1 of 2

২০. চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িটি

চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়িটি ছেড়ে দিতে হল। উদ্দেশ্য ছিল তিনজনে মিলে কাব্য ও গান নিয়ে মেতে থাকা ও প্রকৃতি সম্ভোগ, কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নানা কাজে প্রায়ই কলকাতায় যেতে হয়, আসা-যাওয়ায় অনেক সময় খরচ হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরলেন বটে, কিন্তু জোড়াসাঁকোর বাড়ির অত ভিড়ের মধ্যে থাকতে চাইলেন না। চৌরঙ্গি পাড়ায় একটি অট্টালিকা ভাড়া নিলেন।

এই অঞ্চলটিতে অধিকাংশ বাড়িই ইংরেজ, আরমেনিয়ান ও পারসিদের, বেশ নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্ন, সবচেয়ে বড় গুণ পথ-চলার সময় কিংবা কোনও বাড়ির বার-বারান্দায় দাঁড়ালে দুৰ্গন্ধ সহ্য করতে হয় না। রাস্তার পাশের কাচা ড্রেনগুলি ঢেকে সম্প্রতি এখানে পাথরের ফুটপাথ বানানো হয়েছে, রাত্তির বেলাতেও নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়, কোনও পগারে পদস্থলনের ভয় নেই। গ্যাসের আলোয় ঝলমলে এই পথটির সঙ্গে লন্ডনের যে-কোনও রাজপথের তুলনা করা যায়।

এই চৌরঙ্গির ওপরেই যাদুঘরের প্রাসাদ, তার পাশের রাস্তাটির নাম সদর স্ট্রিট, সেই গলির দশ নম্বর বাড়িতে শুরু হল কাদম্বরী দেবীর নতুন সংসার। ঘরগুলি সাজাবার জন্য প্রচুর নতুন আসবাব কেনা হল, পালঙ্ক, আলমারী, ওয়ার্ডরোব, বড় বড় বেলজিয়ান কাচের আয়না, সাদা কাচ-করার বিলিতি পুতুল, বারান্দায় বসানো হল চিনে মাটির স্ট্যান্ড। হগ সাহেবের বাজার থেকে প্রতিদিন সকালে আসে টাটকা ফুল। কাদম্বরী নিজের হাতে সাজাতে ভালোবাসেন, একবার এক একখানা ঘর সাজান, পছন্দ না হলে আবার বদলে ফেলেন সব কিছু।

রবি কোথায় থাকবে, তা নিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছিল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তার একটি নিজস্ব ঘর আছে ঠিকই, কিন্তু দাদা-বউদিদিরা অন্যত্র বসবাস শুরু করলে জোড়াসাঁকোয় তার মন টিকবে কেন? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অবশ্যই রবিকে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন, সদর স্ট্রিটের বাড়িটির একেবারে শেষ প্রান্তে একটি বিশাল বারান্দাওয়ালা ঘর তার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ওদিন বির্জিতলাও-এর বাড়িতে জ্ঞানদানন্দিনীও তাঁকে বারবার থাকতে বলেছেন। ও বাড়িতে সুরেন আর বিবি তাদের রবিকা-কে কাছে পাবার জন্য সব সময় আবদার করে। জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, রবি, তুমি তো চন্দননগরে নতুনদের সঙ্গে অনেকদিন রইলে, এবার কিছুদিন আমার কাছে থাকে। বিলেতের সেইসব দিনগুলোর কথা ভুলে গেলে? সন্ধেবেলা তুমি বাচ্চাদের নিয়ে গান গাইবে, আরও লোকজন ডেকে পার্টি হবে…।

রবি ঠিক করল সে এবারে বির্জিতলাও-এর বাড়িতেই থাকবে। অনুমতি নেবার জন্য সে এল সদর স্ট্রিটের বাড়িতে। কাদম্বরী তখন রবির ঘরটিতেই পর্দা সাজাচ্ছিলেন। প্রশস্ত পালঙ্কের ওপর ধপধপে বিছানা, শিয়রের দু দিকে লম্বা স্ট্যান্ডের ওপর ফুলদানিতে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল, রবি যদিও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে বালিশ দিয়ে লেখে, তবু তার জন্য আনা হয়েছে নতুন লেখার টেবিল ও চেয়ার, পাশের ওয়ার্ডরোবটিও সাদা রং করা, জানলায় টাঙানো হচ্ছে সাদা লেসের পর্দা। সারা ঘরখানিতেই রয়েছে শুভ্ৰ স্বাচ্ছন্দ্যের আবহাওয়া। একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে, কোমরে আঁচল জড়িয়ে পর্দার রিং পরাচ্ছেন কাদম্বরী। বৈশাখ মাস, বাতাস নীরস, আকাশে কোনও রং নেই, দারুণ দাহন বেলা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কাদম্বরীর মুখে।

রবি বলল, নতুন বউঠান এত যত্ন করে কার জন্য সাজাচ্ছ এই ঘর?

কাদম্বরী মুখ ফিরিয়ে কৌতুক হাস্যে বললেন, কার জন্য বল তো?

রবি বলল, বিশেষ কোনও অতিথি আসবেন বুঝি?

কাদম্বরী বললেন, একতলায় অতগুলো ঘর তা হলে রয়েছে কিসের জন্য?

রবি বলল, বলা তো যায় না, বিহারীলাল চক্ৰবর্তী মশাই যদি কোনও কোনও রাত্তিরে থেকে যেতে চান, তাঁকে তো আর একতলায় পাঠানো যাবে না!

চক্ষে বিদ্যুৎ খেলিয়ে কাদম্বরী বললেন, মরণ!

রবি বলল, নতুন বউঠান, সুরেন আর বিবি আমাকে খুব করে ধরেছে। ওদের কাছে থাকবার জন্য। আমি ভাবছি, কিছুদিন বির্জিতলাও-এর বাড়িতে গিয়ে থাকলে কেমন হয়? শুধু রাত্তিরটা কাটাব ওখানে। বেশিদূরে তো নয়, দিনের বেলা যখন তখন চলে আসতে পারব।

বাতিহীন চিনে লণ্ঠনের মতন কাদম্বরীর মুখখানা সঙ্গে সঙ্গে নিষ্প্রভ হয়ে গেল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, তুমি এখানে থাকবে না? মেজবউঠানের কাছে থাকবে?

কয়েক শো মুহূর্ত পলকহীন চোখে কাদম্বরী নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন রবির দিকে। তারপর খুব ধীর গলায় বললেন, বেশ, তাই যাও। তোমার যদি ইচ্ছে হয়-

সঙ্গে সঙ্গে রবির বুকটা মুচড়ে উঠল। সে কি জানে না, কতখানি মমতায় এই ঘরখানি সাজানো হচ্ছে, এবং কার জন্য? এখানে দাঁড়িয়ে সে চলে যাবার কথা উচ্চারণ করতে পারল কী করে? সে নিজেই কি দূরে গিয়ে থাকতে পারবে?

কাছে এগিয়ে এসে রবি বলল, বাঃ,তুমি অমনি এককথায় রাজি হয়ে গেলে! তুমি বুঝি আমায় তোমার কাছে রাখতে চাও না?

কাদম্বরী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুমি যদি থাকতে না চাও…

রবির আর যাওয়া হল না।

অবশ্য একথাও ঠিক, যেখানেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেখানেই প্রাণের প্রাচুর্য, উৎফুল্ল পরিবেশ, অফুরান আড্ডা। প্রায়ই সকালে চলে আসেন অক্ষয় চৌধুরী, প্রিয়নাথ সেন, জানকীনাথ ঘোষালের মতন বন্ধু ও আত্মীয়েরা। চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে খোস গল্প ছাড়াও ‘ভারতী’ সম্পাদনার কাজও চলে। এই মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদকের হিসেবে বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের নাম ছাপা থাকলেও তিনি বিশেষ সময় দিতে পারেন না। রচনা নির্বাচন থেকে প্রেসে ছাপানো ও ঠিক সময় বিলিতি বন্দোবস্ত করার সব দায়িত্বই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। সম্প্রতি রবি কবিতা বিভাগটির ভার নিয়েছে, সে উদীয়মান কবিদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্ৰহ করে আনে।

রচনাগুলি প্রেসে পাঠাবার আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক একটি হাতে নিয়ে উচ্চ কণ্ঠে পাঠ করেন, উপস্থিত তিন-চার জন শ্ৰোতা কখনও তারিফ করেন, কখনও অংশবিশেষ সম্পর্কে আপত্তি জানান। মূল লেখকরা সবাই ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কিত। পরিমার্জন ও পরিবর্তনের জন্য তাঁদের অনুরোধ জানাতে কোনও অসুবিধে নেই। কোনও লেখার মূল বক্তব্যের সঙ্গে সম্পাদকমণ্ডলির গুরুতর মতভেদ থাকলেও তা বর্জন না করে মুদ্রণ করা হয়, সম্পাদকের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও যোগ করা হয় সেই সঙ্গে। রবি যখন বিলেত থেকে ‘পারিবারিক দাসত্ব’ নামে অতি উগ্ৰ প্ৰবন্ধটি পাঠিয়েছিল, তখন সেটি ছাপিয়ে দ্বিজেন্দ্ৰনাথ ওই অল্পবয়স্ক স্পর্ধিত লেখকের বক্তব্যের প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন সম্পাদকীয়তে।

নির্বাচকমণ্ডলির এই আসরে কাদম্বরী এসে বসেন না কখন। তিনি থাকেন আড়ালে আড়ালে, কখনও রেকাবি ভর্তি লিচু এনে রেখে যান টেবিলে, কখনও নিজের হাতে তৈরি সন্দেশ। ঠিক সময়মতন চায়ের পটি এসে যায়। হঠাৎ কোনও লেখা সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করলে সচকিত হয়ে ওঠেন সবাই। তাঁর উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-রুচির পরিচয় ফুটে ওঠে সেই কথায়।

অক্ষয় চৌধুরী অনেকবার বলেছেন, নতুন বউঠান, আপনি এসে বসুন না আমাদের সঙ্গে! কাদম্বরী সলজ্জভাবে ঘাড় নেড়ে বলেন, না, না। আমি আপনাদের জন্য শরবত নিয়ে আসছি!

কাদম্বরী কিছু লিখতেও চান না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অনেক অনুরোধ করেছেন। রবি ঝুলোঝুলি করেছে, হাত ধরে অনুনয়ের সঙ্গে বলেছে, তুমি লেখো, তুমি সাহিত্য এত ভালোবাসো, তুমি নিশ্চয়ই লিখতে পারবে। কাদম্বরী হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, যাঃ, আমি কি জানি! ওসব আমার দ্বারা হবে না!

ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়েই বাংলা লেখায় হাত দিয়েছে। স্বর্ণকুমারী নিয়মিত লেখিকা, তাঁর একাধিক গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে। এমন কি অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী, যার বাল্যকাল কেটেছে লাহোরে, তাই রবি তাঁর নাম দিয়েছে লাহোরিনী, তিনিও বেশ লিখছেন। মেজবউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর লেখার শখ আছে, তাঁর বাংলা ভাষাজ্ঞান তেমন টনটনে নয়, রবি তাঁর লেখা আগা-পাশ-তলা সংশোধন করে দেয়। কিন্তু যিনি হয়তো এঁদের সবার চেয়ে ভালো লিখতেন, সেই কাদম্বরী না-লেখার ধনুৰ্ভঙ্গ পণ করে রয়েছেন।

সকালের এই আড্ডা শেষ হয় দুপুরের বত্ৰিশ ব্যঞ্জন ভোজনের পর।

কোনও রবিবার এই বৈঠক স্থানান্তরিত হয় মানিকতলার অক্ষয় চৌধুরীর বাড়িতে কিংবা আমবাগানে জানকীনাথের বাড়িতে। একটা হলদে রঙের বাক্সে জমা থাকে সব পাণ্ডুলিপি। সেটাই ‘ভারতী’ সম্পাদকীয় দপ্তর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেই বাক্সটা বগলদাবা করে স্ত্রী ও ছোটভাইকে নিয়ে ল্যান্ডো গাড়ি চেপে চলে আসেন উত্তর কলকাতায়। প্রখ্যাত কবির বিহারীলাল চক্রবর্তীও এসে যোগ দেন প্রায়ই।

সকাল ও দুপুরগুলি জমজমাটভাবে কেটে গেলেও বিকেলের পর বাড়িটি যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রায়ই সন্ধের সময় বাড়িতে থাকেন না।

রবি তার জ্যোতিদাদার কর্মশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। জ্যোতিদাদাই তার হিরো। এ দেশে কত মানুষ শুধু একটা চাকরি কিংবা জীবিকা নির্বাহের কোনও একটা উপায় পেয়েই ধন্য হয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। কেউ বড়জোর সামান্য শখে তবলা পেটায় বা বাঁশি ফোকে। কেউ কবিতা রচনা শুরু করেই নিজেকে মহাকবি ভেবে ফেলে অন্যদের গালমন্দ শুরু করে দেয়। শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেবার সাহস থাকে না অধিকাংশ মানুষের।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। এমন আমুদে ও সঙ্গীতপ্রিয় মানুষটি তাঁর কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু দিকে। মাসিক ‘ভারতী’ পত্রিকা চালাচ্ছেন তিনি, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের পরিচালনা কাৰ্যও তাকে দেখতে হয়। পিতার নির্দেশে জমিদারি তদারকির ভারও তাঁর ওপর, সে কাজ করছেন দক্ষতার সঙ্গে, আয় বেড়েছে যথেষ্ট। এ ছাড়াও নিজস্ব পাটের ব্যবসা আছে জানকীনাথের সঙ্গে, তাতেও লাভ হচ্ছে এখন। এরকম যে-কোনও একটা কাজের ভার নিয়েই অনেক মানুষ হিমসিম খায়। এর পরেও জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ ছবি আঁকছেন, লিখছেন নাটক। এত কাজের তিনি সময় পান কখন? যখন পিয়ানো বাজাতে বসেন, তখন এমন তন্ময় হয়ে যান, যেন ভুলে যান অন্য সব কিছু। আবার আড্ডা দিতে বসলে মনে হয়, তার কোনও কাজের তাড়া নেই। অথচ প্রতিদিন একবার করে সেরেস্তায় গিয়ে হিসেবপত্র বুঝে নেন, পূর্ববাংলায় কিংবা সুন্দরবনে কিংবা উড়িষ্যার জমিদারিতে ঝঁটিতি সফর করেও আসতে হয় মাঝে মাঝে।

জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথের সবচেয়ে বড় গুণ, কোনও কাজে তিনি ব্যর্থ হলেও নিরুদ্যম হন না। জেদ ধরে বারবার চেষ্টা করে হতে চান।

রবি জ্যোতিদাদাকে অনুসরণ করে প্রতি পদে পদে। সে বুঝতে পেরেছে, শ্ৰেষ্ঠত্বের সাধনার জন্য সর্বাঙ্গের ঘাম ঝরাতে হয়। লিখতে তার ভালো লাগে, কিন্তু সার্থক কিছু লিখতে গেলে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে, এমনি এমনি মহৎ সাহিত্য হয় না। তার কবিতায় ভাষা এখনও মর্মভেদী নয়, উচ্ছ্বাসের আবরণে চাপা পড়ে যাচ্ছে জীবনবোধ। লিখতে হবে, ছিঁড়ে ফেলতে হবে, আরও লিখতে হবে, অনেক লিখতে হবে।

সারা দুপুর-বিকেল রবি বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখে যায়। কখনও কবিতা, কখনও প্রবন্ধ, কখনও উপন্যাস, কখনও পুস্তক সমালোচনা। বিষয়বস্তুর শেষ নেই। ভাষার পরিধিও সীমাহীন! একটা কোনও অনুভূতি বা উপলব্ধিকে ঠিক ঠিক ভাষার বাঁধুনিতে ধরে রাখার নামই সার্থকতা। তার জন্যই তো এত সাধনা।

লিখতে লিখতে রবি একেবারে বিভোর হয়ে থাকে, সময় ও পরিবেশজ্ঞান থাকে না। তার একুশ বছরের ভাঁজহীন ললাটে কুঞ্চনের রেখা পড়ে, এক একটা কবিতা লিখতে গিয়ে কিছুতেই তার পছন্দ হয় না, বারবার কাগজ ছেড়ার বদলে সে একটা প্লেটে লিখতে শুরু করে, লেখে, কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে মুছে দেয়, আবার নতুন লাইন মনে আসে।

সারা বাড়ি নিঃশব্দ, দাসদাসীরা কেউ দোতলায় আসে না, মাঝখানে দুটো-তিনটে দরজা আছে বলে মাঝখানের শব্দও শোনা যায় না। হঠাৎ এক সময় এদিকে ভেসে আসে পিয়ানোর মৃদু ঝংকার। রবির ধ্যান ভাঙে, লেখা ছেড়ে সে উঠে আসে।

শেষ গোধূলির আকাশে এখন বিষণ্ণ আলো। চৌরঙ্গির ওপাশের ময়দানের আকাশে বারুদ-বৰ্ণ মেঘ, আর ফ্রি স্কুল বাগানের দিকে কোলাহল করছে অসংখ্য পাখি। দূর থেকে ওই বাগানটিকে অরণ্যের মতন দেখায়।

রবি খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখল, দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই যে হলঘর, সেখানে বড় পিয়ানোটার সামনে বসে আছেন কাদম্বরী, অন্যমনস্কভাবে টুং-টুং শব্দে বাজাচ্ছেন একটা সূর। সেই সুরের সঙ্গে অপরাহ্ন। শেষের আলোর যেন একটা মিল আছে। রবি পাশে গিয়ে দাঁড়াল, কাদম্বরী টের পেলেন না।

সাধারণত সাজসজ্জা সম্পর্কে কাদম্বরী উদাসীন, আজ কিন্তু তিনি বেশ সুসজ্জিত। একটু আগে স্নান করেছেন, ধূপের ধোঁয়া রঙের শাড়ি পরা, খোলা চুলে বেলিফুলের মালা জড়ানো। তাঁর সান্নিধ্যে একটা স্নিগ্ধ সুগন্ধ।

রবি সুরটা চেনার চেষ্টা করল। না, তার কোনও গানের সুর নয়। জ্যোতিদাদার সৃষ্ট কোনও সুরও নয়, অন্য কিছু, অচেনা।

হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে রবিকে দেখেই বাজনা বন্ধ করে দিলেন কাদম্বরী।

রবি বলল, থামলে কেন, বাজাও।

কাদম্বরী বললেন, তোমার লেখার ব্যাঘাত হল? তুমি উঠে এলে

রবি বলল, না, না, কোনও ব্যাঘাত হয়নি।

কাদম্বরী বললেন, আস্তে বাজাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম অত দূরে শোনা যাবে না।

রবি বলল, আমি এমনিই উঠে এসেছি। শুনতে খুব ভালো লাগছিল। এটা কিসের সুর? আর একটু বাজাও।

হাত সরিয়ে নিয়ে কাদম্বরী বললেন, ও এমন কিছু না। তুমি লেখা ছেড়ে উঠে এলে কেন?

রবি বলল, আর মন লাগছিল না। হঠাৎ একসঙ্গে অনেক পাখি ডেকে উঠল, আমার মনে হল ভোর হয়েছে বুঝি। এক একদিন ভোর আর সন্ধ্যার মধ্যে কোনটা যে কখন তা নিয়ে একটা বিভ্ৰম এসে যায়। ভোরবেলা পাখিরা বাসা ছেড়ে যায়, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে, তখন ওরা দিনটাকে বিদায় জানায়।

কাদম্বরী বললেন, আমি বিদায়ের ডাকটাই শুনি।

রবি বলল, সারা দিন ধরে এত লিখছি, এক সময় আঙুলগুলো বিদ্রোহ করে উঠল। মন বলল, চলে যাই, নতুন বউঠানের সঙ্গে গল্প করে আসি। তারপর শুনতে পেলুম তোমার পিয়ানোর সুর। চুপি চুপি এসে তোমার এই সুরের তন্ময়তার রূপখানি দেখছিলুম।

রবির দিকে ঘুরে বসে, থুতনিতে আঙুল দিয়ে কাদম্বরী বললেন, কী গল্প হবে, মশাই?

– তোমার আগেকার জীবনের গল্প।

— আমার আগেকার জীবন? বাপের বাড়ির কথা? গল্প করার তো কিছু নেই, রবি, একরাত্তি বয়েসে চলে এসেছি। এঁরা কেউ আমার বাপের বাড়ির লোকদের পছন্দ করেন না। কতদিন যাইনি।

—বাপের বাড়ির কথা নয়, হেকেটি, তোমার পূর্বজন্মের গল্প। যখন তুমি ছিল গ্রিসের এক দেবী।

– ছিলাম বুঝি?

– বাঃ, তোমার মনে নেই? তোমার তখন ছিল তিনটি মুখ। একটা সুন্দর মুখেই জগৎ জয় করা যায়, সেই রকম তিন তিনটি মুখ।

— কী বিকটই না জানি দেখতে ছিল তাকে। তিনিমুখো মেয়ে, ইস।

— না গো, স্বৰ্গ মর্ত্য আর সমুদ্র, তিন দিকে তার দৃষ্টি। সে ছিল মায়াবিনী। পার্সিফোনকে যখন চুরি করে পাতালে নিয়ে যায়, তখন হেকেটি জ্বলন্ত মশাল হাতে খুঁজতে

– তুমি তখন কোথায় ছিলে?

– আমিও হয়তো তখন ছিলাম গ্রিসে। সেই দেবীর এক নামহীন স্তাবক।

— কেন আমাকে ওই নামে ডাক? আমি বুঝি না।

— তোমারও যে রয়েছে সেই মায়া। আমি যখন যে-দিকেই তাকাই, তোমার একটি মুখ দেখতে পাই।

– তুমি তো সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাক খাতার পাতার দিকে।

– সেখানেও কি তোমাকে দেখি না?

কাদম্বরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার ঘরে বুঝি বাতি জ্বেলে দেয়নি এখনও। দেখি গিয়ে

রবি বলল, দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আজ এত সাজগোজ করেছ, জ্যোতিদাদা বুঝি তোমায় কোথাও নিয়ে যাবেন?

কাদম্বরী উদাসীনভাবে বললেন, নিয়ে যেতে চাইলেই আমি যাচ্ছি আর কি! কোথাও যাব না। শুধু নিজের জন্য বুঝি সাজতে নেই?

রবি বলল, চলো, একবার ছাদে যাবে? এখনি নেমে আসবে সন্ধ্যা, দিগন্তসীমা মুছে গেলে ছাদে হাঁটতে থাকলে মনে হয় যেন অনেক দূরে চলে যাচ্ছি।

এক একদিন সুরেন, বিবি সরলারা চলে আসে এ বাড়িতে। কাদম্বরী বাচ্চাদের ভালোবাসেন খুব, যত্ন করে ওদের খাওয়ান, ওদের সঙ্গে খেলা করেন। রবিও লেখা ছেড়ে উঠে এসে হইচই করে যোগ দেয়। দশ বছরের বিবি রবির ন্যাওটা, সে সব সময় রবির একটা হাত ধরে কাছ ঘেঁষে বসে থাকে। যুগ পাল্টাচ্ছে, কিছুদিন আগেও বিবির বয়েসী মেয়েদের কবে বিয়ে হয়ে যেত, এখন তার বিয়ের কথা কেউ চিন্তাও করে না।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে সন্ধের সময় পাওয়া যায় না। নাটক নিয়ে খুব মেতে আছেন, তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার। শুধু ঘরোয়া অভিনয় নয়, লোকে টিকিট কেটে তাঁর নাটক দেখে। পাবলিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠার হবার পর ইদানীং বাংলা নাটক খুব জনপ্রিয়। গিরিশবাবু, অমৃতলাল, বিনোদিনীর নাম লোকের মুখে মুখে। বারবনিতাদের নিয়ে প্রকাশ্যে নাটক অভিনয় করা নিয়ে নীতিবাগীশদের ঘোর আপত্তি ছিল, কিন্তু জনসাধারণের প্রবল উৎসাহে সে আপত্তি ভেসে গেছে। গিরিশবাবু মাতাল এবং দুশ্চরিত্র হিসেবে কুখ্যাত, প্রকাশ্যেই তিনি বেশ্যালয়ে গিয়ে মদের আসর বসান সারারাত, তবু নাট্যকার এবং অসাধারণ অভিনেতা হিসেবে লোকে তাঁকে সম্মান করে।

নাটকের মহড়ার সময় জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ অনেক রাত পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন সেখানে।

মেজ বউঠানের বাড়িতেও প্রায় রাতেই নিমন্ত্রণ থাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। জ্ঞানদানন্দিনী অনেক লোকজন ডেকে পার্টি দিতে ভালোবাসেন, সেখানে সুরা পানেরও কোনও নিষেধ নেই। এরকমটি হওয়ার উপায় নেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিজের বাড়িতে। অল্প কয়েকজনের ঘরোয়া আসর কাদম্বরীর পছন্দ, একগাদা লোক নিয়ে হই-হুল্লোড় তিনি সহ্য করতে পারেন না। রবিও স্বস্তি বোধ করে না খুব বেশি জনসমাবেশে।

সদর স্ট্রিটের বাড়িতে সকাল-দুপুরের পরিবেশ একরকম, অপরাহ্ন-সন্ধ্যায় অন্যরকম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *