1 of 2

৪৩. বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা

বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা নাটকের জয়জয়কার। শুধু কলকাতা নয়, গ্রাম-গ্ৰামাঞ্চল থেকেও লোকে ছুটে আসছে। এই নাটক দেখার জন্য। দু মাস ধরে চলছে। এই নাটক, এর গান ও সংলাপ লোকের মুখে মুখে, হিন্দু সমাজ আবার কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। স্টার থিয়েটারের মঞ্চে যেন প্রেমের ঠাকুর শ্ৰীগৌরাঙ্গ স্বয়ং আবার আবির্ভূত হয়েছেন।

দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভক্তমণ্ডলির মধ্যেও মাঝে মাঝে এই নাটকের কথা ঘুরেফিরে আসে। এই ভাবোন্মাদ কালীসাধক সব সময় যে ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করেন তা তো নয়, ইয়ার্কি ঠাট্টা ও চটুল মশকরাও করেন প্রায়ই, এঁর সামনে সব রকম কথাই বলা যায়। ভক্তদের মুখে শুনে শুনে রামকৃষ্ণ ঠাকুরেরও ওই থিয়েটার দেখার সাধ হল।

এক ধর্মাত্মা কামিনীকাঞ্চন ত্যাগী সাধক যাবেন রঙ্গালয়ের কৃত্রিম হাসি-কান্নার পালা দর্শন করতে, এ এক অদ্ভুত প্রস্তাব। সেখানে দর্শকদের মধ্যে কতরকম ভোগী-ভণ্ড-লুচ্চা-মাতাল থাকে, তার চেয়ে ভয়ংকর কথা, নটীরা সব বেশ্যা আর নটগুলীর চরিত্র রক্ষার কোনও বালাই নেই। স্বয়ং নাট্যকার ও পরিচালক গিরিশ ঘোষ এক প্রখ্যাত মাতাল এবং প্রায়ই কোনও অভিনেত্রীর বাড়িতে রাত্তিরে পড়ে থাকে এবং সেসব কথা প্রকাশ্যে জানাতেও লজ্জা বোধ করে না।

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভক্তদের মতভেদ আছে, একদল এই বহু আলোচিত নাটকটি দেখার জন্য খুবই উৎসাহী, আর একদল বারাঙ্গনা-সংসর্গে কলুষিত রঙ্গালয়গুলির ধারকাছও মাড়ান না। বেশ্যাদের প্রতি ঘৃণায় দেশের গণ্যমান্য অনেকেই এখনও থিয়েটার বর্জন করে রয়েছেন। নারীদের প্রতি অবিচার ও বঞ্চনায় যাঁর মন সদা কাতর, সেই ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরও বেশ্যাদের নটীবৃত্তি অবলম্বন করার ব্যাপারে সহানুভূতি দেখাতে পারেননি, তিনি সাধারণ রঙ্গমঞ্চগুলির সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করায় তাঁর অনুগামীরাও কেউ আসে না। কেশব সেন ও শিবনাথ শাস্ত্রীর দল এইসব থিয়েটার দেখা অতি পাপ মনে করে। কিন্তু রামকৃষ্ণ ঠাকুর, যিনি শুকনো সন্ন্যাসী নন, যিনি রসে বশে থাকতে চান, তিনি এই বেশ্যা প্রসঙ্গ শুনে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চন করলেন না, তিনি বললেন, আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব!

তারপর তিনি আরও বললেন, শোলার আতা দেখলে সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়। একবার সেই ওরা গড়ের মাঠে বেলুন দেখতে আমায় নিয়ে গোসল। তখন দেখি কি একটি সাহেবের ছেলে একটা গাছে ঠেসান দিয়ে ত্ৰিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখাও যা, অমনি কৃষ্ণের উদ্দীপন হল ; অমনি সমাধিস্থ হয়ে গেলুম!

মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে নামে এক ভক্তের ঘোড়ার গাড়িতে রামকৃষ্ণ ঠাকুর থিয়েটার দেখতে যাবেন, সঙ্গে আরও কয়েকজন জুটেছে, কিন্তু নরেন্দ্র নেই তাদের মধ্যে। নরেন্দ্র যাবে না?

কে একজন বলল, নরেনের পেটের কী ব্যামো হয়েছে, সে বেশ কিছুদিন আসে না।

পেটের ব্যামোটা সাময়িক, নরেন্দ্ৰ দক্ষিণেশ্বরে আর ঘন ঘন আসতে পারে না। অন্য কারণে। সেই যে এক রাতে সেই যে একরাতে নরেন্দ্র রামকৃষ্ণ ঠাকুরের বারংবার অনুরোধে মন্দিরের মধ্যে একাকী ঢুকে কালীমূর্তিকে মা বলে সম্বোধন করেছিল, তার পরেও তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়নি। সেই রাত্রে পাথরের মূর্তিকে তার ক্ষণিকের জন্য জীবন্ত মনে হয়েছিল, চক্ষে লেগেছিল ঘোর,সর্বাঙ্গে ছিল শিহরণ। রামকৃষ্ণ ঠাকুর তাকে ছুঁয়ে দিলে কিংবা তাঁর সংস্পর্শে থাকলে নরেন্দ্রর এরকম ঘোরের মতন হয়, কিন্তু কিছু পরেই তো সে ঘোর কেটে যায়। আবার ফিরে আসে বাস্তব জ্ঞান। সে ভাব-বিহ্বলতা সাময়িক, তা তো কোনও উচ্চস্তরের  উপলব্ধি হতে পারে না। সেই উচ্চস্তরে উঠতে না পারলে নিছক সাময়িক অলৌকিক অভিজ্ঞতায় নরেন্দ্রর আস্থা নেই।

তা ছাড়া, এখনও এই প্রশ্নটা নরেন্দ্রর মনে ঘুরেফিরে আসে, যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর কোনও বিধবার দুঃখ দূর করতে পারে না, কিংবা কোনও অনাথ শিশুর মুখে অন্ন জোগাতে পারে না, সে ধর্ম বা সে ঈশ্বরের প্রয়োজন কী?

তবে, একটা ব্যাপারে নরেন্দ্রর আস্থা যেন আর কখনও দুর্বল হবে না, তা হল রামকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রাণঢালা ভালোবাসা। নরেন্দ্ৰকে দেখার জন্য তাঁর অহৈতুকী ব্যাকুলতা। তবু নরেন্দ্ৰ দক্ষিণেশ্বরে আর নিয়মিত আসে না, কারণ তার সদ্য বিধবা জননী ও পিতৃহীন ছোট ছোট ভাইবোনগুলির গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা সে মুছে ফেলবে কী করে? নরেন্দ্রর মধ্যে সবসময় রয়েছে এই দোলাচল, সব বন্ধনমুক্ত হয়ে দক্ষিণেশ্বরের পরিবেশে পড়ে থাকতে তার ভালো লাগে, আবার সাংসারিক দায়িত্বের বন্ধন সে স্বেচ্ছায় গলায় জড়িয়ে রাখে। নিজের আনন্দের জন্য সে মাকে কিছুতেই দুঃখ দিতে পারবে না। কালীমূর্তিকে সে মা বলে ডেকেছিল, তা বলে নিজের মাকে ডাকবে না মা বলে?

চাকরি-বাকরির চেষ্টা ছেড়ে নরেন্দ্ৰ এখন অন্যভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে। ইংরেজি থেকে বই অনুবাদ করতে শুরু করেছে সে, হার্বার্ট স্পেনসারের একটি বই অনুবাদ করতে করতে সে দু একটি বিষয়ের সমালোচনা করে স্পেনসারকে চিঠি লিখেছিল, স্পেনসারসাহেব তার যুক্তি মেনে নিয়ে একটা উত্তরও দিয়েছেন। এ ছাড়া সে আর এক বন্ধুর সহযোগে একটি গানের সংকলন বই প্রস্তুত করার ব্যাপারেও ব্যস্ত।

কে যেন একজন বলল, নিজের মায়ের প্রতি নরেনের এত বেশি টান, তাই সে দক্ষিণেশ্বরের মাকে দর্শন করার জন্য আসার সময় পায় না।

নরেন্দ্রর প্রতি কোনও কটাক্ষ রামকৃষ্ণ ঠাকুর সহ্য করতে পারেন না। তিনি অমনি তেড়ে উঠে বললেন, মা বাপ কি কম জিনিস গা? তাঁরা প্ৰসন্ন না হলে ধর্মটর্ম কিছুই হয় না। চৈতন্যদেব তো প্রেমে উন্মত্ত ; তবু সন্ন্যাসের আগে কতদিন ধরে মাকে বোঝান। বললেন, মা আমি মাঝে মাঝে এসে তোমায় দেখা দিয়ে যায়!

হঠাৎ তিনি মহেন্দ্র মাস্টারের দিকে ঘুরে তাকালেন। মাস্টার এখন পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে নিজের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আলাদা সংসার করেছেন। সেটা রামকৃষ্ণ ঠাকুরে পছন্দ নয়। এখন সে কথা মনে পড়ায় তিনি ধমক দিয়ে বললেন, আর তোমায় বলি, বাপ-মা কত যত্নে মানুষ করলে, এখন নিজের মাগ নিয়ে বেরিয়ে আসা! বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে ছেলে তার মাগ নিয়ে বাউল-বৈষ্ণবী সেজে বেরোয়! তোমার বাপের টাকা পয়সার অভাব নেই বলে, তা না হলে আমি তোমাকেও বলতুম, ধিক! কতকগুলি ঋণ আছে, বুঝলে! দেবঋণ, ঋষিঋণ আবার মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, স্ত্রীঋণ… হরিশ নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করে এখানে এসে রয়েছে। যদি তার স্ত্রীর খাবার জোগাড় না থাকত, তা হলে তাঁকে বলতুম, ঢ্যামনা শালা!

মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে বলল, পাঁচটা প্রায় বাজে। এবার গাড়িতে উঠবেন না?

মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে ধনী ব্যক্তি, হাতিবাগানে তার একটি ময়দার কল আছে। ঠিক হয়েছে যে দক্ষিণেশ্বর থেকে সেখানে গিয়ে সবাই মিলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হবে। থিয়েটার শুরু হতে হতে তো সেই রাত নটা। গাড়ি চলতে শুরু করতেই রামকৃষ্ণ ঠাকুরের চোখ দুটি আবিষ্ট হয়ে এল, মাথা একটু একটু দুলছে। গুনগুন করে গাইতে লাগলেন :

যার মায়ায় ত্ৰিভুবন বিভোলা
মাগীর আপ্তভাবে গুপ্ত লীলা
সে যে আপনি ক্ষেপা, কর্তা ক্ষেপা
ক্ষেপা দুটো চেলা…

গান গাইতে গাইতে তার ভাবসমাধি হল।

এই সময় ভক্তরা চুপ করে বসে থাকে। রামকৃষ্ণের একপাশে মহেন্দ্র মাস্টার, উল্টেদিকে মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে। একটু আগে ওরা থিয়েটারে গিয়ে কত দামের টিকিট কেনা হবে তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে ইচ্ছে, সে তার গুরুকে নিয়ে যাচ্ছে, সবচেয়ে দামি বক্সের টিকিট কাটবে। রামকৃষ্ণ আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে অত দামি টিকিটের দরকার নেই। এখন মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে আবার ফিসফিস করে মাস্টারকে বলল, বক্সে না বসলে, ওনাকে কি পাঁচপেঁচি লোকের মধ্যে বসাটা মানায়?

রামকৃষ্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিড়বিড় করে বললেন, হাজরা আবার আমাকে শেখায়। শ্যালা!

একটু পরে আবার বললেন, আমি জল খাব!

এই জল খাওয়ার কথাটা শুনলেই মাস্টারের মতন ভক্তরা বুঝতে পারেন যে রামকৃষ্ণ সমাধি অবস্থা থেকে মনটাকে বাস্তব জগতে ফেরাবার চেষ্টা করছেন।

মাস্টার ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওঁর জন্য একটু জলের ব্যবস্থা করতে হবে যে! মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে বলল, শুধু জল? তা হলে কিছু খাবারও আনলে হয় না? মাস্টার বললেন, উনি এখন কিছু খাবেন না। জল দরকার। আধা ঘোরের মধ্যে বললেন, হ্যাঁ, আমি খাব। বাহ্যে যাব।

ঘোড়ার গাড়ি প্রায় হাতিবাগানে পৌঁছে গেছে। মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যের নিজস্ব বড় বাড়ি বাগবাজারে মদনমোহন মন্দিরের পাশে। কিন্তু তার বাবা সাধুসন্ন্যাসী মানেন না। সেই ভয়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে সে নিজের বাড়িতে না নিয়ে এই ময়দার কলে বসাল। এখানে পান-তামাকের ব্যবস্থা নেই। সে সব জোগাড় করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

পান খেয়ে রামকৃষ্ণ আবার জানালেন, তিনি বাহ্যে যাবেন।

মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে ভক্তিভরে জল ভর্তি গাড়ু নিয়ে মাঠের দিকে চলল তাঁর সঙ্গে। কয়েক পা এগোবার পর রামকৃষ্ণ থমকে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন, তোমার নিতে হবে না। গাডুটা মাস্টারকে দাও।

একটু পরে হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে রামকৃষ্ণ একটা ঘরের মধ্যে চৌকিতে বসলেন। তাঁর পরনে খাটো ধুতি, গায়ে ফতুয়া, কাঁধে চান্দর। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, কিছু কিছু পাক ধরেছে দাড়িতে। চোখ দুটি চঞ্চল, কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব। এক এক সময় বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন, আবার হঠাৎ হঠাৎ যেন চলে যাচ্ছেন নিছক বাস্তবতা ছাড়িয়ে অন্য কোথাও।

কেউ একজন তামাক সেজে এনে ধরল তাঁর সামনে। রামকৃষ্ণ হুঁকোটা নিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললেন, সন্ধে হয়েছে নাকি গো? তা হলে আর তামাকটা এখন খাই না।

সন্ধের সময় সব কাজ ছেড়ে একটুক্ষণ ঈশ্বরের কথা স্মরণ করতে হয়। রামকৃষ্ণ কে কী উত্তর দিল শুনলেন না। জানলার বাইরে -আকাশের অবস্থাও দেখার চেষ্টা করলেন না, তিনি নিজের একটা হাতের দিকে তাকালেন। সন্ধে হয়েছে কি না বোঝার জন্য তিনি নিজের হাতের লোম গোনার চেষ্টা করেন, অর্থাৎ যখন হাতের প্রতিটি লোম দেখা যায় না, তখনই সন্ধ্যা।

স্টার থিয়েটারের সামনের রাস্তায় আজ অনেক জুড়ি গাড়ি, ল্যান্ডো, ফিটন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আজ অনেক গণ্যমান্য দর্শক এসেছেন বোঝা যায়। টিকিটঘরে কাছে এখনও বেশ ভিড়।

বাইরের প্রাঙ্গণে পায়চারি করছেন গিরিশ। ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে তিনি কোনও পার্ট নেননি, মঞ্চে দাপাদাপি করতে এখন আর শরীর বয় না। নাটক শুরু হবার আগে টিকিটঘরের সামনের ভিড় দেখতে তাঁর ভালো লাগে, ‘হাউসফুল’ হলে বিশেষ তৃপ্তি হয়। বিশিষ্ট দর্শকদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে অভ্যর্থনা জানান। আজ থিয়োসফি আন্দোলনের নেতা কর্নেল আলকট এসেছেন একটু আগে, এসেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ, সপরিষদ সন্তোষের রাজা, ব্ৰাহ্ম নেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। একটু আগে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ও শশিভূষণকে তিনি ভেতরে বসিয়ে দিয়ে এসেছেন।

আর একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। মাস্টার, মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে, বাবুরাম ও অন্যান্য ভক্তরা আগে নেমে গিয়ে সসম্ভ্রমে রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে নামতে সাহায্য করল। দূর থেকে গিরিশ রামকৃষ্ণকে চিনতে পারলেন, যদিও এঁর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়নি। এর আগে দুবার রামকৃষ্ণকে দেখেও তেমন কিছু ভক্তিশ্রদ্ধা হয়নি গিরিশের।

মহেন্দ্ৰ মুখুজ্যে দ্রুত এগিয়ে এসে গিরিশকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের পরম পূজনীয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এসেছেন। তার জন্য কি টিকিট কাটতে হবে?

গিরিশ ভ্ৰকুঞ্চিত করলেন। এত লোক ফ্রি পাস চেয়ে জ্বালাতন করে যে বাড়িতে, পাড়ায় তিষ্ঠোনো যায় না। থিয়েটারে জন্য কত পরিশ্রম, মঞ্চসজ্জার কত খরচ, নটী-নটীদেরও যে ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে, অন্তরালের কর্মীদের যে গ্ৰাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হয়, তা এইসব লোকেরা বোঝে না।

একজন সাধক মানুষ থিয়েটার দেখতে এসেছেন, এটা অবশ্য গিরিশের পক্ষে শ্লাঘার বিষয়। এতদিন যারা নিন্দামন্দ করত, তারা অনেকেই আসছে এখন। নদীয়া-শান্তিপুর থেকে বৈষ্ণব পণ্ডিতরাও ছুটে আসছে, এই পালা দেখতে। একজন কালীসাধককেও তা হলে আসতে হল। সাধুসন্ন্যাসীদের টাকা-পয়সা থাকে না তা ঠিক, কিন্তু এঁদের সঙ্গে যে অনেক চেলাচামুণ্ডা থাকে। গৃহী ভক্তদের তো পয়সার অভাব নেই।

গিরিশ গম্ভীরভাবে বললেন, ওনার টিকিট লাগবে না, কিন্তু বাকিদের টিকিট কাটতে হবে।

রামকৃষ্ণ এর মধ্যে প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছেন। গিরিশকে তিনি কী করে চিনলেন কে জানে, তার দিকে রামকৃষ্ণ দু হাত তুলে নমস্কার করলেন আগে, গিরিশ প্রতিনমস্কার জানালেন। রামকৃষ্ণ আবার নমস্কার করলেন তাঁকে, সুতরাং নমস্কার ফেরত দিতে হয়, এইভাবে চলতেই লাগল। রামকৃষ্ণের একটা নমস্কার বেশি। কিন্তু শুরুর প্রথম ঘণ্টা পড়ে গেছে, তাই গিরিশ শেষ নমস্কারটা মনে মনে জানিয়ে বললেন, চলুন, ওপরে চলুন।

দোতলায় এসে একটি বক্সে রামকৃষ্ণকে বসালেন গিরিশ। নীচের তলাটা দর্শকে একেবারে ঠাসা। ওপরের বিভিন্ন বক্সে বসেছে বড় মানুষেরা। এরা বাড়ি থেকে আলবোলা নিয়ে এসেছে, কারু কারু সঙ্গে সুরা ভর্তি ডিকান্টার ও গেলাসও থাকে, নিজস্ব বেহারা পেছনে দাঁড়িয়ে মস্ত পাখা দিয়ে বাতাস করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক, তবু বেশ গরম, রঙ্গালয়ের মধ্যে এত মানুষের নিঃশ্বাসে আরও গরম, রামকৃষ্ণের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তা দেখে গিরিশ এঁদের হাওয়া করবার জন্য নিজস্ব বেহারকে নিযুক্ত করে দিলেন। তারপর একটি প্রস্ফুটিত লাল গোলাপ এনে দিলেন রামকৃষ্ণের হাতে। সেটা নিয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ফুলের অধিকার দেবতার আর বাবুদের, আমি নিয়ে কী করব গো?

কনসার্ট বাজতে শুরু করেছে, এখুনি ড্রপসিন উঠবে, গিরিশ সরে এলেন সেখান থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর সারা মুখ রেখায় ভরে গেল। আবার পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। তিনি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, দূর ছাই! এই ব্যথা সহজে থামবে না। এখন তাঁর অসুস্থতার কথা কারুকে জানাবার কোনও মানে হয় না। দু মাস ধরে অভিনয় চলছে, এখন আর প্রতি রাতে তাঁর উপস্থিতি তেমন প্রয়োজনীয় নয়। তা ছাড়া অমৃতলাল তো আছেই, হঠাৎ কিছু অঘটন ঘটলে সে সামলে দেবে।

নীচে নেমে এসে গিরিশ একখানা গাড়ি ডেকে বাড়ি চলে গেলেন।

রঙ্গালয়ের মধ্যে এত লণ্ঠনবাতি, এমন আলোকোজ্জ্বল স্থানে রামকৃষ্ণ আগে কখনও আসেননি। একসঙ্গে এত মানুষ। রামকৃষ্ণ উকি মেরে দেখতে দেখতে বালকের মতন উচ্ছল হয়ে উঠলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, বাঃ বাঃ, এখানটা তো বেশ! এখানে এসে বেশ হল! অনেক লোক একসঙ্গে হলে উদ্দীপন হয়। তখন দেখতে পাই, তিনিই সব হয়েছেন!

তার পরই মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ গা, এখানে যে বসালে, কত নেবে?

মাস্টার বললেন, আজ্ঞে। কিছু নেবে না। আপনি এসেছেন বলে ওদের খুব আহ্লাদ হয়েছে।

রামকৃষ্ণ মাথা দোলাতে লাগলেন। ড্রপসিন উঠতেই দর্শকদের গুঞ্জন থেমে গেল, প্রশস্ত মঞ্চের পেছনে বনপথের দৃশ্য আঁকা, ঠিক যেন গভীর বন বলেই মনে হয়, সামনে দিয়ে পথ।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার শশিভূষণকে নিয়ে বসেছেন নীচে, একেবারে প্রথম সারিতে। এই গরমেও কোটপ্যান্ট পরে আছেন মহেন্দ্রলাল, আর শশিভূষণ ধূতি ও কুর্তা। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্যকেও থিয়েটারে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল শশিভূষণের, কিন্তু তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি।

প্রথম দৃশ্যে নদীয়ায় গৌরাঙ্গ জন্মেছে বলে বিদ্যাধরীরা আর মুনিঋষিরা ছদ্মবেশে সেই শিশুকে দর্শন করতে এসেছে। গৌরাঙ্গ ঈশ্বরের অবতার, তাই সেইসব দিব্যাঙ্গনা ও ঋষিরা স্তব শুরু করলেন। গান আরম্ভ হল :

কেশব কুরু করুণা দীনে, কুঞ্জকাননচারী
মাধব মনোমোহন, মোহন মুরুলীধারী
(সমবেত) হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার…

মহেন্দ্রলাল ফিসফিসিয়ে শশিভূষণকে বললেন, এখানে যে খ্রিস্টানি ঢুকিয়েছে গো!

শশিভূষণ বুঝতে না পেরে ভুরু তুললেন।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বাইবেলে আছে না, যিশুর জন্মের সময় আকাশের একটি নতুন তারা দেখে তিনজন জ্ঞানী লোক ভগবানের বাচ্চা জন্মেছে মনে করে খুঁজতে খুঁজতে এল? এও ঠিক তেমন ধারাটি নয়? নিমাই জন্মাবার সময় কেউ কি ঘুণাক্ষরেও জানত, সে ভবিষ্যতে এক কেউকেটা মহাপুরুষ হবে? অনেকদিন পর্যন্ত ওই শচীর ব্যাটা তো ছিল একটা বয়াটে ছোঁড়া! গিরিশ এখানে কটা দাড়িওয়ালা ঋষিকে আমদানি করল কোথা থেকে?

মহেন্দ্রলাল আস্তে আস্তে কথা বলতে জানেন না। তাঁর ফিসফিসানি আশেপাশের অনেকে শুনতে পাচ্ছে। কয়েকজন বিরক্ত হয়ে এদিকে ফিরে তাকাল, মহেন্দ্রলালের ভ্রুক্ষেপ নেই।

যে দৃশ্য দেখে মহেন্দ্রলাল এইসব উক্তি করলেন, সেই দৃশ্য দর্শনেই রামকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ অন্যরকম। সাধারণ অভিনেতারা মুনি-ঋষি সেজেছে, তাদের দেখেই ভক্তিভাব বিভোর হয়ে গেলেন। গান শুনতে শুনতে তার চোখ বুজে আসছে, শরীর দুলছে, তিনি সরে যাচ্ছেন বাস্তবতা থেকে, হঠাৎ বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে তিনি সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।

থিয়েটার দেখার তাঁর এত আগ্রহ, তবু তিনি সব দেখতে পাবেন না ভেবে এক অর্বাচীন শিষ্য দিয়ে তাকে জাগিয়ে দিতে গেল, মাস্টার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরে নিষেধ করলেন ; কোনও কারণেই সাধকদের কখনও সমাধি ভঙ্গ করাতে নেই।

প্রথম বিনোদিনীকে দেখা গেল কিশোর নিমাই বেশে। যারা অন্য অনেক নাটকে বিনোদিনীকে বহুবার দেখেছে, তারাও চিনতে পারল না। শুধু রূপসজ্জার কৌশলের জন্যই নয়, এ যেন অন্য বিনোদিনী। যে বিনোদিনীকে রঙ্গিনী, নৃত্যগীত পটিয়সী হিসেবে সবাই জানে, সেই বিনোদিনীর পরিচয়টা মুছে ফেলার জন্য সে রীতিমতন সাধনা করেছে। সে এখন শ্ৰীচৈতন্যভাবে ভাবিতা, অভিনয়ের দিন ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করে আসে, তারপর সারাদিন আর কারুর সঙ্গে দেখা করে না, একাগ্ৰচিত্তে শুধু শ্ৰীগৌরাঙ্গের ধ্যান করে। গিরিশচন্দ্রের কাছে জেদ করে সে পুরুষের ভূমিকা নিয়েছে। শুধু রূপের চটক দিয়ে নয়, অভিনয় কলাগুণে দর্শকদের মন জয় করতে হবে। বনবিহারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথাটাও বিনোদিনীর মনের এক কোণে বাসা বেঁধে আছে। এই নাটকে বনবিহারীও পুরুষ সেজেছে, সে নিত্যানন্দ। কিন্তু বিনোদিনীর পাশে সে এবার দাঁড়াতেই পারছে না।

বিনোদিনীকে অবশ্য নাট্যকারই জিতিয়ে দিয়েছেন। প্রথম থেকেই সে ঈশ্বরের অবতার। অধিকাংশ দর্শকের মন তাতেই দ্রব হয়ে গেছে। খ্রিস্টান মিশনারী ও নব্য খ্রিস্টানদের হিন্দু ধর্মের প্রতি কুৎসা-বিদ্রূপ, ব্ৰাহ্মদের খ্রিস্টান তোষন, তরুন শিক্ষিত সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করে নাস্তিকতার আস্ফালন শুরু করায় সাধারণ হিন্দুরা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, প্রকাশ্যে নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে সঙ্কোচ বোধ করত, আজ তারা মঞ্চের চোখ-ধাঁধানো আলোয় দাপটের সঙ্গে হিন্দুত্বের জয়জয়কার দেখে যেন নব বলে বলীয়ান হয়ে উঠল। মুহুমূৰ্হ জয়ধ্বনি। মঞ্চে যেন সত্যিই শ্ৰীগৌরাঙ্গকে প্রত্যক্ষ করছে সবাই।

সাধারণ দর্শক ছাড়াও আরও অনেকে মুগ্ধ। কর্নেল আলকট তাঁর পার্শ্ববর্তী ফাদার লাফোঁকে বললেন, অতি বিস্ময়কর। আমি এতখানি নিপুণ অভিনয়-কৃতিত্ব আশা করিনি। আমি বিলাতে প্রখ্যাত অভিনেত্রী এলেন টেরির ডেসডিমোনা ও পোর্শিয়ার ভূমিকায় অভিনয় দেখেছি, সেই তুলনায় এই বাঙালি অভিনেত্রীটি কোনও অংশে কম নয়। ফাদার লাঁফো চুপ করে রইলেন, তার চক্ষু দুটি এখন মে বেশি উজ্জ্বল। তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক, হিন্দু অধ্যাত্মবাদ নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তিনি ভারতপ্রেমিক, ভারতীয়দের কোনওরকম কৃতিত্ব দেখলেই তিনি আনন্দবোধ করেন। থিয়েটার পরিচালনায় বাঙালিরা যে ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতন কৃতিত্ব অর্জন করেছে, এতেই তিনি গর্ব বোধ করছেন।

রামকৃষ্ণ আবার বাস্তবে ফিরে এসেছেন, সংগ্রহে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখছেন। এখন নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে নিমাইয়ের সেই পূজার নৈবেদ্য কেড়ে খাওয়ার দৃশ্য। বহু নারী-পুরুষ ভক্তিভরে পূজা দিতে বসেছে, দুরন্ত কিশোর নিমাই ঠাকুর দেবতা মানে না, তার খিদে পেয়েছে, সে নৈবেদ্য তছনছ করে, নাড়ু-বাতাসা তুলে তুলে খাচ্ছে। ক্রুদ্ধ ব্ৰাহ্মণরা শাপমন্যি করছে তাকে। এক ব্ৰাহ্মণ বলল, ওরে বেল্লিক, সর্বনাশ হবে তোর! ওসব গ্রাহ্য করে না, তার পেট ভরে গেছে। সে এখন চলে যাচ্ছে। কিন্তু নিমাই চলে গেলে যে সব কিছুই বিরস হয়ে যায়। সেই যে সব দৃশ্যের নায়ক। গঙ্গার ঘাটের স্ত্রীলোকেরা এত দুষ্টামি সত্ত্বেও নিমাইকে ভালোবাসে, তারা ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, ফিরে আয়, নিমাই ফিরে আয়!

তবু নিমাই ফিরছে না। সে বুড়ো আঙুল তুলে কলা দেখাচ্ছে।

একটি রমণী জানত নিমাইকে ফেরাবার মহামন্ত্র। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, হরিবোল, হরিবোল

অমনি নিমাই ফিরে দাঁড়াল। সে দু হাত তুলে গাইতে লাগল হরিবোল, হরিবোল…। সঙ্গীত পরিচালক বেণীমাধব অধিকারী উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে ঢালা ঢালা চোখ করে সব দেখছেন। এই সময় নির্দেশে বাজনাদাররা মৃদঙ্গ, খোল-করতালের বাজনা শুরু করে দিল। এই বিনোদিনী নাচবে, কিন্তু এ নাচ একেবারে অন্যরকম, অন্য নাটকের রঙ্গিলা নাচের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, বিনোদিনীর শরীরের রমণীত্বও যেন একেবারে মুছে গেছে।

রামকৃষ্ণর চক্ষু ছলছল করছে, তিনি বারবার বলতে লাগলেন, আহা, আহা।

মাস্টারও আহা আহা করতে লাগলেন। অন্য একজন ভক্ত বেশ জোরে জোরে কেঁদে উঠল। পাশের বক্স থেকে এক মদ্যপায়ী বাবু হেঁকে বলল, সাইলেন্স! গান শুনতে দাও। ওফ, বড্ড মজিয়েছে!

রামকৃষ্ণর চক্ষে আবার ঘোর লেগেছে। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়লেন। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছেন। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ। যদি আমার ভাব কি সমাধি হয়, তোমরা গোলমাল করো না। ঐহিকেরা ঢং মনে করবে!

নীচের তলায় মহেন্দ্রলাল ওষ্ঠ উল্টে শশিভূষণকে বললেন, এ আবার কী মড়াকান্না শুরু হল হ্যাঁ? দিব্যি জন্মেছিল। হরিবোল, হরিবোল, এর মধ্যে হরি এল কোথা থেকে? রাত্তির বেলা যারা মড়া নিয়ে যায়, তারা হরিবোল বলে অ্যায়সা চ্যাঁচায়, আমার ঘুম ভেঙে যায়! এদের হরি নামের ভগবানটা কি কানে কালা?

শশিভূষণ নাট্যরসে নিমজ্জিত হয়ে এই গান ও নাচ বেশ উপভোগই করছিলেন, মহেন্দ্রলালের কথা শুনে হাসতে লাগলেন।

মহেন্দ্রলাল আবার বললেন, নিমাই, যাকে এখন সবাই চৈতন্য বলে, সে তোক অক্ষরটা শুনলেই কৃষ্ণের কথা ভেবে পাগল হত, তাই না? সেই কৃষ্ণ ব্যাটা ছিল রসিক নাগর, গোপীদের নিয়ে কত লীলেই না করেছে। সে খুব একটা মন্দ না। কিন্তু হরি? শুনলেই মনে হয় রান্নার ঠাকুর। সাধে কি আর সাহেবরা হরিবোল শুনলেই বলে হরিবল!

শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভালো লাগছে না? সবটা দেখবেন না?

মহেন্দ্রলাল বললেন, আলবত দেখব। আমি কোনও কিছুরই শেষ না দেখে ছাড়ি না! যে সব দর্শক আগে এই নাটক দু-তিনবার দেখেছে, তারা গানের সঙ্গে গলা মেলাতে লাগল। হঠাৎ একজন দর্শক চেয়ারের ওপর দাড়িয়ে উঠে নেচে ওই গান গাইতে শুরু করে দিল।

মহেন্দ্রলাল বললেন, আ মোলো যা! এটা আবার কোন ভূত ও মদ খেয়ে চুর চুর হয়েছে, এটাকে দূর করে দিচ্ছে না কেন?

পেছন থেকে একজন দর্শক বলল, ছি, ছি, কী বলছেন মশাই? উনি পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী!

মহেন্দ্রলাল বললেন, পূজ্যপাদ হোক বা আরও বড় কোনও বাতকর্ম হোক, লোকটা কে?

সেই দর্শকটি বলল, আপনি ওঁর নাম শোনেননি? উনি ব্ৰাহ্মদের একজন প্রসিদ্ধ নেতা।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বেম্মোজ্ঞানী! তারা তো নিরাকার নিয়ে লাফালাফি করে, এখানে হরি হরি বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ভাসাচ্ছে কেন?

অন্য একজন দর্শক বলল, বুঝলেন না দাদা, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে যারা চলে গিয়েছিল, সবাইকেই আবার ফিরতে হবে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, যারা খ্রিস্টান, মুসলমান হয়েছে, তারাও ফিরবে? ফিরতে চাইলেও তাদের মেনে নিতে পারবে হিন্দুরা? হ্যাঁ, যত্ত সব আজগুবি কথা!

শশিভূষণ হেসেই চলেছেন। তার দিকে ফিরে মহেন্দ্রলাল রাগত স্বরে বললেন, তুমি তখন থেকে শুধু হেসে যাচ্ছ কেন হে ছোকরা?

শশিভূষণ বললেন, এত আনন্দ পাওয়া কি সহজে মানুষের ভাগ্যে ঘটে? একদিকে দেখছি গিরিশবাবুর নাটক, আর একদিকে দেখছি আপনার নাটক। একসঙ্গে দুশো মজা!

একটি অঙ্কের পর পর্দা পড়ে গেছে। চানাচুর ও কুলপি-মালাইয়ের ফেরিওয়ালারা হল্লা শুরু করেছে। ভেতরে। থিয়েটারের একজন কর্ম মহেন্দ্রলালের পাশে এসে বেশ উত্তেজিত কিন্তু বিনীতভাবে বলল, ডাক্তারবাবু, একটু গ্রিনরুমে আসবেন। খুব জরুরি ব্যাপার।

মহেন্দ্রলাল উঠে পড়লেন।

গ্রিনরুমের দিকে এগোতে এগোতে লোকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে বলতে লাগল, বিনোদ অজ্ঞান হয়ে গেছে, ডাক্তারবাবু। আপনি যে কোনও উপায়ে তাকে চাঙ্গা করে তুলুন, নইলে প্লে বন্ধ হয়ে যাবে!

মহেন্দ্রলাল বললেন, মুশকিল করলে, আমি কি ওষুধের বাক্স সঙ্গে এনেছি? রাত্তির এগারোটার সময় কোনও দোকানও তো খোলা থাকবে না। চল গে দেখি!

মঞ্চের পেছন দিকে এক জায়গায় সমস্ত অভিনেতা ও নেপথ্য শিল্পীদের ভিড় জমে গেছে, সকলেরই মুখে দারুণ উদ্বেগের চিহ্ন। নাটক যেরকম তুঙ্গে উঠে আসে, এই অবস্থায় অভিনয় বন্ধ করে দিতে হলে দর্শকদের ক্ষেপে ওঠা স্বাভাবিক। আগের গান ও নাচের পর টলতে টলতে উইংসের এ পাশে এসেই বিনোদিনী দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে প্রায় একাই টেনে নিয়ে যেতে হয়, তার পরিশ্রম কম নয়। এই সঙ্কটে গিরিশবাবুও আবার উপস্থিত নেই।

ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে মহেন্দ্রলাল দেখলেন, এক দীর্ঘদেহী আলখাল্লা পরা পাদ্রি বিনোদিনীর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছেন। ইনিই ফাদার লাফোঁ, মহেন্দ্রলালের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে, মহেন্দ্রলালের দিকে চোখ তুলে তিনি একটা ইঙ্গিত করলেন। বিনোদিনীর মাথার চুল খুলে গেছে, গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুল, এখন আর তাকে পুরুষ বলে মনে হয় না। চক্ষু দুটি নিমিলিত, ওষ্ঠ অল্প অল্প কাঁপছে। ফাদার লাফোঁ লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে বিনোদিনীর মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন। একজনকে বললেন এক গেলাস জল আনতে।

মহেন্দ্রলাল বুঝলেন, আর বিশেষ কিছু করার দরকার নেই। বিনোদিনী অতিরিক্ত আবেগ সামলাতে পারেনি, একটু পরেই ধাতস্থ হয়ে যাবে। ফাদার লাফোঁ ঠিকই বুঝেছেন।

বিনোদিনী ফিসফিস করে বলতে লাগল, হা কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ।

এই দৃশ্যটিতে মহেন্দ্রলাল বেশ কৌতুক বোধ করলেন। এক রূপসী বারবনিতা শুয়ে আছে পা ছড়িয়ে, তার মুখখানা এমনই তীব্রতায় ক্লিষ্ট, যেন সে সত্যিই কৃষ্ণ উন্মাদিনী রাধা, কিংবা স্বয়ং শ্ৰীগৌরাঙ্গ। তার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে এক খ্রিস্টান সাধু। কৃষ্ণনাম বলতে বলতে চোখ মেলে বিনোদিনী প্রথমে দেখতে পাবে এক শ্বেতাঙ্গ দাড়িওয়ালা পুরুষকে।

তিনি ফিরে গিয়ে নিজের আসনে বসলেন, শশিভূষণ ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? কী হয়েছে ভেতরে?

মহেন্দ্রলাল বললেন, নটী-নটীরা স্টেজের ওপর রাজা-রানী, স্বর্গের দেবদেবী সাজে। কিন্তু মুখস্থ কথা বলতে বলতে তারা যদি নিজেদেরও রাজা-রানী, দেবদেবী ভাবতে শুরু করে, তা হলেই তো চিত্তির। ওরা যে আসলে ভজা-গজা, টেঁপি খাদি তা ভুলে গেলে শেখানো বুলি ঠিকঠাক বলবে কী করে। এখানে সবই তো নকল!

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের এর মধ্যে দু-তিনবার ভাবসমাধি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখছেন, আবার এক একবার বুজে যাচ্ছে চক্ষু। বিশেষত গানগুলি শুনলেই রোমাঞ্চ হচ্ছে তাঁর সর্বাঙ্গে, তিনি সঙ্গীতপ্রিয়, উচ্চ ভাবের গান শুনলে তার আবেশ আসে। আবার শুরু হয়েছে অভিনয়, নিমাইয়ের গৃহত্যাগ আসন্ন, তার এখন পাগল পাগল দশা, কৃষ্ণনাম শুনলেই তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে, শচীমাতাও পুত্রের এই দশা দেখে কান্নাকাটি করছেন। শ্ৰীবাস এসেছেন বাড়িতে, তাকে দেখে নিমাই ছুটে গিয়ে গান গেয়ে উঠল :

কই প্ৰভু কই কৃষ্ণ ভক্তি হল
অধম জনম বৃথা কেটে গেলে
বল প্ৰভু, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কোথা পাব…

এই গান শুনে রামকৃষ্ণ আরও আন্দোলিত হয়ে উঠলেন। মাস্টারের দিকে ফিরে বলতে গেলেন কিছু, কিন্তু শব্দ বেরুচ্ছে না, আবেগে তাঁর স্বর বুজে যাচ্ছে। চক্ষু দিয়ে অনবরত গড়াচ্ছে অশ্রু, উনি মোছার চেষ্টাও করছেন না, গণ্ডদেশ নয়নজলে ভাসছে।

এবারে তাঁর সমাধি হল না বটে, কিন্তু এরপর নিতাইয়ের সঙ্গে মিলনদৃশ্যে যখন গৌরাঙ্গ সম্পূৰ্ণ ঈশ্বর আবিষ্ট হয়ে ঘোরের মধ্যে কথা বলছে, শ্ৰীবাস ষড়ভুজ দর্শন করে স্তব করছে, তখন রামকৃষ্ণ ঠাকুরও মানসনেত্রে ভগবানের মূর্তি দেখতে পেলেন। নিতাই গান গেয়ে উঠল :

কই কৃষ্ণ এল কুঞ্জে প্রাণ সাই!
দে রে কৃষ্ণ দে, কৃষ্ণ এনে দে, রাধা জানে
কি গো কৃষ্ণ বই!

রামকৃষ্ণ ঠাকুর আর বাস্তবে থাকতে পারলেন না, চক্ষু মুদে আবার চলে গেলেন ভাবজগতে।

অন্যান্য নাটকে অভিনয়ের তুঙ্গ মুহূর্তে দর্শকরা চটাপট চটাপট শব্দে হাততালি দেয়। থিয়েটারের ভাষায় যাকে বলে ক্ল্যাপ, কোন অভিনেতা বা এক রাত্রির অভিনয়ে কতবার ক্ল্যাপ পেল, তা দিয়ে তার জনপ্রিয়তা যাচাই হয়। কিন্তু এই নাটকে দর্শকরা যেন ক্ল্যাপ দিতে ভুলে গেল, তারা ঘন ঘন অহো, আহো, আহা আহা ধ্বনি দিচ্ছে, কান্নার ফোসফোঁসানি শোনা যাচ্ছে, যারা রুমাল এনেছে সব এতক্ষণে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

এই নাটকে যা কিছু দেখছে, তা অধিকাংশ দর্শকের কাছেই অভিনব। চৈতন্যদেবের সম্পূর্ণ জীবনকাহিনী অনেকের কাছেই অজানা। বহুদিনের অশিক্ষায় হিন্দুদের অতীত অস্পষ্ট, নিছক কিছু গাল-গল্প ছাড়া ইতিহাস কিংবা উচ্চাঙ্গের দর্শন সম্পর্কে অধিকাংশেরই কোনও ধারণা নেই। বেশির ভাগ হিন্দুই বেদ-উপনিষদ। কখনও চক্ষে দেখেনি, গীতা গ্রন্থাকারে পাওয়াই যায় না প্রায়। গিরিশ ঘোষের ভক্তিরসের নাটকগুলি যেন তাদের অতীত গৌরবের এক একটা অধ্যায় তুলে ধরছে। যেন একটা আবিষ্কারের আনন্দে সকলে বিহ্বল!

মহেন্দ্রলাল শশিভূষণকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ গো, এই কেষ্ট নামের লোকটার দেখা পাবার জন্য এই নাটকে সবাই এমন হেদিয়ে মরছে কেন? ওই নাম শুনে এত হাপুস হুপুস কান্নার কী আছে?

শশিভূষণ খুকখুক করে হেসে বললেন, কেষ্ট নামের লোকটা? সবাই যে তাঁকে ভগবান বলে মানে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, ঠিক আছে, ধরা গেল, সে একখানা বেশ জাঁহাবাজ ধরনের ভগবান। ষোলো হাজার গোপিনীর সঙ্গে লীলেখেলা করলেও সে ভগবান। বেশ। কিন্তু তার দেখা পাবার জন্য এমন আকুলি-বিকুলি কেন, দেখা পেলে কী এমন হাতি-ঘোড়া হবে? কেষ্টর দেখা পেলে ওই লোকগুলোর পাগলামির অসুখ সেরে যাবে, মাগ-ছেলে।পুলের খাওয়া পরার সমস্যা ঘুচবে?

শশিভূষণ বললেন, আপনার এ তো সংসারী লোকের মতন কথা। এখানে তো বৈরাগ্য। আর ঈশ্বর সান্নিধ্যের ব্যাকুলতার ছবি আঁকছেন গিরিশবাবু!

মহেন্দ্রলাল ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শকদের একবার দেখে নিয়ে বললেন, বৈরাগ্য না কচু! এই যে লোকগুলো দেখছে, এরা একটা ভিখিরিকে একটাও পয়সা না দিয়ে যা যা ব্যাটা বলে খ্যাঁকাবে। বাড়িতে ঝি-চাকরীদের কুকুর-বেড়ালের মতন লাথি-ঝাঁটা মারবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে এক ছটাক জমির জন্য লাঠালাঠি করবে। আর এখানে বৈরাগ্যের কথা শুনে কেঁদে ভাসিয়ে সব ধুলো কাদা করে দিল গা। ভণ্ডামি আর কাকে বলে!

শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি এই নাটক একটুও ভালো লাগছে না?

মহেন্দ্রলাল নাক চুলকোতে লাগলেন। তারপর খানিকটা লাজুকভাবে বললেন, গানগুলি বড় খাসা। বিনোদিনী মেয়েটা মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছে, তা স্বীকার করতেই হবে। এটা হচ্ছে আর্ট। জান শশী, আমি ঠাকুর-দেবতা গ্রাহ্য করি না, ধম্মের ন্যাকামি শুনলে আমার গা গুলোয়, তবু কী জান, যদি ভালো গান শুনি, তার মধ্যে ঠাকুর দেবতার কথা থাক বা নাই থাক, আমার বুক মুচড়োয়। গিরিশ বড্ড জমিয়েছে গো!

নাটক শেষ হবার পর রঙ্গালয়ে তুমুল শোরগোল পড়ে গেল। দর্শকরা কেউ আর বেরুতেই চায় না। “হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়, আমি তবে একা দাও। হে দেখা, প্ৰাণ সখা রাখো পায়’, এই গানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল, উন্মাদিনীর মতন বিনোদিনীর নৃত্য যেন একটা ঝড় তুলে দিয়েছে, তার রেশ পর্দা পড়ার পরেও মিলিয়ে যায়নি। সবাই বিনোদিনীকে আবার দেখতে চায়।

বিনোদিনীর জন্য দু দুবার ড্রপসিন তোলা হয়েছে, সে মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তবু দর্শকদের তৃপ্তি নেই, তারা চিৎকার করতে লাগল, এনকোর, এনকোর! বিনোদিনী খুবই পরিশ্রান্ত, তার পক্ষে আর দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

সবাই মিলে যাতে মঞ্চ পশ্চাতে হুড়মুড় করে ঢুকে না পড়ে, সেই জন্য পাহারাদাররা সিঁড়ির কাছে বেষ্টনী করে আছে। কিন্তু কিছু কিছু বিশিষ্ট লোককে যেতে দিতেই হয়, রাজা-মহারাজ কিংবা শহরের বড় বড় ধনী ব্যক্তিদের খাতির না করলে থিয়েটার চালানো যায় না, এবং এই সব ব্যক্তিরাও থিয়েটার দেখে চুপচাপ চলে যাবার পাত্র নন, নিজেদের উপস্থিতি জাহির করবেন অবশ্যই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, কয়েকজন মহামহোপাধ্যায়, নবদ্বীপের ন্যাড়ামাথা, কপালে ফোঁটা ফোটা কাটা গায়ে নামাবলি জড়ানো টিকিধারী বৈষ্ণব নেতারাও বিনোদিনীকে আশীৰ্বাদ জানাবার জন্য ব্যাকুল, তাদেরও পথ ছাড়তে হয়।

দোতালার অন্য সব বাক্স খালি হয়ে গেলেও রামকৃষ্ণ ঠাকুর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাঁর ঘোর কাটছে না। ভক্তরা ডাকতে সাহস পাচ্ছে না। তাঁকে, তারা ফিসফিস করে কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দু চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু।

একটু পরে তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, গৌর হরি, গৌর হরি!

একজন ভক্ত বলল, এবার যে বাড়ি যেতে হয়।

রামকৃষ্ণ বললেন, শ্ৰীগৌরাঙ্গ! আমি শ্ৰীগৌরাঙ্গের কাছে যাব!

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আবার বললেন, ওগো, আমাকে গৌরাঙ্গের কাছে নিয়ে চল—।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সবাই নামছে, এখনও যেন প্রত্যক্ষ জগতে পুরোপুরি ফেরেননি, তাঁর মুখে গভীর তন্ময়তা। তাঁর শরীর ঈষৎ দুলছে। নীচে এসে তিনি হন হন করে এগিয়ে যেতে লাগলেন মঞ্চের দিকে, বেশ জোরে জোরে বলতে লাগলেন, গৌর হরি, গৌর হরি। ভক্তরা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল পেছন দিকে, পাহারাদাররা তাকে না চিনেও সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল।

অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিনোদিনীকে ঘিরে থাকলেও অমৃতলাল বসু বসে আছেন একটু দূরে। এই নাটকে তাঁর দুটি ছোট ভূমিকা। যবনিকা পতনের পরই তিনি মদের বোতল খুলে ফেলেছেন। অন্যান্য নাটকের বেলায় অভিনয় শেষে তিনি আর গিরিশ বিনোদিনীর বাড়িতে গিয়ে বিয়ার ব্র্যান্ডি পান করতে করতে আড্ডা জমাতেন, কিন্তু ‘চৈতন্যলীলা’ শুরু হবার পর বিনোদিনীর বেশ পরিবর্তন ঘটে গেছে, সে আর নিজের বাসস্থানে মদের আসর বসাতে চায় না। আজ গিরিশও নেই এখানে, সুতরাং সুরাপাত্র হাতে অমৃতলাল নিজেই নিজের সঙ্গী।

গিরিশ অনুপস্থিত বলে অনেক অসুবিধে হচ্ছে। হোমরাচোমরা ব্যক্তিরা তাঁর খোঁজ করছে তো বটেই, তা ছাড়া এঁদের সঙ্গে উপযুক্তভাবে কথাবার্তাই বা বলবে কে? বিনোদিনীর মুখ দিয়ে কথা সরছে না। অমৃতলাল সব দিক সামাল দিতে পারেন।

একজন অমৃতলালকে ডাকতে এলে তিনি ধমকে উঠে বললেন, যা যা, আমাকে বিরক্ত করিস না। থিয়েটারের মেয়েগুলো সব বেশ্যা, আর নটগুলো বিশ্ব বখাটে, দুশ্চরিত্র, তাই না! এতদিন তো ওরা এই কথাই বলে এসেছে। এখন বুঝুক শালারা! দেখুক, এই বেশ্যা আর বখাটেরাই মানুষকে মাতাতে পারে। আমরা আজ এত লোককে কাঁদিয়ে ছেড়েছি! একদিন দেখবি, জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে আমরা এই চৈতন্যলীলা পালা করব, সারা দেশকে কাঁদাব, কাঁদতে কাঁদতে দেশের মানুষ জাগবে, নিজেদের চিনবে।

লোকটি বলল, দক্ষিণেশ্বরের কালীসাধক ঠাকুর এসেছেন, তাকে একবার দর্শন করতে যাবেন না।

অমৃতলাল বললেন, আমার কিসের দায় রে ব্যাটা? আমি কোনও ঠাকুরমাকুরের ভক্ত নই। এসেছেন তো আমার কী? আমি মাতাল, সমাজের বার, লক্ষ্মীছাড়া, কালীসাধকের সামনে আমি যেতে যাব কেন?

এদিকে রামকৃষ্ণ ঠাকুর এক সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করে ফেলেছেন। তিনি গৌরহরি গৌরহরি বলতে বলতে প্রায় ছুটে এসেছেন বিনোদিনীর কাছে। বিনোদিনী একটা টুলে বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করল। সে অশুচি বারবনিতা, একজন সাধকের পা স্পর্শ করে প্রণামের অধিকার তার নেই। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দৃষ্টি এখনও আচ্ছন্ন, তিনি কান্নামিশ্ৰিত গলায় গৌরাঙ্গের নাম উচ্চারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিনোদিনীর পায়ের ওপর।

উপস্থিত সবাই ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। রামকৃষ্ণের পার্ষদদেরও আর সহ্য হল না। যিনি পরমহংস, তিনি নিজের পিতা-মাতারও পদস্পর্শ করেন না, তিনি এক চরিত্রহীনা নারীর পা ছুলেন। ভক্তরা সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল, ধমকের সুরে বলল, ঠাকুর, এ কী করছেন!

এতগুলি মানুষের হাতের স্পর্শে রামকৃষ্ণের বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল পুরোপুরি। তিনি দেখলেন, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে শ্ৰীচৈতন্য নয়, একজন নারী। এখন তার মাথার চুল খোলা, মুখে রঙ মাখা, ভুরুতে মাখা কাজল ঘামে একটু একটু গলে গেছে।

পাপের ভয়ে বিনোদিনী কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতেই বলল, প্ৰভু, আমায় আশীৰ্বাদ করবেন না?

রামকৃষ্ণ এবার তার মাথায় দু হাত রেখে বললেন, মা, তোমার চৈতন্য হোক! তার পরই তিনি প্রস্থানের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

একজন জিজ্ঞেস করল, আজকের নাটক কেমন দেখলেন? রামকৃষ্ণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গলায় হাসতে হাসলে বললেন, আসল নকল এক দেখলাম!

মহেন্দ্রলাল জানতেন না গিরিশচন্দ্র অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছেন। গিরিশের খোজে মঞ্চের পেছনে এসে রামকৃষ্ণ-বিনোদিনী দৃশ্যটি দেখলেন তিনি। রামকৃষ্ণ সদলবলে নেমে যাবার সময় তিনি ও শশিভূষণ রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন।

শশিভূষণ বললেন, ইনি দক্ষিণেশ্বরের সেই কালীসাধক রামকৃষ্ণ।

মহেন্দ্রলাল বললেন, হু।

শশিভূষণ বললেন, আমি আগে কখনও দেখিনি। কেউ কেউ এঁকে অবতার বলতে শুরু করেছে।

মহেন্দ্র বললেন, আমি অবতার-টবতার বুঝি না। মানুষ কখনও অবতার হতে পারে। মানুষ মায়ের পেটে যারা জন্মায়, তারা মানুষই। মানুষেরই মতন তাদের সুখ-সম্ভোগ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগ-ভোগের কষ্ট থাকতে বাধ্য। তবে এ কথাও ঠিক, মুখখানি দেখে মনে হল, ইনি ঠিক আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতন নন। অসাধারণ যে, তা মানতেই হবে।

তারপর তিনি বিনোদিনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, খুব ভালো করেছ। আজ, তুমি খুব বড় আর্টিস্ট। গিরিশ তোমায় সার্থক গড়েছে। তবে, কাল থেকে স্টেজে নামার পর তুমি নিজেকে নদীয়ার নিমাই বলে ভেব না, সব সময় মনে রাখবে, তুমি বিনোদিনী দাসী, তুমি অভিনয় করছ। তা হলে তোমার দম ফুরবে না, হঠাৎ অজ্ঞান হয়েও যাবে না।

একটু আগে একজন বড় সাধকের আশীর্বাদে বিনোদিনী হয়ে মোহিত আছে। ডাক্তারের কথাগুলি তার পছন্দ হল না, সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *