কী কুক্ষণেই ভূমিসূতা বলে ফেলেছিল যে, সে নাচতে জানে, এখন অন্দরমহলের দুপুরগুলিতে প্রায়ই তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়।
এই পরিবারের দুই জা কৃষ্ণভামিনী আর সুহাসিনীর মধ্যে প্রকাশ্যে কোনও বিরোধ নেই, বরং গলাগলি ভাবই আছে বলে মনে হয়, তবে আড়ালে পরস্পরের নামে ঠেস দিয়ে কথা বলাবলি, সে তো থাকবেই। দু’জনের মহল আলাদা, কিন্তু কৃষ্ণভামিনী বড় বউ হিসেবে গোটা সংসারের কর্ত্রী, চাবির গোছা তার কোমরে ঝনঝন করে। আবার কৃষ্ণভামিনীর স্বামীর তুলনায় সুহাসিনীর স্বামীই পারিবারিক ব্যবসায়টি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন, তাঁর কৃতিত্বের অর্থাগম হচ্ছে প্রচুর, সুতরাং সুহাসিনীর খানিকটা দেমাক তো থাকতেই পারে।
অনাথা ভূমিসূতাকে পুরী থেকে উদ্ধার করে এনেছেন, বলা যায় টাকা দিয়ে কিনে এনেছেন, মনিভূষণ, অতএব সে সুহাসিনীরই সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণভামিনী তাঁর মহলে ওই মেয়েটিকে স্থান দিয়েছেন, প্রথম থেকেই মেয়েটির ওপর তাঁর টান পড়ে গেছে। এ বাড়ির কর্ত্রী হিসেবে সমস্ত দাস-দাসী ও আশ্ৰিত-পরিজন তাঁর অধীন। ভূমিসূতা বেশ শান্ত ও বাধ্য, প্রত্যেকদিন সে নিয়মিত পুজোর ফুল তুলে আনে, ঠাকুরঘর সাজায়, তা ছাড়াও কত্তা-গিন্নিদের যেকোনও হুকুম সে তামিল করে হাসিমুখে। সে গিন্নিদের স্নানের জন্য হলুদ বেটে দেয়, সেলাই-ফোঁড়াই পারে, কত্তাদের গড়গড়ায় তামাক সাজতেও শিখে নিয়েছে। শশিভূষণের অসুস্থতার সময় সে সেবা করেছে রাত জেগে।
ভূমিসূতার বাবা-মায়ের অকালমৃত্যুর পর দেবদাসী করার জন্য তাকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু সে যে আগে থেকেই নাচ শিখেছে তা কারুর জানা ছিল না। শশিভূষণ যেদিন ছবি তুলছিলেন, সেদিন ভূমিসূতা নিজেই জানিয়ে দিয়েছে।
এখন দুপুরবেলায় আহারাদি সাঙ্গ হলে কৃষ্ণভামিনী ও সুহাসিনী পানের বাটা সামনে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে ডাকেন, ও বুমি, আয় তো, একটু নাচ দেখা। ‘পবন হিল্লোল’ নাচটা আর একবার দেখা তো বাছা!
নাচের জন্য বিশেষ সাজ করে নিতে হয় ভূমিসূতাকে। চুড়ো খোপা করে চুল বাঁধে, কাজল-টানা দেয় দু চোখে, চন্দনের ফোঁটা আঁকে কপালে আর গালে, শাড়িখানা দু ফেরতা করে পরে নেয়, আঁচল বাঁধে কোমরে।
তারপর সে নাচ শুরু করলেই হেসে গড়াগড়ি দেন দুই গিন্নি। শুধু ওঁরা নন, দাসী ও আশ্রিতা মহিলারাও ভিড় জমায়, তাদের মধ্যেও হাসির ধূম পড়ে যায়। বাঙালি পরিবারে নাচ একটা অভিনব ব্যাপার। বাঙালির জীবনে নাচই নেই বলতে গেলে। বৈষ্ণবরা অনেক সময় রাস্তা দিয়ে খোল-কত্তাল বাজিয়ে ধেই ধেই করতে করতে যায়, তাকে ঠিক নাচ বলা যায় না, এবং সে দলে কোনও নারী থাকে না। শোনা যায় বটে যে, বাঈজীরা ধনীদের প্রমোদ-আসরে নাচানাচি করে, কিন্তু ভদ্রঘরের পুর-নারীরা তা কোনওদিন চক্ষে দেখেনি। মেটেবুরুজে লখনউয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দলবলের সঙ্গে অনেক বাঈজী এসে আস্তানা গেড়েছে, কলকাতার ধনী সন্তানেরা সেখানে যাওয়া-আসা করে, কিন্তু সেই বাঈজীরা যে কী ধরনের প্রাণী, তা কৃষ্ণভামিনী-সুহাসিনীর মতন রমণীরা জানে না।
ইদানীং অবশ্য থিয়েটারেও নাচ শুরু হয়েছে। বেশ্যারা অ্যাকটিং করে, আবার নেচে নেচে গান গায় মঞ্চের ওপরে। বেঙ্গল থিয়েটার আর ন্যাশনাল থিয়েটার পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নাচ-গানের সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। গিরিশ ঘোষ ‘আনন্দ রহো’ নামে কী একটা পালা নামিয়েছে, তার একখানা গান, ‘নেচে নেচে আয় মা শ্যামা’ এখন ভিখিরিরাও গায়। কিন্তু কৃষ্ণভামিনী-সুহাসিনীদের সেই থিয়েটারে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্ৰ নারীরা সেখানে যায় নাকি, ছিঃ! থিয়েটার মানেই বেলেল্লাল জায়গা, মাতাল-গাজাখোর-লম্পটদের বেশ একটা আখড়া হয়েছে থিয়েটারের নামে। আট আনার টিকিট কেটে যে-কেউ দর্শক হতে পারে, উচ্চও মাতালরা মঞ্চে বেশ্যাদের নাচ-গান শুরু হলেই জিভের তলায় আঙুল দিয়ে সিটি মারে, অসভ্য মন্তব্য ছুড়ে দিতেও তাদের মুখে আটকায় না। মনিভূষণ নিজে একদিন বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে সুদূর উত্তর কলকাতার মঞ্চে একখানা থিয়েটার দেখতে গিয়ে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করে ফিরে এসেছেন, আর কোনও দিন ও মুখো হবেন না।
ভবানীপুরের এই সিংহীবাড়ির রমণীরা এই প্রথম নাচ দেখছে। বেশ ভালোই নাচে ভূমিসূতা, সারা শরীর দুলিয়ে, দু’ পা থিরিথিরি করে কাঁপিয়ে, শূন্যে লাফিয়ে সে নাচে। বোঝা যায়, সে রীতিমতন যত্ন করে শিখেছে। কৃষ্ণভামিনী প্রথম দিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ, লা, তোকে কে শিখিয়েচে নাচতে?
ভূমিসূতা বলেছিল, আমার বাবা!
সে কথা শুনেও সকলের বিস্ময়ে গালে হাত পড়ে। বাপ হয়ে কেউ মেয়েকে বাঈজীদের মতন নাচ শেখাতে পারে? সুহাসিনী পুরীতে দেখে এসেছেন, দরিদ্র হলেও ভূমিসূতা ভদ্র পরিবারের মেয়ে, তার বাবা ছিলেন পাঠশালার শিক্ষক। সে বাড়ির মেয়ে কী করে বা কেন নাচ শেখে, তা এঁদের বোধগম্য হয় না। কৃষ্ণভামিনীরা জানেন না যে, বাঙালিদের তুলনায় উড়িষ্যার মেয়েরা অনেকখানি মুক্ত, নাচ-গান তাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত। মুসলমানি রীতিনীতির প্রভাবে বাংলার হিন্দু পরিবারের নারীরাও অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ, বাইরের তারা চোখ মেলে তাকাতে পারে না। মোগল-পাঠানদের আধিপত্য উড়িষ্যায় তত বেশি ছিল না। কখনও, পুরী-ভুবনেশ্বরে এবং সদ্য খোঁজ পাওয়া জঙ্গলে ঢাকা অর্ধভগ্ন কোনারক মন্দিরে দেয়ালগাত্রের মূর্তি-শিল্পের তুল্য কণামাত্র নিদর্শন বাংলার কোনও মন্দিরে নেই। নৃত্য যে ভক্তির অর্ঘ্য এবং পূজার অঙ্গ হতে পারে, সে ধারণাও নেই বঙ্গনারীদের।
কিশোরী ভূমিসূতার শরীরে যৌবন এখনও আসেনি। কিন্তু আগমন বার্তা ঘোষণা করেছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই লম্বা হতে শুরু করেছে সে, ছেলেদের তুলনায় আলাদা হয়ে যাচ্ছে তার উরুর গড়ন, বক্ষে দুটি ফুলের কুড়ি, দীর্ঘ হয়েছে অক্ষিপল্লব। হাতের আঙুলগুলি চম্পককলির মতন। নাচ শুরু করে সে প্রথমে যখন দুই হাত যুক্ত করে কপালে ছোঁয়ার, তখন থেকেই মনে হয় তার তনুটি ছন্দোময়।
প্রথম প্রথম তাঁর নাচ ছিল কৌতুকের ব্যাপার, ক্রমশ তা দুই জায়ের মধ্যে রেষারেষিতে পর্যবসিত হল। কৃষ্ণভামিনীর বাপের বাড়ির লোকজন আসে মাঝে মাঝে, তখন তিনি নিজের মহলে গিয়ে বসেন। একদিন তার এক মাসি এসেছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে, তাদের শরবত-মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতে করতে কথায় কথায় ভূমিসূতার প্রসঙ্গ এল। ভূমিসূতা এঁটো রেকাবি-গেলাস সরাচ্ছিল, তাকে দেখিয়ে অভিনব কিছু ঘোষণার ভঙ্গিতে কৃষ্ণভামিনী বলে উঠলেন, জানো গো, ফুলমাসি, এই মেয়েটি নাচ জানে। অ বুমি, একটু নেচে দেখা তো বাছা।
নাচতে আপত্তি নেই ভূমিসূতার, কিন্তু যেমন তেমন অবস্থায় সে নাচ শুরু করে না। সে চুল আঁচড়াতে বসল। পুরী থেকে সে যে একটা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে ছিল একজোড়া ঘুঙুর। এতদিন বার করেনি, আজ বাইরের লোকদের সামনে নাচ দেখাতে হবে, সাজগোজের পর সে পায়ে বেঁধে নিল ঘুঙুর।
কৃষ্ণভামিনী ফুল-মাসির দুটি ছেলেও এসেছে, তারা যমজ, অজয়ানন্দ আর বিজয়ানন্দ, তাদের বয়েস পনেরো। তারা এখনও ঠিক পুরুষমানুষ হয়নি বটে, কিন্তু বালকও বলা যায় না। ভূমিসূতা নাচ শুরু করতেই ফুলমাসি শিউরে উঠে বললেন, ওরে অজু-বিজু, তোরা বাইরে যা, বাইরে যা! কিন্তু সে ছেলেদুটি কথা শুনতে চায় না, তারা গোঁ ধরে রইল, তারাও নাচ দেখবে!
নাচ একটা অসভ্য ব্যাপার, মেয়েমহলে গোপনে দেখা চলতে পারে, কিন্তু ব্যাটাছেলের পাশাপাশি মেয়েরা বসে ওই জিনিস দেখা খুবই গৰ্হিত কাজ। ঘটনাটা সুহাসিনীর কানে উঠতেই তিনি ক্ৰোধে অগ্নিবৰ্ণ হলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি ক্ষেমী দাসীকে আদেশ দিলেন, যা, বুমির কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আয়। ওর নাচের শখ আমি জন্মের মতন ঘুচিয়ে দিচ্ছি।
ও মহলে নাচ বেশ জমে উঠেছে, তার মাঝখানে মূর্তিমান বিঘ্নের মতন ক্ষেমী দাসী গিয়ে পড়ল। ক্ষেমী দাসী অতি জাঁদরেল, যেমন তার চোপার জোর, তেমনই তার পেশীর জোর, পুরুষরাও তার সামনে ভড়কে যায়। নৃত্যরত অবস্থাতেই ভূমিসূতার একখানা হাত খপ করে চেপে ধরে ক্ষেমী দাসী বলল, মেজগিন্নি ডাকছেন, আয়, চলে আয় আমার সঙ্গে।
কৃষ্ণভামিনী, ফুলমাসী ও তাঁর ছেলেদের প্রবল আপত্তিও টিকল না। ক্ষেমী দাসী ভূমিসূতাকে ধরে নিয়ে গেল, সুহাসিনী ঠাস ঠাস করে তার গালে কয়েকটা চড় কষিয়ে গাল পাড়তে লাগলেন। সেই চড়ের শব্দ ও গালাগালি পৌঁছল যথাস্থানে, আত্মীয়দের সামনে অপমানিত হয়ে কৃষ্ণভামিনীও গুমরোতে লাগলেন। দুই জায়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
এ মনোমালিন্য অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হল না। সুহাসিনীর তুলনায় কৃষ্ণভামিনী অনেক সরল ও সাদাসিধে, তিনি স্বীকার করলেন যে, ফুল-মাসির অত বড় বড় দুইছেলের সামনে ভূমিসুতাকে নাচতে বাধ্য করাটা উচিত হয়নি মোটেই।
আবার দুই জায়ে একসঙ্গে বসে ভূমিসূতার ঘুঙুর পরা পায়ের নাচ দেখা শুরু করলেন দুপুরে। প্রথমে ছিল কৌতুক কৌতূহল। এখন যেন তাঁদের অজান্তেই নৃত্যের শিল্পরস একটু একটু করে চুইয়ে যাচ্ছে তাদের অনুভূতিতে। ছন্দের ঝংকার সাড়া জাগাচ্ছে তাদের চেতনায়।
সুহাসিনী একদিন বললেন, অ বুমি, তুই নাচের সঙ্গে গান গাইতে পারিস না? গান শিখেছিস?
ভূমিসূতা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, গানও জানি।
সে গাইতে শুরু করে :
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দত্তারুচি কৌমুদী
হরতিদর তিমিরামতি ঘোরাম
ক্ষুরদাধর সিধবে তব বদনচন্দ্ৰমা
রোচায়তি লোচন চকোরম…
বিস্ময়ে গালে হাত দিয়ে কৃষ্ণভামিনী বললেন, ওমা, এ কী গান গো। কিছুই যে বুঝলুম না। এ তোদের উড়িয়া ভাষা নাকি রে?
কৃষ্ণভামিনীর তুলনায় সুহাসিনী একটু বেশি জানে। সে বলল, না গো, দিদি, এ হচ্ছে সমসকিত্য, ঠাকুর দেবতার গান, পুজোর গান!
ভূমিসূতা মুখ টিপে হাসছে।
কৃষ্ণভামিনী বললেন, এ মেয়ের পেটে পেটে কত বিদ্যে! কত কী জানে!
ভূমিসূতা বলল, আমি ইংলিশ জানি, শুনবেন? এ স্নাই ফক্স মোট এ হেন। একটি ধূর্ত শৃগাল একটি মুরগির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিল…
বেলা এগারোটায় সময় এ বাড়ির বাবুরা খেয়েদেয়ে আপিস করতে যান, তারপর বসে মহিলাদের আসর। বাবুরা ফেরেন সন্ধের সময়। এ বাড়ির কত্তারা বাইরে রাত কাটান না, বাড়িতেও মদের আসর বসান না। জমিদারি বিক্রি করে দেবার পর জমিদারি মেজাজও আর তেমন নেই। মণিভূষণের শুধু একটি রক্ষিতা আছে। শখের বাজারে এক বাগানবাড়িতে, সেখানে তিনি যান শুধু রবিবার দুপুরে, এটুকু বিচ্যুতি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
যেহেতু অন্যের চাকরি নয়, নিজেদেরই অফিস, তাই প্রতিদিন যাবার দায় নেই। এক দুপুরে নিজের চেম্বারে আরাম কেদারায় একটুখানি দিবানিদ্ৰা দিচ্ছিলেন মণিভূষণ, হঠাৎ তাঁর স্কন্ধে একটা যন্ত্রণা বোধ হল। আরাম কেদারায় ঘুমেনোতেও তেমন আরাম নেই, ঘাড়ে ব্যথা হয়ে যায়, মণিভূষণের বিছানার জন্য মন কেমন করল। তিনি বাড়ি ফিরে যাওয়া মনস্থ করলেন।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি শুনতে পেলেন ঘুঙুরের শব্দ। তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। থিয়েটারের মঞ্চে ছাড়া তিনি এ আওয়াজ কখনও শোনেনইনি।
জুতো খুলে পা টিপে টিপে এসে তিনি দেখলেন এক অভাবনীয় দৃশ্য। তাঁরই শয়নঘরের মেঝেতে একদিকে সার দিয়ে বসেছে আট-দশটি নারী, তাদের কোল ঘেঁষে রয়েছে বাচ্চারা, কয়েকজন দাসী উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে জানলা দিয়ে, আর ঘরের অন্য দিকে ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নাচছে একটি কিশোরী। প্রথমে তিনি ভূমিসূতাকে চিনতে পারলেন না। এ বাড়িতে সে ফুট-ফরমাস খাটে, ক্বচিৎ দেখা হয়। এরকম সাজগোজের অবস্থায় কখনও দেখেননি, হিল্লোলিত শরীরটিও অচেনা। তাঁর ধারণা হল, থিয়েটারের কোনও নষ্ট মেয়েকে ধরে এনে বাড়ির মেয়েরা গোপনে আমোদ করছে। বাড়ির মেয়েদের এমন আমোদ করার ইচ্ছেটাই তার মতে পাপ।
কয়েক পলক সেই দৃশ্যটি দেখে তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, এসব কি হচ্ছে, অ্যাঁ, ছি ছি ছি ছিা!
যেন একটা বজ্রপাত হল। থেমে গেল নাচ, সভয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন রমণীরা। বাদামি রঙের সুট ও মেরুন টাই পরা মণিভূষণ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, দুপুরবেলা তোমরা এই কাণ্ড কর! বাড়িতে রাধামাধব রয়েছেন, তার মধ্যে এমন নষ্টামি! বাড়ি অপবিত্র করে ফেললে!
সুহাসিনী ফ্যাকাশে গলায় বললেন, ও আমাদের বুমি গো। নাচ দেখাচ্ছে।
মণিভূষণ ভূমিসূতাকে এবার চিনতে পেরেও বললেন, ভদ্রলোকের বাড়িতে নাচ? ছিছিছিছি! তা হলে আর ওকে পুরী থেকে নিয়ে এলে কেন? মন্দিরে দেবদাসী হলেই তো ওকে মানাত! ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোরও মাথা খাচ্চ! ফের যদি কোনওদিন আমি এসব শুনি, এ মেয়েটাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব!
সেই থেকে নাচ বন্ধ হয়ে গেল। ভূমিসূতার ঘুঙুরজোড়া ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল আস্তাকুঁড়ে। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল, এ বাড়িতে থাকতে হবে তাকে অন্যান্য আশ্রিতদের মতন, বয়স্ক পুরুষদের সামনে সে সহসা আসবে না। তবে তার সকালবেলা ফুল তোলার দায়িত্বটা অব্যাহত রইল।
ভূমিসূতার এই পদাবনতিতে খুশি হল অন্য দাস-দাসীরা। কোথাকার একটা অজাত-কুজাতের মেয়ে, নাচের জন্য বেশি খাতির পেয়ে যাচ্ছিল সে। রান্নার ঠাকুরেরা উড়িষ্যার লোক, সেই সুবাদে তারা মনে করে যে, ভূমিসূতার ওপর তাদের একটা অধিকার আছে। কখনও কখনও ভূমিসূতাকে একতলার রান্নাঘরে আসতে হয়, তখনই নিত্যানন্দ তাকে ধমকায়। তার মুখের ভাষায় কোনও আড় নেই। হেলা নামে তার সহকারিটির বউ সদ্য মারা গেছে, ভূমিসূতা হেলাকে বিয়ে করবে না কেন? হেলার আগের বয় নিত্যানন্দের পদসেবা করত নিয়মিত।
ভূমিসূতা এসব কথা শুনে মুখ বুজে থাকে, খাদ্যের পত্রগুলি ভরা হলে দৌড়ে চলে যায় ওপর মহলে।
নাচ বন্ধ, তবু ভূমিসূতা নাচ ছাড়তে পারে না। সে নির্জনে একা একা নাচে, কখনও একতলায় স্নানের ঘরে, কখনও ছাদে। মস্ত বড় ছাদ, কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই, তবু এ বাড়ির কেউ সন্ধের পর ছাদে ওঠে না, অপদেবতার দৃষ্টি লাগার ভয় আছে। ফাঁক পেলেই ভূমিসূতা ছাদে উঠে আসে, ছায়ামূর্তির মতন ছন্দোময় পদক্ষেপে সে ঘুরে বেড়ায়।
এ বাড়িতে রাত্রির আহারাদির পাট চুকে যায় বেশ তাড়াতাড়ি, তারপর বাতি নিবে যায়। ভূমিসূতা এক-একদিন অন্ধকারে ছাদের আলসে ধরে দাঁড়িয়ে তার বাবা-মা, ভাই-বোনদের কথা স্মরণ করে কাঁদে। মাত্র কয়েকদিনের কলেরায় সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, শুধু বেঁচে রইল সে একা। কেন বাঁচল, একসঙ্গে মৃত্যু হলে সেও মা-বাবার সঙ্গে স্বর্গে গিয়ে থাকতে পারত।
বেশি রাতেও এ বাড়ির একটি ঘরে বাতি জ্বলে। বৈঠকখানা মহলের ওপরতলায় একটি ছোট ঘরে থাকে ভরত। শশিভূষণ ফিরে গেছেন ত্রিপুরায়, ভরতের অবস্থার অনেক বদল হয়েছে। সে আর আগেকার মতন অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত অনাথ কিশোর নয়। রাধারমণ ঘোষ কথা রেখেছেন, তিনি প্রতি মাসে ভরতের নামে দশটি করে টাকা পাঠান। শশিভূষণও ঠিক করে গেছেন, এ বাড়িতে তার সম্পত্তির অংশের হিসেবনিকেশ রাখবে ভরত, সেজন্যও সে বিশ টাকা জলপানি পাবে। এ পল্লীতে ভালো ইস্কুল নেই, ভরতের জন্য দু’জন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে, একজন পণ্ডিত ও একটি কলেজের ছাত্র, তাদের কাছ থেকে ভরত অঙ্ক-ইংরেজি-সংস্কৃতের পাঠ নেয়। তার চেহারা ও স্বভাবেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এক বছরের মধ্যেই অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছে সে, প্রশস্ত কাঁধ, দৃঢ় দু’ হাতের কব্জি, থুতনিতে অল্প অল্প দাড়ি এবং তার ব্যবহার অত্যন্ত গম্ভীর। বাড়ির কারুর সঙ্গে সে মেশে না, অনবরত পড়াশুনো করে। ভরতকে ভয় পায় ভূমিসূতা, দু- একবার সে ভরতের সঙ্গে কথা বলতে গেছে, ভরত পাত্তাই দেয়নি।
ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় ভূমিসূতা, জানলার ধারে চেয়ারে বসা নিবিষ্টভাবে অধ্যয়নরত ভরত, টেবিলের ওপর জ্বলছে সেজবাতি। সেই দৃশ্য দেখে বাবার জন্য মন কেমন করে ভূমিসূতার। তার বাবাও রাত্রি জেগে পড়াশুনো করতেন, বাবার কাছ থেকে কত কী শিখেছিল সে!
ভোরবেলা ভূমিসূতা যখন বাগানে ফুল তুলতে যায়, তখন সে আর ভরতকে দেখতে পায় না। কলকাতার বাবুদের রোগ ধরেছে তাকে, সে এখন বেশ বেলা করে জাগে। খিদের কামড় তাকে আর জাগায় না, তার খাওয়া-দাওয়ার কোনও সমস্যা নেই। ভৃত্যেরা নির্দিষ্ট সময়ে তার ঘরে খাবার দিয়ে যায়, সেই ভৃত্যদের মাঝে মাঝে দু-এক পয়সা বখসিস দেয় ভরত। এমনকি নিজের পয়সায় সে এখন মাখন-মতিচুর কিনেও খেতে পারে।
সকালবেলায় ভূমিসূতা সম্পূর্ণ স্বাধীন, ইচ্ছেমতন সে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, ফুল তোলে, গুনগুনিয়ে গান গায়। ভাঙা পাচিল মেরামত করা হয়েছে, এখন আর শেয়াল ঢোকে না। তিনতলার ঠাকুরঘর সে প্রতিদিন টাটকা ফুল দিয়ে সাজায়, পুরুতমশাইরা আসেন না ন’টার আগে, তার মধ্যে ভূমিসূতা নিজস্ব পূজা সেরে নেয়। নাচই তার পূজা। দেবদাসী হতে চায়নি ভূমিসূতা, ভয় পেয়েছিল, দেবদাসীদের বন্দিনী জীবন সম্পর্কে অনেক কাহিনী শুনেছিল, কিন্তু তাদের গ্রামে পূজামণ্ডপে সে তো অন্য মেয়েদের সঙ্গে অনেকবার নেচেছে।
একদিন এই ঠাকুরঘরেও একটা বিপত্তি ঘটে গেল।
ব্যবসার ব্যাপারে একটা সঙ্কট চলছিল, সারা রাত ঘুম হয়নি মণিভূষণের। ডায়মন্ড হারবারে একটা জাহাজ ডুবির খবর এসেছে, সেই জাহাজে তাদের কোম্পানির অনেক মালপত্র আসবার কথা। সেগুলি উদ্ধার করা না গেলে বহু টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। সকাল সকাল মণিভূষণ ঠাকুরঘরে চলে এসেছেন মানত করতে।
রাধামাধবের মূর্তি কষ্টিপাথরের, চক্ষুগুলি সোনার এবং মাধবের মুকুট জ্বলজ্বল করছে একটি কমল হীরে। শ্বেতমৰ্মরে বাঁধানো মেঝে, সেখানে খালি পায়ে, তন্ময় হয়ে নৃত্য করছে ভূমিসূতা।
বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন মণিভূষণ। তিনি ঘোর বিষয়ী মানুষ, কোনও রকম শিল্প-সম্ভোগের ধার ধারেন না। ভালো ও মন্দ সম্পর্কে তার পূর্ব নির্দিষ্ট ধারণা আছে, নাচ-টাচ তার কাছে মন্দ ব্যাপার। তবু, শিল্পের একটা অভিঘাত আছে, কখনও কখনও তা নিতান্ত বেরসিককেও স্পর্শ করে। ভোরবেলার নরম আলোয় মিশে আছে পাখির ডাক, পূজা-কক্ষে অনেক রকম ফুলের বর্ণ ও গন্ধ, তার মধ্যে তরঙ্গের মতন দুলছে এক কিশোরী। এমন দৃশ্য মণিভূষণ কখনও দেখেননি, কিছুক্ষণের জন্য টাকা-পয়সার লাভ-ক্ষতির কথাও তিনি বিস্মৃত হলেন। মিলিয়ে গেল তার কপালের ভাঁজ, কুঞ্চিত ভুরু সোজা হল, ওষ্ঠে এল প্ৰসন্নতা।
পুরুষের উপস্থিতির একটা উত্তাপ আছে, নারীরা তা টের পায়। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে মণিভূষণকে দেখতে পেয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি মেঝেতে কপাল ঠুকে প্ৰণাম জানিয়ে সে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মণিভূষণ হাত বাড়িয়ে তাকে আটকালেন। কয়েক পলক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে।
কস্তা ডুবে শাড়ি পরা এই মেয়েটিকে যেন তিনি নতুন করে দেখলেন। পুরীতে রোগা লিকলিকে, পাংশু-মুখ যে বালিকাটিতে উদ্ধার করেছিলেন, তার সঙ্গে এর কত তফাত! এমনকি কাল পর্যন্ত বাড়িতে যাকে ঘরোয়া কাজকর্মে দেখেছেন, সেও যেন অন্য মেয়ে ছিল, আজ সকালে সে নারী হয়ে গেছে। মণিভূষণ আবিষ্কার করলেন এক নারীকে।
তিনি আবিষ্টভাবে বললেন, থামলি কেন? নাচ, আর একটু নাচ, আমি দেখি!
ভূমিসূতা ঘাড় হেঁট করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার পা দুটি অসাড় হয়ে গেছে।
মণিভূষণ এগিয়ে এসে তার একটি হাত নিজের মুঠোয় নিলেন। কোমল, কম্পমান সেই হাত। এই হাত ছাড়তে ইচ্ছে করে না। মণিভূষণ একেবারে গলে যাওয়া কণ্ঠে বললেন, আর নাচবি না? আমাকে দেখাবি না? বড় ভালো লাগছিল।
ভূমিসূতাকে আরও কাছে টানতে গিয়ে মণিভূষণের চৈতন্য ফিরল। ঠাকুর ঘর। রাধামাধব দেখছেন, তাঁদের চোখের মণিভূষণ পাপ করতে যাচ্ছিলেন, সর্বনাশ হয়ে যাবে যে।
হাত সরিয়ে নিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে তিন বললেন, গঙ্গাজলের কমণ্ডুলুটা কোথায় রে?
একটু পরে নীচে নেমে এসে মণিভূষণ একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তাদের শয়নকক্ষের মেঝেতে উথালি-পাথালি হয়ে মাথা ঠুকতে সুহাসিনী চিৎকার করছেন, ওগো, আমার জীবনটা ছারেখারে গেল গো! কী কুক্ষণে ওই ডাইনীটাকে ঘরে জায়গা দিয়েছি! ও সবাইকে শেষ করে দেবে! ওগো, তুমি শখের বাজারে মাগী রেখেছ, আবার বাড়িতেও বেবুশ্যে পুষিবে? আমি তবে কোথায় যাব? আমায় বিষ এনে দাও, আমায় পুড়িয়ে মেরে ফেলো-
মণিভূষণ কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এত তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছল কী করে। ঠাকুরঘরের আশেপাশে অন্য দাস-দাসীরা উকি ঝুঁকি মারছিল? ভূমিসূতা নিজে কিছু নিশ্চয় বলবে না। বলবার মতন তো কিছু ঘটেওনি। মেয়েটা নাচছিল, তিনি একবার তার হাত ধরেছেন মাত্র। কিন্তু সুহাসিনীকে তিনি চেনেন, একবার যখন ওঁর মনে কাটা ফুটেছে, তখন হাজার কৈফিয়তেও তা উপড়ে ফেলা যাবে না।
গলা চড়িয়ে তিনি বললেন, শুধু শুধু আমায় এখন দুষছ, তোমাকে পুরীতেই আমি বলিনি, ও মেয়েকে সঙ্গে এনো না? বাপ-মাকে খেয়েছে, ভাই-বোনদের খেয়েছে, ও তো ডাইনী! তখন তোমার দয়া উথলে উঠল! দুর করে দাও! ওকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দাও! ও আমাকেও পাপের পথে নিয়ে যাচ্ছিল, নেহাত আমার চরিত্রের জোর আছে… ওই ঘর..জ্বালানিকে এই দণ্ডেই গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়াও।