1 of 2

২৫. সিঁদুরিয়াপট্টিতে একবার

সিঁদুরিয়াপট্টিতে একবার এক ধনীর পোষা হনুমান শয়নকক্ষ থেকে চুপিসারে একটি পেটিকা নিয়ে চিলের ছাদে উঠে পড়ে। সে ভেবেছিল, অতি সযত্নে রক্ষিত এ পেটিকায় নিশ্চিত কোনও দুর্লভ সুখাদ্য আছে। কিন্তু পেটিকাটি খুলে তার আর নৈরাশ্যের অবধি থাকে না, ভেতরে রয়েছে শুধু গুচ্ছ গুচ্ছ শুষ্ক, অখাদ্য কাগজ। পরম অবজ্ঞা ভরে হনুমানটি সেই কাগজগুলি বাতাসে ওড়াতে তাকে। বলাই বাহুল্য, সেগুলি সব একশো টাকার নোট। সেই উড়ন্ত মুদ্রা সংগ্ৰহ করার জন্য পথচলিত জনতার হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, কড়াকাড়ি এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যে, শৃঙ্খলা ফেরাবার জন্য পুলিশ বাহিনী এসে পড়ে। সেই বাহিনীর মধ্যেও কেউ কেউ যে, কর্তব্য ভুলে দু’চারখানা নোট পকেটস্থ করায় ব্যাপৃত হয়নি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

টাকা ওড়ানো কথাটা সেই থেকে চালু হয়ে যায়। মনুষ্য শ্রেণীভুক্ত কেউ কেউও ওই হনুমানটির অনুকরণ করে। ইদানীং গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নামে এক মাড়োয়ারিনন্দনের রকম সকমও ওই প্রকার। তার বাবা গণেশদাস মুসাদ্দি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং হোর মিলার কোম্পানির প্রধান দালাল। পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর আঠেরো বছরের ছেলে গুর্মুখ বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। টাকার মূল্যই যেন সে বোঝে না, দু হাতে টাকা ছড়িয়েই তার আনন্দ। ইয়ার-বক্সি-মোসাহেবও জুটে গেল যথারীতি। সন্ধের পর তারা সারা শহর মাতিয়ে বেড়ায়।

ইদানীং থিয়েটার-নাটকের খুব রমরমা। গুর্মুখ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে প্রায়ই থিয়েটার দেখতে আসে। তারা সংখ্যায় দশ-বারোজন হলেও টিকিট কাটে পঞ্চাশখানা। সামনের দু’সারিতে কেউ বসবে না, তারা ইচ্ছেমতন পা তুলে দেবে, নেশার ঝোঁকে আধশোওয়া হবে, যখন তখন বিকট চিৎকার করবে।

গিরিশচন্দ্রের ‘সীতাহরণ’ নাটকটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন অভিনয়, গান, তেমনই চমকপ্রদ দৃশ্য। মঞ্চশিল্পী ধর্মদাস সুর পুষ্পক রথে চেপে রাবণের শূন্যপথে গমন পর্যন্ত দেখিয়ে দিলেন। পুষ্পক রথে সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে রাবণ, সীতার ভূমিকায় বিনোদিনী এক একখানি ফুলের গহনা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, এক সময় মনে হয় সীতা যেন সম্পূর্ণ নিরাবরণ। সুরামত্ত অবস্থায় গুর্মুখ চেঁচিয়ে উঠল, ওই আওরতের কত কিস্মত? ওকে আমার চাই!

তার এক বয়স্য বলল, ওদিকে হাত বাড়িয়ো না, বাওয়া! ও আওরত আগুনের খাপরা। ছুঁতে গেলেই হাত পুড়ে যাবে।

পরের নাটক পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে বিনোদিনী দ্রোপদী। একই নারীর কতরকম রূপ! গুর্মুখ অত অভিনয়-টভিনয় বোঝে না। নাটকের ভাবগর্ভ ভাষাও তার মর্মে প্রবেশ করে না, সে বিনোদিনীকে দেখতে বারবার আসে। এবং দুরন্ত বালকের মতন আবদার ধরে, ওই আওরতকে আমার চাই!

কিন্তু তার সঙ্গীরা সকলেই জানে, এই ছলা-কলাময়ী নারী এক প্রভাবশালী ধনীরা রক্ষিতা, নিছক টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে তাকে ভাঙিয়ে আনা যাবে না।

একদিন গুর্মুখ আর তার দলবল নাটক শুরু হয়ে যাবার পর এসে টিকিট চাইল। সে দিন সব আসন পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু গুর্মুখ সে কথা মানবে কেন? গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা বার করে ফরফর করে ছড়াতে ছড়াতে সে চ্যাঁচ্যাতে লাগল, টিকিট লাও! টিকিট লাও! সেই সন্ধ্যায় তাদের নেশার পরিমাণ বেশিই হয়েছিল, ভেতরে ঢুকে এসে তারা এমন হট্টগোল শুরু করে দিল যে, অভিনয় বন্ধ হবার উপক্রম। ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরীর এই বেলেল্লপনা সহ্য হল না। তিনি দারোয়ানদের হুকুম দিলেন ওদের বার করে দেবার জন্য।

এক দারোয়ান গুর্মুখের গায়ে হাত দিতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। প্রতাপচাঁদের এতখানি সাহস যে, বড়তলার কাপ্তান গুর্মুখ সিংয়ের অপমান করে! কত টাকা দাম এই থিয়েটারের, আজই সে এই থিয়েটার কিনে নেবে!

সেদিন বিতাড়িত হল বটে, কিন্তু গুর্মুখ নিজস্ব থিয়েটারের মালিক হবার জন্য গো ধরে রইল। সে ন্যাশনালের চেয়েও অনেক ভালো থিয়েটার বানাবে, ওদেরটা তো কাঠের বাড়ি, সে নির্মাণ করবে পাকা ইমারত। কিন্তু থিয়েটার মানে তো শুধু একটা নাট্যশালা নয়, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীদেরও দরকার। সর্বোপরি চাই বিনোদিনীকে।

সেই যোগাযোগও ঘটে গেল আকস্মিকভাবে।

ন্যাশনালের মালিক প্রতাপচাঁদের সঙ্গে বিনোদিনীর বনিবনা হচ্ছিল না। বিনোদিনীর নামে টিকিট বিক্রি হয়, প্রতিটি ভূমিকা নিখুঁত করার জন্য বিনোদিনী প্রাণ দিয়ে খাটে, কিন্তু সে তুলনায় মালিকের কাছে বিনোদিনীর খাতির নেই। মাঝখানে বিনোদিনী এক মাসের ছুটি নিয়ে তার বাবুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল, প্রতাপচাঁদ বলে কিনা, সেই এক মাসের মাইনে সে দেবে না বিনোদিনীকে। কাজ না করলে আবার মাইনে কিসের। তা শুনে দর্পের সঙ্গে বিনোদিনী বলল, বেশ, তবে আমি চললাম! সেই দণ্ডেই সে সাজপোশাক খুলে রঙ্গালয় ত্যাগ করতে উদ্যত হল। এদিকে সেকেন্ড বেল পড়ে গেছে, অবিলম্বে নাটক শুরু হবার কথা। খবর পেয়ে কীচকবেশি গিরিশ ঘোষ পথ আটকে বললেন, বিনোদ, তুই সাজ পরেও সেই সাজ খুলে চলে যাবি? যাওয়াটা অন্যায্য নয়। কিন্তু দর্শকরা কত আশা করে এসেছে, তারা তোর অভিনয় দেখতে এসেছে, তাদের বঞ্চিত করবি তুই? তারা তো কোনও দোষ করেনি!

গুরুবাক্য অগ্রাহ্য না করে আবার সাজল বিনোদিনী। সে রাত্রে শেষ যবনিকা পতনের পর গিরিশবাবু এসে বিনোদিনীর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ওরে বিনোদ, আজ তোর অভিনয় আগেকার সব দিনকে ছাড়িয়ে গেছে। আহত ফণিনীর মতন তোর তেজ প্ৰকাশ পাচ্ছিল!

গিরিশবাবু এবং আরও অনেকেও অবশ্য প্রতাপচাঁদের ওপর খুশি ছিল না। প্রতাপচাঁদ ধুরন্ধর ব্যবসায়ী, সম্প্রতি প্রচুর লাভ হলেও নট-নটীদের পারিশ্রমিক বাড়াতে সে রাজি নয়, এই নিয়ে মন কষাকষি চলতে চলতে গিরিশবাবু একদিন সদলবলে ন্যাশনাল মঞ্চের সংস্রব পরিত্যাগ করলেন। গুর্মুখ রায় যে নতুন থিয়েটার বানাতে চায়, সে সংবাদও তার কানে এসেছিল।

গুর্মুখ এদের সকলকেই নিতে রাজি, আধুনিক উপকরণে রঙ্গালয় নির্মাণে যত টাকা লাগে, সবই দিতে সে প্রস্তুত, কুশীলবদের পারিশ্রমিকও হবে দ্বিগুণ, কিন্তু তার একটি শর্ত আছে। বিনোদিনীকে তার রক্ষিতা হতে হবে।

এ অতি কঠিন শর্ত!

থিয়েটারের মেয়েরা বারবণিতাদের ঘর থেকে আসে। তাদের প্রত্যেকেরই একজন বাঁধা বাবু থাকে, আবার বেশি টাকার প্রস্তাব এলে বাবু বদলও হয়, এমন কিছু নতুন কথা নয়। নৃত্যগীত পটীয়সী এই সব শয্যাসঙ্গিনী করার জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে কিছু কিছু ধনী সন্তান। বিনোদিনী যেখানেই অভিনয় করতে গেছে, সেখানেই এমন ঘটছে। একেবার লাহোরে গোপাল সিং নামে এক জমিদার মঞ্চে বিনোদিনীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রায় জোর করেই তাকে উপপত্নী বানাতে চায়। সেবারে গোপনে লাহোর ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়।

বিনোদিনী বর্তমান রক্ষক এক বিশিষ্ট বাঙালি জমিদার বংশের সন্তান। সবাই তাকে চেনে, কিন্তু পাছে তার বংশের সম্ভ্রম ক্ষুণ্ণ হয়, তাই কেউ তার নাম উচ্চারণ করে না; তাকে অ-বাবু বলে উল্লেখ করা হয়। এই অ-বাবুর যেমন টাকা খরচের কার্পণ্য নেই, তেমনি বিনোদিনীর প্রতি ব্যবহারও অতি ভদ্র। সে থিয়েটার নিয়ে মাথা ঘামায় না, থিয়েটারের লোকজন ডেকে বাড়িতে মদের আসরও বসায় না। বিনোদিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা নিভৃত।

সেই অ-বাবুকে বিনোদিনী ত্যাগ করবে কী করে? বারবণিতাদেরও নীতিবোধ থাকে। অ-বাবু কোনও অন্যায় করেনি, বিনোদিনীর প্রতি সামান্য অনাদরও দেখায়নি। অ-বাবু কিছুদিনের জন্য কলকাতার বাইরে গেছে, এর মধ্যে এল গুর্মুখের এই প্রস্তাব।

নিজস্ব একটি নতুন রঙ্গমঞ্চ গড়ার জন্য গিরিশ-অমৃতলালদের উৎসাহের অবধি নেই, নকশা তৈরি হয়ে গেছে, বিডন স্ট্রিটেই কীর্তি মিত্তিরের জমি লিজ নেবার বন্দোবস্ত একেবারে পাকা, কিন্তু গুর্মুখের ওই শর্তটিই হল প্রধান বাধা। বিনোদিনী রাজি হতে পারে না। গুর্মুখের জেদ, তা হলে সে থিয়েটার বানাবে না।

গিরিশ-অমৃতলাল ও অন্যান্য সমস্ত নট-নটীরা বিনোদিনীকে ধরে বসল। বিনোদিনীর ওপরেই সব কিছুর নির্ভর করছে, নিজস্ব একটি রঙ্গমঞ্চ পাবার এমন একটা সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। গিরিশবাবু বললেন, বিনোদ, থিয়েটারের জন্যই লোকে তোকে চেনে, মঞ্চেই আমরা অ-সাধারণ, মঞ্চের বাইরে আমরা কেউ না। সেই থিয়েটারের জন্য তুই এইটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবি না! অন্য একজন বলল, অ-বাবুর ওপর তোর এত দায় কিসের? সে মুখে তোকে অত সোহাগ জানায়, যেন তোকে বই আর কারুকে জানে না, কিন্তু সে এখন কলকাতার নেই কেন? তোকে না জানিয়ে চুপি চুপি বিয়ে করতে গেছে।

গুর্মুখ সিংহ বিনোদিনীর চেয়েও বয়সে ছোট, বিকৃত উৎকটে তাঁর স্বভাব। সবাই মিলে বিনোদিনীকে তাঁর শয্যায় পাঠাতে চায় একটি নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ পাবার বাসনায়। এতদিনের সহচর-সহচরীদের কাত অনুনয়-বিনয় আর এড়াতে পারল না বিনোদিনী, সে বাধ্য হয়ে সম্মতি জানিয়ে দিল।

খবর পেয়ে কলকাতায় ছুটে এল অ-বাবু। বিনোদিনীকে সে কিছুতেই ছাড়বে না। টাকার জোর আছে বলেই কেউ বিনোদিনীকে কেড়ে নেবে? নিজের জমিদারি থেকে লাঠিয়াল আনিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে রাখল, বিনোদিনীর সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারবে না। গুর্মুখ রায়ওঁ কম যায় কিসে। সে জমিদার না হলেও কলকাতা শহরের ভাড়াটে গুণ্ডা-ঠ্যাঙাড়ের অভাৰ আছে? গুর্মুখ নিযুক্ত একদল গুণ্ডা জোর করে বিনোদিনীকে ছাড়িয়ে আনতে গেল, শুরু হয়ে গেল মারামারি, রক্তপাত। তারপর পুলিশের হাঙ্গামা। ট্রয়ের হেলেন কিংবা মিশরের ক্লিয়োপেট্রাকে নিয়ে যেরকম রক্তক্ষয়ী সংঘৰ, তারই ছোটখাট সংস্করণ এখনও বহু জায়গায় ঘটে যাচ্ছে।

এই সব ডামাডোলের মধ্যে গিরিশ-সম্প্রদায় বিনোদিনীকে সরিয়ে নিয়ে গেল এক অজ্ঞাত স্থানে অতি ঘনিষ্ঠ দু’-চারজন ছাড়া কেউ তার সন্ধান জানে না। দ্রুতগতিতে থিয়েটার ভবনের নির্মাণকার্য চলছে, নিজেদের দল গড়ার উত্তেজনায় সবাই অধীর, নতুন নাটক নামাতে হবে এবং বিনোদিনী অভিনয় না করলে দর্শকদের ব্যাকুল করা যাবে না।

গিরিশচন্দ্র ‘দক্ষযজ্ঞ’ নামে দ্রুত নাটক লিখে ফেলেছেন, গোপনে গোপনে বিনোদিনীকে এনে অন্য একটি বাড়িতে মহড়া চলছে। স্বয়ং গিরিশচন্দ্র দক্ষ, আর সতীর ভূমিকায় বিনোদিনী যেন সতীত্বের প্রতিমূর্তি।

একদিন মহড়া থেকে ফিরে এসে বিনোদিনী ভার অজ্ঞাতবাসের স্থানে ঘুমোচ্ছে, ডোরের দিকে তার শয়নকক্ষের দরজা সশব্দে খুলে গেল। কাঁচা ঘুম ভেঙে বিনোদিনী দেখল, জুতো মশমশিয়ে সে ঘরে ঢুকছে অ-বাৰু। একেবারে যোদ্ধৃবেশ, কোমরে ঝুলছে তলোয়ার, ক্রোধে গনগনে মুখ। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল, এত ঘুম কেন, মেনি।

বিনোদিনী ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই অ-বাৰু একগোছা টাকা বার করে বলল, মেনি, তুমি কিছুতেই ওই মর্কটটার কাছে যেতে পারবে না। ওই সব থিয়েটারের বাজে লোকদের সংসৰ্গও তোমাকে ছাড়তে হবে। তোমার জন্য যদি ওদের কিছু টাকা খরচ হয়ে থাকে, এই নাও দশ হাজার। দিয়ে সকলকে ভাগাও!

বিনোদিনী বলল, না, তা আর হয় না! আমি ওদের কথা দিয়েছি। থিয়েটারের বন্ধুদের আমি ছাড়তে পারব না।

অ-বাবু অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, কথা দিয়েছ, টাকা দিয়ে চুকিয়ে দাও। দশ হাজারে না কুলোয় আরও দশ হাজার দিচ্ছি।

এবার বিনোদিনীর আঁতে ঘা লাগল। এরা শুধু টাকা চেনে। এরা মনে করে, টাকা দিয়ে মানুষকেও কেনা যায়। সে তেজের সঙ্গে বলল, রাখো তোমার টাকা! টাকা আমি উপার্জন করেছি, টাকা আমায় উপার্জন করেনি। ভাগ্যে থাকে, অমন দশ-বিশ হাজার টাকা আমার কাছে যেতে আসবে। তুমি যাও, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। থিয়েটার আমার ধ্যান-জান, আমি থিয়েটার ছাড়তে পারব না।

অ-বাবুর শরীরটা যেন মশালের মত জুলে উঠল। ধাপ থেকে তলোয়ার খুলে সে বলল, বটে! ভেবেছিস, তোকে আমি অত সহজে ছেড়ে দেব। আজ তোকে এখানে কেটে রেখে যাব!

সেই উদ্যত তলোয়ারের সামনে বিনোদিনী ভাবল, তার উনিশ বছরের জীবনের এখানেই শেষ!

প্রচণ্ড জোরে কোপ পড়ার শেষ মুহূর্তে বিদ্যুগতিতে মাথা সরিয়ে নিল বিনোদিনী। পাশের একটা হারমোনিয়ামে সে কোপ পড়ে গেঁথে গেল দুইঞ্চি। আবার তলোয়ারটা ছাড়িয়ে নিতে মারতে যেতেই বিনোদিনী হরিণীর মতন ছুটতে লাগল সারা ঘরে, অ-বাবু উন্মত্তের মতন কোপ দিতে লাগল যেখানে সেখানে।

কোনওক্রমে একবার বিনোদিনী অ-বাবুর একেবারে সামনে এসে পড়ে তার হাত চেপে ধরে বলল, ওগো, তুমি এ কী করছ। আমাকে মারতে চাও মারো, আমার এই কলঙ্কিত জীবন গেল বা রইল তাতে ক্ষতি কি! কিন্তু তোমার যে হাতে দড়ি পড়বে! খুনের দায়ে তুমি…

অ-বাবু চিৎকার করে বলল, বিশ হাজার টাকা দিয়ে উকিল-সোভার লাগাব, যা হয় হবে। কিন্তু তোকে যেতে দেব না।

বিনোদিনী বলল, আমি সামান্য এক নারী এক ঘৃণিত বারাঙ্গনা আমার জন্য সব খোয়াবে? তোমার বংশের সুনামের কথা ভাবো। একবার পরিণামের কথা ভাবো!

অ-বাবু এবার তলোয়ারটা দুরে ছুড়ে ফেলে দিল, খাটের ওপর বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে আঃ আঃ শব্দে কাতর চিৎকার করতে লাগল।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল বিনোদিনী। একজন মানী লোকের এই কাতরতা সহ্য করা যার না। একবার সে ভাবল, কাছে গিয়ে অ-বাবুর মাথায় হাত দিয়ে বলবে, ওগো আমার ঘাট হয়েছে। আর আমি ওদের কাছে যাব না, তোমার অবাধ্য হব না। তুমি আমাকে নিরে চল।

পরমুহূর্তেই মনে পড়ল মঞ্চের কথা। বন্ধুদের কথা, গুরুর কথা। ফুটলাইটের খেলা, এক একরকম পোশাকে এক একরকম চরিত্র, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ দৰ্শকের হাততালি। তার চোখে জল এসে গেল।

একটু পরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে কয়েক পলক এক দৃষ্টে তাকিরে রইল অ-বাবু। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, নিয়তি। যা মেনি, তোকে আজ থেকে আমি মুক্তি দিয়ে গেলাম!

সেদিন থেকে বিনোদিনীর বিবেকযন্ত্রণা অনেক কমল বটে, কিন্তু অন্যদিক থেকে আবার দেখা দিল জটিলতা।

গুর্মুখ রায়ের মাথার ঠিক নেই, যখন তখন যত বদলায়। নতুন থিয়েটারের পরিচালনা পদ্ধতি বিষয়ে গিরিশবাবুদের সঙ্গে সামান্য মতান্তর হতেই একদিন সে বিনোদিনীর কাছে দপদপিয়ে এসে বলল, দেখ, বিনোদ, আমি স্রিফ তোমাকে চাই। ওসব থিয়েটার-ফিয়েটারের ঝাঞাট যাওয়ার দরকার কী? সব বন্ধ করে দিচ্ছি। আমি তোমাকে পঁচাশ হাজার রূপিয়া দেব। তুমি আমার হয়ে যাও।

ঘরে বিনোদিনীর এক মাসি তখন উপস্থিত। তার চক্ষুদুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্ৰম! পঞ্চাশ হাজার টাকা, অর্থ লক্ষ মুদ্রা! এ যে স্বপ্নের অতীত। গুই টাকায় কলকাতা শহরে বড় বড় পাঁচ ছ’খানা বাড়ি কেনা যার। বারবণিতার রূপ যৌবন আজ আছে, কালও যে থাকবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। রূপ-যৌবন ফুরিয়ে গেলে এই সব পুরুষেরা পা দিয়েও ছোবে না।

মাসি বিনোদিনীর হাত চেপে ধরল। অত টাকার প্রস্তাব শুনে বিনোদিনীও সহসা কোনও উত্তর দিতে পারল না।

এই প্রস্তাবের কথা গিরিশবাবুদের কানে গেলে সকলের মাথায় হাত পড়ল। এতদূর এগিয়েও সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।নিজেদের নতুন রঙ্গমঞ্চ হবে না। এক খেয়ালি ধনীর দুলাল বিনোদিনীকে হরণ করে নিয়ে যাবে শুধু না, এই নতুনত্ব প্রয়াসী নাট্যদলের স্বপ্নও ধূলিসাৎ করে দিয়ে যাবে।

সবাই মিলে বোঝাতে লাগল বিনোদিনীকে। অমৃতলাল বিনোদিনীর দু’হাত ধরে অভ্র ভারাক্রান্ত গলায় বলতে লাগল, তুই শুধু নিজের কথা ভাববি বিনোদ? আমাদের কথা, নাটকের কথা ভাববি না?

গিরিশবাবু আগাগোড়া চুপ করে ছিলেন। এক সময় কশাঘাতের মতন তীব্র বিদ্রূপের সঙ্গে বললেন, থাক, ও যদি রাজি না হয়, ছেড়ে দে। থিয়েটার হবে না তো হবে না! স্টেজে যে হিরোইন, হাজার হাজার অডিয়েন্স যাকে ভালোবাসত, সে যদি সাধারণ বেশ্যার মতন একজনের কাছে বাধা থাকতে চায় তো থাক। লোকে ওর নাম ভুলে যাবে। কালে কালে ও বাড়িউলি মাসি হবে!

বিনোদিনী তখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। গিরিশবাবুর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, আমি কোনওদিন থিয়েটার ছেড়ে যাব না ওগো, তোমরা এখনই বাবুটিকে ডাকো! আমার উত্তর জানিয়ে দিচ্ছি।

গুর্মুখ এলে সবার সামনে বিনোদিনী পরিষ্কার কণ্ঠে তাকে বলল, অগো বাবু, আমি থিয়েটারের মেয়ে। থিয়েটার ছাড়া বাঁচব না। তুমি যদি থিয়েটারের বাড়ি গড়ে দাও, তবেই আমি তোমার সঙ্গে রাত্রিবাস করতে রাজি আছি।নইলে আমাকে কিছুতেই পাবে না।

সবাই তাকে ধন্য ধন্য করতে লাগল এরপর। গিরিশবাবু দাড়িয়ে রইলেন একটু দূরে। তাঁর ওষ্ঠে তির্যক হাসি। মনে মনে তিনি বললেন, নদীর ওপর নতুন সেতু যখন গড়া হয়, তখন নাকি ভিতের ওপর একটি শিশুকে বলি দিতে হয়। নররক্ত না পেলে সেতু মজবুত হয় না। বাংলা নাটকের স্বার্থে তোকে আমরা বলি দিলাম, বিনোদ!

এরপর প্রচুর অর্থব্যয়ে দ্রুতগতিতে গড়া হতে লাগল নাট্যশালা। কিন্তু এর নাম কী হবে? বিনোদিনীর খুব ইচ্ছে, এই নাট্যশালার সঙ্গে তার নাম যুক্ত থাক। একদিন না একদিন এই দেহপট পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাৰে। এই নাট্যশালার নাম শুনে তখনও লোকে মনে রাখবে তাকে। ‘বিনোদিনী নাট্যশালা’ শুনতেও বা খারাপ কী?

প্রথমে সবাই এই নাম রাখতে রাজি। তারপর আড়ালে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল! অন্য থিয়েটারগুলোও নাম বেঙ্গল, ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, সেই তুলনায় ‘বিনোদিনী’? বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? সবাই জানবে, এক বারবণিতাকে মাথার তোলা হয়েছে। সমাজের প্রতি অপমান! এখনও ভদ্রশ্রেণীর অনেকেই থিয়েটারের সংস্রবে আসে না, মহিলা দর্শকদের সংখ্যা খুবই কম, ওই রকম নাম রাখলে যদি দর্শকের সংখ্যা আরও কমে যায়?

বিনোদিনী এই আপত্তির কথা শুনে অভিমানে ঠোঁট ফোলাল। সে এতখানি আত্মত্যাগ করল, এরা তার কোনও মূল্য দেবে না। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কয়েকজন বলল, বরং নাম রাখা যাক বি থিয়েটার। খবরের কাগজওয়ালা কিছু বলতে পারবে না, বি তো শুধু বি, কিন্তু লোকে ঠিকই জানবে, বি আসলে কে!

সেই রকমই ঠিক ছিল, কিন্তু যে-দিন কয়েকজন মিলে রঙ্গমঞ্চটি রেজিস্ট্রি করতে গেল, সেখানে তারা নাম দিরে এল ‘স্টার’!

বিনোদিনী ছুটে এসে গিরিশবাবুর কাছে কেলে পড়ে বলল, তোমরা আমার এইটুকু কথাও রাখলে না? আমার ইচ্ছের কোনও দাম নেই!

গিরিশবাবু তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আরে পাগলী, তোর নামই তো রাখা হয়েছে। স্টার আর কে? সব নাটকে তুই-ই স্টার। আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, রাস্তার লোকেরা কি বলাবলি করতে যাচ্ছে! একজন বলছে, এই থিয়েটারের নাম স্টার হল কেন গা? অন্যজন বলছে, বুঝতে পারলিনি? এই নতুন দলটার স্টার কে? বিনোদিনী গো বিনোদিনী। স্টার মানেই বিনোদিনী!

স্টার থিয়েটার পড়ার পেছনে এই সব কলহ, মান-অভিমান, ত্যাগ ও লালসা সবই তুচ্ছ, যদি সামাজিক পটভূমিকায় এর বিচার করা যায়। গিরিশবাবু নিজেও তখনও জানেন না, এই স্টার রঙ্গমঞ্চ অবলম্বন করে তিনি সমাজ পরিবর্তনের কতটা অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন। পরপর ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘ধ্রুব চরিত্র’, ‘নল-দময়ন্তী’ অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আগে থিয়েটার দেখতে আসত কিছু উচ্চশিক্ষিত কিছু ধনী সম্প্রদায় আর অনেক মাতাল-গেঁজেল-আমোদখোর। এখন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমনকি গ্রাম থেকেও ছটে আসতে লাগল দলে দলে মানুষ। সবই রামায়ণ-মহাভারত আর হিন্দু পুরাণের কাহিনী এবং তাতে ভক্তিরসের প্রাবল্য। প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘অশ্রুমতী’ অর্ধেন্দুশেখরের শত চেষ্টাতেও জমল না। ইতিহাসের কাহিনীতে আর লোকের আগ্রহ নেই। গিরিশবাৰুর নাটকগুলিতে সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায় যেন আত্ব-আবিষ্কার করতে লাগল। সাহেবরা যখন তখন হিন্দু ধর্মের নিন্দা করে, ব্রাহ্মদের শুষ্ক পরম ব্রহ্ম তত্ত্ব সাধারণ হিন্দুরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। পাদ্রিরা হিন্দুদের এতগুলি ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে তো বটেই, ব্রাহ্মরা এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ও এইসব পুতুল পুজোর ঘোর বিরোধী, অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হিন্দুরা পূর্ব সংস্কার বিসর্জন দিয়ে নতুন কী আঁকড়ে ধরৰে তা বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, গিরিশবাবুর নাটকে তারা ফিরে পেল বংশানুক্রমিক বিশ্বাস। একশোটা বক্তৃতার চেয়েও একটি বিশ্বাসযোগ্য নাটকের শক্তি বেশি। গিরিশবাবুর নাটকে যুক্তিবাদ চাপা পড়ে গেল প্রবল ভক্তিবাদে, ঠাকুরদেবতারা জীবন্ত হয়ে উঠল। অধিকাংশ মানুষই বেদ-উপনিষদ পড়েনি, পড়লেও বুঝবে না, মহাকাব্য-পূরাণের গল্পগুলিও ঠিকমতন জানে না, নাটক দেখতে এসে তারা গিরিশ-অমৃতলাল বিনোদিনীর অভিনয় দেখে না, তারা দেখতে পায় জীবন্ত শিব, বিষ্ণু, ভক্ত ধ্রুব আর পতিপরায়ণ দময়ন্তীকে, যারা সব হিন্দুর আদর্শ।

মুসলমানরা এই সব নাটকের ধারে কাছে আসে না। ব্রাহ্ম আন্দোলনও একটা জোর ধাক্কা খেল।

গিরিশ ঘোষের মধ্যেও একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বাগবাজারের বোস পাড়ার ছেলে গিরিশ চোদ্দ বছর বয়সেই বাপ-মাকে হারায়। মাথার ওপর আর কোনও অভিভাবক ছিল না, সুতরাং বখামি শিখতে দেরি হল না। মাঝপথেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সে যত রাজ্যের বদ ছেলের সঙ্গে জুটল। বাগবাজারের পাড়ায় পাড়ায় গাঁজা-চরসের আড্ডাখানা, গিরিশের মদ্যপানের দিকেই ঝোঁক বেশি, সেই সেই সঙ্গে মন্দ স্ত্রীলোকদের নিয়ে ফুর্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতায় তার জুড়ি ছিল না। সে বলশালী যুবা, ব্যক্তিত্ব প্রবল, নেতৃত্ব দেবার সহজাত শক্তি আছে তার, সে সারা পল্লী দাপিয়ে বেড়াত। কিন্তু অন্যান্য বখাটে ছেলেদের সঙ্গে তার তফাত এই যে, তার পড়াশুনোর নেশাও ছিল দারুণ। নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সে শেক্সপিয়ার মিল্টন পাঠ করে। তার সাহিত্যবোধ গাঢ় হতে লাগল দিন দিন।

প্রথম যৌবনে একদল বন্ধুকে নিয়ে একটা সখের যাত্রা দল খুলে ছিল গিরিশ। ‘সধবার একাদশী’ পালায় তার বেশ সুখ্যাতি হয়। ক্রমে পরিচয় হয় দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে। তারপর সে জড়িয়ে পড়ল নাট্যজগতে।

এখন যে-কোনও মঞ্চে গিরিশ ঘোষই প্রধান আকর্ষণ। অভিনয়ে তিনি ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত নট গ্যারিকের সঙ্গে তুলনীয়, তা ছাড়া তিনি অতি সার্থক নাট্যশিক্ষক ও পরিচালক। ইদানীং নাট্যকার। সকলের শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হয়েও গিরিশ ঘোষ তাঁর দুর্দান্তপনা ছাড়েননি, মদ খেয়ে মাতলামি করার সময় মনে হয় ইনি রুদ্রচণ্ড। সেই সঙ্গে আবার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং নাস্তিক। যুক্তিবাদী সাহিত্য ও বিজ্ঞান পাঠ করে গিরিশের ধারণা হয়েছিল যে, সব কিছুই প্রকৃতির নিয়মে চলে, একজন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই বিশ্বজগতে। ধর্মের প্রসঙ্গ উঠলেই গিরিশ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মতন কথা বলেন।

নাট্য নিয়ন্ত্ৰণ আইন পাশ হবার পর ‘নীলদর্পণ’ বা সেই জাতীয় নাটক অভিনয় করা যায় না। নাটকের ধারা পাল্টেছে। ভক্তিরসের পৌরাণিক নাটক প্রচুর দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। কিন্তু নিছক জনপ্রিয়তা কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্যের মোহেই গিরিশ পৌরানিক নাটক লিখছেন না। এর মধ্যে তাঁর একটা বিরাট মানসিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। একবার দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি যুক্তি বিসর্জন দিয়ে অবলম্বন করেছেন ভক্তি। অবিশ্বাস থেকে ফিরে আসতে চাইছেন বিশ্বাসের পথে। কিন্তু পথ দেখাবার জন্য একজন প্রদর্শক চাই।

একদিন ওঁদের পাড়ায় বলরাম বসুর বাড়িতে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের আসবার কথা। বলরামবাবু প্রতিবেশীদের অনেককে নেমন্তন্ন করেছেন। ইনি নাকি পরমহংস। এর আগে বোসপাড়ার একটি বাড়িতে ওই মানুষটিকে দেখেছিলেন গিরিশ। তেমন পছন্দ হয়নি। পরমহংস হওয়া কি সোজা কথা! ঘরের মধ্যে অনেক ভিড় ছিল, মাঝখানে বসেছিলেন সাধারণ চেহারার একজন মানুষ, মাঝ মাঝে হাসছেন, গান গেয়ে উঠছেন, আবার কেশব সেনকে কী সব যেন গল্প শোনাচ্ছেন। বেলা পড়ে এসেছিল, একজন একটা সেজবাতি রেখে গেল সামনে, তাই দেখে রামকৃষ্ণ বারবার বলতে লাগলেন, হ্যা গা, সন্ধে হয়েছে? সন্ধে হয়েছে! গিরিশ ভাবলেন, ঢং দেখ! বাইরে অন্ধকার, সামনে সেজবাতি জ্বলছে, তবু ইনি বুঝতে পারছেন না যে, সন্ধে হয়েছে কি না! এখানে থাকা মানে সময় নষ্ট।

বলরাম বসুর বাড়িতেও তেমন আলাপ হল না। গিরিশ পৌঁছবার আগেই রামকৃষ্ণ ঠাকুর এসে গেছেন, তাকে ঘিরে রয়েছে লোকজন, বিধু কির্তনী গান শোনাবার জন্য বসে আছে একেবারে সামনে। গিরিশের ধারণা পরমহংস হবেন গম্ভীর, ধ্যানী, সাধারণ লোকাচারের অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি কোনও সাধারণ মানুষকে প্ৰণাম করবেন, এ প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ইনি ফিস ফিস করে হাসছেন আর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বারবার প্রণাম করছেন বিধুকে। এ আবার কী! একজন পরমহংসের পক্ষে এরকম রঙ্গ করা কি মানায়?

ঘরের মধ্যে যারা উপস্থিত, তারা সকলেই যে ওঁর ভক্ত তা নয়। অনেকে আগে ওঁর নামই শোনেনি, এসেছে বলরাম বোসের আমন্ত্রণে, কেউ কেউ এসেছে নিছক কৌতূহলে। ওঁর ভাবভঙ্গি দেখে ফিসফিসিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছে দু’-একজন। একটু পরে দরজার কাছ থেকে এক ব্যক্তি হাতছানি দিয়ে ডাকলেন গিরিশকে। ইনি শিশিরকুমার ঘোষ, অমৃতবাজার পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক। গিরিশের বন্ধু। শিশিরকুমার পরম বৈষ্ণব, একজন কালীসাধকের প্রতি তার তেমন আকর্ষণ থাকার কথা নয়। তার মুখেও সেই ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি গিরিশকে বললেন, এখানে আর কী থাকবে, চলো চলো!

গিরিশ বললেন, আর একটু থাকি, একবার কথা বলে দেখি।

শিশিরকুমার ওষ্ঠ ওল্টে বললেন, দেখবার কী আছে? চল আমরা অন্য জায়গায় গল্প করিগে।

একপ্রকার জোর করেই শিশিরকুমার গিরিশকে বাইরে নিয়ে এলেন। কিছুটা পথ যাবার পর গিরিশ তাকালেন পেছন ফিরে। একবার মনে হল, ওই মানুষটির কাছে ফিরে গেলে হয়!

কিন্তু গিরিশের ফেরা হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *