1 of 2

৪৬. যাদুগোপালের দিদি-জামাইবাবু

যাদুগোপালের দিদি-জামাইবাবু থাকেন শিয়ালদা স্টেশনের কাছেই একটা ভাড়া বাড়িতে। জামাইবাবু রাখহরি দত্ত আবগারি বিভাগে চাকরি করেন, সম্প্রতি পাবনা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন কলকাতায়। মানুষটি অত্যন্ত মজলিশি, পাবনার বদলে কলকাতাই তাঁর উপযুক্ত স্থান। প্রায় প্রতি সন্ধেবেলাতেই তাঁর বাড়িতে একটি গান-বাজনার আসর বসে, রাখহরি নিজে পাখোয়াজ বাজান, কীর্তন গানের সঙ্গে সঙ্গীত করতে করতে তাঁর দুচক্ষু দিয়ে দরদর ধারে অশ্রু গড়ায়। তবে এই অশ্রু শুধুই ভক্তির কারণে নয়, কিছুটা দ্রব্যগুণেও বটে।

যাদুগোপালের দিদি সত্যভামা অতি দয়াবতী নারী, তাঁর নিজস্ব স্বাদ-আহ্লাদ শুধু একটিই, নানা প্রকার রান্না করে অতিথিদের খাওয়ানো। সারাদিন রসুই ঘরে কাটিয়ে দিতেও তাঁর ক্লান্তি নেই, আনাজ, আমিষ ও মশলা পাতি দিয়ে তিনি রান্নার পদের নতুন নতুন সৃষ্টিকার্য করে চলেন। মানকচুর জিলিপি, মাংসর কিমার বরফি, লাউয়ের পায়েস, মুসুরির ডাল ও চিংড়িমাছ বাটার চাপ… এই সব তাঁর নিজের আবিষ্কার। কেউ কোনও খাবারের প্রশংসা করলে আর রক্ষে নেই, সত্যভামা তার পাতে আরও দু’ গণ্ডা-চার গণ্ডা ঢেলে দেবেন। সত্যভামার এরকম বদান্যতার খবর রটে যাবার ফলে যাদুগোপালের বন্ধুদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। মেস-হস্টেল নিবাসী এইসব ছাত্ররা উপোসী ইঁদুরের মতন যখন তখন এ বাড়িতে ছুটে আসে। দত্ত সম্পত্তি অপুত্ৰক, সে কারণেও সত্যভামা ছোট ভাইয়ের বন্ধুদের পরম যত্ন-আত্যি করেন।

ভরতও এখানে আসে মাঝে মাঝে। দ্বারিকা যখন তখন ভরতের ঘরে উপস্থিত হয়ে বলে, আরো বোকা, হাত পুড়িয়ে বেঁধে খাবি কেন, চল না, সত্যভামাদিদির কাছে গেলেই লুচি-মাংস জুটে যাবে। স্বভাব-লাজুক ভরত মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারে না, কিন্তু দ্বারিকার জিভের কোনও আগল নেই, সে সটান রান্নাঘরে হাজির হয়ে সত্যভামার কাছে ফরমাস করে নানারকম।

জামাইবাবু রাখহরি যখন বাড়িতে থাকেন না, তখনই ভরত সচ্ছন্দ বোধ করে এ বাড়িতে। নানারকম খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে এনে সামনে বসে অনেকরকম গল্প করেন সত্যভামা। তাঁর খুব ভূতে বিশ্বাস, তাদের পাবনার বাড়িতে ভূত ছিল, একটা নয়, দুটো, সেই ভূতের কত রোমাঞ্চকর কাহিনী! সুযোগ বুঝে সত্যভামাকেও ভূতের উপদ্রবের গল্প শোনায় দ্বারিকা। তাদের মুসলমান পাড়া লেনের মেসের এক কাল্পনিক ভূতের নিত্য নতুন আখ্যান সে বানায়। এ ছাড়া পাবনার পুকুরের ঢেঁকির মতন আকারের গজাল মাছ, একই জবা গাছে লাল ও সাদা রঙের ফুল, এক বাড়িতে ডাকাতি করতে এসে একচক্ষু এক ডাকাত দরজার সামনে খাড়া হাতে জীবন্ত কালীমূর্তিকে দেখে ভয়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে কি রকম রক্তবমি করেছিল, এক নাস্তিক ইস্কুল মাস্টারকে এক সন্ধেবেলা একটা অশ্বত্থ গাছের ডাল হঠাৎ নিচু হয়ে এসে কি মার মেরেছিল, এই সব গল্প সত্যভামা সরল বিশ্বাসে চোখ বড় করে বলে জান, ভরত মুগ্ধ হয়ে শোনে। কোনওদিন পেট ভর্তি ভরত কিছু খেতে না চাইলে সত্যভামা যখন ঝোলা গুড় মাখানো লুচি জোর করে ভরতের মুখে গুজে দিতে যান, তখন তার চোখে জল এসে যায়। অতি শৈশবে মাতৃহীন ভরত কখনও নারীর স্নেহ-যত্ন পায়নি, মা-মাসি-পিসি ধরনের কোনও রমণীর সান্নিধ্যও পায়নি। একটু স্নেহ, একটু সঙ্গ পাবার জন্য তার মনটা বুভুক্ষ হয়েছিল। ভরতের মা-বাবা কেউ নেই শুনে তার প্রতি সত্যভামারও বেশি টান পড়ে গেছে।

রাখহরি উপস্থিত থাকলেই হই-চই শুরু হয়ে যায়। তিনি রোজই সঙ্গে দু’তিনজনকে নিয়ে আসেন। অনবরত খাবার বানাতে বানাতে সত্যভামা আর গল্প করার সময় পান না। তা ছাড়া সুরা পান শুরু হয়ে যায়। আবগারির দারোগার বাড়িতে মদের বোতলের অভাব নেই, রাখহরি নিজে তা পছন্দ করেনই, অল্পবয়েসী ছাত্রদের মদে দীক্ষা দিতেও তার খুব উৎসাহ। তাঁর নিজের শ্যালক যাদুগোপালের ক্ষেত্রে তেমন সুবিধে করতে পারেননি, যাদুগোপাল ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করে, তার বামমার্গী জামাইবাবুর অনেক পীড়াপীড়িতেও সে এখন গেলাস স্পর্শ করে না। দ্বারিকা আবার এ ব্যাপারে বেশ পটু, সে দিন দিন নেশাগ্ৰস্ত হয়ে উঠছে, কলেজের আরও দু’চারটি বন্ধুকে সে দলে টেনেছে। ভরত যাদুগোপালের সঙ্গে সাধারণ ব্ৰাহ্ম সমাজের প্রার্থনা সভায় গেছে কয়েকদিন, কিন্তু দীক্ষা নেয়নি। মদের ব্যাপারে তার শুচিবাই নেই, সে ব্র্যান্ডি ও বিয়ার খেয়ে দেখেছে কয়েকবার, তার তেমন ভালো লাগে না। মদের নেশায় লোকে যখন আবোল-তাবোল বকে, তখন তার বিরক্ত বোধ হয়।

তা ছাড়া, ভরত কি করে রেখেছে, সে সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব, শশিভূষণের দয়ায় পড়াশুনো চালাচ্ছে, এসব বড়লোকি নেশা তার মানায় না। তাকে যত শিগগির সম্ভব স্বাবলম্বী হতে হবে, কোনও রকম বিলাসিতার ফাঁদে পা দিলে চলবে না।

ছোট ভাইয়ের বন্ধুদের মদের নেশা ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা সত্যভামারও একেবারেই পছন্দ নয়, তিনি বারবার আপত্তি জানালেও তার স্বামী কর্ণপাত করেন না।

একদিন গান-বাজনা খুব জমে উঠেছে, বড় হলঘরটায় বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে কয়েকটা, দু-একটি মাতাল গেলাস উল্টে সতরঞ্জি ভিজিয়েছে, এরই মধ্যে এক গায়ক গাইছে :

ভাঙলি না তোর মায়ার ঘুম?

বিষয় মদে চক্ষু মুদে শুয়ে আছ বেমালুম

ঐশ্বর্যের মাৎসর্যে তুমি মনে কর বাদশারুম

ওই প্ৰপঞ্চে এক সাজ সেজেছ

ঠিক যেন ভাই হাতুম থুম

তোর সঙ্গের ছটা বড় ঠোঁটা, ওদের চটা বেমালুম…

পাখোয়াজে চাঁটি দিতে দিতে গানের কথার সঙ্গে মিলিয়েই যেন মাঝে মাঝে রাখহরি ঢুলে পড়ছেন ঘুমে। গায়কের গলাও বেসুরো হয়ে যাচ্ছে এক একবার। রূপচাঁদ পক্ষী রচিত এই গানের মর্মও বুঝতে পারছে না ভরত, তার একটুও ভালো লাগছে না। সে এর মধ্যে কয়েকবার উঠে পড়বার চেষ্টা করলেও দ্বারিকা আঁকড়ে ধরছে তার জানু। ভরতকে সে আগে যেতে দেবে না।

ইদানীং দ্বারিকার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে সে পড়াশুনোয় ভালো ছাত্র ছিল, সাহিত্য রচনায় উৎসাহী, দেশপ্রেম ফুটে উঠত তার কথাবার্তায়। মাস ছয়েক আগে সে আকস্মিকভাবে তার মামাদের জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়েছে। দেশ থেকে এখন তার প্রতি মাসে এক হাজার টাকা হাত খরচ আসে। এত টাকা নিয়ে সে কি করবে? এখন পড়াশুনোয় সে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে, মন ছড়িয়ে গেছে অন্য নানা দিকে। ভরত লক্ষ করেছে, যাদের হাতে অনেক টাকা থাকে, তারা সব সময় ছটফট করে, কিছুতেই সুস্থির হয়ে বসতে পারে না।

একটু পরে দ্বারিকা নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল ভরত! এখানে আর মজা নেই।

ভরত এখান থেকে হেঁটেই নিজের বাসস্থানে যায়, দ্বারিকার মেসও কাছেই, কিন্তু সে ফস করে একটা ঘোড়া গাড়ি ডেকে বসল। ভরতের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, এখুনি ফিরবি কি, বাড়িতে তো তোর বউ বসে নেই, চল, আর এক জায়গায় তোকে নিয়ে যাব!

ভরতের ইচ্ছে নেই, নিজের বাসাবাড়ির নিভৃতিই তার পছন্দ, কিন্তু দ্বারিকা ছাড়বে না। তার খানিকটা নেশা হয়েছে, শরীরে চনমনে ভাব, সে চিবুক উঁচু করে বলল, বাঙালিদের এত দুৰ্দশা কেন জানিস? তারা বড় ঘরকুনোয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সতেরো-আঠেরো ঘণ্টাই তারা বাড়িতে বসে থাকে। আর ইংরেজদের দেখ তো, তারা মাত্র পাঁচ-ছ ঘণ্টা ঘুমোয়, আর সৰ্বক্ষণ টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। গাড়ি খানিকটা চলার পর দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, মোছলমানটার খবর কি? তাকে দেখি না অনেকদিন!

ইরফানের জন্য ভরত ও চিন্তিত। হঠাৎ সে কলেজে আসা বন্ধ করেছে। ভরতের সঙ্গেই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, অথচ ভরতকেও সে কিছু জানায়নি। ইরফানকে দ্বারিকাও বেশ পছন্দ করে। ইরফানের সঙ্গে ভরতের শেষ দেখা হয়েছিল মাস দেড়েক আগে। সেদিন বেশ মজা হয়েছিল।

এর আগে ইরফান কখনও ভরতের ডেরায় আসেনি, সেদিন সে হরি ঘোষের গলিতে এসে ভরতের ঠিকানা খুঁজছিল, ভরতের প্রতিবেশী পুরুতে ঠাকুরের সঙ্গে তার প্রথম দেখা। ইরফান অতি দরিদ্রের সন্তান, কিন্তু সেদিন তার অঙ্গে বিচিত্র পোশাক। গায়ে একটা বহুমূল্য কিংখাব, মখমলের ওপর জরির কাজ করা, পায়ে সাদা নাগরা, তাতে কয়েকটি রঙিন পাথর বসানো, মণিমুক্তোও হতে পারে। বাণীবিনোদ তাকে দেখে রাস্তা থেকে খাতির করে নিয়ে এল ভরতের ঘরে। ভরত পয়সা জমিয়ে সদ্য একটা টেবিল ও চেয়ার কিনেছে, সেই চেয়ারের ধুলো ছেড়ে বাণীবিনোদ বিগলিত ভাবে বলতে লাগল, তশরিফ রাখিয়ে জনাব!

তারপর লম্বা একটা সেলাম ঠুকে আবার বলল, ফরমাইয়ে জনাব, আপনার সেবার জন্য কি করতে পারি?

ইরফান চেয়ারে না বসে মিটিমিটি হাসছিল।

ভরত খালি গায়ে রান্না করছিল, সারা গা ঘামে ভেজা, সেই অবস্থায় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলেছিল, আপনি… কে…ওঃ হো, ইরফান! কি ব্যাপার, হঠাৎ মিউনিসিপ্যালিটির লটারির ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছিস না কি?

ইরফান বলল, কোনওদিন লটারির টিকিটই কাটিনি!

ভরত বলল, তোকে প্রথম চিনতেই পারিনি। এমন নবাব বনে গেলি কবে?

ইরফান বলল, আমাকে মানিয়েছে কি না বল? রাস্তায় লোকেরা খাতির করে তাকাচ্ছিল। ভরত বলল, বস, বস, তোর গল্প শুনি। চা খাবি না কি?

বাণীবিনোদ এখন আর ভরতের ওপর নির্ভর করে না, এখানে এসে নিজেই চা বানিয়ে নেয়। সে তাড়াতাড়ি চায়ের জল চাপিয়ে দিল।

ইরফানের কাহিনীটি করুণ কৌতুকে মেশা। পিতৃহীন ইরফানের মা ও ভাইবােনেরা থাকে মুর্শিদাবাদে সোপর গ্রামে তার চাচার আশ্রয়ে। সেই চাচা সম্প্রতি জানিয়েছেন যে তিনি আর অতগুলি পেটের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। ইরফান বৈঠকখানার দুটি দফতরিখানায় খাতা লেখার কাজ নিয়েছে, সেই টাকা সে মা-ভাইবোনদের জন্য পাঠাবে। এর মধ্যে আর একটা বিপত্তি দেখা দিয়েছে। নবাব আবদুল লতিফ সাহেবের ভৃত্যমহলে তার একটা মাথা গোঁজার ঠাই ছিল, সে ঠাই তাকে ছাড়তে হবে, কারণ অন্য দুটি নবনিযুক্ত ভৃত্যের শোবার জায়গা হচ্ছে না। ইরফান তো আর ভৃত্য নয়, উটকো আশ্রিত। এখন তাকে অন্য কোনও জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ইরফান প্রতিজ্ঞা করেছে, যে-কোনও উপায়ে তাকে বি এ পাস করতেই হবে, তার আগে সে কলেজ ছাড়বে না।

গোয়াবাগানে কিছু মুসলমান গোয়ালা দল বেঁধে থাকে, সেখানে কোনও মতে আশ্রয় পাওয়া যায় কি না, সেই খোঁজে এসেছিল ইরফান, বিশেষ আশ্বাস পাওয়া যায়নি। কাছাকাছি ভরতের বাড়ি বলে সে দেখা করতে এসেছে।

ভরত জিজ্ঞেস করল, তা হলে তুই এসব নবাবি পোশাক জোটালি কোথা থেকে?

ইরফান দু’হাত তুলে দেখাল, দু’দিকেই বগলের তলায় পিঁজে গেছে। জুতো দুটোর হাফসোলে ফুটো। সে বলল, নবাবরা তো রিপু কিংবা মেরামত করে কিছু পরে না, ফেলে দেয়। আমি কুড়িয়ে নিয়েছি। নিজের জামা নেই!

দুই বন্ধু হাসতে লাগল খুব। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল বাণীবিনোদ।

ইরফান বলল, যাত্রার দলে যারা নবাব-বাদশা সাজে, তারাও তো এরকমই ফুটোফাটা পোশাক পরে, তাই না? আমিও সেই রকম কোনও কাপ্তেন সেজেছি!

ভরত বলল, কিন্তু তুই এরকম সেজে গেলে গোয়ালারা তাদের বস্তিতে তোকে রাখতে চাইবে কেন? আর কোথাও জায়গা না পেলে তুই আমার এখানে এসে থাকতে পারিস।

ইরফান বলল, তুই যে বললি, এটাই যথেষ্ট। তোর নিজেরই অনেক সমস্যা আছে ভরত, আমি জানি, আমি আর সমস্যা বাড়াতে চাই না। যতদিন না তাড়ায় ততদিন তো ও বাড়ি ছাড়ছি না!

ইরফান চলে যাবার পর বাণী বিনোদ উৎকট মুখ করে বলেছিল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ভরতচন্দর? আপনি না পায় ঠাই শঙ্করাকে ডাকে! তুমি ওই ছোড়াটাকে এখানে থাকতে দেবে? খবরদার দিও না। ও ওই গেলাসে চা খেয়েছে, এটা ফেলে দাও! কোনও দিন এই গেলাসটা আবার আমাকে দিলে আমার জাত যাবে!

ভরত বলল, সে কি! আপনিই তো খাতির করে ওকে এনে বসলেন, সেলাম ঠুকলেন, নিজে চা করে দিলেন, তখন বুঝতে পারেননি ও মুসলমান?

বাণীবিনোদ বলল, তা বুঝব না কেন, তখন ভেবেছি কোনও আমির-উজির এসেছে, তোমাকে ডেকে নিয়ে বড় কাজ দেবে।

ভরত বলল, তার মানে আপনি ওর পোশাকটাকে খাতির করেছিলেন?

বাণীবিনোদ বলল, এ যুগে পোশাকেরই তো কদর ভাই! আসল মানুষটাকে আর কে দেখে!

ভরত মনে মনে বলেছিল, হায় ব্ৰাহ্মণ!

দ্বারিকাকে সে এখন বলল, ইরফানের থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হয়েছে, সেইজন্যই বোধহয় সে কলেজে আসছে না। দ্বারিকা বলল, থাকার জায়গার সমস্যা? আমাকে বলেনি কেন? আমি ব্যবস্থা করে দেব। ভাবছি, শিগগিরই একটা বড় বাড়ি ভাড়া নেব! চল তো, ব্যাটাকে ধরে আনি!

মৌলা আলির মাজার থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে নবাব সাহেবের বিশাল প্রাসাদ। দেউড়িতে গ্যাসের বাতি জ্বলছে। পাথরের মূর্তির মতন দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুই বন্দুকধারী দারোয়ান। বাড়িটার সামনের দিকটা তেমন জমকালো না, অনেকখানি ছড়ানো, দোতলার সব জানলা বন্ধ, ভেতরে নিশ্চয়ই দু’তিনটি মহল আছে।

দ্বারিকা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই এক বন্দুকধারী নড়ে চড়ে উঠল।

দ্বারিকা বলল, ইরফান হ্যায়? ইরফানকো বোলাইয়ে।

দারোয়ানটি জিজ্ঞেস করল, ইরফান কৌন? কেয়া কাম করতা?

দ্বারিকার হিন্দী-উর্দুর জ্ঞান বিশেষ নেই, সে যত বোঝাবার চেষ্টা করে যে ইরফান এখানে কাজ করে না, সে ছাত্র, সে তাদের বন্ধু, দারোয়ানটি কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা নাড়তে থাকে।

পাশে দাঁড়িয়ে ভরত মিটিমিটি হাসছে। সে বুঝতে পারছে অবস্থাটা। এ বাড়িতে এত বেশি লোকজন যে শুধু নাম শুনে কারুকে চেনা যাবে না। তাছাড়া ইরফান তো নেহাত এক আশ্রিত। ত্রিপুরায় রাজবাড়ির সিংহদ্বারে গিয়ে যদি কেউ জিজ্ঞেস করত ভরতের কথা, তা হলেও কেউ চিনতে পারত না।

ইরফানের কাছে ভরত শুনেছিল যে, এ বাড়িতে সবাই উর্দুতে কথা বলে। একখানা জুড়িগাড়ি এসে থেমেছে, তার থেকে নামলেন এক সুদর্শন প্রৌঢ়, সাদা সিল্কের শেরওয়ানি পরা, মাথায় ফেজ, দেখলেই মনে হয় খানদানি বংশের মানুষ। ইনিও কি কলেজে-পড়া ইরফানকে চিনবেন না?

সে ইংরেজিতে সেই প্রৌঢ়কে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, আমরা আমাদের সহপাঠী ইরফান আলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

প্রৌঢ়টি একবার এই যুবক দুটির দিকে তাকালেন, তারপর দেখলেন ছ্যাকরা গাড়িটি। এই ধরনের ভাড়ার গাড়ি চেপে যারা আসে, তাদের তিনি বোধহয় কথা বলার যোগ্য মানুষ বলেই গণ্য করেন না। তিনি ওষ্ঠাধর সামান্য বক্র করে এমনভাবে ভরতের দিকে তাকালেন, যেন ভরতের শরীরটা স্বচ্ছ, সেই শরীর ভেদ করে তিনি দূরের কিছু দেখছেন। ভেতর থেকে একজন কর্মচারি বেরিয়ে এসেছে। তার দিকে বুড়ো আঙুলের ইঙ্গিত করে তিনি জুতো মশমশিয়ে চলে গেলেন বাড়ির মধ্যে।

কর্মচারিটিও ইরফানকে চেনে না। অনেক খোঁজখবর করার পর ভৃত্য মহল থেকে জানা গেল যে সেখানে ইরফান নামে একজন থাকে বটে, কিন্তু আপাতত সে নেই, দেশের বাড়িতে গেছে সাত দিন আগে।

দ্বারিকা এবং ভরতও প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসেবে গর্ব আছে। অনেকের ধারণা, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। অথচ ইরফানকে এ বাড়ির কেউ গ্রাহ্যই করে না।

দ্বারিকা রাগ করে বলল, ইরফানের ভালো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা আমি করব। চল ভরত, আর একটা জায়গায় যাই!

গাড়িটা ঘুরে গেল বউবাজারের দিকে। যে গলিতে হাড়ের বোতাম তৈরি হয়, সেই হাড়কাটা গলির একেবারে শেষ প্রান্তে একটি বাড়ির সামনে নেমে পড়ল দ্বারিকা, সদর দরজা খোলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে বলল, আমি এখানে মাঝে মাঝে রাত্তিরে এসে থাকি, বুঝলি! তুইও ইচ্ছে করলে আজ থাকতে পারিস। আমার বাবাও নাকি এককালে এ পাড়ায় আসতেন। আমার এক পিসতুতো দাদার কাছে গল্প শুনেছি, বাবার যখন বিয়ের ঠিক হয়, তখন তিনি হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির লোকজন খুঁজতে খুঁজতে এই হাড়কাটা গলির এক বাড়ির থেকে বাবাকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়ে সোজা বিয়ের পিড়িতে বসায়। আমি এখন মামাদের সম্পত্তি পেয়েছি, মানে, মামারা বেঁচে থাকলে এই সম্পত্তি তাঁরই ভোগে লাগত, আমি পেতাম লবডঙ্কা। বাবা নেই, তাই বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।

ভরত তখনও বুঝতে পারেনি, এ বাড়ির ব্যাপারখানা ঠিক কি।

তিনতলার একটা ঘরের ভেজানো দরজা খুলে ফেলল দ্বারিকা। সে ঘরের চার দেয়ালে অন্তত আটটা দেয়ালগিরি বাতি আটকানো। সারা ঘর ঝলমল করছে আলোয়। মাঝখানে একটা বড় পালঙ্ক, তার মশারিদণ্ড গুলি কারুকাজ করা, পুরু তোশক পাতা, সেখানে শুয়ে আছে এক তরুণী, পরণে একটা ঝলমলে শাড়ি, দুহাতে ও গলায় অনেক সোনার গয়না, পাতলা চেহারা, ফার্স রঙ, সে শুয়ে আছে চিত হয়ে, চক্ষু দুটি বোজা। দরজা খোলার শব্দ হল, ওরা দু’জন ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল, তবু মেয়েটি চোখ খুলল না।

প্রথম নজরেই ভরতের মনে হল, যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যা।

দ্বারিকা ভরতের দিকে তাকিয়ে হেসে ভ্রুভঙ্গি করল। তারপর, ঝুঁকিয়ে নিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল :

কুঞ্চিত-কেশিনী      নিরুপম বেশিণী

রস-আবেশিণী ভঙ্গিণী রে

অধর সুরঙ্গিণী                অঙ্গ, তরঙ্গিণী

সঙ্গিণী নব নব রঙ্গিণী রে…

মেয়েটি আস্তে আস্তে চোখ মেলল, ধড়মড় করে উঠে বসল না, কোনও রকম ব্যস্ততা দেখাল না, নরম ভাবে তাকিয়ে থেকে গানটি শুনল, তারপরেও কোনও কথা বলল না।

দ্বারিকা বলল, ভরত, এর নাম বসন্তমঞ্জরী, আমার সখী। অতবড় নাম তো ডাকা যায় না, সবাই বলে বাসি। টাটকা আর বাসি, সেই বাসি নয়। তুমি আমাকে ভালোবাসো, তিন সত্যি করে বলো? হ্যাঁ, বাসি, বাসি, বাসি। সেই বাসি, বুঝলি?

তারপর সে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো, বাসি, তুমি এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে কেন?

বসন্ত মঞ্জরী এবার ছোট্ট একটি হাই তুলে বলল, আমার যে জ্বর হয়েছে! দ্বারিকা তার কপালে হাত দিয়ে বলল, কই, এখন তো জ্বর নেই। তা তুমি এত সেজে গুজে এত বাতি জ্বেলে ঘুমোচ্ছিলে?

বসন্ত মঞ্জরী বলল, সাজতে আমার ভালো লাগে। ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে আমি কত জায়গায় যাই, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, সেই জন্যই তো সেজে থাকি! সকালবেলা একটুও সাজি না, তখন তো আমায় কেউ দেখে না! তোমার সঙ্গে কে এসেছে?

দ্বারিকা বলল, এই আমার বন্ধু ভরত। বড় ভালো ছেলে। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না!

বসন্তমঞ্জরী হঠাৎ যেন গভীর বিস্ময়ে, খানিকটা যেন ভয় মেশানো চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে বলল, তুমি কে?

ভরতের বদলে দ্বারিকা বলল, বললুম তো, আমার কলেজের সহপাঠী, ওর নাম ভরত।

বসন্তমঞ্জরী বলল, চেনা চেনা লাগছে কেন? তোমায় কি আমি আগে দেখেছি?

ভরত নিঃশব্দে দু’দিকে মাথা নাড়ল।

দ্বারিকা বলল, ওকে তুমি আগে দেখবে কি করে?

বসন্তমঞ্জরী টেনে টেনে বলল, আগে দেখা না হলেও কারুকে কারুকে চেনা লাগে। তবে কি স্বপ্নের মধ্যে দেখা হয়েছে?

দ্বারিকা সকৌতুকে বলল, হায় আমার পোড়া কপাল! আমি এত টাকা পয়সা খরচা করে তোকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি, আর আমার বন্ধু তোর স্বপ্নের মানুষ হয়ে গেল? আমাকে আর পছন্দ হচ্ছে না, তুই বুঝি ওকে গাঁথতে চাস?

বসন্তমঞ্জরী তবু সরল ভাবে জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, ওকে আমি স্বপ্নে দেখেছি কখনও।

ভরত কেঁপে উঠল। প্রথমটায় সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। এত কাছ থেকে সে কোনও সুসজ্জিত যুবতীকে আগে দেখেনি। সে চুম্বক আকৃষ্টের মতন তাকিয়েছিল বসন্তমঞ্জরীর দিকে। হঠাৎ তার ঘোর ভাঙ্গল। মেয়েটির কথাবার্তা কেমন যেন রহস্যে মেশা। কি করে সে ভরতকে স্বপ্নে দেখবো? দু’জন পুরুষকে দেখেও মেয়েটি উঠে বসছে না, একই রকম ভাবে শুয়ে আছে।

দ্বারিকা বলল, তোমার স্বপ্নের কোনও মাথা মুণ্ডু নেই!

বসন্তমঞ্জরী বলল, ওর মাথার ওপর একটা খাড়া ঝুলছে, মৃত্যু ওকে তাড়া করে। কি গো, তাই না?

দ্বারিকা বলল, যাঃ, কি আজে বাজে কথা বলিস! প্রথম দিন এসেছে, অমনি তুই ভয় দেখাচ্ছিস ওকে। তুই কিছু মনে করিস না রে, ভরত। বাসি মাঝে মাঝে মাঝে এরকম সব অদ্ভুত কথা বলে।

বসন্তমঞ্জরী বলল, আজে বাজে নয়, ওর মুখ দেখে বোঝা যায়, ওকে জিজ্ঞেস করো!

ভরত বলল, আমি যাই।

দ্বারিকা তার হাত চেপে ধরে বলল, কোথায় যাবি? বোস! এখন আমরা ব্র্যান্ডি খাব। এখানে আমার বোতল রাখা থাকে।

ভরত সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না, আমি এখানে থাকব না!

তার নাক ফুলে গেছে, দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে, অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে চোখ মুখ। সে জোর করে দ্বারিকার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হুড়মুড় করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। রাস্তায় নেমেও সে ছুটতে লাগল।

এর মধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নেমেছে। খানিকদূর যাবার পর তার মাথা ঠাণ্ডা হল। মনটা গ্লানিতে ভরে গেছে। ওই মেয়েটিকে দেখা মাত্র সে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, ওর দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না, এজন্য নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে ভরত! দ্বারিকা হঠাৎ ধনী হয়েছে, ধনীর দুলালদের সব রকম কীর্তিকলাপে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে সে, ভরত কেন তার সঙ্গে তাল মেলাতে যাবে?

এই বউবাজারের রাস্তাতেই কিছুকাল আগে ভূমিসূতাকে নিয়ে এক আশ্রমে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল ভরত। সব তার মনে পড়ে গেল। সে ভূমিসূতাকে কথা দিয়েছিল, কথা রাখেনি।

রাজপথ এখন নির্জন, প্রায় নিস্তব্ধ। ভরতের বাড়ি এখান থেকে অনেকটা দূরে। ভাড়ার গাড়ি পাবার আর আশা নেই, ভরতকে হেঁটেই ফিরতে হবে। তবু ভরত যাচ্ছে না, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। তার বুকটা মোচড়াচ্ছে। ভূমিসূতাকে এক্ষুনি একবার দেখতে ইচ্ছে করছে তার। বসন্তমঞ্জরী নামে মেয়েটির রূপ তার রক্তে তরঙ্গ তুলে দিয়েছে, এখন আর বসন্তমঞ্জরী নেই, শুধু রূপ, সেই রূপ ভূমিসূতায় অর্পিত, ভরত অনুভব করল, ভূমিসূতার রূপ অনেক বেশি। ভূমিসূতার নির্বাক চক্ষু অনেক বেশি কথা বলে। সেই চোখ দুটি দেখার জন্য ছুটে যেতে চায় ভরত।

কিন্তু কোথায় যাবে সে? মহারাজের জন্য যে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, তার পাশেপাশে ভরতকে যেতে বারংবার নিষেধ করেছেন শশিভূষণ। তবু ভরত গেল, অন্ধকার রাস্তার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে চোরের মতন এগিয়ে সে সার্কুলার রোডের সেই বাড়িটির উল্টো দিকে একটা দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তা পার হওয়া সত্যি বিপজ্জনক। মহারাজের সঙ্গে ত্রিপুরা থেকে নিশ্চয়ই আরও অনেকে এসেছে, তারা কেউ ভরতকে দেখলেই চিনবে। ভরতের অস্তিত্বটা একবার জানাজানি হলেই তার ভাগ্যে আরও অনেক দুর্ভোগ ঘনিয়ে আসবে, শশিভূষণও বিপদে পড়তে পারেন।

অত বড় বাড়িতে দুদিকের দুটি মাত্র ঘরে আলো জ্বলছে এখন। ভূমিসূতা কোন দিকে থাকে, তাও জানে না ভরত। সে ব্যাকুল ভাবে তাকিয়ে রইল দুই জানলার দিকে। তার ইচ্ছে করছে এই বাড়িটা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এখনি ভূমিসূতাকে মুক্ত করে আনতে। কিন্তু সে অসহায়, সে অতি সাধারণ এক যুবা, ইচ্ছে শক্তি দিয়ে সে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *