1 of 2

৩৭. দত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র নরেন্দ্র

দত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র নরেন্দ্র। পিতৃবিয়োগের পর তার কাঁধেই সংসার চালাবার সব দায়িত্ব এসে পড়েছে। নরেন্দ্র লেখাপড়া শিখেছে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অসীম জ্ঞানভাণ্ডারের দ্বার তার কাছে উন্মুক্ত। সঙ্গীতের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ। সে জীবনের মর্ম সন্ধান করতে চায়। সাধারণ মানুষের মতন চাকরি-বাকরি ও গৃহের গঞ্জির মধ্যে আবদ্ধ থেকে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতন মানসিকতা তার তৈরিই হয়নি। সে বুদ্ধির জগতের পরিব্রাজক, বুদ্ধি থেকে জ্ঞান, তার থেকেও উপলব্ধিতে পৌছতে চায়! টাকা-পয়সার মতন সামান্য বিষয় নিয়ে তাকে এখন সৰ্বক্ষণ ব্যাপৃত থাকতে হবে?

এই সচ্ছল, সমৃদ্ধ, বিলাসী সংসারটি আসলে তাসের সংসার। বিশ্বনাথ দত্ত জীবিত অবস্থায় বুঝতেই দেননি যে এসংসারের অবস্থা ভেতরে ভেতরে এতখানি অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেছে। অথচ এতদিন পর্যন্ত বিলাসিতার কোনও ঘাটতি ছিল না, বিশ্বনাথ প্রায়ই বন্ধুবান্ধবদের ডেকে পান-ভোজন করাতেন, স্ত্রী-পুত্র-সন্তানদের বসন-ভূষণ ও শিক্ষার ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি, অথচ সবই চলছিল ঋণের ওপর। তিনি উপার্জন করতেন যথেষ্ট, ব্যয় করতেন আরও। এক বন্ধু তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাঁকে প্রতারিত করেছে, অ্যাটর্নি ফার্মটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি যে চোখ বুজতে হবে তা কল্পনাই করেননি, ভেবেছিলেন আবার পরিশ্রম করে সব সামলে দেবেন, সেইজন্যই স্ত্রী কিংবা জ্যেষ্ঠপুত্রকে জানাননি কিছু।

কয়েক মাস আগেও অর্থ-উপার্জনের ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্বই দিত না নরেন্দ্র। নিজস্ব চুরুট-নাস্যির জন্য সামান্য পয়সা ছাড়া তাঁর প্রয়োজন ছিল খুবই কম। বেশভূষায় চাকচিক্যের দিকে তাঁর কোনোদিনই আগ্রহ নেই, পায়ে হেঁটে ঘুরতেই সে অভ্যস্ত, সারা দিনে দশ-বারো মাইল সে অনায়াসে হাঁটতে পারে। পিতার কাছ থেকে সে যথেষ্ট হাত-খরচ পেত। বি এ পাস করার পর একটা কিছু করতে হবে ঠিকই, সে জন্যে অ্যাটর্নি অফিসে শিক্ষানবিসি শুরু করেছিল বটে, কিন্তু তাতেও খুব একটা মন ছিল না।

কিন্তু এখন যে মাথায় একেবারে আকাশ ভেঙে পড়ার মতন অবস্থা। সঞ্চয় তো কিছুই নেই, বরং শুরু হয়ে গেছে পাওনাদারদের তাড়না। মা ও ছোট ছোট ভাইবোনদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করাটাই সমূহ সমস্যা। বাবার এক কাকা মামলা করে আগেই বসতবাড়ি-ছাড়া করেছেন, এখন থাকতে হয় ভাড়া বাড়িতে, সেই ভাড়ার টাকা আসবে কোথা থেকে, প্রতিদিনের বাজার খরচ জোগাবে কে?

একটা চাকরি পাওয়া যে এত শক্ত, তাও ধারণা ছিল না নরেন্দ্রর। ইংরেজ সরকার শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা করেছে, দিকে দিকে কুল-কলেজ খোলা হচ্ছে, কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থা তো কেরানি উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়ে গেছে, এখন বিভিন্ন অফিসের দরজায় শিক্ষিত বেকাররা মাথা কোটে। নরেন্দ্রর পরিচিতের সংখ্যা কম নয়, অনেকেই তাকে ভালোবাসে, কিন্তু কেউ একটা চাকরির সন্ধান দিতে পারে না।

ইংরেজি বই অনুবাদ শুরু করল নরেন্দ্র, কিন্তু তাতেই-বা ক’পয়সা পাওয়া যায়। অগতির গতি মাস্টারি। দক্ষিণেশ্বর পরিচয় হয়েছে মহেন্দ্ৰ গুপ্তর সঙ্গে, তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশানের একটি শাখার প্রধান শিক্ষক। তিনি নরেন্দ্ৰকে বেশ পছন্দ করেন, নরেন্দ্ৰকে সেই স্কুলে ঢুকিয়ে দিলেন। কয়েকটা মাস কোনও ক্রমে চলল।

বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশানের নতুন নতুন শাখা খোলা হচ্ছে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে। চাঁপাতলায় একটি নতুন শাখা খোলা হতে নরেন্দ্ৰকে সেখানকার হেডমাস্টার হিসেবে নিযুক্ত করা হল। সদ্য বি এ পাস এই উৎসাহী তরুণটিকে পছন্দ করলেন বিদ্যাসাগর।

কিন্তু নরেন্দ্রর নিয়তি তাকে স্কুল শিক্ষক হিসেবে সারা জীবন কাটাবার জন্য মনোনীত করেনি। নতুন স্কুল, উৎসাহী হেডমাস্টারটি নানা রকম নিয়ম-কানুন চালু করতে লাগল। শুধু পড়াশুনো নয়, ছেলেরা খেলাধুলো করবে, গান শিখবে, পৃথিবীটাকে জানবে। পরীক্ষায় পাস করাটা বড় কথা নয়, সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠাটাই আসল কথা। এই স্কুলের সেক্রেটারি। আবার বিদ্যাসাগর মশাইয়ের জামাতা। সেক্রেটারির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের মতান্তর শুরু হয়ে গেল। সেক্রেটারিই স্কুলের নীতি নির্ধারক, হেডমাস্টার তো তাঁর অধীনস্থ। একজন কর্মচারি মাত্র। মতান্তর থেকে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। নরেন্দ্ৰকে বাধ্য করা যাচ্ছে না দেখে সেক্রেটারি নালিশ জানালেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে।

বিদ্যাসাগর অসুস্থ, পেটের পীড়ার জন্য মন প্ৰসন্ন থাকে না। এখন আর নিজে তিনি স্কুল পরিদর্শনে যেতে পারেন না। নালিশ শুনে বিরক্ত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অন্য কথা বাদ দাও, নরেন ছেলেটি পড়ায় কেমন?

সেক্রেটারি বললেন, পড়ায় কোথায়, সে ছাত্রদের সঙ্গে মিলে গান করে।

সেক্রেটারি উঁচু ক্লাসের কয়েকটি ছাত্রকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়ে এলেন। তারা জানাল যে হেডমাস্টার ভালো পড়াতে পারে না।

যদি শরীর ভালো থাকত, তা হলে বিদ্যাসাগর নরেনকে ডাকিয়ে তার বক্তব্য শুনতেন। কিন্তু এখন আর এসব তুচ্ছ ঝঞাটে তাঁর মন দিতে ইচ্ছে করে না।

বিদ্যাসাগর সেক্রেটারিকে বললেন, তা হলে নরেনকে বলো। সে যেন আর না আসে।

বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্কুল থেকে যে বরখাস্ত হয়, তার পক্ষে অন্য কোনও কুলে কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু নরেন্দ্রর যে দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থা। একদিন তার বন্ধু হরমোহন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ওরে নরেন, সিটি স্কুলের একজন মাস্টার কাল মরেছে। তুই ছুটে যা, শিবনাথ শাস্ত্রীকে তো তুই চিনিস, ওঁকে ধরলে তোর হয়ে যাবে।

চাকরি-বাকরির এমনই অবস্থা যে অনেক বেকার যুবক এখন শ্মশানঘাটগুলিতে গিয়ে সারা দিন কাটায়। কোনও পুরুষ মরা এলেই তারা সাগ্রহে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোন হৌসে কাজ করতেন? কেরানি না দারোগা? তারপর তারা দরখাস্ত পাঠায় এই বয়ানে : সার, লারনিং ফ্রম দা বারনিং ঘাট দ্যাট এ পোস্ট ইজ লাইইং ভেকান্ট ইন ইয়োর অফিস…

নরেন ছুটে গেল শিবনাথ শাস্ত্রীর কাছে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল, সিটি স্কুলের এই কাজটা তাকে পেতেই হবে। শিবনাথ নরেনকে চেনেন ঠিকই। সাধারণ ব্ৰাহ্ম সমাজের অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছে। শিবনাথ আশা করেছিলেন, এই প্রাণবন্ত যুবকটি হবে সাধারণ ব্ৰাহ্ম সমাজের একজন উৎসাহী কর্মী। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে নরেন তো সমাজের কোনও উৎসবে যোগ দেয় না। গানের দলে, প্রার্থনা সভা, কোথাও দেখা যায় না তাঁকে। শিবনাথ শুনেছেন নরেন এখন দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে প্রায়ই যাতায়াত করে। সে রামকৃষ্ণের খপ্পরে পড়েছে। রামকৃষ্ণ ঠাকুর মানুষটি ভক্তিমান, বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সরল সুন্দরভাবে কথা বলতে পারেন, এ সবই ঠিক আছে। কিন্তু তিনি তো একজন প্রতিমাপূজক, সাকারবাদী হিন্দু। রামকৃষ্ণ ঠাকুর ব্ৰাহ্ম সমাজের ছেলেদের ভাঙিয়ে নেবেন, এটা কী করে মেনে নেওয়া যায়। নরেনের মতন আরও কিছু কিছু যুবক সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ ছেড়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

ব্ৰাহ্ম সমাজে কি বেকারের অভাব আছে। তা হলে ব্রাহ্মদের স্কুলের এই চাকরিটি একজন রামকৃষ্ণের চ্যালাকে দেওয়া হবে কেন।

শিবনাথ তাই সুমিষ্ট ভাবে বললেন, নরেন, তোমার মতন গুণী ছেলে, অন্য কোনও চাকরি পেলে না? মাস্টারিতে কি তোমার সংসারের অতগুলি মানুষের ভরণ-পোষণ সম্ভব? চেষ্টা করো, নিশ্চয়ই ভালো কিছু কাজ পেয়ে যাবে।

ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান!

কিন্তু কেউ তো জানে না যে নরেন্দ্রর অবস্থা এখন সমুদ্রে নিমজ্জমান মানুষের যে-কোনও খড়-কুটো আঁকড়ে ধরার মতন! প্রতিদিন সকালবেলা সে বেরোয়, তারপর সন্ধের দিকে তার বাড়ি ফিরতেই ভয় করে। যদি দেখতে হয় যে ছোট ছোট ভাইবোনেরা না খেয়ে আছে, তার মধ্যে সে খালি হাতে দাঁড়াবে কী করে? সে নিজে প্রায়ই বাড়িতে খায় না, নেমন্তন্ন আছে বলে বেরিয়ে আসে, রাস্তায় জল খেয়ে পেট ভরায়। এর মধ্যে আবার বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে। শেষ পর্যন্ত কি কারুর কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে পারবে না!

বাঙালি হিন্দু যুবকের হঠাৎ বেশ কিছু টাকা উপার্জনের একটাই পথ খোলা আছে। সে উচ্চ বংশীয় কায়স্থের সন্তান, বি এ পাস করেছে, স্বাস্থ্যবান ও সদর্শন, বিয়ের বাজারে এখনও তার মূল্য যথেষ্ট। নিজস্ব রোজগার নাই বা থাকল, তাকে ঘরজামাই করতেও অনেকে। আত্মীয় রাম দত্ত এখনও বিয়ের জন্য সাধাসাধি করেন নরেন্দ্রকে। রামকৃষ্ণ দেবের বিশেষ অনুগত, বিত্তবান বলরাম বসুও তাঁর এক কন্যার সঙ্গে নরেন্দ্রর বিয়ে দিতে চান। নরেন্দ্র একবার মাথা হেলালেই এক সালঙ্কারা বধূ ও প্রচুর পণের টাকা ঘরে আসতে পারে।

সাধারণ ব্ৰাহ্ম সমাজ তো ছেড়েছেই। নরেন্দ্ৰ, এখন সে আর দক্ষিণেশ্বরেও যায় না। ব্ৰাহ্মদের সভায় কিংবা দক্ষিণেশ্বরে ঈশ্বর কিংবা ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে যে আলোচনা হয়, তা সবই এখন নরেন্দ্রর কাছে অবান্তর বলে বোধ হয়। গরিবের আবার ঈশ্বর কী? ক্ষুধার্তের কাছে ধর্মের আবার কী প্রয়োজন? ধর্মের কথায় পেট ভরে। এখন আর গান গাইতেও ইচ্ছে করে না!

জুতো ছিঁড়ে গেছে কবে, এখন নরেন্দ্ৰ খালি পায়ে ঘোরে। গায়ের জামার অবস্থাও শোচনীয়। প্রখর গ্ৰীষ্মকাল, দুপুরের কর্কশ রোদে সে চাকরির সন্ধানে এ-দরজায় সে-দরজায় যায়। দুদিন খাওয়াদাওয়া নেই, পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, এই অবস্থায় হঠাৎ দু’জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তাদের তো নিজের অবস্থা কিছুই জানাবে না নরেন্দ্র। বন্ধু দু’জন অনেকদিন পর নরেন্দ্ৰকে পেয়ে বলল, আয় একটু বসি, গল্প করি।

গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসল ওরা।

অদূরেই হোয়াইটওয়ে লেডল নামে বিশাল বিপণিটির সামনে এসে থামছে ফিটন, জুড়ি গাড়ি। সাহেব মেমরা আসছে ওই দোকানে সওদা করতে। তার পাশেই নির্মিত হচ্ছে একটি নতুন হৰ্মা, দেশি মিস্তিরিদের তত্ত্বাবধান করছে এক ফিরিঙ্গি। দুটি রাখাল একপাল ছাগল চরাতে নিয়ে যাচ্ছে কালীঘাটের দিকে।

নরেন্দ্রর বন্ধু দাশরথি বলল, নরেন, অনেকদিন তোর গান শুনি না, হো-হো করে হাসি শুনি না, কী ব্যাপার বল তো! মুখখানি শুকিয়ে গেছে!

নরেন বলল, হাসির ব্যাপার ঘটেছে নাকি কিছু?

দাশরথি বলল, তুই বরানগরে সাতকড়ির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতেও এলি না এই শনিবার।

নরেন গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল, ওদিকে আর যাওয়া হয় না।

কথাবার্তা জমছে না দেখে দাশরথি অন্য বন্ধুটিকে বলল, তুই একখানা গান ধরা। তোর গান শুনে নরেন যদি গায়।

সেই বন্ধুটি শুরু করল : বহিছে কৃপা ঘন ব্ৰহ্ম নিঃশ্বাস পবনে…

সে গানের প্রতিক্রিয়া হল সাংঘাতিক। নরেন্দ্রর চক্ষু যেন জ্বলে উঠল, শ্বাস পড়তে লাগল দ্রুত। দু-লাইন গান শুনতে না-শুনতেই নরেন্দ্র তীব্ৰ ভাবে বলল, নে, নে, চুপ কর। কৃপাঘন ব্ৰহ্ম নিঃশ্বাস না কচু! কোথায় কৃপা।

নরেন্দ্রর ক্ৰোধ-রক্তিম মুখ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল দুই বন্ধু। নরেন্দ্র কিছুটা নাস্তিকতা-ঘেঁষা হলেও এই ধরনের গান সে ভালোবাসে, অনেক সময় নিজেও গায়।

নরেন্দ্র আবার বলল, ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্ম। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল! নিরাকার, না সাকার! নিরাকার হলে তাঁর নিঃশ্বাস থাকবে কী করে, কৃপাই বা বিলোবেন কী করে! আর যদি সাকার হন, তা হলে তিনি দরিদ্র, অসহায় মানুষদের দেখতেই পান না। খিদের তাড়নায় যাদের নিকটজন কষ্ট পায় না, যারা নিজেরা কখনও গ্রাসাচ্ছাদনের কষ্ট সহ্য করেনি, টানা পাখার হাওয়া খেতে খেতে তাদের কাছে ওই সব কল্পনা মধুর লাগতে পারে। এক সময় আমারও লাগত। এখন আমি বুঝেছি, কঠোর বাস্তব কাকে বলে। সাকার-নিরাকারের ওই সব ব্যাপার আসলে গরিবদের অন্ধ বিশ্বাসে ভুলিয়ে রাখার জন্য আর ধনীদের বিলাসিতার জন্য।

বন্ধুদের ওপর রাগ করে নরেন্দ্র হন।হন করে চলে গেল। বন্ধুরা এরপর কোনও হোটেলে গিয়ে খাওয়ার প্রস্তাব করলে নরেন্দ্ৰকে অপ্রস্তুত হতে হত। তার পকেটে একটি আধলাও নেই। অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যে সে কক্ষনও কিছু খেতে চায় না।

নরেন্দ্ৰ নিজেই একদিন অবাক বনে গেল তার মায়ের রূপান্তর দেখে।

ভুবনেশ্বরী বরাবরই ভক্তিমতী। প্রতিদিন পুজো-আচ্চা না করে জল স্পর্শ করেন না। দশটি পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়েও তাঁর স্বাস্থ্য অটুট আছে, বৈধব্য দশায় বিপদে পড়ে তিনি কোনক্রমে সংসার সামলাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য অটুট আছে, বৈধব্য দশায় বিপদে পড়ে তিনি কোনওক্রমে সংসার সামলাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর মনোবল ভাঙেনি। ছেলে-মেয়েদের তিনি বাল্যকাল থেকেই ধর্মশিক্ষা দিয়েছেন। ঘুম থেকে ওঠার পর তারা নাম করে মাটিতে পা দেয়। নরেন্দ্রও অভ্যেসবশে এখনও সে রকম করে যায়।

একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে নরেন্দ্র বলল, দুর্গ দুর্গ, নারায়ণ নারায়ণ।

পাশের ঘর থেকে ভুবনেশ্বরী ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, চুপ করে ছোড়া। খালি ভগবান আর ভগবান! ভগবান তো আমাদের সব কল্লেন!

নরেন্দ্র বিমূঢ় অবস্থায় মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। এই পৃথিবীতে সে তার মাকেই সব চাইতে বেশি ভালোবাসে। অন্নাভাবের চিন্তায় তার মায়েরও বিশ্বাস টলে গেল? অন্তঃপুরের কোনও নারীর মুখে এই ধরনের কথা যেন অবিশ্বাস্য। মা তো হাৰ্বার্ট স্পেনসার কিংবা স্টুয়ার্ট মিলের লেখা পড়েননি!

নরেন্দ্রর মনে পড়ল, সে যখন আহম্মদ খাঁ নামে এক ওস্তাদের কাছে এক সম গলা সাধতে যেত, সেই ওস্তাদ প্রায়ই কথায় কথায় বলতেন, ‘ভাত এমন চিজ, খোদার সঙ্গে উনিশ-বিশ!’ এই প্রবচনটির অর্থ তখন ঠিক বুঝতে পারেনি। নরেন্দ্ৰ, এখন মর্মে মর্মে অনুভব করল।

নরেন্দ্ৰ বলল, মা—

ভুবনেশ্বরী অভিমান মিশ্ৰিত ক্রোধের সঙ্গে বললেন, লোকে যে এত জপ-তপ-প্রার্থনা করে, তা কি কেউ শোনে? কেউ শোনে না, কেউ না! না হলে, কোনও উত্তর পাওয়া যায় না কেন?

নরেন্দ্রর বুক মোচড়াতে লাগল। সে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সে অসহায়। তার শরীরে শক্তি আছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, তবু সংসারের অভাব মোচন করার কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। মা ও ভাইবোনদের এই দুর্দশা সে আর চোখে দেখতে পারছে না, অদূর ভবিষ্যতেও কোনও আশার ছবি নেই।

নরেন্দ্র ঠিক করল, সে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে।

নাঃ। আর কিছু ভালো লাগছে না। তার সামনে এখন দুটি মাত্র পথই খোলা। হয় বিবাহ করে, সাময়িকভাবে অর্থ সঙ্কটের নিবারণ, অথবা সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। ছেলেবেলা থেকে সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তার আকর্ষণ আছে। সন্ন্যাসীরা দূর দূর দেশ, অরণ্য পর্বতে ঘুরে বেড়ায়, এই ভ্রমণের ব্যাপারটাই তার ভালো লাগে।

নরেন্দ্রর নিজের ঠাকুর্দা দুর্গাপ্রসাদ সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী, ছেলেবেলায় নরেন্দ্র ঠাকুর্দা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে। এখন তার রক্তেও লেগেছে সেই টান।

এই দুর্দশার মধ্যে মা ও ভাইবোনদের ছেড়ে চলে গেলে লোকে তাকে পলায়নবাদী বলবে। তা বলুক না। সন্ন্যাসীর তো পিছটান থাকতে নেই। নরেন্দ্র এখানে উপস্থিত থেকেও কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। সে না থাকলে এমন আর কী ক্ষতিবৃদ্ধি হবে!

গৃহত্যাগ করার জন্য উপযুক্ত সুযোগ খুঁজতে লাগল নরেন্দ্র, দু’চারজন বন্ধুকে এই সংকল্পের কথা জানিয়েও ফেলল। ক্রমে ঐ কথা পৌঁছল দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কানে।

এর আগে নরেন্দ্রর চরিত্র সম্পর্কে অনেকে নানান অকথা-কুকথা বলেছে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে, তিনি আমলাই দেননি। কিন্তু ইদানীং দুটি সংবাদ শুনে তিনি বিচলিত বোধ করেন। নরেন্দ্রর বিবাহের জন্য খুব চাপাচাপি চলছে, এমনকি তাঁর ভক্তদের মধ্যেই কেউ কেউ নরেন্দ্রকে জামাতা করতে চায়, এ বড় ভয়ের কথা। একবার সংসারে বাধা পড়লে ও ছেলেকে দিয়ে আর কোনও বড় কাজ হবে না।

নরেন্দ্র বিয়ে না করে সন্ন্যাসী হতে চায়, এ কথা শুনেও উতলা হয়ে পড়লেন রামকৃষ্ণ। স্বার্থপরের মতন ও কোনও নির্জন গিরি-কন্দরে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে? ও যে সপ্তর্ষির একজন, ওর আলোকে অনেকে আলোকিত হবে। নরেন শিক্ষে দেবে!

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দূত মাঝে মাঝেই আসে, নরেন্দ্র আর যায় না। কালী পূজা কিংবা কোনও প্রতিমা পূজাতেই তার বিশ্বাস নেই। বুদ্ধির বিচারে সে ঈশ্বর কিংবা কোনও সর্বশক্তিমানের অস্তিত্বও মানতে পারে না। ঠাকুর তাকে এক একবার ছুঁয়ে দিলে তার শরীর ঝনঝন করে, কী যেন এক ব্যাখ্যার অতীত অনুভূতি হয়, কয়েক দিন সে ঘোরের মধ্যে থাকে। সেই ঘোর কেটে গেলেই আবার তার বিচারবুদ্ধি ফিরে আসে, আবার সে সংশয়বাদী হয়। তবু রামকৃষ্ণ ঠাকুরের নিছক ভালোবাসার টানে সে আবদ্ধ। মানুষটিকে দিন দিনই তার বেশি ভালো লাগছে। দক্ষিণেশ্বরের পরিবেশেও সে স্বস্তি ও আরাম পায়। গান-বাজনা ও বহুরকম হাসি-মস্করা হয়, ঠাকুর সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।

নরেন্দ্র সম্প্রতি আর সেখানে যায় না, কারণ সে নিজের দারিদ্র্য ও অর্থকষ্টের কথা জানিয়ে অন্যদের ভারাক্রান্ত করতে চায় না। নিজে সে ওই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারবে না, গান-বাজনা-রসিকতা উপভোগও করতে পারবে না। তা ছাড়া, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের অর্থবান কয়েকজন ভক্ত নরেন্দ্রর বিবাহ দেবার জন্য যতটা ব্যস্ত, সেই তুলনায় নরেন্দ্রর একটা জীবিকার ব্যবস্থা করে দিতে তাদের কিছুই উদ্যম নেই, সে কারণে নরেন্দ্রর অভিমানও জন্মেছে।

একদিন নরেন্দ্ৰ শুনল, তাদের পল্লীর কাছেই এক ভক্তের বাড়িতে রামকৃষ্ণ আসছেন। যাক ভালোই হল। এই মানুষটি তাকে এত ভালোবাসেন, এঁর সঙ্গে এখানেই শেষ দেখা করে নরেন্দ্ৰ নিশ্চিন্তে সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারবে। চুম্বকের প্রতি লৌহখণ্ডের মতন নরেন্দ্ৰ গেল রামকৃষ্ণ সন্নিধানে।

ঘর ভরা অত শিষ্য, রামকৃষ্ণ শুধু নরেন্দ্রকে দেখেই অস্থির হয়ে উঠলেন। তার দু হাত ধরে বারবার বলতে লাগলেন, তুই এতদিন পরে এলি? এমন করে ভুলে যেতে হয়? তোর কোনও অজুহাত আমি শুনব না। তোকে আজ আমার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যেতেই হবে।

গাড়িতে বসে কোনও কথা হল না। অনেক দিন অদর্শনের ফলে নরেন্দ্ৰ যেন কিছুটা আড়ষ্ট। দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেও রামকৃষ্ণ তাকে বিশেষ কিছু বললেন না। নরেন্দ্ৰ অন্য ভক্তদের মধ্যে বসে রইল। টুকিটাকি কথা হচ্ছে, এমন কিছুই না, নরেন্দ্র উসখুস করতে লাগল, এবার তো বাড়ি ফিরে গেলেই হয়।

হঠাৎ রামকৃষ্ণ উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর শরীর হয়ে গেল ত্রিভঙ্গ ঊর্ধ্বনেত্র, হাত দুটিতে নাচের মুদ্রা। তাঁর ভাবাবেশ হয়েছে দেখে সসম্ভ্রমে চুপ করে গেল সবাই। নরেন্দ্র বসে রইল মাথা নিচু করে, তার এসব ভালো লাগছে না। খলিত চরণে রামকৃষ্ণ এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। নরেন্দ্রর হাত দুটি ধরে দাঁড় করালেন। নরেন্দ্রর শরীর এখনও শক্ত। সে রামকৃষ্ণের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না।

রামকৃষ্ণ এবার গান গেয়ে উঠলেন:

কথা কহিতে ডরাই    না কহিতেও ডরাই

আমার মনে সন্দ হয় বুঝি    তোমায় হারাই, হা রাই!

আমরা জানি যে মন তোর দিলাম তোকে সেই মনতর

এখন মন তোর;      আমরা যে মন্ত্রে বিপদেতে তরী তরাই

নরেন্দ্ৰ দেখল, গান গাইবার সময় রামকৃষ্ণের দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। সে বিস্মিত হয়ে ভাবল, ইনি কাঁদছেন কিসের জন্য?

তার পরই নরেন্দ্রর সমস্ত অন্তরস্থল মথিত হতে লাগল। সে বুঝতে পারল, ইনি কাঁদছেন তার কষ্ট অনুভব করে। ইনি সব জানেন। কী করে জানলেন? এ পর্যন্ত আর তো কেউ নরেন্দ্রর জন্য এমন সমব্যথা দেখায়নি!

আর নরেন্দ্র নিজেকে সামলাতে পারল না। হু হু করে বেরিয়ে এল তার অশ্রু।

তারপর একবার রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে আকুলভাবে কাঁদেন একবার নরেন্দ্র ওঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কেউ কারুকে ছাড়ছেন না, এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে কেঁদেই চলেছেন। আর কোনও কথা নেই, তবু যেন অনেক কথার আদানপ্রদান হয়ে চলেছে, অশ্রু বিন্দুগুলিই সংলাপ। আর যে কেউ ধারে-কাছে আছে, সে জ্ঞানও ওঁদের নেই।

অন্যরা সবাই দূরে সরে গিয়ে হতবাক। রামকৃষ্ণের ভাবাবেগ আগে অনেকেই দেখেছে, কিন্তু এমন ধারা কারুকে জড়িয়ে ধরে ওঁকে কাঁদতে দেখেনি। কেউ। তেজী, উদ্ধত, অবিশ্বাসী নরেন্দ্ররই বা আজ এ কী হল!

এক সময় রামকৃষ্ণের বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল। নরেন্দ্রকে ছেড়ে দিতেই সে বসে পড়ল ছুঁয়ে। রামকৃষ্ণ অন্য ভক্তদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, সবকটি চোখেই কৌতূহল ও প্রশ্ন লেখা আছে।

তিনি মুচকি হেসে বললেন, ও আমাদের একটা হয়ে গেল!

বারবার এরকম হয় নরেন্দ্রর। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের আন্তরিকতায়, তাঁর স্পর্শে সে আপ্লুত হয়ে পড়ে। অন্য কিছু মনে থাকে না, নিয়ম-নিগড়ের বাইরে চলে যায় চেতনা। এক রকমের সুখানুভূতি, কিংবা তার চেয়েও বেশি, উল্লাস বোধ হয় যাকে দিব্য বলে মনে হয়।

কিন্তু এই বোধও দু’একদিনের বেশি থাকে না। আবার সংসারের জাঁতাকল, আবার ভাত-কাপড় জোটাবার মতন অতি সাধারণ অথচ অমোঘ সমস্যার মধ্যে এসে পড়লে ওই সব উল্লাস- মাথায় ওঠে। নরেন্দ্রকে আবার নানা রকম উঞ্ছবৃত্তি করে টাকা সংগ্রহে লেগে পড়তে হয়। আবার দুপুর রৌদ্রে ঘোরাঘোরি, বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যাখ্যান। গৃহত্যাগও আর হল না, সেদিন রামকৃষ্ণ তাকে নিভৃতে ডেকে কাতর গলায় বলেছিলেন, আমি সব বুঝি, তুই বেশিদিন এ সংসারে থাকবি না, কিন্তু আমি যতদিন আছি, তুই আমাকে ছেড়ে যাসনি।

এখন সঙ্কোচ কেটে গেছে, এখন নরেন্দ্র আবার দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। প্রতিবারই অবশ্য রামকৃষ্ণ ঠাকুরের তেমন ভাবাবেগ হয় না, নরেন্দ্ৰও সেই দিব্য অনুভূতি বোধ করে না। ঠাকুরের সঙ্গে তার তর্ক হয়, ঈশ্বরের মহিমার প্রকাশের ব্যাপারটা সে উড়িয়ে দেয়। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মুখের ওপর নরেন্দ্রর মতন এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা আর কেউ বলে না। অন্য ভক্তরা শুধু বিস্মিত নয়, কেউ কেউ বিরক্তও হয়। দু-একজন মৃদু প্রতিবাদ করে।

রামকৃষ্ণ কক্ষনও নরেন্দ্রর ওপর রাগ করেন না। অন্য ভক্তদের অসন্তোষ দেখলে তিনি এক এক সময় কৌতুকের সঙ্গে নিজের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, এর ভেতর যেটা রয়েছে, সেটা মাদী, আর নরেনের ভেতরে যেটা আছে সেটা মদ্দ। ও হচ্ছে আমার শ্বশুর ঘর!

একদিন দক্ষিণেশ্বরে এসে নরেন্দ্র ফস করে বলে বসিল, মশাই, আপনি তো বলেন যে আপনি আপনার ওই মন্দিরের মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আপনার কথা শোনেন। তিনি প্রত্যক্ষ। তা হলে আপনি তাঁকে গিয়ে বলুন না, তিনি যেন আমার মা-ভাই-বোনদের দুঃখকষ্ট ঘুচিয়ে দেন। রামকৃষ্ণ হা-হা করে হেসে উঠলেন।

নরেন্দ্ৰ বলল, না, উড়িয়ে দিলে চলবে না। আপনাকে বলতেই হবে। আপনি যে গান করেন, “আমি জানি গো ও দীন দয়াময়ী, তুমি দুৰ্গমেতে দুঃখ হরা’, তা হলে তিনি আমার বাড়ির লোকদের দুঃখ হরণ করছেন না কেন?

রামকৃষ্ণ বললেন, ওরে, আমি যে মায়ের কাছে কিছু চাইতে পারি না। আমার মুখে আসে না। তুই যাস না কেন? তুই নিজে চেয়ে দেখ!

নরেন্দ্র বলল, আমি কী করে চাইব! আমি তো আপনার মাকে জানি না।আমি তাঁর সঙ্গে কী করে কথা বলব? না, আপনাকেই বলতে হবে। আজ ছাড়ছি না। আপনার জগজ্জননী কত দয়াময়ী তা দেখতে চাই। আপনি বলুন, একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।

রামকৃষ্ণ বললেন, তুই যে মাকে মানিস না, তাই তোর এত কষ্ট। ওরে, আমি মায়ের কাছে গিয়ে অনেকবার বলেছি, মা নরেনের বড় বিপদ। ওর একটা কিছু ব্যবস্থা হয় না! তুই মাকে মানিস না, সেইজন্যই তো মা শোনেন না। আজ মঙ্গলবার, আজ তুই নিজে গিয়ে যা চাইবি, মা তোকে সব দেবেন।

গভীর রাত্রে রামকৃষ্ণ প্রায় এক প্রকার ঠেলেই নরেন্দ্রকে পাঠালেন মন্দিরের দিকে।

দ্বিধাজড়িত পায়ে এগোতে লাগল নরেন্দ্র।

জ্ঞানমার্গী নবীন ভারত এগোতে লাগল ভক্তিবাদের উদ্দেশ্যে। যুক্তি আত্মসমৰ্পণ করতে চলেছে বিশ্বাসের কাছে। অলৌকিক উপলব্ধির জন্য এক তীব্র আকৃতি মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দিচ্ছে বিচারবোধ।

মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি মাত্র প্রদীপে তেলের বাতি জ্বলছে। চতুর্দিকে ফুল-বেলপাতা ছড়ানো। আবছায়ার মধ্যে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কালীমূর্তি। দিগম্বরী এক রমণী, গলায় নৃমুণ্ড মালা, এক হাতে রক্তাক্ত খড়গ, লকলক করছে জিহ্বা। সোনার চক্ষু দুটি যেন নরেন্দ্রর দিকেই এক দৃষ্টি চেয়ে আছেন।

নরেন্দ্ৰ হাঁটু গেড়ে বসল। এক একবার সে মূর্তির মুখ দর্শন করছে, আবার চোখ ফেরাচ্ছে মাটিতে। এই মূর্তিকে ঈশ্বর কিংবা ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে সে মানবে কী করে। এ তো মাটি আর খড় দিয়ে গড়া এক পুতুল। এই মূর্তিকে জগন্মাতা হিসেবে বহু লোক কল্পনা করে, কল্পনায় কোনও বাধা নেই, কিন্তু এই মূর্তির পক্ষে কোনও প্রার্থনা শোনা কি সম্ভব?

নরেন্দ্ৰ তো জানেই যে এই কালী মূর্তি পৌরাণিক নয়, এমন কিছু প্রাচীনও নয়। রামায়ণ-মহাভারতের যুগেও কালীমূর্তি ছিল না। হিন্দুরা মন্দির বানিয়ে মূর্তিপূজা শুরু করল এই তো সেদিন। আগমবাগীশ নামে এক পণ্ডিত কোনও আদিবাসী রমণীর শরীরের গড়ন দেখে এই মূর্তি রূপ দিয়েছিলেন। তন্ত্রবিশ্বাসী বাঙালিরা ছাড়া বাকি ভারতীয় হিন্দুরা এই নগ্নিকা মূর্তিকে এখনও দেবী হিসেবে গ্রহণ করেনি।

কিন্তু মন্দিরের মধ্যে প্রদীপের মৃদু আলোয় নরেন্দ্রর এক একবার মনে হতে লাগল যেন সেই কালীমূর্তি হাসছেন। যেন দুলে উঠছেন। যেন নরেন্দ্রর মতন এক দুরন্ত শিশুকে বশ করতে পেরে তিনি খুশি হয়েছেন। জানা তথ্যগুলি মিলিয়ে যেতে লাগল নরেন্দ্রর মন থেকে। রামকৃষ্ণের স্পর্শে তার সর্বাঙ্গে তরঙ্গ বইছে, চোখে ঘোর লেগেছে। এই রহস্যময় আলোআঁধারির মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে মাটির মূর্তি।

নরেন্দ্ৰ হাত জোড় করে প্রণাম জানাল।

এত চেষ্টা করেও তো সংসারের অভাব-দুঃখ ঘোচানো গেল না। তা হলে এই মাতৃমূর্তির কাছেই চেয়ে দেখা যাক। মামলায় জিতে যদি পৈতৃক বাড়িটি উদ্ধার করা যায়, আর মা-ভাই-বোনদের দু’বেলার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে নরেন্দ্র মুক্ত হয়ে যেতে পারে। নিছক সংসারী হয়ে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। ইনি সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। রামকৃষ্ণ বলেছেন, আগে বিশ্বাসী হতে হবে, বিশ্বাস না করলে কিছু পাওয়া যাবে না।

নরেন্দ্র অস্ফুট স্বরে ডাকল, মা!

সেই ডাকে তিন তিনটি ব্ৰাহ্ম সমাজের পরাজয় সূচিত হল, সেই ডাকে রামকৃষ্ণের জয়ধ্বনি শোনা গেল দিকে দিকে।

নরেন্দ্র আবার ডাকল মা!

কিন্তু সে ঠিক কী চাইবে?

ইনি বিশ্বমাতা, এঁর কাছে কি সামান্য চাকরি, কিংবা চাল-ডালের ব্যবস্থা চাওয়া যায়। রাজার দাক্ষিণ্য পেলে কেউ কি লাউ-কুমড়ো ভিক্ষে করে? নরেন্দ্রর মুখে ওসব কথা এলই না। সে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, মা, আমায় জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও, আর কিছু চাই না!

কালীমূর্তির মুখে সেইরকমই স্থির হাসি আঁকা রইল, কোনও উত্তর এল না।

চাতালের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন রামকৃষ্ণ। নরেন্দ্র বেরিয়ে আসতেই তিনি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, অভাব-টভাব দূর করার কথা ঠিকঠাক বলেছিস তো? নরেন্দ্ৰ বিহ্বলভাবে বলল, না পারিনি। ওসব কথা আমার মুখ দিয়ে বেরুল না।

রামকৃষ্ণ ধমক দিয়ে বললেন, দূর ছোড়া! নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওসব বলবি তো। যা, যা, আবার যা!

তিন তিনবার মন্দিরের মধ্যে গেল, প্রত্যেকবারই সে অভাবের কথা না জানিয়ে ফিরে এল। ভাত-কাপড়ের মতন তুচ্ছ জিনিস সে চাইতে পারবে না কিছুতেই! নরেন্দ্র রামকৃষ্ণকেই ধরে বসল, আপনি গিয়ে আমার হয়ে বলুন! আপনি বললেই হবে!

কিন্তু রামকৃষ্ণও ওসব বলবেন না। তখন তিনি গান ধরলেন। নরেন্দ্ৰও সব ভুলে গেল, গানে মাতোয়ারা হয়ে পড়ল। আত্মসমর্পণের এক নিগূঢ় আনন্দ আছে। ভক্তি তার স্নায়ুগুলিকে সুস্থির করে দিয়েছে।

এক সময় বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়ল নরেন্দ্র। পরদিন অনেক বেলাতেও তার ঘুম ভাঙে না। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এল, তবু রামকৃষ্ণ অন্যদের বারণ করলেন তাকে ডাকতে। আজ রামকৃষ্ণের আহ্লাদের শেষ নেই। বৈকুণ্ঠ সান্যাল নামে এক ভক্ত এসেছে। রামকৃষ্ণ বারবার উৎফুল্লভাবে তাকে বলছেন, ওরে দেখ, ওই যে ছেলেটি ঘুমোচ্ছে, বড় ভালো ছেলে। আগে মাকে মানত না, কাল রেতে মেনেছে। নরেন কালী মেনেছে, বেশ হয়েছে- না? নরেন মাকে মেনেছে, বড় ভালো হয়েছে রে!

বিকেল চারটের সময় নরেন্দ্রর ঘুম ভাঙল। সে চোখ মুছতে মুছতে রামকৃষ্ণের ঘরে আসতেই তিনি এক বিচিত্র ব্যাপার করলেন। নরেন্দ্রর কাছে ছুটে তিনি তাকে মাটিতে বসলেন, নিজে তার প্রায় কোলের ওপর বসে পড়ে, এক হাত নিজের গায়ে, অন্য হাত নরেন্দ্রর গায়ে দিতে দুলতে দুলতে বলতে লাগলেন, দেখছি কী, এই যে এটা আমি, আবার ওটাও আমি। সত্যি বলছি, কিছু তফাত বুঝতে পারছি না। যেমন গঙ্গার জলে একটা লাঠি ফেলায় দুটো ভাগ দেখাচ্ছে, আসলে তো একটাই-

পরে বললেন, তামাক খাব।

বৈকুণ্ঠ সান্যাল ছুটে গিয়ে রামকৃষ্ণের নিজস্ব হুঁকোটিতে তামাক সেজে আনল।

রামকৃষ্ণ কয়েক টান দিয়েই বললেন, হুঁকো থাক, শুধু কল্কেতে খাব।

তারপর হাত বাড়িয়ে নরেন্দ্রকে বললেন, খা, তুই আমার হাতে খা। আমি ধরে আছি। নরেন্দ্র না না বলে মুখ সরাবার চেষ্টা করতেই রামকৃষ্ণ ধমক দিলেন, তোর তো ভারি হীনবুদ্ধি। তুই আমি কি আলাহিদা? এটাও আমি, ওটাও আমি। খা, তামাক খাবি, আমার হাতে খা।

অগত্যা নরেন্দ্রকে টানতেই হল। রামকৃষ্ণ কল্কে ধরে আছেন, নরেন্দ্ৰ তামাক খাচ্ছে। ভক্তরা কেউ কোনওদিন এরকম দৃশ্য দেখেনি। নরেন্দ্ররও খুব সঙ্কোচ হচ্ছে, দুতিনবার টেনেই সে সরিয়ে নিল মুখ। রামকৃষ্ণ এবার কক্ষেতে মুখ দিতে যেতেই নরেন্দ্র বলল, আপনি হাত-টাত ধুয়ে নিন। আমার এঁটো হয়ে গেছে।

রামকৃষ্ণ বললেন, দূর শালা, তোর তো ভারি ভেদ বুদ্ধি

নরেন্দ্ৰ উঠে পড়ল। তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সেখানকার অবস্থা এখন কী রকম কে জানে! গতরাত্রে রামকৃষ্ণ এক সময় বলেছিলেন, যা, তোর পরিবারের একটা মোটা ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ও নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

কিন্তু ব্যবস্থাটা হবে কবে? আজ কী ভাবে বাড়িতে উনুন জ্বলবে? নরেন্দ্রর আবার ঘোর কেটে যাচ্ছে। মা কালী আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতন তো টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দেবেন না।

মাস্টারমশাই মহেন্দ্র গুপ্ত ওর মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে নিরালায় ডেকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, দেখ, এতে যদি কিছুদিন চলে-

সেই টাকায় চাল কিনে নিয়ে নরেন্দ্ৰ বাড়িতে ফিরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *