যিশু যেমন অন্য মানুষের পাপ নিজে গ্রহণ করেছিলেন, রামকৃষ্ণও সেইরকম অন্যদের রোগ-ব্যাধি নিজের অঙ্গে ধারণ করেছেন। গিরিশের দৃঢ় ধারণা, রামকৃষ্ণ ইচ্ছে করলেই যে কোনওদিন সেরে উঠবেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংস অনেকটা শিশুর মতন হয়ে গেছেন। ডাক্তার আসতে দেরি করলে উতলা হয়ে বলেন, ওগো, এখনও এল না? যাও না, তাকে খপর দাও! নিজেই তিনি ওষুধ চেয়ে খান। কাছাকাছি যাকে দেখতে পান, তাকেই জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ গা, আমার সারবে তো?
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তার সহ্য হয় না, তাই নাম করা হোমিওপ্যাথ প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে ডাকা হয়েছে। ইনি ব্ৰাহ্ম নেতা প্রতাপচন্দ্র নন, শুধুই ডাক্তার। তার ওষুধে সাময়িকভাবে ব্যথার নিবৃত্তি হয়, কিন্তু মূল রোগ বেড়েই চলেছে। এখন কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ে, শক্ত কিছু খেতেই পারেন না। রামকৃষ্ণ। নানান অভিমত শুনে বোঝা যাচ্ছে, ‘পাদ্রিদের গলার ব্যথা’র মতন সহজ রোগ এটা না।
একদিন একদল কবিরাজ এলেন তাকে দেখতে। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদও রয়েছেন। রোগের উপসর্গ শুনে ও রামকৃষ্ণের গলা পরীক্ষা করে তাঁরা গম্ভীর হয়ে গেলেন। গঙ্গাপ্রসাদ উঠে গিয়ে এক ভক্তকে বললেন, এ রোগের নাম রোহিণী, আমাদের চিকিৎসার অতীত।
ভক্তটি বুঝতে পারল না। রোহিণী আবার কী রোগ?
গঙ্গাপ্ৰসাদ বললেন, আমরা যাকে রোহিণী বলি, ইংরেজী ডাক্তাররা তাকেই বলে ক্যান্সার।
রামকৃষ্ণ গঙ্গাপ্ৰসাদকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এ রোগ সাধ্য না অসাধ্য?
কবিরাজ চুপ করে রইলেন।
অধিকাংশ ভক্তই কবিরাজের এই রোগ নির্ণয় বিশ্বাস করেনি, তারা অন্য কথাবার্তা শুরু করে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে দিল।
রামকৃষ্ণের কলকাতায় অবস্থানের খবর রটে যাওয়ায় এখানেও বহু মানুষ আসতে শুরু করেছে। একদিন এলেন পণ্ডিতপ্রবর শশধর তর্কচূড়ামণি। হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্ৰত দিয়েছেন তিনি। রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর রঙ্গরসিকতার সম্পর্ক। তিনি অবশ্য অবতারতত্ত্বে বিশ্বাসী নন, রামকৃষ্ণকে তিনি একজন উচ্চশ্রেণীর সাধক বলে মনে করেন।
তর্কচূড়ামণি বললেন, এ কী ব্যাপার, আপনারাও রোগ হয়।
রামকৃষ্ণ বললেন, আমার তো রোগ না, এই দেহটার। চক্রবর্তী যে ছাড়ে না, দেহে রোগ সকলেরই।
তর্কচূড়ামণি বললেন, দেহটাকে শোধরানো আর এমন কি শক্ত ব্যাপার?
রামকৃষ্ণ বললেন, বড় গর্ত করো, তাও পুরবে, এ দেহ আর পোরে না।
তর্কচূড়ামণি একটা উপায় বাতলালেন। আপনি সমাধিস্থ হয়ে থাকুন, আর আমি স্বস্ত্যয়ন করি—আপনি দেশ বেড়াবেন চলুন।
রামকৃষ্ণ হাসতে লাগলেন।
তর্কচূড়ামণি বললেন, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? মশাই, শাস্ত্রে পড়েছি, আপনার ন্যায় পুরুষ ইচ্ছামাত্র শারীরিক রোগ আরাম করে ফেলতে পারেন। আরাম হোক মনে করে আপনার মনটা একাগ্র করে একবার অসুস্থ স্থানে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে রাখতে পারলেই সব সেরে যাবে। এটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। একবার ওরকম করলে হয় না!
রামকৃষ্ণ বললেন, তুমি পণ্ডিত হয়ে একথা কী করে বললে গো? যে মন সচ্চিদানন্দকে দিয়েছি তাকে সেখানে থেকে তুলে এনে এ ভাঙা হাড়মাসের খাঁচাটার ওপর দিতে কি আর প্রবৃত্তি হয়?
কথাটা খুব মনঃপূত হল না শশধরের। ভাঙা হাড়মাসের খাঁচাটার প্রতি যদি এতই অবজ্ঞা, তা হলে আর ওষুধ খাওয়া কেন? ডাক্তারের কাছে রোগের এত ব্যাখ্যান দেওয়াই বা কেন?
শশধরের ধারণা হল, অসুখের ধাক্কায় সাধক হিসেবে রামকৃষ্ণ খানিকটা নীচে নেমে এসেছেন। ইচ্ছের জোরে মনোময় কোষে উঠে আসার ক্ষমতা তাঁর আর নেই।
সাতদিন পরে বলরাম বসুর বাড়ি ছেড়ে ভক্তরা রামকৃষ্ণকে নিয়ে গেলেন এক ভাড়াবাড়িতে। পঞ্চান্ন নম্বর শ্যামপুকুরের স্ট্রিটে। বলরামবাবু পরম ভক্ত বটে, কিন্তু একটু কৃপণ। গুরুর চিকিৎসা ও সেবার জন্য তিনি অবশ্যই প্রস্তুত, কিন্তু নিজের বাড়িতে গুরুকে দিনের পর দিন রাখলে অনেক আনাগোনা চলবে, তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, বাড়িটা একটা হট্টমেলা হয়ে যাবে। নিজের বাড়িতে রাখলে চাঁদা তোলাটাও ভালো দেখায় না, তার থেকে ভাড়াবাড়িই সুবিধাজনক। কয়েকজন ধনী ভক্ত খরচপত্র ভাগাভাগি করে দেবে।
এক কৃষ্ণা নবমীর সন্ধ্যায় সদলবলে সে বাড়িতে চলে এলেন রামকৃষ্ণ। বৈঠকখানা ঘরে তাঁর জন্য শয্যা পাতা হয়েছে, দেওয়ালে টাঙানো হয়েছে কতকগুলো ছবি। রামচন্দ্র দত্ত একটা বাতি নিয়ে ছবিগুলো দেখালেন। একটা ছবিতে যশোদা ও বালগোপাল। পাশের ছবিটি সঙ্কীর্তনে মত্ত শ্ৰীগৌরাঙ্গের। সে ছবির সামনে একটুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইলেন রামকৃষ্ণ। একজন ভক্ত ফিসফিস করে বলল, উনি নিজেই নিজেকে দেখছেন।
পরমুহুর্তেই রামকৃষ্ণ পেছন ফিরে বললেন, জানলা দিয়ে হিম আসবে না তো?
আস্তে আস্তে এখানে পাতা হল সংসার। তরুণ ভক্তরা ঠিক করল তারা পালা করে দিন-রাত্রি জেগে সেবা করবে। তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয় কি না রামকৃষ্ণ তা নিজেই খোঁজখবর নেন। রান্নার জন্য আনানো হয়েছে সেবিকা গোলাপী মা-কে। সারদামণিই বা একলা একলা দক্ষিণেশ্বরে পড়ে থাকবেন কেন? ওখানে তিনি নহবতখানায় আত্মগোপন করে থাকেন, পুরুষ ভক্তদের সামনে কখনও বেরোন না। এখন তাকে স্বামী-সেবা থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন। রামকৃষ্ণের ইচ্ছেতেই সারদামণিকেও নিয়ে আসা হল শ্যামপুকুরের বাড়িতে।
অসুস্থ রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের সব প্রশ্ন ভুলিয়ে দিলেন। এই একটি মানুষ নিরহঙ্কার, নিরভিমান, সদানন্দ। অসুখের এত কষ্ট, তবু যখনই একটু ভালো থাকেন, তখনই হাস্যময়, কৌতুকপ্রবণ। সবাইকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকতে ভালোবাসেন। ইনি তো খ্যাতি চাননি, প্রতিষ্ঠা চাননি, বড় বড় সাধুদের মতন ধনী গৃহে গিয়ে নানারকম বায়নাক্কা করেননি, কোনও কিছুতেই তাঁর লোভ বা মোহ নেই, চমক দেখাবার কোনও প্রয়াস নেই, তিনি শুধু ভালোবাসা চান। ভালোবাসার জন্য যিনি এমন কাঙাল, তাকে কি ভালোবাসা না দিয়ে পারা যায়? নরেন্দ্ৰ ঠিক করল, একে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
শ্যামপুকুরের বাড়িতেই রামকৃষ্ণের শিষ্যমণ্ডলি আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে লাগল। নরেন্দ্রর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক প্রতি রাত্রে জেগে শুরুকে পাহারা দেয়। আর নিরঞ্জন ঘোষ সৰ্বক্ষণের দ্বারপাল, যে-কোনও উপকো লোককে আর রামকৃষ্ণের কাছে যেতে দেওয়া হয় না।
অনেক ডাক্তারই তো দেখানো হচ্ছে, একবার মহেন্দ্রলাল সরকারকে ডাকার কথা ওঠে। ধন্বন্তরি বলে তার নাম রটেছে। প্ৰতাপ মজুমদারেরও সেই মত।
কিন্তু রামকৃষ্ণ ওই নাম শুনেই বলে ওঠেন, না, না, ওকে ডাকতে হবে না।
মাস্টার, প্রতাপচন্দ্র ও অন্য ভক্তরা একথা শুনে হেসে ওঠেন। এই হাসির কারণ আছে। মহেন্দ্রলাল সরকারের শাঁখারিটোলার বাড়িতে একবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রামকৃষ্ণকে। ভক্তরা গদ গদ স্বরে বলেছিল, রামকৃষ্ণদেব এসেছেন, তিনি কষ্ট পাচ্ছেন…
মহেন্দ্রলাল একবার দূর থেকে রামকৃষ্ণকে দেখেছেন, কিছু কিছু শুনেওছেন ওঁর সম্পর্কে। কিন্তু তিনি যে-কোনও রকম অলৌকিকত্বে ঘোর অবিশ্বাসী এবং পরমহংস ব্যাপাটাও বোঝেন না। যোগী পরমহংসই যদি কেউ হবেন, তা হলে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে বছরের পর বছর গেড়ে বসে থাকবেন কেন, পরমহংসেরা তো এত সংসারী মানুষের সংসর্গে থাকেন না। মহেন্দ্রলালের ধারণা, বড়লোকরা যেমন শখ করে অনেক কিছু পোষে, সেই রকম রানী রাসমণির জামাই মথুরবাবু দক্ষিণেশ্বরে একটি পরমহংস পুষেছেন। তাই কোথাও রামকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উঠলে ডাক্তার কৌতুকচ্ছলে বলতেন, ও, সেই মথুরবাবুর পরমহংস!
মহেন্দ্রলাল ডাক্তারের কাছে রুগী রুগীই, তা সে সাধুই হোক, রাজাই হোক বা নিঃস্ব হোক। তিনি আপনি-আজ্ঞের ধার ধারেন না, সবার সঙ্গেই তুমি তুমি বলে কথা বলেন।
রামকৃষ্ণকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে তাঁর গলা পরীক্ষার জন্য বললেন, কই দেখি, হাঁ করে! সেই অবস্থায় রামকৃষ্ণ কিছু কথা বলতে যেতেই মহেন্দ্রলাল ধমক দিয়ে বলেছিলেন, জিভ নাড়লে আমি দেখব কী করে? তিনি রামকৃষ্ণের জিভটা চেপে ধরেছিলেন।
সেদিন খানিকটা যন্ত্রণা পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি বলেন, না না গরুর জিভ টানার মতন টেনেছিল!
সেই সময়কার অবস্থার থেকে এখন রোগের যাতনা অনেক বেড়েছে। গুরুর কষ্ট দেখলে ভক্তদেরও কষ্ট হয়। মহেন্দ্ৰ মাস্টারের বিশেষ ইচ্ছে আর একবার মহেন্দ্রলাল সরকারকে দেখানো হোক। গিরিশও তাই চান। অন্য ডাক্তাররাও বলছেন, ডাক্তার সরকারের অভিমতটা জানা প্রয়োজন। রামকৃষ্ণের কানের কাছেও ব্যথা চলে এসেছে, গলার মধ্যে ছুরি বেঁধার ভাব, এর যে কোনও ওষুধ নেই।
মহেন্দ্র মাস্টারের নিজের সংসারেও এখন দারুণ দুর্যোগ। তাঁর বড় ছেলেটি মাত্র আট বছর বয়েসে মারা গেছে, তার স্ত্রীর পাগল-পাগল অবস্থা। তবু তিনি দিনে দু’তিনবার এসে গুরুকে দেখে যান, কোনও রাতে বাড়িও ফেরেন না। যাতে ঘুম না আসে তাই দু’তিন খানা মাত্র রুটি খেয়ে রাত জেগে গুরুর সেবা করেন। নরেন, রাখালরা বাড়িতে খেয়ে দেয়ে রাত্তিরে পাহারা দিতে আসে, নরেন আইন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, সঙ্গে আনে পড়ার বই। গিরিশও সব কাজ ফেলে প্রায়ই ছুটে আসে, রামকৃষ্ণের সামনে বসে অঝোরে কাঁদে। কাঁদিতে কাঁদিতে বলে, আপনি যখন নীরোগ থাকেন, তখন কত রকম দৌরাত্ম্য করি, সে এক, কিন্তু আপনাকে এ অবস্থায় দেখতে পারি না।
এরই মধ্যে রামকৃষ্ণ এক একসময় যেন রোগ-ব্যাধির কথা সব ভুলে যান।
একদিন সকালবেলা স্নান সেরে আসার পর তিনি ফিক ফিক কোর হাসতে লাগলেন। কেন তিনি হাসছেন, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। হাসি আর থামে না। খেয়ে-দোয়ে একটু ঘুমোলেন। বিকেলবেলাও তার সহাস্য মুখ, তিনি নিজেই বললেন, এত হাসি কখনও হাসিনি, ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে।
খাট থেকে তিনি নেমে দাঁড়ালেন। দু’হাত তুলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই তাঁর ভাবের ঘোর হল।
ভক্তরা নির্বাক। দক্ষিণেশ্বর ছাড়ার পর রামকৃষ্ণের এরকম ভাব আর হয়নি, তাঁর শরীরটি জড়বৎ, মন কোথায় নিরুদ্দেশ।
খানিক পরে তিনি আবার বাস্তবে ফিরে এলেন। হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা গান গাও, সবাই হরিবোল বলো, তাতে যদি অসুখটা কমে।
সন্ধেটা কাটল বেশ মধুর ভাবে। রাত্রেই তাঁর আবার রক্তবমি হল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন তিনি। একবিন্দু ওষুধও তাঁর গলা দিয়ে যাচ্ছে না।
এর পর মহেন্দ্রলাল সরকারকে না-ডাকলে একেবারে হাল ছেড়ে দিতে হয়। গিরিশ ও মহেন্দ্র মাস্টার বুঝিয়ে সুঝিয়ে রামকৃষ্ণকে রাজি করালেন।
মহেন্দ্রলালের এখন এমন পশার যে তিনি আর রুগী সামলাতে পারছেন না। তাঁর চেম্বার উপচে পড়ছে। যা হোক তা হোক ভাবে রুগী দেখা তিনি পছন্দ করেন না, আবার রুগীদের ফেরানোও যায় না। তারা কেউ যেতে চায় না। ভেতরে আর বসবার জায়গা নেই, অনেক রুগী দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে রোদ্দুরে।
রামকৃষ্ণর নিজস্ব সেবক লাটুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মাস্টার। এত ভিড় দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তার ঠিক নেই, মাস্টারকে আবার ইস্কুলে দৌড়তে হবে।
কুস্তিগির লাটুর সাহায্য নিয়ে তিনি ঠেলেঠলে ভেতরে চলে এলেন। তাঁর ধারণা, রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শুনলেই তিনি আগে আগে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। মহেন্দ্রলাল চিনতে পারলেন না মাস্টারকে। অন্যদের সরিয়ে তাকে সামনে আসতে দেখে তিনি এক দাবড়ানি দিলেন, কে হে তুমি? যাও, বাইরে যাও, বাইরে যাও!
কাচুমাচু হয়ে মাস্টারকে পিছিয়ে আসতে হল। একবার তিনি ভাবলেন, এই উগ্ৰচণ্ড ডাক্তারকে ডেকে কী কোনও লাভ আছে? তাঁর গুরুর সঙ্গে ইনি কী রকম ব্যবহার করবেন কে জানে!
কয়েক মিনিট পরে ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন বাইরে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে লাগলেন অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের। বাজ খাই গলায় বললেন, অ্যাই, রোদে দাঁড়িয়ে আছ কেন সব। ওই দিকে ছায়া আছে দেখতে পাচ্ছ না? রোদে দাঁড়িয়ে রোগ বাড়াবে আর আমি তোমাদের ওষুধ গেলাব! কেন রে বাপু, কলকাতা শহরে কি আর ডাক্তার নেই?
তারপর মাস্টারের দিকে তার চোখ পড়ল।
ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ? কারুর মুখে গঙ্গাজল…কী বৃত্তান্তটা শুনি?
মাস্টার তার নিবেদন জানালেন।
মহেন্দ্রলাল বললেন, দেখছি তো এখন আমার মরার সময় নেই। বিকেলে এসো, এসে আমায় নিয়ে যেও!
বিকেলে আবার গেলেন মাস্টার। এবেলা ডাক্তারকে অনেকগুলি রুগী দেখতে হবে, এক ফাঁকে রামকৃষ্ণকে দেখে আসবেন।
শ্যামপুকুরের বাড়ির দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন মহেন্দ্রলাল। বারান্দাওয়ালা ঘরটিতে একটা চৌকির ওপর বিছানায় বসে আছেন রামকৃষ্ণ, মেঝেতে শতরঞ্চি পাতা, সেখানে উপবিষ্ট কয়েকজন ভক্ত। ঘরে আর চেয়ারটেয়ার কিছু নেই।
মহেন্দ্রলাল দরজার কাছে দাঁড়াতেই রামকৃষ্ণ তাকে নমস্কার জানালেন হাত তুলে। প্রতি নমস্কার জানিয়ে মহেন্দ্রলাল বললেন, কী হে, তুমি তো দক্ষিণেশ্বরের মথুরবাবুর পরমহংস। তুমি যে এখানে এসে জুটেছ?
রামকৃষ্ণ বললেন, চিকিৎসার জন্য এরা এখানে এনেছে। তারপর তিনি বিছানায় নিজের পাশে চাপড় মেরে ডাক্তারকে বসতে ইঙ্গিত করলেন সেখানে। প্যান্ট-কোট ও জুতো পরা অবস্থাতেই মহেন্দ্রলাল সেই খাটে বসলেন।
কয়েকজন ভক্ত শিউরে উঠলেন।
রামকৃষ্ণের বিছানায় কোনও ভক্ত কখনও বসে না, বাইরের লোকের তো প্রশ্নই নেই। সাধক পুরুষদের সব সময় পৃথক আসন। আর এই ডাক্তারটি জুতো পরে ওঁর পাশে বসে পড়ল?
মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী কী কষ্ট হয় বলো তো!
রামকৃষ্ণ বললেন, কোনও কোনও স্থান গোল হয়ে ডোব হয়… হাওয়া গিয়ে ফিরে আসে ঢোঁকের পর।
– কাশি আছে?
— হ্যাঁ গো, রাত্ৰে কাশি হয়-যেন ক্যাস্টর অয়েল-পরে পুঁজ হয়ে ওঠে।
– গলার ব্যথা?
— যেন ছুরি বেঁধা। ফোঁড়া ফাটিয়ে দেবার মতন যন্ত্রণা–রাত্তিরে ঘুম হয় না।
– ঠিক আছে, এবার হাঁ করো, গলাটা দেখি।
যেন শিশুর মতন ভয়ে ভয়ে রামকৃষ্ণ মুখটা ফাঁক করলেন। পুরো মুখ খুলতে পারেন না।
মহেন্দ্রলাল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ধমক দিয়ে বললেন, ভালো করে দেখাতে পারছ না, তুমি তো বড় আহাম্মক-না দেখালে কাকে দেখতে এসেছি!
যাঁর মুখ দিয়ে হাজার হাজার চমকপ্ৰদ উপমা ও লৌকিক কাহিনী বেরিয়ে এসেছে, ধর্মের সহজ, সরলতম ব্যাখ্যা দিয়েছেন যিনি, তার রক্তাক্ত, রোগ-বিক্ষত কণ্ঠনালির মধ্যে উকি দিলেন মহেন্দ্রলাল। আস্তে আস্তে বললেন, আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন? আমরা কি মানুষ মেরেই বেড়াই?
অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন মহেন্দ্রলাল। তাঁর যে অন্য রুগী দেখতে যাবার তাড়া আছে, তা যেন ভুলেই গেলেন। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত কী তা জানার জন্য রামকৃষ্ণ উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকলেও মহেন্দ্রলাল সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করলেন না।
এক সময় যন্ত্রপাতি গোছাতে গোছাতে বললেন, ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, নিয়মিত খাবে। বেশি কথা বলবে না। এখন কিছুদিন উপদেশ-টুপদেশ বন্ধ রাখো।
মাস্টার ও আরও দু’তিনজন ডাক্তারকে নিয়ে এলেন নীচে। ডাক্তার বাড়িটি দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন, এটিও বুঝি রানী রাসমণির?
মাস্টার বললেন, আজ্ঞে না। ঠাকুরের ভক্তরা এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।
মহেন্দ্রলাল বললেন, ভক্ত? ওর আবার শিষ্যটিষ্য আছে নাকি? আমি তো জানতুম, জানবাজারের ওরাই রেখেছে। কারা ওর ভক্ত শুনি? তোমাকে সবাই মাস্টার বলে, তুমি কোথাকার মাস্টার?
বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্কুলের একটি শাখার হেডমাস্টার যে এই ব্যক্তিটি, তা জেনে মহেন্দ্রলাল বেশ বিস্মিত হলেন। অন্য ভক্তদের মধ্যে রয়েছেন আর এক ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত, নেপালের রাজপ্রতিনিধি ক্যাপ্টেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, সদ্য বি এ পাশ করা যুবক নরেন্দ্র দত্ত, এ ছাড়া রাখাল, কালীপদ, শশী এরা সব কলেজে পড়া শিক্ষিত ছেলে।
মহেন্দ্রলাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ভক্তদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা জানতে চাইলেন। যার পরনের কাপড়ের ঠিক থাকে না, কথাবার্তা শুনলে আধ-পাগল মনে হয়, সেই লোকটির চারপাশে একদল কলেজে-পড়া শিক্ষিত তরুণ কেন জুটেছে, কিসের টানে? বয়স্ক লোকেরা সাধু-সন্ন্যাসীদের ঘিরে থাকে নিজেদের পাপ আর দুষ্কর্ম ঢাকার জন্য, পরলোকে যাতে শাস্তি না পায় সেই আশায়, কিন্তু যুব সমাজের মধ্যে তো এমন স্বাৰ্থ বুদ্ধি থাকে না!
মহেন্দ্ৰলাল সবচেয়ে বিস্মিত হলেন গিরিশ ঘোষের বৃত্তান্ত শুনে। তার উচ্ছৃঙ্খলতা ও দুর্দান্তপনার কথা কে না জানে? সেই লোকেরও চরিত্রের এমন বদল হয়েছে, সে রামকৃষ্ণের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে? এই মানুষটি গিরিশের মনের এমন পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলেন কী ভাবে? এই মানুষটিকে আরও ভালোভাবে জানতে হবে।
ডাক্তারের ফি আগে থেকেই জোগাড় করে রাখা ছিল, মাস্টার সেই টাকাটা বাড়িয়ে দিলেন। মহেন্দ্রলাল গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে টাকা দিচ্ছ কী জন্য?
মাস্টার বললেন, আজ্ঞে ঠাকুরের ভক্তরা ওঁর চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা সংগ্রহ করেছেন। ডাক্তারের ফি তো অবশ্যই দিতে হবে।
আমাকেও তাদের একজন বলে ধরে নিতে পারো। ওষুধের খরচাও লাগবে না। তোমরা তোমাদের গুরুকে সাবধানে রাখবে। বুঝতেই পারছি, এ রোগ অতি কঠিন রোগ। দেখো, যেন বেশি লোকজন ওকে জ্বালাতন না করে। পায়ের ধুলো টুলো দেওয়া বন্ধ রাখো, যত বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলবে, তত ওর উত্তেজনা বাড়বে, কষ্টও বাড়বে।
মহেন্দ্রলাল চলে যাবার পর ভক্তরা বসে ঠিক করল, বাইরের লোকদের আর রামকৃষ্ণের কাছ যেতে দেওয়া হবে না। লোকদের তো প্রশ্নের শেষ নেই, তা ছাড়া অনেকেরই ধারণা হয়েছে, ওঁকে একটু স্পর্শ করলে, ওঁর পায়ের ধুলো নিলে মুক্তি পাওয়া যাবে। এখন ভক্তরাও পায়ের ধুলো নেওয়া বন্ধ রাখবে।
গিরিশ অবশ্য তাতে রাজি নন। প্রতিদিন গুরুর পদবন্দনা না করলে সে সুস্থির থাকতে পারে না। তবে বাইরের লোক আসা বন্ধ করতে হবে অবশ্যই।
কিন্তু দেখা গেল কাজটা সহজ নয়। দক্ষিণেশ্বরে বেশি লোক যেত না, অনেকে রামকৃষ্ণের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতই না। কলকাতা শহরে কিছু একটা ঘটলেই মুখে মুখে রটে যায়। একজন পরমহংস শ্যামপুকুরে এসে রয়েছেন, তাকে দেখার আকাঙ্খায় বহু লোক ছুটে আসে। সকলকে আটকানো যায় না। একেবারে অপরিচিতদের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া গেলেও ভক্তদের পরিচিত ব্যক্তিরা সঙ্গে আসে, তাদের মুখের ওপর বলা যায় না কিছু।
একদিন কালী ঘোষ তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এল। বন্ধুটি নিখুঁত বিলাতি পোশাক পরা, মাথায় টুপি, চোখে রিমলেস চশমা। পাহারাদার নিরঞ্জন ওদের আটকে দিল। কালী ঘোষ বলল, তার বন্ধুটি পশ্চিমদেশে থাকে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এসেছে। একবার রামকৃষ্ণকে দর্শন করে যাবে। নিরঞ্জন তবু রাজি নয়। তর্ক শুরু করে দিল কালী ঘোষ। সাহেবি কেতায় বন্ধুটি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে, যেন এসব তর্কে তার কিছু আসে যায় না। কেউ তাকে কোথাও আটকাতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত নিরঞ্জনকে নরম হতেই হল।
ভেতরে এসে কালীর বন্ধুটি চোখ থেকে খুলে ফেলল চশমা। মাথা থেকে টুপি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুল, আর্তবিলাপের স্বরে সে বলে উঠল, প্রভু, অপরাধ নেবেন না, আপনাকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে এসেছি!
স্বর শুনেই চিনতে পারলেন। এ তো অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী।
সেই চৈতন্য লীলা দেখার পর থিয়েটার দেখার নেশা লেগে গিয়েছিল রামকৃষ্ণের। ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’, ‘বিম্বমঙ্গল’ পালা দেখেছেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত বেশ কয়েক বার গেছেন, গ্ৰীনিরুমে বিনোদিনী ও অন্যান্য নটী-নটীদের আশীৰ্বাদ করেছেন।
রামকৃষ্ণের অসুস্থতার খবর পেয়ে বিনোদিনী ছটফট করছিল। সেই প্রথম দর্শনের দিন থেকেই বিনোদিনী এঁকে মহাপুরুষ বলে জেনেছে। রামকৃষ্ণের করুণাঘন চোখদুটি দেখার জন্য সে ছটফট করে। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, তার অভিনেত্রী-জীবন শেষ হয়ে আসছে।
বিনোদিনী ছদ্মবেশ ধরে আসার ব্যাপারটা দেখে রামকৃষ্ণ রাগ করার বদলে খুব মজা পেলেন, খল খল করে হাসতে লাগলেন তিনি। এ মেয়ে সাহেব সেজে অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছে। এ কী কম কথা! একে বলে টান!
রামকৃষ্ণ হাসছেন, আর তাঁর রোগ-জর্জর শীর্ণ শরীর দেখে অনবরত কাঁদছে বিনোদিনী। সে বারবণিতা, এমন একজন সাধক পুরুষকে স্পর্শ করার অধিকার তার নেই, দূর থেকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম জানাতে হয়। কিন্তু একবার কি সে ওই শ্ৰীচরণে মাথা ছোঁয়াতে পারবে না?
রামকৃষ্ণ পা বাড়ালেন, বিনোদিনীর চোখের জলে সেই পা ভিজে গেল।
বিনোদিনী ফিরল একলা। গিরিশবাবুকেও না জানিয়ে সে এসেছে, জানতে পারলে গিরিশচন্দ্র রাগ করবেন। বিনোদিনী সে রাগ সহ্য করতেও রাজি আছে, তাকে আসতেই হতো।
ঘোড়ার গাড়িতে বসে একটা ছোট আয়না বার করে মুখ দেখতে লাগল বিনোদিনী। তার কান্না এখনও থামছে না। মুখে রঙ মেখে সে সেজে এসেছে, থুতনির কাছটা ঘষতে লাগল বারবার। রঙ ওঠার পর সেখানে বেরিয়ে পড়ল একটা সাদা দাগ। কুষ্ঠ বা স্বেতী? কোন পাপে তার এমন হল? গুরুর কৃপায় এ দাগ মুছে যাবে না? না যদি যায়, এ দাগ ক্রমশ ছড়ায়, তা হলে আর মঞ্চে নামবে না সে, এ কালামুখ দর্শকদের দেখাবে না। দর্শকদের হৃদয়ের রাণী ছিল সে, সেই ভাবেই বিদায় নিয়ে চলে যাবে।