1 of 2

১৩. বাবুঘাটে স্টিমার থেকে নেমে

বাবুঘাটে স্টিমার থেকে নেমে ভাড়ার গাড়ির জন্য রবিকে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতে হল। কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে রাস্তা, লোকজনের ভিড়, মুটে-মজুরদের ঠেলাঠেলি, এর মধ্যে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করল রবি, তাও পারা যায় না। একজন তার পা মাড়িয়ে জুতো নোংরা করে দিল। বৃষ্টির দিনে গাড়ি দুর্লভ হয়ে যায়, ফিটন একটাও নেই, কেরাঞ্চি গাড়িগুলোতে একসঙ্গে চার-পাঁচজন যাত্রী হুড়মুড়ে করে উঠে পড়ছে। ও রকম বারোয়ারি গাড়িতে যেতে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা অভ্যস্ত নয়। এর চেয়ে পদব্রজে গমনই প্রশস্ত।

অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সদলবলে আশ্রয় নেবার পর মেটেবুরুজ অঞ্চলটিতে প্রচুর দোকানপাট বসে গেছে, পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাকে আসে কোপ্তা-কাবাব ও আরও নানাবিধ মোগলাই খানার সুগন্ধ। এই অঞ্চলটিতে মুসলমানদের প্রাধান্য, বাংলা কথা প্রায় শোনাই যায় না। রবির মনে পড়ল, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ যখন আই সি এস হয়ে বিলেত থেকে এসে আমেদাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেকটর ও ম্যাজিস্টেটের চাকরি নেন তখন এই মেটেবরুজ থেকে আব্দুল নামে একজন বাবুর্চিকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আব্দুলের যেমন ছিল রান্নার হাত তেমনই ছিল গাল-গল্পের সঞ্চয়। রবি সেই সময় কিছুদিন গিয়ে থেকেছিল মেজদাদার কাছে। বাড়িখানা কী, বাদশাহী আমলের প্রাসাদ, যেন এক স্তব্ধ ইতিহাস। কলকাতা শহরটি বড় অর্বাচীন, এখানে ইতিহাসের কোনও রূপ নেই। আমেদাবাদে সেই শাহিবাগ-প্রাসাদের প্ৰকাণ্ড ছাদে জ্যোৎস্না রাতে একা একা পদচারণ করবার সময় মনে হতো যেন চারপাশ থেকে অনেক অশরীরী ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে।

নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বাড়িতে গান-বাজনার আসরে অনেকেই যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে নবাব বাহাদুরের পরিচয় আছে, রবি ঠিক করল সেও একদিন ওই আসরে যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে রবি চলে এল লালবাজারের কাছে। এখানে একটি ভাড়া-গাড়ির আড্ডা আছে, রবি সেখানে একটি ল্যান্ডো গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে কথা বলছে, এমন সময় পাশে আর একটি গাড়ি দাঁড়াল, সেই গাড়ি থেকে ঝুঁকে এক ব্যক্তি বলল, আরে রবীন্দ্ৰবাবু যে, এসো, এসো, এ গাড়িতে উঠে এসো!

রবি ফিরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। এই ব্যক্তিটির নাম শিবনাথ ভট্টাচাৰ্য, অনেকে শাস্ত্রীমশাই বলেও ডাকে। রবির চেয়ে বয়েসে চোদ্দ পনেরো বছরের বড়; রবিকে বালক বয়েস থেকেই চেনেন, আগে শুধু রবি বলতেন, এখন রবীন্দ্ৰবাবু বলে সম্বোধন করছেন। সাহিত্য জগতে এঁর বেশ সুনাম আছে, আবার তেজস্বী সমাজ সংস্কারক। বিধবা বিবাহ ও নারী শিক্ষার জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন। চোদ্দ বছরের কম বয়েসী বালিকাদের বিবাহ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রবক্তা, পরে কুচবিহার রাজবাড়ীতে নিজের অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ দিতে গিয়ে কেশববাবু যখন সেই আদর্শ থেকে চ্যুত হলেন, তখন শিবনাথের নেতৃত্বেই দলত্যাগীরা সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ গড়ল। এখন ছেলে-ছোকরা মহলে এই তৃতীয় শরিকটিই বেশি জনপ্রিয়।

শিবনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কোথায় এসেছিলে?

রবি সঙ্কুচিতভাবে বলল, আমি তো আপনাদেরই ওখানে যাব, আসছি চন্দননগর থেকে। দেরি হয়ে গেল—।

শিবনাথ ধুতির ট্যাঁক থেকে একটা গোল ঘড়ি বার করে দেখলেন। তরুণ ব্ৰাহ্মরা অতিশয় সময়ানুবর্তী, ঘড়ির কাটা মেনে চলেন। রবির গান শেখাতে যাবার কথা দুপুর বারোটার সময়, এখন একটা বেজে দশ মিনিট।

তবু শিবনাথ বললেন, তাতে কী হয়েছে, এত দূরের পথ। নগেন, কেদাররা অবশ্যই অপেক্ষা করবে। আমার সঙ্গেও ওদের কথা হয়েছে।

ঘোড়ার গাড়ি ঝুমঝুমিয়ে ছুটতে লাগল। রবির আশঙ্কা হয়েছিল, আদি ব্ৰাহ্মরা রাজনারায়ণ বসুর মেয়ের বিয়েতে যে উপস্থিত থাকবে না সেই প্রসঙ্গ তুলে শিবনাথ তির্যক মন্তব্য করবেন। কিন্তু শিবনাথ সে দিকে গেলেন না। এমনকি এককালের খ্রিস্ট ভক্ত কেশব সেনের সাম্প্রতিক বৈষ্ণবীয় চালচলন যে অনেকের ঠাট্টা-বিদ্রূপের প্রিয় বিষয়, তারও উল্লেখ করলেন না একবারও। বয়েসে অনেক কনিষ্ঠ রবি যেন তারই সমসাময়িক একজন লেখক, এই ভাব নিয়ে সাহিত্য আলোচনা করতে লাগলেন।

গাড়ি থেকে নামবার সময় শিবনাথ বললেন, আমাদের সভায় এসে তুমি যে গান শেখাতে সম্মত হয়েছ, তাতেই আমি বিলক্ষণ খুশি হয়েছি।

সভাগৃহে দশ-বারোজন পুরুষ উপস্থিত। রবি ভেতরে এসে নমস্কার জানিয়ে তার বিলম্বের জন্য মার্জনা চাইল। সকলেই অতিশয় ভদ্রতার সঙ্গে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, না, না, কিছুমাত্ৰ দেরি হয়নি, আমরা সবাই আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।

গান শিখবেন মোট পাঁচজন। শুভ্র ফরাসের একদিকে তাঁরা বসেছেন, একটু দূরে তাদের মুখোমুখি রবি। গায়কদের একজনের হাতে এসাজ, আর একজনের হাতে খঞ্জনি। তত্ত্ববোধিনী প্রেস থেকে গানের কথা ছাপিয়ে সেই কাগজ ওঁদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।

রবি প্রথমে দুই হৃদয়ের নদী গানটার এক লাইন গেয়ে বলল, এটা সাহানা ঝাঁপতাল-

গায়কদের সবারই বেশ তৈরি গলা, সহজেই গান তুলে নিতে পারেন। ওঁদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেরই বয়েস রবির চেয়ে ঢের বেশি। নগেন চাটুজ্জে, সুন্দরীমোহন দাস, কেদার মিত্তিরকে তো রবি চেনেই, অন্ধ চুনীলালের গানও সে শুনেছে আগে। অন্যজন যেন বয়েসে রবির চেয়েও কিছু ছোট, বেশ বলিষ্ঠকায় এক সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবা, বড় বড় টানা টানা চোখ, গাঢ় ভুরু। আলাপ করিয়ে দেবার সময় ওর নাম বলা হয়েছে। নরেন দত্ত, সে একজন কলেজের ছাত্র।

রবির প্রথমে মনে হয়েছিল এই যুবকটি তার একেবারেই অচেনা। একটু পরে মনে হল, এই মুখের আদলটি সে আগে কোথাও দেখেছে। তারও পরে মনে পড়ল, বড়দাদার ছেলে দীপুর সঙ্গে এই নরেন দত্তকে সে তাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই দু’এক বার দেখে থাকবে। তখন সে আরও ছোট ছিল, খুব সম্ভবত সে দীপুর স্কুলের সহপাঠী ছিল। নরেনের বেশ জোরালো উদাত্ত কণ্ঠস্বর, তারসপ্তকেও ভাঙে না। কোরাস দলে এরকম একটি গায়কের বিশেষ প্রয়োজন।

দ্বিতীয় গানটি জয়জয়ন্তী ঝাঁপতাল, মহাগুরু, দুটি ছাত্র এসেছে তোমার…

সে গানটিও যখন অনেকখানি শেখানো হয়ে গেছে, তখন গায়কদের একজন বললেন, রবীন্দ্রবাবু, আমাদের তো পাঁচ ছ’টি গান গাইবার কথা, আপনার আর একটি গান আমাদের নরেন বেশ গায়। সেটি কি এই উপলক্ষে চলতে পারে?

রবি কৌতূহলী হয়ে তাকাল।

সেই গায়কটি বললেন, ওহে, নরেন, “তোমারেই করিয়াছি” গানটা একবার ধরো না। রবীন্দ্রবাবুকে শোনাও।

অনেক গায়কই গানের অনুরোধ জানালে অহেতুক লজ্জা প্রকাশ করে সময় নষ্ট করে। নরেন দত্তর সে বালাই নেই। দুহাতে তাল দিয়ে সে গেয়ে উঠল, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা…।

মুখ নিচু করে ফরাসের ওপর আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে রবি শুনতে লাগল গানটা। শুনতে শুনতে এ গান যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, মনে পড়ল তার কথা। টনটন করতে লাগল বুকের মধ্যে। বিলেতে যাবার সময় শুধু সেই একজনকে ছেড়ে যাবার কষ্টই রবির অসহ্য বোধ হতো, জাহাজের ডেকে দাড়িয়ে ভারতভূমির দিকে তাকিয়ে জল এসে যেত তার চোখে। সেই সময়ে এই গানটির খসড়া করা হয়েছিল।

…যেথা আমি যাই নাকো    তুমি প্রকাশিত থাকো

আকুল নয়নজলে ঢাল গো কিরণ ধারা

তবু মুখ সদা মনে জাগিতেছে সঙ্গোপনে

না, না, এ গান শুধু তাদের দু’জনের, সর্বসাধারণের জন্য নয়। নরেন গানটি যদিও বেশ ভালোই গেয়েছে, তবু রবি বলল, এ গানে বিরহের কথা আছে, এই উৎসবের পক্ষে ঠিক মানানসই হবে না।

সঙ্গীত শিক্ষাপর্ব শেষ হতে হতে পেরিয়ে গেল অপরাহ্ন। তখনই স্টিমার ঘাটে না গিয়ে রবি ঠিক করল মাঝপথে সে একবার মেজদাদার বাড়ি ঘুরে যাবে। মেজদাদার দুটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার ভারি ভাব, অনেকদিন দেখা হয় নি। মেজ বউঠান বারবার যেতে বলেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথকে কাৰ্যব্যাপদেশে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন অঞ্চলেই থাকতে হয়। তাঁর পত্নী জ্ঞাননন্দিনী স্বামীর কাছেই ছিলেন, এখন ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে এসেছেন। সুরেন্দ্র আর ইন্দিরা দুই পিঠোপিঠি ভাই বোন, দশ আর ন’বছর বয়েস। তারা সাহেবি ইস্কুলে পড়ে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিলিতি আদবকায়দা আমদানি করেছেন জ্ঞানদানন্দিনী। যে-দেবেন্দ্রনাথ নিজের কন্যা ও পুত্ৰব অন্দরমহলের বাইরে বেশি যাতায়াত পছন্দ করেন না, তাঁরই মধ্যম পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী স্বামী সঙ্গ ছাড়াই একা শিশু পুত্র-কন্যা নিয়ে ইংল্যান্ড ঘুরে এসেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ নিজে স্ত্রী-স্বাধীনতার বিশেষ পক্ষপাতী, জোড়াসাঁকোর বাড়ির খড়খড়িগুলো ভেঙে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁর অনেকদিনের। মেয়েরা চিকের আড়াল থেকে সব কিছু দেখবে, তারা কি অন্ধকারের প্রাণী? কিন্তু পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব যবনিকা ছিড়ে ফেলা সম্ভব নয়। সত্যেন্দ্রনাথ নিজে যখন ছাত্র অবস্থায় ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন খুব চেয়েছিলেন স্ত্রীকেও নিজের কাছে নিয়ে যেতে। পাশ্চাত্যের মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় কর্মক্ষেত্রে কতটা এগিয়ে গেছে, কতটা সংস্কারমুক্ত হয়েছে, তা এ দেশের মেয়েরা নিজের চোখে দেখুক! কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ তখন অনুমতি দেননি। তারপর দেশে ফিরে এসে সত্যেন্দ্রনাথ যখন উচ্চ চাকরি নিয়ে স্বাবলম্বী হলেন, তখন এক দুঃসাহসী কাজ করে ফেললেন। সঙ্গে তিনটি শিশু সন্তান, পুরুষ অভিভাবক নেই, এই অবস্থায় কোনও বঙ্গললনা তো দুরের কথা, কোনও ভারতীয় নারী এর আগে সমুদ্র পাড়ি দেয়নি। জ্ঞানদানন্দিনী তখন ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবতী। ইংল্যান্ড যাত্রা অবশ্য এর মধ্যে অনেকটা সুগম হয়ে গেছে, জাহাজে মাত্র এক মাস লাগে।

জ্ঞানদানন্দিনীর রূপান্তর অতি বিস্ময়কর, কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছেন। যশোরের এক অতি সাধারণ পরিবারের কন্যা, নিতান্ত বালিকা বয়েসে ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ হয়ে এসেছিলেন। লাজুক, ভীরু, রোগা-পাতলা সাত-আট বছরের সেই বালিকা ঠাকুরবাড়ির ঐশ্বর্য ও আড়ম্বরের মধ্যে এসে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে বসে থাকত। রবি মেজ বউঠানের কাছে তাঁর বাপেরবাড়ির গল্প শুনেছে। সে ছিল নানা রকম কুসংস্কারে ভরা এক শাক্ত বংশ। বাড়ির কারুর অসুখ বিসুখ হলে মা কালীর কাছে জোড়া পাঁঠা আর মদ মানত করা হতো। জ্ঞানদানন্দিনীর মা একবার কোনও এক সংকটের সময় পাঁঠা-মদ ছাড়াও নিজের বুকের রক্ত দিতে চেয়েছিলেন ঠাকুরকে, নিজের করতলে জ্বলন্ত ধুনো-গুগগুল নিয়ে আরতি করেছেন।

সেই বাড়ির একটি পুঁচকে মেয়ে যেন রূপকথার মতন একটি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল এক অসামান্য রমণী হয়ে। যেমন তার রূপ, তেমন তেজ। ইংরেজ-সমাজেও মিশতে পারেন সমান আত্মমর্যাদা নিয়ে, ইংরেজি ফরাসিতে কথা বলতে পারেন অনর্গল। এতকাল হিন্দু বাঙালি স্ত্রীলোকেরা ছিল একবস্ত্রা, অঙ্গে শুধু শাড়ি ছাড়া আর কোনও অন্তর্বাস থাকত না। নারী দেহ শুধু ভোগের জন্য এবং সন্তান উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত, অন্দরমহলে অবরুদ্ধ সেই সব নারীদের জন্য ওইটুকু বস্ত্ৰই তো যথেষ্ট। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে যখন বাইরে নিয়ে এলেন, তখন ওই পোশাক তাঁর কাছে অশ্লীল ও অসভ্য মনে হয়েছিল। তিনি নিজে স্ত্রীর জন্য অন্য পোশাকের পরিকল্পনা করেছেন, জ্ঞানদানন্দিনীও প্রবাসে স্বামীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে, পারসি রমণী ও মেমদের দেখে দেখে সেমিজ, শায়া, পেটিকোটের নতুন সাজসজ্জার প্রচলন করেছেন। ঠাকুর পরিবার ও অন্যান্য অনেক অভিজাত পরিবারের নারীরা এখন জ্ঞানদানন্দিনীর অনুসরণ করে।

তা বলে জ্ঞানদানন্দিনী সমস্ত রকম চালচলন ও ইংরেজিয়ানা বাড়ির সবাই মেনে নেয়নি। দেবেন্দ্রনাথও এসব অনুমোদন করেন না, তিনি ইংরেজদের কোনওদিনই পছন্দ করেননি, ইংরেজদের সংস্পর্শে এড়িয়ে চলেছেন, ইংরেজি পোশাক ও আদব-কায়দার অনুকরণ তাঁর দুচক্ষের বিষ। আজকাল অবশ্য তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায়ই থাকেন না।

বিলেত থেকে ফেরার পর জ্ঞানদানন্দিনী শ্বশুরবাড়িতে তাঁর অংশটিতে আলাদা রীতি নীতি চালু করেছেন। তাঁর ছেলেমেয়ে দুটি বাংলা ইস্কুলে পড়ে না, বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও বিশেষ মেশে না। তারা কাঁটা-চামচ দিয়ে খায়, পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে এবং প্রতিদিন বিকেলে সাহেব বাচ্চার মতন খাস বিলেতি কোট ও ফ্রক পরে সেজে একজন ভৃত্যের সঙ্গে ইডেন উদ্যানে হাওয়া খেতে যায়। বাড়ির অন্যান্য অনেক বাচ্চার মধ্যে যে-কোনও একজনকে দয়া করে সুরেন-ইন্দিরার সঙ্গে পাঠানো হয় বটে, তাও নিয়মিত নয়, পালা করে। জ্ঞানদানন্দিনী রামা নামে একজন ভৃত্য এনেছেন বাইরে থেকে, সেও প্যান্ট-কোট পরে থাকে। ফ্রান্সের নিস শহর থেকে একটা সাদা রঙের তুলতুলে কুকুর এনেছেন, তার নাম নিসুয়া। বাড়ির মধ্যে কুকুর পোষাতে অনেকেই ঘেন্নায় মুখ কুঁচকেছে, এ পরিবারের আগে কেউ দেখেনি।

যারা প্রথমে কোনও সংস্কার ভাঙে, তাদের অনেক নিন্দাও সহ্য করতে হয়। যারা নতুন কোনও পথ দেখায়, তাদের তৈরি থাকতে হয় পথের অনেক বাধার জন্য। যারা মুক্তি অভিলাষী, তাদের খুলতে হয় অনেক বন্ধ দ্বার। আবার এ কথাও ঠিক, যারা পথিকৃৎ, তারা অত্যুৎসাহে কিছুটা বাড়াবাড়িও করে ফেলে, অনেক সময় তাদের স্বাধীন চেতনা ঔদ্ধত্যের মতন মনে হয়, প্রকট নতুনত্ব মনে হয় দৃষ্টিকটু।

জ্ঞানদানন্দিনী শুধু বিলেতে যাননি স্বামীর সঙ্গে ভারতের নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন, মিশেছেন বহু জাতের মানুষের সঙ্গে। ক্ষুদ্র বাঙালি-গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি দেখেছেন বৃহত্তম জগৎ। তিনি লক্ষ করেছেন, এই দেশেই বাঙালিদের তুলনায় অন্যান্য জাতের কিছু কিছু মহিলা বেশ অগ্রসর হয়ে আছে, তারা সব সময় ঘোমটায় মাথা ঢেকে গুড়ের নাগরী হয়ে থাকে না। জ্ঞানদানন্দিনীর ব্যবহারে কিছুটা উগ্রতা থাকলেও তিনি নারীদের অবরোধমুক্ত করার জন্যই নিজের দৃষ্টান্ত সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু অনেক নারীই তাঁকে মানে না, তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান। অন্যের নিন্দে গ্রাহ্য করেন না, সকলে বলে সেটা তাঁর দেমাক। তিনি পুরুষদের সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে কথা বলতে গেলে অন্য মেয়েরা বলে বেহায়াপনা। ভারতের প্রথম আই সি এস অফিসারের স্ত্রী হিসেবে তাঁর কিছুটা অহংকার থাকতে পারে, কিন্তু যখন সেরকম কোনও অহংকারের প্রকাশ নেই, তখনও লোকে সেটা আরোপ করে তাঁর ওপর। অনেকে এমন কথাও বলে, সত্যেন তো আই সি এস হয়েছে দ্বারিকানাথ ঠাকুরের নাতি বলে, না হলে কি আর পারতো!

নিজে বড় হবার চেষ্টা না করে, অন্য কেউ বড় হলে তাকে নানা ভাবে ছোট করার চেষ্টায় এ দেশের মানুষের বিশেষ আনন্দ। মেয়েরা এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরে মেয়েরাই।

জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর শ্বশুরবাড়ির অনেক জা-ননদ-ঠাকুরঝির পুরোপুরি সমর্থন পাননি। এই বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে বাইরের অনেক মেয়ে এসেছে, পুত্রবধূ হয়ে, এ বাড়ির মেয়েরাও বিয়ের পর বাড়িতেই থেকে গেছে, তাদের স্বামীরা ঘরজামাই, এতগুলি মানুষ সব বিষয়ে একমত হয়ে মিলে মিশে বরাবর সুখে সাচ্ছন্দ্যে থাকবে, এটা একটা অলীক কল্পনা। ঠোকাঠুকি লাগবেই কখনও কখনও। তবে ঠাকুরবাড়ির বিশেষ একটা সহবত আছে, ব্ৰাহ্ম সংস্কৃতির অঙ্গ পরিশীলিত বিনয় বচন, এ পরিবারে কেউ চেঁচিয়ে ঝগড়া করে না, এক জানলা থেকে আর এক জানলায় পরনিন্দা করে না। কিন্তু ঠারে ঠোরে ইঙ্গিতে ঈর্ষা-বিদ্বেষ, পরিহাসের ছলে গা বেঁধানো কথা, নিজে দায়িত্ব না নিয়ে অমুক বলছিল বলে এক টুকরো কুৎসা শুনিয়ে দেওয়া, এগুলো তো থাকবেই। এসব মানব চরিত্রের অন্তর্গত।

এই পরিবেশে জ্ঞানদানন্দিনী কিছুদিন পর হাঁপিয়ে উঠলেন। ছেলে-মেয়ে দুটির সুশিক্ষার জন্যও তিনি চিন্তিত। তিনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা কোথাও থাকতে চান, সেই অনুরোধ জানিয়ে প্রবাসী স্বামীকে চিঠি লিখতেন প্রায়ই। সত্যেন্দ্রনাথেরও আপত্তি নেই। বাড়ির মেয়েদের সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশের কড়াকড়ি তারও মনঃপূত নয়। তাঁর বড় দাদা দ্বিজেন্দ্ৰনাথ ভোলা ভালা মানুষ, নিজের নানা রকম খেয়াল নিয়েই মশগুল হয়ে থাকেন, তিনি কিছুই বলেন না। সত্যেন্দ্রনাথই মাঝে মাঝে এই বিশাল পরিবারের অধিপতির মতের বিরুদ্ধে মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছেন। স্বামী এখানে নেই, জ্ঞানদানন্দিনী শুধু ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলাদা বাড়িতে থাকবেন, তা আবার হয় নাকি? সত্যেন্দ্ৰনাথ জানালেন, হ্যাঁ, তাও হতে পারে, তাঁর স্ত্রীর বাপের বাড়ির দু’একজন না হয় সঙ্গে এসে থাকবে।

জ্ঞানদানন্দিনী শুধু প্রথম বিলেতেই যাননি, তিনি প্রথম এই যৌথ পরিবারটির ভাঙনের সূচনাও করেছেন। এখন তিনি থাকেন বির্জিতলাও-এর একটি বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের স্কুল লরোটো, সেন্ট জেভিয়ার্স কাছাকাছি হবে। এই অছিলায় উঠে এলেও সবাই বুঝেছে, এই ভাঙন আর জোড়া লাগবে না।

বির্জিতলাওয়ের বাড়িটি বেশ বড়, এই সম্পত্তিটি অনেকদিন আসামের বিজনি এস্টেটের কাছে ন্যস্ত ছিল, এখন সেটি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কাছেই সেন্ট পলস গির্জার আকাশচুম্বী চূড়া, তার সামনে একটা মস্ত পুকুর, সেই পুকুরের নামেই বাড়িটির নাম। আত্মীয়-বন্ধু, দাস-দাসী-বাবুর্চি নিয়ে বাড়িটি সরগরম।

অন্যান্য আত্মীয় ও দেওরদের তুলনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবি জ্ঞানদানন্দিনী বেশি ঘনিষ্ঠ। রবি আর নতুন বউঠান কাদম্বরী যেমন প্রায় সমবয়েসী, সেই রকম মেজ বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর বয়েসও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছাকাছি। ওঁদের দু’ জনের খুব বন্ধুত্ব। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বাড়িতে প্রায়ই সময় কাটাতে আসেন।

রবি যখন বিলেতে যায় তখন জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেমেয়েদের নিয়ে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে সমুদ্রের ধারে ব্ৰাইটার শহরে বাসা ভাড়া করে ছিলেন। নতুন দেশটাকে সইয়ে নেবার জন্য রবি কিছুদিন মেজ বউঠানের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে মেজ বউঠানের একটি ছেলে মারা গেছে। অন্য দুটি শিশু সুরেন আর ইন্দিরা, ডাক নাম সুরি আর বিবি খুব ন্যাওটা হয়ে যায় রবির। সেই থেকে তারা রবিকা’র সঙ্গ পেলে আর ছাড়ে না। এতদিনে তারা অবশ্য কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে, ইংরেজি ইস্কুলে পড়লেও সব সময় ইংরেজি বলে না, বাংলা বেশ শিখেছে, বাংলা গান গায়। কাঁটা-চামচের বদলে হাত দিয়েও দিব্যি খেতে পারে।

সদর দিয়ে ঢোকবার পর একটি মারবেল গাঁথা প্রশস্ত হলঘর। তারপর এক পাশ দিয়ে চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে, তাতে লাল কার্পেট পাতা। সেই সিঁড়ির বাঁকের মুখে একজন কর্মচারির সঙ্গে কথা বলছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। ঘি রঙের সিস্কের শাড়ি পরা, সামনে কুচি দেওয়া, কাঁধের কাছে আঁচলে একটা ব্ৰোচ আঁটা, তাতে দুটি চুনী-পান্না বসানো। বাড়িতে কোনও উৎসব থাকুক বা না থাকুক, প্রতিদিন জ্ঞানদানন্দিনী বিকেলে ভালো করে গা ধুয়ে উত্তম সাজসজ্জা করে থাকেন। অন্যদের, এমনকি ভৃত্যদেরও পোশাকের মালিন্য সহ্য করতে পারেন না তিনি। জ্ঞানদানন্দিনী রূপসী, তবে সে রূপ স্নিগ্ধ নয়, প্রখর, তাঁর ব্যক্তিত্বের আভা মণ্ডিত। দুটি জীবিত পুত্র-কন্যা ছাড়াও যে তাঁর যে আরও দুটি সন্তান জন্মেছিল, নিঁখুত শরীরে গড়নে তার কোনও ছাপ নেই, তেত্ৰিশ বছর বয়সের এক পরিপূর্ণ যুবতী।

রবিকে দেখে তিনি কথা থামিয়ে কয়েক পলক বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন, রবি? এতদিনে আমাদের মনে পড়ল? চন্দননগরে লুকিয়ে আছ বুঝি?

রবি হেসে বলল, মেজ বউঠান, আমার খিদে পেয়েছে। কি খাওয়াবে বল!

জ্ঞানদানন্দিনী আরও কাছে এসে বললেন, এ কী রুখুসুখু চেহারা হয়েছে। জুতোয় কাদা মাখা মাখি, খুলে ফেল, খুলে ফেল!

রবি বলল, সারা দুপুর গান শেখাতে হয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে।

সুরেন পেছনের বাগানে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলছে, বিবি পিয়ানো বাজাচ্ছে পাশের ঘরে বসে। রবির গলার আওয়াজ শুনে সে খুশিতে ঝলমল মুখে ছুটে এল, রবির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, রবিকা, তুমি এতদিন আসনি কেন?

এই বয়সেই যা সুন্দরী বিবি, কালে সে ঠাকুরবাড়ির সেরা রূপসীদেরও ওপরে টেক্কা দেবে মনে হয়। বিবির সমবিয়েসী আর একটি মেয়েও বেরিয়ে এল পিয়ানোর ঘর থেকে, সে রবির দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা। সে কয়েকদিন এ বাড়িতে এসে রয়েছে। এই দুই বালিকাকে সোফায় পাশে বসিয়ে রবি চন্দননগরের গল্প শোনাতে লাগল। তার জন্য রুপোর রেকাবিতে এল কেক-পেস্ট্রি।

জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, রবি, তুমি ভালো দিনে এসেছ। আজ সুরির জন্মদিন, অনেকে আসবে, তুমি গান গাইবে।

বিবি আবদার করে বসল, রবিকা, তুমি রাত্তিরে এখানে থাকবে। তুমি আজ যাবে না। এই অ্যাত্ত বড় কেক কাটা হবে।

ইংরেজ সমাজের দেখাদেখি জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করেছেন। হিন্দুরা এই ব্যাপারটা জানেই না। ব্ৰাহ্মরাও এতদিন এই প্ৰথা গ্ৰহণ করেনি। তবে অনেকেরই এখন ভালো লাগছে। একজন বাচ্চার জন্মদিন উপলক্ষে অন্য অনেক বাচ্চা আনন্দে মেতে থাকে। এই একটাই উৎসব যাতে বাচ্চারা গুরুত্ব পায়।

জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, তুমি এতদিন ধরে চন্দননগরে পড়ে আছ কেন, রবি? তুমি আমাদের এখানে এসে থাকো। কত ঘর খালি রয়েছে। বিবি আর সুরি তোমাকে এত ভালোবাসে, ওরা তোমার কথা এত বলে।

রবির একটা হাত চেপে ধরে বিবি বলল, রবিকা আর যাবে না, যাবে না, যাবে না!

জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, নতুনও আসবে। সেও তো আজ রাত্তিরে এখানে থাকবে বলেছে। আমি নতুনকে বলেছি, এবার চন্দননগর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসো। বাগানবাড়িতে লোকে দু’চার দিনের জন্য যায়। শহুরে মানুষ কি শহর ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারে?

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর রবি লক্ষ করল, জ্ঞানদানন্দিনী নতুন বউঠানের কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করা দূরে থাক, একবারও তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না। দুই জায়ে ভাব নেই। বরং একটা সূক্ষ্ম অপছন্দের ব্যাপার রয়েছে পরস্পরের মধ্যে। জ্যোতিদাদার সঙ্গে নতুন গুণবান ভাইয়ের বিয়ে দিতে সত্যেন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি ছিল। মেয়ের বাবা সম্পর্কে বিরাগের ভাব ছিল বলে মেয়ে সম্পর্কে আপত্তি। জ্ঞানদানন্দিনী চেষ্টা করেছিলেন একটি বিলেত ফেরতা মেয়ের সঙ্গে তাঁর এই প্ৰিয় দেবরটির বিয়ে দিতে, সেটা শেষ পর্যন্ত হল না। সত্যেন্দ্ৰনাথ বাবামশাইয়ের কাছেও তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, একে পিরালির বংশ, তায় ব্ৰাহ্ম, এই পরিবারে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দুই মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। পাত্রী অতি দুর্লব। সহজে পাত্রী পাওয়া যায় না বলে যে-কোনও হেঁজিপেঁজি মেয়ের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতন এক অসাধারণ পুরুষের বিয়ে দিতে হবে। আর কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত না?

পিতৃপরিচয় যাই হোক, কাদম্বরী যে হেঁজিপেঁজি নন তা তিনি প্রমাণ করেছেন। মেজদাদা, মেজবউঠান তা এখনও মানতে চান না কেন? জ্ঞানদানন্দিনীরই মতন অতি সামান্য অবস্থা থেকে এসে কাদম্বরী নিজেকে অন্যভাবে তৈরি করে নিয়েছেন, এখন রূপে-গুণে তিনি অতুলনীয়। তবে জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে কাদম্বরীর গভীর প্রভেদও আছে। জ্ঞানদানন্দিনীর বাস্তব জ্ঞান অতি তীক্ষ্ণ, সব দিকে তার নজর, যেমন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিশেষ যত্ন নেন, তেমনি টাকা পয়সার হিসেব বুঝে দক্ষভাবে সংসার চালাতে পারেন। স্বামী প্রবাসে, তিনি আলাদা বাড়িতে এসে নিজের সংসার তো সুষ্ঠুভাবে চালাচ্ছেন! যে-কোনও মানুষকে দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করাবার ক্ষমতা আছে। কারুর অসুখ-বিসুখ হলে সেবা করতেও তাঁর জুড়ি নেই। আবার বই পড়তে ভালোবাসেন, লিখতে পারেন, গান-বাজনা আমোদ-আহ্লাদেও সমান উৎসাহী। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণা। অন্যদিকে কাদম্বরীও লেখাপড়া শিখেছেন, তাঁর রুচি অতি সূক্ষ্ম, গান ভালোবাসেন, অভিনয় করতে জানেন, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে যেন তার কোনও সম্পর্ক নেই। বাইশ বছর বয়সেও তাঁর সন্তান হয়নি, টাকা পয়সা নিয়ে কখনও মাথাই ঘামান না, আপনি খেয়ালে থাকেন। তাঁর উপস্থিতিতে রবি সব সময় যেন একটা রহস্যের ইঙ্গিত পায়। জোড়াসাঁকোয় যখন থাকেন, তখনও কাদম্বরী তাঁদের তেতলার মহলেই অধিকাংশ সময় কাটান, বাড়ির অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারেন না সাবলীলভাবে। এ যে তার অহংকার নয়, তার স্বভাবের ধরনটাই এ রকম, তা রবি বোঝে।

আস্তে আস্তে আরও অনেকে আসছে। কয়েকজন প্রতিবেশী মেম এল তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। হলঘরে একটা টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে কেকটি, সুরি আজ দশ পেরিয়ে এগারো বছরে পা দেবে তাই গোল করে এগারোটি মোমবাতি বসানো। রবি উসখুস করছে, শেষ স্টিমার ছেড়ে যেতে পারে ছাঁটার সময়, ছ’টা বাজতে চলল। গতিক দেখে মনে হচ্ছে আজ আর ফেরা হবে না। ছেলেমেয়েরা ঝুলো বুলি করছে থেকে যাবার জন্য।

বাচ্চাদের নিয়ে রবি একটা ইংরেজি গান ধরল। ব্রাইটনে থাকবার সময় রবি এই গানটা শিখে গাইত। দু একটা শব্দ বদলে দিলে সুরি। আর বিবি হেসে কুটি কুটি হতো।

Won’t you tell me, Molly darling

Darling you are growing old

Good-bye sweetheart goodbye.

মলি ডারলিং এর বদলে বিবি ডারলিং করে দিল রবি। আর অন্য ছেলেমেয়েরা বিবিকে ঘিরে হাততালি দিতে লাগল।

কেক কাটা যাচ্ছে না, কারণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এখনও এসে পৌঁছননি। তিনি মধ্যমণি। বাচ্চারা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে, রবিও ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে, যদিও শেষ স্টিমার ছেড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে।

বাইরে একটা জুড়ি গাড়ি দাঁড়াতেই সবাই ছুটে গেল। হ্যাঁ, এবার এসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মুগ্ধভাবে চেয়ে রইল এই কন্দৰ্পকান্তি পুরুষটির দিকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চুল উস্কো খুস্কো, জামার বোতাম খোলা, মুখে ক্লান্তির ছাপ। গাড়ি থেকে নামতে নামতে তিনি বললেন, কী, সবাই এসে গেছে?

হলঘরটির প্রবেশপথে দেবীমূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছেন জ্ঞানদানন্দিনী, ওষ্ঠধরে চাপা হাসি। মৃদু ভৎসনার সুরে তিনি বললেন, নতুন, তুমি এত দেরি করলে?

কাছে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, মেজ বউঠান, খুব দুঃখিত। থিয়েটারে পার্ট দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। লোকগুলো এমন আকাট, মুখ দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় উচ্চারণ বেরোয় না।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবরের জামার বোতাম আটকে দিতে দিতে রঙ্গ করে বললেন, ঠিক করে বল তো, কোন অ্যাকট্রেস তোমাকে এতক্ষণ আটকে রেখেছিল? এরপর কেক কাটা, হইচই ও গান চলতে লাগল।

এক সময় রবি জ্যোতিদাদাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আজ চন্দননগরে ফিরবে না। নতুন বউঠানকে বলে এসেছ? উনি একা থাকবেন।

জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, গাদা গুচ্ছের চাকর-দারোয়ান তো রয়েছে। একা একটা রাত্তির থাকলেই বা, ভয়ের তো কিছু নেই।

রবি বলল, জ্যোতিদাদা, আমি কি তবে চলে যাব?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবার খানিকটা স্বস্তিময় মুখে বলল, সেই ভালো, তুই বরং ফিরে যা, রবি। তোর নতুন বউঠানকে বলবি, কাল সকালেই আমার এখানে একটা কাজ আছে, তাই আজ রাতে আর ফিরছি না। তুই কী করে যাবি?

ছেলেমেয়েরা হইচই করে উঠল, তারা রবিকে কিছুতেই ছাড়বে না। জ্ঞানদানন্দিনীও বারবার বোঝাতে লাগলেন। তা ছাড়া রবি ফিরবে কি করে? নৌকোয় যাবে নাকি অতটা পথ, কত রাত হয়ে যাবে, কী দরকার।

রবি কারুর উপরোধ কৰ্ণপাত না করে জুতো পরতে লাগল। চন্দননগরের অতবড় বাড়িতে কাদম্বরী নিঃসঙ্গ থাকবেন সারারাত? তাঁর অভিমান কত তীব্র, তা কি রবি জানে না?

হাওড়া থেকে রাত সাড়ে আটটায় একটা ডাক গাড়ি ছাড়ে। এই দ্রুতগামী ট্রেনটি জল নেবার জন্য থামে চন্দননগরে। এখনই বেরিয়ে পড়লে রবি সে গাড়িটা ধরতে পারবে। রবিকে ফিরে যেতেই হবে, সে নতুন বউঠানকে কথা দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *