ভবানীপুর অঞ্চলের তুলনায় উত্তর কলকাতায় হরি ঘোষের নামের রাস্তাটির পরিবেশের অনেক তফাত। ভবানীপুরের ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় এক একটি বাড়ি, প্রত্যেক বাড়ি সংলগ্ন কিছুটা বাগান, নিরালা পথে গাড়ি-ঘোড়া চলে কম, মাঝে মাঝে এঁদো পুকুর ও ঝোপজঙ্গল। আর উত্তর কলকাতা জনবহুল, গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, রাস্তা দিয়ে অনবরত হেঁকে যাচ্ছে হরেক রকমের ফেরিওয়ালা, এক বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীলোকেরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অন্য বাড়ির জানালার সঙ্গে হেঁশেলের আলোচনা করে।
সকালবেলা ছোট্ট একটি ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভরত পথের অবিরাম লোক চলাচল দেখে। এখানে এসে সে কলকাতা শহরটিকে নতুনভাবে চিনছে। ভোর থেকেই গোয়ালা, মাছওয়ালা, মুড়িওয়ালারা প্রতিটি বাড়ির সদরে এসে ডাকাডাকি করে। অধিকাংশ মানুষই পরস্পরকে চেনে, নাম ধরে ডাকে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ খোসগল্প করে। কিছু কিছু রমণীকেও পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়, তারা অবশ্য সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির নয়। কেউ আলতা দাসী, কেউ কাচের চুড়ি বিক্রি করে, আবার দু’তিনজন একসঙ্গে হেদোর পুকুরে স্নান করে এই পথ দিয়ে কোথায় যায়, কে জানে!
ভরতের এই বারান্দা থেকে একটু দূরে একটি বিশাল অট্টালিকা দেখা যায়। যার নামে এই রাস্তা, সেই হরি ঘোষের বাড়ি। তিনি গত হয়েছেন বহু বৎসর আগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান ছিলেন এই হরি ঘোষ, যেমন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, তেমনই স্বভাবটি ছিল দিলদরিয়া। দূর দূর গ্রামাঞ্চল থেকে এসে গরিব ছাত্ররা তাঁর কাছে আশ্রয় চাইলেই তিনি নিজের বাড়িতে রেখে দিতেন। আবার ছাত্র সেজে বহু ফেরেব্বাজও বিনি পয়সায় থাকা খাওয়ার সুযোগ নিত এখানে। ও বাড়ির মস্ত বড় বৈঠকখানায় তিরিশ-চল্লিশটা হুঁকোয় তামাক পুড়ত অনবরত। লোকে তার বৈঠকখানার নাম দিয়েছিল হরি ঘোষের গোয়াল। এখন অবশ্য শরিকী বিবাদে সে রকম বোলবোলাও আর নেই, ছাত্ররাও আশ্রয় পায় না, প্রাসাদটির দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে চলটা।
ভরত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানুষজন দেখে, কিন্তু সে নিজেও যে বিশেষ দ্রষ্টব্য, তা সে জানে না। সে একজন সুঠাম, স্বাস্থ্যবান তরুণ, তার সম্পর্কে পাড়াপড়শিদের কৌতূহল তো থাকবেই। সে কোথা থেকে এল, তার পিতৃপরিচয়, জাত-ধর্ম এসব না জানালে যেন অন্যদের স্বস্তি নেই। আশপাশের বাড়ির জানলার ফাঁক-ফোকর কিংবা ছাদের কার্নিশের আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়েরাও তাকে লক্ষ করে। নতুন ভাড়াটে নিজেই যেচে কাছাকাছি বাড়ির লোকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে, এটাই নিয়ম, কিন্তু ভরত সে নিয়ম জানে না, অচেনা লোকদের সঙ্গে তো চট করে কথা বলতেও পারে না।
মাসখানেকের মধ্যে ভরত তার নতুন সংসার কোনওক্রমে গুছিয়ে নিয়েছে। আসবাবপত্র তার কিছুই নেই, একটি ঘরের মেঝেতে সতরঞ্চি ওপর একখানা বালিশ, এই তার বিছানা। অন্য ঘরটিতে একটি মাদুর পাতাই থাকে সব সময়, বাইরের কেউ এলে এখানে বসে। রান্নার সামান্য কিছু সরঞ্জাম কিনে নিয়েছে সে। লেখাপড়ার জন্য একটি টেবিলের অভাব সে খুব অনুভব করে, হাতে কিছু পয়সা জমলে টেবিল ও একখানা অন্তত চেয়ার কিনতে হবে। রান্না ও গৃহকর্মের জন্য সে মহিম নামে একটি লোককে প্রথমে এনে নিযুক্ত করেছিল, কিন্তু সে অতি ধড়িবাজ চোর। এক টাকার বাজার করতে দিলে তার থেকে এক সিকি সরাত, তার ওপর আবার বেড়ালে মাছ খেয়ে গেছে বলে ভরতকে প্রায়ই মাছ দিত না। এর মধ্যে একবার শশিভূষণ পরিদর্শনে এসে মহিমকে বরখাস্ত করে গেছেন, এখন ভরত নিজেই রান্না করে নেয়। একটা সুবিধে এই যে বাইরের থেকে জল আনতে হয় না, এ বাড়িতে কলের জলের ব্যবস্থা আছে।
একতলায় মশলার গুদাম, দিনের বেলা লোকজন থাকে সেখানে, ভরত তখন সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে রাখে। চাকরি-বিচ্যুত মহিম এর মধ্যে একদিন চুপিসারে ঢুকে পড়ে রান্নাঘর থেকে থালা-বাসন সরাবার উপক্রম করেছিল। ভরত দেখে ফেলার পর তাড়া করতেই সে পালাল বটে, কিন্তু তার উপদ্রব থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে না, তা বোঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটি ফেরিওয়ালাও উঠে এসে সিঁড়ির দরজায় ধাক্কা দেয়। আগের ভাড়াটে এদের কাছ থেকে নিয়মিত জিনিসপত্র কিনত, সুতরাং ভরতকেও কিনতে হবে, এই তাদের দাবি। আগে ছিল সাত-আটজনের একটি পরিবার, কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকত এই দুটি ঘরে, আর ভরত মোটে একা। তা ছাড়া তিলকুটো-চন্দ্রপুলি-নারকোল নাড় কিংবা কাশীর বেগুন আর রাঁচির ফুলকপি তার কতই বা লাগতে পারে!
ভরতের কলেজের বন্ধুরা আসে মাঝেমাঝে, এক চমকপ্ৰদ আগন্তুকও এসে পড়েছিল একদিন।
এ বাড়িতে এসে পড়াশুনোর প্রতি মনোযোগ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে ভরতের। সব সময় তার মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। সেই বোধের জন্য যেন তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছে তার অন্তঃকরণ। সে ভূমিসূতাকে কিছুই না জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসেছে। অথচ সে কথা দিয়েছিল সবরকম বিপদে-আপদে ভূমিসূতার পাশে দাঁড়াবে। ভূমিসূতা নিশ্চয়ই ভাববে যে, সেই অঙ্গীকার রক্ষা করার সাহস নেই ভরতের, সে পালিয়ে এসেছে কাপুরুষের মতন!
ভূমিসূতার সঙ্গে দেখা করার যে কোনও উপায় নেই তার। এর মধ্যে শশিভূষণের কাছ থেকে সে শুনেছে যে ভূমিসূতা এখন ত্রিপুরার মহারাজের জন্য সার্কুলার রোডের ভাড়াবাড়িতে নিযুক্ত হয়েছে পরিচারিকা হিসেবে। ভবানীপুরের বাড়িতে যদি বা গোপনে কোনওক্রমে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করা যেতে পারতো, মহারাজের বাড়ি তো সিংহের গুহা! ত্রিপুরা থেকে কর্মচারী এসেছেন কয়েকজন, তারা ভরতকে দেখলেই চিনতে পারবেন এবং আঁতকে উঠবেন। ভরতের তো বেঁচে থাকার কথাই নয়!
ভরতের আরও একটা ভয়, মহারাজই তো স্বয়ং একটি সিংহ, তিনি নিজেই ভূমিসূতাকে গ্ৰাস করে ফেলতে পারেন। মহারাজ সুন্দরের উপাসক, সুন্দরী যুবতীদের তিনি আপন করে নিতে চান। ভরতের মনে আছে, দু একটি রূপসী দাসীকেও মহারাজ একসময় রক্ষিতার সম্মান দিয়েছিলেন, রাজবাড়িতে যাদের বলে কাছুয়া। ভরতের মাও ছিলেন সেইরকমই একজন। ভূমিসূতা গান জানে, নাচতে জানে, দৈবাৎ যদি তার এইসব গুণ মহারাজের কাছে প্ৰকাশ হয়ে পড়ে, তা হলে আর রক্ষা নেই! ভূমিসূতাকে মহারাজের নিভৃত কক্ষে দণ্ডায়মান অবস্থায় দৃশ্যটি কল্পনা করা মাত্র, ভরতের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে।
অথচ শশিভূষণকে যে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না ভরত। শশিভূষণ এর মধ্যে একবার মাত্র এসেছিলেন এ বাড়িতে। তিনি ভরতকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেছেন, তিনি সময়-সুযোগমতন খোঁজ নিতে আসবেন। ভূমিসূতাকে যে এর মধ্যে সার্কুলার রোডের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি ভরত! ভবানীপুরের বাড়িতে মণিভূষণের লুব্ধ দৃষ্টি থেকে ভূমিসূতাকে রক্ষা করার জন্য নজর রাখতেন মণিভূষণের স্ত্রী, কিন্তু মহারাজের গ্রাস থেকে তাকে রক্ষা করবে কে? ভরতের পক্ষে অগম্য এক প্রাসাদে যেন বন্দিনী হয়ে রয়েছে ভূমিসূতা। সে প্রাসাদ যে কেন ভরতের কাছে অগম্য, ভূমিসূতা তাও তো জানতে পারবে না!
শশিভূষণকে কী বলবে ভরত? সে এখনও বেঁচে আছে শশিভূষণের কৃপায়। তার নিজস্ব উপার্জন কিছু নেই, শশিভূষণ এই সংসার পাতা ও কলেজে পড়ার খরচ না দিলে তাকে রাস্তার কাঙালিদের মধ্যে আশ্রয় নিতে হত।
বইয়ের পৃষ্ঠা খোলা থাকে, ভরতের মাঝে মাঝে মনে হয়, আর কলেজে লেখাপড়া শিখে কী হবে? তার বদলে চাকরি খোঁজাই উচিত। সাবলম্বী হতে না পারলে তার ইচ্ছের কোনও স্বাধীনতাও থাকতে পারে না। পরাশ্রয়ী পুরুষের আবার পৌরুষ কী?
এক সন্ধেবেলা ভরত কাঠের উনুন জ্বালিয়ে একটা কেতলিতে জল গরম করার জন্য চাপাল। ইদানীং তার খুব চায়ের নেশা হয়েছে, সে ঘন ঘন চা খায়। চায়ে খিদে কমে। বন্ধুরা কেউ এলে ভরতের বানানো চায়ের তারিফ করে। জল ফুটে উঠলে ভরত কেতলির মধ্যেই খানিকটা দুধ, চায়ের পাতা আর চিনি ফেলে দেয়, তারপর গেলাসে ঢালার সময় ছেকে নেয় এক টুকরো ন্যাকড়ায়। এক একবারে তার তিন গেলাস চা হয়। পড়াশুনো করার সময় ছাড়া অন্যসময় হারিকেন না জ্বেলে ভরত কেরেসিনের খরচ বাঁচায়।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই ভরতের বুক কেঁপে উঠল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষের মতন ছায়ামূর্তি। মানুষ, না অন্য কিছু? মানুষ কী করে হবে, মানুষ কী করে আসবে এখানে? একটু আগে ভরত নিজের হাতে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। টিনের দরজা, খোলা-বন্ধ করার সময় ঝ্যান ঝ্যান শব্দ হয়। সে রকম শব্দও শোনা যায়নি।
ভরতের একমাত্র অস্ত্র একটা দরজার আলগা খিল। মাঝে মাঝে বেড়াল তাড়াবার জন্য সেটা ব্যবহার করতে হয়। দুর্বল গলায় কে? কে বলতে বলতে ভরত খিলটা খুঁজতে লাগল।
ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, নমস্কার গো দাদা, নমস্কার। ভালো চায়ের গন্ধ পেয়ে চলে এলুম গো!
এবারে ভরত দেখতে পেল, একটি বেশ রোগা আর লম্বা লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ভূত-প্ৰেত যদি না হয়, তাহলে ভরতের সঙ্গে গায়ের জোরে সে পারবে না।
লোকটি বলল, কী গো! ভয় পেলে নাকি গো দাদা?
ভরতের ভয় কমে গেছে কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? এখানে এলেন কী করে?
লোকটি বলল, বাঃ, নেতাইবাবু আপনাকে বলে যায়নি? আমি তো মাঝে মাঝেই আসি।
— নিতাই বাবু কে?
– আগের যিনি ভাড়াটে ছিলেন, আমার বড্ড স্নেহ করতেন গো! তেনার পত্নীকে আমি বড় মামি বলে ডাকতুম। পাশের বাড়িতেই থাকি তো, পিঠোপিঠিও বলতে পারেন।
– আপনি কী করে এলেন, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
— ওঃ, হো, সেটা বোঝেননি বুঝি? ছাদ টপকে চলে আসি, বেশ সুবিধে হয়।
– এ বাড়িতে তো ছাদ নেই!
— কী যে বলেন, দাদা, ছাদ ছাড়া কি বাড়ি হয়? ছাদের সিঁড়ি নেই, তাই বলুন। ন্যাড়া ছাদ। আমার বাড়ি থেকে এক পা বাড়ালেই এ বাড়ির ছাদ, তারপর পাচিলের খাঁজে পা দিয়ে আপনার ভেতর-বারোন্ডায় নামা তো খুব সোজা। যাবার সময় দেখিয়ে দেবোনে। তা দাদা একটু চা খাওয়াবেন না?
ভরত হারিকেনটি জ্বালল। লোকটির বয়েস তিরিশের বেশি নয়, রং বেশ ফর্সা, খাড়া নাক, দাড়ি গোঁফ নেই, মাথার সামনের দিকটা কামানো, পেছন দিকে গোছা করে টিকি। গায়ে জামা নেই, ধুতির খুটটাই জড়ানো, ঠোঁটে একটা স্থায়ী হাসি আঁকা।
ভরত একটি গেলাসে চা ঢালল। তাতে সুরুত সুরুত চুমুক দিয়ে লোকটি বলল, আঃ! বড় ভালো, বড় ভালো, খেয়ে যেন প্ৰাণটা জুড়োল। আমাদের বাড়িতে চ্যা হয় না, কী দুঃখের কথা দাদা বলবো আপনাকে, বাড়িতে ইচ্ছেমতন কিছু খেতে পারি না। কথায় কথায় গিন্নির মুখঝামটা। আমার নাম বাণীবিনোদ ভট্টাচাৰ্য, ঠাকুর্দার দেওয়া নাম, পাড়ার লোকে অবশ্য আমায় ঘণ্টা ভটচাজ বলে, পুরুতগিরি করে খাই তো! এ পাড়ার ছোঁড়ারা আমায় মান্যি করে না, কিন্তু যজমানদের কাছে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা পাই, বুঝলেন, কায়স্থবাড়ির মোটা মোটা বাবুরা আমার পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করে। শোভাবাজারে যে বসাকদের বাড়ি আছে, সে বাড়ির গিন্নি আমার পা ধোওয়া জল পর্যন্ত খায়! তবেই বুঝুন!
এই অনাহূত অতিথিকে পছন্দ-অপছন্দ করার কোনও প্রশ্নই নেই। নিজের থেকেই সে গলগল করে কথা বলে যেতে লাগল এবং একটু পরেই সে আর এক গেলাস চা দাবি করল। লোকটির কথা বলার ভঙ্গিতে বেশ কৌতুক বোধ করা যায়, ভরতের শুনতে খারাপ লাগছে না।
রান্নাঘরের কল খুলে ভরত কেতলিতে জল ভারতে যেতেই পুরুত ঠাকুরটি আঁতকে উঠে বলল, আরি সর্বনাশ! আগেরবারেরও চ্যাও এই জল দিয়ে বানিয়েছিলেন? আপনি আমার জাত মেরে দিলেন যে গো দাদা, হায় হায় হায়, এমন জানলে কি খেতুম গো! এর চেয়ে যে বিষ খাওয়া ভালো ছিল। স্লেচ্ছদেরর জল খেতে হল বামুনের ছেলেকে!
ভরত ঘাবড়ে গিয়ে বলল, স্লেচ্ছদের জল মানে?
বাণীবিনোদ খেঁকিয়ে উঠে বলল, তাও বোঝেন না? সাহেব ব্যাটারা তো হিন্দুদের জাত মারবার জন্যই ঘরে ঘরে এই জল পাঠাচ্ছে। আর মনে মনে বলছে, খা শালারা, এই গরু শুয়োরের চর্বি মেশানো জল খা! এই জল খেয়ে নরকে যা!
ভরত বলল, কলের জল পাঠাবার ব্যবস্থাটা সাহেবরা করেছে বটে, কিন্তু তাতে গরু-শুয়োরের চর্বি মেশানো থাকবে কেন? দেখুন না, পরিস্কার জল।
– পরিষ্কার না ছাই! ফিটকিরি দিয়ে দেয়, এই জল তোলে কোথা থেকে তা জানেন? পলতা থেকে। কেন, আমাদের আহিরীটোলায় গঙ্গা নেই? ম্লেচ্ছ ব্যাটারা পলতার কাছ থেকে গঙ্গাজল তোলে, তার কারণ ওখানে গো-ভাগাড় আছে। সব ষড়যন্ত্র বুঝলেন, ষড়যন্ত্ৰ!
– ভটচার্যিমশাই, আমি খবরের কাগজে একটা আর্টিকেল পড়েছি। গঙ্গার জল এখানে নোনতা, একমাত্র পলতার কাছেই জলে নুনের ভাগ কম, সাহেবেরা টেস্ট করে দেখেছে, তাই ওখান থেকে জল তোলার ব্যবস্থা হয়েছে।
– ওসব বুজরুকি, বুঝলেন। লম্বা লম্বা পাইপে করে যে জল আনে, সেই পাইপগুলোর জোড়ো মুখে গরুর চর্বি দেয় কিনা, তা আপনার ওই আর্টিকেলে লেখেনি?
– প্রথম প্রথম দিত বোধহয়। এখন দেয় না।
– আপনার দেশ কোথায়? কলকাতার মানুষ যে নন, তা তো বুঝতেই পারছি।
– আমার বাড়ি…আমার বাড়ি আসামে।
– বাঙালি দেশের ওপারে তো! বাঙাল দেশের ছেলেরা জাত ধম্মো মানে না, কলকাতায় এসে শোর-গরু খায়, মদ গেলে, আবার দেশে ফিরে সাধু সাজে।
– আপনি তো আগের ভাড়াটেদের কাছেও চা খেতে আসতেন।
– তখন এসব কল মল ছিল না। বাড়িওয়ালা নতুন জলের লাইন নিয়েছে, তাতে আমাদের বাড়িসুদ্ধ অপবিত্র হয়ে গেছে।
– ভটচার্যিমশাই, আপনার তা হলে গঙ্গার জলের পবিত্রতায় বিশ্বাস নেই? আমি তো শুনেছিলাম, গঙ্গার জলে সব কিছু শুদ্ধ হয়ে যায়। কত পাপী-তাপী উদ্ধার পায়, আর এই স্লেচ্ছদের বসানো পাইপ শুদ্ধ হবে না?
এবারে বাণীবিনোদ ভট্টাচার্য এক গাল হেসে বলল, এটা আপনি ঠিক বলেছেন দাদা! পলতার ঘাট হোক আর আহিরীটোলার ঘাট হোক, গঙ্গার জল হচ্ছে শিবের জটা থেকে নেমে আসা মা জাহ্নবীর জল। কত গরু-মোষ-মানুষের মড়া এই জলে ভেসে যায়। নিন, আবার চা বসান।
এরপর প্রায়ই সন্ধের দিকে চায়ের লোভে বাণীবিনোদ ছাদ টপকে আসে ভরতের কাছে। এই বয়েসেই তার দুটি স্ত্রী ও সাতটি সন্তান ; তার মধ্যে প্রথম স্ত্রী ও চারটি সন্তান থাকে হালিশহরে, কলকাতায় দ্বিতীয় সংসার। লোকটি লেখাপড়া বিশেষ শেখেনি, সংস্কৃত উচ্চারণ শুদ্ধ নয়, কিন্তু টুকটুকে ফর্সা চেহারা, মাথায় অত বড় শিখা, গলায় ধপধপে পৈতে, তার ওপর নামাবলি গায়ে দিলে বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মনে হয়। কলকাতার অনেক ধনী পরিবারে তার যাতায়াত আছে, একমাত্র পুরুতঠাকুরের পক্ষেই যে কোনও রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের একেবারে অন্দরমহলে প্রবেশ করা সম্ভব। অভিজাত অসূর্যস্পশ্যা রমণীরাও এই একটি পুরুষ মানুষের কাছাকাছি বসার অধিকার পায়। সেই সব অন্দরমহলের অনেক রসালো কাহিনী জানে বাণীবিনোদ। ভরত শুনতে না চাইলেও তার কোনও উপায় নেই, বাণীবিনোদ বলে যাবেই।
দুটি সংসার চালাবার জন্য বাণীবিনোদ পয়সা উপার্জনের কোনও পন্থাই ছাড়ে না। ভরত একদিন শুনে আশ্চর্য হল যে, পুরুতগিরির একটি উপরি আয়ের পন্থা হল চিঠি চালাচালি করা। অন্তঃপুরের অনেক রমণীই স্বামীসোহাগ বঞ্চিতা, তাদের কারুর কারুর উপপতি থাকে, কোনও কোনও গৃহিণী স্বামীকে লুকিয়ে সোনা-দানার বন্ধকী কারবার করে, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হচ্ছে পুরুতঠাকুরের মারফত চিঠি বা জিনিসপত্র আদান-প্রদান। কোনও এক মিত্তিরবাড়ির কর্তমশাই প্রায়ই ইয়ার-বক্সিদের নিয়ে বহরমপুরে যান, তিন-চারদিন ফেরেন না, সে বাড়ির তরুণী বধূটি সেই সময় পুরুতের হাতে তার প্রেমিকের কাছে চিঠি পাঠায়, সেই কটি রাত প্রেমিকপ্রবরই কর্তমশাইয়ের খাট দখল করে থাকে।
এই সব শুনতে শুনতে ভরতের মাথায় একটি চিন্তার উদয় হয়। সে জিজ্ঞেস করল, ভটচার্যিমশাই, আপনার কি সব যজমান বাঁধা? নতুন যজমান নেন না?
বাণীবিনোদ বলল, বাঁধা যজমানে তেমন লাভ নেই রে, দাদা! যাদের বাড়িতে বিগ্ৰহ আছে, তাদের বাড়ি রোজ ঘণ্টা নেড়ে, ফুল-বেলপাতা ছিটিয়ে এলে মাসে মোটে দু তিন টাকা দেয়। বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধ কাজ পেলে তবে না মোটা কিছু আসে। সে রকম আর কটা হয়!
ভরত বলল, কলকাতায় অনেক রাজা-মহারাজ এখন বাড়ি করছেন। জয়পুরের রাজা, মহীশূরের রাজা, পাতিয়ালার রাজা, এঁদের কতবড় বড় বাড়ি, কত মানুষজন, কিছু না কিছু তো লেগেই থাকবে সেখানে। সে রকম কোনও রাজবাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন না?
বাণীবিনোদ বলল, সে রকম পেলে তো বর্তে যাই। তবে কি জান, কলকাতা শহরে আমার মতন পুরুতে তো কম নেই! এক ফোঁটা রসের গন্ধ পেলেই সব শালা মাছির মতন ঝাঁক বেঁধে সেদিকে ছোটে। এই তো গত বেস্পতিবারে জানবাজারে রানী রাসমনির বাড়িতে বামুন খাওয়াল। অবারিত দ্বার, বুঝলে, যার গলায় পৈতে থাকবে, সেই গেলে খেতে পাবে, দক্ষিণে পাবে। গিয়ে দেখি কী, ওরে বাপ রে বাপ, গলায় মোটা মোটা পৈতে বুলিয়ে প্রায় হাজার খানেক বামুন গিয়ে সেখানে পাত পেড়ে বসেছে। দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। এত বামুনের সঙ্গে কমপিটিশান, দিন দিনই তো আমার কাজ কমে আসবে, মাগ-ছেলেপুলেকে খাওয়াব কী?
ভরত বলল, আমি আপনাকে একটা খবর দিতে পারি। ত্রিপুরার মহারাজ কলকাতায় সদ্য সদ্য একটা বাড়ি নিয়েছেন। মহারাজের দেবদ্বিজে খুব ভক্তি। আপনি দেখুন না। যদি সেখানে কোনও কাজ পান।
বাণীবিনোদ বলল, কেমন দরের মহারাজ? ত্রিপুরাটা আবার কোথায়?
ভরত বলল, ত্রিপুরা একটা স্বাধীন রাজ্য, আপনি নামই শোনেননি। মহারাজ খুব দিলদরিয়া, আপনার ওপর সন্তুষ্ট হলে হয়তো আপনাকে নিজের হাত থেকে হীরের আংটি খুলে দিয়ে দেবেন।
বাণীবিনোদ এবার উৎসুক হয়ে বলল, কোথায়? সে বাড়িটা কোথায়? তা হলে একবার চেষ্টা করে দেখতে হয়। এনারা কী বাংলায় কথা বলেন?
ভরত বলল, হ্যাঁ। বাংলা তো বটেই। মহারাজ বৈষ্ণবপদাবলি পড়তে ভালোবাসেন, কিছু মুখস্থ করে নেবেন।
বাণীবিনোদ বলল, তবে তো মার দিয়া কেল্লা! আমি চণ্ডীমঙ্গল গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারি, শুনবে?
ভরত ধরেই নেয়, বাণীবিনোদ ভট্টাচাৰ্য সার্কুলার রোডের বাড়িতে পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হবে এবং অন্দরমহলের প্রবেশ অধিকার পেয়ে যাবে। তা হলে ভূমিসূতার সঙ্গে ওর দেখা অবশ্যই। ভবানীপুরের বাড়িতে ভূমিসূতাই একসময় ঠাকুরঘর সাজাত, ভোরবেলা পুজোর ফুল তুলতে যেত বাগানে। শশিভূষণ জানেন সে কথা। রাজবাড়িতেও নিশ্চয়ই ভূমিসূতাকেই ঠাকুরঘরের ভার দেওয়া হবে। পুরুতমশাইয়ের হাত দিয়ে ভূমিসূতাকে চিঠি পাঠাবে ভরত।
কল্পনায় সে দেখতে পায়, শুভ্ৰ বসন পরে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভূমিসূতা, হাতে তার ফুলের সাজি। ভূমিসূতার মুখখানিও সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের মতন, বিস্ময়মাখা দু চোখের পল্লব, তার চুলে বিন্দু বিন্দু শিশির। সে ছবিটির তাকিয়ে ভরত তখনই পত্ররচনা শুরু করে দেয়ঃ ভূমি, তুমি ভুল বুঝিও না, নীতিহীন মিথ্যাবাদী ভাবে আমাকে ঘৃণা করিও না। আমি অসহায়, অপরের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাকে চলিতে হয়, তবু আমি একদিন না একদিন অবশ্যই তোমার পাশে গিয়া দাঁড়াইব…