1 of 2

৩৬. কাদম্বরীর শয়নকক্ষে দরজার পিছন দিকে

কাদম্বরীর শয়নকক্ষে দরজার পিছন দিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আয়না লাগানো আছে। অতি মূল্যবান বেলজিয়ান গ্লাস। দরজাটি খোলা থাকলে এ আয়না দেখা যায় না। আবার দরজা বন্ধ করলে, ঘরের মধ্যে একজন মানুষ দু’জন হয়ে যায়।

সদ্য স্নান সেরে এসে সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন কাদম্বরী, গান গাইছেন গুনগুনিয়ে। আজ তাঁর মনে বেশ একটা লঘু প্ৰসন্নতা ছড়িয়ে আছে। সারা সকাল তিনি বই পড়েছেন। আজ তাঁকে বই পড়ার নেশায় পেয়ে বসেছিল, সময় জ্ঞান ছিল না, এক সময় হঠাৎ খেয়াল হল যে মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে। তাঁর দাসী এসে স্নানের তাড়া দিয়ে গেছে দু’বার। কাদম্বরী একতলায় মেয়েদের স্নানের ঘরে যান না, তিনতলায় তাঁর মহলেই স্নানের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, ভৃত্যেরা কয়েক ঘড়া জল তুলে দিয়ে যায়।

কাদম্বরী শুধু একটা জাম রঙের শাড়ি পরে আছেন, মাথার চুলে একটি বেশ বড় আকারের চিরুনি। যশোর থেকে তার বাপের বাড়ির একজন এনে দিয়েছে। যশোরে এটাকে বলে কাকুই, এখানে সবাই বলে চিরুনী। কাদম্বরী বিয়ের পর প্রথম প্রথম কাঁকুই বলে ফেলতেন, তা শুনে এ বাড়ির অনেকেই হাসত। তাঁর স্বামী অবশ্য বলতেন, এতে হাসির কিছু নেই, সংস্কৃতে কঙ্কতিকা, তার থেকে কাঁকুই। চিরুনিটাই গ্রাম্য লোকদের বানানো। তাঁর বিদ্বান স্বামী সে সময় কত কিছু শেখাতেন তাঁকে!

আয়নার ভেতরের কাদম্বরী দেখছেন মানুষ কাদম্বরীকে।

অনেকদিন পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করছেন, মুছে গেছে চোখের নীচের কালিমা, ত্বকে এসেছে মসৃণ ঔজ্জ্বল্য। অসুখ আর অসুখ, ভালো লাগে না! খুব যত্ন করে সাজগোজ করতে হবে।

বাইরে থেকে তার নিজস্ব দাসী জিজ্ঞেস করল, বউদিদিমণি, ঠাকুররা এয়েছে, ক’জনের খাবার রাখব!

ঠিক বেলা একটার সময় ঠাকুররা আসে। বার মহলের প্রকাণ্ড রান্নাঘরে দশ-বারোজন ঠাকুর সকাল থেকে রান্নার কাজে লেগে যায়। প্রতিদিনই যেন যজ্ঞি বাড়ির রান্না। বিভিন্ন উনুনে ভাত, ডাল ও পঞ্চ ব্যঞ্জন চাপে। মেঝেতে ফর্সা কাপড় পেতে ঢালা হয় ভাত। ক্রমশ তৈরি হয় এক ভাতের পাহাড়। মাছ ভাজা হয় শয়ে শয়ে। কর্তাদের এক একজনের বিশেষ অভিরুচি অনুযায়ী ঝোল ও কালিয়া-কোপ্তা। কোন মহলে কতজন মানুষ তার হিসেব রাখে ঠাকুররা, সেই অনুযায়ী শ্বেতপাথরের থালা ও বাটিতে ভাত-ডাল-তরকারি সাজিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে দিয়ে আসা হয় ঘরে ঘরে। এ ছাড়াও প্রত্যেক মহলে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা আছে, গৃহিণীরা নিজেদের শখ ও মর্জিমতন বিশেষ কিছু রান্না করে নেন।

দিনের বেলা ভাত, রত্তির বেলা লুচি। কাদম্বরীর মহলে কাল রাত্রে ঠাকুররা যে লুচি তরকারি দিয়ে গিয়েছিল, তা অভুক্ত হয়ে পড়ে আছে। অনেক দিন কাদম্বরী নিজেও কিছু রান্না করেননি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবি, দু’জনেই ভোজনরসিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকলে দু’চারজন বন্ধুকেও খাওয়ার নেমন্তন্ন করবেনই, তখন কাদম্বরী কোমরে আঁচল জড়িয়ে নিত্যনতুন পদ রান্না করতে লেগে যান, রাঁধতে তাঁর ভালোও লাগে। অনেক দিন সে রকম কিছু হয় না।

কিছুদিন আগেও প্রতিদিন সকালে ভাঁড়ার ঘরের সামনের বড় বারান্দাটাতে কুটনো কোটার আসর বসত। এ বাড়ির সমস্ত বউ ও মেয়েরা এক একখানা বঁটি নিয়ে বসে যেত আলু-পটল-কুমড়ো নিয়ে। তরকারি কোটার ছলে কত গল্প, কত হাস্য-পরিহাস হত। এখন আর কাদম্বরীর সেখানে ডাক পড়ে না। সেই আসরটাই যেন ভেঙে গেছে, ঘর-জামাইরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে একে একে চলে গেল অন্য বাড়িতে, পুত্রবধূদের মধ্যেও আর তেমন প্রাণের টান নেই। এই যে রবির বিয়ে হল, বাড়িতে একটি নতুন বউ এল, তার সঙ্গে তো অন্য জা-দের ভালো করে পরিচয়ই হল না। জ্ঞানদানন্দিনী তাকে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে রেখে দিলেন সার্কুলার রোডের বাড়িতে, নিজের কাছে।

কাদম্বরীর নিজস্ব পুরনো দাসী সম্প্রতি বিদায় নিয়েছে, নতুনটির নাম হলধরের মা, সে নাম সংক্ষেপ করা হয়েছে হলোর মা। সে এখনও রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হয়নি। ঠাকুরেরা খাবার দিয়ে যাবে, সে রেখে দেবে। জিজ্ঞেস করার কী আছে। যা নষ্ট হবার হবে। এ বাড়িতে কত জনের জন্য রান্না হয়, আর কতজন খায়, তার হিসেব কর্তারাও রাখেন না।

হলোর মায়ের প্রশ্ন শুনে কাদম্বরী অন্যমনস্কভাবে শুধু বললেন, রাখ!

চিরুনির ডগায় সিঁদুর মাখিয়ে সিঁথিতে লাগাতে লাগাতে কাদম্বরী হঠাৎ চক্ষুদুটি ঘুরিয়ে মুচকি হাসলেন। আয়নার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই নানা রকম ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছে যায়। যেবারে তিনি স্বামী ও কনিষ্ঠ দেবরটির সঙ্গে অলীকবাবু নাটকে হেমাঙ্গিনী সেজেছিলেন, তাতে এই রকম একটি ভঙ্গি ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন বলতেন, তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ কিছুক্ষণ পার্ট বলবে, তা হলে দেখবে অভিব্যক্তিগুলো ঠিক হবে। আয়নার সামনে এরকম পার্ট অভ্যেস করার সময় রবি এসে মাঝে মাঝে দাঁড়াত পেছনে। এই চোখ মুখ ঘোরানো ও ওষ্ঠ-টেপা হাসিটি দেখেই সে পরে লিখেছিল: “কটাক্ষে মরিয়া যায়, কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে/হাসিতে হৃদয় জুড়ে, হাসিতে হৃদয় টুটে…”।

এ কথা মনে পড়তেই কাদম্বরীর আরও হাসি পেয়ে গেল। কী ছেলেমানুষই না তখন ছিল রবি। সব সময় ছায়ার মতন লেগে থাকত তাঁর সঙ্গে। কাদম্বরীই মাঝে মাঝে বলতেন, রবি, তুমি ছেলেদের সঙ্গে মেশো না কেন? তোমার বাইরের কোনও বন্ধু নেই?

সেই রবির আর এখন দেখাই পাওয়া যায় না। তার অনেক বন্ধু।

আজ দেখা হবে। অনেক দিন বাদে আজ সবাই মিলে এক সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ করা হবে।

কেশসজ্জা শেষ করে কাদম্বরী দরজা খুলে দেখলেন, হলোর মা এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে সব সময় কিছু না-কিছু কাজ চায়। কিন্তু বাড়ির কর্তা অনুপস্থিত থাকলে তেমন তো কিছু কাজ থাকে না। একজন কেউ কাছাকাছি সব সময় ঘুর ঘুর করবে, এটা কাদম্বরীর পছন্দ নয়। পুরনো দাসীটা তাঁর স্বভাব জানত, সে চুপটি করে বাইরের সিঁড়ির কাছে শুয়ে থাকত। ডাকলেই পাওয়া যেত তাকে, অন্য সময় তার উপস্থিতি টের পাওয়া যেত না।

হলোর মা জিজ্ঞেস করল, বউদিদিমণি, কালকের লুচিগুলো কী হবে?

কাদম্বরী বললেন, কী আর হবে, ফেলে দিবি! ফেলে দিয়ে এঁটো বাসন নীচে দিয়ে আয়।

হলোর মা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ফেলে দেবে কী গো! বাসি লুচি খুব ভালো হয়।

কাদম্বরী বললেন, তুই খাবি? তো খেয়ে নিয়ে যা!

কাদম্বরী বাটির ঢাকনাগুলো তুলে গন্ধ আঁকলেন। নাকটা কুঁচকে বললেন, তরকারিগুলো পচে গেছে, লুচিগুলো দেখ যদি খেতে পারিস।

হলোর মা এমন ব্যগ্রভাবে থালাবাটিগুলো গুছিয়ে কোলে তুলে নিল যে মনে হল সে তরকারিও ফেলবে না। বাইরে গিয়ে সব গপগপ করে খাবে।

কাদম্বরী মাঝে মাঝে ভাবেন, মানুষের উদর কি বিভিন্ন মাপের হয়? দু’খানা লুচি খেলেই তাঁর পেট ভরে যায়, আর হলোর মায়ের মতন অনেকেই দু’দিস্তে লুচি দিব্যি খেয়ে নিতে পারে। এরপর আবার ভাত খাবে। হলোর মা বলে, লুচি কিংবা রুটি খেলে ওদের নাকি পেটই ভরে না, ওগুলো জলখাবার, ভাতই ওদের আসল খাদ্য!

অধিকাংশ রাতে কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। কাদম্বরীর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ না ফিরলে তো তাঁর একার খাওয়ার প্রশ্নই নেই। না খেয়েও তো তার শরীর ভাঙে না!

আজ অবশ্য তাঁর বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। আজ তাঁর মন ভালো আছে, মন ভালো থাকলেই খিদেয় শরীর চনমন করে। ঠাকুররা আজ দিয়ে গেছে ভাত, উচ্ছে-বড়ি ভাজা, কাচা মুগের ডাল, পটল-পোস্ত ছাঁচি কুমড়োর ঘণ্ট, দুটি খুব বড় গলদা চিংড়ি।

মাটিতে আসন পেতে, সামনে জল ছিটিয়ে তারপর থালা-বাটি সাজিয়ে খেতে বসাই ছিল বরাবরের রেওয়াজ। জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত ঘুরে আসার পর টেবিল-চেয়ারে খাওয়ার রীতি প্রবর্তন করেছিলেন নিজের মহলে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও সেটাই পছন্দ। এখন কাদম্বরীও টেবিলেই খেয়ে নেন। আলাদা থালায় দু মুঠো ভাত নিয়ে কাদম্বরী প্রথমে তেতো ও তারপর ডাল দিয়ে মাখলেন, একটুখানি ছাঁচি কুমড়ো দিয়ে দু’গরাস ভাত মুখে দিতেই একটা কথা মনে পড়ে গেল। ও মা, কী ভুল হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর স্বামী বলে গেছেন, আজ রাত্তিরে প্রচুর খানাপিনা আছে, তাঁর স্টিমারে সাহেবি হোটেল থেকে সব কিছু যাবে। দুপুরে বেশি খেয়ে পেট ভরা থাকলে সেসব কোনও কিছুরই স্বাদ নেওয়া হবে না। কাদম্বরী তক্ষুনি উঠে পড়লেন। পেটে খিদে রয়ে গেল, তা থাক, সেই তো ভালো।

এই বড় বড় চিংড়ি মাছ সমেত সব কিছুই হলোর মায়ের ভোগে যাবে। তা যাক, ওরা খেতে ভালোবাসে, খাক না!

কাদম্বরী একটা পান মুখে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

এখানে সারি সারি ফুলের টবে বহুরকম ফুলগাছ। সব কাদম্বরীর নিজের হাতে লাগানো। আগে সন্ধেবেলা এখানে যখন গান-বাজনা ও কাব্য পাঠের আসর বসত, তখন বাইরের অতিথিরা বলত নন্দনকানন।

এত বড় বাড়িতে কিছু না কিছু হইচই লেগেই থাকে সব সময়, আজ যেন নিস্তব্ধ। বড় বেশি নিস্তব্ধ। তার কারণ আছে, গতকাল দেবেন্দ্র-নাথ চুঁচড়ো থেকে এ বাড়িতে এসে রয়েছেন এমন তিনি হঠাৎ হঠাৎ চলে আসেন, খাজাঞ্চিখানার কর্মচারিদের ডাক পড়ে তাঁর ঘরে। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসেব পরীক্ষা করেন। ছেলেদের ওপর সব ভার দেওয়া আছে বটে, তবু তিনি নিজের রাশ আলগা করেননি। হিসেবের ভুল দেখলে তিনি শাস্তি না দিয়ে উপদেশ দেন, সেই উপদেশকেই সবাই বেশি ভয় পায়।

কর্তমশাই বাড়িতে থাকলে কেউ একটু টু শব্দ করতেও সাহস করে না। গোলমাল তিনি সহ্য করতে পারেন না একেবারে। অথচ তাঁর সেবার জন্য নানা রকম ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন কাল সন্ধে থেকে এ বাড়ির একটি বৃহৎ ভাগলপুরি গাভীকে দফায় দফায় গুড় খাওয়ানো হচ্ছে। দেবেন্দ্রনাথের ধারণা, গরুকে অনেকটা গুড় খাওয়ালে তার দুধের স্বাদ সুমিষ্ট হয়। গঙ্গা থেকে টাটকা জল বয়ে আনা হয় তার স্নানের জন্য। জেলেদের খবর দেওয়া হয়েছে কাল রাতে, তারা প্রতিদিন। এমন রুই মাছ ধরে আনবে, যার ওজন তিন সেরের কম নয়, সাড়ে তিন সেরের বেশি হলেও চলবে না, এবং সেই রুই মাছ উঠোন পড়ে লাফাবে। তাঁর সুখসাচ্ছন্দোর ভার তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার ওপর।

ঘরে ফিরে এসে কাদম্বরী পালঙ্কে আধ শোওয়া হয়ে একখানি বই খুললেন। তাঁর স্বামী তাঁকে নিতে আসবেন ঠিক ছাঁটার সময়, এখনও ঢের দেরি আছে।

বইখানি রবির ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অনেক কথা মনে পড়ে গিয়ে কাদম্বরীর হাসি এসে যাচ্ছে। এক একদিন রবিকে রাগিয়ে দিয়ে তিনি বেশ মজা পেতেন। রবি যখন লেখে তখন যেন উদাম এক আবেগে সে ভেসে যায়। চন্দননগরে, সদর স্ট্রিটের বাড়িতে, দাৰ্জিলিঙে যে-কোনও লেখাই কিছুটা লিখে সে নতুন বউঠানকে শোনাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সে এমনই স্পর্শকাতর যে বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারত না। এই যে এই কবিতাটা, ‘কেন গান গাই’, এটা শুনতে শুনতে কাদম্বরী বলেছিলেন, না, রবি, ঠিক হচ্ছে না।

রবি আহত ভাবে বলেছিল, কেন? বোঝা যাচ্ছে না?

কাদম্বরী বলেছিলেন, তুমি আবার পড়ে।

রবি আবার শুনিয়েছিলেন :

সংসারে যে দিকে ফিরে চাই

এমন কি কেহ তোর নাই

তোর দিন শেষ হলে স্মৃতিখানি নিয়ে কোলে

বিমল শিশির-মাখা প্রেম ফুলে দিয়ে ঢাকা

চেয়ে রবে আনত নয়নে?

কাদম্বরী বাধা দিয়ে বলেছিলেন, কেন অমন লিখেছ? ‘তোর দিন শেষ হলে’, তারপর তোমায় কেউ আদর করবে? কেন এর মধ্যেই মৃত্যুর কথা? এখনই বুঝি কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারে না?

রবি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, কে? তাই তো আমি লিখেছি, ‘কেহ না, কেহ না!’

তা শুনে কাদম্বরী এমন হেসেছিলেন যে রবির একেবারে অপ্রতিভ অবস্থা।

এর পরই সে আর একটা কবিতা লিখল, ‘কেন গান শুনাই’।

এসো সখি, এসো মোর কাছে

কথা এক সুধাবার আছে।

কাদম্বরী কিছু না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন সখীকে ডাকছ তুমি? কী নাম তার?

বিষণ্নভাবে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রবি ফের শুনিয়েছিল:

চেয়ে তব মুখপানে বসে এই ঠাই

প্রতিদিন যত গান তোমারে শুনাই

বুঝিতে কি পার সখি, কেন যে তা গাই?…

কাদম্বরী আবার কৌতুক করে বলেছিলেন, তোমার সখী বুঝি কিছুই অনুভব করতে পারে না?

বুঝ না কি হৃদয়ের

কোন খানে শেল ফুটে

তব প্রতি কথাগুলি

আর্তনাদ করি উঠে!

কাদম্বরী থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আর না, রবি, আর না। আমি সবই বুঝি, কিন্তু এমন কবিতা লিখো না। অন্য লোকে ভুল বুঝবে!

বারবার পড়া এই কবিতাগুলিই আবার পড়তে লাগলেন কাদম্বরী। চোখের সামনে ফিরে এল পুরনো সেই দিনগুলি। যতই এইসব ছবি মনে আসে, ততই যেমন আনন্দও হয়, তেমনি চক্ষু দিয়ে অশ্রুও গড়ায়।

এক সময় একটু ঘুময়ে পড়েছিলেন। কাদম্বরী, আবার জেগে উঠলেন কোকিলের ডাকে। ক’বার ডাকল কোকিল, পাঁচ বার। ধড়মড় করে উঠে বসে কাদম্বরী তাকালেন দেয়ালের দিকে। এক দিকের দেয়াল অনেকখানি জুড়ে রয়েছে একটি সুইস ঘড়ি। প্রতি ঘণ্টায় তার তলার দিক থেকে বেরিয়ে আসে একটি কলের কোকিল এবং অবিকল আসল কোকিলের মতন ডাক দিয়ে সে সময় জানিয়ে দেয়।

সত্যিই তো পাঁচটা বাজে। কাদম্বরী ছুটে স্নানঘরে গিয়ে তোলা জলে মুখ চোখ প্রক্ষালন করলেন। সাজগোজ শেষ করতে হবে তাড়াতাড়ি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিতে আসবেন তাঁর স্বামী।

বহু পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রথম জাহাজ জলে ভেসেছে। সাধ করে নাম রেখেছেন। “সরোজিনী’, তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটকটির নামে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই জাহাজটি বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু করবে পূর্ববঙ্গে, আজ গঙ্গাবক্ষে জ্যোৎস্না রাতে সেখানে হবে এক পারিবারিক উৎসব। রবি কয়েক দিন ধরেই সেই জাহাজে রয়েছে, জোয়ার-ভাটার সময় সেটি ঠিক চলাচল করছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি খুলনা পর্যন্ত যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনের কাজ শুরু করার জন্য জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জাহাজের ব্যবসায় শুরু করার পরিকল্পনা যখন তাঁর মাথায় এসেছিল, তখন তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করেননি, ঠাকুর বাড়ির যে-কোনও উদ্যোগ সম্পর্কেই অনেকেই কৌতূহলী। কথা বাতাসে ছড়ায়। এর মধ্যেই ফ্লোটিলা কোম্পানি নামে একটি বিদেশি জাহাজ প্রতিষ্ঠান খুলনা ও বরিশালের মধ্যে বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।

জ্ঞানদানন্দিনীও গত পরশু থেকে ওই জাহাজের একটি কেবিনে আস্তানা গেড়ে আছেন। জাহাজটির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা হচ্ছে তাঁর নির্দেশে, তিনি শেষ পরিদর্শন করছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজের পত্নীর ওপর এ ভার দেননি, যদিও কাদম্বরীর গৃহসজ্জার রুচির এ যাবৎ প্রশংসা করেছেন সকলেই। কাদম্বরী তাঁর অভিমানের কোনও প্রকাশ্য ইঙ্গিত না দিলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আগে থেকেই খানিকটা কৈফিয়তের সুরে জানিয়েছিলেন যে, বিলেতি কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে, জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত ফেরত, সুতরাং সরোজিনীকে কেমন সাজাতে হবে, তা তিনিই ভালো বুঝবেন। দুদিন ধরে ওই জাহাজে জ্ঞানদানন্দিনী, রবি ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রয়েছেন, ওঁরা কাজে ব্যস্ত ঠিকই, কিন্তু এক সঙ্গে কাজ করার একটা আমোদও তো আছে, তার থেকে বাদ পড়েছেন কাদম্বরী, এই চিন্তার যন্ত্রণা তাঁর বুকে কাঁটার মতন বিধে আছে। কিন্তু কে আর সে কাটার খোজ রাখে। এমনকি যে কবি তাঁকে শুনিয়েছিল, “বুঝি না কি হৃদয়ের/কোনখানে শেল ফুটে”, সেও তো আর এই হৃদয়ের কথা বুঝতে চায় না।

তবু কাদম্বরী ঠিক করেছেন, আজ আর কোনও গ্লানি রাখবেন না। আজ জ্যোৎস্না রাতের উৎসবে তিনি যোগ দেবেন খোলা মনে। জাহাজটি রয়েছে শ্ৰীৰামপুরের কাছাকাছি। শুধু তাঁকে নিয়ে যাবার জন্যই তাঁর স্বামী আসবেন এতটা পথ উজিয়ে।

যত্ন করে শরীর ধুয়ে নিয়ে কাদম্বরী শাড়ি বদলাতে লাগলেন। কত শত মূল্যবান শাড়ি জমে আছে, পরাই হয় না। বাড়ি থেকে না বেরুতে হলে এইসব জমকালো শাড়ি আর কে পরে! কাদম্বরী শেষ বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন মাস খানেক আগে, স্বর্ণকুমারীর বড় মেয়ের বিয়েতে। স্বর্ণকুমারীর বাড়িতে তাঁর যেতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু বিয়েতে যেতেই হয়েছিল। পরিচালনায় বাড়ির অনেক ছেলেমেয়েরা মিলে বিবাহোৎসব নাটক করল, অনেক মজা হল। বিয়ের কনে হিরণ্ময়ীর বয়েস ষোলো এত বয়েস পর্যন্ত সে অবিবাহিতা ছিল তার কারণ পাত্র তো ঠিক করা ছিল আগে থেকেই। পাত্ৰ ফণিভূষণ ওদের আত্বীয়ের মতন, ও বাড়িতে যাতায়াত করতে করতে হিরণ্ময়ীকে পছন্দ করেছিল, কিন্তু যোগ্য হবার জন্য সে বিলেত ঘুরে ডিগ্রি নিয়ে এল। হ্যাঁ, সে বিয়ের দিন আমোদ আহ্লাদ হয়েছিল খুবই, তবু যেন কাদম্বরী অনুভব করেছিলেন, অনেকেই যেন তাঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। তিনি এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ তাকে ডাকেনি কেন্দ্রস্থলে আসতে। তিনি আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন, রবি যখন নিভৃতে তাঁর কাছে থাকে, তখন রবি তাঁর কত আপন, কিন্তু যখন অনেকের মধ্যে দেখা হয়, তখন রবি যেন তাঁর দিকে স্পষ্ট করে তাকাতেও সঙ্কোচ বোধ করে।

জ্যোৎস্নারাতে নীল রং মানায়। অনেক শাড়ি ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষ পর্যন্ত কাদম্বরী পছন্দ করলেন গাঢ় নীল রঙের নয়ন সুখ সিন্ধের শাড়ি। আলতা-দাসীকে আগে থেকেই খবর দেওয়া ছিল, সে এসে দু’পায়ে আলতা পরিয়ে দিয়ে গেল। তারপর কাদম্বরী একসঙ্গে বারোটি ধূপ জ্বালিয়ে সেই ধূপের ধোঁয়া লাগালেন তাঁর চুলে ও দুই স্তনের মাঝখানে। ভুরুতে দিলেন কাজল, সুর্মা আঁকলেন চোখে। দুই বগলের নিচে বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরে রইলেন কয়েকটি করে চাঁপা ফুল। আতর কিংবা বিলিতি সুগন্ধের চেয়ে এই সবই কাদম্বরীর পছন্দ।

সাজ শেষ করে, খোপায় যুঁইয়ের একটা মালা জড়িয়ে কাদম্বরী আবার দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। নিজের রূপ নিয়ে গুমোর করতে নেই। কিন্তু কাছাকাছি কেউ নেই, একা, খুব সন্তৰ্পণে, দর্পণের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কার না ভালো লাগে? কাদম্বরীর মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগে রবি তাকে একবার সাজতে দেখে বলে উঠেছিল :

অশোক বসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে

আপনার রূপের মাঝার,

রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে

রূপেতেই লুকায় আবার।…

আজও কি সেইরকম সাজ হয়েছে? বেশি বেশি হয়ে যায়নি তো? রূপের মধ্যেই রূপ লুকিয়েছে?

ভাবতে ভাবতে তিনি দারুণ চমকে উঠলেন। আবার কোকিল ডেকে উঠল, ছ’বার। তা হলে তো সময় হয়ে গেছে। সিঁড়িতে কি শোনা যাচ্ছে তার স্বামীর পদশব্দ। দরজা খুলে তিনি বললেন, হলোর মা, দেখ দেখি, কেউ এল?

না, সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে আসছে না এখনও। তবু কাদম্বরীর দৃঢ় বিশ্বাস, একটু দেরি হলেও জ্যেড়াতিরিন্দ্রনাথ এসে পড়বেন যে কোনও মুহূর্তে। কোনও কাজের অছিলা দেখিয়ে আজ রবিকে পাঠালে কাদম্বরীর খুব রাগ হবে। না, আজ তিনি রবির সঙ্গে যাবেন না। জ্ঞানদানন্দিনীর সামনে তিনি আজ তাঁর স্বামীর পাশাপাশি থাকতে চান।

কোকিল, নির্দয় কোকিল, সে খালি ডেকই চলে। বসন্ত শেষ হয়ে গেছে, তবু সে ডাকে। ঘড়ির মধ্যে কলের কোকিল আবার দিন রাত্রি মানে না, সে ক্লান্তও হয় না, ডাকবেই সে প্রতি ঘণ্টায়। সাতটা, আটটা, নটা, দশটা। কাদম্বরী ছটফটিয়ে বারবার ঘর আর বার করতে লাগলেন। কখনও দাঁড়ালেন বারান্দায়, কখনও জানলায় । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আজ আসবেন না, এ তিনি বিশ্বাসই বরেতে পারছেন না। আসবেন, তিনি ঠিকই আসবেন, যতই দেরি হোক।

হলোর মাকে ছুটি দিয়েছেন তিনি, সারা বাড়ি ক্রমশ অন্ধকার ও স্তব্ধ হয়ে এল। এগারোটা বেজে গেল, এর পর আর জাহাজে পৌছনো যাবে কী করে? আজকের মতন কি জ্যোৎস্না রাতের উৎসব বাতিল? তা হলে সবাই ফিরে এল না কেন! কিংবা সবাই কাদম্বরীর কথা ভুলে গেছে? আসবেন না, তার স্বামীও আজ সত্যি আসবেন না?

এ ঘরে তিরিশটি বাতিদানের বৃহৎ ঝাড়লণ্ঠনটি জ্বালানো হয়েছে। উজ্জ্বল আলোকময় কক্ষ। আয়নায় একজন, ঘরের মধ্যে আর এক কাদম্বরী। একজন যেন আর একজনকে বিদ্রূপ করছে । আয়নার নারীটি বলছে, ওরে, তুই এমন অভিসারিকার মতন সাজগোজ করলি কার জন্য? তোকে যে বীভৎস প্রেতিনীর মতন দেখাচ্ছে!

দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে কাদম্বরী ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিছানায় । এতক্ষণ তাঁর কেশচর্চা নষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি একবারও শয্যায় গা এলাননি। এখনও কিন্তু তাঁর কান্না আসছে না, চক্ষু দুটি শুষ্ক, শরীরে অসহ্য ছটফটানি । একটু পরেই আবার উঠে পড়ে তিনি একটি গান গেয়ে উঠলেন :

বুঝি বেলা বহে যায়

কাননে আর তোরা আয়…

সাধ ছিল যে পরিয়ে দেব মনের মতন মালা গেঁথে

কই সে হল মালা গাঁথা, কই সে এল হায়…

এখনও তো কান্না পাচ্ছে না, গাইতে গাইতে হি হি হি হি করে হেসে উঠলেন কাদম্বরী। আবার আয়নায় নারীটির দিকে চোখ পড়ল। যে কিছু বলার আগেই কাদম্বরী চোখ পাকিয়ে বললেন, তুই এখনও রয়েছিস কেন মুখপুড়ী! যা, বিদেয় হ! ইস, আবার সাজের ঘটা দেখ!

দেয়ালের কোণে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি রূপো বাঁধানো ছড়ি রাখা আছে । ছুটে গিয়ে সেটা এনে কাদম্বরী ঠাঁই ঠাই করে মারতে লাগলেন তাঁর এতকালের সাধের দর্পণে। ঝনঝন শব্দে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল কাচ । তাতে কাদম্বরী খুব তৃপ্তি বোধ করলেন। যাক, আর কোনওদিন ওই আয়নায় নিজের মতন এক নারীকে দেখতে হবে না। নিজের সঙ্গে আর তার দেখাই হবে না।

এমনিতে কেউ শত অনুরোধ করলেও গান শোনাতে চান না কাদম্বরী। এখন, এত রাত্রে, কেউ অবাক বা বিরক্ত হবে কিনা না ও বেশ জোরে জোরে আপন মনে গান করতে লাগলেনঃ

দেখে যা, দেখে যা, দেখে যা লো তোরা সাধের কাননে মোর

আমার সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া, মলয় বহিছে সুরভি লুটিয়া রে…

মাঝপথে গান থামিয়ে, তিনি কাল্পনিক কোনও শব্দ শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন, কে? কে?

কোনও সাড়া নেই। তিনি বাজপাখির মতন তীক্ষ্ণ, কুটিল চোখে চেয়ে রইলেন বন্ধ দরজার দিকে।

তারপর আপন মনে বললেন, কেউ না, বুঝি বাতাস? আজ থেকে বাতাস, তুমি আমার কেউ না। মধ্যরাতের জ্যোৎস্না? তুমি আমার কেউ না! বারান্দায় যত ফুল ফুটে আছ, তোমরা আমার কেউ না!

আর কাকে কাকে ছাড়তে হবে। একটুক্ষণ ঘাড় বেঁকিয়ে, লক্ষ্ণী ট্যারা হয়ে তিনি ভারতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর মাথায় অন্য একটা চিন্তা এল। সরোজিনী জাহাজে নিশ্চয়ই এখন গানের আসর বসেছে, ফুর্তির ফোয়ারা বইছে। তিনি নিজে যদি তার মধ্যে সহসা হাজির হন। তা হলে কেমন হয়? কিন্তু যাওয়া যাবে কি করে? কাদম্বরী তো পথ চেনেন না। বঙ্গললনাদের পক্ষে একা একা কোথাও যাওয়ার যেন প্রশ্নই ওঠে না। ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন যুবা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে পথে বেরিয়ে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কত লোক সে জন্য কটু কথা বলেছে, এমনকি এ পরিবারের কর্তামশাই ঋষিতুল্য দেবেন্দ্রনাথও ভ্রু কুঞ্চিত করেছেন । কিন্তু এ পর্যন্তই। ওই সব প্রগতিশীল স্বামীরাও তো তাদের স্ত্রীদের একা একা পথে বেরুতে দেবার কথা ভাবেননি।

এখন যদি সোজা বেরিয়ে গিয়ে, পাল্কি বেহারাদের জাগিয়ে তুলে বলা যায়, আমার শ্রীরামপুর নিয়ে চলো, তারা আঁতকে উঠবে। এমন কি কখনও হতে পারে না?

কাদম্বরী অসহিষ্ণুভাবে মাটিতে পা ঠুকে বলতে লাগলেন, কেন হবে না? হ্যাঁ, আমি যাব, আমি যাব, আমি যাব! ওদের আনন্দ উৎসবের মধ্যে গিয়ে জোর করে বসব। ইচ্ছেমতন পাখি হতে পারলে কত সুৰিধে ছিল। একবার আকাশে উড়াল দিলে পথ চেনার কোনও সমস্যাই নেই। পাখিদের সমাজে লোকলজ্জা বলেও কিছু নেই। এমন হলে তো বেশ হয়, শরীরটা আর রইল না, আত্মাটা পাখির মতন সর্বত্র পরিভ্রমণ করতে লাগল।

কাদম্বরী ছুটে গেলেন পাশের ঘরে। চাবি দিয়ে খুললেন দেয়াল আলমারি। তার ভেতরের একটি গুপ্ত স্থান থেকে বার করলেন একটি গয়নার বাক্স, চন্দন কাঠের তৈরি, ওপরে হাতির দাঁতের কারুকাজ করা। এই পেটিকায় স্বর্ণালঙ্কার নেই, শুধু হীরে-চুনী-পান্না-মুক্তোর মালা। সেগুলি সরিয়ে সরিয়ে তলা থেকে বার করলেন একটা কাগজের মোড়ক। এর মধ্যে রয়েছে চারখানা কালো রঙের বড়ি, এই বড়ি খেলে পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া যায়। বিশু নামে এক কাপড়উলির কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করে রেখেছেন কাদম্বরী। কাপড় বেচতে আসে বটে, কিন্তু এই বিশু একজন দেয়াসিনী, অনেক জড়ি-বুটি, শিকড়-বাকড়ের গুণ জানে । সে ঘুমের ওষুধ দেয়। একটু ঘুম, বেশি ঘুম, গহন ঘুম, মরণ ঘুম!

এই গয়নার বাক্সের মধ্যেই সযত্নে রক্ষিত আছে তিনখানি চিঠি। এর মধ্যে একখানি কাদম্বরী পেয়েছিলেন ধোপার কাছে কাচতে দেবার আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এক জোব্বার পকেট, অন্য দুটি এক বৃহদাকার অভিধানের ভাঁজে। তিনটি চিঠিই একই মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা, সম্বোধনে প্ৰাণাধিকুষ, তলায় কোনও নাম নেই। এ চিঠির কথা কাদম্বরী তাঁর সর্বগুণান্বিত, ব্যস্ত, বিখ্যাত স্বামীকে কখনও বলেননি।

তিনখানি চিঠিই তিনি পড়লেন আবার। তাঁর ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল, অত্যুজ্জ্বল হল দুই চক্ষু সমস্ত রোমকূপে জ্বালার অনুভূতি। চিঠিগুলি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি এক সঙ্গে চারটি কালো বড়িই খেয়ে ফেললেন। জল পান করলেন দু’ গেলাস।

আঃ, শান্তি, শান্তি! এখন আর একা একা যে-কোনও জায়গায় যাওয়ার কোনও বাধা নেই। কোনও অবরোধের দেয়াল তাকে আটকাতে পারবে না। সব পথ তার জন্য খোলা।

পাখির ডানার মতন দু’হাত ছড়িয়ে তিনি দৌড়তে লাগলেন। সারা ঘরে। ভাঙা কাচ তাঁর পায়ে বিধে যাচ্ছে, কোনও খেয়াল নেই, তাঁর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। বিশু একটা মোটে পুরিয়া খেতে বলেছিল, চারটি খেয়ে শরীর কী হালকা লাগছে।

পা দিয়ে ফোটা ফোটা রক্ত পড়ছে, তাতে যেন আলপনা আঁকা হয়ে যাচ্ছে সাদা মারবেল পাথরে। কাদম্বরী আজ নাচছেন, কেউ কোনওদিন তাঁর নাচ দেখেনি। খুলে ফেললেন শাড়ি। পরনেই রইল শুধু সেমিজ। নাচতে নাচতেই ছুড়ে ফেলতে লাগলেন হাতের কঙ্কণ, গলার হার, কানের দুল, খোপার ফুল। গাইতে লাগলেন একটা গান, তা খুবই অস্পষ্ট, কথা বোঝাই যায় না।

একটু ক্লান্ত হয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। এ ঘরে একটি টেবিলও রয়েছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অনেক সময় এখানে বসে লেখাপড়া করতেন। অনেক দিন বসেননি, এখনও কিছু কাগজপত্র ছড়ানো রয়েছে।

কাদম্বরী ভ্রু কুঞ্চিত করে ভাবলেন, যাবার আগে একটা চিঠি লিখে যাবেন। কিন্তু কাকে, রবিকে না তাঁর স্বামীকে? তাঁর স্বামী হয়তো একখানা চিঠি পাঠ করারও সময় পাবেন না। রবিকে কত কথা বলার ছিল, রবি এক সময় কত কথা বলেছে, তার উত্তর দেওয়া হয়নি।

কলম তুলে নিয়ে রবির নামটি লিখতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন। রবি তো আর আগের মতন নেই। তাঁর সর্বক্ষণের ছায়া-সহচর যে এখন অনেক দূরে সরে গেছে। সে এখন পরিপূর্ণ যুবক, বিবাহিত, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত। না, রবিকে আর তিনি কাছে টানতে চান না। টানতে গেলে ব্যথা পেতে হবে, রবি আর কিছুতেই তাঁর একার হবে না।

রবি এখন মেজ বউঠানের বাড়িতেই থাকে, তার বালিকা বধূটিও সেখানে। এই জোড়াসাঁকোর বাড়ির রবির ঘরটি একদিন সাফসুতরো করতে গিয়েছিলেন। কাদম্বরী। তার এলোমেলো ছড়ানো পাণ্ডুলিপির মধ্যে দু’ লাইনের একটি অসমাপ্ত কবিতা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। লাইন দুটি পড়ে কাদম্বরীর বুকে একটা প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। এমন তো রবি আর কখনও লেখেনি। এই অসমাপ্ত কবিতাটির কথা বলেওনি তাঁকে। লাইন দুটি তাঁর এখন আবার মনে পড়ে গেল।

হেথা হতে যাও, পুরাতন!

হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে…!

কী নিদারুণ সত্যি কথা! নতুন খেলা শুরু হলে পুরাতনের আর স্থান কোথায়, তাকে সরে যেতেই হয়। কিন্তু নতুন কত দিনে পুরাতন হয়। নারীই পুরাতন হয়ে যায়। পুরুষ হয় না বুঝি। পুরুষের যে বাইরের জগৎ আছে, আছে অসীম বিশ্ব, তাই সে নিত্যনতুন?

না, রবিকে নয়, স্বামীকেই চিঠি লিখে যাবেন তিনি। এর আগে কখনও চিঠি লেখার অবকাশ হয়নি। কী সম্বোধন করবেন। ‘প্ৰাণাধিকেষু’ আর একজন নিয়ে নিয়েছে, তাহলে পরাণ প্রিয়? প্রিয়তম?

বেশ শব্দ করে আপন মনে হেসে উঠলেন কাদম্বরী। কী অর্থ আছে, এই সব শব্দের। যে আর ফিরেও চায় না, সে কি ওই সব সম্বোধনে ভ্ৰক্ষেপ করবে? যে-নারী কোনও সন্তানের জন্ম দিতে পারে না, কোন পুরুষ তাকে বেশিদিন চায়। অন্য যে-একজন তীব্ৰভাবে তাঁর সাহচৰ্য চাইত, সেও এখন নতুন খেলার সাথী পেয়েছে। সে মেতে থাকুক ওই খেলায়, সে সুখী হোক, আরও বড় হোক, পুরাতন সরে যাচ্ছে তার চোখের আড়ালে।

পরাণ প্রিয় সম্বোধনেই স্বামীকে চিঠি লিখতে শুরু করলেন কাদম্বরী। বেশি লিখতে পারলেন না, চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। সংক্ষিপ্তভাবে শেষ করলেন দ্রুত। তলায় লিখলেন, ইতি তোমার জন্য জন্ম জন্মান্তরের এক কাঙালিনী।

উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরটিতে যেতে যেতে অস্ফুট কণ্ঠে আবার বললেন, হেথা হতে যাও, পুরাতন! হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে। কেউ চায় না, পুরাতনকে কেউ চায় না, আমায় আর কেউ চায় না। অচ্ছুতের মতন সবাই আমাকে ঠেলে দিয়েছে ঘরের কোণে।

এই প্রথম এক উচ্ছ্বসিত জলপ্রপাতের মতন কান্নায় আন্দোলিত হলেন কাদম্বরী। আর্ত স্বরে বলতে লাগলেন, রবি, রবি, আমি চলে যাচ্ছি! তোমার কবিতা, তোমার গানই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তোমার রচনার মধ্যেই আমি নিজেকে মুছে পেয়ে ধন্য হয়েছি। রবি, আমি চলে যাচ্ছি, নতুন বউঠান এখন পুরাতন হয়ে গেছে, সেই পুরাতন আজ বিদায় নিচ্ছে…

আর দাঁড়িতে পারলেন না কাদম্বরী। তাঁর শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে চেয়ে পড়ল কঠিন পাথরে। জোর শব্দে তাঁর মাথা ঠুকে গেল।

ঝাড়লণ্ঠন জ্বলতেই লাগল। প্রতি ঘণ্টায় ডেকে গেল কোকিল। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস ঢুকে খেলা করতে লাগল এক নিস্পন্দ শরীর ঘিরে।

কাদম্বরীর ভোরে ওঠা স্বভাব। প্রতিদিন তিনি নিজের হাতে ঝারি নিয়ে তার টবের গাছগুলিকে জলসিক্ত করেন। এদিন অনেক বেলা হয়ে গেল, তবু দ্বার খোলে না। হলোর মা কয়েকবার ফিরে গেল ডাকাডাকি করে। ক্রমে আরও বেলা বাড়ল, তারপর দাস-দাসীদের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে গেল। দাস-দাসীরাই খবর ছড়িয়ে দিল বিভিন্ন মহলে। অন্যান্য বধূরা উকি-ঝুঁকি মেরে গেলেন, কিছুই বোঝা গেল না। ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই।

পাশের বাড়ি, হিন্দু ঠাকুরদের একটা অংশ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মহলটি দেখা যায়। সেখানে গিয়ে ভিড় করল অনেকে। হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে বটে জানলা খোলা, পালঙ্কটি শূন্য, ঘরে তো কেউ নেই। কোথায় গেলেন। কাদম্বরী? একটা বড় টুল এনে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল গুণেন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে সুনয়নীকে। সবাই জিজ্ঞেস করছে, কী দেখছিস, কী দেখছিস। সুনয়নীর কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না, মুখখানি ভয়ে বিবৰ্ণ হয়ে গেছে, এই প্রথম সেই বালিকা মৃত্যু দৰ্শন করছে। মেঝেতে অস্বাভাবিকভাবে পড়ে থাকা নতুন কাকিমার দেহটি দেখলেই মৃত্যুকে চেনা যায়।

এর পর দরজা ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু কাদম্বরীর স্বামী অনুপস্থিত, ও ঘরের দরজা ভাঙার দায়িত্ব কে নেবে?

অবিলম্বেই দেবেন্দ্রনাথের কাছে তাঁর অন্য পুত্ররা এই মর্মান্তিক সংবাদ পৌঁছে দিল। দেবেন্দ্রনাথ ধ্যানে বসেছিলেন, তার মাঝখানেই তাঁকে শুনতে হল সব। তাঁর মুখের একটি রেখাও কাঁপিল না, তিনি পাথরের মূর্তি মতন বসে রইলেন। যেন তাঁর মন বহু দূরে চলে গেছে।

কয়েক মিনিট পরে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে এলেন বাস্তব পারিপার্শ্বিকে। ছেলেদের চলে যাবার ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, কিশোরীকে ডেকে দিয়ে যাও।

কিশোরী তাঁর সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত ও দক্ষ অনুচর। সে পারে না এমন কাজ নেই। ঘরের দরজা বন্ধ করে কিশোরী দেবেন্দ্রনাথের একেবারে সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল, দেবেন্দ্রনাথ একটু একটু থেমে থেমে তাকে নির্দেশ দিতে লাগলেন।

তিনি প্রথমে বললেন, নতুন বধূমাতার কী হয়েছে, তুমি শুনেছ? ছেলেরা সন্দেহ করছেন যে তিনি আত্মঘাতিনী হয়ে থাকতে পারেন। লোকজন নিয়ে গিয়ে তুমি দরজা ভাঙাও। কিন্তু তুমি ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তিকেই, এমনকি আমার পুত্রদেরও ভিতরে যেতে দেবে না। ঘরের ভিতরের অবস্থা তুমি দেখবে, সন্দেহজনক যাবতীয় কিছু পরিষ্কার করে ফেলবে।

একটু চিন্তা করে তিনি আবার বললেন, এ বাড়ির কোনও বধূর মৃতদেহ মার্গে পাঠানো যেতে পারে না, কিছুতেই না। করোনার কোর্টকে বাড়িতে ডেকে এনে বসাবে, যত টাকা লাগে লাগুক। কেমিক্যাল এগজামিনার যেন লিখে দেয়, এ মৃত্যু স্বাভাবিক।

তিনি একবার চক্ষু মুদিত করলেন। খোলার পর বললেন, এ দেশের কোনও সংবাদপত্রে, বাংলা বা ইংরেজি, দিশি বা বিদেশি, কোনওটিতেই যেন এ সংবাদ প্রকাশ না পায়। তুমি সবকটি সম্পাদককে এক জায়গায় ডেকে আমার এ অনুরোধ জানাবে। খাজাঞ্চিখানা থেকে তুমি আপাতত এক হাজার টাকা তুলে নাও, পরে হিসাব দিও। যাও, পরম করুণাময়ের আশীর্বাদে তোমার সর্ব কাৰ্য সিদ্ধি হোক।

কিশোরী চারজন জওয়ান ভৃত্যকে ডেকে নিয়ে উঠে এল তিনতলায়। মেহগনি কাঠের দরজার সহজে ভাঙে না, তবু ভাঙল এক সময়। কিশোরী বারান্দা ও সিঁড়ি থেকেও সরিয়ে দিল। সকলকে। তারপর ভেতরে পা দিয়ে দেখল, চতুর্দিকে আয়না ভাঙা কাচের মধ্যে চিত হয়ে পড়ে আছে। কাদম্বরীর সেমিজ পরা শরীর। একটি হাত ছড়ানো, একটি হাত বুকের ওপর রাখা, চক্ষু বোজা, মুখে কোনও যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, ছড়িয়ে আছে এক রাশ চুল, মুখখানি যেন মেঘভাঙা জ্যোৎস্না মাখা, লাবণ্যময় তনু, আলতা পরা দুখানি পা, পায়ের নীচে শুকনো রক্ত।

কিশোরীর এখন রূপ দর্শনের সময় নেই। বিছানা থেকে একটা চাদর টেনে নিয়ে সে কাদম্বরীর শরীর ঢেকে দিল। তীক্ষ্ণ নজরে সে চোখ বোলাতে লাগল। ঘরের সব কিছুর ওপর। আয়না ভাঙা কাচগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। এ ছাড়া এ ঘরে সন্দেহজনক কিছু নেই। মাঝখানের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাশের ঘরের মেঝেতে কাগজ ছড়ানো। দৌড়ে গিয়ে সে চিঠি তিনখানি তুলে নিয়ে দু-এক লাইন মাত্র পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে টুকরোগুলো রাখল নিজের পকেটে। টেবিলের ওপর চাপা দেয়া, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিটা সে পড়ল পুরোই। এখানিও ছিঁড়ে ফেলতে সে দ্বিধা করল না। আলমারি খোলা, গহনার বাক্স রয়েছে টেবিলের এক কোণে। এত সব মূল্যবান অলংকার দেখেও কিশোরীর লোভ হল না, বাক্সটি আলমারিতে তুলে, তালা বন্ধ করে, চাবিটি রাখল নিজের কাছে।

অন্য কক্ষটিতে ফিরে এসে সে কাচ পরিষ্কার করার জন্য একটা কিছু খুঁজছে, অকস্মাৎ একটা শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠল সে। ভয় যেন মুগুর পিটতে লাগল তার বুকে। এখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কে?

পিছন দিকে তাকিয়ে আরও সাঙ্ঘাতিক ভয়ে সে কাঁপিতে লাগল। মৃত শরীরটি জেগে উঠেছে। কাদম্বরী এক পাশ ফিরে জ্বলজ্বলে চোখে সোজা তাকিয়ে আছেন কিশোরীর দিকে।

কয়েক পলক মাত্র, তারপরই আবার চোখ বুজে গোল কাদম্বরীর।

কিশোরী বহু অভিজ্ঞ ও সাহসী পুরুষ। ভূত-প্রেত সম্পর্কে একটা বহুকালের সংস্কার রয়ে গেছে, তা কিছুতেই তাড়ানো যায় না। একটুক্ষণের মধ্যেই কিশোরী ধাতস্থ হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কাদম্বরীর একটা হাত তুলে নিল। অতি ক্ষীণ হলেও নাড়ি আছে। কাদম্বরীর মৃত্যু হয়নি।

আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে বেরিয়ে এল কিশোরী।

এর পর সব কিছুই বদলে গেল। বাড়ি থেকে মুছে গেল শোকের থমথমে ছায়া। কাদম্বরীর ননদ ও জায়েরা এসে লেগে গেলেন সেবায়। সাহেব ডাক্তার ও তিনজন বাঙালি ডাক্তারকে ডেকে আনা হল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

এর মধ্যে সরোজিনী খবর দেবার জন্য দূত চলে গেছে। জাহাজ ছেড়ে সকলে তিনখানা দ্রুতগামী জুড়িগাড়িতে ফিরে এল জোড়াসাঁকোয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবি বসল কাদম্বরীর শিয়রের দু’পাশে। কাদম্বরীর দেহে প্রাণ আছে বটে, কিন্তু তাঁর বাকরোধ হয়ে গেছে, জ্ঞানও ফিরছে না। ডাক্তাররা যমের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন, তিনজন চিকিৎসককে রাত্তিরেও বাড়ি ফিরতে দেওয়া হল না, তারা সারা রাত জেগে রইলেন পর্যবেক্ষণে।

রবি ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিকে আর চক্ষু মেলে চাইতে পারলেন না। কাদম্বরী, সেই অবস্থায় দু’দিন পর তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।

আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল কিশোরী, কাদম্বরীর কথা নিশ্চিতভাবে ঘোষিত হতেই সে করোনার কোর্টের দু’তিনজন কেরানি ও কেমিক্যাল এগজামিনার সমেত সাহেবকে ডেকে আনল বাড়িতে। তাদের জন্য সাহেবি হোটেলের উত্তম উত্তম খাদ্য ও ব্র্যান্ডির বোতল আনা হল, তারা খানাপিনা করে উপযুক্ত রিপোর্ট দিয়ে গেল, এই লাশ মৰ্গে পাঠাবার প্রয়োজন নেই।

হেমচন্দ্ৰ বিদ্যারত্নকেও আনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি শ্মশানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালনা করবেন। প্রচুর চন্দন কাঠ, কয়েক হাঁড়ি ঘৃত ও ধূপ-ধুনো সংগ্রহে ক্ৰটি হল না। কিন্তু শ্মশানে কে কে যাবে • পুত্ৰহীনা। কাদম্বরীর মুখাগ্নি করার কথা তার স্বামীর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন। শেষ দেখাও হল না! সেদিন সন্ধেবেলা ভাটার জন্য জাহাজ আটকে গিয়েছিল, জোয়ার সেই মধ্যরাত্রে, সেইজন্যই কাদম্বরীকে নিতে আসা হয়নি। দু’একজন অবশ্য বলেছিল, জাহাজ যদি যেতে না পারে, তা হলে ঘোড়া গাড়ি পাঠিয়ে কাদম্বরীকে শ্ৰীরামপুরে আনিয়ে নিলেই তো হয়। কিন্তু তখন গানবাজনা শুরু হয়ে গেছে, কেউ আর সে উদ্যোগ নেয়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, আজ সন্ধেবেলা হল না, আগামীকাল তাঁর পত্নীকে অবশ্যই আনবেন। কিন্তু এর মধ্যে যে তাঁর পত্নী প্রচণ্ড অভিমানে এমন একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড বাধিয়ে বসবেন, তা অনুমান করতে পারলে কি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেদিনই আসতেন না?

সেই ক্ষোভে, ধিক্কারে, গ্লানিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর দাড়িয়ে থাকতেই পারছেন না, মুখ গুজে শুয়ে আছেন বিছানায়, এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে শ্মশানে যাওয়া অসম্ভব। অগত্যা রবিকেই সব দায়িত্ব নিতে হল। জ্ঞানদানন্দিনী প্রায় জোর করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। এখন ওঁরই চিকিৎসা ও শুশ্রূষা দরকার।

রবি একটা আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে রয়েছে, ঠিক কান্নাও আসছে না তার। নতুন বউঠান নেই, এ কথা সে বিশ্বাসই করতে পারে না। চোখের সামনে সে দেখছে বটে, যে নতুন একটা পালঙ্কে লম্বমান কাদম্বরীর মৃতদেহ, পুরোহিতরা মন্ত্র পড়ছেন, ওদিকে চিতা সাজানো হচ্ছে, তবু তার মনে হচ্ছে, এ সব কিছুই অলীক। নতুন বউঠান অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, রবি রয়েছে আর তিনি চলে গেছেন, এ কখনও হতে পারে? না, না, অসম্ভব।

মুখাগ্নির জন্য অবশ্য রবিকে যন্ত্রণা দেওয়া হল না। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সকলেই জানে, কাদম্বরীর সঙ্গে রবির সম্পর্ক ছিল। বড়দাদার ছেলে দিপুবাবু সে কাজটি সেরে দিলেন।

কিশোরী শ্মশানে যায়নি। নিমতলা ঘাটের চিতায় ঘি খাওয়া আগুনের লেলিহান শিখায় যখন কাদম্বরীর শরীর পুড়ছে, তখন কিশোরী কলকাতার সবকটি দৈনিক ও সাময়িক পত্রের সম্পাদকদের জড়ো করছে উইলসন হোটেলে। সেখানে ঢালাও খাদ্য ও পানীয় পরিবেশিত হল। সকলকে করজোড়ে আপ্যায়ন করতে করতে কিশোরী মহামান্য দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধটি জানাল, আপত্তি তুলল না কেউ।

শ্মশান থেকে ফিরে রবি মুখে নিমপাতা ছুঁইয়ে নতুন বস্ত্ৰ পরিধান করল। এর পরেও আরো অনেক পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম আছে। সবই ঘটে যাচ্ছে, অথচ রবি যেন এসব কিছুই দেখছে না। সে বৈঠকখানা ঘরের একটা মাদুরের ওপর বসে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রবির চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ছবির পর ছবি। মোরান সাহেবের বাগান বাড়ি, ভোরবেলা এক সঙ্গে ফুল কুড়োনো, এক দোলনায় পাশাপাশি বসা, নতুন গানে সুর দিয়েই ওঁকে শোনানো, আর কেউ নেই, শুধু নতুন বউঠান, তাঁর গভীর একাগ্র দৃষ্টি, সদর স্ট্রিটের বাড়ির ছাদে জ্যোৎস্নালোকে হাত ধরে বসে থাকা নীরবতার মধ্যে অজস্র কথা, এক একদিন নতুন সকালবেলা তার ঘুম ভাঙিয়েছেন, বসেছেন শিয়রের কাছে, তার কোলে মাথা রেখেছে। রবি, এ সবই তো জীবন্ত।

এক সময় রবির শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শেষ কিছুক্ষণ সে অন্য কথা ভাবছিল। তার নতুন বই ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ” প্রায় তৈরি হয়ে আছে। শেষ কয়েকটি পাতার প্রুফ দেখা বাকি, ওর মধ্যে আর একটি গান কি ঢোকানো যায়, ‘মরি লো মারি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে’ গানটির একটা-দুটো শব্দ বদলাতে হবে। এরই মধ্যে নতুন বউঠানের মুখ মন থেকে সরিয়ে দিয়ে সে তার বইয়ের কথা চিন্তা শুরু করেছিল? এমনও হয়!

রবির দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগিল জল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *