দেবতারা যেমন স্বর্গে থাকেন, তাদের দেখা যায় না, সেই রকম ভারতের শ্বেতাঙ্গ শাসকরাও থাকেন আড়ালে, শহরের এমন অংশে, যেখানে দেশের সাধারণ মানুষরা কখনও যায় না। সেই সাহেবপাড়ায় পথ ঘাট বাধানো ঝকঝকে, বড় বড় থামওয়ালা সব সুদৃশ্য বাড়ি, যেন অমরাবতী! যারা এ দেশের মূল অধিবাসী, তাদের পল্লীগুলিকে ইংরেজরা নাসিকা কুঞ্চিত করে বলে ‘ব্ল্যাক টাউন’, সেখানকার মানুষগুলো তাদের ভাষায় ‘ডাস্কি সোয়ার্মস’!
ভারতীয়রা যতই শিক্ষিত হচ্ছে ততই ইংরেজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছে। ওকালতি, ডাক্তারি, মাস্টারি, সিভিল সার্ভিস, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভারতীয়রা ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিতে আসছে দেখে তারা ক্রুদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। অস্ত্রবলে এত বড় দেশটা তারা দখল করেছে কি এখানকার মানুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবার জন্য, না তাদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখার জন্য? বাঙালিদের ওপরেই তাদের বেশি রাগ। কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, এখানকার মানুষজনই শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেয়েছে বেশি। খানিকটা লাই পেয়েই বাঙালিরা মাথায় চড়তে চায়। কিছু কিছু বাঙালি যখন তখন ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে, সে দেশ ঘুরে দেখছে যে টুপিওয়ালা সাদা চামড়ার দেশটা এমন কিছু আহামরি জায়গা নয়, লন্ডন শহরের সঙ্গে কলকাতা শহরের এমন কিছু তফাত নেই। ফিরে এসে তারা ইংরেজিতে সংবাদপত্র বার করছে, ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে জানাচ্ছে ভারত শাসনের ব্যাপারে ভারতীয়দের কিছু কিছু অধিকার থাকা উচিত। এক দরিদ্র, পরাজিত জাতির মুখে এমন স্পৰ্ধার কথা! ইংরেজরা যখন তখন ভারতীয় অপমান করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কে প্রভু আর কে দাস!
অশালীন ভাষায় ভারতীয়দের আক্রমণ করার প্রধান মুখপত্র ইংলিশম্যান পত্রিকা। বছর দেড়েক আগে সেখানে এরকম। একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, “কৰ্মখালি। সৈয়দপুরের অধিবাসীদের জন্য কিছু ধাঙড়, পাখা-কুলি আর ভিস্তি চাই। এট্ৰেন্স পাশ শিক্ষিত বাঙালিবাবু ছাড়া আর কারুর দরখাস্ত গ্রাহ্য হবে না। প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরা (বাঙালি) অগ্রাধিকার পাবে।”
ভারতীয়দের কুকুর আর বাঁদর বলে অভিহিত করা এবং বাঙালিদের জুতিয়ে সিধে করার প্রস্তাবও এই পত্রিকায় প্রায়ই স্থান পায়। আর ইংরেজরা যখন ভারতীয়দের প্রহার করে কিংবা রাগের মাথায় খুন করে ফেলে, সে সব সংবাদ এ পত্রিকায় স্থান পায় না।
ইংরেজরা যতই অপমান বা ব্যাঘাত করুক, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ভারতীয়দের নেই। আদালতে গেলে তারা সুবিচার পাবে না, তাদের হাতে অস্ত্রও নেই, অন্ত্র আইনের ফলে কোনও ভারতীয়দের অস্ত্র রাখা বা অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ। বিদেশ থেকে আসা কোনও আফ্রিকান কিংবা চিনে বা জাপানি, এমনকি এদেশের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাও অনায়াসে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে পারবে, কিন্তু ভারতের মাটিতে শুধু কোনও ভারতীয়ই অস্ত্র রাখতে পারবে না।
হায়দ্রাবাদ অঞ্চলের এক ছোটখাটো রাজা কিছুদিন আগে আগ্রা যাচ্ছিলেন সরকারি সফরে। তিনি ট্রেনের ফাস্ট ক্লাসের যাত্রী, তার প্রজারা স্টেশনে এসে ভিড় করে জয়ধ্বনি দিতে দিতে তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানাল। সে এক রাজকীয় যাত্রা! ফেরার নির্দিষ্ট দিনে তিনি কিন্তু নামলেন মুখ চুন করে এক তৃতীয় শ্রেণীর কামরা থেকে। তিনি আর কখনও প্রথম শ্রেণীতে চাপবেন না ঠিক করেছেন। কারণ, যাবার সময় তাঁর কামরায় ছিল দুটি বন্দুকধারী ইংরেজ, তাদের জুতো কাদামাখা, তারা কোনও জলা জায়গায় স্নাইপ শিকার করে ফিরছে। সেই ইংরেজ দু’জন রাজামশাইয়ের কান ধরে টেনে নিজেদের কাছে এনে বলেছে, ওরে নেটিভ, আমাদের জুতো খুলে দে, কাদা মুছিয়ে পা মালিশ কর। সে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন রাজা!
রাজাদেরই যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষদের আরও যে কত দুর্দশা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতন ব্রিটিশ-ভক্ত মানুষও সখেদে বলেছেন, বেশির ভাগ ইংরেজ কর্মচারিই মনে করে ‘কোনও নেটিভই ভদ্রলোক হতে পারে না’। মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার চার্লস টার্নার তাঁর সহকর্মী বিচারপতি মাহমুদকে নিয়ে একদিন মাদ্রাজ ক্লাবে গেছেন, দরজার কাছেই একজন সদস্য দৌড়ে এসে বলল, কোনও নেটিভকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এই রকম ঘটনা প্রতিনিয়িতই দেশের নানা অঞ্চলে ঘটছে।
দেবরাজ ইন্দ্রের মতন ভারত শাসক ইংরেজদের শিরোমণি অর্থাৎ ভাইসরয় এখন লর্ড রিপন। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি অদৃশ্য। তিনি কখনও কলকাতায়, কখনও দিল্লিতে, কখনও সিমলায় থাকেন। সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই ইংরেজ রাজপুরুষরা দেশীয় লোকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। আগের দশকেই ভাইসরয় লর্ড মেয়ো আন্দামান সফরে গিয়ে এক ধর্মোন্মাদ পাঠানের হাতে খুন হয়েছেন। রিপনের ঠিক আগের ভাইসরয় লর্ড লিটন ভারতীয় প্রজাদের যতটা ক্ষতি করে গেছেন, তেমনটি আর কেউ করেনি। প্রখ্যাত এক লেখকের সন্তান এই লর্ড লিটন এক ক্রূর রাজনীতিবিদ শাসক। ভারতে যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আসা হয়েছে, তখন দয়ামায়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই লিটনই জারি করে গেছেন অস্ত্র আইন, সমস্ত ভারতীয় পত্র-পত্রিকার ওপর চাপিয়ে গেছেন সেনশরশিপ। ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড়ের কলের মালিকদের স্বার্থে এদেশের তাঁতিদের সর্বনাশ করে গেছেন। সাঙ্ঘাতিক দুর্ভিক্ষে ভারতের পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা গেল, আর ভারতের প্রভু তখন দিল্লিতে এক দারুণ আড়ম্বরপূর্ণ ও ব্যয়বহুল দরবার বসালেন। বহুকাল ধরে দিল্লিতে ছিল মুঘল সম্রাটের রাজধানী, সেই দিল্লিতেই ঘোষণা করা হল যে মহারানী ভিক্টোরিয়া এখন ভারতের সম্রাজ্ঞী।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাধিয়ে লিটন আর এক মারাত্মক ভুল করে গেছেন।
সমগ্র ভারত জয় করেও ইংরেজরা আফগানিস্তানকে সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পারেনি। কয়েকবার চেষ্টা করে বোঝা গেছে, দুঃসাহসী আফগানরা কিছুতেই পরাধীনতা মেনে নেবে না। গায়ের জোরে দখল করা যেতে পারে, কিন্তু অশান্তি চলতেই থাকবে, আফগানদের হাত থেকে অস্ত্রও ছাড়ানো যাবে না, তাদের ওপর শাসন পদ্ধতিও চাপানো যাবে না। তাই আফগানিস্তানকে অনেকদিন ঘটানো হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝেই রুশ জুজুর গুজব ছড়ায়। ইংরেজদের ধারণা, রাশিয়ার সম্রাটের ফৌজ হঠাৎ কোনওদিন ভারত আক্রমণ করে বসবে। ভারতের মতন এমন একটি সোনার হাসের সব ডিম শুধু ইংরেজরা ভোগ করবে, এটা অন্য ইওরোপীয়দের সহ্য হবে কেন? ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগিজরা এখানে পাল্লা দিয়ে হেরে গেছে, রাশিয়ার শক্তির সঙ্গে এখনও ইংরেজদের মুকাবিলা বাকি আছে। রাশিয়ানরা যদি আসে, তা হলে আসতে হবে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে, তাই আফগানিস্তানকে কবজায় রাখতে ইংরেজদের প্রায়ই হাত নিশপিশ করে।
আফগানিস্তান যেন একটি নধর ভেড়া, যার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্য একটি সিংহ এবং একটি বিশাল ভালুক সব সময় উদ্যত। কিন্তু ভাল্লুকের চেয়েও সিংহ অনেক বেশি ক্ষিপ্র, তাই আফগানিস্তানের আমির ব্রিটিশ সিংহের সঙ্গে আপোস-রফায় থাকতে চান, কিন্তু সিংহ এক-এক সময় ধৈর্য ধরতে পারে না।
লর্ড লিটন আফগানিস্তানের আমির শের আলির সঙ্গে খিটিমিটি লাগিয়ে দিলেন। কাবুলে তিনি জোর করে একজন ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি পাঠাতে গেলেন, যুদ্ধ অনিবাৰ্য হয়ে উঠল। সরাসরি যুদ্ধে আফগানিস্তান সেনাবাহিনী পারবে কেন, তারা পর্যুদস্ত হল, শের আলি সিংহাসন ছেড়ে পালালেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলি অভিনন্দন জানালেন লর্ড লিটনকে। কিন্তু দুর্ধর্ষ কাবুলিরা এ অপমান বেশিদিন সহ্য করল না, হঠাৎ একদিন প্রকাশ্য রাজপথে ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি এবং তার দেহরক্ষী খুন হয়ে গেলো। সারা আফগানিস্তানে জুড়ে শুরু হয়ে গেলো চোরা গোপ্তা আক্রমণ। ইংরেজ কর্মচারি ও ব্যবসায়ীদের প্ৰাণ সব সময় বিপন্ন, তারা পালাতে পারলে বাঁচে। শের আলির বদলে তার ভাইপো আবদুর রহমানকে সিংহাসনে বসিয়ে ব্রিটিশ সিংহ আবার লেজ গুটিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে এল। প্রমাণিত হল যে আফগানিস্তান নিছক একটি নধর ভেড়া নয়, বরং বলা যায়, সর্বাঙ্গে কাঁটা ভর্তি শজারু।
এই অনর্থক আফগান যুদ্ধে যে কোটি কোটি টাকা খরচ হল, সেই ব্যয় বহন করতে হল ভারতের দরিদ্র মানুষদেরই। এটা তো ভারত সরকারেরই যুদ্ধ, অথচ ভারতীয়দের মতামতের কোনও দাম নেই।
লর্ড লিটন আরও নানা বিপত্তি ঘটাতে পারতেন, এ মধ্যে ইংলন্ডের মন্ত্রিসভার রদবদল হয়ে গেল। ডিজরেলির বদলে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলেন গ্ল্যাডস্টোন। তিনি উদারপন্থী, আদর্শবাদী হিসেবে পরিচিত। ভারতে ইংরেজ শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অত্যাচারে ইংলন্ডের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে তিনি ক্রুদ্ধ। ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত থাকবে ঠিকই, শক্ত হাতে শাসন করতে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু আধটু নরম সুরে কথা বললে ক্ষতি কি? কিছু কিছু ছোটখাটো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে কিংবা বিচার ব্যবস্থায় দু-চারজন ভারতীয় প্রতিনিধি নিলে তারা খুশি থাকবে, বড় রকম আন্দোলনে যাবে না। নতুন প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন লর্ড লিটনকে বরখাস্ত করে সেই পদে পাঠালেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামী লর্ড রিপনকে।
লর্ড রিপন মানুষটি ভদ্র এবং ধর্মভীরু। তিনি সাম্রাজ্যের রক্ষক হলেও একেবারে প্রকট অবিচার দেখলে চক্ষুলজ্জা বোধ করেন। ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট এই ঊনবিংশ শতাব্দীর মুক্ত চিন্তার প্রবাহে সত্যিই তো দৃষ্টিকটু। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার ওপর কোনও বিধিনিষেধ নেই, অথচ বাংলা বা মারাঠি ভাষার পত্র-পত্রিকা থাকবে সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণে, এ আবার কেমন ব্যাপার! এখন অনেক বাঙালি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, দক্ষিণ ভারতীয়রা ভালো ইংরেজি শিখে নিয়েছে, তারা ইংরেজি ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ করে, সেগুলো তো ছোঁয়া যাবে না। লর্ড রিপন কুখ্যাত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট তুলে দিলেন।
কিন্তু অস্ত্ৰ-আইন সংশোধন করতে গিয়ে তিনি প্রবল বাধার সম্মুখীন হলেন। কোনও আইন পাশ করাতে গেলে বা রদ করতে হলে তাকে সেক্রেটারি অব স্টেট এবং লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, কাউন্সিলের প্রায় সব প্রতিনিধি, রাজ-কর্মচারি এবং ইংরেজ ব্যবসায়ী শ্রেণী তাঁর এই উদারনীতির বিপক্ষে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থাগুলিতে ভারতীয় প্রতিনিধি নিতে চাইলেন তিনি, তা নিয়ে ইংলিশম্যানের মতন পত্র-পত্রিকায় গালাগালি শুরু হয়ে গেল। হতাশ হয়ে রিপন একদিন বলে উঠলেন, আমরা যদি বাঙালিবাবুদের নিজেদের ইস্কুল আর নর্দমা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দিই, তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নষ্ট হয় না! বরং তাতে সুফল হবে এই যে, বাঙালিবাবুরা এই সব নিরীহ বিষয় নিয়েই মাথা ঘামাবে, অন্য দিকে মন দেবে না।
নানারকম বাধা সত্ত্বেও লর্ড রিপন কিছু কিছু শাসন সংস্কার চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন, ভারতে এখন নিত্য-নতুন কল-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে, অধিকাংশই ইংরেজ মালিকানায়, সেখানে নিয়ম শৃঙ্খলার কোনও ব্যাপারই নেই। ভারতীয় কুলিদের পশুর মতন খাটানো হয়, শ্রম-ঘণ্টার কোনও হিসেব থাকে না, ছুটি ছাটার বালাই নেই, দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরও কাজে লাগানো হয়। ইংল্যান্ডে এরকম অবস্থা অকল্পনীয়! শিল্পবিপ্লবের পর সেখানকার শ্রমিক শ্রেণী দিন দিন সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। কৃষিনির্ভর ভারতেও কল-কারখানা বাড়বেই ক্রমশ এবং শ্রমিকদের অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে বাধ্য। রিপন এদেশে আসার পরেই জারি করলেন ফ্যাকট্রি আইন। তাতে বলা হল যে, অন্তত একশো জন শ্রমিক যেখানে কাজ করে এবং যেখানে যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে উৎপাদন হয়, সেই সব ফ্যাকট্রি এই আইনে আওতায় আসবে। সাত বছরের কম কোনও বাচ্চাকে এখানে কাজ দেওয়া যাবে না, বারো বছরের কম বাচ্চাদের দিয়ে দিনে ন’ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। প্রতিদিন কাজের মধ্যে এক ঘণ্টা বিশ্রামের জন্য দিতে হবে আর মাসে চার দিন ছুটি।
রিপন বুঝেছিলেন যে, ব্যবসায়ী শ্রেণীকে চটিয়ে দেশ চালানো যাবে না। তাই অতি প্ৰাথমিক কিছু নিয়ম বেঁধে দিলেন মাত্র, আর বেশি দূর এগোলেন না। তাতেও প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
পূর্ববর্তী বড়লাট লর্ড লিটন ভারতের নব জাগ্ৰত শিক্ষিত সমাজকে ঘোর অপছন্দ করতেন। ইংরেজ কর্মচারিরাও চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সঙ্গে জায়গা ভাগাভাগি পছন্দ করে না। এদিকে হাজার হাজার ছেলে বি এ, এম এ পাশ করে চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতার দাবি করছে। বিলেত থেকে আই সি এস হয়ে এসে সরাসরি উঁচু পদে বসছে। তাই ইংরেজ পক্ষ থেকে দাবি তোলা হচ্ছে, ভারতীয়দের আই সি এস পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হোক। এখানকার কলেজগুলিতে সরকারি সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে উচ্চশিক্ষার বাধা সৃষ্টি করা হোক। সামান্য কিছু ইংরেজি শিখিয়ে কেরানি তৈরি করাই তো ছিল স্কুল টুল স্থাপনের উদ্দেশ্য, এখন যে এরা অফিসার হতে চায়।
সাধারণ মানুষ সব সময় সরকারের সংস্কার ব্যবস্থাগুলির মর্ম বোঝে না। এ দেশের ইংরেজরা যখন চটে গিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে, তখন অনেকে মজা পায়। তা হলে সব শ্বেতাঙ্গরাও এককাট্টা নয়! মহারানী তাঁর প্রজাদের ভালোই চান, এদেশে তাঁর চ্যালা চামুণ্ডারা ধারালো দাঁত আর নখ উঁচিয়ে থাকে। দুরকম ইংরেজের একটা অস্পষ্ট ধারণা অনেকে মনে দানা বাঁধে। ডেভিড হেয়ার, বেথুন, পাদ্রি লঙের এখনও মিলিয়ে যায়নি। এখনও তো রয়েছেন ফাদার লাফোঁ, কর্নেল আলকটের মতন বেশ কিছু সাহেব, যারা ঘৃণা করে না।
সরকারের সব সংস্কার নীতি ভারতীয়রাও মেনে নিতে পারে না। একটা ছোট্ট ব্যাপার নিয়ে শহরে হুলুস্থল পড়ে গিয়েছিল।
হেদোর মোড়ে জনা পনেরো লোকের এক জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে মহা উত্তেজিত ভাবে হাত-পা নেড়ে চ্যাঁচামেচি করছে বাণীবিনোদ। শ্রোতারা তাকিয়ে আছে, তার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
বাণীবিনোদ একজনের দিকে করে তাকিয়ে বলল, আমি মিছে কথা বলছি? মানিকতলায় আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি, আজ থেকে আর কালীপুজো হবে না, হবে না! সরকার কালীপুজো বন্ধ করে দিয়েছে।
তবু একজন অবিশ্বাসের সুরে বলল, হ্যাঃ! কি গুলিখোরের মতন কথা বলছ গো? কালীপুজো কখনও বন্ধ হতে পারে?
আর একজন বলল, ওগো ঘণ্টা ঠাকুর, নিজের চোখে কি দেখলে সেটাই ভালো করে বলো না ছাই! মানিকতলার মন্দিরে পুজো হয়নি আজ?
বাণীবিনোদ বলল, কি করে হবে? সরকারের প্যায়দা দাঁড়িয়ে আছে, প্যাঁঠা বলি দিতে দেবে না!
—পুজো বন্ধ, না বলি বন্ধ?
– পাঁঠা বলি কে বন্ধ করল?
-গভরমেন্ট গো, গভরমেন্ট! ম্লেচ্ছরা আমাদের জাত মারবে। পুজো আচ্চা সব বন্ধ করে দিয়ে এবার সবাই গির্জেয় গিয়ে যিশু-ভজনা করো গো!
একজন ছোকরা টিপ্পনি কেটে বলল, ঘণ্টা ঠাকুর, তবে তো তোমার মহা বিপদ! পুজো বন্ধ হয়ে গেলে তুমি খাবে কি?
অন্যরা অবশ্য বিষয়টা এত লঘুভাবে নিল না। কালীপুজো বন্ধ, না পাঁঠা বলি বন্ধ, এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ পাঠা নিয়ে সরকারের মাথা ব্যথা হল কেন?
একটু দূরে দু’জন উকিলবাবু ভাড়ার গাড়ি ধরার জন্য এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে মালকোছা মারা ধুতি, ও কালো কোট, পায়ে পাম্পশু। দু’জনেরই মুখে পান, এক জনের হাতের দু’আঙুলের টিপে ধরা নাস্যি, অন্য জনের হাতে পানের বেঁটার ডগায় মাখা চুন। এই জনতা সেই উকিলবাবু দুটিকে ঘিরে ধরে আসল ব্যাপারটা জানতে চাইল।
একজন উকিল বলল, কে বলেছে, পাঠা বলি বন্ধ? আজ সকালেই তো আমি বাজার থেকে কচি পাঠার মাংস কিনে ঝোল খেয়ে এসেছি। পাঠার মাংস না খেলে বাঙালি বাঁচে?
ফোক্কড় ছোকরাটি বলল, এই যে আমাদের ঘণ্টা ঠাকুর নিজের চক্ষে দেখে এসেছে যে মানিকতলায় কালীমন্দিরে সরকারের প্যায়দা এসে বলি বন্ধ করে দিয়েছে?
দ্বিতীয় উকিলটি জিভ বার করে তাতে চুন লাগিয়ে বলল, এও হয়, ও-ও হয়। পাঠার মাংস পাওয়া যাচ্ছে এটাও যেমন ঠিক, পাঁঠার বলি বন্ধ এটাও ঠিক।
এই উকিল বাক্যে আরও ধাঁধার সৃষ্টি হল। বলি যদি বন্ধ হয়, তাহলে কি জ্যান্ত পাঁঠা মাংস বিক্রি হচ্ছে নাকি?
দ্বিতীয় উকিলটি এবার একটু খোলসা করে বলল, যার খুশি যখন তখন পাঁঠা বলি দেবে, তা আর চলবে নাকো। চড়ুইভাতি করতে গেলে, আর একটা ছাগল নিয়ে গিয়ে কেটে কুটে রান্না করলে, তা হলে জেল হবে!
–তা হলে বাজারে মাংস বিক্রি হবে কি করে?
– কসাইখানা থেকে আসবে। করপোরেশান নিয়ম জারি করেছে, পাঁঠা কাটতে গেলে লাইসেন্স নিতে হবে। মাংসের দোকানদাররা স্লাটার হাউস থেকে পাঁঠা কাটিয়ে আনবে!
– সে কোন জাতের না কোন জাতের লোক কাটবে, তার ঠিক কি! তাদের ছোঁয়া খেতে হবে?
—কসাইরা কোন জাতের হয়? এতকাল তাদের ছোঁয়া মাংস খাওনি?
বাণীবিনোদ প্রবল ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, আমি কক্ষনও খাই না। ঠাকুরের সামনে যে পাঁঠা বলি হয়, সেই মাংস ছাড়া আমি অন্য কোনও মাংস খাই না!
ছোকরাটি বলল, অর্থাৎ কি না যা বিনা পয়সায় পাওয়া যায়!
অন্য একটি লোক বলল, লোকে যে কালী ঠাকুরের কাছে মানত করে, এখন আর সেই মানতের বলি হবে না?
একখানা ভাড়ার গাড়ি এসে গেছে। উকিলবাবুরা সেদিকে ছুটে যেতে যেতে একজন মন্তব্য ছুড়ে গেল, মা কালীকেও লাইসেন্স নিতে হবে!
করপোরেশনের আইনে প্রথম দিকে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হল অনেক। আইনের উদ্দেশ্যটি ছিল সৎ। লোকে পাঁঠা-পাঁঠী, ছাগল যা খুশি বলি দিয়ে বাজারে মাংস বিক্রি করে। বড় বড় কালী মন্দিরগুলি ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় নিত্য নতুন গজিয়ে উঠছে, সেসব মন্দিরের সামনে সকাল থেকে হাঁড়ি কাঠে পাঠা বলি চলতে থাকে, রাস্তা রক্তে থিক থিক করে, রক্ত চাটার জন্য মারামারি করে এক পাল কুকুর, কাক-চিলও ছোঁ মারতে আসে। সেই সব বলির মাংস পবিত্র-মাংস হিসেবে বাজারে একটু বেশি দামে বিক্রি হয়। করপোরেশনের স্বাস্থ্যসম্মত বিধি প্রণয়নেরই উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু বিধায়করা ধর্মীয় ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। কালী মূর্তির সামনে পাঠা বলি দেওয়া যে হিন্দুদের ধর্মীয় অধিকারের মধ্যে পড়ে। মুসলমানদের যেমন কোরবানি।
মন্দিরের সামনে বলি বন্ধ হওয়ায় হিন্দুরা প্রবল সোরগোল শুরু করে দিল। করপোরেশন শেষ পর্যন্ত আইন কিছুটা সংশোধন করতে বাধ্য হল। কালীঘাটের মন্দির, ফিরিঙ্গি কালী, ঠনঠনের মতন কতকগুলি বিখ্যাত, সুপ্রতিষ্ঠিত মন্দিরের সামনে পাঠা বলি আগেকার মতন অব্যাহত রইল, কিন্তু যে-কোনোও ছোটখাটো মন্দিরে বলি দেওয়া নিষিদ্ধই রইল, অনেক মন্দির রাতারাতি উঠেও গেল এই জন্য।
যেকোনও আইনই পুরোপুরি প্রয়োগ করা সহজ নয়। লুকিয়ে-চুরিয়ে গলি ঘুঁজিতে পাঁঠার মাংস বিক্রি এর পরেও চলতে লাগিল কিছু কিছু। কত জায়গায় আর পেয়াদারা গিয়ে বাধা দেবে? পেয়াদাদেরও তো ধর্ম ভয় আছে! তা ছাড়া হাতে একটা টাকা গুজে দিলে তাদের কর্তব্যজ্ঞান উপে যায়।
তবে অনেক মানুষ এখন সতর্ক হয়ে গেল! যে-কোনও মাংস খাওয়া যে স্বাস্থ্যসম্মত নয়, এই জ্ঞানটুকু অন্তত হল, লাইসেন্সের দোকানের পাঠা কিংবা বড় মন্দিরের বলির পাঠার মাংস ছাড়া অন্য মাংস তারা কিনতে চায় না। বে-আইনি মাংস কেনা অপরাধ।
রামকৃষ্ণ ঠাকুর অসুস্থ। গলায় ব্যথা, কাশি হচ্ছে খুব, শরীর বেশ দুর্বল। দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে তিনি এখন অন্য জায়গায় আছেন। মাঝে মাঝে একটু ভালো থাকেন, আবার হঠাৎ একটু ঠাণ্ডা লাগলেই তার কাশি বেড়ে যায়। তাঁর স্ত্রী সারদামণিও তাঁর সঙ্গে এসে আছেন, তিনি নিজের হাতে রান্না করে স্বামীকে খাওয়ান।
নামকরা ডাক্তাররা এসে দেখে যাচ্ছেন। তারা নির্দেশ দিলেন, রুগীকে কচি পাঠার মাংসের সুরুয়া খাওয়াতে হবে, না হলে দুর্বলতা কাটবে না। রামকৃষ্ণের মাংস খেতে আপত্তি নেই, কিন্তু ভক্তদের তিনি পইপই করে বলে দিলেন, দেখ, তোরা যে-দোকান থেকে মাংস কিনবি, দেখবি সেখানে কসাই কালীমূর্তি যদি না থাকে তা হলে কিনিসনি। যে-দোকানে কসাই কালী প্রতিমা থাকবে, সেই দোকান থেকে মাংস আনবি।
একজন ভক্ত প্ৰতিদিন সকালে সেরকম মাংস কিনে আনে। সারদামণি কাঁচা জলে সেই মাংস দিয়ে সেদ্ধ করেন কয়েক ঘণ্টা। তাতে ক’খানা তেজপাতা ও অল্প মসলা দিয়ে তুলোর মতন সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নেন। তারপর কাপড়ে ছেঁকে শুধু সুরুয়াটুকু রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে খাওয়ানো হয়।
তিনি আস্তে আস্তে একটু একটু চুমুক দেন। গলায় বড্ড ব্যথা।