শীতের ফিনফিনে বাতাস বইছে, আকাশে মেঘ নেই, কিন্তু নদীর ওপর দুলছে পাতলা কুয়াশা। স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গায়ে একটি চমৎকার নকশা করা কাশ্মিরি শাল জড়ানো। তিনি সদ্য বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন, তার চোখে এখনও ঘুমের আবেশ। কীর্তনখোলা নদীর ওপর পাল তুলে চলেছে অনেক নৌকো, অধিকাংশই ধানে বোঝাই। এ জেলার জমি খুবই উর্বর, সোনার শস্য ফলে, এ বছর ফলন খুবই ভালো।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে-স্টিমারটিতে দাড়িয়ে আছেন, এর নাম “বঙ্গলক্ষ্মী”, এটি ছাড়বে দুপুর একটার সময়, এখন একেবারে খালি। বন্দর থেকে খানিকটা দূরে নোঙর করে রয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে নদীর বুকে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ভো বাজাতে বাজাতে আসছে তার আর স্টিমার, “স্বদেশী”, সেটি যাত্রীতে একেবারে টইটম্বুর বোঝাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তৃপ্তির সঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর স্টিমারগুলির মধ্যে ‘স্বদেশী’-ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী, এর মধ্যে একবারও বিগড়োয়নি, সে বিলিতি কোম্পানির জাহাজগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যায়। ‘স্বদেশী’র জয়যাত্রা অব্যাহত।
বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকোগুলো মোচার খোলার মতন দুলছে। একটি ছোট ডিঙ্গি নৌকো ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র কাছে এসে ভিড়ল, মালকোছা মারা ধুতি ও কালো রঙের চায়না কোট পরা এক বাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার জ্যোতিবাবুমশাই, একবার ওপরে আসতে পারি কি?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যক্তিটিকে চিনতে পারলেন না। সকালবেলাতেই অপরিচিত কোনও লোকের সঙ্গে সময় ব্যয় করা তাঁর পছন্দ নয়, আবার কোনও দর্শনার্থীকে ফিরিয়ে দিতেও তার ভদ্রতায় বাধে।
এই স্টিমারের তিনতলায় একটি মাত্র ক্যাবিন, এখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একা থাকেন। ডেকের ওপরে কয়েকটি চেয়ার ছড়ানো। কালো কোট পরা লোকটি ওপরে এসে বলল, গুড মর্নিং, গুড মর্নিং, এ সময়ে এসে আপনার ব্যাঘাত ঘটালাম না তো?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লোকটিকে একটি চেয়ারে বসার অনুরোধ জানিয়ে নিজে বসলেন একটু দূরে। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি চা-পান করবেন কী?
লোকটি বলল, অবশ্যই। চায়ে আমার কখনও অরুচি নেই। দিনে অন্তত বিশ কাপ চা খাই। অধমের নাম অভয়চরণ ঘোষ, আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি একজন সামান্য জুনিয়ার উকিল, তবে আমার সিনিয়ারকে অবশ্যই চিনবেন, তিনি হচ্ছেন প্যারীমোহন মুখুজ্যে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভুরু দুটি ঈষৎ কুঞ্চিত ছিল, এবার সোজা হল। লোকটির ব্যবহারের মধ্যে খানিকটা ঔদ্ধত্যের ভাব আছে, এবার বোঝা গেল, উকিল, সেইজন্য। কিন্তু সকালবেলা একজন উকিল তাঁর কাছে আসবে কী জন্য!
তিনি বললেন, প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে বিলক্ষণ চিনি, উত্তরপাড়ার রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে তো? তিনি কৃতবিদ্য, স্বনামধন্য ব্যক্তি, হঠাৎ আমাকে স্মরণ করেছেন কেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে অভয়চরণ বলল, আমি আপনাকে আগে দু-একবার দেখেছি। সোনার মতন বর্ণ ছিল আপনার শুনেছি, কলকাতায় যান না একেবারেই, এত ধকল কি আপনার সইবে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুকনো গলায় বললেন, ব্যবসা চালাতে গেলে নিজেকেই দেখতে হয়। জাহাজে বসবাস করতেই আমার এখন ভালো লাগে।
অভয়চরণ বলল, কতদিন এই ব্যবসা চালাবেন?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিরক্তভাবে বললেন, তার মানে? আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন চলবে। ব্যবসা আরও বৃদ্ধি পাবে, আরও জাহাজ কিনে বিভিন্ন লাইনেও চালাব।
অভয়চরণ বলল, পারবেন কি? আপনারা জমিদারি চালাতে অভ্যস্ত। বঙ্গসন্তানরা ব্যবসা চালাতে শিখল কবে? ব্যবসায়ে অনেক হ্যাপা, জমিদারির মতন আরাম তো তাতে নেই। বাড়ি ঘর ছেড়ে আপনিই বা এখানে কত দিন পড়ে!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবার ধৈর্য হারিয়ে রূঢ়ভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অভয়চরণ আবার বলল, আমার সব কথাটা আগে শুনে নিন, জ্যোতিবাবু। আমাদের ল ফার্ম-এর মক্কেল হচ্ছে ফ্লোটিলা কোম্পানি। সেই মক্কেলের কাছ থেকে আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আপনার এই সব জাহাজপত্তর, অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি, মায় অফিস ঘরের চেয়ার টেবিল পর্যন্ত সব কিছুই আমাদের মক্কেল কোম্পানি কিনে নিতে রাজি আছে। ন্যায্য দামই দেবে। যদি চান, দামের ব্যাপারে দুএক দিনের মধ্যেই সাহেবদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হতে পারে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে উকিলবাবুটির দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। যতই রাগ হোক, তবু শালীনতা বজায় রাখা তাঁদের বংশের রীতি। যদিও তাঁর বলতে ইচ্ছে করছিল, দূর হয়ে যাও, এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও, কিন্তু কণ্ঠস্বর সংযত করে ধীরভাবে তিনি বললেন, এ রকম অযাচিত প্রস্তাবের মর্ম আমি বুঝতে পারছি না। কোনও বামনের হঠাৎ চাঁদ কেনার ইচ্ছে হতে পারে, মানুষের ইচ্ছেকে কেউ বাধা দিতে পারে না, কিন্তু আকাশের যিনি মালিক তিনি চাঁদটা বিক্রি করে দেবার জন্য ব্যস্ত না-ও হতে পারেন। আপনার মক্কেলকে জানাবেন, বিক্রি করে দেবার জন্য এই জাহাজগুলি আমি কিনিনি। নমস্কার।
অভয়চরণ মুচকি হেসে বলল, আপনি চা খাওয়াবেন বলেছেন, সুতরাং আমি আরও কিছুক্ষণ বসতে পারি। চা না খেয়ে উঠছি না। এই অবসরে আর একটি প্রশ্ন করি। আপনার যদি লাভ না-হয়, দিনের পর দিন লোকসান দিয়েও আপনি ব্যবসা চালাবেন?
জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ বললেন, আমার লাভ-লোকসান নিয়ে অন্য কারুর মাথা না-ঘামালেও চলবে।
অভয়চরণ বলল, আপনার ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করা অশিষ্টতা তা আমি জানি, কিন্তু ব্যবসার ব্যাপারে প্রতিপক্ষ তো সবরকম খোঁজখবর নেবেই। এই জাহাজের ব্যবসায়ে আপনার আয়-ব্যয়ের খুঁটিনাটি পর্যন্ত আমরা জানি। এখন আপনার তেমন কিছু লাভ না হলেও ক্ষতির পরিমাণ তেমন কিছু বেশি নয়। এ ভাবেও আপনি বেশিদিন চালাতে পারবেন না। সামনের সপ্তাহ থেকে আপনার যাত্রীর সংখ্যা কমতে থাকবে। ফ্লোটিলা কোম্পানি যাত্রী ভাড়া দু পয়সা কমিয়ে দেবে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, সে কি? ওরা স্বেচ্ছায় ক্ষতি স্বীকার করবে? এখন যা ভাড়া, তাতে জাহাজ পুরোপুরি ভর্তি না হলে ঠিক খরচ ওঠে না, তা সত্ত্বেও ওরা লোকসান দেবে? অভয়চরণ বলল, ওদের বড় কোম্পানি। অনেক দেশে ওদের স্টিমার চলে। ইংলন্ডে, আফ্রিকায়, ইন্ডিয়ায়। দু-এক লাখ টাকা ক্ষতি হলেও ওদের গায়ে লাগবে না। এক জায়গার লাভ নিয়ে অন্য জায়গায় ক্ষতি পুষিয়ে নেবে। এই সব বিলিতি কোম্পানির কায়দাই হচ্ছে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রতিযোগীদের হঠিয়ে দেওয়া। এখানে আপনি ওদের পথের কাটা। আপনাকে সরাতে পারলেই ওরা একচেটিয়া ব্যবসা করবে, তখন ইচ্ছেমতন ভাড়া বাড়াবে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ওরা হঠিয়ে দিতে চাইলেই আমি হঠে যাব? হেরে যাবার জন্য আমি ব্যবসায় নামিনি।
অভয়চরণ বললেন, দেখুন জ্যোতিবাবু, আপনারা উচ্চমার্গের মানুষ। আপনার সব কিছুই দেখেন একটা ভাবের চশমা দিয়ে। আমরা সাধারণ লোক, এ দেশের মানুষদের খুব ভালো মতনই চিনি। টিকিটের দামের দু পয়সা তফাত হলে লোকে আপনার জাহাজ ফেলে ফ্লোটিলার জাহাজের দিকে ছুটে যাবে। মশাই, দু পয়সার জন্য এ দেশের মানুষ কী-ই না করতে পারে। হাট-বাজারের দু পয়সার জন্য লাঠালাঠি হয়। দু পয়সা বাঁচাবার লোভ লোকে সামলাতে পারবে না। সেই জন্যই আমি প্রস্তাবটা এনেছিলাম, যাতে আপনার বেশি ক্ষতি না হয়। আপনি সসম্মানে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একদৃষ্টিতে অভয়চরণের দিকে চেয়ে রইলেন। রাগের বদলে তাঁর দুঃখবোধ হল। এরা তাকে ভাবে কী? তিনি কলকাতার আরামের জীবন ছেড়ে, গান-বাজনা, থিয়েটার, নটী-নটীদের সংসর্গ, সব রকম আমোদ-প্ৰমোদ ছেড়ে মাসের পর মাস এত কষ্ট করে আনে পড়ে আছেন, তা কি এমনি এমনি? শুধু নিজের লাভ বা স্বার্থসিদ্ধিই নয়, তাঁর জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জাতীয় সম্মানের প্রশ্নও জড়িত।
ললাটের দেখা মুছে গেল, প্ৰবল আত্মাভিমানের সঙ্গে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, আমি গজদন্তমিনারে বসে ব্যবসা চালাতে আসিনি। প্রতিদিন সাধারণ মানুষদের সঙ্গে আমি সমানভাবে মিশি। মানুষের প্রতি আমি বিশ্বাস হারাতে পারি না, বরং বিশ্বাস আমার দৃঢ় হয়েছে। পরাধীন জাতি হলেও আমাদের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে যায়নি, ইংরেজদের জাহাজে না উঠে তারা দিশি কোম্পানিকেই বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে।
অভয়চরণ বলল, দেখুন, আমিও তো বাঙালি। আপনার জয় হলে আমারও গর্ব হবে। কিন্তু ইংরেজরা ধুরন্ধর বেনিয়ার জাত। আগামী পাঁচ বছরের হিসেব করে ওরা ব্যবসায় নামে। ওদের সঙ্গে এঁটে ওঠা বড় শক্ত, বুঝলেন, বড় শক্ত।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিশ্বাস অমূলক নয়। এই ক’মাসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভাবনীয় সহযোগিতা পেয়ে তিনি অভিভূত। বরিশালের ছাত্ররা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিয়মিত তাঁর হয়ে প্রচার চালাচ্ছে। গান বাঁধা হয়েছে তাঁর জাহাজগুলির নাম নিয়ে। বারো-তেরো বছরের কিশোররা পর্যন্ত হাঁটুজল পর্যন্ত নেমে চিৎকার করে, স্বদেশি জাহাজ, স্বদেশি জাহাজ, আমাদের নিজস্ব জাহাজ, কেউ অন্য জাহাজে যাবেন না! আবার জাহাজ যখন দূর থেকে এসে বন্দরে ভেড়ে, তখন দলে দলে লোক ছুটে আসে তা দেখার জন্য। এই আবেগের টান ছাড়াও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জাহাজগুলিতে যাত্রীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছেন বিলিতি কোম্পানিরই সমান।
সত্যি ফ্লোটিলা কোম্পানির জাহাজ দু পয়সা ভাড়া কমিয়ে দিল। প্রথম কয়েকদিনে তার প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজে যথারীতি প্রচুর যাত্রী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাবলেন, তাঁর বিশ্বাসই জয়ী হয়েছে। দিন সাতেক বাদে দেখা গেল, বরিশাল থেকে তাঁর জাহাজগুলি যাত্রী বোঝাই হয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু খুলনা থেকে ফেরার সময় তাতে যাত্রী সংখ্যা যথেষ্ট কম। বরিশালের ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকদের সামনে অনেকে চক্ষুলজ্জায় দিশি কোম্পানিতে যায়, ফেরার সময় দু পয়সা বাঁচাবার জন্য তারা বিলিতি কোম্পানিতে চাপে। ক্ৰমে চক্ষুলজ্জাও ঘুচে গেল, গরিব মানুষের দল স্বদেশি জাহাজের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ দৌড়ে চলে যায় বিলিতি জাহাজের দিকে।
এক মাসের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যবসা বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। যাত্রীতে টইটম্বুর হয়ে চলে যায় ফ্লোটিলা কোম্পানির জাহাজ, এদিকে স্বদেশি কোম্পানির কর্মচারিরা চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করলেও সিকি পরিমাণ যাত্রীও মেলে না। একদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিমর্ষ মুখে বসে আছেন অফিসঘরে, তাঁর ম্যানেজারবাবু এসে বলল, সার, আর তো চলে না। এবার আমাদেরও দু পয়সা ভাড়া কমাতেই হয়।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দপ করে যেন জ্বলে উঠলেন। টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মেরে তেজের সঙ্গে বলে উঠলেন, দু পয়সা কেন, আমি চার পয়সা কমাব। আজই নোটিস লটকিয়ে দিন! দেখি, ওরা কী করে যাত্রী টানতে পারে। এরপর শুরু হয়ে গেল এমন এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা, যা ভূ-ভারতে কেউ কোথাও দেখেনি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বেশি ভাড়া কমিয়ে দিতেই যাত্রীদের ঢেউ আবার চলে এল স্বদেশি কোম্পানির দিকে। ফ্লোটিলার জাহাজ খালি। কয়েকদিন পর ফ্লোটিলা আরও দু পয়সা কমাল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার কমালেন চার পয়সা। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের আম, কলা ও সন্দেশ খাওয়ানো হতে লাগল। লাভ-ক্ষতির প্রশ্নই আর নেই, এখন শুধু জেদ। ভাড়া যত কমতে থাকে, উপহারের পরিমাণ ততই বাড়ে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গাঁঠরি গাঁঠরি ধুতি-লুঙ্গি-শাড়ি কিনে বিলোতে লাগলেন যাত্রীদের মধ্যে। যাত্রীদের তো দুশো মজা! বরিশাল-খুলনায় এমন সুদিন আগে কখনও আসেনি। মাত্র চার আনার টিকিট কেটে জাহাজে উঠলেই একখানা কাপড় পাওয়া যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নজর উঁচু, তিনি বাজে কাপড় মানুষকে দিতে পারেন না। লোকের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন থাক বা না থাক অতি শাস্তায় জাহাজ ভ্ৰমণ ও উপহার লাভের জন্য দারুণ হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, ভিড় সামলাবার জন্য রক্ষী নিয়োগ করতে হল।
এই প্রবল উত্তেজনার মধ্যে এল এক দারুণ দুঃসংবাদ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী’ জাহাজটি কলকাতা যাবার পথে ঝড়ের মুখে পড়েছিল, প্রায় কলকাতার কাছে পৌঁছে কিছুতে ধাক্কা লেগে সেটি ডুবে গেছে। জাহাজে যাত্রী ছিল না, মালপত্র বোঝাই ছিল, সারেং ও খালাসিরা কোনও ক্রমে বেঁচে গেলেও মালপত্র কিছুই উদ্ধার করা যায়নি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ‘স্বদেশী’ জাহাজের সলিল সমাধির সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশি জাহাজ কোম্পানিরও ভরাডুবি হয়ে গেল। জাহাজখানা তো গেছেই, এখন ওইসব মালপত্রের জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বহু টাকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজের যথাসর্বস্ব এবং আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যথেচ্ছ ধার করে এই ব্যবসা চালাচ্ছিলেন, এখন তিনি সর্বস্বান্ত হলেন।
এবারে স্বয়ং প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় দেখা করলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে। তিনি হাইকোর্টের প্রখ্যাত উকিল। তিনি জানালেন যে, ফ্লোটিলা কোম্পানি এখনও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাকি জাহাজগুলো কিনে নিতে রাজি আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যাতে উপযুক্ত মূল্য পান, প্যারীমোহন তা দেখবেন। এবারে আর প্রত্যাখ্যান করার মতন কোনও তেজ নেই, সব কিছু বেচে দিয়ে আহত, পরাজিত যোদ্ধার মতন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফিরে এলেন কলকাতায়।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে না গিয়ে সোজা এসে উঠলেন মেজবউঠানের কাছে। এক সময় এ বাড়িতে আসতেন কন্দৰ্পকান্তি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পোশাকের কত বাহার, সমস্ত শরীর সুবাসিত, বৈদগ্ধ্য, ও কৌতুকমণ্ডিত মুখ। আজ তিনি এলেন সামান্য পোশাক পরে, অতি ব্যবহৃত ধুতি ও পিরান, মলিন মুখমণ্ডল, কোটরগত চক্ষু, মুখে ভাষা নেই। জ্ঞানদানন্দিনী সমস্ত সংবাদই জেনেছেন, কিছু প্রশ্ন করলেন না, দেবরের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসালেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেই যে স্তব্ধ হলেন, আর কোনও কথাই বলতে চান না। কারুর সঙ্গে। দিনের পর দিন ঘরের দরজার বন্ধ করে রাখেন, ডাকাডাকি করলেও বেরুতে চান না। সুরি আর বিবি মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে পায়, তাদের কাকামশাই দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। দাড়ি কামান না, স্নান করেন না, পোশাক বদলান না।
এতদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাজের নেশায় মগ্ন হয়েছিলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জাহাজের ব্যবসার চিন্তায় কেটে যেত, যে-সব কাজ স্বয়ং পরিদর্শন না করলেও চলত, তা নিয়েও মাথা ঘামাতেন তিনি। এখন যে-ই এক প্রবল শূন্যতার সৃষ্টি হল, অমনি ফিরে এল কাদম্বরীর আত্মহত্যাজনিত গ্লানিবোধ। এই প্রথম যেন তিনি সত্যিকারের উপলব্ধি করলেন যে কাদম্বরী নেই। সে অভিমানভরে আপনি প্রাণঘাতিনী হয়েছে। সে জন্য কে দায়ী? তিনি? জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বারবার মনে পড়ে কয়েক বছর আগেকার কথা। সেই মোরানাসাহেবের বাগানবাড়ি, দাৰ্জিলিং-এর দিনগুলি, এত কোমল, এত সংবেদনশীল, এত সূক্ষ্ম রুচিসম্পন্না, এত সেবাপরায়ণা, রূপ-গুণের এমন চমৎকার সম্মিলন হয়েছিল যে-নারীর মধ্যে, সে ছেড়ে চলে গেল? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ধরেই নিয়েছিলেন সে বরাবর একই রকম থাকবে, এই ধরে নেওয়াটাই চরম ভুল। আর কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা হবে না? মৃত্যুর পর মানুষ কি একেবারেই হারিয়ে যায়?
মানুষের চিন্তা কখনও পুরোপুরি একমুখী হতে পারে না। কাদম্বরীর কথা ভেবে ভেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেমন অনুতাপে দগ্ধ হন, তেমনি হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, তাঁর অতি সাধের জাহাজগুলি এখন ফ্লোটিলা কোম্পানির নামে চলাচল করছে। ওরা জাহাজগুলির নাম বদলে দিয়েছে, তিনি নিজের থাকার জন্য ওপরের ডেকের যে ক্যাবিন সাজিয়েছিলেন, সেখানে থাকছে কোনও ইংরেজ। ওরা তাঁকে হারিয়ে দিল! তিনি চেষ্টা বা পরিশ্রমের কোনও ক্রটি করেননি, তবু হার মেনে নিতে হল!
নিজের ক্ষোভ ও গ্লানি নিয়ে ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকতে চাইলেও বেশিদিন তা সম্ভব হলো না। ক্রমেই এই বাড়িতে এসে তাগাদা দিতে লাগল পাওনাদারেরা। ফ্লোটিলা কোম্পানির কাছ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে-টাকা পেয়েছিলেন, তাতেও ধার তো শোধ হয়নি, আরও অনেক বাকি পড়ে আছে। কোথায় যে কত ধার, কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেই সব জানতেন না। বিশেষ করে শেষ দিকে, যখন ভাড়া কমিয়ে, উপহার বিলিয়ে তিনি যাত্রী টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সময় তার কর্মচারিরাও দু হাতে চুরি করেছে। কর্মচারিরাও বুঝেছিল, এ কোম্পানি লাটে উঠতে আর বিশেষ দেরি নেই, তখন তারাও যে-কোনও উপায়ে আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সব টাকাই দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাতে অন্য পাওনাদাররা ছাড়বে কেন? তাদের কিছুতেই সামলানো যায় না।
জ্ঞানদানন্দিনী ভয় পেয়ে গেলেন অন্য কারণে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যবহার দিন দিন কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, চক্ষুদুটি উদভ্ৰান্ত, এক দৃষ্টিতে কারুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু কিছুই দেখেন না। মানুষটা শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবে নাকি? ঠাকুরবাড়িতে পাগলামির ধারা আছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি ভাইয়ের মস্তিষ্ক সুস্থ নয়। সত্যেন্দ্রনাথ এখানে নেই, পিতা দেবেন্দ্রনাথকে কিছু জানানো হয়নি, জ্ঞানদানন্দিনী কার কাছে পরামর্শ নেবেন? রবি ছেলেমানুষ, সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁর মন ফেরাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তখন জ্ঞানদানন্দিনী শরণাপন্ন হলেন পারিবারিক বন্ধু তারকনাথ পালিতের। তারকনাথ সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী, বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসে তিনি এখন অর্থ উপার্জন করছেন, দান-ধ্যানও করেন প্রচুর। তারকনাথ জ্যোতিকে আপনি ছোটভাইয়ের মতন ভালোবাসেন, কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সব শুনে তিনি ছুটে এলেন। সমস্ত পাওনাদারদের একসাথে জড়ো করলেন তিনি, হিসেবনিকেশ করে প্রত্যেকের দেনা আন্তে আস্তে শোধ করে দেবার যুক্তি হল, জামিন রইলেন তিনি নিজে এবং বেশ কিছু টাকা তিনি তখনই দিয়ে দিলেন।
পাওনাদারদের সমস্যা মিটল বটে, তবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনের অবসাদ কাটে না। বাড়ি থেকে বেরুতে চান না, গান-বাজনার কথা যেন ভুলেই গেছেন, কেউ কোনও প্রশ্ন করলে দুটো-একটা উত্তর দেন, নিজে থেকে কোনও কথাই বলেন না। এমনভাবে কি একজন মানুষ বাঁচতে পারে আগেকার প্রাণবন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে যারা দেখেছে, তাদের এখন কষ্টে বুক ফেটে যায়।
তারকনাথ পালিত নিয়মিত খোঁজখবর নেন। তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই অবস্থা দেখে একদিন বললেন, জ্যোতির এখন পরিবেশ পালটানো দরকার। কোথাও সে বেড়াতে যাক, পাহাড়ে বা সমুদ্রে, অথবা কিছুদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে থাকুক, সেখানে অনেক লোকজন, সেখানে তার মতি ফিরতে পারে।
অনেক পেড়াপিড়িতেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাইরে কোথাও যেতে রাজি হলেন না, তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পৈতৃক ভদ্রাসনে। তিনতলায় তাঁর মহলটা এখনও খালি পড়ে আছে, কেউ এখানে আসে না। এ বাড়িতে এখনও মৃত্যুর ছায়া। কাদম্বরীর আত্মহত্যার কিছুদিন পরেই দেবেন্দ্রনাথের আর-একটি কৃতী সন্তান হেমেন্দ্রনাথ মারা যান। হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যায়ামবীর, মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই হতবাক। হেমেন্দ্রনাথের তিনটি পুত্র ও আটটি কন্যা। তাঁর মৃত্যুশোকে কাদম্বরীর কথা চাপা পড়ে গেছে। তা ছাড়া কাদম্বরীর আত্মহত্যার ঘটনাটা গোপন করা হয়েছে বলেই তাঁর কথা আর কেউ প্রকাশ্যে আলোচনা করে না।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একা এসে বসলেন নিজের শয়নকক্ষে। দুপুরবেলা, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বসে রইলেন তো বসেই রইলেন এভাবে, চেয়ে আছেন বড় আলমারিটির দিকে। দরজার সঙ্গে যে আয়নাটি ছিল, সেটা আর নেই। কিন্তু আলমারির আয়নাটা এখনও অক্ষত আছে। এমন কতদিন হয়েছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই পালঙ্কে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে লেখাপড়া করেছেন, কাদম্বরী ঘোরাফেরা করেছেন ঘরের মধ্যে মাঝে মাঝে এসে এই আলমারি খুলেছেন, চাবির শব্দ পেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুখ তুলে স্ত্রীকে শুনিয়েছেন সদ্য রচিত কয়েকটি লাইন। কাদম্বরীর মতামতের মূল্য দিতেন তিনি। শেষের দিকে বেশ কিছুদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিছু লেখেননি, লেখা থেকে তাঁর মন চলে গিয়েছিল, রবিই তার লেখা শোনাত কাদম্বরীকে। কাদম্বরীর মন্তব্য শুনে রবি তার অনেক কবিতার লাইন বদল করেছে। বিহারীলাল চক্রবর্তী এসে বসতেন। ওই বারান্দায়, তাঁর সঙ্গে রবির তুলনা করে কতরকম মেতে উঠতেন কাদম্বরী। বিহারীলালের জন্য কাদম্বরী সেই যে একখানা আসন বুনে দিলেন, সেটি পেয়ে ভদ্রলোক কী খুশি! এই তো, এই ঘরের মধ্যেই স্বর্ণকুমারীর একটি মেয়েকে নিয়ে কাদম্বরী কতদিন ছেলেমানুষের মতন খেলা করেছেন।
আলমারির আয়নাটার পাশে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন কাদম্বরীকে। নীলাম্বরী শাড়িখানা পরা, চুল খোলা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মস্তিষ্ক এখন দুর্বল, তবু তিনি বুঝতে পারছেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রেতমূর্তি দেখছেন না, এমনকি কোনও ছায়া নয়, এ কাদম্বরী তাঁর মনের প্রতিচ্ছবি। ঠিক এইভাবে কাদম্বরীকে তিনি ওইখানে দাঁড়াতে দেখেছেন। এও সেই দেখা। তাই জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ ওই ছবিকে সম্বোধন করে কোনও কথা বলছেন না। শুধু চেয়ে আছেন। কিন্তু তাঁর বুকের মধ্যে বড় বড় ঢেউ আন্দোলিত হচ্ছে। তিনি দেখছেন, কাদম্বরীর মুখখানা অসম্ভব বিষণ্ণ, যেন এক বিষাদের প্রতিমূর্তি। ক্রোধ নেই, অভিযোগ নেই, শুধু দুঃখ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাবলেন, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, তিনি ওকে, দুঃখ দিয়েছেন। সুখের দিনও কি ছিল না? কাদম্বরীর রঙ্গিণী মুখ, হাস্যময়ী মুখ, আবদার-ভরা মুখ, গান তোলা মুখচ্ছবি সেসব গেল কোথায়! জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেন নিজের মনের কাছে মাথা খুঁড়ছেন, কিন্তু কিছুতেই এই বিষাদমাখা মুখ ছাড়া অন্য কোনও মুখ মনে করতে পারছেন না। আর সব ছবি মুছে গোল কী করে? এর পর বাকি জীবন তিনি কাদম্বরীর শুধু এই মুখটাই দেখতে পাবেন, আর সব মিথ্যে হয়ে গেছে? এটাই কি কাদম্বরীর প্রতিশোধ?
খাট থেকে নেমে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগলেন, না, না, না, আমি আর কোনও দিন, জীবনে আর কখনও এখানে আসব না। আমি এখানে থাকতে পারব না!