মহারানী ভানুমতীও শয্যাগ্ৰহণ করেননি সারারাত, তবু তাঁর মন বেশ প্রফুল্লই ছিল। সতীনপুত্র রাধাকিশোরকে মহারাজ সত্যি সত্যি যুবরাজ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন শুনে প্রথমে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজস্ব দূতের মারফত খানিক বাদেই যখন জানলেন যে সে ঘোষণা মহারাজ নিজের মুখে করেননি, অমনি তাঁর মনের ভার কেটে গেল! ঘোষমশাই তাঁর শত্ৰপক্ষ, মনের মধ্যে শতেক প্যাঁচ, কলকাতার বাবুগুলোই এমন হয়। ঘোষমশাই যা ইচ্ছে বলুক, স্বয়ং মহারাজ যখন মুখ খোলেননি, তখন ও ঘোষণার কোনও মূল্য নেই। এ নিশ্চয়ই মহারাজের কৌতুক। তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, তিনি যখন খুশি মত বদল করতে পারেন। রাধাকিশোরকে কুমিল্লার জমিদারি দেওয়া হোক না, তাতে ভানুমতীর আপত্তি নেই, সিংহাসনে বসবে তাঁর পুত্র সমরেন্দ্ৰচন্দ্র।
উৎসব শেষে মহারাজ ভানুমতীর কক্ষে রাত্রিযাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এলেন না, তাতেও কিছু যায় আসে না। রাত্রে আসেননি, প্ৰভাতে আসবেন। সারা রাত ধরে কিশোরী মনোমোহিনীর সঙ্গে তাস পেটাপেটি করতে করতে ভানুমতী তাঁর দূতীদের কাছ থেকে প্রহরে প্রহরে খবর পেতে লাগলেন। তিনজন বিশ্বস্ত দাসীকে ছড়িয়ে রেখেছিলেন অন্দরমহলের অন্যত্র, মহারাজ অন্য কোনও রানীর ঘরে যাচ্ছেন কি না তা জানিবার জন্য। যদিও ভানুমতীর দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর প্রিয়তম বীরচন্দ্র এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতেই পারেন না। তাঁর বিশ্বাসই সত্য হল, এই রাতে আর কোনও রানী মহারাজের সঙ্গ পেয়ে ধন্য হয়নি। একজন দাসী এ খবরও জানাল যে রাধাকিশোরের মা রাজেশ্বরী খুব সাজগোজ করে বড় আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, ঘন ঘন কপাট খুলে দেখছিলেন বাইরে। রাজেশ্বরীর আশাতেও ছাই পড়েছে, বেশ হয়েছে!
মহারাজ গান-বাজনা শুনতে চলে গেছেন বাগানবাড়িতে, সেটাও স্বস্তির কথা। ওই মানা-ঘরে গোনাগুনতি পুরুষমানুষ ছাড়া কেউ যেতে পারে না, কোনও নারীর যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। এ বিষয়ে মহারাজের কঠোর নিষেধ আছে। ওই বাড়ির ঘরগুলি কেমন, তা ভানুমতী নিজেও দেখেননি। এত যে গান-বাজনা ভালোবাসেন মহারাজ, ও বাড়িতে প্রায়ই আসর বসান, কিন্তু একবার যে সেই একটি বাইজী আনানো হয়েছিল লক্ষ্ণৌ থেকে, তাকেও মহারাজ মানা-ঘরে নেননি, তার নাচ হয়েছিল এই প্রাসাদ সংলগ্ন নাচঘরে। এবং তাকে মহারাজের পছন্দও হয়নি। পরে মহারাজ হাসতে হাসতে ভানুমতীর কাছে গল্প করেছিলেন, সে বেটীর ঠমক-ঠামকই বেশি, নাচতে ভালো জানে না, তার যতটা চক্ষু ঘোরে ততটা পা সরে না। আরে শরীর ভাঙানোটাই যদি আসল উদ্দেশ্য হয়, তা হলে লক্ষ্মৌ থেকে এত দূরে আসতে গেলি কেন?
অন্য কোনও নারীর কাছে যাননি মহারাজ, এটাই ভানুমতীর জয়। মাঝে মাঝে চিত্ত উতলা হলেও তিনি আবার নিজেকে বোঝাচ্ছেন যে, আসবেন, মহারাজ ঠিকই আসবেন, গান-বাজনার পর্ব শেষ হোক।
সারা রাত বিনিদ্র অবস্থায় কাটল, তবু দিনের বেলা ঘুমনোর কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তিনি যে-কোনও সময় এসে পড়তে পারেন, সে জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘর যেন অগোছালো না থাকে, শরীর যেন অবশ না হয়। ভানুমতী স্নান করে শুদ্ধ হলেন, বাসি বস্ত্ৰ ছেড়ে নতুন শাড়ি পরলেন, মাল্য-চন্দনে সাজলেন আবার। তাঁর জীবনীশক্তি যথেষ্ট, তাঁর মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ পড়েনি।
মহারানীর সাজ শেষ হবার পরই এক দাসী তার জন্য সকালের জলখাবার নিয়ে এলো। তিনি দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, মানা-ঘরে কী কী খাবার গেছে রে?
বাগানবাড়ির আশেপাশে মহারানীর চর নিযুক্ত আছে। তারা খুঁটিনাটি খবর আনছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। একজন দাসী বলল, মহারাজ শুধু বেলের পানা ও চা খেয়েছেন, আর কিছু না।
প্রতিদিন সকালে মোহনভোগ ও গাওয়া ঘি-এর লুচি মহারাজের পছন্দসই প্রাতরাশ। তিনি পাউরুটি বা বিস্কুট স্পর্শ করেন না। তাঁর বাল্যকালে কী করে যেন রটে গিয়েছিল যে বিস্কুট তৈরি করার সময় কারিগরেরা যেখানে সেখানে সিকনি ঝাড়ে আর পাউরুটি বানাবার সময় ময়দার তাল দলাইমলাই করা হয় পা দিয়ে।
মহারাজ ছবির ঘরে ব্যস্ত আছেন এবং মোহনভোগ-লুচি ফেরত এসেছে শুনে ভানুমতীও হাতের ইঙ্গিতে সেসব নিয়ে যেতে বললেন। তিনি চা পান করেন না, খেলেন শুধু বেলের পানা। তারপর তিনি দাসীগণসমেত মনোমোহিনীকে বললেন, তোরা শোন, মহারাজ যখন আসবেন, তখনই কিন্তু তোরা সবাই সরে পড়বি। একদম সামনে আসবি না। এ ঘরে কেউ দরজা ধাক্কিয়ে বিরক্ত করবি না। মহারাজ যদি সারা দিন-সারা রাত থাকেন, তাও ডাকবি না। কিছু দরকার লাগলে আমি বেরিয়ে চাইব।
মনোমোহিনী বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, সারা দিন, সারা রাত!
ভানুমতী হেসে বললেন, তুই তো জানিস না। মহারাজ একবার আমার ঘরে এলে আর যেতেই চান না। কত কথা হয়ে থাকে আমাদের। একবার দেওয়ানজি কী একটা কাগজ সই করবার জন্য পাঠিয়েছিল, মহারাজ তাও ভাগিয়ে দিলেন।
বেলা বাড়ল, তবু মহারাজের দেখা নেই। শোনা গেল, মহারাজ তখনও কোনও খাবার খাননি, তাঁর ভৃত্য দু’বার খাবার-দাবার ফেরত এনেছে। ভানুমতীও কিছু গ্ৰহণ করলেন না। শ্যামা দাসী বলল, রানীমা, আপনি তো কাল রাতেও কিছু মুখে দেননি, পিত্তি পড়বে যে!
ভানুমতী হেসে বললেন, ওই তো এক ঘটি বেলের পানা খেয়েছি। তাতেই দেখ না ঢেঁকুর উঠছে। হ্যারে শ্যামা, মহারাজ কি গান-বাজনা শুনছেন ও বাড়িতে? না কারুর সঙ্গে কথা কইছেন?
শ্যামা বলল, ওই দারোয়ান মিনসেগুলো যে কোনও খবরই দিতে চায় না। খালি বলে, কাক-পক্ষীরও ঢোকা বারণ। তবে সারেঙ্গি-তবলার কোনও আওয়াজ নেই।
ভানুমতী বললেন, তবে নিশ্চয়ই রাজকার্যের শলা-পরামর্শ করছেন।
মনোমোহিনী চপলভাবে বলল, মাসি, আমি একছুটে গিয়ে মহারাজকে ডেকে আনব?
ভানুমতী বললেন, পাগল নাকি! তুই বাইরে যাবি কী করে? ওই মানা-ঘরে কোনও মেয়েমানুষ দেখলে মহারাজ একেবারে কেটে ফেলবেন!
মনোমোহিনী দুষ্টুমির হাসি দিল। দুপুরবেলা যখন সবাই ঘুমোয়, তখন সে যে কতবার চুপিচুপি বেরিয়ে জঙ্গলে চলে যায়, তা মাসি জানে না। মাসি যদিও মণিপুরের কন্যা, কিন্তু বহুদিন যাবৎ বন্দিনী থাকতে থাকতে এই দশাটাই তার অভ্যেস হয়ে গেছে। মনোমোহিনী জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, ভরত নামে ছেলেটির সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হয়। কিন্তু ওই ভরত একটা ভিতুর ডিম, কথা বলতেও সাহস পায় না। মনোমোহিনী একদিন একটা গাছেচড়ে মানা-ঘরের দোতলাতেও উকি মেরে দেখেছিল। একটা ঘরের দেওয়ালে অনেক ছবি টাঙানো, দেওয়ালের এক কোণে একটা বন্দুক।
মনোমোহিনী বলল, মাসি, মহারাজ তোমার কথা ভুলে যাননি তো?
ভানুমতী বললেন, ভুলতে তো পারেনই। ওঁদের কত কাজে মাথা খাটাতে হয় বল তো! আমরাই কত কথা ভুলে যাই। এই দেখ না, কাল সকালেই আমি টিয়াপাখিগুলোকে ছোলা খাওয়াতে ভুলে গিয়েছিলাম।
কক্ষের অনেকখানিই জুড়ে আছে একটি মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, তার ওপর উজ্জ্বল হলুদ-কালো ডোরাকাটা একটা সুজনি পাতা। মাঝখানে ঠিক রাজেন্দ্রাণীর মতনই সোজা হয়ে বসে আছেন ভানুমতী, তার পরনের বসনটিও হলুদ। পা দুটি ঢাকা। দুই বাহুতে সোনার বাজু, আঙুলে নানা রঙের পাথরের আংটি। তাঁর কণ্ঠস্বরে কোনও অভিযোগের সুর নেই।
নামে রাজপ্রাসাদ হলেও কক্ষগুলি তেমন বড় নয়। নারীমহলের কক্ষের জানলা অনেক উঁচুতে। ভানুমতীর এই ঘরটি জিনিসপত্রে ঠাসা। ভানুমতীর খুব ঘড়ির শখ, অন্তত সাতখানা ঘড়ি রয়েছে দেয়ালে, তার কোনটায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় কোকিল ডাকে, আর কোনটায় পুতুল-কামার প্রতি মিনিটে নেহাই ঠোকে।
মেঝেতে মনোমোহিনী ও আরো আত্মীয়স্বজন বসে আছে, দাসীরা দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে। সবাই উদগ্রীব, কখন মহারাজ এসে পড়বেন। ভানুমতীর প্রতীক্ষার চাপা ব্যাকুলতা সবার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। একজন আত্মীয়া বলল, মহারাজ যদি ভুলেই বসে থাকেন, তাঁকে একবার মনে করিয়ে দিলে হয় না? ভানুমতী বললেন, মানা-ঘরে যে কেউ ঢুকতেই পারবে না। মহারাজের সামনে যাবে কি করে?
মনোমোহিনী ফস করে বলে উঠল, ভরতকে পাঠাও না, মাসি, সে তো ব্যাটাছেলে, সে নিশ্চয়ই পারবে।
ভানুমতী জিজ্ঞেস করলেন, সে আবার কে রে?
মনোমোহিনী বলল, সে যে একজন নতুন রাজকুমার হয়েছে গো। কলকাতার মাস্টারের পাঠশালায় পড়ে।
দাসীদের মাধ্যমে রাজপুরীর সব খবরই চালাচালি হয়। সেই সূত্রে ভানুমতী শুনেছেন যে সম্প্রতি এক মৃত কাছুয়ার সন্তান রাজকুমারের পদমর্যাদা পেয়েছে। ছেলেটির বয়েস বেশি না। কৌতূহলী হয়ে ভানুমতী বললেন, যা তো, ছোড়াটাকে ডেকে নিয়ে আয় একবার দেখি।
মনোমোহিনী লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ডেকে আনছি!
ভানুমতী তাকে নিষেধ করে বললেন, না, না, তুই না, তুই যাবি না।
কিন্তু কার কথা কে শোনে। চঞ্চলা হরিণীর মতন মনোমোহিনী ততক্ষণে দু-তিন লাফে অন্যদের ডিঙিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
পুরনো আমলের রাজপ্রাসাদ। বর্তমানে রানী, দাস-দাসী ও আশ্রিতদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, সকলের স্থান সঙ্কুলান হয় না। তাই মূল প্রাসাদের গা ঘেঁষে ডাইনে-বাঁয়ে, পেছনে আরও ছোট ছোট কয়েকটি বাড়ি জোড়া হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। সেই রকমই প্রাসাদ সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গৃহ মহারাজার সচিব ঘোষ মশাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট। তার একতলার একটি ঘর পেয়েছে ভরত। ঘোষ মশাই থাকেন দোতলায়, একতলার ঘরগুলি স্যাঁতসেঁতে, পোকা-মাকড়সরীসৃপের উপদ্রব আছে, ভরত তবু নিজস্ব একটি ঘর পেয়েই সন্তুষ্ট।
মূল প্রাসাদের পেছনের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে, একটি ফুলের বাগান পার হয়ে মনোমোহিনী ভরতের ঘরের জানলার কাছে দাঁড়াল। এ ঘরে তেমন রৌদ্র ঢোকে না, কেউ জানলা আড়াল করলে ভেতরে ছায়া পড়ে। ঘরে শুধু একটি কাঠের চৌকি, ওপরে তোশক নেই, শুধু চাদর ও বালিশ পাতা। এক কোণে একটি কালো রঙের মাটির কুঁজোর গলা একটি পেতলের গেলাস দিয়ে ঢাকা। শুধু এই অস্থাবর সম্পত্তি ছাড়া ভরত এ যাবৎ সংগ্ৰহ করতে পেরেছে মোট সাতখানি বই, সেগুলি সে তার মাথার বালিশের পাশে রাখে, এবং এ বইগুলিই বার বার পড়ে।
লুঙ্গি পরা, ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও বসন নেই, খাটের ওপর বসে ভরত একটা বই খুলে মনোযোগী হয়ে আছে। কাল বিজয়া দশমীর রাত গেছে, আজ ভাসান, পাঠশালার ছুটি। অন্যদিন এই সময় ভরত পাঠশালায় শশিভূষণের কাছে গিয়ে পাঠ নেয়। কিন্তু তিনি আজ কোনও কাজে কুমিল্লা শহরে গেছেন।
বইয়ের ওপর ছায়া পড়তে ভরত মুখ তুলে তাকাল।
আবার সেই কিশোরী! ভরতের বুক কাপে, রোমাঞ্চে নয়, ভয়ে। মনোমোহিনীকে দেখলেই ভরতের মনে হয়, এ কোনও বিপদ ঘটাতে চায়। অন্য রাজকুমাররা সবাই তাকে বিদ্বেষের চোখে দেখে, তার সামান্য কোনও খুঁত ধরা পড়লে তারা তাকে শাস্তি দিতে ছাড়বে না। এ মেয়েটি কেন বার বার আসে তার কাছে?
মনোমোহিনী চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই, খুব যে হিজিবিজি পড়ছিস, বল তো, অৰ্জ্জুনের কাটা বউ ছিল?
ভরত এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কোনও উত্তর দিল না।
মনোমোহিনী আবার বলল, পারলি না তো। ছাই লেখাপড়া করিস। আচ্ছা এইটা বল, অৰ্জুনের কোন বউ তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই করতে জানে?
ভরত এবারও চুপ করে রইল।
মনোমোহিনী ভেংচি কেটে বলল, তোর নাম কি ভরত, না জড়ভরত রে ; ওঠ, উঠে বাইরে আয়!
এবার ভরত জিজ্ঞেস করল, কেন? বাইরে যাব কেন?
মনোমোহিনী বলল, তা হলে আমি ভেতরে গিয়ে তোর ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে আসব?
ভরত শান্তস্বভাবের হলেও তার শরীর দুর্বল নয়। আর মনোমোহিনী ছিপছিপে গড়নের কিশোরী, সে ভরতের ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যাবে, এ কল্পনাও হাস্যকর। তবু সে অনায়াসে এ রকম স্পর্ধার কথা বলতে পারে।
মনোমোহিনী আবার বলল, শিগগির আয়, মহারানী তোকে ডাকছেন। আমার সঙ্গে না গেলে বীরু সর্দার এসে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে।
ভরত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রইল। এর মধ্যে সে দেখেছে যে এই কিশোরীটি এ রাজ্যের পাটরানীর স্নেহধন্য। কিন্তু পাটরানী তাকে ডাকবেন কেন? সে আবার কী দোষ করল?
একটু পরেই একজন দাসী এসে যোগ দিল মনোমোহিনীর সঙ্গে। তার কাছেও এই বার্তার স্বীকৃতি পেয়ে ভরতকে তৈরি হতেই হল। মহারানীর সামনে কিছুটা সজ্জিত হয়ে যেতেই হয়। কিন্তু ভরত লুঙ্গি ছাড়বে কী করে, জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুই স্ত্রীলোক। একটা ধুতি নিয়ে সে ভেতরের সিঁড়ির তলায় চলে গেল, তারপর গায়ে দিল একটা পিরান।
সে বেরিয়ে আসতেই মনোমোহিনী তার পিঠে একটা কিল মেরে বলল, দৌড়ে দৌড়ে চল রে, জড়ভরত!
ভানুমতী ভরতকে কয়েকটা প্রশ্ন করেও তার মায়ের কথা মনে করতে পারলেন না। ছেলেটি কথাই বলতে চায় না, এই মহিলা মহলে এসে সে যেন আরও লজ্জায় ঘেমে নেয়ে উঠেছে। একে দিয়ে কি কোনও কাজ হবে? মানা-ঘরের প্রবেশদ্বারে হুমদো-হুমদো প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের পেরিয়ে সে যাবে কী করে?
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তুই মানা-ঘরে গেছিস কখনও?
ভরত দু দিকে মাথা নাড়ল।
ভানুমতী অন্যদের উদ্দেশ্যে চেয়ে বললেন, তা হলে কী হবে রে? এ তো পারবে না।
মনোমোহিনী আদুরে গলায় বলে উঠল, না, মাসি, ওকে পাঠাও! ও কেন পারবে না? ও ব্যাটা ছেলে, দারোয়ানদের ফাঁকি দিয়ে একবার ফুড়ুত করে ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে না?
দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে অনেকেই আনন্দ পায়, বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরাও তার বাইরে নয়। ভরত প্রহরীদের হাতে ধরা পড়ে কেমন জব্দ হবে, সেটা ভেবেই মনোমোহিনী খলখল করে হেসে উঠল।
ভানুমতী নিজের হাতের একটি আংটি ঘুরিয়ে বললেন, শোন ছেলে, তুই যদি মানা-ঘরের ভেতরে একবার যেতে পারিস, তা হলে মহারাজকে শুধু বলবি, মহাদেবী তাঁর জন্য দুয়োর খুলে বসে আছেন। শুধু এই খবরটা দিলে তুই এই আংটিটা পাবি।
ভরত আচ্ছা বলে বেরিয়ে গেল। যদিও যেতে তার পা সরছে না। মানা-ঘরের প্রহরীরা বিশেষ রকম ভীমাকৃতি, ওদের কাছে সে ঘেঁষে না কখনও। কিন্তু মহারানীর নির্দেশও অমান্য করতে পারবে না সে। সে আরও আশঙ্কা করল যে, অঘটনঘটন-পটীয়সী ওই মেয়েটি নিশ্চয়ই তার ওপর নজর রাখার জন্য পিছু পিছু আসবে। মনোমোহিনী অবশ্য এলো না, এমন প্রকাশ্যে বাগানবাড়ি পর্যন্ত যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
চর এসে খবর দিল প্রহরীরা ভরতকে সিঁড়ির মুখ থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। ভরত বসে আছে কাছাকাছি এক গাছের নীচে। মহারাজ দৈবাৎ বেরিয়ে এলে সে কথা বলার চেষ্টা করবে।
দাসীদের মধ্যে শ্যামা যেমন চতুর, তেমনই তার চটকদার চেহারা। রাজার বিশ্বস্ত প্রহরীরাও তার সঙ্গে কঠোরভাবে কথা বলে না, দু একজনের সঙ্গে তার গাঢ় সম্পর্কই আছে। ভানুমতী বললেন, শ্যামা, কেউ ভেতরে ঢুকবে না বুঝলাম। যারা পাহারা দিচ্ছে, তাদের দিয়েই খবর পাঠাতে পারিস না? চিতুরাম ও বাড়িতে খাবারদাবার দেয়, তাকে বলবি, যে কোনো ছুতোয় শুধু মহারাজের কাছে একবার মহারানী কথাটা উচ্চারণ করবে। তা হলেই ওঁর মনে পড়ে যাবে।
শ্যামা সেই দায়িত্ব নিয়ে ছুটে চলে গেল।
এখন দ্বিপ্রহরের আহারের সময়, কিন্তু বাগানবাড়ি থেকে খবর এসেছে, মহারাজ এখনও কিছু খেতে চাননি। ভানুমতী হাসি হাসি মুখে বললেন, তা হলে তো আমিও কিছু খাব না।
অন্যদের খিদে পেয়ে গেছে, মনোমোহিনী এর মধ্যেই টুকিটাকি কিছু খেয়ে এসেছে। প্রত্যেকদিন সে ভানুমতীর সঙ্গে ভাত খায়। ভানুমতীর সংকল্প শুনে অন্য কেউ খেতে গেল না।
একটু পরেই সুসংবাদ এলো যে শ্যামা ও বাড়ির ওপরে উঠে গেছে। স্ত্রীলোক হয়েও সে কী করে ঢুকল সেটা বিস্ময়কর হলেও শ্যামার পক্ষে সবই সম্ভব। প্রহরীদের সে পোষা কুকুরের মতন বশ করে ফেলেছে।
কিন্তু শ্যামা ফিরে আসছে না কেন? খানিকবাদে ভানুমতী সত্যিকারের উতলা হয়ে উঠলেন। ওখানে তো তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে বলা হয়নি। কোনও প্রহরীর সঙ্গে গোপনে আশনাই করছে নাকি? মহারাজের কানে টুক করে কথাটা তুলেই তো সে ফিরে আসবে। শ্যামার কোনও বিপদ হল? মহারাজ বীরচন্দ্র খুব ক্রুদ্ধ হলেও কারুকে চরম শান্তি দেন না। শ্যামাকে ভানুমতী বিশেষ পছন্দ করেন, তার জন্য দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে তিনি বলতে লাগলেন, ওরে দেখ না, শ্যামার কী হল।
তিনজন চর আড়াল থেকে নজর রাখতে রাখল বাগানবাড়ির দিকে। ভরত একটা গাছতলায় নিথর হয়ে বসে আছে। শ্যামার কোনও চিহ্ন নেই। ভরত সাক্ষী আছে, শ্যামা ও বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসেনি। প্রহরীরা কিছুই বলতে চায় না।
ভানুমতীর এবার একটি বিশেষ নির্দেশ এলো প্রহরী দুজনের কাছে। মহারাজের আদেশ তারা কারুকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। সেটা ঠিক কথা। কিন্তু মহারানীর নিজস্ব দাসী শ্যামাকে তারা ভেতরে যেতে দিয়েছে। শ্যামা ও বাড়িতে কোথায় আছে এবং এতক্ষণ কী করছে তা যদি প্রহরীরা মহারানীকে না জানায়, তা হলে প্রহরী দুজনের গ্রামের বাড়িতে আগুন জুলিয়ে দেওয়া হবে।
প্রহরীরাও মহারানী ভানুমতীর ক্ষমতা জানে। তাঁর আদেশে শুধু দুটি বাড়ি কেন, পুরো একটা গ্রাম জ্বলে যেতে পারে। তারা ভানুমতীর চরকে জানিয়ে দিল যে, শ্যামা রয়েছে স্বয়ং মহারাজের সন্নিধানে। অনেকক্ষণ। সে কোনও শান্তিও পায়নি, কেননা তার এবং মহারাজের কথোপকথনও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। প্রহরীরা আরও যা জানাল, তা মহারানীর কানে তোলা যায় না। একজন প্রহরী বন্ধ দরজার চাবির গর্ত দিয়ে দেখেছে যে, শ্যামার অঙ্গে বসন নেই, সে রঙ্গিণীর মতন দাড়িয়ে আছে একটি চেয়ারের হাতল ধরে।
শ্যামা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মহারাজের সঙ্গে এক কক্ষে রয়েছে শুনেই ক্ৰোধে জ্বলে উঠলেন ভানুমতী। তিনি তীক্ষ্ণুস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, শ্যামা, হারামজাদী, তোর এত সাহস! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব! আয়, শিগগির চলে আয়!
যেন শ্যামা শ্রবণ-দূরত্বে আছে, যেন সে মহারানীর হুকুম শুনতে পেয়েই ছুটে চলে আসবে। ভানুমতী আর কোনও যুক্তির কথা শুনতে চাইলেন না, তিনি বার বার শ্যামার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। দাসীরা আবার ছুটে গেল। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়ে যাবার ভয় থাকলেও কোনও প্রহরীর সাহস নেই মহারাজের কক্ষ থেকে শ্যামাকে ডেকে আনার, তারা দাঁড়িয়ে রইলো বধিরের মতন।
অপরাহ্ণও শেষ হয়ে গেল, আকাশে বর্ণবাহার ছড়িয়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। পাখিরা কুলায় ফিরল, গাছপালাগুলো ঝাপসা হয়ে গেল, মানুষের জীবনযাপনের শব্দ স্তিমিত হয়ে এলো। রাজপুরীর দেউড়ির দুপাশে দাউ দাউ করতে লাগল দুটি মশাল, নির্দিষ্ট দাসীরা প্রতিটি কক্ষে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে দিতে এলো।
মহারানী ভানুমতী এখন অপ্রকৃতিস্থের মতন ছটফট করছেন। পালঙ্ক থেকে নেমে একবার আলুথালু বেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন সারা ঘর, কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। কখনও নিজেই শুয়ে পড়ে দাপাচ্ছেন হাত-পা। অনবরত বলছেন শ্যামা কোথায়, শ্যামা, তাকে ডেকে নিয়ে আয়, সে হতচ্ছাড়ির নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে আয়, এত বড় সাহস তার, কোথায় সে লুকিয়ে আছে।
মহারাজের নাম আর উচ্চারণ করছেন না তিনি। এক অভিজ্ঞ, কূটনীতিজ্ঞ, প্রণয় নিপুণ পুরুষের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে বসেছিলেন এই রমণী, সরলা বালিকা মতন বিশ্বাস, এখন তাঁর পুঞ্জীভূত অভিমান যেন বিষ হয়ে গেছে, সেই বিষের জ্বালা তাঁর সর্বাঙ্গে। অন্য কেউ কোনও সান্ত্বনা দিতে পারছে না, সবাই নীরব, এমনকি চপল স্বভাব মনোমোহিনী পর্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।
এক সময় লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে এসে ভানুমতী এক দাসীর টুঁটি চেপে ধরে ডাকিনীর মতন চক্ষু পাকিয়ে বিকট স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামা কোথায় আছে বল? তোরা জানিস, আমার কাছে লুকচ্ছিস।
দাসীটি প্ৰাণের দায়ে বলল, শ্যামা এখনও মানা-ঘরে রয়েছে। আর কোথাও যায়নি। তিন সত্যি করে বলছি, রানীমা-
ভানুমতী তার মাথা ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, কেন তাকে ডেকে আনছিস না? যা, যা
দাসীটি বলল, সে ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে কুলুপ দেওয়া।
হঠাৎ থেমে গেলেন ভানুমতী, তার হাত অবশ হয়ে গেল, চক্ষু, থেকে নিবে গেল তেজ। তিনি নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত, যেন একটা কাঠামোবিহীন খড়ের মূর্তি, এখনই খসে পড়বেন ভূমিতে। ফাঁকা গলায় বললেন, তোরা যা, সবাই যা, কেউ থাকিস না, আমি এখন শোব।
একে একে সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মনোমোহিনী ইতস্তত করছিল, ভানুমতী তাকেও বললেন, চলে যা এখান থেকে।
তারপর দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, আর আমাকে কেউ ডাকবি না। এই দরজা আর খোলা হবে না।
কোনও কোনও সংবাদের প্রচার মাধ্যম লাগে না। কোনও কোনও সংবাদ দেওয়াল কিংবা বন্ধ দরজার বাধাও মানে না। গভীর রাতে মহারাজ বীরচন্দ্র যখন বাগানবাড়ি থেকে ছুটে এলেন প্রাসাদে, ততক্ষণে ভানুমতীর ঘরের দরজা ভাঙা হয়ে গেছে। সারা সন্ধে সেই দরজার বাইরে ভিড় করে দাঁড়ানো নারীরা শুনছিল ভেতরের কাতর শব্দ। শুধু বুকফাটা তীক্ষ্ণ আঃ আঃ ধ্বনি। অন্য মহল থেকে ছুটে এসেছিল রানীরা। শত ডাকাডাকিতেও দরজা খোলেননি ভানুমতী। এক সময় তাঁর সেই আর্তনাদও থেমে গিয়েছিল। তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। তখন কুমার রাধাকিশোরের নির্দেশে দরজা ভেঙে ফেলা হল।
মহারাজ বীরচন্দ্ৰ পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন ভানুমতীর বুকের ওপর দু হাত চাপা, চক্ষু দুটি খোলা, প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। সারা ঘরময় ভানুমতীর অলঙ্কার ছড়ানো। কাছে কোনও বিষের পাত্র নেই, শরীরে কোনও অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নেই। রাজবৈদ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিয়েছেন।
বীরচন্দ্র আস্তে আস্তে হাঁটুগেড়ে বসলেন ভূতপূর্ব মহারানীর পায়ের কাছে। ফুঁপিয়ে ওঠার আগে বললেন, ঘরটা ফাঁকা করে দাও, এখন এখানে কেউ থাকবে না।