বাহাত্তর নম্বর আপার সার্কুলার রোডে কেশব সেনের বাড়িটি শহরের একটি দ্রষ্টব্য স্থান। এ গৃহের নাম কমল কুটির। গৃহ সংলগ্ন উদ্যানটি বড় সুচারু, মধ্যে একটি দিঘি, তার নাম কমল সরোবর, সেখানে সত্যি সত্যি কমল ফুটে আছে । পাশের বাড়িটির নাম শান্তি কুটির, সেখানে থাকেন বিখ্যাত বাগ্নী প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। পেছন দিকের একটি বড় অট্টালিকায় এক সঙ্গে বসবাস করছেন কয়েকটি ব্রাহ্ম পরিবার, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে মঙ্গলবাড়ি। পথ চলতি লোকেরা এই পল্লীটিকে বলে বেম্মোদের আখড়া।
প্রতি রবিবার বেলা দশটা এগারটার সময় কমল কুটিরের সামনে রীতিমতন ভিড় জমে যায়।
ব্রাহ্মসমাজ ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে বটে, কুচৰিহার-কাহিনীর পর কেশবচন্দ্রের জনপ্রিয়তা কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে তাও ঠিক, তবু তাঁর ভক্তসংখ্যা এখনও যথেষ্ট। ছেলে ছোকরারা এখন কেশববাবুকে পরিত্যাগ করে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যার, কিন্তু মধ্যবয়সীরা এখনও কেশববাবুর অনুরাগী এবং তাঁদের পরিবারের ছেলেমেয়েরাও দলত্যাগ করেনি। প্রতাপ মজুমদারের মতন অনেকেই কেশববাবুর সর্বাঙ্গীণ সমর্থক।
কুচৰিহার-বিহারের ব্যাপারটা ঘটে গেছে বছর চারেক আগে, তা নিয়ে বিতর্ক চলেছে এখনও। কেশববাবু নিজেই বাল্যবিবাহ রোধ করার জন্য মেয়েদের বিয়ের নিম্নতম বয়েস চোদ্দ বছরে বেঁধে দেবার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু কুচৰিহার রাজবাড়ি থেকে তের বছরের কন্যা সুনীতির বিবাহের প্রস্তাব আসার পর কিছু দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এ কী রাজপরিবারের সঙ্গে কূটুন্বিতা করার আগ্রহে? ব্রাহ্মসমাজের এক বড় প্রবক্তা কেশববাবু, অথচ তাঁর কন্যার বিবাহ হবে হিন্দু পরিবারে, হিন্দু মতে? তা হলে আর আদর্শ রইল কোথায়? কেশবপক্ষীয়রা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক পাত্র ও পাত্রীর বিবাহের অনুষ্ঠান হবে শুধু, তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করবে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর, কিশোর রাজা ততদিনে বিলেত ঘুরে আসবে, সুতরাং এতে দোষ নেই। বরপক্ষ হিন্দুমতে বিবাহের অনুষ্ঠান করলেও কন্যা পক্ষ ব্রাহ্ম মতই মেনে চলবেন। বিরুদ্ধ পক্ষ তখন বলেন, তা হলে তো এই যুক্তিতে বা ছুতোয় অনেকেই নাবালিকার বিবাহ দিয়ে বলবে, ওরা স্বামী শ্রী হিসেবে এখন একসঙ্গে থাকবে না। নাবালক-নাবালিকা বিবাহের পর দাম্পত্য জীবনযাপন করছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য কি ইন্সপেক্টর নিয়োগ করতে হবে? একটা আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে কেশববাবু নিজের পরিবারেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেন না, পথভ্রষ্ট হলেন?
দু’পক্ষের চাপান-উতোর আরও বহুদূর চললেও এ কথা ঠিক, কেশববাবুর ব্যক্তিগত সততা সমস্ত প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, নীতি ও সুরুচিবোধ বাংলার যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছে দীর্ঘদিন। একেশ্বরবাদ, সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার ও নারীদের অধিকার স্থাপনের জন্য অনলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। পাদ্রিরা যখন হিন্দুধর্ম বিষয়ে নানা রকম কুৎসা প্রচার শুরু করেছিল, তখন বাংলার ডেমোস্থেনিশ কেশববাবু সিংহবিক্রমে তাদের মুখের ওপর জবাব দিয়েছেন। যারা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেয়নি, এমন অনেকও ওঁর অনুরাগী।
মাদকবর্জনের দাবি নিয়েও কেশববাবু ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কর্মীদের সহায়তায় এক আন্দোলন শুরু করেছেন। এখন পাড়ায় পাড়ায় মদের দোকান, বিলাতি মদের ছড়াছড়ি, আবগারি আইন বলতে তেমন কিছু নেই। অঢেল মদ বিক্রি করে মুনাফা লুটছে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা, আর সেই মদের নেশায় উচ্ছন্নে যাচ্ছে এ দেশের অল্পবয়সী ছেলেরা। বিলিতি মদের মাত্রাজ্ঞান নেই বলে পটাপট মরেও যাচ্ছে অনেকে।
কেশববাবু কিছুসংখ্যক উদ্যমী যুবকদের নিয়ে ‘ব্যান্ড অফ হোপ’ নামে একটি দল গড়েছেন, বাংলায় ‘আশা বাহিনী’। তারা প্রতি রবিবার সকালে মাদক নিবারণী গান গেয়ে নগর পরিক্রমা করে, সঙ্গে থাকে খোল করতাল। ‘মদ না গরল’ নামে একটি পত্রিকাও বিলি হয়। অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে সেই আশা বাহিনী এসে থামে কমল কুটিরের সামনে। সেখানে পথের ওপর রয়েছে শোলা ও খড় দিয়ে তৈরি বিশাল ও বিকট একটি মূর্তি, তার পারে লেখা ‘মদ রাক্ষসী’। মূর্তিটির পেটের মধ্যে থাকে সোরা-গন্ধক-বারুদ, একটু আগুন লাগলেই মদ রাক্ষসী দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এই রাক্ষুসী-বাজি পোড়ানোর মজা দেখতে আসে অনেক মানুষ, তাদের মধ্যে মদো-মাতালরাও থাকে, আর কিছু রসিক ছোকরা বাজি দেখার বদলে কেশববাবুর বাড়ির অন্দরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারে। কেশববাবুর কন্যা-ভাগ্য অতি ভালো, তাঁর পাঁচটি কন্যাই অতীব সুন্দরী, বড় দুটির বিবাহ হয়ে গেছে, বাকি তিনজনকে কেউ কেউ কবিত্ব করে বলে থ্রি গ্রেসেস।
মদ-রাক্ষসীর মূর্তিতে এখনও আগুন ছোঁয়ানো হয়নি, আশা বাহিনী তার সামনে নেচে নেচে গান ধরেছে :
পয়সা দিয়ে গরল গেলে ইহকালটি মজিয়ে গেলে
পরকালে তপ্ত তেলে করবে ভাজা ভাজা
ও ভাই খিদের জ্বালায় তুর্কি নাচন মদে দুঃখ হয় না মোচন
এখন খাচ্ছ খাও পাবে যমরাজের সাজা!
ঘরে কাঁদে মাগ ছেলে…
ভিড়ের মধ্যে শশিভূষণের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে ভরত। তার শুধু হারিয়ে যাওয়ার ভয়। সারি সারি বাড়িওয়ালা রাস্তা দেখলে তার একই রকম মনে হয়। এই সব রাস্তায় একটুক্ষণ শশিভূষণকে না দেখলেই ভরত অগাধ জলে ডুবে যাবার মতন আকুপাকু করে।
কয়েকদিন ধরে শশিভূষণ ভরতকে কলকাতা শহর চেনাচ্ছেন। নিজের অসুখের সময় শশিভূষণ ভরতের দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। একদিন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে জুড়িগাড়ি করে যেতে যেতে দেখলেন, কালীঘাটের রাস্তায় ভরত শ্মশানযাত্রীদের ছড়ানো পয়সা কুড়োচ্ছে। ভরত শেষ পর্যন্ত তার রাজরক্তের মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেনি, খিদের জ্বালায় সে কাঙালিদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল, রাস্তা থেকে পয়সা কুড়িয়ে সে মুড়ি মুড়কি কিনে খেত। শশিভূষণ তাঁকে দেখতে পেয়ে কান ধরে টেনে তুলেছিলেন গাড়িতে। এখন আবার শশিভূষণ ভরতের শিক্ষার ভার নিজে নিয়েছেন।
শশিভূষণের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে প্যান্টালুন ও চায়না কোট পরা, জেনারাল অ্যাসেম্বলি কলেজের একটি ছাত্র, নরেন। দত্ত। আজ তার মুখখানি উদাসীন, চক্ষুদুটি উদভ্ৰান্ত। সে চেয়ে আছে বটে, কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না। সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার মন নেই এখানে।
আশা বাহিনী গান শেষ করার পর একে একে প্রবেশ করতে লাগল কমল কুটিরের মধ্যে। অনেকক্ষণ পদব্ৰজে আসার পর তারা ক্লান্ত, এখন ব্ৰহ্মানন্দের গৃহে পবিত্র জল পান করবে, স্বয়ং কেশবচন্দ্র তাদের হাতে একটা করে মিষ্টি তুলে দেবেন। একটু পরে সমবেতভাবে শুরু হবে প্রার্থনা সঙ্গীত। নরেন মাঝে মাঝে এই সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। সে ভারতবর্ষীয় ব্ৰাহ্মসমাজ এবং সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ, দু দলের অনুষ্ঠানেই যায়। তার পক্ষপাতিত্ব নেই। সে নিজে এখনও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেয়নি, গায়ক হিসেবেই তার ডাক পড়ে।
এক বন্ধু নরেনের পিঠে হাত দিয়ে বলল, কি রে, বিলে, চল, ভেতরে যাবি না?
নরেন যেন অকারণে বেশি চমকিত হল, তার শরীর কপিল। খানিকটা রুক্ষভাবেই সে বলল, না, আজ আর যাব না! তারপর সে হন।হন করে হেঁটে চলে গেল অন্যদিকে।
মদ-রাক্ষসীর মূর্তিটা পুড়ে শেষ হয়ে যাবার পর যখন ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, শশিভূষণ ভরতকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল? সব বুঝলি? গরল মানে জানিস?
ভরত বলল, জানি।
শশিভূষণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, মদ চেখে দেখেছিস কখনও?
ভরত এবার সবেগে দুদিকে ঘাড় নাড়ল।
শশিভূষণ চলতে চলতে বললেন, আমার বাবা বেশি মদ্যপান করে অকালে গেছেন। আমার বড় দাদার সঙ্গে পরিচয় ছিল চোরবাগানের কালী সিঙ্গির, অত বড় একটা তেজী পুরুষ, অথচ মাত্র তিরিশ বছরেই, আর মাইকেল মধুসূদনের নাম শুনেছিস তো, তিনিও, এ রকম আরও কত, সেই জন্য আমি মদ ছুঁই না, জীবনে কখনও, তুইও প্রতিজ্ঞা কর, কোনওদিন মদ স্পর্শ করবি না! ঈশ্বরের নামে বল…
ভরত রাস্তার বাঁকের একটি শিবমন্দিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, এখানে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করি?
শশিভূষণ বিরক্ত হয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন, তোকে কতবার বলেছি না, মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায় ঈশ্বর থাকেন না! ঈশ্বরকে নিজের মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা কর। নিজের ভাবের ঘরে যে চুরি করে, সে মন্দির-মসজিদ-গির্জেয় গিয়ে যতই ভড়ং দেখাক, সে সব মিথ্যে। ভরত। এতসব বড় বড় কথা বুঝল না। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে বলল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি! শশিভূষণ বললেন, চল, এবার একটু ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ঘুরে যাই।
কাছেই ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বার। শশিভূষণ এখন প্রায় সুস্থই বলা যায়, শুধু দু’একটি উপসর্গ আছে। তিনি ত্রিপুরায় ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আজই ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে শেষ ওষুধ নিয়ে তিনি কয়েকদিনের মধ্যে রওনা হবেন মনস্থ করেছেন।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বারে তখনও কয়েকটি রোগী রয়েছে। শশিভূষণ ভরতকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন বাইরে।মহেন্দ্রলালের চেহারা অনুপাতে গলাটিও বাজখাই। ডাক্তারদের গুপ্তিমন্ত্রের শপথ অনুযায়ী তিনি রোগীদের রোগ বিষয়ে আলোচনা করেন নিম্নস্বরে। যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা যেন তাঁর চেম্বার ছাড়িয়ে গড়ের ময়দান পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
যেমন, শেষ রোগীটি দেখার পর তিনি চিৎকার করে তাঁর সহকারির উদ্দেশে বললেন, শওকত, এনার কাছ থেকে ষোলো টাকা ভিজিট নিয়ে রশিদ লিখে দাও!
রোগীটি হাতজোড় করে বলল, ডাক্তারবাবু, আপনি অতি মহানুভব, আপনার নাম শুনে এসেছি, কিন্তু আমি অতি দরিদ্র, দু’বেলা অন্ন জোটে না, আপনার ফিস দেবার ক্ষমতা নেই। আপনি যদি দয়া করেন…
মহেন্দ্রলাল বললেন, দয়া? ডাক্তার-রুগীর সম্পর্কের মধ্যে আবার দয়া আসে কী করে? ফেল কড়ি মাখ তেল! ডাক্তারকে পয়সা না দিলে, ওষুধের দাম না দিলে সে চিকিৎসায় ফল হয় না, তা জান না? ষোলো টাকা দিতে না পার, কত দিতে পারবে?
লোকটি বলল, আজ্ঞে, আমার সামর্থ কিছুই নেই। আমি গরিব চাষী। এ বছর আষাঢ় মাসেও বিষ্টি হয়নি, হাতে একটা আধরাও নেই। এবারকার মতন যদি মাপ করেন, শরীরের তাগত ফিরে পেলে
মহেন্দ্রলাল দু কোমরে হাত দিয়ে লোকটির সামনে পাহাড়ের মতন দাঁড়িয়ে বললেন, বাটে! একটি আধলাও নেই! তোমার কষ্ট শুনে আমার চোখে জল আসছে। হে! তোমার একটি আধলাও না থাকলে আমি তোমায় হাজার আধলা দেব। তোমার বাড়ি তো গুসকরা। এক আধলাও না থাকলে ফিরবে। কী করে? তোমার রাহা খরচা, খাই খরচা সব আমি দেব। তার আগে একটু সার্চ করে দেখতে হবে যে! শওকত, লোকটার ট্যাঁক খুলে দেখে নাও তো!
মহেন্দ্রলালের সহকারি শওকত মিঞা একজন রোগা-পাতলা মাঝবয়েসী মানুষ, মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ, ঠোঁটে সব সময় মৃদু হাসি। তিনি এসে প্রথমে মহেন্দ্রলালকে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যার! তারপর লোকটি ধুতি ধরে টান দিতেই সে কোমরে বাধা-বেশ মোটাসোটা একটি পুটলি চেপে ধরল দুহাতে।
মহেন্দ্রলাল প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, হাত সরাও, খুলে দেখব ক’ত আছে!
শওকত বলল, আটচল্লিশ টাকা, আর একটা আধুলি!
মহেন্দ্রলাল রোগীটিকে বললেন, ওহে, তোমার তো কিছু নেই। আমি এক হাজার আধলা দেব বলেছিলাম, সাত টাকা তের আনা নিয়ে বাড়ি যাও। বাকি সব আমার!
লোকটি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, গোস্তাকি হয়ে গেছে হুজুর, এবারকার মতন ক্ষমা করে দ্যান হুজুর।
মহেন্দ্রলাল বললেন, লোকটা অনেক সময় নষ্ট করেছে। শওকত, আমার ফি ষোলো টাকা আর আমাদের বিজ্ঞান কেন্দ্রের জন্য কুড়ি টাকা চাঁদা কেটে নিয়ে ওর বাকি পয়সা ফেরত দাও!
লোকটি মহেন্দ্রলালের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, অত টাকা নেবেন না হুজুর, মহাবিপদে পড়ে যাব, কালীঘাটে পাঠা মানত করেছি, বউদের জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে যাব, একখান বেড়াজাল.এই টাকাতেও কুলোবে না…
পা সরিয়ে নিয়ে অসহিষ্ণুভাবে মহেন্দ্রলাল বললেন, ওফ, আর পারি না। এদের নিয়ে। সবার জন্য কত কিছু কেনার ফর্দ, শুধু ডাক্তারের ফি দেবে না। ডাক্তাররা কি সব নিরাহারী সন্ন্যোসী! অন্তত দশটা টাকা তো দেবে। তাও দেবে না? ওহে শওকত, পুঁটুলিটা ফেরত দিয়ে একে তাড়াতাড়ি বিদেয় করো।
লোকটি তৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে ধুতি গুছিয়ে সরে পড়ল।
শওকত বলল, লোকটার পাটের ব্যবসা আছে স্যার। অনেক টাকা। আপনি কিছু না নিয়ে ছেড়ে দিলেন?
মহেন্দ্রলাল বললেন, আমি কান্নাকাটি সহ্য করতে পারি না। আপদ বিদায় হয়েছে বাঁচা গেছে। তারপর তিনি গুনগুন করে একটা গান ধরলেন : “পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে…”
চেম্বারের পর্দা সরিয়ে বাইরে পা দিয়েই শশিভূষণকে দেখতে পেয়ে গান থামিয়ে দিলেন। নিশ্চয়ই ভাবলে, আমি চশমখোর। রুগীদের ট্যাঁক খুলে দেখি! ব্যাপার কী জানি না তো, আমি কিছু গরিব-গুর্বো মাগনায় দেখি, তাদের ওষুধপথ্য কিনো দিই, যাদের সামর্থ্য নেই, তারা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? কিন্তু এই কথা রটে যাবার পর এখন যাদের রেস্তোর জোর আছে, মদ-মাগীতে পয়সা ওড়ায়, তারাও আমার কাছে চিকিচ্ছে করিয়ে ফি দিতে চায় না। গুয়োর ব্যাটারা আমার সামনে এসে মড়াকান্না জুড়ে দেয়। আমি কি দানছত্তর খুলেছি? আমার নিজের বাড়ির একটা খরচ আছে, বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের জন্য পয়সা জোগাড় করতে আমার মুখের রক্ত উঠে যাচ্ছে, হুঁ, যত্তো সব!
আবার চেম্বারে এসে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন এলে যে? তোমার তো বিকেলে আসার কথা। আমাকে একবার বউবাজারে বিজ্ঞান কেন্দ্ৰে যেতে হবে।
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে কেশববাবুর বাড়ি গেসলুম, তাই ভাবলুম আপনার এখান থেকে একবার ঘুরে যাই, যদি আপনাকে পাওয়া যায়।
মহেন্দ্রলাল ভুরু কুঁচকে বললেন, কেশববাবুর বাড়ি…তুমি ওদের খাতায় নাম লিখিয়েছ নাকি?
শশিভূষণ বললেন, না, তা নয়। এই ছেলেটাকে নিয়ে গেসলুম মদ-রাক্ষসী দেখাতে।
মহেন্দ্রলাল বললেন, আ, তামাশা দেখতে গিয়েছিলো। হুঃ! নেচে-গেয়ে আর বাজি পুড়িয়ে উনি মদ খাওয়া ছাড়াবেন! এরপর দেখবে পাকা পাকা মাতালরাও ওই সঙ্গে নাচবে-গাইবে! সব জ্ঞানপাপীর দল!
শশিভূষণ বললেন, আর তো কেউ কিছু করছে না, তবু কেশববাবু চেষ্টা করছেন।
মহেন্দ্রলাল বললেন, চেষ্টা তো উনি করছেন অনেক কিছুরই। ফল হচ্ছে কী? আমার দুঃখ কী জান, এ দেশের শিক্ষিত লোকেরা এখানে শুধু সাকার না নিরাকার, দ্বৈত না অদ্বৈত এই নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করছে। যেন সারা দেশে আর কোনও সমস্যা নেই। এই যুগটা হল বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের চর্চা করলে যুক্তিবোধ আসে। যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শিখলে সাকার-নিরাকার ফুৎকারে উড়ে যাবে।
শশিভূষণ বিনীতভাবে মৃদু প্রতিবাদের সুরে বললেন, আজ্ঞে, ধর্ম নিয়ে ইদানীং যে এক প্রবল সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা তো মানতেই হবে। মনোজগতে আলোড়ন চলতে থাকলে বাইরের জীবনে সুস্থির হওয়া যায় না। হিন্দুরা খুবই ধন্ধের মধ্যে পড়েছে। এতকাল হিন্দুরা নানা রকম ঠাকুর-দেবতার পুজো করে, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে বেশ ছিল। মুসলমানরা নিরাকার আল্লার ভজনা করে। মুসলমান যুগেও হিন্দুরা নানান মূর্তিপূজার প্রথা পাল্টাবার কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু এখন হয়েছে মহামুশকিল। ইংরেজরা স্থায়ী হয়ে বসেছে, এখন হিন্দুরা মনে করে সভ্য হতে গেলে ইংরেজি শিখতে হবে, ইংরেজদের মতন পোশাক পরতে হবে, তাদের মতন খানা খেতে হবে। অনেক বাঙালি যোগ্যতায় ইংরেজের সমকক্ষ হয়েও উঠেছে, কিন্তু তারা ধাক্কা খায় ধর্মের ব্যাপারে। মাড়ি-খড়-পাথরের পুতুল ঠাকুর পুজো নিয়ে সাহেবরা হাসি-ঠাট্টা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে অনবরত। আর সব ধর্মেই ঈশ্বর নিরাকার, শুধু হিন্দুদেরই তেত্ৰিশ কেটি দেব-দেবী। শিক্ষিত হিন্দুরা তা নিয়ে বিব্রত।
– সেই জন্যই ব্ৰাহ্মরা নিরাকার পরমব্রহ্মের আমদানি করলেন।
— হিন্দুধর্মে পরম ব্ৰক্ষের ধারণা আগেও ছিল। অন্য ধর্ম থেকে আমদানি করতে হয়নি, তবে সবাই মানত না। এক সময় দলে দলে বাঙালি ছেলেরা যে খ্রিস্টান হচ্ছিল, ব্ৰাহ্মরা তা যে রুখে দিয়েছেন, তা তো স্বীকার করতেই হবে। রামমোহন-দেবেন্দ্রবাবু কৃতিত্ব অনেকখানি, কিন্তু কেশববাবুই যে তরুণদের মধ্যে একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটা অবশ্য মানা উচিত।
— কেশববাবু হিন্দু পরমব্রহ্মের সঙ্গে খ্রিস্টানদের পরম ব্ৰহ্মকেও খানিকটা মেশাননি? সাহেবদের জবাব দেবার জন্য গদগদ ভাবে, যিশুর নাম উচ্চারণ করা আর কথায় কথায় বাইবেল থেকে কোট করা, এসব কী? এই আমাদের শওকতকে জিজ্ঞেস করো, মোছলমানেরা নিজের ধর্মের শ্ৰেষ্ঠত্ব বোঝাবার জন্য বাইবেল নিয়ে টানাটানি করে। যে ব্ৰাহ্ম দল, তাদের প্রার্থনাগৃহটা ভালোভাবে লক্ষ করেছ? চুড়োটা গির্জের ধাঁচের। লোকে বলে, ওটা কেশববাবুর গির্জে!
– হ্যাঁ, গোড়ার দিকে কেশববাবু অনেকটা ঝুঁকেছিলেন বটে। অনেকে ভেবেছিল, উনি বুঝি খ্রিস্টানই হয়ে যাবেন। কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছেন। এখন বুঝেছেন, সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য ঐতিহ্যকে বাদ দিলে চলবে না। এখন তাঁর দল নামগান, সঙ্কীর্তন হয়।
— জানি, জানি! সেও তো আবার চরম জায়গায় পৌঁছে যায়। মুঙ্গেরে কী হয়েছে জান না?
– আজ্ঞে না।
—ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করতে কেশববাবু সদলবলে বোম্বাই গিয়েছিলেন। পথে থেমেছিলেন মুঙ্গের শহরে। সেখানে আগে থেকেই ব্ৰাহ্মদের আখড়া আছে। ভক্তির আতিশয্যে সেখানকার ব্রাক্ষিকারা ঘটি ঘটি জল কেশববাবুর পায়ে ঢেলেছে, তারপর সেই মেয়েগুলো তাদের লম্বা চুল দিয়ে পা মুছে দিয়েছে। নর-অবতার। মূর্তিপূজার বদলে মানুষ পূজা!
— সে রকম দু’একবার বাড়াবাড়ি হতে পারে। এখন হয় না। দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গে কেশববাবুর যোগাযোগ হয়েছে। ভক্তিবাদের সঙ্গে মিলেছে জ্ঞানবাদ। আমার তো মনে হয়, এই দুটির মিশ্রণই সাধারণ মানুষের কাছে।
— দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুর, তাঁর কথা বেশ শোনা যাচ্ছে ইদানীং। বিদ্যাসাগরমশাইও একদিন বলছিলেন বটে। তিনি নাকি পরমহংস, যখন তখন মুচ্ছো যান। মৃগীরোগ আছে কিনা একদিন গিয়ে দেখে আসতে হবে। কালীঠাকুর! ওই একটা ডবকা সাঁওতালী মাগীর সামনে লোকে যে কী করে টিপ চিপ করে প্রণাম করে, তা আমি কিছুতেই বুঝি না। আমাদের বেদ-উপনিষদে কোথাও ওই কালীমূর্তির কথা আছে?
শশিভূষণ নিজে মূর্তিপূজায় একেবারে অবিশ্বাসী হলেও মহেন্দ্রলালের মুখে এই কথা শুনে শিউরে উঠলেন। তিনি আড়চোখে তাকালেন ভরতের দিকে। তার মুখখানা হাঁ হয়ে আছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। শশিভূষণ ভাবলেন, মহেন্দ্রলালের এ রকম উক্তি কালীভক্ত শাক্তরা শুনলে যে তাকে মেরে ফেলতে চাইবে।
মহেন্দ্রলাল নিজের কপাল চাপড়ে বললেন, কেশববাবু! তাকে কি আমি কম চিনি? আমাদের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও তিনি এক সময় কত কাজ করেছেন। যেমন ওঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তেমনি নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। ইচ্ছে করলে উনি কত বড় কাজ করতে পারতেন, তা নয়, শুধু একটা ছোট গুষ্টির ধর্মগুরু হয়ে রইলেন। কেশববাবু আসল কাজ কি শুরু করেছিলেন জান? যদি তিনি শুধু ওই একটি কাজ নিয়ে লেগে থাকতেন, তা হলে মহা উপকার হতো এ দেশের। কেশববাবুই প্রথম বাঙালিদের ভারতীয় হতে শেখাচ্ছিলেন। এখনও বাড়িতে একজন পাঞ্জাবি বা মাদ্রাজি ভদ্রলোক এলে লোকে বলে একজন বিদেশি এসেছে। কিন্তু পাঞ্জাব বা মাদ্রাজ যে বিদেশ নয়, আমরা যে শুধু বাঙালি নাই, ভারতীয়, একথা আগে কে বলেছে। কেশববাবু পত্রিকা বার করলেন, তার নাম বেঙ্গলি মিরার নয়, ইন্ডিয়ান মিরার। বক্তৃতার সময় উনি প্রায়ই নেশান বা ন্যাশনাল শব্দ ব্যবহার করতেন। আমরা বেঙ্গলি রেস কিন্তু ইন্ডিয়ান নেশান।
শশিভূষণ বললেন, ঠিক, এমন কথা আগে কেউ তেমন বলেনি।
মহেন্দ্রলাল বললেন, সিভিল ম্যারেজ আইন পাশ হবার সময় কেশববাবু কী বলেছিলন জান? আমরা মুসলমান নাই, খ্রিস্টান নাই, আমরা হিন্দু নই, আমরা ভারতবাসী। এ একটা কত বড় কথা। এই বোধটা আমাদের ছিল না বলেই তো ইংরেজ এসে সকলের ঘাড়ের রক্ত চুষছে। আমেরিকাতেও নানা জাতের মানুষ আছে, কিন্তু তারা সবাই আমেরিকান, সেই জন্যই তো দেশটা ধা, ধা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের নেতাদের এখন এই আদর্শের প্রচারটাই প্রধান কাজ নয়?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, মহেন্দ্রলাল আবার বললেন, যাক, অনেক বকবক করলাম, দেরি হয়ে গেল। দেখি, তোমার হাতটা দাও, কেমন আছ বল।
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে, এখন তো ভালোই আছি। দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারি। খিদেও বেড়েছে। এখন আমি ত্রিপুরায় ফিরতে পারি?
শশিভূষণের নাড়ি পরীক্ষা করতে করতে মহেন্দ্রলাল বললেন, যাও। কোনও কমপ্লেন যদি না থাকে, যাবে না কেন?
শশিভূষণ বললেন, তেমন কিছু নেই, তবে মাঝে মাঝে মাথা ঝিমঝিম করে। রাত্তিরে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখি, সেগুলো স্বপ্নই, ঘুম ভেঙ্গে যায়
মহেন্দ্রলাল শশিভূষণের হাত ছেড়ে দিয়ে হা, হা শব্দে অট্টহাস্য করে উঠলেন। শশিভূষণের ঘাড় চাপড়ে বললেন, শোনো হে, তোমার বয়েসী পুরুষদের মাথা ঝিমঝিমুনি রোগ আর স্বপ্ন তাড়ানোর খাঁটি ওষুধ কী জান? বি পূর্বক বহু ধাতু ঘঙ। বিশেষরূপে কারুকে বহন করো। তেমন কিছু ভাবোনি?
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে না। এখন আমি ও জন্য প্রস্তুত নই।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তোমাদের ঈশ্বর নিরাকার হোন আর যাই হোন, নারী কিন্তু সাকার। পুরুষও সাকার। এই সাকারে সাকারে মিলন হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। তাতেই আত্মার সুখ। ত্রিপুরায় যাচ্ছ যাও, কিন্তু বেশিদিন একা থেক না।
শশিভূষণ বললেন, এই ছেলেটিকে একবার একটু দেখে দিন তো। ও সর্বক্ষণ খাই খাই করে। অস্বাভাবিক খিদে, বাগানে গিয়ে তেঁতুলপাতা চিবিয়ে খায়। এ রকম খিদেও মনে হয় কোনও অসুখ।
মহেন্দ্রলাল আবার হেসে বললেন, খিদে আবার অসুখী কী হে? খাদ্য পেলেই খিদে থাকে না। উঠতি বয়েসের ছেলে, এখন দু’বেলা পেটপুরে খেলে পাঠ্যা জোয়ান হবে।
তিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ভরতের দিকে। ভরত জড়সড় হয়ে গেল সেই দৃষ্টির সামনে।
মহেন্দ্রলাল মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, রোগ নেই, কোনও রোগ নেই। খাবি, যত ইচ্ছে খাবি। বড়লোকের বাড়িতে থাকিস, খাবারের অভাব কি? মনে করে খেতে না দেয়, চুরি করে খাবি। তেঁতুলপাতাও মন্দ কিছু না। টুলো পণ্ডিতের ছাত্ররা ওই দিয়ে ভাত খেত। এই ছেলে, তুই লেখাপড়া করিস।
ভরত ঘাড় নাড়ল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, পড়, মন দিয়ে পড়বি। বিজ্ঞান পড়তে শেখ। বিজ্ঞান ছাড়া গতি নেই। তোর এই দাদাটি যদি ব্ৰাহ্মদের দলে ভেড়াতে চায়, সটকে পালিয়ে আসবি। নিজে ভালো-মন্দ বিচার করবি, নিজেই নিজের ধর্ম তৈরি করে নিবি। তোকে একটা বীজমন্ত্র দিয়ে দিচ্ছি, সেটা জপ করবি সব সময় : পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে… পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে…