1 of 2

৩০. কলকাতা শহরে বহিরাগত ছাত্রদের পৃথক পৃথক মেস

কলকাতা শহরে বহিরাগত ছাত্রদের পৃথক পৃথক মেস আছে। সিলেটি মেস, কুমিল্লা মেস, ঢাকা মেস, নদীয়া মেস এই রকম সব নাম। ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, ওড়িশা থেকেও ছাত্ররা পড়তে আসে কলকাতায়, তারা গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে থাকে এক একঢি মেসে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১৯ নম্বর মুসলমান পাড়া লেনের মেসটি, কোনও জেলার নামে নাম নয়, সবাই এটিকে মুসলমান পাড়া মেস বলে জানে এবং যে কোনও জেলা বা প্রদেশের ছাত্ররাই এখানে থাকতে পারে। সাধারণত মেধাবী ছাত্ররাই এখানে এসে ওঠে, প্রতি বছর এই মেসের বেশ কিছু ছাত্র বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতের সহপাঠীরা অনেকেই থাকে এই সব বিভিন্ন মেসে, কেউ কেউ ভরতকে টেনে নিয়ে যায় নিজেদের মেসে আড্ডা দেবার জন্য। ভরত অবশ্য কুমিল্লা, ত্রিপুরা কিংবা সিলেট মেসে ভুলেও কখনও পা দেয় না। সে তার ত্রিপুরার পরিচয়টা একেবারে মুছে ফেলতে চায়। কোথাও ছাপার অক্ষরে ত্রিপুরা নামটি দেখলেও তার বুক কেঁপে ওঠে। এক একদিন দুঃস্বপ্ন দেখে সে জেগে ওঠে, যেন জঙ্গলের মধ্যে বুক পর্যন্ত তাকে পুতে রাখা হয়েছে আবার, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, তার দম শেষ হয়ে আসছে। কখনও একা একা পথ চলতে চলতে তার মনে হয়, তার পরিচয় জানতে পারলে কোনও গুপ্ত ঘাতক এখানেও এসে তাকে হত্যা করে যাবে। একা অবশ্য থাকে না ভরত, তার তিনজন বন্ধু খুবই ঘনিষ্ঠ, তারা ভরতের বাড়িতে আসে, ভরত ওদের মেসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটায়।

যাদুগোপাল রায় থাকে ঢাকা মেসে আর দ্বারিকানাথ লাহিড়ী থাকে মুসলমান পাড়ায়। দুটি মেসের পরিবেশের তফাত আছে। ছাত্ররা অধিকাংশই বাবার টাকায় পড়তে আসে, যাদের অবস্থা বেশ সচ্ছল তারা অধ্যয়নটাকেই তপস্যা না করে অন্যান্য দিকে আকৃষ্ট হয়। গ্রাম থেকে কলকাতা শহরের মতন চোখ ধাঁধানো পরিবেশে এসে দেখে যে এখানে সহজে বিশিষ্ট হতে গেলে পয়সা খরচ করতে হয়, পয়সা খরচ করার অনেক পিচ্ছিল পথ আছে, সে সব পথে নিয়ে যাবার জন্য সঙ্গী-সাথীরও অভাব হয় না। কিছু কিছু ছাত্র ক্লাস রুমে যাবার বদলে পতিতাপল্লীতে বেহুঁস হয়ে পড়ে থাকে। মফঃস্বল থেকে আসা অর্থবান ছাত্রদের নিঃস্ব করার জন্য কিছু কিছু আড়কাঠি লেগেই আছে।

ঢাকা মেসে কিছু ছাত্ৰ আছে এ রকম, আর কিছু ছাত্র কট্টর নীতি-বাগীশ ব্রাহ্ম। এখানকার পরিচালনা ব্যবস্থা বেশ কঠোর। এই মেসগুলি সম্পর্কে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও দায়িত্ব নেই, ছাত্ররা নিজেরাই চালায়। এখানেই প্রথম গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে ছাত্রদের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়। প্রতিমাসে একদিন নিজেদের মধ্যে ভোট নিয়ে একজনকে পরিচালক ঠিক করা হয়, সে যে শুধু সমস্ত খরচ চালাবার দায়িত্ব নেবে তাই-ই নয়, প্রয়োজনে কোনও ছাত্রকে শাসনও করতে পারবে। পরের মাসে নতুন কারুকে নির্বাচন করার আগে প্রাক্তন পরিচালক সমস্ত হিসেব-নিকেশ এবং কোনও গাফিলতি হলে তার জবাবদিহি করতেও বাধ্য। এ ছাড়া কিছু কিছু কোড অফ কনডাক্ট আছে। যেমন কোনও ছাত্রই মেস বাড়ির মধ্যে মদ এবং নিষিদ্ধ মাংস নিয়ে আসতে পারবে না। পরিচালকের অনুমতি না নিয়ে সারারাত বাইরে কাটাতে পারবে না। এবং আত্মীয় পরিচয় দিয়েও কোনও স্ত্রীলোককে ভেতরে আনা নিষিদ্ধ। এই সব নিয়মের বিরুদ্ধতা করলে কোনও কোনও ছাত্রকে বহিষ্কার করে দেবারও দৃষ্টান্ত আছে।

একটা ব্যাপার দেখে অবশ্য ভরতের মজা লাগে। যাদুগোপালের অতিথি হিসেবে সে ঢাকা মেসে কয়েকবার খেয়েছে। মির্জাপুরের এই তিনতলা বাড়িটির দোতলায় একটি হলঘর আছে। সবাই সেখানে মেঝেতে খবরের কাগজ পেতে একসঙ্গে রাত্তিরের খাবার খেতে বসে। কোনও কোনও ছাত্র জমিদার তনয় কিংবা উচ্চবংশীয় বলে অন্যদের মতন খবরের কাগজের ওপর বসে না। নিজেদের আলাদা পশমের আসন নিয়ে আসে। কারুর কারুর সঙ্গে থাকে ঘিয়ের শিশি কিংবা সন্দেশ-রসগোল্লা বা মিষ্টি দইয়ের ভাড়। সেগুলি শুধু নিজের জন্য, অন্যদের দেবে না। ভরত এ রকম আগে দেখেনি। তার ধারণা ছিল, একসঙ্গে খেতে বসলে সবাই একরকম খায়।

অঘোরনাথ বাঁড়ুজ্যে নামে বিক্রমপুরের একটি ছাত্র আরও একটি বিচিত্ৰ কাণ্ড করে। রান্নার ঠাকুরটিকে সে ঠিক বিশ্বাস করে না। তার ধারণা, লোকটির গলায় পৈতে থাকলেও সে বদ্যিবামুন। আসল ব্ৰাহ্মণ নয়। তাই সে একটা ছোট হাঁড়িতে নিজের জন্য রোজ ভাত ফুটিয়ে নেয়। ঠাকুরের রান্না ডাল-তরকারি-মাছের ঝোল খেতে তার আপত্তি নেই। অন্য ছেলেরা ঠাট্টা করে বলে, আরো অঘোইরা, ঠাকুরের রান্না খাইলে যদি তোর জাইত যায়, তাইলে ডাইল-মাছের ঝুল খাস ক্যামনে? ভাত ছাড়া আর কিছু রান্দতে জানোস না বুঝি!

অঘোরনাথ নিরীহভাবে উত্তর দেয়, না রে ভাই, আমি জাত-টাত বুঝি না। আসবার সময় আমার মা মাথার দিব্যি দিয়ে বলে দিয়েছে, অব্ৰাহ্মণের হাতে ভাত খাবি না। আমি সত্যভ্রষ্ট হতে পারব না। বাড়ি গেলে বলব, না, মাগো, কথা রেখেছি, অন্য জাতের রাঁধা ভাত খাইনি। কেউ কি জিজ্ঞেস করে, অব্ৰাহ্মণের হাতে ডাল খেয়েছিস? ঝোল খেয়েছিস? তাই ওগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

ভরতের বন্ধু যাদুগোপাল ব্ৰাহ্ম। সে মাঝে মাঝে ভরতকে তাদের প্রার্থনা সভায় নিয়ে যায়, ভরত কিন্তু প্রার্থনায় কখনও যোগ দেয় না, বাইরে বসে পত্র-পত্রিকা পড়ে। তার মা নেই, বাবা নেই, কোনও পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্র নেই, তার জীবনে ঈশ্বরেরও কোনও ভূমিকা নেই। সে একবার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে, চরম ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে, এই সব শাস্তি তাকে কে দিয়েছেন? ঈশ্বর? তা হলে তিনি কিসের করুণাময়? বিদ্যাসাগগর মশাই বলেছেন, দুর্ভিক্ষে যখন লাখ লাখ লোক মারা যায়, তখন ঈশ্বর কোথায় থাকেন? ভরত আর এইটুকু জীবনেই দেখেছে, সমাজে যারা ক্ষমতাবান কিংবা ধনী, তারা নানা পাপ কাৰ্য করেও ড্যাং ড্যাং করে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের কথাটি ভরতের খুব মনে ধরেছে। যদিও তার গলায় সুর নেই, তবু ভরত প্রায়ই গুনগুন করে, “পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে…।”

যাদুগোপালদের মেসে ব্ৰাহ্ম বনাম হিন্দু ছাত্রদের প্রায়ই তর্ক যুদ্ধ লেগে যায়। হিন্দুরা এক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, তাদের জাত-পাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, হাজার রকম কুসংস্কার আর তেত্রিশ কোটি দেব-দেবী নিয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় নানারকম ঠাট্টা ইয়ার্কি করত। ব্ৰাহ্মরা দাবি করে, তারা হিন্দু ধর্মের সংস্কার ঘটিয়ে একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করেছে, শিক্ষিত তরুণরা এক সময় দলে দলে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করছিল, ব্ৰাহ্মরা সেই স্রোত প্রতিহত করেছে।

বংশানুক্রমিক হিন্দু ছাত্ররা এই সব দাবির জবাব দিতে পারত না। হঠাৎ যেন নববলে বলীয়ান হয়ে উঠেছে হিন্দুরা। তারা বলতে শুরু করেছে, ব্ৰাহ্মদের সব সংস্কারই আসলে খ্রিস্টানদের অনুকরণ। সাহেবদের কাছে আধুনিক সাজার চেষ্টা। পাদ্রিরা যখন হিন্দুদের এতগুলি ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তখন বশংবদ ব্ৰাহ্মরা বলে, কেন, কেন, এই দেখুন না, এখন আমরা কেমন শুধু নিরাকার পরম ব্ৰহ্মকে মানি! আরে বাবা, খ্রিস্টানদের জবাব দেবারই বা কী দরকার? সাহেবরা যে গির্জায় গিয়ে যিশুর মূর্তির পায়ের কাছে কেঁদে ভাসায়, সেটা বুঝি মূর্তি পূজা নয়? এতগুলো ঠাকুর-দেবতা নিয়েও তো হিন্দু সমাজ কয়েক হাজার বছর ধরে বেশ টিকে আছে। যার ইচ্ছে যে কোনও দেব বা দেবীকে ইষ্টদেবতা বলে মানে। কেউ কিছুই মানে না। এমনকি নাস্তিকও হিন্দু থাকতে পারে।

এখনকার হিন্দু ছাত্ররা জোরালো সমর্থন পাচ্ছে মহামান্য লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে। শশধর তর্কচূড়ামণি নামে এক পণ্ডিতের আগমন হয়েছে শহরে, তিনি আবার মাথায় টিকি রাখা, একাদশীর উপোস, পূর্ণিমায় গঙ্গাস্নান, অমাবস্যার দিন লাউ কিংবা বেগুন না খাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন।

এই উগ্ৰ হিন্দুদের কেউ কেউ কেশবপন্থীদের আরও বিদ্রূপ করে বলে, তোদের কেশববাবু আর ব্ৰাহ্ম রইলেন কোথায় রে! এখন তো তিনি বোষ্টম। মহাপ্রভুর অবতার, নাচতে নাচতে কাঁদেন।

অবশ্য সম্প্রতি কেশবচন্দ্রের মৃত্যুতে হিন্দু ব্ৰাহ্ম সব ছাত্ররাই শোকপালন করেছে। একসময় কেশবচন্দ্র যুবসমাজকে যেমন ভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলেন, তার তুলনা নেই। এখনকার তরুণরা সুরেন বাড়ুজ্যে-শিবনাথ শাস্ত্রীদের দিকে ঝুঁকেছে, তবু কেশবচন্দ্রের ভূমিকা চিরকাল অম্লান থাকবে।

ভরতের আর এক বন্ধু দ্বারিকানাথদের মুসলমানপাড়ার মেসের পরিবেশ আবার অন্যরকম। ধর্মের বদলে এখানকার প্রধান তর্কাতর্কির বিষয় রাজনীতি।

ছাত্র সমাজ যে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হতে পারে, তা এই কিছুদিন আগে অবিষ্কৃত হয়েছে। সঙ্ঘবদ্ধ হলে ছাত্র শক্তি একটি বড় শক্তি। কয়েক বছর আগে বিপিন পাল নামে একটি ছাত্রকে ফিরিঙ্গিরা অপমান করেছিল, তাই নিয়ে বিপিন ও কয়েকজনের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের মারামারি বেধে যায়। পুলিশ এসে ফিরিঙ্গিদেরই সাহায্য করে। তখন ছাত্ররা দল বেঁধে ছুটে এসে বিপিনের পক্ষ সমর্থন করলে পুলিশও হটে যেতে বাধ্য হয়। কয়েকটি পুলিশ রীতিমতন ঠ্যাঙানি খেয়েছিল।

প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন সাহেব অধ্যাপক ভারতীয়দের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছিলেন, একটি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রকে স্কুলের ছেলের মতন বেঞ্চির ওপর দাঁড়াতে বলেন। তাতে সমস্ত ছাত্ররা একযোগে প্রতিবাদ জানায়। অধ্যাপকমশাই ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়লেও ছাত্ররা সিঁড়ি অবরোধ করে রাখে। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক মিঃ বেলেট যখন অন্য কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাবার চেষ্টা করলেন, একটি ছাত্র বেশি বাড়াবাড়ি করে তাঁর মাথা লক্ষ করে ইট ছুড়ে মারে। যাই হোক, মিঃ বেলেটের মাথায় বেশি লাগেনি, শুধু টুপিটা খুলে পড়ে গিয়েছিল। ছাত্ররা টের পেল সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের জোর।

মুসলমানপাড়া মেসের এককালের বাসিন্দা ছিলেন আনন্দমোহন বসু। এ রকম মেধাবী ছাত্ৰ এখনও আর একটিও আসেনি। আনন্দমোহন এই মেসে থাকতে থাকতেই প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলার হয়ে দশ হাজার টাকা পান, তারপর বিলেতে গিয়ে আরও অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। কেমব্রিজে তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম র‍্যাংলার অর্থাৎ গণিতে প্রথম শ্রেণীর সম্মানসহ স্নাতক হয়েছিলেন। শুধু কতৃবিদ্যই নন, আনন্দমোহন দেশ ও সমাজ মনষ্ক। কলকাতায় ফিরে তিনি স্থাপন করলেন, ক্যালকাটা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। এই প্রথম কলকাতার ছাত্ররা একটা সমিতির অন্ত্ররভুক্ত হল। এখন ছাত্র আন্দোলনে এই সমিতিই নেতৃত্ব দেয়। আনন্দমোহনের সঙ্গে সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথও এসে যোগ দিয়ে এই সমিতির ছাত্রদের মাতিয়ে তুললেন।

আনন্দমোহন এবং সুরেন্দ্রনাথ এখনও মুসলমানপাড়ার এই মেসে মাঝে মাঝে আসেন। নতুন ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হতে চান।

রাজনীতি ছাড়াও এই মেসে খাওয়া-দাওয়াও হয় বেশ ভালো। নিত্য-নৈমিত্তিক ডাল-ভাত-মাছের ঝোল তো আছেই, তা ছাড়াও ধনী ছাত্রদের কেউ কেউ এক একদিন মেসের সব বাসিন্দাদের মাংস কিংবা পোলাও কিংবা রাবড়ি খাওয়াবার শুরু হয়। মুরগির মাংস এই মেসে নিষিদ্ধ নয়। দ্বারিকানাথ একদিন একাই চারটি আস্ত মুরগি খেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল।

দ্বারিকানাথ প্রায়ই বড়াই করত, সে চারখানা মুরগি খেতে পারে। সে বঙ্কিমচন্দ্রের শিষ্য। বঙ্কিমবাবু নাকি তাকে বলেছেন, তিনি যখন ওড়িশার যাজপুরে চাকরি করতেন, তখন প্রতিদিন চারটি আস্ত মুরগি ও চারটি ডিম খেতেন। এখনও দুটো মুরগি অনায়াসে খেতে পারেন। যারা বেশি মাথার কাজ করে, তাদের বেশি বেশি ভালো খাবার খেতে হয়। দ্বারিকানাথের দাবি, তার গুরু যদি চারটি মুরগি খেতে পারেন, সে শিষ্য হয়ে পারবে না?

কয়েকটি ছেলে তার সঙ্গে বাজি ধরেছিল। চারখানা বড় আকারের মুরগি রান্না করে সাজিয়ে দেওয়া হল তার সামনে। কার্পেটের আসনে বাবু হয়ে বসে খেতে শুরু করার আগে সে বলল, ওরে, রামমোহন রায় একটা গোটা পাঠার মাংস খেতে পারতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চারটে মুরগি খান। তোরা একটাও সাবাড় করতে পারিস না? বাঙালির কী অধঃপতন!

সত্যি সত্যি দ্বারিকানাথ সেই চারখানা মুরগি শেষ করে বিরাট এক ঢেঁকুর তুলল। তারপর মুচকি হেসে বলল, এরপর একটু সিরাপ খাব, তাতেই সব হজম হয়ে যাবে!

বঙ্কিমবাবুর নাম শুনলেই ভরতের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে ঈশ্বর মানে না, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তার আরাধ্য দেবতা। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাকে কেন্দ্র করেই ভরতের জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। অন্য বইয়ের অভাবে সে একসময় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা থেকে বঙ্কিমের রচনা মুখস্থ করত।

সেই বঙ্গদর্শনের প্রকাশ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, তাতে ছাত্র সমাজের ক্ষোভের শেষ নেই। অবশ্য বঙ্গদর্শনের সম্পাদনা বঙ্কিমচন্দ্র অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, তারপর সঞ্জীবচন্দ্র ও শ্ৰীশ মজুমদারের হাতে এই পত্রিকার রুচির বেশ অবনতি হয়েছিল, ‘পশুপতি সম্বাদ’-এর মতন বিশ্ৰী বদ রসিকতাও সেখানে ছাপা হয়, তবু যাই হোক, তাতে বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু না কিছু রচনা তো পাওয়া যেত! তিনি যে অন্য পত্রিকায় লেখেন না।

বঙ্কিমবাবু এখন কলকাতাতেই কলুটোলায় বাসা ভাড়া করে আছেন। তাঁর বাড়িতে ছুটির দিন মজলিশ বসে, অনেক নাম করা লোক সেখানে আসেন, ইদানীং শশধর তর্কচূড়ামণিও আসছেন।

ভরতের খুব ইচ্ছে, একবার বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে সাক্ষাত করে জীবন ধন্য করে। কিন্তু অযাচিতভাবে যাওয়া যায় না, শোনা যায় তিনি খুব গম্ভীর ও রাশভারি। দ্বারিকানাথের বাবাও একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে পরিচয় আছে, সেই সুবাদে দ্বারিকানাথ প্রায়ই ওঁর বাড়িতে যায় এবং ফিরে এসে নানা রকম গল্প করে, তার কতটা সত্য আর কতটা দ্বারিকানাথের স্বকপোলকল্পিত, তা বলা শক্ত। ভরত দ্বারিকানাথের সঙ্গে একদিন যাবার জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও দ্বারিকানাথ তাকে ল্যাজে খেলাচ্ছে।

ভোজনরসিক দ্বারিকানাথকে খুশি করার জন্য ভরত প্রায়ই তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায়। ভবানীপুরের এই সিংহবাড়ির সবাই বৈষ্ণব, এ বাড়ির রান্নাঘরে মুরগির মাংস ঢোকার তো প্রশ্নই ওঠে না, ওই নাম উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ। কেন যেন অনেকেই মনে করে যে কুক্কুট মাংসের সঙ্গে যবন সংসৰ্গ আছে। এরা কোনও মাংসই খায় না। মাছ রান্না হয় অবশ্য, তাও বাছাই করা তিন-চার রকম মাত্র।

ভরত এই ব্যাপারটা বোঝে না। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্যও বৈষ্ণব, কিন্তু রাজবাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনও ছুৎমার্গ নেই। ত্রিপুরায় পাঁঠা, খাসি, বনমোরগ, খরগোশ, হরিণ, মোষ সব রকম মাংসই চলে। মুসলমানদের বাড়িতে গো-মাংসও চলে, সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে কোনও হিন্দু আহারাদি করলেও তার জাত যায় না। বাংলা নিয়ম অন্যরকম।

সিংহবাড়ির লোকজনদের সঙ্গে ভরতের বনিবনা নেই তেমন। সে শশিভূষণের অংশের প্রতিনিধি বলে কেউ তাকে ঘাটায় না বটে, কথাবার্তাও বলে না বিশেষ। বারোয়ারি রান্নাঘর থেকে ভরতের জন্য খাবার আসার কথা, কিন্তু দিনের পর দিন ঝালহীন, মশলাহীন রান্না আর ভালো লাগে না তার। এখন তার অবস্থাও কিছুটা সচ্ছল। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হবার পর গৃহশিক্ষক দুজনকে রাখার আর প্রয়োজন হয় না। এখন সে দোতলায় তার ঘরের পাশের বারান্দায় একটি ছোট রান্নাঘর বানিয়ে নিয়েছে, রান্না শিখতেও তার দেরি হয়নি।

প্রায় অদৃশ্যভাবে এবং নিঃশব্দে তাঁর রান্নার অনেক কিছু জোগাড়যন্ত্র করে দিয়ে যায় ভূমিসূতা। ভরত তাকে আসতে বারণ করে, তবু সে কিছুতেই শুনবে না। স্ত্রীজাতি সম্পর্কে ভরতের মনে একটা বিতৃষ্ণা ও ভীতির ভাব আছে। মাতৃস্নেহ পায়নি সে, স্নেহ ব্যাপারটাই তার কাছে অজ্ঞাত। তার কলেজের কিছু কিছু সহপাঠী যখন নারীসম্ভোগ বিষয়ে রসালাপ করে, গা ছমছমিয়ে ওঠে ভরতের, সে সেখান থেকে সরে যায়, তার মনে হয়, ওই ছেলেগুলি স্বেচ্ছায় বিপদের মধ্যে ঢুকতে চাইছে।

একটি মেয়ে তো শুধু স্ত্রীজাতির একজনই নয়, সে মানুষও বটে। পুরুষ ও স্ত্রী যে একই মানব শ্রেণীর অন্তর্গত, ভরত তাও বোঝে। মানুষের বিপদের মানুষই তো পাশে দাঁড়ায়। ভরত জানে যে, ভূমিসূতা তার কাছে বেশি যাওয়া-আসা করলে একটা কিছু গোলযোগ ঘনিয়ে উঠবে। ত্রিপুরার রাজবাড়ির মতন হয়তো এ বাড়ির আশ্রয়ও ছাড়তে হবে ভরতকে। অপরপক্ষে, ওই ভূমিসূতা নামের মেয়েটিও যে বিপদের মধ্যে আছে, তাও ঠিক। সে প্রায় একটি ক্রীতদাসী, সুতরাং তার মাংসের ওপর অধিকার আছে যার-তার। এমনকি রান্না ঘরের ঠাকুরেরাও তার ওপর জোর-জবরদস্তি করে, তাই ভূমিসূতা ভরতের কাছে আশ্রয় পাবার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু ভরত তাকে কী ভাবে আশ্রয় দেবে?

ভরতকে এখন মন দিয়ে পড়াশুনো করতে হবে, এম এ পরীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত সে থামবে না, তারপর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি জোগাড় করতে পারলে সে স্বাবলম্বী হবে। সরকারি অফিসার হলে কেউ আর তার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারবে না। এমনকি সে তখন ইচ্ছে করলে ত্রিপুরাতেও ফিরে যেতে পারবে। জন্মভূমির কথা ভেবে মাঝে মাঝে ভরতের বুক টনটন করে।

তা ছাড়া, কলেজে ভরত এক বৃহত্তর জগতের সন্ধান পেয়েছে। দেশ, সমাজ, ধর্ম, পরাধীনতা এই সব নিয়ে সে এখন চিন্তা করে, সারা বিশ্বে ভারতের স্থান এখন কোথায়, তা নিয়ে মাথা ঘামায়। সে অনুভব করছে যে, এ দেশের মানুষের মানসিকতার একটি পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, এবং তাতে তারও একটা ভূমিকা আছে। এই সব রোমাঞ্চকর সম্ভাবনা ছেড়ে সে কি নিতান্ত একটা মেয়ের জন্য ঝঞ্ঝাট জড়িয়ে পড়বে? এ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলে সে অকুল পাথরে পড়বে, তার পড়াশুনোও শেষ হয়ে যাবে!

ভূমিসূতার মতন আশ্রিতা মেয়েরা শেষ পর্যন্ত বাবুদের ভোগেই লাগে। তারাও তা মেনে নেয়। কিন্তু এই মেয়েটি কিছুটা পড়াশুনো শিখেছে, ওর মনের অন্ধকারে ফাটল ধরে সেখানে ঢুকেছে বাইরের আলোর রশ্মি, তাই ও অমন কদৰ্য জীবন মানতে পারে না। ওর সঙ্গে দু একবার কথা বলে ভরত তা টের পেয়েছে। কিন্তু ভরতও যে অসহায়!

একবার সে ভেবেছিল, মেয়েটিকে থিয়েটারের দলে ভিড়িয়ে দেবে। এই ব্যাপারে সে তার বন্ধু যাদুগোপালের সাহায্য চেয়েছিল। যাদুগোপালের সঙ্গে প্ৰখ্যাত নট অর্ধেন্দুশেখরের সামান্য আত্মীয়তা আছে, সেইজন্য যাদুগোপালের মাধ্যমে গেলে অর্ধেন্দুশেখর হয়তো প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখবেন। কিন্তু যাদুগোপাল এ কথা শুনেই ঘোর আপত্তি জানাল। ব্ৰাহ্ম নৈতিকতায় ঝলসে উঠে সে বলেছিল, তুই কী রে ভরত? একটা জলে ডোবা মেয়েকে উদ্ধার করতে গিয়ে তুই নোংরা পাঁকে তার মাথা ঠুসে দিবি? থিয়েটারে গেলে ওর নষ্ট হতে দুদিনও লাগবে না। বাড়ির থেকে থিয়েটারের পরিবেশ ভালো? বাড়িতে যদি বা বাঁচার আশা থাকে, থিয়েটারে গিয়ে ঘাগী বেশ্যা হবে, আর তুই দায়ী হবি তার জন্য!

এরপর ভরত হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ভূমিসূতার ভাগ্য সে বুঝে নিক। সে একদিন কঠিন মুখ করে ভূমিসূতাকে জানিয়ে দিল, তুমি আর কক্ষনও আমার কাছে আসবে না।

কাছে আসে না ভূমিসূতা, দূরেই থাকে। ভরত তাকে দেখতে পায় না, কিন্তু তার ঘোরাফেরা টের পায়। ভরত ঘর থেকে বেরুলেই সে পালিয়ে যায় এক ছুটে। এরই ফাঁকে ফাঁকে সে কখন যেন ভরতের এঁটো বাসন মেজে দেয়, কুঁজোয় জল ভরে রাখে, রান্নার জন্য মশলা পাতি বেটে, তরিতরকারি কুটে রাখে। কিন্তু গান আর সে গায় না। নাচে না। সকালবেলা যখন সে বাগানে ফুল তুলতে যায়, তখন ভরত দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই সে লুকিয়ে পড়ে ঝোপের আড়ালে। ভরতকে সে দেখা দেবে না কিছুতেই।

ভরত সন্ধেবেলা সেজবাতি জ্বেলে পড়াশোনা করে, সেই সময় তাঁর ঘরের বাইরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকে  ভূমিসূতা। সে স্থানটি অন্ধকার, তবু সেই অন্ধকারেই তার নিরাপদ আশ্রয়। এই সময়টাই তার ভয়ের সময় যমজ ভাইদুটি এখনও আশা ছাড়েনি, তারা ভূমিসূতার সন্ধানে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায়। রান্নাঘরের ঠাকুরদেরও সন্ধের পর কাজ কম থাকে, তারা নানান ছুতোয় ভূমিসূতাকে ডাকার চেষ্টা করে। ভূমিসূতা তখন নিশ্চিন্তে অন্ধকারের মধ্যে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকে। যমজ ভ্রাতৃদ্বয় ভরতের হাতে একদিন গলা ধাক্কা খেয়ে আর এদিকে আসতে সাহস পায় না। যারা লেখাপড়ায় মোটেই এগোয়নি, তারা কলেজে-পড়া ছেলেদের ভয় পায়। শুধু শারীরিক আঘাতের ভয় নয়, কথার ভয়। কলেজের ছাত্রদের কথার তেজে গুরুজন শ্রেণীর লোকও কুঁকড়ে যায় ভয়ে। রান্নার ঠাকুররাও ভরতকে সমীহ করে। দেশে চিঠি পাঠাবার সময় ঠিকানা লেখাবার জন্য ভরতই তাদের ভরসা।

পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করা ভরতের স্বভাব। মাঝে মাঝে সে জোরে জোরে পাঠ্য বিষয় আবৃত্তি করে। শুধু কবিতা নয়, গদ্যও। ভাষা শিক্ষার জন্য গদ্য মুখস্থ করা খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় তার কাছে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বই বিশেষ নেই, বঙ্কিমের গদ্য রচনা মুখস্থ করে সে বাক্যের গড়ন শেখে। ‘আনন্দমঠ’ বইখানি খোলা থাকে, সে চোখ বুজে উচ্চারণ করে : ‘ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিল। ভবানন্দ বলিল, “ভাই ইংরেজ ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।” তখন পিপীলিকা শ্রোতোবৎ সন্তানের দল, নতুন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া ইংরেজদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল…।’ বলতে বলতেই ভরত ভাবে, ‘ইংরেজাদিগকে আক্রমণ করি’ না লিখে বঙ্কিম লিখেছেন, “আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল”, কত বেশি ভালো শোনায়। ছবিটা স্পষ্ট দেখা যায়।

প্রতিদিনই ভরত টের পায় যে ঘরের বাইরে অন্ধকারে ভূমিসূতা বসে আছে। সে কোনও শব্দ করে না বটে, কিন্তু একজন মানুষের অস্তিত্ব কিছুতেই গোপন থাকে না। চতুর্দিকে নিস্তব্ধ, এর মধ্যে কাপড়ের খসখসানি, মৃদু নড়াচড়া, নিঃশ্বাসের শব্দও এক এক সময় কানে আসে। ভরত কিছুতেই ও দিকে মন দেবে না ভাবলেও কখনও পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হতেই হয়। মেয়েটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন বসে থাকে? এ ভাবে বসে থাকাটা কি শোভন? শত নিষেধও ও শুনবে না।

কোনওদিন ভরতের মানসিক চাপ অসহ্য হয়। অন্ধকারে পোকা-মাকড়-টিকটিকি ঘোরে, একদিন একটা তেঁতুলে বিছে দেখা গিয়েছিল, তার মধ্যে বসে আছে মেয়েটি, এ কথা জানলে কি পড়াশুনোয় মন দেওয়া যায়?

ভূমিসূতাকে আরও কড়া বকুনি দেবার জন্য ভরত আচমকা দরজা খুলে ফেলে। তবু ধরা যায় না তাকে। সে যেন পাখির মতন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। কিংবা আঁধারে এক ঝলক বিদ্যুৎ। কিংবা রূপকথার রাজ্যের এক পরী। ভরত অপলকভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *