যশোরে নরেন্দ্রপুর গ্রামে জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি। বহুদিন পর তিনি সদলবলে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। দলটি বেশ বড়, তাঁর দুই ছেলে মেয়ে ছাড়াও রয়েছে দুই দেবার জ্যোতি আর রবি, এবং জা। কাদম্বরী। একেবারে বালিকা বয়েসে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী, তারপর দেশ-বিদেশ ঘুরে এতকাল বাদে আবার ফিরলেন। পুরনো আমলের মানুষরা তাঁকে দেখে চিনতেই পারেন না। এইগ্রামে কিছু ভালো হয়নি, কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর রূপান্তর বিস্ময়কর।
নিছক বেড়াবার জন্যই আসেননি জ্ঞানদানন্দিনী, তার প্রধান উদ্দেশ্য রবির জন্য পাত্রী খোঁজা। এই যশোর জেলা থেকেই অনেকগুলি মেয়েকে ঠাকুর বাড়ির বধূ হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যশোরের মেয়েরাই লক্ষ্মী!
অনেক ঘটক-ঘটকীর আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া এই সব কাছাকাছি গ্রামে এক একদিন জ্ঞানদানন্দিনীরা মেয়ে দেখতে যান, এক একদিনে তিন-চারটি মেয়ে দেখে আসেন। দিনের পর দিন কাটে, একটিও পাত্রী পছন্দ হয় না। বাংলা দেশে কি মেয়ের আকাল পড়ল। এদিককার হিন্দুরা কন্যার বয়স সাত-আট বছর হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে দেয়। ঘটকরা যে-সব পাত্রীর সন্ধান আনছে, তাদের কারুর বয়স পাঁচ, কারুর বয়েস তিন। সেই সব কচি কচি কন্যার কারুর নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে, কেউবা এতগুলি অচেনা মানুষ দেখে কেঁদে ভাসায়।
রবি এইসব পাত্রী-সন্ধান-অভিযানে যেতে চায় না কিছুতে। জ্ঞানদানন্দিনী জোর করে তাঁকে নিয়ে যাবেনই। রবি ঠিক করেছে, সে কোনও মতামত দেবে না। বউঠানরা যা ঠিক করবেন, তাই-ই সে মেনে নেবে।
এক একদিন রবি পায়ে হেঁটে গ্রাম দেখতে বেরোয়, সঙ্গে থাকে সুরেন আর বিবি। এই বালক-বালিকা দুটি বিলেতের গ্রাম দেখেছে, কিন্তু বাংলার গ্রাম দেখেনি আগে। রবিরও পল্লীগ্রাম সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। দু’পাশে ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা, এমন দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত সে আগে দেখেছে ট্রেনের জানলা দিয়ে। এখন ইচ্ছে করলে পথ ছেড়ে নেমে সেই ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়, নাকে এসে লাগে সেঁন্দা গন্ধ, বাতাসে সবুজ ঢেউ খেলে যায়। প্রচুর ফড়িং ওড়াউড়ি করছে ঘাসের ডগায়। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে খানা-ডোবা, গ্ৰাম্য বালকরা তার মধ্যে লাফালাফি করে মাছ ধরছে। রাস্তাটা শেষ হয়েছে নদীতে এসে, ঘাটের দু’ধারে ছোট ছোট মন্দির, শ্মশানতলা। নদীটি বেশ ছোট, কাছাকাছির মধ্যেই কয়েকটি বাঁক, হাঁটু জল, হেঁটেই অনেক লোক এপার ওপার হচ্ছে, একটা গরুর গাড়িও দিব্যি নদীর ওপর দিয়ে চলে গেল। এই সব দৃশ্য রবির কাছে অভিনব এই নদীতেও মাছ ধরছে অনেক ছেলেরা, সারা গায়ে কাদা মাখা, গামছা কিংবা হাত টানা জাল দিয়ে টেনে তুলছে ঝাঝি-পাক, তার মধ্যে ছটফট করে কুচো চিংড়ি, মৌরলা, খলসে কোনওটায় একটা বড় ফলি মাছ কিংবা কালবোস পেলে তারা লাফিয়ে উঠছে উল্লাসে। যেন তাদের ইস্কুল যাওয়া নেই, হোম টাঙ্ক নেই, অন্য কোনও দায়িত্ব নেই, সারাদিন জলে দাপাদাপি করা আর মাছ ধরাতেই আনন্দ। সুরেন আর বিবি ওদের থেকে চোখ ফেরাতে পারে না।
এখানকার দিগন্ত-ছোঁয়া আকাশ দেখে রবির মনে হয়, আকাশ যেন গ্রামের দিকে অনেক নিচু। স্পষ্ট বোঝা যায় মেঘের গতিশীলতা, সারা দিনের বর্ণফেরা। এখান থেকে পৃথিবীটাকে মনে হয় বেশ ছোট, এই তো কয়েকখানা গ্রামের পরেই দিগন্তরেখা, অন্য দিকেও তাই। সমুদ্রের তটে দাঁড়িয়ে অন্যদিকের কুল-কিনারা দেখা যায় না। কিন্তু এই ধান খেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটলে দেখা যায় দুদিকেরই দিগন্ত। প্রকৃতির থেকে চোখ ফিরিয়ে রবি মানুষের দিকে তাকায়। গ্রামের মানুষ আর শহরের মানুষের মধ্যে এত প্ৰভেদ! সারা গায়ে কাদা মেখে যে ছেলেগুলো মাছ ধরছে, তাদের তুলনায় ইজোরআলেস্টার জুতো পরা সুরেন আর ফ্রক ও হাঁটু পর্যন্ত মোজা পরা ইন্দিরাকে মনে হয় যেন অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। নদীর ঘাটে সারা দিন ধরে যারা আসছে-যাচ্ছে, তারা নিজেদের গ্রামের মানুষ ছাড়া অন্য কোনও মানুষজন চেনেই না। রবিদের দিকে তারা ভাষাহীন বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। একদিন এখানকার পোস্টমাস্টারবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। যুবকটি এসেছে। জেলা শহর থেকে, গ্ৰাম্য জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত নয়, নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়, একটি বাচ্চা মেয়ে তার ঘরের কাজ করে দেয়। সাতখানা গ্রামের এই একমাত্র পোস্ট অফিস, তাও চিঠি আসে নাম মাত্র, এক একদিন আসেই না। পোস্টমাস্টারবাবুট কবিতা লেখে, একমাত্র সে-ই বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত।
মেয়ে দেখার অভিযান অব্যাহত থাকলেও মনে হচ্ছে, এখান থেকেও ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে। কাদম্বরী যদিও সঙ্গে এসেছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে রবির বিশেষ দেখা হয় না। রবি বাচ্চাদের নিয়ে বাইরের দিকের একটি ঘরে থাকে। পাত্রী নির্বাচনের সময় কাদম্বরী একটিও কথা বলেন না। অন্তরঙ্গদের বাইরে তিনি নীরবই থাকেন। জ্ঞানদানন্দিনীই চালান সব কথাবার্তা।
হঠাৎ একদিন পথে বেণী রায়ের সঙ্গে দেখা। বেণী রায় জোড়াসাঁকোর বাড়িরই এক কর্মচারী, তার দেশ যে যশোরে তা কে জানত! বাবুদের বাড়ির এতগুলি মানুষজন দেখে সে একেবারে বিগলিত হয়ে পড়ল। হাত কচলাতে কচলাতে সে বলল, জ্যোতিবাবুমশাই, এতদূর এসেছেন যখন, একবার আমার এই গরিবের বাড়িতে পা দেবেন না? বধূঠাকুরানীরাও যদি আসেন, আমার ওয়াইফ আর ফ্যামিলি ধন্য হয়ে যাবে।
কাছেই দক্ষিণডিহি গ্রামে বেণী রায়ের বাড়ি। পরদিন সবাই এলেন সেখানে বিকেলবেলা। প্ৰখ্যাত জমিদার ঠাকুর বংশের রাজা-রানীর মতন চেহারায় কয়েকজন এসেছেন বেণী রায়ের মতন একজন সাধারণ লোকের বাড়িতে, এ জন্য পাড়াপ্রতিবেশীরাও এঁদের দেখার জন্য ভিড় করে এল। বেণী রায় প্রচুর জলযোগের আয়োজন করে ফেলেছে, ঐরা কেউ অত খাবেন না, তবু পেড়াপিড়ি চলতে লাগল।
একটি আট-ন বছরের শ্যামলা রঙের দোহারা চেহারার বালিকা খাবারের প্লেট, জলের গেলাস এনে দিচ্ছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়েটি কে?
বেণী রায় হেঁ হেঁ করে হেসে বলল, আজ্ঞে ইটি আমারই শেষ বয়েসের কন্যা। ওর নাম “ভবতারিণী। এই ভবি, পেন্নাম কর, বাবুদের পেন্নাম কর। জ্ঞানদানন্দিনী জিজ্ঞেস করলেন, ওরা এখনও বিয়ে দেননি। বেণী রায় বলল, মা জননী, চেষ্টা তো করছি, ঠিকমতন যোটক হচ্ছে না। এবারে ওর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করব বলেই তো ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছি!
জ্ঞানদানন্দিনী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে চোখাচোখি করলেন।
বাড়ি ফেরার পথেই জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, এই তো পাত্রী পাওয়া গেছে। আর খোঁজাখুঁজির দরকার কী? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইতস্তত করে বললেন, আমাদের সেরেস্তার কর্মচারীর মেয়ে। এই সম্বন্ধ করতে কি বাবামশাই রাজি হবেন? জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, বাবামশাইকে বুঝিয়ে চিঠি লিখতে হবে। দেখলে তো, এর চেয়ে ভালো আর কোনও মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবামশাই তো জানেন, কোনও বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারই আমাদের বাড়ি মেয়ে দিতে চায় না। এই মেয়েটিকেই আমরা বেশ গড়ে-পিটে মানুষ করে তুলব।
এরপর আরও আলোচনা হল। জ্ঞানদানন্দিনীর মতটাই প্রবল। তাঁর উদ্দেশ্যও স্পষ্ট, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। রবির বিবাহের ব্যবস্থা করে রবিকে তিনি কাদম্বরীর পক্ষছায়া থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চান।
কাদম্বরী যথারীতি কোনও মতামত দিলেন না। রবির মনটা দমে গেছে। তার বয়েস এখন তেইশ। অতি সাধারণ, মুখচোরা একটি ন বছরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে তার সঙ্গে সে জীবনের কোন কথা আলোচনা করবে। লেখাপড়াও তো প্রায় কিছুই শেখেনি মেয়েটি।
সুরেন আর ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তারা যখন শুনল, পাত্রী বাছা হয়ে গেছে, তখন ইন্দিরা বলল, ওমা, আমার থেকেও ছোট। তার সঙ্গে রবিকাকার বিয়ে হবে, তাকে কাকিমা বলে ডাকব?
দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালেন। অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি খবর পেলেন যে, রবি এই বিবাহের ব্যাপারে দোনামোনা করছে, তিনি মুসৌরিতে ডেকে পাঠালেন রবিকে। রবি যে শুধু তার জ্যোতিদাদা আর নতুন বউঠানের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ঘোরে, নিজে দায়িত্ব নিয়ে কোনও কাজ করতে শেখেনি, এ জন্য তিনি অসন্তুষ্ট। মুসৌরিতে ডেকে তিনি রবিকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, সামনের অঘ্রাণ মাসেই শুভদিন আছে, সেইদিনই বিবাহ করতে হবে রবিকে এবং তারপর থেকেই লেগে পড়তে হবে জমিদারির কাজকর্মে। প্রথমে সে কাছারিতে বসে সদর আমিনের কাছ থেকে জমাওয়াশিল ৰাকি ও জমা খরচ দেখতে থাকবে।
পিতৃ আদেশ মাথা নিচু করে শুনে রবি ফিরে এল কলকাতায়।
বিয়ের উদযোগ শুরু হয়ে গেল। এই সময় জ্ঞানদানন্দিনী আর ছাড়লেন না। রবি এসে রইল তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে। আর বিবি খুব খুশি। এ বাড়িতে কবিতার আসর বসে না, তবে গান-বাজনা ও হইচই হয় খুব। প্রায় প্রতি সন্ধেতে। যখন ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে যায়, তখন জ্ঞানদানন্দিনী বাংলা প্ৰবন্ধ লেখার কসরত করেন, মাঝে মাঝেই রবির কাছে এসে বলেন, তুমি আমার ভাষা ঠিকঠাক করে দাও তো।
কাদম্বরী যে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সে খবর রবি পেল বেশ কয়েকদিন পরে। ওদিকে তার আর যাওয়াই হয় না। এ বাড়িতে কে যেন কথাচ্ছলে জানাল, নতুন বউঠানের চেয়ে বড় বন্ধু আর কে? নতুন বউঠানের যে আর একজনও বন্ধু নেই।
পরদিন বেলাবেলি রবি জোড়াসাঁকোয় এসে পৌঁছোল বটে, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। সে অসুস্থ নতুন বউঠানকে দেখতে এসেছে, এমনি এমনি আসেনি। আগে সব কিছুই ছিল অকারণ। কোনও কথা না বলেও দুজনে একসঙ্গে কত সময় কাটিয়েছে।
তিনতলায় মহলটি নিঃশব্দ শুনেই রবি বুঝল জ্যোতিদাদা বাড়িতে নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জাহাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কলকাতা বন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ। খিদিরপুর ও হাওড়ায় জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতির অনেকগুলি বড় বড় কারখানা আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিলামে যে জাহাজের খোলটি কিনেছেন সেটিকে পূর্ণাঙ্গ করে তোলার জন্য তিনি অনেক কারখানায় ঘুরছেন, কিন্তু সকলেরই হাতে অনেক কাজ, কেউই বছর খানেকের আগে হাত দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত একটি সাহেব কোম্পানিকে রাজি করানো গেছে, কিন্তু তাদের কাজও চলছে অত্যন্ত শ্লথ গতিতে। তিনতলায় উঠে এসে রবি দেখল, কাদম্বরী পাশ ফিরে শুয়ে আছেন তাঁর পালঙ্কে, ঘরে আর কেউ নেই। রবির রাগ হল। এত বড় বাড়ি, এত মানুষজন, অথচ একজন রুগীকে দেখাশুনো করার কেউ নেই? কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে পরিবারটি, কেউ কারুর ব্যাপারে মাথা গলায় না। একটা দাসী পর্যন্ত এসে নেই কাছে।
রবি এসে শিয়রের কাছে দাঁড়াল। ঘুমিয়ে আছেন কাদম্বরী, রোগ হয়ে গেছেন এই কদিনেই। মুখখানি শীর্ণ, বেরিয়ে এসেছে কণ্ঠার হাড়। ডাকবে কি না, বুঝতে পারল না। রবি। কাদম্বরীর শুয়ে থাকার মূর্তিটি এত করুণ! যেন ঘোর জঙ্গলে গাছতলায় শুয়ে থাকা এক নির্বাসিতা রাজকন্যা। রবির খুব ইচ্ছা হল, সব কাজ ছেড়েছুড়ে সে নতুন বউঠানের সেবা করবে। কিন্তু কী করে সেবা করতে হয় তা যে সে জানে না। পায়ে হাত বুলিয়ে দিলে ভালো লাগবে?
তখনই জেগে উঠলেন কাদম্বরী। স্নান হেসে বললেন, রবি? কখন এসেছ? রবি বলল, নতুন বউঠান, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ।” কাদম্বরী বললেন, না তো। রাগ করব কেন? রবি বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি, ও বাড়িতে থাকছি।! কাদম্বরী বললেন, বাঃ, তাতে কী হয়েছে। তুমি সব সময় আমাদের কাছে থাকবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? সুরো-বিবি তোমাকে নিয়ে কত আনন্দ করে। আমার কাছে সব সময় থাকতে তোমার ভালো লাগবেই বা কেন?
– তোমার কী হয়েছে?
— কী একটা লক্ষ্মীছাড়া অসুখ। মাঝে মাঝে হাত-পা ব্যথা করে, বুক ব্যথা করে, মাথা তুলতে পারি না।
— ডাক্তাররা কী বলছেন? আমি ডাক্তারাসাহেবের সঙ্গে দেখা করব।
— অসুখের কথা ছাড়ো তো, রবি! তোমার বিয়েতে কত আনন্দ-ফুর্তি হবে, সেই সময় আমি কি বিছানায় শুয়ে থাকিব? ঠিক সেরে উঠবে তার আগে।
রবি কয়েক চেয়ে রইল কাদম্বরীর দিকে। তারপর খানিকটা আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, নতুন বউঠান, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি ঠিক উত্তর দেবে? আমি যে…আমার যে বিয়ে হচ্ছে, তুমি তাতে খুশি হয়েছ?
কাদম্বরী ধড়মড় করে উঠে বসলেন, হাসি-কান্না-বিস্ময় মেশানো গলায় বললেন, ওমা, সে কি কথা গো! খুশি হব না। কেন? তোমার বিয়ে, আমাদের কত আনন্দের ব্যাপার। মেয়েটিকে বুঝি তোমার মনে ধরেনি! না, না, বেশ মেয়ে, ভালো মেয়ে। দেখো, একদিন গুটিপোকা ঠিক প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলবে।
রবি বলল, নতুন বউঠান, তুমি সেরে ওঠে, তুমি ভালো হয়ে ওঠে। তোমার অসুখ দেখলে আমার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু ভাল লাগে না। আমি কালই ও বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসছি, তোমার পাশে থাকব।
কাদম্বরী ব্যস্ত হয়ে রবির একটা হাত চেপে ধরে বললেন, অমন কাজও করো না, রবি! কেন আসবে। সুরো-বিবির মা মনে দুঃখ পাবেন। আমার জন্য তোমাকে মোটেই আসতে হবে না। আমি ঠিক সেরে উঠব বলছি তো।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ধারণা, অসুখ বিসুখ সারাবার শ্ৰেষ্ঠ উপায় হাওয়া-বাদল। সত্যেন্দ্রনাথ এখন আছেন। কর্নাটকের সমুদ্র-বন্দর কারোয়ায়। খুবই মনোরম স্থান। তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য অনেকবার আহবান জানিয়েছেন। এবারে তার পত্নী, ছোট ভাই ও আরও অনেককে নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যাত্রা করলেন সেই সমুদ্রের দিকে। প্রথমে ট্রেনে বোম্বাই, তারপর একটি সম্পূর্ণ জাহাজ ভাড়া করে তিনদিন সমুদ্রপথে পাড়ি।
সেখান থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই রবির বিবাহের সব ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেল।
বিবাহ তো শুধু দুইজনের ব্যাপার নয়, আরও কতজন যে এর সঙ্গে জড়িত! এই উপলক্ষে বাড়ির ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক হয়, গৃহিণীরা নতুন গয়না গড়ান, নিমন্ত্রিতদের তালিকা বানাবার ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা চলে, ভোজের তালিকাটাও কম আলোচ্য নয়। রবির বন্ধুরা বলে রেখেছে, বিয়ের দিন যা-ই খাওয়া দাওয়া হোক, পরে শুধু বন্ধুদের জন্য হোটেলে আলাদা পার্টি দিতে হবে। কিংবা নানকিং নামে একটি চিনা রেস্তোরা খুলেছে, সেখানকার কাঁকড়ার রোস্ট উপাদেয়।
এই সব উৎসাহের ছোঁওয়া শেষ পর্যন্ত রবির মনেও লাগল। একটি নিতান্ত খুকিকে যখন বিয়ে করতেই হচ্ছে, তখন মন খুলে করাই ভালো। পারিবারিকভাবে নিমন্ত্রণের চিঠি ছাপা হলেও রবি তার বন্ধুদের নিজের হাতে চিঠি লিখে পৃথকভাবে আমন্ত্রণ জানাল। প্রিয়নাথ সেনকে সে লিখল :
প্রিয়বাবু,
আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্ৰীমােন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি
অনুগত
শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিঠিখানি পেয়ে বেশ অবাক হল প্রিয়নাথ। এর যে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রের বিবাহ হচ্ছে তা তো জানা, সে ছেলেমানুষের মতন একখানি চিঠি রচনা করেছে, কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে কোথায়। সে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যেতে বলেছে, সেখান থেকে কি বরযাত্রী হিসেবে যাওয়া হবে? কনের বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয় সব সময়। কিন্তু রবি যে লিখেছে, ওই জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই “বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া’?
প্রিয়নাথ জিজ্ঞেস করল নগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে। নগেন বলল, আমিও তো ওই একই চিঠি পেয়েছি। ঠিক বুঝতে পারছি না!
রবির বিবাহ হল নতুন মতে। তার শ্বশুর বেণী রায়ের টাকা পয়সা নেই। তার কন্যাকে যাতে ঠাকুরবাড়ির বন্ধুর উপযুক্ত বস্ত্ৰালঙ্কার সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়া হয়, সে জন্য ঠাকুরবাড়ি থেকেই নানারকম গয়না ও শাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় একটা বাড়িও ভাড়া করে দেওয়া হয়েছে ওঁদের জন্য, যশোর থেকে ভবতারিণী, তার মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন এসে রয়েছে সেই বাড়িতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাত্রপক্ষ বিবেচনা করল, সবই যখন তাদেরই দেওয়া, তখন ওই ভাড়াবাড়িতে আর বর ও বরযাত্রীদের পাঠাবার কী দরকার! জোড়াসাঁকোর বাড়িতে সব চুকিয়ে ফেললেই তো হয়।
ফুল দিয়ে সাজানো অশ্বশকটে নয়, পায়ে হেঁটে একখানি মাত্র বারান্দা ঘুরে রবি এল অন্দরমহলের বিবাহ আসরে। হিন্দু মতে এর আগে আইবুড়ো ভাত খাওয়া এবং গায়ে হলুদ বর্ণ সবই হয়েছে, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের বিয়েতে শুধু শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষী রাখা হয় না। রবি পরেছে। গরদের কাপড় ও কাঁধে একটি পারিবারিক শাল, মাথায় সে মুকুট পরেনি। রবি দাঁড়াল একটা পিঁড়ির ওপর, কনেকে আর একটা পিড়িতে বসিয়ে ঘোরানো হল সাত পাক। কনে জড়সড় হয়ে এমন মাথা নিচু করে আছে যে তার মুখখানি দেখাই যায় না।
এরপর বর-কনে দুজনেই হেঁটে হেঁটে এল দালানে। এখানে হল সম্প্রদান।
এ বাড়ির কোনও পুত্র বিবাহ করে সংসারী হলেই তার জন্য বরাদ্দ করা হয় একটি মহল। রবির জন্য একটি বেশ বড় ঘর নতুন আসবাবে সুসজ্জিত করা হয়েছে। আচার-অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সেই ঘরে বসল বাসর।
দেবেন্দ্রনাথ আসেননি। পুত্ৰ-কন্যাদের বিবাহ-অনুষ্ঠান সাঙ্গ হবার কয়েকদিন পর তিনি যৌতুক পাঠিয়ে দেন, এটাই তাঁর প্রথা। দাদারাও অনেকে অনুপস্থিত, রবির বিবাহ উৎসব কেমন যেন অনাড়ম্বর। বাসরে আমোদ-প্ৰমোদও কিছুটা নিষ্প্রাণ, কেউ কেউ গান গাইছে, ঠিক যেন জমছে না।
এ বাসরে অন্য পুরুষ নেই। কাচ্চা-বাচ্চা ও বয়স্ক মহিলারাই উপস্থিত। রবির কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বললেন, ও রবি, তুই হেন এমন গায়ক থাকতে আর কেউ যে সাহস করে গাইতে পারছে না। তুই একটা গান ধর না। মাঝে মাঝেই রবি চোখ দিয়ে একজনকে খুঁজছে। আর সবাই আছে। শুধু একজন নেই। কাদম্বরীকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কাদম্বরী বলেছিলেন রবির বিয়েতে তিনি খুশি হয়েছেন। সত্যি কি সেটা তার মনের কথা? কোনও আচারঅনুষ্ঠানেই দেখা যাচ্ছে না তাঁকে।
উৎসবের সব ভার নিয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি দশভূজার মতন সব দিক সামলাতে পারেন, তাঁর পাশে কাদম্বরী যেন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। রবি যেন কল্পনায় দেখতে পেল, কাদম্বরী একা নিজের ঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরের বাতি জ্বলেনি, অন্ধকারের মতন নিঃসঙ্গতা জড়িয়ে আছে তাঁকে। বিবাহ বাসরের প্রধান ব্যক্তিটির কি অন্যমনস্ক হয়ে থাকার উপায় আছে? সবাই ঠেলাঠেলি করছে তাকে, রবি জোর করে হাসি ফোটাচ্ছে মুখে। তার বুকের ভেতরটায় যেন একটা ফাটা বাঁশির বেসুরো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মেয়েদের দঙ্গল বারবার বলছে, অমন চুপ করে আছ কেন, রবি, তুমি একটা গান ধরো, গান গাঁও!
রবি তখন তার স্বর্ণদিদির লেখা একটা গান গেয়ে উঠল : আ মারি লাবণ্যময়ী, কে ও স্থির সৌদামিনী…
কনেটির নাম আজ থেকে বদলে গেছে। ভবতারিণী নাম একেবারে চলে না। তার নতুন নাম হয়েছে মৃণালিনী। ওড়নায় মুখ ঢেকে সে লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে, যেন তার কপাল ঠেকে যাবে মাটিতে। তান দেওয়ার ভঙ্গিতে রবি সেই অবগুণ্ঠিতার মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বারবার বলতে লাগল, কে ও স্থির সৌদামিনী… কে ও স্থির সৌদামিনী…
সবাই হেসে আকুল!
রবি আরও দুষ্টুমি করতে লাগল ভাঁড়কুলো খেলার সময়। একটা কুলোর ওপর চাল থাকে, ভাঁড়ে করে সেই চাল একবার করে ভরে ফেলে দিতে হয়। মেয়েরা তখন নানারকম কৌতুক করে। সেই খেলা শুরু হতে না হতেই রবি ভাঁড়গুলো সব উপুড় করে দিতে লাগল।
ত্রিপুরাসুন্দরী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ওকি, ওকি করছিস রবি? ভাঁড়গুলো সব উলটে পালটে দিচ্ছিস কেন?
রবি ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বলল, জানো না কাকিমা, সবই যে ওলোট পালোট হয়ে গেল। আজ থেকে!