1 of 2

১৯. নরেন্দ্ৰ ছুটতে ছুটতে রামতনু বসুর গলিতে

নরেন্দ্ৰ ছুটতে ছুটতে রামতনু বসুর গলিতে ঢুকে পড়ল। তাদের নিজেদের বাড়িতে অনেক মানুষজন, তার নিজস্ব ঘর নেই, পড়াশুনো-গানবাজনা চর্চার সুবিধে হয় না। এই গলিতে তার দিদিমার বাড়ি, এখানে সে একটা ঘর পেয়েছে। ঘরটি অবশ্য বিচিত্র, মূল বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, একেবারে বাইরের দিকে একটা গম্বুজের দোতালায়, হয়তো এককালে নহবৎখানা কিংবা দারোয়ানের ঘর ছিল। রাস্তার দিক থেকে আলাদা সিঁড়ি, বন্ধুরা যখন তখন চলে আসতে পারে, নরেন্দ্র নিজেই এই ঘরটার নাম দিয়েছে টঙ।

ছোট্ট ঘরখানিতে রয়েছে একটা ক্যাম্বিসের খাট, তার ওপর একটা ময়লা বালিশ। মেঝেতে একটা ছেড়া সাপ পাতা, একদিকের দেয়ালে দড়ি টাঙানো, তাতে কয়েকখানি কাপড়, পিরান, চাদর গামছা ঝুলছে। নরেন্দ্রর সম্পত্তির মধ্যে এ ঘরে রয়েছে একটু তানপুরা, একটি সেতার ও একটি বাঁয়া, কুলুঙ্গিতে, খাটের ওপর, মাদুর ছড়ানো প্রচুর বই। রাস্তার দিকে একটি মাত্র জানলা।

নরেন্দ্ৰ পাজামা-আচকান ছেড়ে একটি ধুতি জড়িয়ে নিল, মাথা মুছল গামছা দিয়ে। ভিজেছে খুব। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, তাকে এতখানি ভিজে ঘরে আসতে হল, আর পৌঁছবার পরই বৃষ্টি কমে গেল একেবারে! একদিকের রয়েছে একটা থেলো হুঁকো, খানিকটা তামাকের গুল আর ছাই ফেলবার একখানি-সারা। আর একটা সরাতে টিকে, নারকোল ছোবড়া আর দেশলাই। এই দেশলাই জিনিসটা কিছুদিন যাবৎ চালু হয়ে বেশ সুবিধে হয়েছে।

কলকেতে তামাক ও টিকে দিয়ে ধরাবার পর নরেন্দ্র গুড়ুক গুড়ুক করে আরামের টান দিতে লাগল, নেশার দ্রব্য পেয়ে সুস্থির হল। একটু পরেই পৌঁছল ব্ৰজেন্দ্র, ছাতাটা গুটিয়ে রাখল বাইরে।

নরেন্দ্রর মনটা কিছুতেই হালকা হতে পারছে না। স্বাভাবিক হাস্য পরিহাসের বদলে সে ব্ৰজেন্দ্ৰকে দেখেই বলল, তুই জানতে চাইছিলি, শ্ৰীরামকৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখে আমার কী মনে হয়েছে? জানিস ব্ৰজেন, আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, মশাই, আপনি স্বচক্ষে ঈশ্বরকে দেখেছেন? উনি একটুও দ্বিধা না করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমি ঈশ্বর দর্শন করেছি। যেমন তোমাদের দেখছি। আরও ঘনিষ্ঠ রূপে দেখেছি!

ব্ৰজেন্দ্রর মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, তুই তা বিশ্বাস করলি নাকি?

নরেন্দ্র প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, না, অবশ্যই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এটা বুঝতে পারলুম, উনি অন্য সাধকদের মতন রূপক হিসেবে বলেননি। সরল বিশ্বাসের আন্তরিকতায় বললেন। হয়তো উনি মনোম্যানিয়াক।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, তুই বললি না কেন তোকেও দেখাতে? আমাকে কেউ ভূতের গল্প বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে দাবি করি, আমাকে দেখাতে পার? কেউ তো তা পারে না দেখি!

নরেন্দ্র বলল, না। সে কথা বলিনি। উনি বলতে লাগলেন, সত্যি করে কে ঈশ্বরকে দেখতে চায়? লোকে মাগ-ছেলের শোকে, বিষয়-আশয়ের দুঃখে ঘটি ঘটি কাঁদে। ভগবানের জন্য কে তা করে?

ব্ৰজেন্দ্র বলল, তোর মাগ-ছেলে কিংবা বিষয়-আশয়ের টান নেই। তুই কিছুদিন কাঁদকাঁদি করে দেখবি নাকি?

নরেন্দ্র বলল, পরিহাসের ব্যাপার নয় রে। মানুষটি অর্ধোন্মাদ হলেও খাঁটি, এটা আমি বুঝেছি। কথা-বার্তার মধ্যে কোনও খাদ নেই। ওঁর কাছে গিয়ে আমার এমন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, যার কোনও ব্যাখ্যা আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। কোনও ব্যাখ্যাও মনে ধরছে না।

নরেন্দ্ৰ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সেই প্রথমবার দক্ষিণেশ্বরের যাবার পর নরেন্দ্ৰ ঠিক করেছিল, সে আর ওখানে যাবে না। ওই আধ-পাগলা লোকটি স্বাৰ্থশূন্য, সরল ও পবিত্রমনা হলেও কালীসাধক তো বটে! তাঁর সঙ্গে নরেন্দ্রর মতন যুবকদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? নরেন্দ্র কি যুক্তি বিসর্জন দেবে নাকি? ঈশ্বরকে চোখে দেখা যাবে কী করে, তা হলে তো মেনে নিতে হয় যে ঈশ্বরের কোনও রূপ কিংবা আকার আছে।

তবু সে কথা দিয়েছিল বলে নরেন্দ্রর মনটা খচখচ করে। যেতে সে চায় না, কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষার একটা দায়িত্ব আছে। একদিন সে ভাবল, ব্যাপারটা চুকিয়েই ফেলা যাক। আর একবার গিয়ে সে বলে আসবে, না মশাই, আমার আর এখানে আসা হবে না। একদিন সে হেঁটেই রওনা দিল। কিন্তু সিমলে থেকে শ্যামবাজার-বাগবাজার-কাশীপুর হয়ে দক্ষিণেশ্বর যে এতটা দূর, তা তার ধারণা ছিল না। পথ যেন ফুরোতেই চায় না। যখন দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছল, তখন সে রীতিমতন ক্লান্ত। সে দিন ঘরে আর কেউ নেই, নিজের ঘরের ছোট খাটখানিতে বসে আছেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর। নরেন্দ্রকে দেখে অতিমাত্রায় খুশি হয়ে সেই খাট চাপড়ে বললেন, আয়, আয়, এখানে বোস। নরেন্দ্র সঙ্কুচিত ভাবে খাটের এক প্রান্তে বসল। রামকৃষ্ণ যেন সঙ্গে সঙ্গে ভাবে আবিষ্ট হয়ে গেলেন। নরেন্দ্রর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কী যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন। একটু একটু করে এগোতে লাগলেন নরেন্দ্রর দিকে। নরেন্দ্ৰ ভাবল, এই রে, আজ আবার বুঝি কোনও পাগলামি করবে। নরেন্দ্র সরে যাচ্ছে, কিন্তু আর জায়গা নেই, পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। হঠাৎ রামকৃষ্ণ তাঁর ডান পা তুলে দিলেন নরেন্দ্রর কাঁধে। নরেন্দ্ৰ ঝাঁকুনি দিয়ে পা-টা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করেও পারল না, সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ঘুরতে লাগল। কিংবা দেয়াল সমেত ঘরটাই যেন ঘুরছে, দারুণ জোরে, ঘুরতে ঘুরতে কোথাও লীন হয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্রও যেন মিশে যাচ্ছে সর্বগ্রাসী শূন্যতায়। সেই শূন্যতাই মৃত্যু, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নরেন্দ্র তার মধ্যে মিলিয়ে যাবে। দারুণ ভয় পেয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, ওগো, তুমি আমার এ কী করলে? আমার যে বাপ-মা আছেন। তা শুনে সেই অদ্ভুত পাগল খল খল করে হেসে উঠলেন। তারপর নরেন্দ্রর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তবে এখন থাক, একবারে কাজ নেই, কালে হবে!

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সব ঘুর্ণন, অপসৃত হল মহাশূন্য, ঘর ও দেয়াল ফিরে এল নিজের জায়গায়, নরেন্দ্র যেখানে বসে ছিল, সেখানেই বসে আছে। রামকৃষ্ণ তার দিকে চেয়ে হাসছেন। সব কিছুই স্বাভাবিক।

প্রায় সেই সময়েই আরও লোকজন ঢুকে পড়ল ঘরে, তাই আর কোনও কথা হতে পারল না। নিজের ওপরেই মহা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল নরেন্দ্র। এ তো শস্তার ম্যাজিক। হিপনোটিজম! তাই দিয়ে এই পাগলটি তাকে ভয় দেখিয়ে কাবু করে দিল? সে এত দুর্বল? সে কখনও কারুর কাছে হার মানে না, কোথাও মাথা নিচু করে না, সামান্য ভেলকিতে সে ভয় পায়?

সেদিন ওই বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পাওয়া গেল না, নরেন্দ্র ফিরে এল। কয়েকদিন ধরে রাগে ছটফট করতে লাগল সে। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আর একদিন পরীক্ষা করে দেখতেই হবে। সাত দিনের মধ্যেই আবার দক্ষিণেশ্বরে গেল নরেন্দ্ৰ, এই নিয়ে তৃতীয়বার। আগের দিন হেঁটে আসায় পথশ্রমে শরীর ছিল শ্ৰান্ত, সেইজন্য সে ম্যাজিকের বশীভূত হয়েছিল হয়তো। আজ সে ভাড়ার গাড়িতে এসেছে, শরীর টনকো, মন সজাগ। আজ সে প্রস্তুত।

সেদিনও কয়েকজন ভক্ত আগে থেকেই বসে আছে, এর মধ্যে ব্যক্তিগত কথা চলে না। রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে দেখেই ব্যগ্র হয়ে বললেন, এসেছিল, চল, যদু মল্লিকের বাগানে বেড়িয়ে আসি।

মন্দির-এলাকার পাশেই কলকাতার বিশিষ্ট ধনী যাদু মল্লিকের বাগানবাড়ি। তিনি মাঝে মাঝে আসেন, অন্য সময় তাঁর মালি-দ্বারবানরা পাহারা দেয়। সাধারণ লোকের এখানে প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু যদু মল্লিকের আদেশ দেওয়া আছে, রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন খুশি আসতে পারবেন, তিনি এলে গঙ্গার ধারের বৈঠকখানা ঘরটির তালা খুলে দেওয়া হয়। এখানকার বাগানটি কেয়ারি করা, অজস্র কুসুমের সমারোহ, মাঝে মাঝে শ্বেত পাথরের বসবার জায়গা।

দুজনে বেড়াতে লাগলেন সেই বাগানে। বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে, শীত শেষ হয়েই গরম পড়েছে বেশ, আকাশে মেঘ। নরেন্দ্র পরে এসেছে একটা ধুতি ও মলিন পিরান, সাজ পোশাকের দিকে তার কখনও মনোযোগ নেই। রামকৃষ্ণের ধুতি পরা খালি গা, বাতাস নেই, গুমোট। রামকৃষ্ণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নরেন্দ্রর বাড়ির খবর জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তিনি আগেই জেনেছেন যে, সে ব্ৰাহ্ম সমাজে যাতায়াত করে, নিরাকারবাদী। কথায় কথায় বললেন, আমি তোদের কেশবকে কী বলেছি জানিস? ঈশ্বর হলেন সচ্চিদানন্দ সমুদ্র, কুল-কিনারা নাই। ভক্তি হিমে এই সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হয়ে জমে যায়। জল বরফ হয়ে জমাট বাঁধে না? নিরাকার আর সাকার হল যেমন জল আর বরফ। ভক্তের কাছে তিনি সাক্ষাৎ হয়ে কখনও সাকার রূপে দেখা দেন। আবার ব্রাহ্ম-জ্ঞান-সূৰ্য উঠলে সে বরফ গলে যায়।

নরেন্দ্ৰ বলল, কথাটা শুনতে ভালো, কিন্তু ওতে কিছু প্রমাণ হয় না।

রামকৃষ্ণ বললেন, ওরে, আমি যে সাকার রূপে দেখেছি। কতবার দেখেছি।

নরেন্দ্র বলল, ওসব আপনার মনের ভুল। রূপ-টুপ আপনার খেয়াল।

রামকৃষ্ণ বললেন, তুই যদি মনে করিস, তুইও মনের মধ্যে কৃষ্ণকে হৃদয়মধ্যে দেখতে পাস

নরেন্দর এবার উদ্ধতভাবে বলল, মশাই, আমি ও সব কিষ্টফিস্ট মানি না।

আজ নরেন্দ্র প্রত্যেকটি কথা কাটিয়ে দিচ্ছে। তার যুক্তিবোধের প্রাখর্যের কাছে এ সব ভাবাবেগের কোনও মূল্য নেই।

একটু পরে ধুলোর ঝড় উঠল। কালিমালিপ্ত হয়ে গেল দিগন্ত। গঙ্গার ওপর নৌকোর মাঝিরা চ্যাঁচামেচি করে পাল নামিয়ে নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে শো শো শব্দ। এখন আর বাইরে থাকা যাবে না।

রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে নিয়ে এলেন বৈঠকখানা ঘরে। মূল্যবান সোফায় সে ঘরখানি সাজানো, ওপরে ঝুলছে ঝাড়লন্ঠন। টানা পাখীরও ব্যবস্থা রয়েছে। নরেন্দ্রর পাশে বসে রামকৃষ্ণ বললেন, আমি কতদিন ধরে তোর প্রতীক্ষা করে আছি। জানতাম, তোকে আসতেই হবে। আমার তো সিদ্ধাই করবার যো নাই। তোর ভিতর দিয়ে করব, কী বলিস?

নরেন্দ্র বলল, না না তা হবে না।

এ কথা শুনেই রামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হয়ে গেলেন, দৃষ্টি স্থির, ঘাড়টা সামান্য বাঁকা, একটা হাত ওপরে তোলা। নরেন্দ্ৰ কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল। এই ব্যাপারটা কী, সে বুঝতে পারছে না। এ রকম যখন তখন সমাধি হতে পারে? সাধকদের কোনও প্রস্তুতি লাগে না? এক ধনীর গৃহের বৈঠকখানায়-

সহসা রামকৃষ্ণ ঝুঁকে পড়ে নরেন্দ্রর কপাল স্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার। আজ আর মহাশূন্য দর্শনও হল না, একেবারে চৈতন্য লোপ!…

ব্ৰজেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে নরেন্দ্র বলতে লাগল, কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলুম তা জানি না। এক সময় চোখ মেলে দেখি, উনি আমার বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর ফিক ফিক করে হাসছেন। অজ্ঞান অবস্থায় উনি নাকি আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছেন, আমি তার উত্তরও দিয়েছি। তারপর থেকে এই একমাস ধরে, এখনও আমার…

ব্ৰজেন্দ্ৰ উত্তেজিতভাবে বলল, মেসমেরিজম! এ তো বোঝাই যাচ্ছে মেসমেরিজম। মেসমার সাহেব এ রকম সম্মোহন করে রুগীদের ঘুম পাড়িয়ে তাদের মনের কথা জেনে নিতেন, তুই তা পড়িসনি?

নরেন্দ্ৰ মহা বিরক্ত হয়ে গলা চড়িয়ে বলল, দেখ শালা, ব্যাখ্যা, তুই কার সঙ্গে কথা কচ্ছিস তোর মনে থাকে না? আমি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন দত্ত। সিমলে পাড়ার কাপ্তান, আমার মুখের ওপর কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। আমাকে মেসমেরাইজ কিংবা হিপনোটাইজ করবে ওই এক অশিক্ষিত বামুন! আমি কি মেনীমুখো, না রুগী?

ব্ৰজেন্দ্র বলল, তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? ভালো করে ভেবে দেখ।

নরেন্দ্র বলল, ধুৎ শালা, তোকে এ সব কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। তোর কাছ থেকে এমন সহজ ব্যাখ্যা আমি চেয়েছি? আমি এ সব আগে ভেবে দেখিনি? সম্মোহন করলে একমাস ধরে তার ঘোর থাকে? আমি এখনও সেই ঘোর কাটাতে পারিনি, মাঝে মাঝেই মনে হয়, চোখের সামনে যা দেখছি, তা সবই অলীক, মাথার মধ্যে দপ-দপ করে, ধোঁয়া ধোঁয়া দেখি, এটা কী করে হয়। আজ যে রেলিঙ-এ মাথা ঠুকছিলুম, তা ঠিক মাথা ব্যথার জন্য নয়, ওখানে সত্যিই একটা রেলিঙ আছে কি না তা বোঝার জন্য! যাঃ, তুই বাড়ি যা!

মুখখানা গোঁজ করে ব্ৰজেন্দ্রর দিকে পেছন ফিরে নরেন্দ্র আবার হুঁকো টানতে লাগল।

ব্ৰজেন্দ্র কাছে এসে নরম গলায় বলল, তোর মাথা গরম হয়ে গেছে। এখন আর ওই নিয়ে ভাবিস না। পরে চিন্তা করে করা যাবে। এবার একটা গান শোনা, নরেন।

নরেন্দ্র বলল, এখন গান গাওয়ার মেজাজ নেই। বললুম তো, বাড়ি যা।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, তোর একটা অন্তত গান না শুনে কিছুতেই যাব না। মন যখন উদভ্ৰান্ত থাকে, তখন সঙ্গীতই শ্ৰেষ্ঠ ওষুধ। আমি সম্মোহিত হই গানে।

ব্ৰজেন্দ্রর বারবার অনুরোধে নরেন্দ্র হুঁকো রেখে তানপুরা তুলে নিল। সুর বাঁধতে লাগল মাথা ঝুঁকিয়ে। তারপর গান ধরল :

এ কি এ সুন্দর শোভা! কী মুখ হেরি এ!

আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ

প্ৰেম-উৎস উথলিল আজি…

গান শুনতে শুনতে হঠাৎ অলংকারের ঝনঝনানির শব্দ শুনে ব্ৰজেন্দ্ৰ জানলা দিয়ে তাকাল। রাস্তার ঠিক অপর পারেই একটি বাড়ি, দোতলায় টানা বারান্দা। সেই বারান্দা অন্ধকার হলেও বোঝা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক যুবতী। তার এক মাথা চুল, ফর্সা রঙের মুখখানি ঝুঁকে আছে রেলিং দিয়ে।

নরেন্দ্ররও গান থেমে গেছে। ফুলে উঠেছে নাকের পাঁটা, চক্ষু দুটি ক্ৰোধ-চঞ্চল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, নষ্ট মাগী! আমায় জ্বালিয়ে খেলে!

উঠে গিয়ে দড়াম করে জানলা বন্ধ করে দিয়ে সে আবার বলল, নাঃ আজ আর গান হবে না। আমার খিদে পেয়েছে। চল যাই-

দিদিমার বাড়ির এই ঘরখানায় থাকলেও নরেন্দর দু বেলা খেতে যায় নিজের বাড়িতে। বন্ধুকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।

কয়েকদিন পরেই ছুটি হয়ে গেল কলেজ। নরেন্দ্র কিছুতেই আর পড়াশুনো কিংবা গান-বাজনায় মন বসাতে পারে না। এক এক সময় পড়তে পড়তে সে বই ছুড়ে ফেলে দেয়। অ্যাটর্নির কাজ শেখার জন্য বাবা এক জায়গায় ভর্তি করে দিয়েছেন, সেখানে যেতেও ভালো লাগে না তার। রামকৃষ্ণের স্পর্শে কেন অমন ঘোর লেগেছিল তার ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায়নি বটে, কিন্তু সেই ঘোরটা কেটে গেছে। এখন সে আবার কুস্তি লড়তে বা সাঁতার কাটতে পারে স্বাভাবিকভাবে। দক্ষিণেশ্বরে সে আর কিছুতেই যাবে না ঠিক করেছে। কেনো যাবে?

মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বর থেকে অদ্ভুত সব খবর আসে। দু একজন লোক নরেন্দ্রর কাছে এসে বলে, এ ভায়া, ঠাকুর আপনার জন্য বড় কান্নাকাটি করছেন, সর্বক্ষণ নরেন, নরেন করেন, আপনি একবারটি চলুন না!

রামকৃষ্ণ ঠাকুর নাকি যদু মল্লিকের বাগানে গিয়ে নরেনের নাম করে ডাক ছেড়ে কাঁদেন। পাগলের মতন অবস্থা। কালীবাড়ির খাজাঞ্চি ভোলানাথ বলেছিল, মশায়, একটা কায়েতের ছেলের জন্য আপনি এমন করেন কেন? তাতেও তাঁর কান্না থামে না।

একদিন কয়েকজন ভক্ত রাত্রে ওখানেই থেকে গেছে, রাত্তিরে বারান্দায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন একসময় চোখ মেলে দেখল, রামকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর ধুতিখানা বগলে নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে ঘুরে কাঁদছেন। একজনকে ডেকে বললেন, ওগো, ঘুমুলে? দেখ, নরেনের জন্য আমার প্রাণের ভেতরটা গামছা নিঙড়োনোর মতন জোরে জোরে মোচড় দিচ্ছে, তাকে একবার দেখা করে যেতে বলো। তাকে না দেখলে যে থাকতে পারি না!

আর একদিন তিনি ভক্তদের মধ্যে বসে অনবরত নরেন্দ্রর কথা বলছিলেন। তারপর হঠাৎ বারান্দায় উঠে গিয়ে কাতর চিৎকার করতে লাগলেন। চোখ দিয়ে বন্যার মতন অশ্রু বইছে। মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, মা গো, আমি তাকে না দেখে আর থাকতে পারি না। এত কাঁদলাম, তবু তো নরেন এল না। প্ৰাণে বিষম যন্ত্রণা হচ্ছে, বুকে বিষম মোচড় দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু সুস্থির হয়ে নাকি বলেন, বুড়ো মিনসে, তার জন্য এমন অস্থির হয়েছিল আর কাঁদছি দেখে লোকেই বা কী বলবে দেখি! কিন্তু আমি যে কিছুতেই সামলাতে পাচ্ছি না!

দূতদের মুখে এ সব কথা শুনেও নরেন্দ্র বিচলিত হয় না। কঠোরভাবে বলে, আমার যাওয়া হবে না। এগজামিনের পড়া করছি, বলবেন, আমার সময় নেই!

জোর করে সে আবার পড়াশুনোয় মন বসায়, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে গান গায়, গলা সাধে। মন থেকে অবশ্য সে দক্ষিণেশ্বরের পাগলটির কথা একেবারে সরাতে পারে না। প্রায়ই ভুরু কুঁচকে ভাবে, একজন পুরুষ মানুষ তার জন্য এত উতলা হন কেন? কান্নাকাটি করেন সবার সামনে, কেন? ওঁর তো আরও ভক্ত আছে। নরেন মোটেই ওঁর ভক্ত নয়, এবং মাত্র কিছুদিনের পরিচয়।

নাঃ, দক্ষিণেশ্বরে আর সে যাবে না। একজনের মাথায় যদি বাতিক চাপে, তাই নিয়ে কান্নাকাটি করে কষ্ট পায়, তার জন্যে নরেন্দ্র দায়ী নয়!

এক একদিন নিরিবিলিতে গান গাইতে গাইতে অনেক রাত হয়ে যায়। যত রাত বাড়ে, শহর নিঝুম হয়, তত কণ্ঠস্বরে বিশুদ্ধতা আসে। রাস্তার দিকের জানলাটা আর সে খোলে না, তার দরজায় অর্গল নেই, এমনিই বন্ধ থাকে। ঘরের মধ্যে খুব গরম হয়, তবু জানলা খোলার উপায় নেই!

নিবিষ্ট হয়ে সঙ্গীত সাধনা করছে নরেন্দ্ৰ, হঠাৎ দরজা ঠেলার শব্দ হল। নরেন্দ্ৰ মেঝেতে বসেছিল, পাশ ফিরে তাকাল। বিপরীত দিকের বাড়ির সেই যুবতী বিধবাটি সর্বনাশিনীর রূপ ধরে চুপি চুপি একেবারে তার ঘরে চলে এসেছে। তার আলুলায়িত চুল, চোখের দৃষ্টিতে আগুন, সর্বশরীরে কামনা।

নরেন্দ্রর সারা শরীরে দপ করে জ্বলে উঠল রাগ। এত সাহস হারামজাদির! নরেন্দ্ৰ প্ৰথমে ভাবল, প্রচণ্ড ধমকে ওকে বিদায় করবে। মেয়েটির দিকে তীব্ৰ চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে তার ক্রোধ রূপান্তরিত হল। সে ভাবল, এই মেয়েটি আসলে কত অসহায়! বিদ্যাসাগর মশাই যতই প্রচুর কষ্ট করে বিধবা বিবাহের আইন পাশ করান, সমাজ তো তা মেনে নেয়নি! দু চারটি বিধবার বিয়ে হয়েছে মাত্র, বাকি সহস্ৰ সহস্ৰ বাল-বিধবারা যে তিমিরে ছিল, এখনও সেই তিমিরে। ওদেরও যে শরীরের ক্ষুধা আছে, সংসার পাতার আকাঙ্খা আছে, সন্তান পালনের সাধ আছে, কে তার মূল্য দেবে। ওর যৌবন যেন হরিণীর মাংস, কিছু কিছু লোকের কাছে লোভের সামগ্ৰী! এই মেয়েটিও হয়তো কখনও সেই লোভের ফাঁদে ধরা দিয়েছে, তাই লাজ-লজ্জা ঘুচে গেছে।

এত রাতে কোনও পুরুষের ঘরে স্বয়মাগতা হয়ে আসার একটাই অর্থ হয়। মেয়েটি প্ৰেম কাকে বলে জানল না, শুধু দেহজ লালসা। নরেন্দ্ৰ বৈষ্ণব পদাবলি পড়েছে, ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা পাঠ করেছে, ভালোবাসা-বর্জিত দৈহিক মিলন তার কাছে বিষম ঘৃণার ব্যাপার। কিন্তু এ মেয়ে যে অন্য কিছু জানে না। একে ফেরানো সহজ নয়, শরীরে ওর উন্মাদনা, ধমক দিলেও মিনতি করছে, নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের জন্য গায়ে এসে পড়তে পারে। এই লালসার সর্পকে বশীভূত করার জন্য একটাই মাত্র মন্ত্র আছে।

নরেন্দ্র ঝুঁকে যুবতীটির পায়ের কাছে দুহাত রেখে কাল, মা, মা জননী। আমি যে তোমাকে নিজের মায়ের মতন দেখি!

যুবতীটি বিহ্বল হয়ে গেল একটুক্ষণের জন্য। তারপরই দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল হুড়মুড়িয়ে।

এই ঘটনার পর নরেন্দ্র তার এই প্রিয় আস্তানাটি ছেড়ে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। এখানেও শান্তি নেই। এখানে বিয়ের জন্য পেড়াপোড়ি। কন্যাদায়গ্ৰস্ত পিতারা সরাসরি তাকে পাকড়াও করে। বন্ধুদের আড্ডাতেও নরেন্দ্রর যেতে ইচ্ছে করে না, তারা দক্ষিণেশ্বরের প্রসঙ্গ তুলে বিদ্রূপ করে। বাড়িতে গান-বাজনা চৰ্চার তেমন সুবিধে হয় না বলে নরেন্দ্র আবার ব্ৰাহ্মসমাজের প্রার্থনায় যোগ দেওয়া শুরু করল। কেশববাবুদের সমাজে নয়, সেখানে রামকৃষ্ণ ঠাকুর হঠাৎ এসে পড়তে পারেন। সে যায় সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজে, সেখানকার তরুণদের সঙ্গেই তার মতের মিল হয়।

একদিন নরেন্দ্র বসে আছে উপাসনা গৃহের গানের দলে, পরপর কয়েকটি গানের পর ধ্যান হল। তারপর উঁচু বেদীতে বসে আচাৰ্য উপদেশ দিতে শুরু করলেন। সাধারণ এই উপদেশ দেড় থেকে দুঘণ্টা চলে। অনেক সদস্য এই সময় চক্ষু বুজে। আবার ধ্যানমগ্ন হয়, সেই অবস্থায় উপদেশাবলি বেশি উপভোগ করা যায়।

সবেমাত্র উপক্ৰমণিকা পর্বও শেষ হয়নি, সভাগৃহ নিঃশব্দ, দরজা দিয়ে দ্রুতপদে ঢুকে এলেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর, বলতে লাগলেন, নরেন। নরেন কোথায়? নরেন –

অনাহুত ভাবে সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের উপাসনার সময় দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুর হঠাৎ এসে পড়বেন, এমন আশাই করা যায় না। কেশববাবুর নববিধানে তিনি এমন যান বটে, কিন্তু সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। তিনি বোধহয় জানেনও না যে সাধারণ ব্ৰাহ্ম সমাজের নেতারা ইদানীং তাকে আর তেমন পছন্দও করছেন না। শিবনাথ শাস্ত্রী ও আরও কেউ কেউ একসময় রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে যেতেন বটে। কিন্তু কেশব সেনের ভক্তি বন্যার প্রাবল্য দেখে তারা সরে এসেছেন। একজন কালী সাধকের সঙ্গে তারা আর সম্পর্ক রাখতে চান না।

উপস্থিত সদস্যরা কেউ কেউ রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে চেনেন, অনেকেই চেনেন না। ঠেঙো ধুতি ও ফতুয়া পরা, খালি পা একজন লোককে পাগলের মতন ঢুকে পড়তে দেখে কয়েকজন বলল, এ কে, এ কে? কয়েকজন বলল, আরে এ যে দক্ষিণেশ্বরের সেই ঠাকুর। কেউ বলল, ওঁকে কে ডেকেছে। বেদী থেকে আচার্য ভ্রূকুটি করে সবাইকে চুপ করতে বললেন। তবু সোরগোল, হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর কোনও কিছু গ্ৰাহ্যই করছেন না। তিনি নরেন কোথায়, নরেন কোথায় বলতে বলতে বেদীর কাছে পৌঁছে গেলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁর ভাব-সমাধি হল, তিনি হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রস্তুত মূর্তির মতন। সেই অবস্থাটা দেখবার জন্য পেছন দিকের সদস্যরা সামনে আসতে চাইল, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল বেঞ্চের ওপর। রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি না হয়, সেই জন্য কর্তাব্যক্তিদের একজন নিবিয়ে দিলেন গ্যাসের আলো। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বিশৃঙ্খলা পৌঁছল চরম অবস্থায়। ঠেলাঠেলি, চিৎকার, কে কার পা মাড়িয়ে দিচ্ছে তার ঠিক নেই।

গায়কদের দলে বসে থাকা নরেন্দ্রর হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠল। শুধু তার জন্য ছুটে এসেছেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর। এমন স্বাৰ্থশূন্য ভালোবাসাও সম্ভব! এত ব্যাকুলতা, এত টান, নরেন তো তার কোনও প্রতিদান দেয়নি। তার সন্ধানে এসে ঠাকুর অপমানিত হচ্ছেন, ধাক্কাধাক্তিতে আহতও হতে পারেন।

নরেন উঠে গিয়ে সবলে ভিড় সরিয়ে বেদীর কাছে গিয়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিল। কেউ কিছু বুঝবার আগে তাঁকে নিয়ে এল বাইরের খোলা হাওয়ায়। ধমকের সুরে বলল, আপনি হুট করে এখানে চলে এলেন কেন? আপনার মতন মানুষ, এমন ভাবে আসে?

রামকৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, নরেন, নরেন, তোকে না দেখে আমি যে আর থাকতে পারি না। আমার বড় কষ্ট হয়। বুকটা মোচড়ায়।

একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাতে রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে শুইয়ে দিয়ে বললেন, আর কক্ষণও আসবেন না। চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি!

রামকৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, আমি আর তোকে ছাড়ব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *