ছ’নম্বর বিডন স্ট্রিটে ন্যাশনাল থিয়েটারের সামনে এসে থামল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফিটন গাড়ি। থিয়েটার ভবনটি প্রায় কাঠের তৈরি, চতুর্দিকে তক্তার বেড়া আর করোগেটের ছাদ। আজ অভিনয়ের দিন নয়, তাই জন সমাগম নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গায়ে পাতলা জামার ওপর সিন্ধের মেরজাই, কাঁধে উড়নি, ধুতির কেঁচা বা হাতে ধরে তিনি নামলেন গাড়ি থেকে। গেটের কাছে টুলে বসে একজন দারোয়ান গাজা টানছিল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখে তাড়াতাড়ি কল্কেটা লুকিয়ে ফেলল। থিয়েটারের দারোয়ানেরা যণ্ডামার্কা ধরনের হয়, মাতাল ও উচ্ছৃঙ্খল দর্শকদের ঠ্যাঙবার জন্য তৈরি থাকে। এই দারোয়ান ভুজবল সিংও সেই প্রকৃতির, চক্ষু সব সময় রক্তবর্ণ, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত তাকে খাতির করে, সেও একমাত্র এই মঞ্চের মালিক প্রতাপ জহুরী ছাড়া আর কারুকে তোয়াক্কা করে না।
তবু যে ভুজবল সিং এখন গাজা কন্ধে সরিয়ে রেখে সম্ভ্রম দেখাল, তার কারণ এই বাবুর কথা আলাদা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শুধু চেহারা কিংবা সাজপোশাকের জন্যই নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বেই এমন কিছু মহিমা আছে, যার জন্য সাধারণ মানুষ তাঁর সামনে এসে এমনিতেই মাথা নিচু করে। অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গম্ভীর স্বভাবের নন, সদা হাস্যময়। দারোয়ান লম্বা সেলাম ঠুকলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাত তুলে বললেন, আচ্ছা হ্যাঁয়?
অডিটোরিয়ামের পাশের টানা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। ভেতরে কোনও বাতি নেই, গ্রিনরুমের দিকে যাবার সিঁড়ির কাছে শুধু একটা গ্যাসের বাতি জ্বলছে। ডান ধারের ফাঁকা জায়গায় খাবারের দোকানটি আজ বন্ধ, পানের দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে গজল্লা করছে কয়েককজন, হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে এদিকে তাকিয়ে তারা ফিসফিস করে বললেন, জ্যোতিবাবু, জ্যোতিবাবু!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আজ কিছুটা ভারাক্রান্ত। এখানে আসবেন কি আসবেন না, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেকদিনের। এই মঞ্চে নাট্যকার হিসেবে তাঁর সার্থকতা প্রমাণিত হয়েছে। নিজেদের বাড়ির মঞ্চে পরিবারের লোকজনের নিয়ে অভিনয় করা এক কথা, সেখানে দর্শকরা সব আমন্ত্রিত, আর এখানে সাধারণ দর্শকরা টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে, তাদের পছন্দ না হলে আসনগুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। এখানে তাঁর ‘পুরুবিক্ৰম’ নাটক, কিঞ্চিৎ জলযোগ, ‘সরোজিনী’ বা চিতোর আক্রমণ নাটক জনপ্রিয় হয়েছে। সরোজিনী তো দারুণ ভাবে সার্থক, অন্য কারুর নাটক দর্শক মনোরঞ্জনে সমর্থ না হলেই সরোজিনী আবার মঞ্চস্থ হয়েছে। ন্যাশনাল থিয়েটারে তিনি বিশেষ সম্মানিত নাট্যকার।
কিন্তু অবস্থাটা বদলে গেছে সম্প্রতি। এই ন্যাশনাল থিয়েটারে গিরিশ ঘোষের ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ জমজমাটভাবে চলছিল, হঠাৎ মালিকের সঙ্গে পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কলহ হল। গিরিশবাবু সদলবলে বেরিয়ে গেলেন, এই বিডন স্ট্রিটের খুব কাছে স্টার নামে নতুন থিয়েটার খোলা হয়েছে। গিরিশবাবু সঙ্গে নিয়ে গেছেন অমৃতলাল, বিনোদিনী, কাদম্বিনীদের, ‘দক্ষযজ্ঞ’ পালা নামিয়ে বিপুলভাবে দর্শক টানছেন। ন্যাশনালের অবস্থা এখন শোচনীয়, কোনও নাটকই জমছে না, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এর নাট্যরূপ দিয়েও কোনও সুফল হল না। দর্শকরা আনন্দমঠ একেবারেই পছন্দ করেনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুধু নাট্যকারী নন, নাট্যসমালোচকও, ‘ভারতী’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাধারণ মঞ্চের নাটক বিষয়ে লেখেন। সেই জন্যই যখন নিজের নাটক মঞ্চস্থ হয় না, তখনও থিয়েটারের লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। ‘আনন্দমঠ’ মঞ্চে তাঁরও পছন্দ হয়নি। মূল উপন্যাসটি অবশ্য এখনও পড়া হয়নি তার। রবি পড়েছে, রবির ভালো লাগেনি, রবির মতে উপদেশের ঠেলায় চারিত্রগুলো রক্ত-মাংস পায়ানি, চরিত্রগুলি যেন এক একটি সংখ্যা, আর শান্তিকে নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।
ন্যাশনালের এই দুর্দশার সময়ে এখানকার মালিক জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ধরেছেন নতুন নাটক লিখে দেবার জন্য।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথমে রাজি হননি। ন্যাশনাল নাটক দেওয়া মানে স্টারের গিরিশবাবুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা। গিরিশবাবু বন্ধু মানুষ, এতকাল গিরিশ-অমৃতলাল-বিনোদিনীরাই তাঁর নাটকে অভিনয় করেছে, ‘সরোজিনী’-র জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বিনোদিনীর অসাধারণ অভিনয়। এখন তিনি ওদের বিপক্ষে যাবেন কীভাবে? স্বপ্নময়ী নামে একটি নাটক তিনি এমনিই লিখেছিলেন, ন্যাশনালের মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরী সেখানা পাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দ্বিধার কথা জানতে পেরে গিরিশবাবু একজন লোক মারফত খবর পাঠিয়েছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ওই নাটক ন্যাশনালকে অবশ্যই দিতে পারেন, এই নাট্যকার বিভিন্ন মঞ্চের জন্য নাটক লিখে দেবেন, এ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতাও তো মজার ব্যাপার।
স্বপ্নময়ীর মহড়া শুরু হয়ে গেছে এখানে। তবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অস্বস্তি কাটেনি। তাঁর চেনা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেকেই এ নাটকে নেই। নামভূমিকায় বিনোদিনী ছাড়া অন্য কোনও অভিনেত্রীকে কি মানাবে?
ন্যাশনালের মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরী, আর সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্টারের মালিক গুর্মুখ রায়, দু’জনেই মাড়োয়ারী। দুটি প্রধান বাংলা মঞ্চের মালিকানা মাড়োয়ারিদের হাতে। থিয়েটারেও যে একটা ব্যবসা এবং তার থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন করা যায়, এ বুদ্ধি বাঙালিদের মাথায় আসে না। দশ-বারো বছর আগেও কলকাতার নাট্যচর্চা ছিল ধনীদের শখের ব্যাপার। সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পর যখন টিকিট বিক্রি হতে লাগল, তখনও বাঙালি মালিকদের মাথা লাভ-ক্ষরিত ব্যাপারটা ঠিক চুকত না, প্রায় প্রতি রাতের টিকিট বিক্রির টাকা মদ্যপান ও আমোদ-প্রমোদে উড়ে যেত। প্রতাপচাঁদ জহুরী ন্যাশনালের মালিক হবার পর আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসেব কৰে এখন নিজের পকেটে টাকা ভরে। স্টারের মালিক গুর্মুখ রায় হোর মিলার কোম্পানির দালাল, টাকার হিসেব সেও ভালো বোঝে। নইলে অত টাকা খরচ করে সে নতুন মঞ্চ বানাবে কেন?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন প্রোসেনিয়ামের পাশে। দর্শক শূন্য অন্ধকার হলের সামনের সারির চেয়ারে বসে আছে দু’তিনজন, আর মঞ্চে রিহার্সাল দিচ্ছে তিনটি পুরুষ ও দুটি নারী। পুরুষদের মধ্যে মহেন্দ্রলাল বসু রয়েছে, সে বড় অভিনেতা, আর দু জন অচেনা। নারীদের মধ্যে একজন বনবিহারিনী, যার ডাক নাম ভুনি, এর গানের গলা ভারি সুরেলা। বনবিহারিণীর যথেষ্ট খ্যাতি হয়েছে এবং বিনোদিনীর সঙ্গে তার একটা প্রতিযোগিতার ভাব আছে, বিনোদিনী চলে যাবার পর সে এখন ন্যাশনালের প্রধানা নায়িকা। বনবিহারিণী পার্ট ভালোই করবে, কিন্তু বিনোদিনী যে এক একটা চরিত্রের মধ্যে ডুবে যেতে পারে তার সেই আবিষ্টভাবটি বনবিহারিণী কোথায় পাবে?
অন্য নারীটিকে দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চমকে উঠলেন। এ কে? মনে হচ্ছে যেন তেপান্তরের মাঠ থেকে এক শাকচুন্নিকে সদ্য ধরে আনা হয়েছে। গায়ের রঙ কালো হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু এর যে খড়ি ওঠা মুখ, পুরুষদের চেয়েও বেশি চ্যাঙা, মনে হয় একখানা বাঁশের গায়ে শাড়ি জড়ানো। নাটকের জন্য নতুন মেয়ে সংগ্রহ করা দুষ্কর। দল ভাঙার পর এই থিয়েটারে মেয়ে কমে গেছে, তাই সোনাগাছি থেকে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই নিয়ে এসেছে। এদের দিয়ে নাটক উৎরবে কী করে?
তবে একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার, হঠাৎ অর্ধেন্দুশেখরকে পাওয়া গেছে। অর্ধেন্দুশেখর গিরিশবাবুরই সমকক্ষ ও প্রতিভাবান বটে ও নাট্যশিক্ষক, কিন্তু বড়ই খেয়ালি। কখন যে কোথায় চলে যান, তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝে কলকাতা শহরেই তার পাত্তা পাওয়া যায় না। গিরিশবাবুর দলবল বিদায় নেবার পর এখানে যখন আনন্দমঠের রিহার্সাল চলছিল, তখন অর্ধেন্দুশেখর হঠাৎ এসে উপস্থিত। তখনসব ভূমিকাই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, অর্ধেন্দুশেখর নিলেন মহাপুরুষ চরিত্রটি। তাতে তিনি তেমন কিছু কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। এই স্বপ্নময়ী নাটকেও অর্ধেন্দুশেখরের উপযুক্ত কোনও ভূমিকা নেই। সিরিও-কমিক রোলে অর্ধেন্দুশেখরে প্রতিভা ঠিক খোলে।
ঐতিহাসিক নাটক, বাদশা আওরঙ্গজেবের আমলে শোভা সিং নামে এক ভুস্বামীর বিদ্রোহ এর বিষয়বস্তু। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার নাটকের কাহিনীর মধ্যে দেশপ্রেমের আদর্শ ছড়িয়ে দেন। পরাধীন জাতির কাছে নৗঢ্যমঞ্চ একটা বড় অস্ত্র। নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে স্বাদেশিকতার ভাবনা সঞ্চারিত করা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘পুরুবিক্রম’ আর ‘সরোজিনী’ নাটকে রয়েছে জ্বলন্ত দেশপ্রেমের আদর্শ। আরও অনেকে সেরকম নাটকই রচনা করছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ রাজসভার যুবরাজ সপ্তম এডোয়ার্ডের ভারত সফর উপলক্ষে সব গোলমাল হয়ে গেল!
সপ্তম এডোয়ার্ড ভারতের রাজধানী কলকাতায় কয়েকটা দিন কাটাবার পর কোনও হিন্দু পরিবারের অন্দরমহল পরিদর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। ভারতীয় নারীদের আচার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে তিনি আগ্রহী। হাইকোর্টের জুনিয়র সরকারী উকিল জগদানন্দ মুখুজ্যে অমনি আগ বাড়িয়ে যুবরাজকে তার ভবানীপুরের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে বসল। এক সন্ধে বেলা যুবরাজ দলবলে উপস্থিত হলেন জগদানন্দের বাড়িতে। সে বাড়ির মহিলারা শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে অভ্যর্থনা করল যুবরাজকে, চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বরণ করা হল। ঘোমটার আড়াল সরিয়ে যুবরাজ সেই সব নারীদের মুখ দেখতে চাইলেন, কথা বললেন। শুধু মালা বদলটাই বাকি রইল, একটি সোনার থালায় একছড়া হীরের মালা ও একখানি ঢাকাই ধুতি নজরানা পেল যুবরাজ।
সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে হ্যাংলামি ও হীনতাবোধ প্রকট। সরকারি উকিলের ডান হাত-বাঁ হাতের উপার্জন প্রচুর, কিন্তু একটা সরকারি খেতাব না পেলে সমাজে মান্যগণ্য হওয়া যায় না, তারই জন্য এই প্রয়াস। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের মহিলারা আর কোনও পুরুষকে কখনও অন্দরমহলে প্রবেশ করতে দেয়? তারা প্রায় অসূর্যাস্পশ্যা, পরপুরুষের কাছে কক্ষণও মুখ দেখায় না। স্লেচ্ছ যুবরাজকে দেখে বিগলিত হয়ে গেল! জগদানন্দের এই নির্লজ্জ চাটুকারিতায় অপমানিত বোধ করল সারা দেশ। হাইকোর্টের অন্যতম উকিল থিয়েটার চটপট নামিয়ে ফেলল এক প্ৰহসন, ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’! জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী নাটকের অভিনয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল সেই প্রহসন। কয়েকরাত পরে পুলিশ এসে সেই অভিনয় বন্ধ করে দিল। গ্রেট ন্যাশনালের কর্ণধার তখন উপেন দাস, তিনি অতি তেজস্বী পুরুষ, ভয় না পেয়ে, সেই প্রহসনের নাম বদল করে, ‘হনুমান চরিত্র’ নামে আবার মঞ্চস্থ করলেন। আবার পুলিশের হানা । অকুতোভয় উপেন্দ্রনাথ এবার পুলিশকেই একহাত নেবার জন্য ইংরেজিতে তৈরি করলেন এক প্রহসন “The Police Of Pig & Sheep”। তখন কলকাতার পুলিশ কমিশনারের নাম স্যার স্টুয়ার্ট হগ। আর এক পুলিশ সুপারের নাম মিঃ ল্যাম্ব! অপূর্ব মিল! এরপর থিয়েটারে শুরু হয়ে গেল পুলিশের হামলা, অন্য একটি নাটকের অভিনয়ের সময় একদল পুলিশ জুতো মশমশিয়ে মঞ্চে উঠে উপেন্দ্রনাথ ও আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল থানায়। বড়লাট লর্ড নর্থক্রুক সিমলা থেকে এই সব নাটকের অভিনয় বন্ধ করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এদেশের বহু মানুষের আপত্তি ও আপিল অগ্রাহ্য করে বছরের শেষে পাশ হয়ে গেল ড্রামাটিক পারফরমেন্সেস অ্যাক্ট। এই আইনবলে পুলিশ এখন যে কোনও নাটককে অশ্লীল কিংবা রাজদ্রোহমূলক ঘোষণা করে বন্ধ করে দিতে পারে।
এর ফলে বাংলা রঙ্গমঞ্চের মোড় ঘুরে গেল। মনঃক্ষুন্ন উপেন্দ্রনাথ দাস দেশত্যাগী হবার পর কেউ আর তেমন সাহস দেখাতে পারে না। এখন সব মঞ্চের নটিকেই থাকে শুধু ভাঁড়ামি অথবা ভক্তিরসের প্রাবল্য। গিরিশবাবু নিজে আগে নাটক লিখতেন না, অন্যের কাহিনীর নাট্যরূপ দিতেন, এখন তিনি পৌরাণিক বিষয়বস্তু থেকে নিজেই নাট্য রচনা শুরু করেছেন। প্রায় প্রতি মাসে লিখে ফেলছেন এক একখানা নাটক। সাধারণ দর্শকরা হঠাৎ রামায়ণ মহাভারতের বাহিনীতে আকৃষ্টও হচ্ছে খুব। তার লেখা ‘সীতার বনৰাস’ নাটকে লব ও কুশের ভূমিকায় বিনোদিনী আর কুসুমকুমারীর করুণ অভিনয় দেখে দর্শকরা কেঁদে ভাসিয়েছে। লব-কুশের এই জনপ্রিয়তা দেখে উৎফুল্ল মঞ্চ মালিক ধুরন্ধর ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ গিরিশবাবুকে বলেছিলেন, বাবু, যব দুসরা কিতাব লিখোগে, তব ফিন ওহি দুনো লেড়কা জোড় দেও! সেই অনুরোধ এড়াতে না পেরে গিরিশবাবু আবার লিখলেন ‘লক্ষণ বর্জন’।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর এই নাটকটিতে একটি প্রেমের গল্পের মোড়কে সূক্ষ্মভাবে দেশপ্রেমের কথা জুড়ে দিতে ভোলেননি। প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শোভা সিং-এর মতন এক ক্ষুদ্র জমিদারও বিদ্রোহ করতে পারে। এই বিদ্রোহের মনোভাবটি যদি দর্শকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, সেইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু নাটকের রিহার্সাল দেখে তিনি আঁতকে আঁতকে উঠতে লাগলেন।
ড্রেস রিহার্সাল নয়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেমন তেমন ভাবে পার্ট বলে যাচ্ছে। শোভা সিং-এর ভূমিকায় মহেন্দ্রলাল এখন পরে আছে একটা লুঙ্গি ও ফতুয়া, হাতে হুঁকো। মাঝে মাঝে তলোয়ার তোলার ভঙ্গিতে সেই হুঁকোটাই উঁচু করে তুলছে, ছিটকে পড়ছে আগুন। বনবিহারিণীর হাতে মদের গেলাস, অভিনয়ের দিনেও দুএক ঢোঁক না খেয়ে সে মঞ্চে নামতে পারে না। বনবিহারিণীর শরীরে যৌবন বিদায় জানাতে চলেছে বলেই সে যৌবনকে আরও প্রকট করে তুলতে চায়। গরমের অজুহাতে সে সেমিজ পরেনি, শরীরে শুধু একটা শাড়ি জড়ানো, আঁচল খসে পড়ছে বার বার।
বনবিহারিনী বলছে, কে আসে? কার পদশব্দ শোনা যায়!
তাঁর সঙ্গে নতুন মেয়েটি বলল, ঘোড় দুঃছময়! ধেয়ে আসে সত্ত্বর পক্ষ, রাছি রাছি ছানা।
বনবিহারিনী তীক্ষ্ণভাবে হিহিহিহি করে হেসে উঠল বলল, ছ্যানা কি লা? সেনা, বল সেনা! রাশি রাশি সেনা!
মেয়েটি বলল, ছ্যানাই তো বলছি! ছ্যানা!
মহেন্দ্রলাল বলল, ছানা দিয়ে রসগোল্লা বানাবি নাকি? এ দিয়ে তো যুদ্ধ হবে না!
বনবিহারিনী বলল, এরপর আছে, শুভ কুসুমের মত শিশুগুলি, তা কী করে বলবি?
মেয়েটি বলল, এই তো বলছি, দেখ না। সুভভর কুছুমের মত ছিছুগুলি, কী হয়নি?
বনবিহারিনী বলল, তোর হিরোইন হওয়া আটকায় কে? ও সাহেব, একে আরও বড় পার্ট দাও!
অডিটোরিয়ামে প্রথম সারিতে বসে আছেন অর্ধেন্দুশেখর। তিনি সহাস্যে বললেন, তা হলে আর একটা নাটক বাছতে হয়, যাতে শ কিংবা স নেই একটাও।
প্রতাপচাঁদ বলল, এই লাটক ফিফটি পার্সেন্ট তৈয়ার হো গয়া। এটা কেন বাদ যাবে? রাইটারবাবুকো বোল দিজিয়ে, সব ডায়ালোগ থেকে সো আর সো উতার দেবে। আভি দুসরা লেড়কি কাহা সে মিলে গা?
বনবিহারিণী উইংসের দিকে তাকিয়ে বলল, ওই তো রাইটারবাবু এসে গেছেন। ঠাকুরবাবু!
তরতর করে ছুটে এসে সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হাত ধরে নিয়ে এল মঞ্চের মাঝখানে। তারপর অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ঠাকুরবাবু, আপনি আমার পার্টে এখনও গান লিখে দিলেন না! কবে আর আমি গান তুলব? এক হণ্ডা মোটে আর সময় আছে। প্রতাপচাঁদ উঠে দাঁড়িয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে সম্মান দেখিয়ে বলল, নমস্তে, ঠাকুরবাবু, নমস্তে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, আপনি আমার নাটকের ডায়ালগ থেকে সমস্ত স আর শ তুলে দিতে চান? তা হলে এ প্লে বন্ধ রাখুন!
অর্ধেন্দুশেখর হো-হো করে হেসে উঠলেন। প্রতাপচাঁদ জিভ কেটে বলল, আরে রাম রাম। ওটা কোথার কোথা! আপনি সিরিয়াস মানলেন? আপনার প্লে ঠিক যেমন আছে, তেমুন হবে, একটা ডায়ালগ বাদ যাবে না। এ মাগীটাকে দিয়ে টেরাই করছিলাম, ওকে চাকরানির পার্ট দিন, আউর দুসর মাগী আসবে।
ভুল উচ্চারণ শুনলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রায় শারীরিক কষ্ট হয়। উচ্চারণ শুদ্ধ করার জন্যই তিনি ঘন ঘন মহড়া দেখতে আসেন। অর্ধেন্দুশেখরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, সাহেব, প্রোনানসিয়েশন ঠিক না হলে সংলাপের রস নষ্ট হয়ে যায়।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, যতটা সম্ভব দেখব। এ ছুড়িটাকে দিয়ে চলবে না।
প্রতাপচাঁদ বলল, ঠাকুরবাবু, আপনার প্লে-টাতে দো-তিনটো নাচ জোড়কে দিজিয়ে না! ভুনি বহুৎ আচ্ছা নাচ দেখাতে পারে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ওর চরিত্রে নাচ মানাবে না। নাটক আরম্ভের আগে আপনি যত ইচ্ছে সখীদের নাচ দিন। বনবিহারিণীর জন্য কয়েকখানা গান আমি লিখে দেব।
বনবিহারিণী আদুরে গলায় বলল, খুব ভালো গান চাই কিন্তু! আহা, কী অপূর্ব গান লিখেছিলেন, জ্বল জ্বল চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ।
বনবিহারিণী গানটা গেয়ে উঠতেই অর্ধেন্দুশেখর ধমক দিয়ে বললেন, আই, থাম। পরের সিনটা শুরু কর। রিহার্সাল দিতে দিতে রাত ভোর করবি নাকি?
এরপর মহেন্দ্রলাল এবং বনবিহারিণী এই দু’জনে শুধু সংলাপ বলতে লাগল। দু’জনেই অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, যে কোন ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারে। তবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে হল নাম ভূমিকায় বিনোদিনীকে পেলে নাটকটি আরও প্রাণবন্ত হতে পারত। কিন্তু বিনোদিনী এখন স্টারে, আর স্টার থিয়েটার তাঁর নাটক নেবে না। গিরিশবাবু এখন নিজেই সবেগে এত নাটক লিখছেন যে, অন্য কোনও নাট্যকারের আর মুখাপেক্ষী নন তিনি। একটা দৃশ্য শেষ হবার পর অর্ধেন্দুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন, জ্যোতিবাবু?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আমতা আমতা করে বললেন, ঠিক আছে, এমনিতে বেশ ভালোই হচ্ছে, তবু একটা জিনিসের যেন অভাব। ফরাসি ভাষায় যাকে বলে Jolie de vivre, মানে জীবনের একটা উচ্ছ্বলতা।
মহেন্দ্রলাল বলল, ও জন্য ভাববেন না। ও আমরা ঠিক স্টেজে মেরে দেব।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জামার পকেট থেকে একটা গোল সোনার ঘড়ি বার করে ডালা টিপে দেখলেন। রাত নটা দশ। এবার তাঁকে বাড়ি ফিরতে হবে।
প্রতাপচাঁদ একটা খুব জরুরি গোপন কথা জানাবার ভঙ্গিতে বলল, ঠাকুরবাবু, হামি একটা প্ল্যান করেছি। স্টারে গিরিশবাবুকা ‘দকষ জগিয়া’ প্লে-টা ইতনা সাকসেসফুল হল কেন জানেন? সাহেববাবুসে শুনে লিন।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, গিরিশ ওর দক্ষযজ্ঞ স্টেজে নামাবার আগে কী করেছে জানেন? ইদানীং ও তো খুব ঠাকুরদেবতার ভক্ত হয়েছে! আগে ছিল ঘোর নাস্তিক, এখন সৰ্বক্ষণ ‘মা, মা’ করে। তা ওরা ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকের ড্রেস রিহার্সাল দিয়েছে কালীঘাটে। একদিন রাত্তিরে নাটমন্দির খালি করে দক্ষযজ্ঞের ড্রেস রিহার্সাল হল, প্রধান দর্শক মা কালীর মূর্তি। প্রতাপচাঁদ-এর ধারণা হয়েছে, ওই জন্যই ‘দক্ষযজ্ঞ’ এত জমে গেছে।
প্রতাপচাঁদ বলল, কালী মাইজির আশীরবাদ! হামিও ঠিক করেছি আপকা ইয়ে যে অসসুরমতী প্লে, এর ডেরেস রিহারসাল হবে ওই কালী মাঈয়ের সামনে, নাটমন্দিরে!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ করে রইলেন। বাংলা নাটক এ কোন দিকে যাচ্ছে? মাটি-পাথরের তৈরি একটা কালীমূর্তির সামনে অভিনয়। তিনি আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সম্পাদক, তিনি এটা কিছুতেই মানতে পারবেন না। তিনি বললেন, শেঠজী, আমি এতে রাজি নই! ন্যাশনাল থিয়েটারের স্টেজে আমার নাটক অভিনয়ের চুক্তি হয়েছে, কালীঘাটের নাটমন্দিরের জন্য নয়। আপনার যদি সেরকম ইচ্ছে থাকে, তা হলে আপনি আমার নাটক বন্ধ করে অন্য নাটক ধরুন।
অন্য কোনও নাট্যকার থিয়েটার-মালিকের মুখের ওপর এমনভাবে কথা বলতে পারে না। তারা সবাই অনুগ্রহ প্রত্যাশী। কিন্তু টাকা-পয়সার তোয়াক্কা করেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
তাঁর সেই দৃঢ়তাপূর্ণ কণ্ঠস্বর ও কঠোর মুখভঙ্গ দেখে চুপসে গেল প্রতাপচাঁদ। মিনমিনে গলায় সে বলল, নেহি নেহি, আপনি আপত্তি করবেন তো ঠিক আছে, ওসব কিছু হবে না। আপনি বড় রাইটার, আপনার প্লে এমনিতেই জমে যাবে।
ওদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর মনটা খচখচ করতে লাগল। ন্যাশনালের দলটার যেন কোমর ভেঙ্গে গেছে। তার নাটক এরা সাৰ্থক করতে পারবে কিনা সন্দেহ।
গেটের বাইরে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজের গাড়িতে উঠতে যাবেন, এমন সময় মস্ত বড় একটা টমটম গাড়ি থামল একটু দূরে। তার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে গিরিশ ঘোষ বলল, জ্যোতিবাবু যে, নমস্কার, নমস্কার! কেমন চলছে মহড়া?
সেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। গিরিশবাবু ছাড়া, বিনোদিনী এবং আর একজন পুরুষ বসে আছে তার মধ্যে। বিনোদিনীও জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নমস্কার জানাল।
অন্য যে একজন বসে আছে, তার বয়েস আঠেরো-উনিশের বেশি নয়। মাথায় পাগড়ি, গলায় মুক্তোর মালা। মুখখানা এমনই কচি যে, মনে হয় একটি শিশুকে বয়স্ক ব্যক্তি সাজানো হয়েছে। তার পরিচয় শুনে জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ রীতিমতন বিস্মিত হলেন। এই-ই গুর্মুখ সিং? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুনেছিলেন বটে যে, এক ধনাঢ্য মাড়োয়ারি যুবক বিনোদিনীকে রক্ষিতা হিসেবে পাবার শর্তের স্টার থিয়েটার গড়ার জন্য প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু তার বয়েস এত কম!
গঙ্গার ধারের এক বাড়িতে আজ গান-বাজনার আসর বসবে, বিনোদিনী সেখানকার প্রধান গায়িকা। গিরিশবাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেও সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাজি হলেন না, তবু পেড়াপোড়ি করতে লাগলেন গিরিশবাবু। তিনি বেশ খানিকটা নেশা করেছেন, জড়িত কণ্ঠে বললেন, শত্রুপক্ষকে আপনার নাটক দিয়েছেন বলে কি আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বও থাকবে না। চলুন, খানিকক্ষণ অন্তত বসবেন!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তাঁর গাড়িতে এসে উঠে বসলেন গিরিশবাবু, দুটি গাড়ি ছুটল গঙ্গার দিকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাড়ি ফেরা হল না।