এ বাড়ির বড় কত্তা বিমলভূষণ বারান্দায় বসে ছিলেন গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে। তিনি সংসারের সাতে-পাঁচে বিশেষ থাকেন না। আরাম কেদারার পাশে একটি টুলে এক গেলাস নিমপাতার রস রাখা আছে, মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছেন।সেদিকে শিশুদের মতনই তেতো জিনিস সম্পর্কে তার একটা ভীতি আছে, কিন্তু তাঁর কোষ্ঠকাঠিণ্যের সমস্যা, কবিরাজের নির্দেশে নিমপাতার রস তাকে খেতেই হয় প্রতিদিন সকালে।
শুধু ধুতি পরা, খালি গা, ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি ভাবছিলেন আজ সকালে দুধ-চিড়ে-কলা খাবেন, না লুচি- হালুয়া। তিনি ঔদরিক, সারাদিন খাদ্যচিন্তায় তিনি আরাম পান।
এক সময় তিনি বললেন, হ্যাঁ গা গিন্নি, মেজদের ওদিকটায় কিসের গোলমাল হচ্ছে গো?
কৃষ্ণভামিনী কাছে এসে বললেন, শুনলুম তো মেজগিন্নি বুমিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিমলভূষণ বললেন, বুমিটা আবার কে? নতুন কেউ বুঝি?
কৃষ্ণভামিনী বললেন, বুমি গো, বুমি, বুমিসূতো, ওই যে মেয়েটাকে ওরা পুরী থেকে নিয়ে এল। আহা অনাথা মেয়ে, ওর ওপর আমার মায়া পড়ে গেসল!
বিমলভূষণ তার স্ত্রীর গোল মুখখানির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই সময় তার একটু কৌতুক করার সাধ হল। সেই সাধের জন্যই সাময়িক ভাবে রক্ষা পেল ভূমিসূতা।
বিমলভূষণ ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, তোমার মায়া পড়ে গেসল, তা হলে তাকে মেজ বউ তাড়িয়ে দেয় কোন হিসেবে? তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে? চাকর-চাকরানিদের মাইনে দেয় কে, তুমি না মেজবউ?
কৃষ্ণভামিনী বললেন, ও মেয়েটাকে ওরা গুচ্ছের টাকা দিয়ে কিনে এনেছে, ওর মাইনে নেই।
বিমলভূষণ বললেন, কিনে এনেছে তা জানি। কিন্তু কার টাকায়? এস্টেটের টাকায়, না মণির নিজের টাকায়?
বিমলভূষণ বললেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে, মণি সেরেস্তায় হিসেব দাখিল করেছিল, পুরী হইতে নতুন দাসী আনয়ন বাবদ খরচ একশো চল্লিশ টাকা। মণি নিজের পয়সায় দয়া-দাক্ষিণ্য করার ছেলেই নয়। ও মেয়েটা এজমালি দাসী। মেজবউ যদি এমনি যখন তখন যাকে তাকে বিদেয় করে দেয়, তা হলে অন্য ঝি-চাকরদের কাছে তোমার মান থাকবে?
কৃষ্ণভামিনী বললেন, আহা মেজবউ ভারি আমার কথা শোনে! গুমোরে তার মাটিতে পা পড়ে না!
বিমলভূষণ ফিক করে হেসে বললেন, তুমি বুঝি মেজবউকে ভয় পাও? তুমি বড়বউ হয়ে তাকে শাসন করতে পার না?
কৃষ্ণভামিনী অমনি ফস করে জ্বলে উঠলেন। ব্যক্তিত্ব জাহির করার জন্য তিনি হাঁকডাক শুরু করলেন অন্য দাস-দাসীদের।
ভূমিসূতার পুঁটুলিটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে উঠোনে। ক্ষেমী দাসী তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে বাইরে। ভূমিসূতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, এই সময় মঙ্গলা দাসী এসে ওদের পথ আটকাল। বড়গিন্নির হুকুম, ভূমিসূতা যাবে না। সে কাজ করবে কৃষ্ণভামিনীর মহলে।
এই উপলক্ষে দুই জায়ে আবার কথা বন্ধ হয়ে গেল কয়েকদিনের জন্য।
কৃষ্ণভামিনীর পুত্রসন্তান নেই, তিনটি কন্যার মধ্যে দু’জনের বিবাহ হয়ে গেছে। ছোট মেয়েটির বিয়ের প্রস্তুতি চলছে, তার বয়েস ভূমিসূতার চেয়েও কম। কৃষ্ণভামিনীর বড় বোনের ছেলে-মেয়েরা এ বাড়িতে প্রায়ই আসে, তাদের মধ্যে আবার যমজ ছেলেদুটির, অজু ও বিজুর যেন সম্প্রতি মাসির জন্য দরদ একেবারে উথলে পড়ছে। তারা এ বাড়িতে আসে, খায় দায়, গল্প জমায়, রাত্তিরেও ফিরে যাবার নাম করে না। কৃষ্ণভামিনী ওদের প্রতি স্নেহে অন্ধ, দিদির ছেলেদুটি যদি পাকাপাকি তার কাছে থেকে যায়, তাতেও আপত্তি নেই। কৃষ্ণভামিনীর তুলনায় তার দিদির শ্বশুরবাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়, কৃষ্ণভামিনীই অজুবিজুর হাতখরচ জোগান।
ছেলেদুটি বেশ সুদর্শন, হুবহু একরকম চেহারা, তাদের স্বভাবেও প্রচুর মিল। দু’জনে পাশাপাশি থাকে, প্রায় একই কথা বলে। ওরা লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোয়নি, আর কিছুদিনের মধ্যেই বিমলভূষণের অফিসে ওদের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হবে, এই রকম ভরসা দেওয়া আছে।
ভূমিসূতার নাচ এই ছেলেদুটির খুব পছন্দ হয়েছিল। আগের তুলনায় নীতিবোধ খানিকটা শিথিল হয়েছে। অজু-বিজু অন্দরমহলেই থাকে, দুপুরবেলার কৌতুকের সময় ওদের বার করে দেয়া যায় না, ওরা দু’একবার ভূমিসূতার নাচ দেখেছে। এখন ভূমিসূতা এ মহলেই সর্বক্ষণ থাকে, অজুবিজু প্রায়ই বলে, ও মাসি, ওকে একটু নাচতে বল না! বোনপোদের অনুরোধ ফেলতে পারেন না কৃষ্ণভামিনী, তিনিও বলেন, ও বুমি, দেখা না একটু নাচ, মাঝের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি, এদিক পানে কেউ আসবে না।
কিন্তু ভূমিসূতা আর কিছুতেই নাচবে না। সে কোনও কথা না বলে মুখ গোঁজ করে থাকে। সে বুঝেছে, নাচের জন্যই এত অনৰ্থ। কিছুতেই তাকে রাজি করানো যায় না। তার ঘুঙুর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, অজু-বিজু বলে, আবার একজোড়া ঘুঙুর কিনে দিলে হয়তো সে নাচবে।
অজু-বিজুদের এড়িয়ে, আড়ালে আড়ালে থাকার চেষ্টা করে ভূমিসূতা। সারাদিন এক রকম কাটে, সন্ধের পর বাড়ি নিঝুম হয়ে গেলে তার মন খারাপ শুরু হয়ে যায়। সুহাসিনী তাকে একটা আলাদা ছোট ঘর দিয়েছিলেন, এই মহলে তাকে মঙ্গলা দাসীর সঙ্গে এক খাটে শুতে হয়। মঙ্গলা দাঁতে মিশি দেয়, তখন তার হাসির রঙও হয়ে যায় কালো, সেই কালো হাসির সঙ্গে সে অদ্ভুত সব খারাপ কথা বলে। সে সব শুনতে একেবারেই ভালো লাগে না ভূমিসূতার। তার ভূতের ভয় নেই, সে ছাদে চলে যায়।
পূর্ণিমার রাত, দুধ-সাদা হয়ে গেছে দিগন্ত, এই জ্যোৎস্নার টানে যেন দূর থেকে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। চাঁদ ঠিক মাথার ওপরে। ভূমিসূতা এক-একবার ওপর দিকে তাকায়, আর তার মনে হয়, চন্দ্রদেবতা তাকেই দেখছেন। পৃথিবীতে তার কেউ আপনি নেই, একথা মনে পড়তেই তার বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। কেউ নেই, কেউ নেই!
একা একা অনেকক্ষণ ছাদে ঘুরে বেড়ায় ভূমিসূতা। এক সময় সে মানুষের পায়ের শব্দ পায়। একজন নয়, দু’জন। ভূমিসূতা পাচিল ঘেষে দাঁড়াল, কাছে এসে ওদের একজন বলল, এই তো পেয়েছি। ভূমি, এখানে নাচবি? অন্যজন প্রতিধ্বনি করল, এখানে নাচবি?
উত্তর না দিয়ে ভূমিসূতা এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।
তখন অজু তার একহাত চেপে ধরে বলল, যাস কোথায়? নাচবি না?
বিজু অন্য হাত ধরে বলল, যাস কোথায়। নাচবি না?
ভূমিসূতা কান্না-মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, না, আমি নাচব না। আমায় ছেড়ে দাও গো!
অজু অবাক হয়ে বলল, ভয় পাচ্ছিস কেন? ভয় কিসের? বিজুও সেই একই কথা বলল।
তারপর ওরা দু’জনে হ্যাচকা টান দিয়ে শূন্যে তোলার চেষ্টা করল ভূমিসূতাকে, সে আছাড় খেয়ে পড়ল। তারপর প্ৰাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিল ছুটি। ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতন অজু-বিজু দুদিক থেকে গেল ধেয়ে। তারা খলখল করে হাসছে একই রকম গলায়।
একজনের হাত থেকে তবু উদ্ধার পাওয়া যায়, দু’জনের আক্রমণ এড়ানো খুব কঠিন। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যাচ্ছে ভূমিসূতা, ওরা তাকে বুকে জড়াতে চাইছে, কিন্তু দুদিকের বিপরীত টান, সেই ঝটাপটিতে কোনওক্রমে মুক্ত হয়ে আবার ছুটছে সে।
ভূমিসূতা জানে, সাহায্যের জন্য চিৎকার করে কোনও লাভ নেই। বাড়ির অন্য কেউ এখানে এসে পড়লে তাকেই দোষ দেবে। পুরুষমানুষ সোনার আংটি, তাতে কোনও কলঙ্ক পড়ে না। মেয়েদেরই শুধু দোষ হয়। অন্যরা বলবে, ভূমিসূতা একটা ডাইনী, সে এই ছেলেদুটির মাথা খেতে ছাদে টেনে এনেছে। বড় তাড়াতাড়ি এসব বুঝে যাচ্ছে ভূমিসূতা।
একবার সে ভাবল, পাঁচিল ডিঙিয়ে মরণঝাঁপ দেবে। লাফাতে গিয়েও থেমে গেল। মৃত্যুর আগে যে যন্ত্রণা হবে, সেটা কি সে সইতে পারবে। না লাফিয়ে সে অন্ধের মতন ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। হুড়মুড়িয়ে খানিকটা গড়িয়ে গিয়ে সে আবার দৌড়ে গেল সেই ঘরটির দিকে, যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে।
দরজা ঠেলে দেয়ালের এক কোণে ছিটকে পড়ল সে। পেছন পেছন তাড়া করে এল অজু আর বিজু। ভরত টেবিলে মুখ গুঁজে কিছু একটা লিখছে, তাকে গ্রাহ্যও করল না ওরা দু’জন। ভূমিসূতা যেন একটি আহত হরিণী, দুই শিকারী এসে তার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে ছেঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে। ভরত চেয়ার ছেড়ে ওঠেনি, শুধু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে। ভূমিসূতার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। আহত হরিণীটির দৃষ্টিতে শুধু করুণা ভিক্ষা নেই, যেন রয়েছে তার পৌরুষের প্রতি ধিক্কার।
অজু বলল, হিহি হি, কোথায় পালাবি তুই?
বিজু বলল, হিহি হি, কোথায় পালাবি তুই?
চেয়ারটা শব্দ করে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ভরত। সে এখন সবল যুবা, তা ছাড়া যেন তার মধ্যে ছলাৎ করে উঠল রাজরক্ত। দুটি ফর্সা বাঁদরের এই বেয়াদপী সে সহ্য করতে পারবে না।
সে ওদের একজনের চুলের মুঠি ধরে প্রচণ্ড জোরে এক চড় কষাল। তারপর রক্তচক্ষে অন্যজনের দিকে চেয়ে বলল, এখানে আমার পড়াশুনোর ব্যাঘাত করতে এসেছ, দূর হয়ে যাও!
অজু ও বিজু খাঁটি বঙ্গসন্তানের মতন, মার খেলে হজম করে যায়, প্রতি আঘাত করার সাহস নেই। অসহায় নারীদের ওপর অত্যাচার করার সময় বীরত্ব ফলায়, কিন্তু কোনও শক্ত মানুষের পাল্লায় পড়লেই মাথা নিচু করে কুইকুই করে। ভরতের রুদ্রমূর্তি দেখে তারা পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল, দরজার বাইরে গিয়ে আবার হম্বিতম্বি শুরু করল। ভরত একটা লোহার ডাণ্ডা নিয়ে বেরোতেই পিঠটান দিল তারা।
ভূমিসূতার দিকে কোনও মনোযোগ না দিয়ে আবার চেয়ারে ফিরে এসে ভরত পড়াশুনো শুরু করল। বুকের কাছে দুহাতে আঁচলটা চেপে ধরে একটা মূর্তির মতন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ভূমিসূতা।
একটু পরে সে বলল, শুনুন।
ভরত তার দিকে না ফিরে একটি হাত নেড়ে ইঙ্গিত করল তাকে চলে যেতে। শিয়াল তাড়াবার দিনে সে যেমন এই মেয়েটির সঙ্গে একটিও কথা বলেনি, আজও সে কোনও কথা বলতে চায় না।
ভূমিসূতা তবু এক পা কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনি যে আমার মান রক্ষা করলেন, সে জন্য আমি কী প্রতিদান দেব?
এবার ভরত কৌতূহলী হয়ে মুখ ফেরাল। শশিভূষণ যেদিন এই মেয়েটির ছবি তুলেছিলেন, সেদিন ভরত একে এ বাড়ির কোনও দাসী মনে করেছিল। তারা বাবা মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্যও দাসীদের ফটোগ্রাফ তোলেন। কিন্তু এই মাত্র মেয়েটি যে বাক্যটি বলল, তা তো দাসীদের ভাষা নয়। এর উচ্চারণও ভদ্র।
ভরত জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
ভূমিসূতা নিজের নাম জানিয়ে বলল, আমাদের বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়, আমার মা-বাবা কেউ নেই।
ভরত বলল, প্রতিদানের প্রশ্ন নেই। তুমি এখন যাও! এখানে আর এসো না। ভূমিসূতা বলল, ওরা যদি যাবার সময় আবার ধরে?
ভরত গম্ভীরভাবে বলল, আমি তো সব সময় তোমাকে রক্ষা করতে পারব না! বাড়ির কত্তাদের কাছে গিয়ে বল।
ভূমিসূতা বলল, আমার নালিশ কেউ শুনবে না।
ভরত এবার অসহিষ্ণুভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কী মুশকিল, আমি তার কী করতে পারি। আমি একটেরেয় থাকি, এ বাড়ির অন্য লোকদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
আবার উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, আমি সিঁড়ির কাছে বাতি ধরছি, তুমি যাও, কোনও ভয় নেই।
তবু যেতে চায় না ভূমিসূতা। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ভরত তাকে রক্ষা করেছে। তবু বিনিময়ে এই মানুষটি কিছুই চায় না।
এ পৃথিবীতে ভূমিসূতা এমন ব্যবহার যে আর কারুর কাছ থেকে পায়নি। এই মানুষটির পা দুটি জড়িয়ে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে।
ভরত কঠোর ভাবে বলল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাও!
পরদিন রাতে ভরতের কক্ষে আবার চলে এল ভূমিসূতা। আজ তাকে কেউ তাড়া করেনি, সে স্বয়মাগতা।
ভরত নিবিষ্টভাবে কিছু পাঠ করছিল, প্রথম কিছুক্ষণ খেয়ালই করেনি। একসময় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, লাল পাড় শাড়ি পরা মেয়েটি কাছেই দাঁড়িয়ে একদৃষ্টি চেয়ে আছে তার দিকে।
ভুরু কুঞ্চিত করে ভরত জিজ্ঞেস করল, আবার এসেছ? কী চাই?
ভূমিসূতা বলল, একটা পলার আংটি, সোনার না, রুপোর, আপনি নেবেন?
ভরত বলল, আংটি? কেন, আমি আংটি নেব কেন?
ভূমিসূতা বলল, আমার যে আর কিছুই নেই!
কুঞ্চিত ভুরু সোজা হয়নি, ভরত বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে রইল এই কিশোরীটির দিকে। এক ঝলক তার মনে পড়ে মনোমোহিনীর কথা। যদিও মনোমোহিনীর সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। এ মেয়ে রঙ্গিণীর মতন হাসে না, চোখের কোণে ইঙ্গিত নেই। বরং ভিতু ভিতু ভাব। যেন একটা ভয় পাওয়া পাখি। সামান্য দাসী-বাদীর কাজ করে। তবু সে একটা আংটি দিতে চাইছে তাকে?
ভরত বলল, আমায় কিছু দিতে হবে কে বলেছে? কেউ কিছু দিলেও আমি নিই না।
ভূমিসূতা বলল, আমি গীতগোবিন্দের পদ গাইতে পারি। গেয়ে শোনাব?
ভরত বলল, গীতগোবিন্দী? তুমি সংস্কৃত উচ্চারণ করতে পার।
ভূমিসূতা বলল, আমি ইংরেজি জানি। এ স্নাই ফক্স মোট এ হেন। একটি ধূর্ত শৃগাল….
ভরত জিজ্ঞেস করল, মুখস্থ করেছ? এলিফ্যান্ট মানে কী জান।
ভূমিসূতা বলল, হ্যাঁ জানি। হাতি।
— জগন্নাথের মন্দির, এর ইংরেজি কী?
— লর্ড জগন্নাথ’স টেম্পল।
– এসব তোমাকে কে শিখিয়েছে?
– আমার বাবা।
– তা হলে তুমি এ বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে এসেছ কেন?
– এরা নিয়ে এসেছে। আমার যে কেউ নেই। বাবা-মা সব মারা গেছেন কলেরায়।
— হুঁ, তা হলে আর কী করা যাবে!
– আপনি আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবেন? এই সময় আমার কোনও কাজ থাকে না।
– আমার সময় নেই। আমি মাস্টারি করতে জানিও না।
ভূমিসূতা এবার মেঝেতে বসে পড়ল। অনুনয়ের সুরে বলল, আর কিছু করতে হবে না। আপনি জোরে জোরে পড়বেন, আমি শুনিব। যদি মানে না বুঝতে পারি-
ভরত এবার ধমক দিয়ে বলল, ওসব হবে না! ওঠো, ওঠো, নিজের জায়গায় যাও। এখানে আমাকে বিরক্ত করতে আর এসো না!
ভূমিসূতা বলল, তা হলে এটা আপনাকে নিতে হবে।
উঠে দাঁড়িয়ে, ভরতের টেবিলের ওপর একটা আংটি রেখে দিয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।
ভরত একটুক্ষণ বসে রইল হতবুদ্ধির মতন। এই আংটি নিয়ে সে কী করবে। আংটিটা ফেরত দেবেই বা কী করে। ভিতর মহলে সে কক্ষনও যায় না। এ বাড়ির কেউ তার জীবনযাত্রা নিয়ে মাথা গলায় না, কারণ সে শশিভূষণের প্রতিনিধি, সে শশিভূষণের অংশ দেখাশুনা করে।
এ বাড়ির রান্নার ঠাকুর নিত্যানন্দ আর হেলার কাছে সে এক সময় খিদের জ্বালায় দুমুঠো মুড়ির আশায় বসে থাকত, এখন ওরা তাকে খাতির করে, দেখা হলে নমস্কার ঠোকে। ওরা বুঝে গেছে, ভরত এখন পাকাপাকিভাবে বাবুশ্রেণীর অন্তর্গত হয়ে গেছে। এখন ভরতের নিজস্ব হাতখরচ আছে, সে নিত্যানন্দদের বখশিস দেয়, সে ঘোড়ায় টানা ট্রামে চাপে, ইডেনবাগানে বাজনা শুনতে যায়, টিকিট কেটে থিয়েটার দেখে। প্রেসিডেন্সি কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে থিয়েটার দেখার সূত্রে তার বন্ধুত্ব হয়েছে, আগামী বছর ভরত ওই কলেজে ভর্তি হবে।
ভূমিসূতা আর আসেনি, কিন্তু আংটিটার জন্য মনটা খচখচ করে ভরতের। অতি সাধারণ একটা পলার আংটি, রুপো কালো হয়ে গেছে, তবু ওই অনাথা মেয়েটার কাছে এর দাম আছে। বিক্রি করলে এক টাকা-দুটাকা পেতে পারে।
বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশুনো করে বলে ভরত জাগে বেশ দেরিতে। সে এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন, যখন ইচ্ছে ঘুমোবে, যখন ইচ্ছে জাগবে। বেলা দশটার সময় পণ্ডিতমশাই আসেন পড়াতে, তার আগে তৈরি থাকলেই হল। তবু একদিন ভোরবেলা তার ঘুম ভেঙে গেল। কোথা থেকে যেন মৃদুস্বরে একটা গান ভেসে আসছে। নারী কণ্ঠের গান। সে খুবই অবাক হল। এই সময় কে গান গাইবে! কান খাড়া করে শুনে তার বিস্ময় আরও পেল। গানের ভাষা সংস্কৃত, এবং সে গান কেউ গাইছে তারই দরজার ওপাশে। ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি দান্তরুচি কৌমুদী…।
ভরত ঝাঁট করে খাট থেকে নেমে একটানে দরজাটা খুলে ফেলল। মাটিতে বসে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে গান গাইছে ভূমিসূতা। ভরতকে দেখেই যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে, তারপর দৌড় লাগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল!
ভরতের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটির আত্মসম্মানজ্ঞান আছে। শুধু আংটিটা দিয়েই তার প্রতিদান শেষ হয়নি। ঘুমন্ত ভরতকে সে গান গেয়ে জাগাতে চায়।
জানলা দিয়ে দেখল, মেয়েটি এখন ফুল তুলছে। ধুতিটা গুছিয়ে পরে নিল ভরত। গায়ে একটা বেনিয়ান চাপিয়ে, টেবিল থেকে আংটিটা তুলে নিয়ে বাগানে নেমে এল। ভূমিসূতা তাকে দেখে পালাবার চেষ্টা করছিল, ভরত হাত তুলে আদেশের সুরে বলল, দাঁড়াও!
কাছে গিয়ে জোর করে তার হাতের মুঠোয় আংটিটা ভরে দিয়ে ভরত বলল, গান শুনিয়েছ, আর কিছু দিতে হবে না এটা রাখো।
সলজ্জ কণ্ঠে ভূমিসূতা বলল, আবার কাল গান শোনাতে পারি।
ভরত বলল, না, তার আর দরকার নেই।
ভূমিসূতা বলল, আমি নাচও জানি। দেখাব? এখন এখানে কেউ আসবে না।
উত্তর শোনার অপেক্ষা করল না সে। মাথার ওপর দু’হাত তুলে চাপড় মেরে তাল দিল, তারপর শুরু করে দিল নাচ।
স্মিতহাস্যে মেয়েটিকে দেখতে লাগল ভরত। শিল্পের তরঙ্গ তাকে স্পর্শ করল না। ফুলের বাগানে এক নৃত্যরতা কিশোরীকে দেখতে দেখতেও মনে হল, এটা একটা কৌতুকজনক ব্যাপার। একটু পরেই সে বলল, এই তো যথেষ্ট হয়েছে! বাঁ!
ভরত গমনোদ্যত হতেই ভূমিসূতা জিজ্ঞেস করল, আপনি আমায় পড়া শেখাবেন না? মুখ না ফিরিয়েই ভরত বলল, না, আমার সময় নেই।
দুদিন পর ভরত কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গেল ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ থিয়েটার দেখতে। বেঙ্গল থিয়েটার আর ন্যাশনাল থিয়েটারের মধ্যে জোর প্রতিযোগিতা চলছে, দুটি মঞ্চেই নামছে নতুন নতুন পালা। বেঙ্গলেরই সুনাম বেশি, ওরা মঞ্চের ওপর ঘোড়া নিয়ে আসে। কিন্তু গিরিশবাবু ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ পালা একেবারে জমিয়ে দিয়েছেন। কীচক আর দুৰ্যোধন, দুটো ভূমিকাতেই নেমেছেন গিরিশচন্দ্র স্বয়ং, অমৃতলাল মিত্তির ভীম, আর দ্রোপদী সেজেছে বিনোদিনী। অভিমন্যু কে সেজেছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, এক বন্ধু ভরতের কানে কানে বলল, ও তো বনবিহারিণী! তা শুনে ভরত একেবারে থ। বনবিহারিণী নামকরা নায়িকা, সে পুরুষের ভূমিকাতেও এত ভালো অভিনয় করতে পারে? বিনোদিনী আর বনবিহারিণী দু’জনেই ঘন ঘন ক্ল্যাপ পাচ্ছে।
সব নাটকেই নাচ থাকে। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, দর্শকেরা নাচ দেখতে চায়। নাটকের শুরুতে এবং ইন্টারভ্যালের পর সখীর দল খানিকক্ষণ নেচে যায়। এই নাটকে অবশ্য উত্তরার তো নাচেরই ভূমিকা, বৃহন্নলাবেশী অৰ্জ্জুন তাকে নাচ শেখাবে। কিন্তু উত্তরা সেজেছে ভূষণকুমারী, তার নাচ মোটেই সুবিধের নয়, শরীর একেবারে শক্ত।
নাটক দেখতে দেখতে হঠাৎ ভূমিসূতার কথা মনে পড়ল ভরতের। মেয়েটি নাচতে জানে, গাইতে জানে, কিছু লেখাপড়াও শিখেছে, কিন্তু বিশ্বসংসারে ওর আপনি কেউ নেই ওকে ঝি-গিরি করেই কাটাতে হবে সারাজীবন। ওর এই গুণগুলো বৃথা যাবে। একমাত্র থিয়েটারে যোগ দিলে ওর ভাগ্য খুলে যেতে পারে। মেয়েটি দেখতে শুনতেও ভালো, নাচ জানা, গান জানা এমন মেয়ে পেলে লুফে নেবে যে-কোনও নাটুকে দল। থিয়েটারের মেয়েদের অবশ্য কেউ ভালো বলে না, সমাজে তাদের স্থান নেই, কিন্তু বাড়ির ঝিদেরও কি গ্রাহ্য করে সমাজ? অভিনেত্রীরা তবু তো হাততালি পায়, বাড়ির ঝি সারাদিন মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করলেও কি পায় কিছু?
ভরতের বন্ধু নীলমাধনের সঙ্গে অর্ধেন্দুশেখরের আত্মীয়তা আছে, তাকে ধরে ভূমিসূতাকে কোনও নাটকের দলে ঢুকিয়ে দেওয়া শক্ত হবে না, তার আগে জানাতে হবে ভূমিসূতা এই জীবন চায় কি না!
সে রাত্রে বাড়ি ফিরে ভরত দেখল, কে যেন তার ঘরখানি সুচারু ভাবে গুছিয়ে দিয়েছে। তার বইপত্র এলোমেলো হয়েছিল, জামা-কাপড় যেখানে সেখানে ছড়ানো থাকে, সব এখন সুবিন্যস্ত। টেবিলের ওপর অনেকখানি কালির দাগ ছিল, মোহা হয়নি, কেউ সযত্নে সেই দাগ তুলে দিয়েছে। টেবিলের ঠিক মাঝখানে রয়েছে রুপোর তৈরি সেই পলার আংটি।