1 of 2

০২. মহারাজ বীরচন্দ্রের এক পাশে হুঁকো-বরাদর

মহারাজ বীরচন্দ্রের এক পাশে হুঁকো-বরাদর, অন্য পাশে সুসজ্জিত ও সশস্ত্ৰ কৰ্ণেল সুখদেব ঠাকুর। পেছনে ন’জন পারিষদ। বিভিন্ন উপলক্ষে এই পারিষদদের মুখ বদল হয়। এই পারিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে মহারাজ একটি নীরব প্রথা অনুসরণ করেন সব সময়। রাজকর্মচারী, সভাসদ ও প্রাসাদ-বাসিন্দা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেকেই যার যার স্বার্থে মহারাজের কাছাকাছি ঘুরে ঘুর করতে চায়, চাটুকারিতায় মহারাজকে খুশি করতে পারলে জীবন-সার্থক বোধ করে। কিন্তু মহারাজ তাঁর মর্জিমতন এক এক সময় এক একটি দল বেছে নেন, যারা কাছাকাছি সমবেত হয় মহারাজ তাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার দৃষ্টি ন্যস্ত করেন, এক একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর তাঁর ভুরু কুঁচকে যায়, তখন সেই ব্যক্তি পায়ে পায়ে পিছু হটে আড়ালে চলে যেতে বাধ্য। মহারাজ কখন যে কেন কাকে অপছন্দ করেন, তা বোঝা অতি দুষ্কর। একদিন যার প্রতি ভ্রূকুটি করে দূরে পাঠিয়ে দেন, পরদিনই হয়তো সাগ্রহে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বিশ্রম্ভালাপ শুরু করে দেন। রাজা-রাজড়াদের ব্যবহারের ব্যাখ্যা কেউ দাবি করে না।

কৰ্ণেল সুখদেব ঠাকুর মহারাজের পরামর্শদাতা এবং প্রধান দেহরক্ষী, তিনি এবং একান্ত সচিব রাধারমণ ঘোষ তার নিত্য সঙ্গী; গৃহশিক্ষক শশিভূষণ কিন্তু কখনও স্বেচ্ছায় রাজ সন্নিধানে আসার চেষ্টা করেন না। মহারাজ নিজেই কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে, ওই মানুষটিকে না ডাকলে কখনও দেখা পাওয়া যায় না। ছবি তোলার ব্যাপারে মহারাজ প্রায়ই ওঁর কাছ থেকে সাহায্য নেন। আগে বীরচন্দ্ৰ দাগেরোটাইপ ছবি তুলতেন, সেই সঙ্গে কলোডিয়ান ওয়েট প্লেট ফটোগ্রাফিরও চর্চা করেছেন। সিলভার নাইট্রেট-এ ডোবানো কাচের প্লেট সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় ভরে ছবি তোলার ঝঞাট অনেক। শশিভূষণই তাঁকে ড্রাই প্লেটের সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু শশিভূষণ মহারাজের কাছ থেকে কখনও অতিরিক্ত পারিতোষিক নিতে চান না। মনে হয় শশিভূষণের অর্থাভাব নেই, হয়তো তাঁর যথেষ্ট পৈতৃক সম্পত্তি আছে, তা হলে কেন তিনি কলকাতার চাকচিক্যময় পরিবেশ ছেড়ে এই জঙ্গলের দেশে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে এসেছেন, কে জানে।

গড়গড়ার নিলে মৃদু টান দিতে দিতে বীরচন্দ্র কয়েকবার ভ্ৰকুঞ্চিত করে কয়েকজন অনুসরণকারীকে বিদায় দিলেন। তারপর প্রাসাদ থেকে বার হবার ঠিক আগে সিংহদ্বারের আড়ালে দাঁড়িয়ে একান্ত সচিবকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘোষমশাই, প্রতি বৎসর এই উৎসবের দিনে আমি প্রজাদের পক্ষে মঙ্গলময় কোনও সুবিধার কথা-ঘোষণা করি। এ বৎসর কী ঘোষণা করব ঠিক করেছ?

রাধারমণ ঘোষ মধ্যবয়স্ক এবং মধ্যম আকৃতির মানুষ। তাঁর বেশবাস অতি সাধারণ, তাকে দেখলে বুঝাই যায় না যে, এ রাজ্যে তিনি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। তাঁর নাকটি তীক্ষ্ণ নয় কিন্তু কণ্ঠস্বর অনুনাসিক। তিনি বললেন, হ্যাঁ, মহারাজ। একটি ঘোষণার কথা আমি আগেই চিন্তা করে রেখেছি। সেই ঘোষণায় আপনি শুধু ত্রিপুরা রাজ্যেরই গৌরব বর্ধন করবেন না, সারা ভারতেও আপনার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। মহারাজ উৎসুকভাবে রাধারমণের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রাধারমণ বললেন, এই বিষয়টি নিয়ে আমি কর্নেল ঠাকুরের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। তিনিও আমার সঙ্গে একমত।

কর্নেল সুখদেব ঠাকুর সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

বীরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ঘোষণাটি কী?

রাধারমণ বললেন, আপনি এখানেই সকলকে জানিয়ে দিন, আজ থেকে এ রাজ্যে সতীদাহ প্রথা রদ করা হল। এই বর্বর প্রথা হিন্দু সমাজের কলঙ্ক।

বীরচন্দ্ৰ আনত নয়নে চুপ করে রইলেন।

কর্নেল সুখদেব ঠাকুর বললেন, আপনি ক্রীতদাস প্রথা রদ করে দিয়ে অশেষ গৌরবের অধিকারী হয়েছেন। রাজপ্রাসাদের ক্রীতদাসরা মুক্তি পেয়েছে। প্রজারা আপনার নামে ধন্য ধন্য করেছে।

রাধারমণ বললেন, ভূমি সংস্কারের জন্য আপনি যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন….

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বীরচন্দ্র বললেন, না, এ ঘোষণা করা যাবে না। এ প্রথা রদ করার সময় এখনও আসেনি। এই প্রথা অতি প্রাচীন ও ধর্মীয়। এ রাজ্যে সতীদের কেউ জোর করে না, তারা স্বেচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে সহমরণে স্বর্গে যায়। আমার প্রজাদের এই ধর্মীয় বিশ্বাসে আমি আঘাত দিতে পারি না।

রাধারমণ বললেন, মহারাজ, ইংরেজ আসার পর বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্ৰথা বে-আইনি বলে ডিক্রি জারি করেছেন, সেও অনেক দিন হয়ে গেল। সারা ভারত তা মানে। ত্রিপুরা কি পিছিয়ে থাকবে?

বীরচন্দ্র গম্ভীর স্বরে বললেন, ভুলে যেও না, আমার ত্রিপুরা ইংরেজ রাজত্বের মধ্যে পড়ে না। সব স্লেচ্ছ আইন মানতে আমি রাজি নই।

রাধারমণ বললেন, মহারাজ, সতীদাহ প্ৰথাকে ধর্ম পালন বলা চলে না। এ হল ধর্মের ব্যভিচার। আপনি নিশ্চয় রাজা রামমোহনের নাম শুনেছেন?

বীরচন্দ্ৰ এক হাত তুলে বললেন, ওসব তর্কের কথা এখন থাক। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে যে প্রথা, তা এক কথায় রদ করা যায় না। অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে। প্রজাদের মনোভাব জানতে হবে। ঘোষমশাই, আমার বাবার আমলে উৎসবের দিনের এই বিশেষ ঘোষণার ব্যাপারটা নিয়ে আগে থেকে অনেক আলাপ-আলোচনা করতে হতো, সুললিত ভাষায় সেটি লেখা হতো, তারপর আমার বাবা তা পাঠ করতেন। আর আমি, প্রজাদের সম্মুখে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে এই থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটা কিছু ঠিক করে নিতে চাইছি। এভাবে কাজ চলে? আমি অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপৃত থাকি, তোমরা আগের থেকে কিছু ঠিক করে রাখতে পারোনি?

রাধারমণ বললেন, একটা বিরাট ঘোষণার কথা তো ঠিক হয়েই আছে। আমি নিজে তার বয়ান প্রস্তুত করেছি, লিপিকরকে দিয়ে রোবকারি করা হয়েছে। কুমার রাধাকিশোর আপনার উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন আজ।

মহারাজ বীরচন্দ্রের মুখখানি এতক্ষণ ব্যক্তিত্ব ও গাম্ভীর্যে টসটস করছিল, এবার সেই মুখে যেন এসে পড়ল শিশুর চাঞ্চল্য। তিনি হাতের ইঙ্গিতে পেছনের পরিষদদের, এমনকি হুঁকো-বরাদরকেও দূরে সরে যেতে বললেন। তারপর খানিকটা ভয়ার্ত ফিসফিস স্বরে বললেন, ওই ঘোষণাটি আমি এ বছর স্থগিত রাখতে চাই। সামনের বারে দেখা যাবে। রাধারমণ এমন কথা শুনে খুবই বিস্মিত হলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তাঁর মুখে কোনও রেখা ফুটল না। কর্নেল সুখদেব ঠাকুরের সারা মুখখানি চমকিত।

রাধারমণ ধীর কণ্ঠে বললেন, তার ফল ভালো হবে না।

বীরচন্দ্র নিজের কর্মচারীর কাছে খানিকটা অনুনয় করে বললেন, কেন, এক বছর দেরি হলে কী এমন ক্ষতি হবে?  আমার স্বাস্থ্য ভালো আছে, আমি হঠাৎ করে মরেও যাচ্ছি না।

রাধারমণ বললেন, মহারাজ, আপনি শতায়ু হন, আমরা সকলেই তাই চাই। কিন্তু কুমার রাধাকিশোরের কত বয়েস হল তা আপনি খেয়াল করেছেন কী? তিনি যুবক হয়েছেন অনেক দিন আগে। কুমার ধীর স্থির দায়িত্বশীল। আপনি গান বাজনা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি নিয়ে নিরত থাকেন, এখন কুমারের হাতে রাজকার্যের কিছু দায়িত্ব দিলে রাজ্যেরই মঙ্গল হবে।

—দাও না কিছু কিছু দায়িত্ব। খাজনা আদায়ের ভার দাও। ইস্কুল খোলার ভার দাও।

– তার আগে পদাধিকার দেওয়াটা বিশেষ জরুরি। মহারাজ, আপনি কি যুবরাজ পদ দেবার ব্যাপারে আপনার মন বদল করেছেন?

—না, না, তেমন কথা তো বলিনি। কুমারের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই। শুধু বলছি, ঘোষণাটা বিলম্বিত হোক।

—তাতে শুধু কুমার নন, আরও অনেকে নিরাশ হবেন। সবাই ধরেই নিয়েছে যে, আজই কুমারের যৌবরাজ্যের ঘোষণা হবে।

—সবাইকে জানিয়ে দিয়েছ বুঝি?

—মাত্র তিনজন ব্যক্তি ছাড়া আর কোনও কাকপক্ষীকেও আমি জানাইনি। তবু লোকে জেনে যায়। গত দু’বছর আপনি এই উৎসবের দিনে এখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি, কার্শিয়াঙ ছিলেন। এবার…

-গত বার কার্শিয়াঙ গিয়েছিলাম। তার আগেরবার ঢাকা শহরে যেতে হয়েছিল জরুরি কাজে।

—এবারে বড় আকারে উৎসব হচ্ছে, আপনি স্বয়ং প্রজাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবেন। সকলেরই ধারণা, কুমার রাধাকিশোরকে আপনি এবারেই তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেবেন। কুমার রাধাকিশোর আপনার বংশের আরও মুখোজ্জ্বল করবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

—এ বছর যদি ঘোষণা স্থগিত রাখি, তা হলে কুমার কি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে নাকি?

-স্বয়ং কুমার তা করবেন না। কুমার অতিশয় নম্র, আপনাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করেন। কিন্তু কুমারের অনুরাগীরা হঠাৎ ফুসে উঠলে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইতিমধ্যেই খুব জনপ্রিয়।

— হাঁ, কিন্তু ঘোষমশাই, তো জান যে, মহাদেবী ভানুমতীরও যথেষ্ট লোকবল আছে! তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনরা যথেষ্ট শক্তি ধরে। মহাদেবী তাঁর সন্তানের জন্য সিংহাসনের দাবি ছাড়েননি। সমরেন্দ্রর সাঙ্গোপাঙ্গরা যদি মণিপুরিদের উস্কানি দেয়, তা হলে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠতে পারে।

রাধারমণ কর্নেল সুখদেব দিকে চেয়ে বললেন, এবার আপনি বলুন, কর্নেল।

কর্নেল ঠাকুর গলা খাঁকারি বললেন, মহারাজ, এই ব্যাপার নিয়ে আমরাও চিন্তা করেছি, খবরাখবর নিয়েছি। কুমার সমরেন্দ্রর পক্ষের লোকদের মধ্যে গুপ্তচর লাগানো হয়েছে। নিশ্চিত করে বলতে পারি, কুমার সমরেন্দ্র কিংবা তাঁর পক্ষের লোকরা সে রকমভাবে তৈরি নয়। তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে বটে। বড় রানীর ছেলেই সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী, এ রকম কথা তাঁরা প্রচার করছেন, কিন্তু বিদ্রোহ ঘটাবার মতন সমর্থক তাঁদের নেই।

রাধারমণ বললেন, কুমার রাধাকিশোরকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করে তার হাতে পুলিশ বাহিনী দিলে কেউ আর তার বিরুদ্ধতা করতে সাহস পাবে না।

কর্নেল সুখদেব ঠাকুর বললেন, কুমার সমরেন্দ্রর উচ্চাভিলাষ অঙ্কুরেই বিনাশ করা দরকার। নইলে গোলযোগ শুরু হবে, মামলা-মোকদ্দমায় জেরবার হতে হবে, তাতে এ রাজ্যেরই ক্ষতি।

মহারাজ হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বিকট মুখভঙ্গি করে দেহরক্ষীকে বললেন, তুই রাধাকিশোরের কাছ থেকে অনেক টাকা খেয়েছিস, তাই না? আমার কাছে তার হয়ে দালালি করছিস। আমি বেঁচে আছি, এর মধ্যেই কালনেমির লঙ্কা ভাগ শুরু হয়ে গেছে। যত্তোসব হারামজাদের পাল।

মহারাজ এবার সচিবের দিকে চাইলেন। রাধারমণ সোজাসুজি তাকিয়ে আছেন, এখনও তাঁর মুখ ভাবলেশহীন। তাঁর এরকম ঠাণ্ডা স্বভাবের জন্য মহারাজ তার ওপর কখনও উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন না।

এবার তিনি সিংহদ্বারের দিকে পা বাড়ালেন। তাঁর অন্তরের এক ধরনের অসহায়তা ও তজ্জনিত ক্রোধ টগবগ করছিল। কিন্তু বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই আবার তাঁর মেজাজ প্রশান্ত হল। নির্মল আকাশে ফুটে আছে দশমীর চাঁদ। তার থেকে যেন ফুলের রেণুর মতন ঝরে পড়ছে জ্যোৎস্না। মহারাজের মনে হল, ওই চাঁদ যেন জীবন্ত। পুরাণ কাহিনীতে চন্দ্র দেবতা একজন পুরুষ এবং দুর্বল ক্ষয়রোগী। কিন্তু মহারাজের তা মনে পড়ল না, তিনি দেখলেন এক হাস্যময় নারীর মুখ, যেন স্বৰ্গলোক থেকে তারই দিকে চেয়ে আছে। এখনই যদি ওই চাঁদের একখানা ফটোগ্রাফ তোলা যায়, তা হলে সেই নারীর মুখ নিশ্চিত ফুটে উঠবে।

মহারাজকে দেখা মাত্ৰ সহস্ৰ কণ্ঠ এক সঙ্গে জয়ধ্বনি দিল। জ্বলে উঠল অনেক রংমশাল। মহারাজ সে সব দিকে মনও দিলেন না, বার বার চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে তিনি সোজা হেঁটে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মঞ্চে। অজস্র ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে মঞ্চটি, সাতখানা পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে স্থানটি দিনের আলোর মতন আলোকিত। জয়ধ্বনির তখনও বিরাম নেই, মহারাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তিনি যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। আর একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, সহাস্য চাঁদ যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছে অনেকখানি নীচে, একটু একটু দুলছে।

এত মানুষের কোলাহল অগ্রাহ্য করে মহারাজ তাঁর সচিবের দিকে ফিরে বললেন, ঘোষমশাই, বলো তো এই পদটি কার রচনা? “ওহে বিনোদ রায় ধীরে যাও হে”…

যখন তখন যে মহারাজের এরকম ভাবান্তর হয় তা রাধারমণ বেশ ভালোই জানেন। ক্ষণমাত্র চিন্তা করে তিনি উত্তর দিলেন, মনে হয় যেন ভারতচন্দ্র।

মহারাজ বললেন, পরের পদটি মনে আছে? বলো—

রাধারমণ বললেন, “আধরে মধুর হাসি বাঁশিটি বাজাও হে…”

রাধারমণ বললেন, “নব জলধর তনু শিখিপুচ্ছ শক্ৰধনু পীতধড়া বিজুলিতে ময়ূরে নাচাও হে…”

মহারাজ সন্তুষ্ট না হয়ে আরও কৌতূহলী হয়ে বললেন, আরও বলো।

রাধারমণ বললেন, সব মনে নেই। দেখি চেষ্টা করে, “নয়ন চকোর মোর দেখিয়া হয়েছে ভোর মুখ সুধাকর-হাসি-সুধায় বাঁচাও হে…”

মহারাজ উজ্জ্বল মুখে বললেন, অ্যাই। মুখ সুধাকর! সুধাকর। দেখ দেখ, আকাশ পানে একবার চেয়ে দেখ। শিখিপুচ্ছ তো ময়ূরের পাখা, তাই না? চকোর মানে কী গো?

রাধারমণ বললেন, আজ্ঞে, চকোর হচ্ছে একরকম পাখি, রাত্তিরে ওড়ে।

জয়ধ্বনি শেষ হবার পর বিভিন্ন উপজাতীয় নেতারা নিয়ে আসছে উপহার ও উপঢৌকন। জন্তু-জানোয়ারগুলিকে রাজকর্মচারীরা সরিয়ে রাখছে এক পাশে। হাতির বাচ্চা এসেছে। এগারোটা, আঠেরোটি হরিণ, দুটি চিতা বাঘের ছানা ও অনেক ময়ূর। শীত শুরু হলেই হাতি বিক্রি হবে কুমিল্লার হাটে। বাঘের বাচ্চা পাঠাতে হবে কলকাতায়, এদিকে বাঘ কেনার খরিদার নেই।

অন্যান্য দ্রব্যগুলি রাখা হচ্ছে মহারাজের পায়ের কাছে। তিনি বিভিন্ন দলপতির সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করছেন। দু’একটা কথা বলে, কিন্তু বোঝা যায় তাঁর যেন ঠিক মন নেই। উপঢৌকনগুলির দিকে তিনি চেয়েও দেখছেন না। মহারাজ এমনিতে বেশ লোভী ও ভোগী, কিন্তু কখনও কখনও হঠাৎ উদাসীন হয়ে যান।

এক একজন দলপতি নেমে যাচ্ছে আর একজন উঠছে, এরই এক ফাঁকে মহারাজ রাধারমণকে জিজ্ঞেস করলেন, চাতক আর চকোর কি একই পাখি?

রাধারমণ বললেন, না, মহারাজ। চাতক পান করে বৃষ্টির জল। আর চকোর শুধু জ্যোৎস্না পান করেই তৃপ্তি পায়।

মহারাজ বললেন, শুধু জ্যোৎস্না পান করে? বা-বা-বা-বা। আমার রাজ্যে এ পাখি আছে? একবার দেখাতে পারবে?

রাধারমণ বললেন, আমি নিজেও কখনও দেখিনি। এখানে ও পাখি পাওয়া যাবে না।

মহারাজ বললেন, কেন পাওয়া যাবে না? আমার রাজ্যে নেই? খোঁজ নিয়েছ কখনও? শুধু মানুষের খোঁজ নিলেই হবে? ত্রিপুরায় কত রকম পাখি আছে তার একটা তালিকা বানাও। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই চাই। চকোরও নিশ্চয়ই পাওয়াই যাবে।

কর্নেল সুখদেব ঠাকুর বললেন, আমি যতদূর জানি…

মহারাজ বললেন, চোপ! তোর কোনও কথা শুনতে চাই না।

রাধারমণ বললেন, মহারাজা উপহার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার হলে-

মহারাজ সুখদেব ঠাকুরকে বললেন, কী বলবি বলছিলি বল। জলদি বলে ফেল!

সুখদেব ঠাকুর বললেন, আমি যত দূর জানি, চকোর নামে কোনও পাখি বাস্তবে নেই। আছে শুধু কবি কল্পনায়।

মহারাজ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, গাধা। কবিরা চোখে না দেখলে কল্পনা করে কী ভাবে? গ্যাঁজায় দম দিয়ে কল্পনা করে? নিশ্চয়ই এই পাখি কোথাও না কোথাও আছে।

সুখদেবের প্রতি মহারাজের রাগ আরও বেড়ে যাবে এই আশঙ্কা করে রাধারমণ তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, মহারাজ। উনি জানেন না। নিশ্চয়ই চকোর পাখি কোথাও না কোথাও আছে। বৃন্দাবনে নিশ্চয়ই দেখা পাওয়া যায়।

মহারাজ বললেন, তবে? বৃন্দাবনে লোক পাঠিয়ে এক জোড়া ওই পাখি আনাবার ব্যবস্থা করো। আমার ত্রিপুরায় জ্যোৎস্নার অভাব নেই, এখানে ভালোই খেয়ে পরে বাঁচবে। ঘোষমশাই, ভারতচন্দ্রের কাব্যগুলির কোনও কেতাব আছে তোমার কাছে?

রাধারমণ বললেন, আমার কাছে নেই। বাল্যকালে পড়েছি। কলকাতার দোকানে অবশ্যই পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের দোকানে।

মহারাজ বললেন, সবই তোমার কলকাতায়। কেন, আগরতলায় ভালো বইয়ের দোকান খুলতে পার না? কালই দোকান খোলার ব্যবস্থা করো। আর আমাকে খানকতক পদাবলি কাব্য আনিয়ে দিও।

রাধারমণ বললেন, অবশ্যই দেব, মহারাজ। এবার তা হলে ঘোষণাপত্রটি।

মহারাজ বললেন, আহা, বললাম তো, ওটা আগামী বৎসরের জন্য মুলতুবি রাখো।

রাধারমণ বললেন, সবাই অপেক্ষা করছে, মহারাজ। পলিটিকাল এজেন্ট মহোদয়ও এরকম ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যুবরাজির নিষ্পত্তি না হলে রাজ্যে অশান্তি দেখা দেবে।

মহারাজ কর্নেল সুখদেব ঠাকুরকে বললেন, তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোকে আমার দরকার নেই, দূর হয়ে যা এখান থেকে। সাতদিন আমার সামনে আসবি না। গাধাস্য গাধা। বৃন্দাবনে চকোর পক্ষী পাওয়া যায়, তাও জানে না।

কর্নেল সুখদেব ঠাকুর যুক্ত হাতে প্ৰণাম করে বললেন, যথা আজ্ঞা মহারাজ। কর্নেল সুখদেব ঠাকুর মঞ্চ থেকে নেমে যাবার পর রাধারমণ রৌপ্যদণ্ডে মোড়া ঘোষণা পত্রটি মহারাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি এটা পাঠ করুন, মহারাজ।

মহারাজ দেখলেন, যাত্রাপালা দেখার উদগ্ৰীব ভঙ্গিতে সমস্ত প্ৰজাবৃন্দ তাকিয়ে আছে এই মঞ্চের দিকে। সবাই নিঃশব্দ। অদূরেই রয়েছে কুমার রাধাকিশোর ও তাঁর দুই ভাই, রাজধানীর ক্ষমতাশালী ঠাকুর সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ রয়েছে রাধাকিশোরের কাছাকাছি, অর্থাৎ ওরা ওই কুমারের সমর্থক। কিশোর সমরেন্দ্ৰও দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্য দিকে, তাকে ঘিরে রয়েছে মণিপুরিরা। পাহাড় জঙ্গল থেকে এসেছে যে-সমস্ত মানুষ, তারা কে কার সমর্থক কে জানে! শীতকালের জলাশয়ে স্নান করতে নামার আগে বালকের যেমন অনিচ্ছা থাকে, সেই ভঙ্গিতে মহারাজ বললেন, ঠিক আছে ঘোষমশাই, তুমিই পড়ে শুনিয়ে দাও।

রাধারমণ বললেন, সে কি মহারাজ! এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা প্রজারা আপনার স্বকণ্ঠে শুনতে চায়।

মহারাজ বললেন, ওই একই কথা। তুমি শোনালেও যা, আমি শোনালেও তা।

রাধারমণ তবু বললেন, আমার পাঠ করাটা ভালো দেখায় না। মন্ত্রীমশাই অসুস্থ বলে আসতে পারেননি, তা হলে অন্তত দেওয়ান মশাইকে ডাকা হোক।

মহারাজ এবার দৃঢ় স্বরে বললেন, তুমি পড়তে চাও তো পড়ো, না হলে দরকার নেই। আমার ক্ষুধা লেগেছে, আমি এবার খেতে যাব।

অগত্যা রাধারমণই পাঠ শুরু করলেন। “চন্দ্ৰবংশীয় ত্রিপুরেশ্বর শ্ৰী শ্ৰী শ্ৰী শ্ৰী বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য বাহাদুর মহারাজের আদেশক্রমে…”

মহারাজ বীরচন্দ্রের বুকের মধ্যে দুরু দুরু শব্দ হতে লাগল। অচিরেই এই সংবাদ অন্তঃপুরে মহারানী ভানুমতীর কাছে পৌঁছে যাবে। ভানুমতী নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন যে, মহারাজ এত তাড়াতাড়ি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন না। কত আঘাত পাবেন তিনি! বাল্যকালের খেলার সঙ্গিনী ভানুমতী। এই জন্যই ভানুমতী মহারাজের পাশে থাকার জন্য জেদ ধরেছিলেন। ভানুমতীর মুখের দিকে চেয়ে বীরচন্দ্র এমন ঘোষণা কিছুতেই করতে পারতেন না। রাজকাৰ্যে স্নেহ-ভালোবাসার দাম থাকে না। রাধাকিশোরকে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা কি ঠিক হল, বয়োজ্যেষ্ঠ হলেই যে সিংহাসনের উপযুক্ত হবে তার কি মানে আছে।  তিনি নিজেই কি তাঁর দুই দাদা চক্ৰধ্বজ আর নীলকান্তকে বঞ্চিত করে এ রাজ্যের শাসন ভার নেননি।  ভানুমতীকে এখন তিনি কী সান্ত্বনা দেবেন। ভানুমতীকে বিদ্বিষ্ট করে এ রাজ্যে শান্তি রক্ষা করাও কি সম্ভব?

পাশার দান পড়ে গেছে, আর কোনও উপায় নেই। ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্রই তুমুল হর্ষধ্বনিতে বাতাস কেঁপে উঠল।

মহারাজের ভ্ৰূদ্বয় কুঞ্চিত, তিনি এখনও আপত্তিসূচক মাথা নাড়ছেন। এর মধ্যেই তাঁর খেয়াল হল যে প্রজারা তার বিরূপ মুখভঙ্গি বুঝে ফেলতে পারে, তাই তিনি হুঁকোবরাদরকে কাছে ডেকে গড়াগড়ার নল ঠোঁটে লাগিয়ে ধূমপান করতে লাগলেন। এত জয়ধ্বনি শুনতেও তার ভালো লাগছে না। হঠাৎ তার শীতবোধ হল, যেন কেউ কোথাও নেই, আদিম পৃথিবীতে তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন, শব্দতরঙ্গ বাতাসের তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে তাঁর শরীরে ধাক্কা দিচ্ছে। মুখ থেকে নল সরিয়ে তিনি অসহায়ভাবে বললেন, ঘোষমশাই, ক্ষুধায় যে আমার পেট জুলে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ?

এবার আহারে বসার পালা। রাধারমণ সকলকে পথ ছেড়ে দাঁড়াবার জন্য ইঙ্গিত করলেন, মঞ্চ থেকে সদলবলে নেমে এলেন মহারাজ। এক জায়গায় গোল করে অনেকগুলি আসন পাতা হয়েছে, মাঝখানে জ্বলছে গোটা চারেক মশাল। সমস্ত উপজাতীয় নেতারা এখানে মহারাজের সঙ্গে বসবেন। পট্টবসনে সজ্জিত হলেও মহারাজের কোমরে ঝুলছে তাঁর বংশের বিখ্যাত তলোয়ার, সেটার কথা মনে ছিল না, বসতে গিয়ে সেই তলোয়ারের হাতলের খোঁচা লাগল। তার কোমরে, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠতে গিয়েও কোনও রকমে সামলে নিলেন তিনি।

একজন পরিচারক এসে মহারাজের সামনে একটি বৃহৎ রুপোর থালা পেতে দিতেই মহারাজ রক্তচক্ষে বললেন, এটা আবার কী? সরিয়ে নিয়ে যা।

এই প্রত্যাখ্যানও অনুষ্ঠানের অঙ্গ। প্রতিবারেই মহারাজকে প্রথমে রুপোর থালা দেওয়া হয়, মহারাজ সরিয়ে নিতে যেতে বলেন। এই ক্ষুদ্র দৃশ্যটি আসলে অভিনয়। প্রজারা দেখতে পায় যে, প্রতিদিন রুপোর থালায় অন্নগ্রহণে অভ্যস্ত মহারাজ আজ সকলের সঙ্গে সমান হয়ে কলাপাতায় খিচুড়ি খাবেন। মেজাজ খিচড়ে আছে বলে মহারাজ এই অভিনয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললেন, মুখে বারণ করার পরেও তিনি বা হাতে সজোরে ধাক্কা দিলেন পরিচারকটিকে, সে উল্টে পড়ে গেল।

সমস্ত দলপতিদের খাদ্য পরিবেশন করা হয়ে গেলে মহারাজ প্রথম গ্ৰাস মুখে তুললেন। অন্যান্য বছর তিনি দলপতিদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, আজ তাঁর সেদিকে মন নেই। দু’তিন গ্ৰাস খেয়ে তিনি থেমে গেলেন। খানিক আগেই তিনি প্রবল ক্ষুধা বোধ করছিলেন, এখন অনুভব করলেন যে, আসলে তাঁর আহারে রুচি নেই। খিচুড়ি তিনি বেশ পছন্দই করেন, রন্ধনও বেশ স্বাদু হয়েছে কিন্তু মহারাজের আহারের ইচ্ছে চলে গেছে। তিনি পাত্র ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, সচরাচর তিনি সৌজন্যের ধার ধারেন না, কিন্তু আজ একটা বিশেষ দিন। তিনি খাওয়া বন্ধ করতেই অন্য সবাই হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এবার মহারাজ কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন, খাও হে, তোমরা সবাই পেট পুরে খাও। তোফা রান্না হয়েছে।

হুঁকো-বরদাকে ডেকে তিনি সেই অবস্থাতেই ধূমপান করতে লাগলেন আবার। পাঁচ মিনিটের বেশি মহারাজ ধূমপান ছাড়া থাকতে পারেন না তা সবাই জানে, সুতরাং এটা কারুর অস্বাভাবিক মনে হল না।

আহারপর্ব শেষ হতেই মহারাজ প্রাসাদের দিকে ফিরতে শুরু করলেন। আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন কিছুদূর গিয়েই। সাঙ্ঘাতিক ভুল হয়ে যাচ্ছিল। প্রাসাদে এখন তিনি কোন রানীর কক্ষে যাবেন? মহারানী ভানুমতীর কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এ রাতে অন্য রানীর শয্যায় গিয়ে ভানুমতীর দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিতেও চান না তিনি।

রাধারমণের দিকে ফিরে বললেন, আমি বাগানঘরে যাব। কাসেম আলি, ভোলা চক্কোত্তি, যদু ভট্ট, নিশার হোসেনদের ডেকে পাঠাও, সারা রাত গান-বাজনা হবে, আর কেউ যেন সেখানে আমাকে বিরক্ত না করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *