দ্বারিকানাথ শেষ পর্যন্ত একদিন ভরতকে বঙ্কিমবাবুর বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজি হল।
দিনটি সে ঠিক নির্বাচন করেনি। কয়েকদিন যাবৎ বঙ্কিমচন্দ্রের মেজাজ নানা কারণে বেশ খারাপ। তাঁর বই জাল হবার খবর আসছে। বঙ্গদর্শনের পাতায় তিনি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে, যে-সব বইতে তার কিংবা তার দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের স্বাক্ষর থাকবে না, সেগুলি যেন পাঠকেরা না কেনেন। তাতেও বিশেষ কাজ হচ্ছে না। তাঁর স্বাক্ষরের একটা মোহর চুরি গেছে বেশ কিছুদিন আগে, সেই স্বাক্ষর-ছাপ মারা নকল বই এখনও বাজারে আসছে। পটলডাঙার ক্যানিং লাইব্রেরী নামে নামকরা দোকানটিতে এই রকম জাল বই ধরা পড়েছে।
থিয়েটারের দলগুলির ওপরেও তিনি চটে আছেন। বছরের পর বছর প্রধানত তার উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ দিয়েই পেশাদারি মঞ্চগুলি দর্শক আকৃষ্ট করেছে। এখন হঠাৎ তারা ঝুকেছে পৌরাণিক নাটকের দিকে। বেদ-পুরাণ সম্পর্কে ধারণা নেই। যে-সে কোনও রকমে একটা নাটক খাড়া করে তার মধ্যে প্রচুর ভক্তি আর কান্না মিশিয়ে দিতে পারলেই হল! তাঁর প্রিয় উপন্যাস আনন্দমঠ একেবারেই জমাতে পারেনি ন্যাশনাল থিয়েটার। তাঁর ধারণা নাট্যরূপই অতি দুর্বল। আর অভিনেতাগুলিও এমন, ভাঁড়ামি-ফাজলামি দিয়ে আসর মাত করতে শিখে গিয়ে বীররসের অভিনয় ভুলেই গেছে। বঙ্কিম এখন এক এক সময় ভাবেন, তিনি নিজেই এবার উপন্যাসের বদলে একটি নাটক লিখবেন!
সাংসারিক ব্যাপারেও অশান্তি কম নয়। তাঁর বড় ভাই তাঁকে পৈতৃক বাড়ির অংশ দিতে চান না। বাবাও কেমন যেন দুর্বল। এতে বঙ্কিমের মন এমনই বিরক্ত হয়ে ওঠে যে এক এক সময় তিনি ঠিক করেন, জীবনে কখনও কাঠালপাড়ায় পদাৰ্পণ করবেন না। সবাই এখন তার টাকা দেখে। সবাই মনে করে, বই বিক্রি করে তার এখন অনেক টাকা। তাঁর যে কত খরচ, তা লোকে বোঝে না। মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্ৰ তো খাটি একটি উড়নচণ্ডী, তার উপার্জনের কোনও স্থিরতা নেই। বঙ্গদর্শনের ভার তাঁকে দেওয়া হল, তিনি চালাতে পারলেন না। তাঁর ছেলে জ্যোতিষও একটি অকাল কুষ্মাণ্ড, তার খরচও টানতে হয় বঙ্কিমকে। সে ছোকরা তাঁর মায়ের সঙ্গে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করে, আর এমনই তার বাবুয়ানি যে মোটা চালের ভাত রান্না হলে নাক সিটকোয়।
এ ছাড়া বঙ্কিমের অফিস নিয়ে ঝঞাট তো লেগেই আছে।
বৈঠকখানা ঘরে বঙ্কিম এক ব্যক্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোনও কাজের কথা বলছেন। বাড়ির মধ্যে তিনি খালি গায়ে থাকেন। খুবই ফর্সা গায়ের রং, তাঁর মুখখানি যেন তত গৌরবর্ণ নয়, একটু কালো ছায়া আছে। গভীর, মর্মভেদী দুই চক্ষু, গাঢ় ভুরু, সমুন্নত নাসিকা। ওষ্ঠের রেখায় দৃঢ়তা।
দ্বারিকানাথ এবং ভরত ঘরে ঢুকেই চিপ টিপ করে বঙ্কিমের পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করলেন। বঙ্কিম এক পলক তাকালেন মাত্র। কোনও কথা বললেন না, অন্য ব্যক্তিটির কথা শুনতে লাগলেন। সে একজন ছাপাখানার লোক, বঙ্কিমের কোনও উপন্যাস প্রকাশের জন্য কাগজের দাম, মুদ্রণ ও বাধাই খরচের হিসেব দিচ্ছে। দ্বারিকানাথ বললেন, খুড়োমশাই, আমার এক বন্ধুকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছি। এর নাম ভরত। বঙ্কিম গম্ভীরভাবে বললেন, এখন ব্যস্ত আছি। পরে এসো। দ্বারিকানাথ বলল, বেশিক্ষণ সময় নেব না। মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন করব। বঙ্কিম এবার প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, বললাম না ব্যস্ত আছি। অন্য একদিন এসো।
দ্বারিকানাথ তাতে ঘাবড়াবার পাত্র নয়। বোঝা যায়, এই ধরনের ধমক খেয়ে সে অভ্যস্ত। সে ভরতের দিকে চক্ষু সঙ্কুচিত করে একটা ইঙ্গিত জানাল। ভরত তাকে মুরগির ঝোল খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ভরতের সঙ্গে সে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা বলিয়ে দেবে ঠিকই।
ভরত অপলক মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছ তার আরাধ্য দেবতার দিকে। তার যেন নিশ্বাসও পড়ছে না। ইনিই বিষবৃক্ষ, চন্দ্ৰশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইলের স্রষ্টা? সাধারণ মানুষের মতন অনাবৃত শরীরে দাড়িয়ে আছেন তার সামনে। এঁর ভ্রু দুটি কুঞ্চিত, মুখে রাগী রাগী ভাব, অথচ ইনিই লিখেছেন। কমলাকান্তের রঙ্গ-রসিকতা? এত বড় একজন লেখক, তাকে এত কাছ থেকে দেখা, তাতেই ভরতের জীবন ধন্য হয়ে গেছে। কথা বলার দরকার কী! তা ছাড়া ভরত অতি সামান্য মানুষ, সে এই অসামান্য লেখকের সঙ্গে কী-ই কথা বলবে! ওঁর সময় নষ্ট করতেও সে চায় না।
অন্য লোকটি একবার কথা থামাতেই সেই ফাঁকে দ্বারিকানাথ বলল, খুড়োমশাই, আমাদের কলেজের ছাত্ররা জিজ্ঞেস করে, বঙ্গদর্শন তো বন্ধ হয়ে গেল, এখন তা হলে আমরা ‘দেবী চৌধুরানী’ কী করে পড়ব? ধারাবাহিক বেরুচ্ছিল, মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল।
বঙ্কিম দ্বারিকার দিকে না তাকিয়েই অবহেলার সঙ্গে উত্তর দিলেন, পুস্তকাকারে শিগগিরই বেরুবে। ততদিন ধৈর্য ধরে থাকো।
দ্বারিকা বলল, আর একটা প্রশ্ন আছে, ‘আনন্দমঠে” আপনি যে আদর্শ প্রচার করেছেন, “দেবী চৌধুরানী’-তে ও তো সেই একই আদর্শ… মানে দেবী চৌধুরানী আনন্দমঠ এর পরিপূরক?
বঙ্কিম বললেন, আঃ, বলছি যে এখন বিরক্ত করে না। দেখছ, এর সঙ্গে কাজের কথা বলছি!
দ্বারিকা ভরতের দিকে আবার চোখের ইঙ্গিত করল যাতে ভরতও টপ করে একটা প্রশ্ন করে ফেলে। ভরত পাল্টা চোখের ইঙ্গিতে বলতে চাইল, চল, এখন আমরা চলে যাই। ইনি সত্যি ব্যস্ত আছেন, এখন বিরক্ত করা উচিত নয়।
দ্বারিকা তা গ্রাহ্য না করে বসে পড়ল একটি চেয়ারে।
একটু পরে সেই ঘরে আরও দুজন মানুষ এল। দু’জনেই বঙ্কিমের চেয়ে বয়সে কিছু ছোট। এরা প্ৰণাম করতেই বঙ্কিম ব্যস্ত হয়ে একজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, তোমার স্ত্রী খবর কী? শুনলাম, তার কিছু কঠিন ব্যারাম হয়েছে?
লোকটি বলল, ব্যারাম মানে ফোঁড়া। এমন ফোঁড়া বাপের জন্মে দেখিনি, ঘাড়ের কাছে এই এত বড়।
বঙ্কিম বললেন, কার্বাঙ্কল নয় তো?
লোকটি বলল, হতে পারে, নাও হতে পারে। চিকিৎসক ঠিক বুঝতে পারছেন না। বলছেন, কেটে দেখলে বোঝা যাবে। আমার স্ত্রী কাটা-ছেড়া করতে খুব ভয় পান, শুনেই মুৰ্ছা যাবার জোগাড়। বঙ্কিম বললেন, সার্জারি না করেও ফোঁড়ার ওপর মেসমেরাইজ করার মতন আঙুল চালনা করলে স্বস্তি বোধ হয়। তবে কর্পূর মাখিয়ে নিতে হয় আঙুলে। তুমি নগেন চাটুজ্যেকে চেন?
সেই ব্যক্তি বলল, আজ্ঞে না।
বঙ্কিম বললেন, নগেন্দ্রবাবু মোসমেরাইজ করতে জানেন। অনেকের উপকার হয়েছে…আর একটা কথা আছে, তুমি স্নান করে শুধু ফলমূল খাবে, আর কিছু খেও না। সমস্ত দিন একমনে চিন্তা করো কিসে তোমার পরিবারের ভালো হবে। শরীর ও মন পবিত্র রেখো, মনে পাপ-চিন্তা যেন না আসে। সন্ধ্যার সময় তার বিছানার পাশে বসে একবার তাকে স্পর্শ করো…
ভরত হা করে সব শুনছে। এই সবই সাধারণ মানুষের মতন কথা। সাহিত্যের মধ্যে এরকম সংলাপ সে দেখেনি। একজন লেখক যখন কাগজ-কলম নিয়ে বসেন, তখনি বুঝি তিনি অসাধারণ হয়ে ওঠেন। তবু, যত সামান্য কথাই হোক, বঙ্কিমের কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতেই সে রোমাঞ্চিত হতে লাগল।
একটু পরে বঙ্কিম আবার দ্বারিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা এখন এসো। আমি স্নান করতে যাব। দ্বারিকা মরিয়া হয়ে বলে উঠল, খুড়োমশাই, আমার এই বন্ধুটি আপনার এত ভক্ত যে আপনার উপন্যাসের পাতার পর পাতা মুখস্থ বলতে পারে। আপনি একটু শুনবেন? বঙ্কিম বললেন, আমার এখন সময় নেই।
ভরত লজ্জায়, মরমে মরে যাচ্ছে, সে পালিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত। তার প্রিয় লেখকের এমনভাবে সময় নষ্ট করা মহাপাপ। কিন্তু অন্য দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন কৌতূহলী হয়ে বললেন, তাই নাকি? গদ্য মুখস্থ পারে?
অপর ব্যক্তি বললেন, ওঁর লেখা স্থানে স্থানে অপূর্ব কবিত্বময়। এক-দু’বার পড়লেই মনে থেকে যায়।
দ্বারিকা আর দেরি করল না। এক কোণে টেবিলের ওপর বঙ্কিমের কিছু বই রাখা আছে, সদ্য দফতরখানা থেকে এসেছে। তাঁর একটি বই টপ করে তুলে নিয়ে দ্বারিকা বলল, এই তো আনন্দমঠ। মিলিয়ে দেখুন। শুরু কর, কোন পৃষ্ঠা বলবি? থেকে তোর মুখস্থ তো দুদিন আগেই শুনেছি।
ভরত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, না, না, আমি সে রকম কিছু পারি না। দ্বারিকা, এখন চল, উনি স্নান করতে যাবেন…
দ্বারিকা বলল, পাঁচ মিনিট! পাঁচ মিনিট। একটা পাতা বল। আপনারা দেখবেন, ও একটা শব্দ, কমা, দাঁড়িও ভুল করবে না।
দ্বারিকার পেড়াপিড়িতে অগত্যা ভরতকে শুরু করতেই হলো। বঙ্কিম কিছুটা অপ্রসন্ন মুখে, কিছুটা কৌতূহলের সঙ্গে ভরতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আধ মতন বলে ভরত থেমে গেল।
যে-ব্যক্তিটি বই মিলিয়ে দেখছিল, তার ভুরু দুটি ঈষৎ কুঞ্চিত। সে বলল, হ্যা, মোটামুটি ঠিকই আছে, কিন্তু কয়েকটি শব্দে ভুল আছে। এই শব্দগুলি কি তুমি ইচ্ছে করে বদলে দিলে? তুমি বললে, ‘ভবানন্দ বলিল, “ভাই, ইংরেজ ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।” বইতে আছে, ‘ভাই, নেড়ে ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।’ আর এক জায়গা তুমি বললে, ‘অকস্মাৎ তাহারা ইংরেজের উপর পড়িল। ইংরেজ যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না।” বইতে রয়েছে দেখছি। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়ল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না।”
ভরত হকচাকিয়ে গেল, এরকম ভুল তো তার হতেই পারে না। লাইন ভুলে যেতে পারে, কিন্তু শব্দ বদলাবে কেন?
এতক্ষণ পর বঙ্কিমের ওষ্ঠে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠেছে। তিনি ভরতকে বললেন, তোমার মুখস্থ শক্তি অসাধারণই বলতে হবে। তুমি ঠিকই বলেছ। পরীক্ষকটি বলল, তা হলে বইয়ের সঙ্গে কয়েকটি শব্দের অমিল কেন? বঙ্কিম বললেন, তুমি যেটি দেখেছ, সেটি দ্বিতীয় সংস্করণ। এই যুবকটি প্রথম সংরক্ষণ পড়েছে। ওর মুখস্থ ঠিকই আছে।
দ্বারিকা করলেন, আপনি আনন্দমঠের দ্বিতীয় সংস্করণে অনেক কিছু বদলেছেন!
বঙ্কিম বললেন, অনেক নয়, কিছু পরিবর্তন করতেই হয়েছে। আনন্দমঠ লেখার ফলে সাহেবরা আমার ওপর চটেছে। খামোখা উড়িষ্যায় বদলি করে দিল।
ভরত যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এই উপন্যাস থেকে ইংরেজ কেটে নেড়ে কিংবা যবন বসানো হয়েছে? কেন? আমাদের আসলে প্রতিপক্ষ কে, ইংরেজ নয়? মুসলমানরাও তো এই দেশের মানুষ! তার বন্ধু ইরফান আলি, বঙ্কিমচন্দ্ৰে খুব ভক্ত। সেও আনন্দমঠ পড়ে উচ্ছ্বসিত। দ্বিতীয় সংস্করণ তার চোখে পড়লে সে কষ্ট পাবে না?
বঙ্কিম তার প্রশংসা করেছেন, এ জন্য ভরতের আনন্দে অধীর হবার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার মনটা দমে গেছে। দ্বারিকা বলল, খুড়োমশাই, আমি একটা এই বই নেব? বঙ্কিম শুধু মাথা নাড়লেন, নাম সই করে দিলেন না।
এবার সত্যিই যেতে হবে। দু’জনে বাইরে এসে জুতো পরতে লাগল। একটা ফিটন গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। তার থেকে নামল কেঁচানো ধুতি, কুর্তা ও মেরজাই পরা এক রূপবান তরুণ যুবা। তার চক্ষুদুটি এমনই স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল যে সেই মুখের দিকে একবার তাকালে সহসা চোখ ফেরানো যায় না।
ভরত জিজ্ঞেস করল, ইনি কে রে, চিনিস?
দ্বারিকা খানিকটা অবহেলার সঙ্গে বলল, হ্যা, চিনি। ভারতী গোষ্ঠীর একজন লেখক।
দ্বারিকা এমনই বঙ্কিম-ভক্ত যে সে অন্য কোনও লেখককে পাত্তাই দেয় না। ভরত কিন্তু বঙ্গদর্শন ও ভারতী এই দুটি পত্রিকাই পড়ে।
ভরত আবার জিজ্ঞেস করল, ভারতী গোষ্ঠীর কে? জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ? দ্বারিকা বলল, না, তার ছোট ভাই। রবীন্দ্ৰবাবু। ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ নামে একটা নবেল লিখেছেন, পড়িসনি?
ভরত বলল, সেখানা পুরো পড়া হয়নি। কিন্তু এঁর ‘প্রভাত সঙ্গীত”, অপূর্ব সুন্দর কাব্য!
দ্বারিকা গুরুত্ব না দিয়ে বলল, আমাদের বঙ্কিমের প্রথম নোবেল দুর্গেশনন্দিনী, সেই তুলনায় বট ঠাকুরাণীর হাট কী? কিছুই না।
ভরত এক তর্ক করল না। নেমে এল রাস্তায়। আবার তাঁর মনে পড়ল, ইরফান যদি আনন্দমঠের দ্বিতীয় সংস্করণ দেখে; ইরফানকে এমনিতেই অনেকে নেড়ে নেড়ে বলে ক্ষ্যাপায়!
কলেজের ছাত্রদের মধ্যে খাস কলকাতার ছেলেদের সংখ্যাই বেশি। তারা প্রায়ই বাঙালিদের মাথায় চাটি মারে। বাঙালিরা তাদের ভাষা গোপন করতে পারে না। বিশেষত সিলেট, চিটাগাং, কুমিল্লার ছেলেদের উচ্চারণ বোঝা বেশ শক্ত, তারা মুখ খুললেই কলকাতার ছেলেরা ভেংচি কাটে। ভরত অবশ্য কলেজে ভর্তি হবার আগে প্রায় এক বছর এই শহরে থেকেছে, সে এখানকার ভাষা অনেকটা রপ্ত করে নিয়েছে, তবু তাকেও মাঝে মাঝে ওরা চাটি মারে কৌতুকছলে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। ভরতের ক্লাসে মাত্র পাঁচজন। নবাব আবদুল লতিফের মতন ধনী পরিবারের ছেলেদের কেউ ঘটাতে সাহস করে না, গরিব মুসলমান ছাত্ররা বাঙালিদের মতনই জড়োসড়ো হয়ে থাকে। ইরফানের সঙ্গে প্রায় প্রথম দিন থেকেই ভরতের ভাব হয়েছে, কিছু কিছু ব্যাপারে দু’জনের চিন্তার বেশ মিল আছে।
দ্বারিকানাথ ভরতকে নিয়ে গেছে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্র ভরতের মুখস্থ বিদ্যার প্রমাণ পেয়ে প্রশংসা করেছেন, এ যে আশার অতিরিক্ত পাওয়া। কৃতিত্বের গর্বে উদ্ভাসিত হয়ে সে বলল, চল শালা, আজ উইলসনের হোটেলে আমাকে খাওয়াতে হবে!
উইলসন সাহেবের হোটেলের সামনে দিয়ে কয়েকবার যাওয়া-আসা করলেও ভরত কোনওদিন ভেতরে ঢোকেনি। হোটেলে খাওয়ারই অভ্যেস নেই তার। বড় জোর বউবাজারের মোড়ের রাস্তার দোকান থেকে কখনও কাবাব কিনে খেয়েছে। এখনও দোকান থেকে একটু দামি কিছু কিনতে গেলে তার হাত কাঁপে, হাসিও পায়। কিছুদিন আগেও যে সে কালীঘাটের কাঙালিদের মতন রাস্তা থেকে পয়সা কুড়োত, তা বন্ধুরা কেউ জানে না।
এখন অবশ্য মাসে মাসে সে দশ টাকা করে জমায়।
অলি-গলি দিয়ে লাল দিঘির দিকে যেতে যেতে এক সময় সে দ্বারিকাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যা রে, মেসমেরিজম বলে সত্যি কিছু আছে?
দ্বারিকা বলল, বাঃ, আজব কথা বললি! বঙ্কিমবাবু যখন বললেন, তখন তা সত্যি না হয়ে পারে? মেসমার সাহেবের নাম শুনিসনি এ মেসমেরিজম কী জানিস, তুই আমার দিকে চেয়ে থাকবি, আমি তোর চোখের সামনে হাত ঘোরাব, হাত ঘোরাব, এইরকম হাত ঘোরাব, তাতেই তুই এক সময় ঘুমিয়ে পড়বি। তারপর আমি তোর সব মনের কথা টেনে বার করব। ওই অবস্থায় মানুষ ঘুমের মধ্যেও কথা বলে।
– ওরকম করলে রোগ সারে?
– আলবাত সারে। সঞ্জীবচন্দ্র-জ্যাঠার কাছে শুনেছি, উনিও এরকম পারেন। কত মৃগী রুগী সারিয়েছেন। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী, জানিস তো, এই বিদ্যেটা শিখে নেয়, তারপর ভক্তদের বশ করে।
— তুই সাধু-সন্ন্যাসী মানিস?
— তেমন তেমন সাধু পেলে নিশ্চয়ই মানব। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের ওপর আমার খুব ভক্তি। শ্যামপুকুরের এক বাড়িতে ওঁকে দেখেছিলাম। খাটি যোগী পুরুষ। নেহাৎ করে ফেলেছি, না হলে আমি ওঁর চেলা হতাম!
– বিয়ে করলে বুঝি ওঁর চেলা হওয়া যায় না?
— গৃহী মানুষদের উনি তেমনভাবে আপন করে নেন না শুনেছি। আমি তো মহেন্দ্র গুপ্ত মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়েছি, ওঁর কাছেই শুনেছি, উনি যখন প্রথম বার দক্ষিণেশ্বরে যান, উনি বিবাহিত শুনেই রামকৃষ্ণদেব বলে উঠেছিলেন, এই রে, বিয়ে করে ফেলেছে!
– আমি ওঁকে কখনও দেখিনি!
— চলে যা একদিন দক্ষিণেশ্বর। সেখানে তো শুনেছি। অবারিত দ্বার, যে-সে গিয়ে ওঁর কাছে বসতে পারে। তুই যাদুগোপালের সঙ্গে অত মিশিস কেন? ব্রাহ্মদের সঙ্গে বেশি ঘেঁষাৰ্ঘেষি করিস না, রামকৃষ্ণদেবের কাছে যা, শশধর তর্কচূড়ামণির বক্তৃতা শোন, অনেক কিছু শিখতে পারবি।
ভরত চুপ করে গেল।
উইলসন হোটেলের গেটের দু’পাশে দু’জন তাগড়া চেহারার দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কোমরবন্ধে তলোয়ার, হাতে পেতল দিয়ে বাধানো লাঠি। দেখলেই বুক কাপে। দ্বারিকানাথও যদিও এই প্রথম আসছে, তবু খুব চেনা ভাব দেখিয়ে ঢুকে গেল অকুতোভয়ে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভরত চুপি চুপি জিজ্ঞেস করল, হ্যা রে, ইংলিশে অর্ডার দিতে হবে? দ্বারিকা হেসে বলল, কেন, ইংলিশ বলতে শিখিস নি? ভরত বলল, কোন খাবারের কী নাম তা যে জানি না! দ্বারিকা বলল, আন্দাজে চিল মারব। সাহেবের দোকানের সব খাবারই অতি উত্তম! দোতলায় এক ফিরিঙ্গি তাদের দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, গুড আফটারনুন, বাবু, হাউ মেনি পার্সনস?
দ্বারিকা আঙুল তুলে বলল, টু!
ফিরিঙ্গি একটি মুসলমান খানসামাকে ডেকে বলল, এদের একটা ক্যাবিনে নিয়ে গিয়ে বসাও!
খানসামাটির পোশাকও বেশ জমকালো। লাল মখমলের লম্বা জামা। মাথায় পাগড়ি, তাতে পায়রার পুচ্ছের মতন ঝুঁটি। কোমরে তকমা আঁটা বেল্ট। মুখভর্তি দাড়িওয়ালা সেই খানসামাটি এমন ভারিক্কী চালে ওদের দু’জনকে নিয়ে গেল, যেন দুটি শিশুকে হাঁটতে শেখানো হচ্ছে।
কাঠের পার্টিশন দেওয়া ক্যাবিনটিতে চার জনের বসার জায়গা, ওরা দু’জন বসিল মুখোমুখি। কোথায় যেন টুং-টাং করে পিয়ানো বাজছে, পাশের ক্যাবিন থেকে শোনা গেল হাসির হররা। বাতাসে নানারকম খাদ্যের গন্ধ।
খানসামাটি প্রথমে ওদের পাশে সাজিয়ে দিল অনেকগুলি ছুটির কাটা চামচ। তারপর মেলে ধরল খাদ্য তালিকা। দু’জনে মাথা ঝুঁকিয়ে নাম পড়ে দেখার চেষ্টা করল। ভিণ্ডালু, পৰ্ক কাটলেট, বীফ স্টেক, শাটুরিব্রয়া, আর দ্যভর, লেণ্ড্যম…এর কোনওটারই মানে জানে না ওরা।
দ্বারিকা ঢালাও ভাবে বলল, যা যা ভালো আছে সব একটা করে নিয়ে এসো! ভরত আঁতকে উঠে। জিজ্ঞেস করল, কত টাকা লাগবে? খানসামাটি বুঝেছে, এরা একেবারেই উটকো, নাবালক। গম্ভীর ভাবে জানতে চাইল, জেব মে কিৎনা হ্যায়? ভরত বলল, পঁচিশ রূপেয়া? খানসামাটি মাথা নেড়ে বলল, হো জায়েগা!
ভরত নিজের পকেটে হাত দিল। সব সুদ্ধু সে পঁয়তিরিশ টাকা এনেছে। অনেক খরচ হয়ে যাবে একদিনে। তা হোক, আজ একটি স্মরণীয় দিন। বঙ্কিমবাবুকে সশরীরে দেখেছে। আর যদিও কথা বলা হল না, তবুও অনিন্দ্যকান্তি রবীন্দ্ৰবাবুকেও দেখা গেল এক ঝলক।
খানসামাটি খাবার আনতে গেছে, ভরত বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, এই সব ছুরি-কাঁটা-চামচ দিয়ে কী করে খাব? কোনটা কোন হাতে ধরে?
জিনিসগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে দ্বারিকা বলল, এর আবার ডান হাত, বা হাতের ব্যাপার আছে। কোনটা কোন হাতে ধরে কে জানে! আমরা হিন্দুরা বাঁ হাত এঁটো করি না। ম্লেচ্ছদের ব্যাপারই আলাদা। আরে দূর দূর, পয়সা দিয়ে খাচ্ছি, অত পরোয়া করার কী আছে। শুধু হাত দিয়ে খাব। দেখলি না, ফিরিঙ্গি ম্যানেজারটা কেমন কোমর ঝোঁকাল আমাদের দেখে। পয়সা দিলে সব হয়।
ভরত বলল, না বুঝে খাবার দিতে বললাম, যদি গরু-শুয়োর দেয়? তুই হিন্দুর ছেলে হয়ে সেসব খাবি?
দ্বারিকা এক গাল হেসে বলল, আমার ঠাকুর্দা গরুর মাংসের কাবাব খেয়েছিলেন সেই কতকাল আগে, আমি তো কোন ছার। আমার ঠাকুর্দা দক্ষিণা মুখুজ্যে, রাজনারাণ বোসদের সহপাঠী ছিলেন। এখন গাে-মাংস খাওয়া এমন আর কি মর্ডান ব্যাপার? আমার ঠাকুর্দারা অতদিন আগে খেয়েছিলেন তাদের তো জাত যায়নি। রাজনারাণ বোস এখন বরং বেশি বেশি হিন্দু হয়েছেন।
একটু থেমে সে জিজ্ঞেস করল, তুই ওসব খাস? তোদের বাড়িতে মুরগির মাংসও ঢোকে না বলেছিলি।
ভরত বলল, ওটা তো আমার বাড়ি নয়। শিশু বয়েস থেকে যার বাপ-মা থাকে না, তার কি কোনও জাত থাকে? রাস্তার যে কাঙালিগুলো সবজাতের এঁটো-কাঁটা খুঁটে খায়, তারা হিন্দু না মুসলমান?
দ্বারিকা বলল, শিশু বয়েসে বাপ-মা হারা অনাথরা খ্রিস্টান হতে পারে অনায়াসে। তুই বুঝি কোনও পাদ্রির সুনজরে পড়িসনি?
খানসামা প্রথম এক গ্রন্থ খাদ্য নিয়ে এল। সুদৃশ্য রুপোর রেকাবিতে সাজানো। রুপোর গেলাসে কাওড়া মিশ্ৰিত পানীয় জল।
দ্বারিকা বলল, ও, আগে বলতে ভুলে গেছি। ড্রিংকস দাও। রম। দু পাত্তর রম।
ভরত বলল, না, না, আমি না, আমি না!
দ্বারিকা বলল, শালা, এই মাত্র বললি তোর কোনও জাত নেই। মদ খেতে আপত্তি কী?
ভরত ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে অনেক রকম বিলাসিতা দেখেছে, কিন্তু মদ্যপান দেখেনি। মহারাজের কঠোর নিষেধ ছিল। শশিভূষণও মদ্যপান ঘৃণা করেন। তাই ভরতের মনে মদ্যপান সম্পর্কে বিতৃষ্ণার ভাব আছে।
দ্বারিকা বলল, আমার গুরু নিয়মিত পান করেন, এ কখনও খারাপ হতে পারে। মদ্যপান করলে চিন্তাশক্তি বাড়ে। ভরত দু’হাত তুলে বাধা দেবার চেষ্টা করলেও দ্বারিকা কিছুতেই শুনল না। একটা গেলাস তার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে বলল, খা শালা, খেয়ে দেখা! একটা চুমুক দিয়ে দেখ কেমন লাগে।
শশিভূষণের কাছে ভরত একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কখনও মদ স্পর্শ করবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা প্ৰায় সবাই মদ্য পান করে ও চুরুট ফোকে। এমনকি যাদুগোপাল কট্টর ব্ৰাহ্ম হয়েও এ ব্যাপারে আপত্তি করে না। বন্ধুদের সঙ্গে খোসা গল্পের আসরে ভরত শত উপরোধেও পান করতে রাজি হয়নি। কিন্তু দ্বারিকা একেবারে নাছোড়বান্দা, সে জোরাজুরি শুরু করে দিল।
প্ৰতিজ্ঞা ভাঙলে কি পাপ হয়? যদি কেউ জানতে না পারে? একটুখানি খেলে কী এমন ক্ষতি! ভরত মনের দ্বিধা কাটাতে পারছে না, দ্বারিকা অনবরত বলছে, খা শালা, খালি একটু চেখে দেখ. বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত ভরত গোলাসে ওষ্ঠ স্পর্শ করল।
তার মনে পড়ে গেল, জঙ্গলের মধ্যে তার সেই মাটিতে গেঁথে যাবার দৃশ্য। এক পায়ে ছিল গভীর ক্ষত, উদরে খিদের জালা, মাথার ওপর বাদুড়ের মতন ঘুরপাক খাচ্ছিল মৃত্যু। যে-কোনও মুহূর্তে তার প্রাণবায়ু নির্গত হলেই সেই বাদুড়টা হাঁ করে শুষে নিত।
সেই অবস্থান থেকে কত দূরে চলে এসেছে ভরত। সে হেসে উঠল আপন মনে।