শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সরোজিনী খুলনা হয়ে পৌঁছল বরিশাল শহরে। সেখানে এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখে রবির বুক ভরে গেল।
জাহাজঘাটায় কাতারে কাতারে মানুষ জমা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বহু ছাত্র, উকিল-মোক্তার, হাকিম-জমিদার, দোকানদার-মহাজন, সবাই সহৰ্ষে স্বাগত অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এই সব লোকদের এত উৎসাহের কারণ কী? কলের জাহাজ তো অভূতপূর্ব কিছু নয়! ফ্লোটিলা কোম্পানি কয়েক মাস আগে থেকেই স্টিমার চালাচ্ছে, তাতে যাত্রীরাও যাতায়াত করছে নিয়মিত। কিন্তু ‘সরোজিনী’ যে স্বদেশী জাহাজ, বাঙালির গর্ব!
ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি অভিভূত গলায় বললেন, নতুন, তোমার স্বপ্ন সার্থক!
সাধারণ মানুষের এই অযাচিত ভালোবাসার নিদর্শন দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তিনি মুখ নিচু করে চশমা মোছার ছল করতে করতে বললেন, ওই সাহেব ব্যাটাদের আমি ঘায়েল না করে ছাড়ব না!
ফ্লোটিলা কোম্পানির জাহাজ লেগে আছে নদীর অন্য পাড়ে। জলি বোটে করে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে। হঠাৎ একদল ছাত্র ছুটে এসে সেই ছোট নৌকাগুলোর সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত জোড় করে বলতে লাগল, দাদা-ভাইরা, আমাদের কথা একবার শুনুন। তারপর যে-জাহাজে ইচ্ছে হয় যাবেন। আপনারা বাঙালি, বাঙালির জাহাজ থাকতে আপনারা ইংরেজের জাহাজে যাবেন কেন? দেশের টাকা কেন দেবেন বিদেশিদের? সাহেবরা কি আমাদের মানুষ বলে মনে করে? কত রকম অপমান করে, মনে করে দেখুন! আমাদের মঙ্গলের জন্যই ঠাকুরবাবুরা এখানে জাহাজ এনেছেন। তবু কি বিদেশির জাহাজে যেতে আপনাদের মন চায়?
কিছু যাত্রী দোনামোনা করতে লাগল। কিছু যাত্রী ব্যস্ততার ভান করে চড়ে বসল নৌকোয়। সাহেবদের জাহাজ নিয়মিত নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে। স্বদেশি জাহাজের ওপর কি সেই আস্থা রাখা যায়? মাঝপথে যে ডুবে যাবে না তার ঠিক কী?
ছাত্ররা অনেক যাত্রীর হাত ধরে মিনতি করতে লাগল, কারুর কারুর পায়েও আছড়ে পড়ল। কয়েকখানা নৌকো এর মধ্যে মানুষ বোঝাই করে ছেড়ে দিয়েছে। একটি বারো-তেরো বছরের লুঙ্গি পরা ছেলে নদীতে নেমে পড়ে হাঁটু জলে দাড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, সাহেবগো জাহাজ থিকা আমাগো জাহাজ অনেক পেল্লায়…সাহেবগো জাহাজ দুলদুল করে, আমাগো জাহাজ কত শক্ত, ওই জাহাজ ঝড়ে ডুইব্যা যাবে, আমাগো জাহাজ ঝড়-তুফান গ্ৰাহ্য করে না, ও কত্তারা ওই জাহাজে গ্যালে একদিন না একদিন পরানাডা যাবে।
ছেলেটির কাণ্ড দেখে অনেকে হাসছে। রবির মনে হচ্ছে অন্য কথা। ইংরেজের সঙ্গেও যে প্রতিযোগিতায় নামা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই চেতনা জাগল কী করে? সিপাহি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাবার পর এ দেশের মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে ইংরেজরা অপরাজেয়। শ্বেতাঙ্গ শাসকরা মহা শক্তিধর, তারা সব দিক দিয়েই কালো মানুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আবার কি সেই ভুল ভাঙছে? একটি সাধারণ কিশোরও সাহসের সঙ্গে সেই কথা বলতে পারছে।
‘সরোজিনী’র ওপরের ডেকে যেমন দাঁড়িয়ে আছে ঠাকুরবাড়ির মালিকপক্ষ, সেইরকম ফ্লোটিলা কোম্পানির জাহাজের ডেকেও দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি ইংরেজ। একজন বিলেত থেকে সদ্য আগত, অন্যজন স্থানীয়। প্রথম ইংরেজটি মুখে পাইপ কামড়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মনে হয়, নেটিভরা ব্যবসা করতে পারবে?
দ্বিতীয় ইংরেজটি মুখ থেকে অনেকখানি অবজ্ঞার বাতাস ছেড়ে শব্দ করল, ফিউ! তারপর বলল, ব্যবসা করবে বাঙালিরা? এরা দালালি আর জমিদারগিরি ছাড়া আর কিছু জানে না। ব্যবসা করতে গেলে ধৈর্য লাগে, সেটাই বাঙালিদের নেই যে! এরা চাকরি খুঁজে নিশ্চিন্ত হতে চায়।
প্রথম সাহেবটি বলল, আমাদের ব্যস্ততার কিছু নেই। দেখা যাক, ওদের দৌড় কতখানি!
দ্বিতীয় সাহেবটি বলল, ওরা আড়কাঠি লাগিয়ে আমাদের যাত্রীদের ফেরাবার চেষ্টা করছে। পুলিশে খবর দিই, কয়েক ঘা ঠ্যাঙানি খেলেই এই নেটিভরা কুত্তার মতন পালায়।
প্রথম সাহেবটি বলল, না, না, পুলিশ ডাকবার কথা মনেও স্থান দিও না। তাতে উত্তেজনা বাড়বে, আমাদের জাহাজ একেবারে বয়কট করার ডাক দিয়ে ফেলতে পারে। এখন কিছুটা লাফালাফি করছে, করতে দাও!
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ফ্লোটিলার জাহাজের অর্ধেক যাত্রীই চলে এল ‘সরোজিনী’র দিকে। প্রথম দিনের পক্ষে এটা একটা বিরাট জয় বলতে হবে। সগৌরবে ভো বাজাতে বাজাতে ‘সরোজিনী, চলল খুলনার দিকে।
দুদিন পর বরিশালের এক সভায় সংবর্ধনা জানানো হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ সেখানে উপস্থিত। দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে দ্বার। ছাত্ররা শহরে হ্যান্ডবিল বিলি করেছে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েও এসেছে অনেকে দূর দূর থেকে। বিভিন্ন বক্তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। অভিভূত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উত্তর দিতে গিয়ে আবেগমথিত গলায় বললেন, আপনারা যে অনেকেই এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন যে এটা আপনাদেরই জাহাজ, তাতেই আমি ধন্য। সত্যিই এটা আমার জাহাজ নয়, এটা আমার স্বদেশবাসীর জাহাজ!
এই উপলক্ষে গানও বাঁধা হয়েছে। একদল সমবেত স্বরে নগরে সংকীর্তনের সুরে গাইল :
(ও ভাই) দেখ, সব ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে
দেশের দশা একবার করে না। স্মরণ
(একবার চায় না রে কেউ নয়ন মেলে
এ কী রে কাল নিদ্রা এল)
(মোরা) সবারে জাগাব, দুৰ্দশা ঘুচাব
নিদ্ৰাগত প্ৰাণে আনিব চেতন…
ফরাসি ক্যাপ্টেনটি এসে কাজে যোগ দিয়েছে, নিয়মিত যাতায়াত করতে লাগল ‘সরোজিনী’, যাত্রীসংখ্যা রোজই বাড়ছে, ‘স্বদেশী’ ও ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নামে আরও দুটি জাহাজ চলে এল। এই সব জাহাজ যখন যায়, নদীর দু’ধারে সারবন্দি হয়ে দাড়িয়ে থাকে মানুষ, দেশের নামে জয়ধ্বনি দেয়।
ছেলে-মেয়েদের স্কুল খুলে যাবে, জ্ঞানদানন্দিনী আর দেরি করতে পারবেন না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বয়ং সব কিছু তত্ত্বাবধান করবেন বলে ‘সরোজিনী’র ক্যাবিনেই আস্তানা গাড়লেন, রবিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন জ্ঞানদানন্দিনী।
এবার রবি আর মেজো বউঠানের সঙ্গে সার্কুলার রোডের বাড়িতে গেল না, সে এল জোড়াসাঁকোয়। বাবামশাইয়ের নির্দেশে তাকে জমিদারির কাজকর্ম দেখতে হবে। এখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথও এখানে থাকতে পারবেন না, সুতরাং রবির দায়িত্ব আরও বেশি। প্রতিদিন সেরেস্তায় বসে সে হিসেবপত্র বুঝে নিতে লাগল। সেইসঙ্গে চলল তার লেখালেখি ও নতুন বইয়ের প্রুফ দেখা।
কাদম্বরীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ‘ভারতী’ পত্রিকারও মৃত্যু হতে যাচ্ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দু’জনেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা আর এ পত্রিকা চালাতে পারবেন না। তখন স্বর্ণকুমারী এগিয়ে এলেন, তিনি ওই পত্রিকার ভার নিতে চান। সংবাদপত্রে ঘোষণা করে ‘ভারতী’র মালিকানা দিয়ে দেওয়া হল স্বর্ণকুমারীকে। রবিকে তো প্রতি সংখ্যায় লিখতেই হবে আগের মতন।
আগে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবির জন্য বরাদ্দ ছিল একখানি ঘর। বরিশাল থেকে ফিরে এসে সে দেখল, দোতলায় মিস্তিরি লেগে গেছে, রবির জন্য নিজস্ব একটি বৈঠকখানা ঘর প্রস্তুত হচ্ছে, সেইসঙ্গে একটু রান্নার জায়গা ও স্নানের জায়গা এবং খানিকটা বারান্দা। দেবেন্দ্রনাথের সন্তানরা বিবাহের পর এরকম একটি পৃথক মহলের অধিকারী হয়।
ঘরের মধ্যে মিস্তিরিরা ঘোরাঘুরি করলে লেখাপড়ার অসুবিধে হয় খুবই। তিনতলায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মহলটা খালি পড়ে আছে, আগে রবি যখন-তখন ওখানেই চলে যেত, এখন একবারও যায় না। মিস্তিরিরা দেয়াল রং করছে, মেঝেতে ম্যাটিং আঁটছে, তারই একপাশে রবি চেয়ার-টেবিল পেতে প্রুফ দেখে। রাত্তিরে মশারি না। টাঙিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। রবির স্ত্রী মৃণালিনী এখনও জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে থেকে লরেটো স্কুলে পড়তে যাচ্ছে। সুরেন-ইন্দিরার সমবয়েসী হলেও সে লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে, তার ওই ইংরেজি স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, রবিও এ কথাটা শুনেছে কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মৃণালিনী এখন এ বাড়িতে এসে কী করবে? মেজো বউঠান তাকে মানুষ করতে চান, দেখুন চেষ্টা করে!
কাদম্বরী নেই, একসময় এই বাড়িতে কাদম্বরীই ছিলেন রবির প্রধান অবলম্বন, এখন তাঁর অনস্তিত্ব যে রবির মনে কতখানি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তা সে নিজেই যেন জানে না। প্রকাশ্যে হুতাশের তো প্রশ্নই ওঠে না, বিরলেও রোদন করে না সে। রমণী তার সংসারে কলঙ্ক দিয়ে যায়, সে জন্য তার প্রসঙ্গ তোলাই যেন এ বাড়িতে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, রবিও তা মেনে নিয়েছে। নিজেকে সে নানা কাজে ব্যস্ত রাখে।
তার মধ্যেও মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায় রবি। কাদম্বরীর শরীর সে শ্মশানে পুড়তে দেখেছে। যে-নারীকে ঘিরে ছিল রবির কত শত কবিতা, সেই বরবর্ণিকীকে পুড়িয়ে ছাই করে দিল আগুন, তবু রবির মনে হয়, তিনি আছেন, কোথাও না কোথাও রয়েছেন এখনও। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অনেক ঊর্ধ্বে এই অনুভূতি, এক এক সময় রবির মনে হয়, মুখ তুলে তাকালেই সে দেখতে পাবে নতুন বউঠানের কৌতুক-হাস্য মাখা মুখখানি। রবির এই অন্যমনস্কতা অন্য কেউ লক্ষ করলেই সে সচেতন হয়ে যায়, জোর করে আবার মন দেয় কাজে।
রবির মুখে এখন নবীন তৃণের মতন অল্প অল্প দাড়ি, সাজ-পোশাকের দিকে মন নেই, ধুতির ওপর একটা উড়নি জড়িয়ে রাখে গায়ে। এক এক সময় সেই ভাবেই বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, থ্যাকার স্পিংসের দোকানে গিয়ে এক গাদা বই কেনে। প্রখ্যাত ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রটি এরকম অতি সাধারণ পোশাকে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখে চেনা শুনো কেউ অবাক হয়ে থমকে, রবি ভ্রুক্ষেপ করে না। মাঝে মাঝে স্নান করতে, খেতেও সে ভুলে যায়। ভৃত্যরা খাবার নিয়ে সাধাসাধি করলে সে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই পাত্রটি সরিয়ে দেয়, আহারে তার একেবারেই রুচি নেই।
একমাত্র নিজের বইয়ের প্রুফ দেখার সময়ই রবির আর অন্য কোনও কথা মনে পড়ে না। কবিতাই তার আসল সত্তা, কবিতার মধ্যেই সে বসবাস করে। কবিতার এক একটি শব্দ তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাতিয়ে রাখে, আবার কোনও শব্দের সঠিক প্রয়োগ না হলে রক্তক্ষরণের মতন একটা যন্ত্রণা হয়, যতক্ষণ না মনোমতন একটা শব্দ আসে, ততক্ষণ সেই যন্ত্রণা থেক নিস্কৃতি নেই। প্রুফ দেখতে বসে রবি অনবরত কাটাকুটি করে, তখন তার বাহ্যজ্ঞান পর্যন্ত থাকে না।
কাদম্বরীর মৃত্যুর ঠিক সাত দিন পর রবির বই বেরিয়েছিল ‘প্রকৃতির পরিশোধ’। ছাপার কাজ সব আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, পত্ৰতে লেখা ছিল শুধু ‘তোমাকে দিলাম,’ কিন্তু সে বই রবি নতুন বউঠানের হাতে তুলে দিতে পারেনি! তখন কাদম্বরীর শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা চলছে।
এর মধ্যে ‘নলিনী’ নামে আর একটা চটি নাটকের বই বেরিয়ে গেছে, তারপর ছাপা শুরু হয়েছে “শৈশব সঙ্গীত’। রবির কাব্যচর্চায় একেবারে শুরুর নিদর্শন কবিতাগুলি স্থান পেয়েছে এই বইতে। কয়েকদিন একটানা প্রুফ দেখার পর তার চিন্তা জাগল, এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হবে কাকে। রবির যে সব বই-ই নতুন বউঠানকে দিতে ইচ্ছে হয়ত। মৃত কারুকে কি বই উৎসর্গ করা যায়। তারপর সব বই একজনকে দিলে অন্যরা কেউ কিছু ভাববে? সাঁটে লিখলেও সকলে বুঝে যায়। কিন্তু এই কবিতাগুলির সঙ্গে যে নতুন বউঠানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক!
রবি একটা সাদা কাগজে প্ৰথমে লিখিল ; এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম।
একটুক্ষণ সে দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার লিখল, বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। …তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।
হঠাৎ কী মনে হল, কাগজপত্র সব ফেলে রেখে রবি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল তিনতলায়। শিকল খুলে সে হাট করে দিল দরজা। কাদম্বরী চলে যাবার পর রবি আর এখানে আসেনি। ভাঙা কাচগুলি শুধু পরিষ্কার করা হয়েছে, তা ছাড়া পাশাপাশি ঘর দুটি যেমন যেমন সাজানো দিল তেমনই আছে। বাগানের দিকে যে জানলা, সেই জানলার পাশে কাদম্বরী প্রায়ই বসে থাকতেন। পালঙ্কটিতে এখনও বিছানা পাতা রয়েছে। টেবিলের ওপর রবিরই বই, ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ অর্ধেক খোলা।
রবি অস্ফুট স্বরে ডাকল, নতুন বউঠান।
বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, ঘরের মধ্যে একটু একটু অন্ধকার। অনেক দিন এ মহলে আর বাতি জ্বলে না। রবি এ-ঘর ও-ঘর ঘুরতে লাগল, হাত বুলোতে লাগল নানান আসবাবে, আর মাঝে মাঝে ডাকতে লাগল, নতুন নতুন বউঠান, নতুন বউঠান!
রবির মনের একটা অংশ জানে, কেউ সাড়া দেবে না। সে যে শ্মশান দেখে এসেছে। তবু তার ডাকতে ইচ্ছে করছে। মনের অন্য একটা অংশ যেন বলছে, অসম্ভবের পরেও তো আরও অসম্ভব থাকে, সেই চরম অসম্ভব কি কখনও বাস্তব-সম্ভব হয় না?
বারান্দায় সার-সার ফুলগাছের টব। এই সব গাছ কাদম্বরীর নিজের হাতে লাগানো, এর মধ্যে অনেক গাছ শুল্ক, বিবর্ণ হয়ে গেছে, অনেকদিন কেউ জল দেয় না। রবিকে দেখে কয়েকদিন গাছ যেন দুলে দুলে অভিযোগ জানাতে লাগল। স্নানের ঘরের একটা গামলায় এখনও পুরনো জল রয়ে গেছে, তার ওপর পাতলা ধুলোর সব পড়েছে, হয়তো এই জলেই কাদম্বরী শেষবার স্নান করেছিলেন। জ্যোতিদাদাও তো তারপর আর একদিনও এখানে থাকেননি।
সেই গামলাটি ধরে এনে রবি সব টবে একটু একটু জল দিল। এই গাছগুলিতে কাদম্বরীর হাতের স্পর্শ আছে, এক একটা গাছে হাত বুলিয়ে রবি সেই স্পর্শ পেতে চায়। এই বারান্দায় কত হাসি, কত গান, কত কৌতুকের স্মৃতি। কখনও পাঠ করে শোনাতেন। অক্ষয় চৌধুরী চুরুটের ছাই ছড়াতেন চতুর্দিকে, জ্যোতিদাদা পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে বলতেন, রবি, সেই গানটা ধর তো, মুলতান আড়খেমটা, “বুঝি বেলা বহে যায়, কাননে আয় তোরা আয়…”।
আর এক একদিন, প্রায়ই, অন্য কেউ থাকত না, শুধু রবি আর নতুন বউঠান, এই নন্দনকানন ভরে যেত কুসুম গন্ধে। কাদম্বরীর বিকেলবেলাও স্নান করা চাই, ভিজে চুল, ভিজে ভুরু, কানের লতিতে আন্তর ছোঁয়ানো…
রবি আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল সেখানে। আবার ডাকল, নতুন বউঠান, তুমি আর আসবে না!
সারা রাত রবি শুয়ে রইল সেই বারান্দার মেঝেতে। মাঝখানে ঝোপে বৃষ্টি এল একবার, রবির সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিল, তবু সে উঠল না। মাঝে ঘুম ও জাগরণ, নতুন বউঠান আসবেন না সে জানে, তবু এখানে শুয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে, সে যেন নতুন বউঠানের অতীন্দ্ৰিয় স্পর্শ পাচ্ছে।
সকালের দিকে রবির গায়ে জুর এসে গেল, তবু তার মনে একটা খুশি খুশি ভাব। নীচে নেমে গিয়ে, জ্বর অগ্রাহ্য করে সে মেতে গেলে কাজে।
জ্বরটা অবশ্য সহজে ছাড়ল না, দুদিন বাদে রবিকে শয্যা নিতে হল। কিন্তু তার মন থেকে যেন একটা পাষাণ ভার নেমে গেছে। সেদিন বারান্দায় শুয়ে থেকে একটা নতুন উপলব্ধিও হয়েছে তার। নতুন বউঠানের বিচ্ছেদ এখনও সে কল্পনা করতে পারে না। তিনি অত্যাগসহন, তবু তিনি যেন মুক্তি দিয়ে গেছেন রবিকে। শেষের দিকে, কাদম্বরীর একাকিত্ব তাঁর মন-খারাপ দেখে রবির অপরাধবোধ হত, কিন্তু অঞ্চল ছায়া ছেড়ে বাইরের জগতে যাবার জন্য যে রবির ডাক এসে গেছে, এই দুদিক সে সামলাতো কী করে
? নতুন বউঠান আর বাস্তবে নেই, স্মৃতির মধ্যে নতুন বউঠান এখন যেন আরও প্রিয় হয়ে উঠেছেন।
শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে রবি। খুট করে একটা শব্দ শুনে সে চোখ তুলে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী, জবরজং শাড়ি পরা, তাকে দেখাচ্ছে একটি রঙিন পুঁটুলির মতন। এ কে?
একটু নজর করেই রবি বুঝল, এ তো তারই বিবাহিতা! ভালো করে এখনও পরিচয়ই হয়নি এর সঙ্গে। মৃণালিনীর মুখে ভিতু ভিতু ভাব, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, যেন ভেতরে আসতে সাহসই করছে না।
রবি জিজ্ঞেস করল, তুমি? তুমি কখন এলে?
মৃণালিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমাকে বলুদাদা নিয়ে এল। আমার ও বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগে না।
রবি বলল, কেন, ভালো লাগবে না কেন? ওঁরা সবাই তোমাকে ভালোবাসেন! তা ছাড়া ইস্কুল যাওয়ার সুবিধে ওখান থেকে।
মৃণালিনী বলল, আমার ইস্কুল ভালো লাগে না।
রবি হাসল। সে নিজে ইস্কুল-পালানো ছেলে। তার স্ত্রীও কি সেইরকমই হবে। ইস্কুল বিষয়ে উপদেশ দেওয়া কি তার সাজে? তবু সে বলল, তা বললে কী হয়। বিবি, সরলা এরা সবাই ইস্কুলে যায়…
মৃণালিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ইস্কুল এখন ছুটি!
রবি জিজ্ঞেস করল, এখন কিসের ছুটি? এই তো সামার ভ্যাকেশন শেষ হল!
মৃণালিনী বলল, তা জানি না। এখন ছুটি। হ্যাঁ, সত্যি ছুটি, ছুটি।
রবি পালঙ্ক থেকে নেমে এল দরজার কাছে। বালিকা-বধূর সামনে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। বিয়ে করেছে, তবু এই মেয়েটিকে সে এখনও চেনে না। এই মেয়েটির তো কোনও দোষ নেই। ওঁরও হয়তো অনেক স্বপ্ন আছে তাকে ঘিরে।
রবি আঙুল দিয়ে তার থুতনি তুলে বলল, ছুটি, ছুটি, ভারি মিষ্টি শোনাচ্ছে তোমার গলায়। আজ থেকে তোমার ডাকনাম দিলাম ছুটি।