এখন ভরতের সবসময় খিদে পায়। পেটের মধ্যে একটি অনিবাৰ্ণ উনুন জ্বলছে, তার দাহ্য চাই, এমনকি মাঝরাত্রেও ঘুম ভেঙে গিয়ে তার মনটা খাই খাই করে। কিন্তু কে তাকে সৰ্বক্ষণ খাবার জোগাবে? ত্রিপুরার রাজবাড়িতে যদিও সে ছিল ফ্যালনা ছেলে, কিন্তু ক্যাওটরাম নামে এক বৃদ্ধ পাচক তাকে নেকনজরে দেখত। রাজবাড়ির রন্ধনশালায় ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কিছু না কিছু রাঁধাবাড়া চলতই, কয়েকগণ্ডা রানী ও এক কুড়ি রাজকুমার-রাজকুমারীদের মধ্যে কে কখন কী চেয়ে পাঠাবে তার ঠিক ছিল না। ক্যাওটরাম প্রায়ই জোর করে তাকে এটা সেটা খেতে দিত। তখন কিন্তু এমন খিদেও ছিল না ভরতের।
ভবানীপুরের এই সিংহবাড়িতেও আত্মীয়-আশ্ৰিত মিলিয়ে লোকসংখ্যা প্রায় পঁচিশজন, একতলার রান্নাঘরে তিনটি বড় উনুন। ওপর মহলের কেউ এখানে আসেন না, প্রধান রাঁধুনী নিত্যানন্দ প্রতিদিন সকালে বড় তরফ আর মেজ তরফের গিন্নিদের কাছ থেকে কী কী পদ রান্না হবে তার নির্দেশ নিয়ে আসে। যৌথ পরিবার হলেও দু’ তরফের কত্তা-গিন্নিরা একসঙ্গে বসে আহার গ্রহণ করেন না, এজমালি রান্নাঘর থেকে তাঁদের মহলে অন্ন ব্যঞ্জন যায়, তারপর তারা নিজেদের রুচি মতন ঘি-মাখন, মণ্ডা-মেঠাই যোগ করে নেন। দাস-দাসী ও আশ্রিতদের সারা বছর একই খাদ্য, মোটা চালের ভাত আর ডাল, তার সঙ্গে একটা কিছু তরকারী, কখনও কখনও তার মধ্যে ছিটেফোঁটা মাছ বা কাটা-মুড়ো মেশানো থাকে। তবে তারা বৈচিত্র্যের অভাবটা পূরণ করে নেয় পরিমাণে, প্রায় সকলেই আধ সের চালের ভাত খায়, কারুর কারুর এক সেরও লাগে। চালের পরিমাণ বিষয়ে বাড়ির কত্তাদের কোনও বিধি-নিষেধ নেই। দু’মনি বস্তার কয়েক বস্তা চাল আসে প্রতি মাসের গোড়ায়। ভরত অবশ্য একবারে অনেকখানি গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে জাবর কাটতে পারে না সারাদিন।
সকালবেলা উঠেই ভরত দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘরের সামনের দাওয়ায় উবু হয়ে বসে থাকে। ঠিক যেন মনে হয় একটা ল্যাজ-গোটানো বিড়াল। ইজের পরা, খালি-গা, হাড়-পাঁজর বার করা বুক, মাথার চুল কদম ফুলের মতন। তার পাগলামির ভাবটা অনেকটা কমে গেছে, পুরনো কথা বেশ মনে পড়ে। উরুর ক্ষতটাও শুকিয়ে গেছে প্রায়, ছোটাছুটি করতে অসুবিধে নেই। এখন তার রোগ একটাই, অনবরত খিদে, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে খিদে।
নিত্যানন্দের সঙ্গে ক্যাওটরামের কোনও তুলনাই হয় না। ক্যাওটরাম প্রায় বৃদ্ধ, গায়ের রং পোড়া হাঁড়ির মতন, একটা চোখ অস্বচ্ছ, কিন্তু তার মুখের রেখাগুলি নরম। ক্যাওটিরাম আসামের লোক, সেই জন্যই বোধ হয় ভরতের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব ছিল। নিত্যানন্দ মাঝবয়সী, বেঁটে ও চ্যাপটা ধরনের শরীর, মাথায় টাক, রং বেশ ফর্সা, তার বাড়ি বালেশ্বর জেলায়। রান্নার কাজে না লেগে সে যাত্রার দলে যোগ দিলে আরও বেশি পয়সা উপার্জন করতে পারত বোধ হয়। সে যখন তখন মুখের অভিব্যক্তি বদল করতে পারে। বাবুদের কারুর সামনে সে একেবারে বিনয়ের অবতার, হাত জোড় করে থাকে, মুখে একটা তেলতেলে মাখো মাখো ভাব, নিমীলিত চক্ষু। আবার বাবুরা চলে গেলেই সে মুহূর্তের মধ্যে ভঙ্গি বদলায়, চোখ জ্বলে ওঠে, তার তিনজন সহকারীর প্রতি তর্জন গর্জন করে, চড়-চাপড়ও মারে। যখন তখন কোনও সহকারীর কাঁধে তার একটা গোদা পা তুলে দিয়ে শালো, হারামজাদো বলে ডাকা তার বিশেষ বিলাসিতা।
ভরতকে সে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। এ বাড়িতে কার কী রকম খাতির তা সে তীক্ষ্ণ নজরে বুঝে নেয়। প্রথম শশিভূষণ যখন কোথা থেকে একটা ক্যাংলা চেহারার পাগলকে এনে আদিখ্যেতা করতেন, তখন মনে হয়েছিল এই ছেলেটা বাবুদের মহলেরই একজন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এখন ভরতকে কেউ পাত্তা দেয় না, সে সারাদিনে কখন কী খায় তা নিয়ে কেউ খোঁজখবরও করে না। শশিভূষণ অনেকটা সুস্থ হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি, দুদিন অন্তর ফিটুন গাড়ি করে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের কাছে যান, বাকি সময় শুয়েই থাকেন, দু’চারজন পরিচিত ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। ভরতের কথা যেন তিনি ভুলেই গেছেন।
নিত্যানন্দের তিন সহকারির মধ্যে একেবারে ছোটটির বয়েস কুড়ি-একুশ, তার নাম হেলা। হয়তো অন্য কোনও নামও তার আছে, কিন্তু সেটা কখনও শোনা যায়নি, হেলা বলেই সবাই তাকে ডাকে। ভরত এই হেলার কাছ থেকে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে যেদিকেই যায়, তাকে অনুসরণ করে দৃষ্টি দিয়ে। হেলার ওপর দিনের প্রথম দায়িত্ব, সব উনুনের ছাই বার করা। পাথুরে কয়লা জিনিসটা নতুন, সকলে এখনও অভ্যস্ত হয়নি, এরা সুঁদুরি কাঠের জ্বালে রান্না করে। ছাই উড়তে থাকে, ভরতের চোখে মুখে লাগে, তবু সে সরে যায় না, খিদের জ্বালায় সে দাতে দাঁত চেপে থাকে। মনটাকে ফেরাবার জন্য সে তার অধীত বিদ্যা স্মরণ করে, টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার. এ স্নাই ফক্স মেট এ হেন … অস্তি গোদাবরি তীরে বিশাল শাল্মলি তরু..পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে যুঝিব, যুঁঝিব দিন রাত,/ কালের প্রস্তর পটে লিখিব অক্ষয় নিজ নাম/অলস নিদ্রায় পড়ি করিব না এ শরীর পাত / মানুষ জন্মেছি যাবে…
নিত্যানন্দ আর তার সহকারীরা কল্পনাই করতে পারবে না, ভিখারিরও অধম হয়ে যে লোভী কিশোরটি বসে আছে, সে এত শক্ত শক্ত লেখাপড়ার কথা জানে।
একসময় নিত্যানন্দ ওপরে গেলে হেলা অন্যদের বলে, এ বিলোইটারে এবার বিদায় করি! চক্ষু দিয়ে আমাকে যে গিলে খাচ্ছে গো!
একটা ফুটো সানকিতে কয়েকখানা বাসি রুটি আর কুমড়োর ছক্কা দেওয়া হল তাকে। গত রাতে বাবুদের অবশিষ্ট সেই খাদ্যই হাভাতের মতন অতি দ্রুত খেতে শুরু করল এই রাজার কুমার। তারপর উঠোনের কুয়োতলায় গিয়ে নিজেই কলসিতে জল তুলে পেট ভরিয়ে নিল অনেকখানি। জলে টইটুম্বুর পেটে রুটিগুলো ফুলতে থাকে।
এ বাড়ির যে কোনও জায়গাতেই গতিবিধির ব্যাপারে ভরতের ওপরে কোনও নিষেধ নেই। কত্তাদের কেউ তাকে কখনও ডেকে একটা ভালো কথাও বলে না, খারাপ কথাও বলে না। ভেতর মহলের দিকে পারতপক্ষে যায় না ভরত। ত্রিপুরার রাজবাড়ির অন্দরমহলে মহারানী ভানুমতীর এত্তেলায় সে একবারই মাত্র প্রবেশ করেছিল। নারীজাতি সম্পর্কে তার মনে একটা ভীতি বদ্ধমূল হয়ে গেছে। কোনও রমণীর চোখের দিকে সে সরাসরি তাকাতে পারে না, যখন তখন মনোমোহিনীর কৌতুক মাখা চক্ষু দুটির কথা মনে পড়লেই তার ত্ৰাস হয়, তার বুক কাঁপে। নিজের বুকে হাত বুলোতে বুলোতে তার এখনও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, সে কি সত্যিই বেঁচে আছে। জঙ্গলের মধ্যে মাটি খুঁড়ে তাকে বুক পর্যন্ত পুতে রাখা হয়েছিল, দিনের পর দিন সে কিছু খায়নি, সে কোনও মানুষজন দেখেনি, তবু কে তাকে রক্ষা করল? শুধু দু’তিনটি আদিবাসী-শিশু, তারা কি স্বৰ্গ থেকে নেমে এসেছিল, না নরকের প্রাণী? তারা তাকে ইট মারছিল, ভরতের বাধা দেবার কোনও উপায় ছিল না, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তারপর আর তার কিছুই মনে নেই। সেই অবস্থা থেকে কে শেষপর্যন্ত উদ্ধার করেছিল তাকে, তার নিজের তো সামৰ্থ্য ছিল না, কার-দায় পড়েছিল? তবে কি ভগবানই বাঁচিয়েছেন তাকে! ছোটবেলা থেকে সে শুনে এসেছে, যার কেউ নেই, তার ভগবান আছে। ভগবান, ভগবান! খুব খিদে পেলে সে ভগবানকে ডাকে।
দিনের বেশির ভাগ সময়েই সে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। সকালবেলা কয়েকখানা রুটি খাবার কিছুক্ষণ পরেই আবার তার পেট জ্বলতে থাকে। কিন্তু দুপুরে ভাত খাওয়ার আগে তো তাকে আর কেউ কিছু খেতে দেবে না। কিন্তু খিদের চোটে ভরত অবশ হয়ে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বাগানের ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়ে। এ বাগানে ফলবান বৃক্ষ বেশি নেই, আছে কয়েকটা বেল গাছ, কলা গাছ, নারকেল গাছ। উঁচু উঁচু নারকেল গাছগুলিতে নারকেলের কাঁদি আছে বেশ কয়েকটা, কিন্তু ভরত যে গাছে চড়তে পারে না, লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে দিকে। একটা পেয়ারা গাছে কষি কষি পেয়ারা ছিল বটে, একদিন খিদের চোটে ভরত সেই পেয়ারাই খেয়ে ফেলে অনেকগুলো, তারপর তার পেট ছেড়ে দেয়, প্রায় মুমূর্ষু অবস্থা হয়েছিল। তার পরেও ভরত সেই পেয়ারা খেয়েছিল, এখন আর সে গাছে একটাও নেই।
সকালের দিকে ফুলের বাগানে ভরত মাঝে মাঝে একটি কিশোরী মেয়েকে ফুল তুলতে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে ভরত লুকিয়ে পড়ে আড়ালে, এ পর্যন্ত সে ওই মেয়েটির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি।
বাড়ির দেউড়ির একপাশে দারোয়ানের ঘর। তার নাম নটবর। প্রায় সারাদিনই নটবর শুয়ে থাকে একটা খাটিয়ায়, তার আসল কাজ সন্ধের পর, তখন সে একটা বন্দুক কাঁধে নিয়ে পায়চারি করে আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে, জয় সীয়ারাম! গভীর রাতে, সে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর ওই হুংকার দিয়ে তার জেগে থাকার কথা মালিকদের জানান দেয়। নটবরের রান্নাবান্নার কোনও বালাই নেই, সে দু’বেলাই ছাতু আর লঙ্কা খায়, আর সে ভালোবাসে কলা। ভরত ওই নটবরের খাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার কাছাকাছি ঘুর ঘুর করছে, কিন্তু দারোয়ানজি একটু প্রসাদও দেয় না। তার চক্ষুলজ্জাও নেই, খাওয়ার সময় নজর লাগার ভয়ও নেই।
মাঝে মাঝেই দেউড়ি খোলা থাকলে শিয়াল ঢুকে পড়ে বাগানে। ভবানীপুরে বড় শিয়ালের উৎপাত। সন্ধে হতে না হতেই তাদের হুক্কা হুয়া শুরু হয়ে যায়, এক শিয়াল এদিকে ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিক থেকে জবাব দেয় আর এক শিয়াল। এমনকি দিনের বেলাতে তারা দৌরাত্ম্য করে, অদ্ভুত সাহস ও বুদ্ধি এই প্রাণীটির, কিছুদিন আগে এ বাড়ির রান্নাঘর থেকে একটা আস্ত কাতলা মাছ চুরি করে পালিয়েছে দিনে দুপুরে। দেউড়ি পেরিয়ে, বাড়ির পেছন দিক ঘুরে কী করে রান্নাঘর পর্যন্ত শিয়ালটা পৌঁছল, সেটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। বড়কত্তার কাছে নটবর সাঙ্ঘাতিক বকুনি খেয়েছিল, তার চাকরি যাবার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু পরদিন রাতেই বন্দুকের গুলিতে একটা শিয়াল মেরে সে তার বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছে।
খুব ভোরের দিকে এ বাড়ির বাগানে ভরত দু’একবার শিয়াল দেখেছে। বাগানের পাচিলে নিশ্চয়ই কোথাও ফাঁকফোকর আছে। ভরত অবশ্য শিয়ালকে ভয় পায় না, ত্রিপুরায় অনেক দেখা আছে তার। বরং কুকুর সম্পর্কে তার ভীতি আছে।
ইদানীং কারা যেন রাস্তায় কিছু নেড়ি কুত্তা ছেড়ে দিয়েছে। কলকাতার রাস্তায় আগে কুকর দেখা যেত না, শিয়াল তাড়াবার জন্য কারা এই ব্যবস্থা নিয়েছে কে জানে! কুকুর আর শিয়াল যেন জন্ম শক্ৰ, কাছাকাছি এলেই প্রবল মারামারি শুরু হয়, শেষপর্যন্ত শিয়ালরা লেজ গুটিয়ে পালায়। কুকুরের পাল যখন আসে এ পল্লীতে, কয়েকদিন শিয়ালের উপদ্রব বন্ধ থাকে।
ভরত এক একসময় দেউড়ি পেরিয়ে রাস্তায় পা দেয়। এ দিকটা এমনিতেই ফাঁকা, কাছাকাছি বাড়িঘর নেই, মাঝে মাঝে এঁদো পুকুর ও জংলা জায়গা পড়ে আছে। কিছুটা দূরে শাঁখারিপাড়ায় একটি বসতি গড়ে উঠেছে। দুপুরের দিকে এখানকার রাস্তায় মানুষজন প্রায় দেখাই যায় না। কাচা রাস্তা, যেখানে সেখানে ভাগার, নোংরা-পচা আবর্জনার গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে, হাজার হাজার মাছি ভনভন করে। কোনও কোনও ভাগারের ওপর নড়বড়ে সাঁকো, সেখান দিয়ে পালকি বেহারারা যখন পালকি নিয়ে যায়, মনে হয়, এই বুঝি সবসুদ্ধ ভেঙে পড়ল। ভরত ভিতু ভিতু মুখে দেউড়ি ছেড়ে কয়েক পা এগোয়, এদিক ওদিক তাকায়, তারপরই আবার দৌড়ে ফিরে আসে। আবার যায় দু’এক পা বেশি। ঠিক যেমন ইদুর গর্ত ছেড়ে খানিকটা বাইরে আসে, বাতাসে গন্ধ শোকে, হঠাৎই অজানা আশঙ্কায় আবার এক ছুটে গর্তে ফিরে যায়, ভরতের ভাব-ভঙ্গি অবিকল সেইরকম। নগর কলকাতা সম্পর্কে সে কত গল্প শুনেছে, এখনও পর্যন্ত কিছুই দেখেনি, সে আবিষ্কার করতে চায়, কিন্তু তার সাহসে কুলোয় না।
গুটি গুটি পা-পা করতে করতে ভরত দিন সাতেক বাদে বেশ খানিকটা দূরে চলে আসে। এখানে গোয়ালদের একটা পল্লী, তার পাশ দিয়ে কালীঘাটের মন্দিরে যাবার একটা রাস্তা। এই পথে লোক চলাচল অবিরাম। তীর্থযাত্রীরা দিনের আলো থাকতে থাকতে মন্দিরে পুজো-আচ্চা সেরে বাড়ি ফিরে যেতে চায়, সন্ধে হয়ে গেলে গড়ের মাঠ পেরিয়ে যেতে মানুষের বুক কাঁপে। মাতাল গোরাদের সামনে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। তারা টাকা পয়সা কেড়ে নেয়। নারীদের ইজ্জত নষ্ট করে। গোরাদের নামে কোতোয়ালিতে নালিশও চলে না।
গোয়ালপল্লীতে গরু-মোষের অনেকগুলি খাটাল, সকাল-বিকেল দুধ দোওয়া হয়, ভরত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। কতদিন সে দুধ খায়নি! এই গোয়ালারা সবাই মুসলমান, পুরুষদের লম্বা-চওড়া চেহারা, গিট দিয়ে লুঙ্গি পরে, নগ্ন চওড়া বুক যেন লোহা দিয়ে গড়া, মুখে দাড়ি আর গালপাট্টা গোঁফ, চোখে লালচে ভাব। ভরত ত্রিপুরায় অনেক মুসলমান দেখেছে, কয়েকজনের সঙ্গে তার ভাবও আছে, তারা বাংলায় কথা বলে, কিন্তু ভরত এদের ভাষা এক বর্ণ বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে জুড়ি গাড়ি করে সম্ভ্রান্ত মুসলমান ভদ্রলোকেরাও এখানে আসেন, দুধে-আলতা মেশানো গায়ের রং, নবাব-বাদশাদের মত পোশাক, তারাও বাংলা বলেন না কেউ।
একদিন এক মুসলমানকে দেখে ভয়ে ভরতের প্রাণ উড়ে গিয়েছিল। তখন বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, ভরত পাড়া বেড়িয়ে ফিরছে। দেউড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একজন লম্বা লোক, আলখাল্লা পরা, অনেক ছেড়া ছেড়া কাপড় সেলাই করা যেন সেই আলখাল্লা, মাথায় লম্বা ধরনের কালো টুপি। তার এক হাতে একটা ঝোলা, অন্য হাতে একটা পেতলের ডিবেতে আগুন জ্বলছে। সারা মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, শুধু জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটি। ভরতের বুক টিপ টিপ করতে লাগল। ওই পোশাক-পরা লোকটিকে এড়িয়ে সে ভেতরে ঢুকবে কী করে, কাছে গেলেই যদি খপ করে ধরে! কিন্তু যেতে তো হবেই। লোকটি পেছন ফিরে আছে, খুব সন্ত্ররপনে এগোতে লাগল ভরত, হঠাৎ লোকটি পাশ ফিরে তাঁকে দেখল, হাসল, কালো গোঁফ-দাড়ির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ল ধবধবে সাদা দাঁত। ভরত কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আমি এই বাড়িতে থাকি…
লোকটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ও বাছা, ভয় পাও কেন? ভয় নাই গো, ভয় নাই। আমি মুশকিল আসান। সত্যপীরের কথা শোনো, সব মুশকিল দূর হয়ে যাবে।
তারপর সে দোলানির সুরে একটা ছড়া বলে যেতে লাগল। তার অনেকটাই বুঝতে পারল না ভরত, কিন্তু সুরের একটা মাদকতা আছে, সে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। ছড়া শেষ করার পর লোকটি আগুনের শিখার ওপর একটুক্ষণ নিজের হাত রেখে সেই তপ্ত হাত বুলিয়ে দিল ভরতের মুখে। এই রকম তিনবার করার পর সে একটা কাজলের ফোঁটা দিল তার কপালে, বলল, আর ভয় নাই, সব বিপদ দূর হয়ে যাবে। বাড়ির ভিতর থেকে আমার জন্য একটি পয়সা এনে দাও তো বাপ আমার!
লোকটির চেহারা দেখে আতঙ্ক জন্মালেও তার হাতের স্পর্শ বেশ স্নিগ্ধ, শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল ভরতের। আর তার ভয় করছে না। কিন্তু পয়সা সে কোথায় পাবে, কার কাছে চাইবে?
সমস্যাটা খুব সহজেই মিটে গেল, প্রায় সেই মুহূর্তেই বাড়ির সামনে এসে থামল একটা ল্যান্ডো গাড়ি, তার থেকে নামল মেজ কর্তা। পাক্কা সাহেবি পোশাক-পরা মণিভূষন লোকটির কাছে নিজের মাথা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দাও হে মুশকিল আসান, আমায় তোমার আশীৰ্বাদ দাও! অনেকদিন আসনি!
লোকটি মণিভূষণের মুখে মাথায় তিনবার হাত বুলিয়ে দিলে তিনি তাকে একটি দুআনি দিলেন, সে সন্তুষ্ট মনে আরও স্বস্তিবচন উচ্চারণ করে চলে গেল।
পয়সার কথাটা শোনার পর থেকে ভরতের মনে নতুন করে একটা দুঃখ চাড়া দিল। তার কোনও পয়সা নেই। কিন্তু পয়সা খচর করার অভ্যেস তার ছিল। ত্রিপুরায় রাধারমণ ঘোষ তাকে মাসে দশ টাকা করে জলপানি দিতেন। সাত টাকা কয়েকটা পয়সা তার বিছানার বালিশের নীচে রয়ে গিয়েছিল, কে নিল কে জানে! এখানে কেউ তাকে পয়সা দেয় না। পয়সা থাকলে সে খিদের সময় কিছু কিনে খেতে পারত। গোয়ালাদের পল্লীর কাছে সে একটা মুদিখানা দেখেছে, সেখানে দু’পয়সায় এক ধামা মুড়ি পাওয়া যায়। আর কী সুন্দর সাদা সাদা বাতাসা বিক্রি করে।
শশিভূষণ অনেকদিন ভরতের সঙ্গে একটা কথাও বলেননি, যেদিন তিনি ডাকলেন, সেদিন ভরত সাড়া দিতে পারল না।
সকালবেলা বেরিয়ে গোয়ালাপল্লী ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল ভরত কালীঘাট মন্দিরের দিকে। এত লোক যেখানে যায়, সেই মন্দিরটা দেখার খুব ইচ্ছে তার। কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেলার ভয়ে বেশি দূর যেতে পারে না। সেদিন সে একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে, কলকাতার রাস্তায় পয়সা ছড়ানো থাকে। এদিকে কোথাও একটা শ্মশান আছে, প্রায়ই ‘বল হরি হরি বোল’ হাঁক তুলে এক একদল লোক মড়া নিয়ে যায় সেদিকে। সাধারণ বাড়ির মড়া আর অবস্থাপন্ন বাড়ির মড়ার তফাত বোঝা যায় শ্মশানযাত্রীদের আচরণ দেখে। সাধারণ মানুষ যায় দড়ির চারপাইয়ে শুয়ে, বাহকেরা ছোটে হনহানিয়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুড়িয়ে ফেলার জন্য ব্যস্ত। আর বেশ পালিশ করা কাঠের খাট, পুরু বিছানা, ফুলের স্তূপ দিয়ে সাজানো মড়া দেখলে বোঝা যায় হোমরাচোমরা কেউ, শব-বাহকরা হাঁটে ধীর গতিতে, সামনে দু’একজন খোল-ফাত্তাল বাজিয়ে কীর্তন গায়। সবচেয়ে বড় কথা, সেই মড়ার সামনে সামনে বাড়ির কেউ খই আর তামার পয়সা ছড়াতে ছড়াতে যায়। ভরত নিজে ঠং ঠং করে পয়সা পড়তে দেখেছে। অবশ্য সেরকম জাঁকজমকের শবযাত্রা দেখলেই যেন মাটি ফুড়ে উঠে আসে গোটা কয়েক ধুলোমাখা, নেংটি পরা, কাঙালি ছেলে, তারা ছুটে ছুটে সেই পয়সা কুড়িয়ে নেয়। তা দেখে কী কষ্ট ভরতের! খিদেয় তার পেট মোচড়ায়, একটা-দুটো পয়সা পেলে সে পেট ভর মুড়ি-বাতাসা কিনে খেতে পারত। প্রবল ইচ্ছে হয় ভরতের, কাঙালিগুলো তারই বয়েসী, সেও চেষ্টা করলে ওদের সঙ্গে ঠেলা ঠেলি করে কুড়োতে পারে পয়সা, তবু সে যেতে পারে না, বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। রাজবাড়িতে সে মানুষ, রাজকুমারের সম্মান সে কখনও পায়নি বটে, তবু তো রাজরক্ত আছে তার শরীরে। সে মুখ ফুটে কারুর কাছে কিছু চাইতে পারে না। নটবর দারোয়ান তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে একসঙ্গে চার-পাঁচটা কলা খায়, ভরতের কত ইচ্ছে করে একটা কলা খেতে, কিন্তু কোনওদিন চাইবে না সে। রান্নাঘরের দাওয়ায় সে বসে থাকে, বসেই থাকে, কিছু চায় না তো কখনও। সে কী করে কাঙালিদের সঙ্গে মিশে পয়সা কুড়োবে? তবু কাঙালিদের তার হিংসে হয়, চোখের সামনে মাটিতে পয়সা পড়তে দেখেছে, তবু সে নিতে পারছে না, এই জন্য আরও মন-মরা হয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে।
দেউড়ি দিয়ে ঢুকে দেখল, বাগানে বেশ কিছু মানুষের ভিড়। ওখানে আবার কী ব্যাপার? ভরত এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল, ফুলবাগানের ধারে শশিভূষণ তেপায়া স্ট্যান্ডের ওপর ক্যামেরা বসিয়েছেন, পাশে তাঁর তিন চারজন বন্ধু, বাড়ির কিছু লোকও উকি ঝুঁকি মারছে কাছ থেকে, নটবর দারোয়ান বেশ সেজোগুজে, মাথায় পাগড়ি পরে, কাঁধে বন্দুক নিয়ে ওদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন তারও ছবি উঠে যাবে। কালো কাপড়ে ক্যামেরা ও নিজের মাথা ঢাকা দিয়ে শশিভূষণ বলতে লাগলেন, একটু ডাইনে সরো, অতটা নয়, থুতনি উঁচু করো, চোখ খোল, চোখ খোল, ভালো করে চোখ তুলে চাও…। কাকে শশিভূষণ এই সব বলছেন তা প্রথমে বুঝতে পারেনি ভরত, আরও কাছে এসে দেখল, এই বাগানে প্রায়ই সকালে পুজোর ফুল তুলতে আসে যে মেয়েটি, সে একটা হলুদ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে ফুলের ঝাড়ের পাশে, ঠিক পুতুলের মতন স্থির, একটা হাত উঁচু করা।
ছবি তোলা সহজ কর্ম নয়, সেই ভঙ্গিটি পছন্দ হল না শশিভূষণের, মেয়েটিকে জায়গা বদলাতে হল, ক্যামেরাও সব সরঞ্জাম সমেত সরে এল, আবার নানারকম নির্দেশ। তবু শাটার টিপলেন না। শশিভূষণ, কালো কাপড় সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন। যাঃ, মেঘ এসে গেল, এই আলোতে হবে না।
একজন বন্ধু বলল, পাতলা মেঘ। এখুনি সরে গিয়ে রোদ উঠবে।
শশিভূষণ বললেন, তা হলে একটু অপেক্ষা করা যাক।
ভূমিসূতাকে বললেন ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকো। নড়বে না।
বন্ধুটি বলল, এ মেয়েটি দেবদাসী ছিল, নাচতে জানে নিশ্চয়ই। নাচের পোজে ছবি তুললে কিন্তু প্রাইজ পাবার মতন হতো!
শশিভূষণ বললেন, ও দেবদাসী ছিল না। ওকে দেবদাসী করার জন্য জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
শশিভূষণকে অবাক করে দিয়ে ভূমিসূতা বলল, আমি নাচতে জানি। দেখাব?
শশিভূষণ তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে বললেন, না, না, না! একটুও নড়বে না। অ্যাংগল নষ্ট হয়ে যাবে।
বন্ধুটির দিকে ফিরে বললেন, ছিঃ! কী যে অদ্ভুত কথা বল তুমি!
এইবার তিনি ভরতকে দেখতে পেলেন ভিড়ের এক ফাঁকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। যেন ভরতের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ভরত, তুই ভালো হয়ে গেছিস? এদিকে আয় তো, কাছে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে দারুণ অভিমানে ভরে গেল ভরতের বুক। এ বাড়িতে এই একটি মাত্র মানুষ ছাড়া আর কারুকেই সে চেনে না। কেউ কথা বলে না তার সঙ্গে। এমনও দিন যায়, সারা দিনে ভরতের একবার মুখ খোলার কারণ ঘটে না। সারা দুনিয়াতেই শশিভূষণ মাস্টার ছাড়া তার আপনজন আর কেউ নেই। তিনিও ভরতকে তাচ্ছিল্য করেছেন, ভরতের অসুখ সেরে গেছে কি না সে খবরও রাখেন না। ভরতের যে এত খিদে পায়, তাও জানেন না তিনি।
অভিমানের বাষ্পে গলা রুদ্ধ হয়ে গেছে ভরতের, সে কোনও উত্তর দিল না। বন্য প্রাণীর মতন মাথা নিচু করে ভিড়ের মধ্যে ঢুঁসো মেরে ছুটে বেরিয়ে গেল, আর দেখা গেল না তাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে একটা এঁদো পুকুরের পাড়ে বসেই কাঁদতে লাগল মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে, সমস্ত বিশ্ব এখন তার কাছে অর্থহীন। সেই কান্নার মধ্যেই সে বলতে লাগল, মা, মা আমি মরে গেলাম না কেন? মা, মা আমাকে নিয়ে যাও…।
এক সময় কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘাসের ওপর লম্বমান এক কিশোর শরীর, এখানে কোনও মানুষজন নেই, শুধু গাছপালাগুলি ব্যগ্র হয়ে তাকে দেখছে। ঘুমের মধ্যেও ভরতের ঠোঁটে আঁকা অভিমান। এক একদিন সকালে বাসি রুটি-কুমড়োর ছক্কাও থাকে না, সেই সব সকালে ভরত একবারে ধুঁকতে থাকে। যেন খিদের চোটে সে মরেই যাবে। জঙ্গলের মধ্যে যখন সে মাটির মধ্যে পোতা ছিল দিনে পর দিন, তখনও সে এত খিদের কষ্ট পায়নি। হেলা’র জ্বর হয়েছে ক’দিন ধরে। ভরতকে সামান্য দয়া করারও কেউ নেই। এক সকালে অন্য একজন রাঁধুনি ভরতকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখে এ মুঠো মুড়ি এনে বলল, এই ছোড়া, আজ রুটি নেই, এই দুগগা মুড়ি খা, এখন যা এখান থেকে!
ওই সামান্য মুড়িতে খিদে আরও বাড়ে। জ্বলন্ত উদর দু’ঘটি জল খেয়েও নেবে না। ভরতের নিজেরই হাত পা কামড়ে খেতে ইচ্ছে করে। বাগানে গিয়ে সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর শরীরের জ্বালা ভোলার জন্য মুখস্থ কবিতার লাইন উচ্চারণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে পড়ে না। মন এখন পেটের মধ্যে। কবিতার বদলে ভরত বিড় বিড় করে, হে ভগবান, হে ভগবান, আমায় কিছু খেতে দাও, আমায় দুটি খাবার জুগিয়ে দাও…
একটা তেঁতুল গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে সে পাতা চিবোতে শুরু করল। গরু-ছাগলে ঘাস-পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে, মানুষ পারে না? তেঁতুল পাতাতে একটু টক টক স্বাদ, মন্দ লাগে না। বেশি খেলে পেট ব্যথা হবে না তো? হয় হোক, তবু ভরত খেয়ে যায়।
এক সময় সে হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনল। একটি মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠল, উ মাগো, বাবাগো! বেশ খানিকটা দূরে। ভরত কারুকে দেখতে পেল না। আবার ওই রকম শুনে সে খানিকটা এগিয়ে গেল। ভূমিসূতা নামে সেই মেয়েটি এক জায়গায় পাঁচিল ঘেষে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখ-চোখ আতঙ্কে বিবর্ণ। ভরত ঠোঁট উল্টে ভাবল, নেকি! সেদিন ছবি তোলার জন্য আদেখলেপনা করছিল। বলছিল, নেচে দেখাব! আজও নাচুক না!
ভূমিসূতা চিৎকার করেই চলেছে। সে রোজ যেখানে ফুল তোলে তার থেকে আজ চলে এসেছে অনেকটা দূরে। বাগানের পাঁচিল এখানে শেষ হয়েছে কোনাকুনি ভাবে। মেয়েটির সামনেই কিছু একটা রয়েছে, তাই সে পালাতে পারছে না। ভরত ভাবল, সাপ! এ বাগানে সে একদিন একটা সাপ দেখেছে বটে। সাপ হলেই বা ভরত কী করবে? খিদের চোটে তার মাথা ঝিমঝিম করছে, এখন কি সে সাপ মারতে যাবে নাকি?
ভরতকে এবার দেখতে পেয়েছে ভূমিসূতা। সে আকুল হয়ে তাকে ডাকছে, ডাকুক। ও মেয়েটা তার কে? ও কি একদিনও নিজের থেকে কথা বলেছে তার সঙ্গে? মেয়েটা ভেতর মহলে থাকে, ভালো ভালো খাবার খায়।
ঝোপের মধ্যে একটা আওয়াজ হল। কোনও বড় সড় প্রাণী! বাঘ নাকি? মেয়েটা অত ভয় পেয়েছে, বাঘের চোখে চোখ পড়লে নাকি চলৎশক্তি চলে যায়। ত্রিপুরায় কমলদিঘির ধারে দু’একবার বাঘ এসেছিল। হঠাৎ কেমন যেন ভাবান্তর হল ভরতের, তার ভয়-ডর চলে গেল। যদি বাঘ হয়, তবে তাকেই খাক, তার জীবনের তো কোনও মূল্য নেই। রোজ রোজ খিদের জ্বালা আর সহ্য হয় না। মাটি থেকে একটা ভাঙা আধলা ইট তুলে নিয়ে সে সটান হেঁটে গেল মেয়েটির দিকে। ভূমিসূতা ভরতের দিকে চেয়ে থরথর করে কাঁপছে। অসীম সাহসীর মত ভরত ঝোপটার একেবারে কাছে গিয়ে উঁকি মারলো।
বাঘ নয়, লতা-পাতার আড়ালে রয়েছে একটা শিয়াল। শিয়াল দিনের বেলা ডাকে না। কোনও মতলবে শিয়ালটা এখানে লুকিয়েছিল, মানুষ দেখে সে নিজেই ভয় পেয়েছে, সামনে দিয়ে পালাতে পারছে না।
আশ শ্যাওড়ার ঝোপটা খানিকটা টেনে ফাঁক করে ভরত বলল, যাঃ যাঃ!
শিয়ালটা এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে ল্যাজ গুটিয়ে চোঁ চোঁ দৌড় লাগাল।
ইটটা ফেলে দিয়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে আবার উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল ভরত। ভূমিসূতার সঙ্গে সে একটিও কথা বলল না, তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না।