রবির বিবাহের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পাত্রীও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, কথাবার্তা প্রায় পাকা। এক বিশাল ধনী পরিবারের একমাত্র দুহিতা, এই বিবাহে রবি শুধু রাজকন্যাই লাভ করবে না, সেই সঙ্গে পাবে রাজত্ব, সাত লাখ টাকা আয়ের জমিদারি। পাত্রী পক্ষ অবশ্য বাঙালি নয়, দক্ষিণ ভারতীয়, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এই বিবাহে জ্ঞানদানন্দিনীরই বেশি উৎসাহ, স্বামীর সঙ্গে তিনি ভারতের নানা অঞ্চলে গিয়ে থেকেছেন, অন্য ভাষাভাষী মানুষজনের সঙ্গে মিশেছেন অন্তরঙ্গভাবে। তা ছাড়া রবির বিয়ে তো যেমন তেমন মেয়ের সঙ্গে হতে পারে না, এই কন্যাটি ইংরেজি জানে, পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতে পারে।
ঘটকের মুখে কন্যাটির রূপ-গুণের আরও অনেক পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, শুধু এ বাড়ির মহিলাদের একবার দেখে আসাটাই বাকি আছে। বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ তো একটা কবিতাই লিখে ফেললেন রবির আসন্ন বিবাহ উপলক্ষে।
দেবেন্দ্রনাথও রবির বিবাহ-ব্যবস্থা করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন মুসৌরি থেকে। রবির বাইশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, তাকে এখন জমিদারি দেখাশুনোর কিছু দায়িত্ব নিতে হবে, তার আগে সংসারী হওয়া দরকার। সর্বক্ষণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর নতুন বউঠানের ছত্ৰচ্ছায়ায় থাকলে তার নিজস্ব দায়িত্বজ্ঞান হবে কী করে?
জ্ঞানদানন্দিনী একদিন কয়েকজন ননদ-জাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন। পুরুষ সঙ্গী পত্র স্বয়ং। রবি প্রথমে লাজুকতাবশত কিছুতেই আসতে চায়নি, তাকে প্রায় জোর করে ধরে আনলেন জ্ঞানদানন্দিনী।
মাদ্রাজি জমিদারমশাই কলকাতাতে একটি বড় বাড়ি ক্রয় করেছেন। পাত্ৰিপক্ষকে বসানো হল একটি সুসজ্জিত বৈঠকখানায়। সে ঘরে রয়েছেন শুধু কয়েকজন মহিলা ও কিশোরী। মাদ্রাজি মেয়েরা বেশ সপ্রতিভ হয়, বাঙালিদের মেয়ে-দেখার আসরে কন্যাটি গয়না ও পোশাকের পুঁটুলি হয়ে মুখ নিচু করে থাকে, সাতবার এক কথা জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিতে চায় না। এখানে পাত্রী নিজেই ওঁদের অভ্যর্থনা জানাল। তার গায়ের রং চাঁপা ফুলের মতন, মাথা ভর্তি চুল, গভীর টানা চোখ। একটি প্রশস্ত ঘরে জমকালো গালিচা পাতা, তার এক দিকে বসলেন পাত্ৰপক্ষ। অন্যদিকে কয়েকজন অল্পবয়েসী নারী-পুরুষ বসে আছে, এক কোণে একটি পিয়ানো। জ্ঞানদানন্দিনীই ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন মেয়েটির সঙ্গে। একটু পরে সে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাল। তার শিক্ষা অতি উত্তম তো বটেই, উত্তর ভারতের সঙ্গীত রীতির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের কী প্রভেদ, তাও বুঝিয়ে দিতে লাগল সে।
কথা বলতে বলতে রবির দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগলেন জ্ঞানদানন্দিনী। রবির যে পছন্দ হয়ে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও সে নিজে মুখ ফুটে যোগ দিচ্ছে না আলোচনায়।
এক সময় চটি ফটফটিয়ে সেইকক্ষে প্রবেশ করলেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ, তিনিই গৃহকর্তা। নমস্কার বিনিময়ের পর তিনি বললেন, আমার কন্যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তো? ইনি আমার স্ত্রী, আর ওই আমার কন্যা।
ঘরের মধ্যে যেন একটি বজ্ৰপাত হল। এতক্ষণ যার সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল, যাকে এঁরা পাত্রী হিসেবে মনোনীত করে ফেলেছিলেন, সে আসলে ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী! আর দেয়াল ঘেঁষে জড়সড় হয়ে বসে থাকা, অতি সাদামাটা একটি কন্যাই আসলে পাত্রী। হাসি চাপার জন্য দারুণ সংযম দেখাতে হল পাত্ৰপক্ষকে। সৌজন্য রক্ষার জন্য বড় বড় মিষ্টির থালা থেকে মুখে দিতে হল কিছু কিছু, তারপর পরে পাকা কথা জানাব বলে, জ্ঞানদানন্দিনী সদলবলে বেরিয়ে এলেন।
বাড়ি ফিরে সবাই ফেটে পড়লেন হাসিতে। মাদ্রাজি জমিদার মশাইয়ের সর্বগুণান্বিতা স্ত্রীটি সম্ভবত তৃতীয় পক্ষের। বিমাতা ও কন্যা প্রায় সমবয়েসী। রবিকে নিয়ে কৌতুকের আর শেষ রইল না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, আর একটু হলে যে পরস্ত্রীহরণ পালা ঘটতে যাচ্ছিল রে, রবি!
এই সম্বন্ধে ভেঙে যাওয়ায় সবচেয়ে খুশি হলেন বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। তিনি বললেন, বাড়িতে নতুন বউয়ের সঙ্গে সৰ্বক্ষণ ইংরাজিতে কথা বলতে হবে, এই ভয়ে কাটা হয়ে ছিলুম। আমাদের বাঙালি মেয়েরা কি ফ্যালনা যে, রবির বিয়ের, জন্য দক্ষিণ ভারতে ছুটতে হবে?
আবার নতুন করে পাত্রী খোঁজা চলতে লাগল। সদর স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার ফিরে এসেছেন জোড়াসাঁকোয়। বাবামশাই বাড়িতে থাকলে নিজেদের মহলেও গান-বাজনার আসর বা সান্ধ্য-আড্ডা বসাতে বেশ অস্বস্তি হয়। রাত যত বাড়ে, মজলিশ তাত জমে, হাসি ও তর্ক উচ্চগ্রামে ওঠে, তাতে দেবেন্দ্রনাথের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। এখন বাবামশাই মুসৌরিতে রয়েছেন, সহসা ফিরছেন না। কাদম্বরী তাদের তেতলার মহলটি নতুন করে সাজিয়েছেন। বারান্দায় অনেকগুলি ফুলগাছের টব, বসবার ঘরটিতে খসখসের টানা পাখাটি সন্ধেবেলা ভিজিয়ে খানিকটা আতর ছড়িয়ে দেওয়া হয়, বাতাসে ছড়ায় সেই সুগন্ধ। প্রায়ই সন্ধেবেলা কয়েকজন বন্ধু আসে, কবিতা পাঠ ও গানে গানে প্রহর পেরিয়ে যায়। খানা-পিনাও চলে সঙ্গে সঙ্গে।
দিনের বেলা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যস্ত থাকেন। সম্প্রতি তিনি জাহাজের ব্যবসা করার চিন্তায় মেতেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আমোদ-প্রমোদে যতই মত্ত থাকুন, তার মনের মধ্যে একটা স্বাজাত্যাভিমান সব সময় কাজ করে। ইংরেজদের তুলনায় ভারতবর্ষীয় মানুষ কোনও অংশেই হীন নয়। ইংরেজরা অস্ত্রবলে ভারত অধিকার করে আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বুঝেছেন, ইংরেজদের আসল শক্তি তাদের বাণিজ্যিক কূট বুদ্ধিতে। অন্ত্রের শাসন চোখে দেখা যায়, কিন্তু বাণিজ্যের নামে শোষণেই ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে এই দেশ। ভারতীয়দের হাতে অস্ত্র নেই, অস্ত্র ব্যবহারের নৈপুণ্যও তারা ভুলে গেছে, সম্মুখসমরে তারা ইংরেজদের সঙ্গে এঁটে পারবে না। সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার অত বড় সুযোগটাও নষ্ট হয়ে গেল, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সব কিছু। এখন ইংরেজরা বজ্র আঁটুনি দিয়ে রেখেছে। এখন ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যে পাল্লা দেওয়াটাই শক্তি সংগ্রহের একমাত্র উপায়।
পিতামহ দ্বারিকানাথ এক সময় জাহাজের ব্যবসার কথা ভেবেছিলেন। ‘ইন্ডিয়া’ নামে তার একটা জাহাজ সমুদ্রে চলাচল করত। দেবেন্দ্ৰনাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে যাননি। জমিদারি বিস্তারে মন দিয়েছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার জাহাজের ব্যবসা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। একটি জাহাজ নির্মাণ করার কাজ এখন মেতে আছেন তিনি।
রবি সকাল দুপুরে বিশেষ বেরোয় না। বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে সভা সমিতিতে গান করার জন্য তার ডাক পড়ে। কখনও সে পায়ে হেঁটে কিছুটা ঘুরে আসে, কিংবা প্রিয়নাথ সেনের বাড়িতে যায়।
দিনের বেলাটা তার লেখার সময়। ‘ভারতী’ পত্রিকার জন্য অনেক কিছুই তাকে লিখতে হয়, প্ৰবন্ধ, শ্লেষ-রচনা, পুস্তক সমালোচনা। কবিতা ও গান তো আছেই। লেখার বিষয়ের যেন শেষ নেই! একটা লেখা শেষ করতেই অন্য একটা লেখার চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। এবং মাথায় কোনও চিন্তা এলেই রবি সঙ্গে সঙ্গে সেটা লিখে ফেলতে চায়। নইলে নতুন চিন্তা যে জায়গা পাবে না।
তিনতলায় জ্যোতিদাদার ঘরে বসে কিংবা বিছানায় বুকে বালিস দিয়ে শুয়ে সে লেখে। কাদম্বরী ঘোরাফেরা করেন নিঃশব্দে। কখনও পাশে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে যান রবি কী লিখছে। রেকাবি ভরে যুঁই ফুল রেখে যান এক পাশে। নিজের হাতে মোহনভোগ এনে দেন। রবি মাঝে মাঝে মুখ তুলে তাকায়, হাসে। কাদম্বরী ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলেন, উহু, অন্যমনস্ক হতে নেই, মন দিয়ে লেখো। আবার কোনও সময় কাদম্বরী ঝুপ করে পাশে বসে পড়ে বলেন, কী সারা দিন ধরে লিখছ! চোখ ব্যথা করবে যে! আর লিখতে হবে না, এসো গল্প করি। রবির খাতাটা তিনি তুলে নেন বুকে।
একদিন দুপুরে রবি ‘সিন্ধু দূত’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা লিখছে। বিদেশের পটভূমিকায় বর্ণনাবহুল এক কাব্য, তেমন কিছু রস নেই, নেহাত প্রয়োজনের লেখা, রবির ঠিক মন লাগছে না। হঠাৎ কাদম্বরী চলে গেলেন রবির পাশ দিয়ে, তাঁর আঁচলের এক ঝলক বাতাস লাগল।রবির গায়ে। রবি মুখ তুলে চেয়ে রইল একটুক্ষণ। কাদম্বরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বারান্দায়, ফুলের টবগুলোতে নুয়ে নুয়ে দেখতে লাগলেন কী যেন। দুপুর রঙের শাড়ি পরা, পিঠের ওপর ছেয়ে আছে দীর্ঘ কেশভার, নিরাভরণ একটি বাহুতে রোদ পড়ায়, মনে হচ্ছে যেন লেগে আছে অভ্র কুচি।
রবির মাথায় এসে গেল একটি নতুন গান। নীরস লেখাটি সরিয়ে রেখে অন্য একটি কাগজে রবি লিখতে শুরু করলেন, আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মত…
একটু পরে ঘরে এসে কাদম্বরী জিজ্ঞেস করল,আজি কী লিখছ, রবি? রবি বলল, একটুকরো বসন্ত বাতাসের গান। কাদম্বরী অন্যদিনের মতন আজ আর লেখাটা দেখতে চাইলেন না। বসলেন না। রবির পাশে। পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে বললেন, কী মুশকিল কিছুতেই তোমার জন্য পাত্রী ঠিক হচ্ছে না। তোমার তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে হয়ে গেলে বেশ হয়!
রবি বলল, কেন, তোমরা সবাই এত ব্যস্ত কেন?
কাদম্বরী বললেন, বাঃ, বাড়িতে একটা নতুন বউ আসবে, কত মজা হবে! তোমার বউকে আমি মনের মত করে সাজাব, তার সঙ্গে কত গল্প করব। রবি বললেন, অর্থাৎ তাকে নিয়ে তুমি পুতুল খেলবে। তোমার একটি পুতুল চাই?
কাদম্বরী মৃদু বকুনি দিয়ে বললেন, অমন কথা বলছি কেন? একটি বাইরের মেয়ে নিয়ে আসা হবে, তাকে সব শেখাতে-পড়াতে হবে না? তোমার মত কবিবরের যোগ্য করে তুলতে হবে তাকে।
রবি মনে মনে প্ৰমাদ গুনল। কয়েকদিন আগে জ্ঞানদানন্দিনীও এই রকম কথা বলেছেন। তাঁর ইচ্ছে, রবির স্ত্রীকে তিনি প্রথম বেশ কিছুদিন তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে নিজের কাছে রাখবেন। তাকে লোরেটো স্কুলে ভর্তি করে দেবেন, তিনি নিজে সেই অন্য পরিবার থেকে আনা মেয়েটিকে আদব-কায়দা শিখিয়ে ডুর উপযুক্ত করে তুলবেন। সর্বনাশ! সে বেচারি মেয়েটিকে নিয়ে দুই বউঠানের মধ্যে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে? এই নিয়ে দু’জনার মধ্যে না আবার মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।
রবি বললেন, তোমরা এত তাড়াতাড়ি আমার গলায় বিয়ের ফাঁস পরিয়ে বুঝি আনন্দ পেতে চাও।
কাদম্বরী বললেন, তোমাকে আর বেশিদিন আইবুড়ো থাকতে দেওয়া হবে না মশাই! তোমার নতুন দাদা আর একটি পাত্রীর সন্ধান এনেছেন, শুনেছ।” উড়িষ্যার এক রাজার মেয়ে, সত্যিকারের রাজকন্যা।
রবি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না। আমার আর রাজকন্যা টন্যা দরকার নেই! এই প্রসঙ্গটি এড়াবার জন্য রবি হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে উঠে পড়ল লেখা ছেড়ে। কাদম্বরী জিজ্ঞেস করলেন, এ কী, কোথায় চললে? রবি বলল, একবার শ্যামবাজারে যেতে হবে, আজ একটা প্রার্থনা সভা আছে।
কাদম্বরী বললেন, শোনো, শোনো, অত তাড়া করছি কেন, প্রার্থনা সভা তো সন্ধের আগে হয় না। তোমার নতুনদা কাল উড়িষ্যা যাচ্ছেন, তোমাকেও সঙ্গে নেবেন বলেছেন। তোমার পোশাক-পত্ৰ গুছিয়ে দেব?
রবি কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে চেয়ে রইল ওঁর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, নতুন বউঠান, তুমি যখন আপন মনে ঘুরে বেড়াও, তখন তোমাকে যেন ইথিরিয়াল মনে হয়, ধুলো মাটিতে তোমার পা ছোয় না, সেই অবস্থাটাই তোমাকে মানায়। আর তুমি যখন কাজের কথা বল, তখন যেন তোমাকে ঠিক চিনতে পারি না।
কাদম্বরী ভ্ৰভঙ্গি করে বললেন, ইথিরিয়াল মানে কী?
রবি বলল, মানে…স্বর্গীয়, হাওয়া দিয়ে গড়া, তখন তুমি দেবী হেকেটি। কাদম্বরী কয়েক মুহূর্ত শব্দটি নিয়ে ভাবলেন। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, আহা-হা আমার বুঝি রক্ত-মাংসের, সুখ-দুঃখের একটা শরীর নেই?
এ প্রশ্নের উত্তর অতি কঠিন। এমনকি শরীর শব্দটির সঠিক অর্থ কী, তাও এখনও রবির কাছে অস্পষ্ট। রক্ত-মাংসের শরীর তো সব মানুষেরই থাকে, কিন্তু সুখ-দুঃখের শরীর? সুখ-দুঃখ কি মনের ব্যাপার নয়, শরীরেরও সুখ-দুঃখ থাকে।
আর কথা না বাড়িয়ে রবি নিজের ঘরে চলে গেল। পোশাক বদল করে বেরিয়ে পড়ল খানিক বাদে।
নন্দনবাগানের কাশী মিত্তির শ্যামবাজার ব্ৰাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার কুড়ি বৎসর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে আজ উৎসব। আদি সমাজের অনেকেই যাবেন, দেবেন্দ্রনাথের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে রবিকে। যাবার পথে সে স্বর্ণদিদির বাড়ি থেকে জামাইবাবুকে তুলে নিল।
উৎসবের আয়োজন বেশ বড় করেই হয়েছে। গান, প্রার্থনা, ভাষণ, তারপর খাওয়া দাওয়া। রবি প্রথমে দু’খানা গান গেয়ে ছিল। ক্রমেই লোকজন বাড়ছে। একতলার একটি ঘরে বেশ ভিড়। জানকীনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ও ঘরে কী হচ্ছে, রবি? ভেতরে গিয়ে দেখবে নাকি?
পাশ থেকে একজন বলল, দক্ষিণেশ্বরের সাধু, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এসেছেন, উনি ভারি চমৎকার গল্প বলেন।
রবি হঠাৎ ভ্ৰকুঞ্চিত করে চুপ করে রইল। ব্ৰাহ্মদের উৎসবে মূর্তিপূজকদের আনাগোনা কেন? সাধু সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে রবির তেমন আগ্রহ নেই। সে ভেতরে গেল না। জানকীনাথ লোকজনদের ঠেলে ঠুলে ঢুকে পড়লেন।
রবি বাইরে দাড়িয়ে আছে। প্ৰচণ্ড গরমের দিন, সন্ধ্যে পরেও সমুদ্র-বাতাস আসেনি, আকাশ গুমোট থমথমে। এই সময় মানুষে গা ঘেঁষাৰ্ঘেষিতে আরও অসহ্য লাগে।
একজন প্ৰবীণ ব্ৰাহ্ম, রবির কাছে এসে কুশলসংবাদ নিতে লাগলেন। হঠাৎ এক সময় তিনি বললেন, রবীন্দ্র, তুমি দুঃসংবাদটা শুনেছ?
সেই ব্যক্তিটি বললেন, ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন বাঁড়ুজ্যেকে জেলে ভরার আদেশ বেরিয়েছে। আমি দেখে এলাম, বিদ্যেসাগারমশাইয়ের কলেজের সামনে ছাত্ররা খুব দাপাদাপি করছে এই নিয়ে। শহরে একটা হাঙ্গামা না শুরু হয়ে যায়!
আরও কয়েকজন ব্যক্তি কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে কাছাকাছি ঘিরে এল। তারপর শুরু হল উত্তপ্ত আলোচনা।
ঘটনাটি অতি গুরুতর তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রখ্যাত চিকিৎসক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ছাত্র হিসেবে মেধাবী, বি এ পাশ করে বিলেত যান আই সি এস পরীক্ষা দিতে। সামান্য বয়েসের ব্যাপারে খুঁটিনাটির জন্য তিনি পরীক্ষায় পাস করলেও তাঁকে আটকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মামলা করেছিলেন, এবং মামলায় জিতে ইংরেজ সরকারকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে নিয়োগ পত্র দিতে। কিন্তু মামলায় জিতে চাকরি পাওয়া গেলেও নিয়োগকারীর আস্থাভাজন হওয়া যায় না। শ্ৰীহট্টের সহকারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, তাঁর শ্বেতাঙ্গ ওপরওয়ালারা তাকে মোটেই পছন্দ করতেন না, একবার আদালতের কাজে সামান্য ত্রুটি দেখিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করা হল।
এই অবিচারের প্রতিকারের জন্য আবার বিলেত গেলেন সুরেন্দ্রনাথ। এ দেশের ইংরেজরা নানা রকম উদ্ধত ব্যবহার করে বটে, কিন্তু ইংলন্ডের সরকার ন্যায়-নীতির মূল্য দেয়, এই ছিল সকলের ধারণা। কিন্তু সেখানেও সুবিচার পেলেন না সুরেন্দ্রনাথ, তাকে বিমুখ হয়ে ফিরতে হল।
তখন এদেশও সকলে বুঝে গেল যে, সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসকদের বিরাগভাজন। এ দেশের মানুষ কর্তাভজা, সরকার যাকে পছন্দ করে না, তাকে কেউ ছুতে সাহস করে না। সুরেন্দ্রনাথ সরকারি চাকরি আর পাবেন না, দেশীয় ব্যক্তিরাও কেউ তাঁকে কাজ দিতে চায় না। জীবিকা নির্বাহ করাই দুষ্কর হয়ে উঠল তার পক্ষে। সৌভাগ্যের বিষয়, একজন মানুষ এখনও আছেন, যিনি গ্ৰাহ্য করেন না ইংরেজের রাঙা চোখ। মশাই একদিন সুরেন্দ্রনাথকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, সুরো, তুই কাল থেকে আমার কলেজে ইংরেজি পড়াবি। কত মাইনে চাস বল!
মেট্রোপলিটন কলেজটি বিদ্যাসাগর মশাইয়ের নিজের, যথাসর্বস্ব ব্যয় করছেন এই কলেজের জন্য, সরকারি সাহায্যের তোয়াক্কা করেন না তিনি।
আই সিএস সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। কালো সাহেব, অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তিনি বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজের অন্তর্গত হলেন। ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন অবিলম্বে, সূক্ষ্মভাবে প্রচার করতে লাগলেন দেশাত্মবোধ। ইংল্যান্ডে পড়াশুনো করার সময় তিনি জেনেছিলেন, ইওরোপের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন ও লড়াই কী ভাবে পরিচালিত হয়েছে। ইতালিতে ম্যাৎসিনি তরুণদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন, “তরুণ-ইতালি’ পরিণত হয়েছিল একটা বিশেষ শক্তিতে। এখানেও সেই আদর্শ অনুসরণ করা যায়।
অন্য একজন উজ্জ্বল ছাত্র আনন্দমোহন বসু ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম র্যাংলার হয়ে বিলেত থেকে ফিরে স্টডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামে ছাত্র সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন। সুরেন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। সেই স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশানে সুরেন্দ্রনাথ একদিন বক্তৃতা দিলেন, তার বিষয়বস্তু Rise of the Sikh Power। যোদ্ধৃ শিখ জাতি সম্পর্কে বাঙালিরা সামান্যই জানে, স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে যে-টুকু থাকে। ইংরেজ লিখিত সেই ইতিহাসে এই জাতির প্রকৃত বীরত্বের বিবরণ নেই, যে-সব যুদ্ধে শিখরা ইংরেজদের পরাজিত করেছে, তার উল্লেখই থাকে না। সুরেন্দ্রনাথ দেখালেন, এই তরুণ সম্প্রদায় বারবার অত্যাচার ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে প্ৰাণপণে, মোগলদের সঙ্গে লড়েছে, ব্রিটিশদের সঙ্গেও লড়েছে। নিছক শিখদের ইতিহাস বর্ণনা করাই সুরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য নয়, বাংলা ছাত্রদের তিনি বোঝাতে চাইলেন যে, আদর্শের দৃঢ়তা থাকলে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধেও সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া যায়।
সুরেন্দ্রনাথ বেঙ্গলি পত্রিকার সম্পাদক। ইংরেজ শাসকের নানান অব্যবস্থার সমালোচনা করেন তিনি। সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা অদ্ভুত!
নরিস নামে হাইকোর্টের এক বিচারকের মতিগতি বোঝা ভার। উদ্ভট উদ্ভট সব আদেশ জারি করেন। তার এজলাসে এক হিন্দু পরিবারের গৃহদেবতার পুজার অধিকার নিয়ে মামলা চলছিল। দুই শরিকের মধ্যে মামলা। অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, গৃহদেবতার অস্তিত্ব নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তবু নরিস সাহেব হুকুম দিলেন ওই শালগ্রাম শিলা আদালতে এনে তাঁকে দেখতে হবে! আদেশ শুনে সকলে হতবাক। শালগ্রাম শিলা একখণ্ড পাথর হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাসী হিন্দুদের চোখে তা স্বয়ং নারায়ণের পবিত্র প্রতীক। পুরোহিত ছাড়া কেউ স্পর্শ করারও অধিকার নয়। সেই শালগ্রাম শিলা আনা হবে আদালতে? গির্জা থেকে যিশুর মূর্তি কখনও আদালতে আনানো হয়? সাহেবের এ কী স্পর্ধা? কিন্তু হিন্দুদের প্রতিবাদ আগ্রাহ্য করে সেই শালগ্ৰাম শিলা আদালতে আনতে বাধ্য করা হল। নরিশ সাহেব সেদিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের সঙ্গে বললেন, দুঃ, কে বলেছে এটা একশো বছরের পুরনো?
সুরেন্দ্রনাথ তাঁর পত্রিকায় এই ঘটনাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে লিখলেন, ওই বিচারক সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসার অযোগ্য! আদালত অবমাননার অভিযোগে দু’মাসের কারাদণ্ড হল সুরেন্দ্রনাথের। ইংরেজ সরকার নিশ্চুপ।
ইংরেজরা দেশের রাজা, তারা ইচ্ছে মতন প্রজাদের শান্তি দিতে পারে। কিন্তু এই প্রথম প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখানো হল রাজশক্তির বিরুদ্ধে। ছাত্রসমাজ ক্ষেপে গেল, বিভিন্ন স্থানে সভা করে বক্তারা প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। কেউ কেউ আবার ভাবলেন, এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এটা যে এক রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত, তা অনেকের এখনও বোধগম্য হয় না।
সুরেন্দ্রনাথ জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তাঁর সংবর্ধনা সভা হতে লাগল। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলল অবিরাম। ঠাকুর পরিবারের কেউ অবশ্য এ আন্দোলনে অংশ নিলেন না। পত্রিকায় রবি অন্যান্য পত্রপত্রিকার গালাগালির ভাষা নিয়ে খানিকটা বিরূপ মন্তব্যই করে ফেলল।
একদিন প্রিয়নাথ সেন এসে বললেন, এটা তুমি কী করলে রবি? সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা উদ্দীপনা এসেছে, এ সময় তার বিরুদ্ধতা করা কি তোমার উচিত হল?
রবি বলল, প্রতিবাদ জানানো ভালো কথা, কিন্তু ভাষার এমন অসংযম থাকবে কেন? গালাগালি দেবার সময়ও ভদ্রলোক ভাদ্রলোকই থাকে, বানরের মতন মুখ ভেঙচিয়ে দাঁত বার করলে যে, নিজেদেরই অপমান করা হয়।
প্রিয়নাথ বললেন, এখন ওসব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। শোনো, রবি, তুমি একটাও জনসভায় যাওনি। আমার মনে হয়, দু’একটিতে তোমার যোগদান করা উচিত। ফ্রি চার্চ কলেজের ছাত্ররা আমাকে ধরেছিল, ওদের সভায় তোমাকে দিয়ে দু’একখানি গান গাওয়াবার জন্য। আগামীকাল একটা সংবর্ধনা সভা আছে, তুমি যাবে।
রাজি হল রবি, কয়েকটি গানও গেয়েছিল, কিন্তু সভার উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে সে ঠিক উদ্দীপিত হতে পারল না। তার বাংলা গানগুলি যেন এখানে অপ্রাসঙ্গিক। সংবর্ধনার উত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিলেন ইংরেজিতে। অন্যান্যদের বক্তৃতা, সভার কাজ কর্ম সবই চলছে ইংরেজিতে। অবিকল ইংরেজদের সভার অনুকরণ। অথচ শ্রোতারা প্রায় সবাই বাঙালি। তবু বাংলায় বক্তৃতা দিলে মান থাকে না।
এই আন্দোলন টিকিয়ে রাখা ও দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার জন্য চাঁদা তোলা হচ্ছে। তাঁর নাম দেয়া হয়েছে “ন্যাশনাল ফান্ড”। ঠিক যেমন ইংরেজদের ‘ওয়ার ফান্ড’ কিংবা ‘ফ্যামিলি ফান্ড” হয়। “জাতীয় ভাণ্ডার’ কিংবা ‘জাতীয় তহবিল” বললে বুঝত না কেউ। এখানেও চাঁদা তোলা হচ্ছে, এখন ঘোষণা করছে, প্লিজ কনট্রিবিউট অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান ফর দা ন্যাশনাল ফান্ড । উই উইল রেইজ আওয়ার ভয়েস…
রবি ভাবল, মাতৃভাষার ব্যবহার যারা সম্মানজনক মনে করে না, তাদের দাস মনোভাব কি কোনওদিনও দূর হতে পারে?