মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য ভোজনবিলাসী, কিন্তু পেটুক নন। খাদ্যের আস্বাদের ব্যাপারে তিনি খুঁতখুতে। তাঁর বপুটি বেশ বড়সড় হলেও মাঝে মাঝেই তিনি আহার করেন নাম মাত্র। কাজে বিভোর হয়ে থাকলে দু’একবেলা তিনি কিছু মুখে দিতেই ভুলে যান। সাধারণত তিনি আহার গ্রহণ করেন নিজের কক্ষে বসে, তখন দু’একজন পরিচারিকা ছাড়া অন্য লোকজনের উপস্থিতি পছন্দ করেন না। এক একদিন তিনি কোনও বিশেষ রানীর মহলে গিয়ে সেই রানীকে পরিবেশনের সুযোগ দিয়ে ধন্য করতে চান। সেদিন ধরে নেওয়া হয় যে, মহারাজের পরিপাটি ভোজনের শখ হয়েছে। নির্দিষ্ট রানীটি ধন্য হবার বদলে অতি মাত্রায় উতলা হয়ে পড়েন, কারণ মহারাজের মতিগতি বোঝা যেন ভগবানেরও অসাধ্য।
শ্বেত পাথরের মেঝেতে একটি লাল পশমের আসন পাতা হয়েছে। স্বর্ণথালা ঘিরে আঠারোটি রুপোর বাটি সাজানো, জল পানের গেলাসটিও সোনার। একটু দূরে নীল শাড়ি পরা রানী করেণুকা হাঁটু গেড়ে জোড় হাতে এমনই নিথর হয়ে বসে আছেন, যেন তাঁর নিঃশ্বাসও পড়ছে না। স্নানের পর তিনি সারা মুখে চন্দনচর্চা করেছিলেন, এখন তা ঘামে মিশে যাচ্ছে। সীতার অগ্নিপরীক্ষার চেয়েও যেন কঠোরতর এক পরীক্ষায় সম্মুখীন রানী করেণুকা।
ঘি রঙের পট্টবস্ত্র পরিধান করে খড়ম খটখটিয়ে এসে হাজির হলেন বীরচন্দ্ৰ, মুখ দেখলে মনে হয় তিনি বেশ খোশমেজাজেই আছেন। আসনে বসবার আগে তিনি একবার অন্ন-ব্যঞ্জনের পাত্রগুলি সাজাবার পারিপাট্য দেখে নিলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস রে, করেণু তুই কটা পদ বেঁধেছিস।
করেণুকা মহারাজের পাটরানীদের অন্যতমা নয়। পুত্রের জননী হবার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি, তিনি দুটি কন্যার গর্ভধারিণী। নামের সঙ্গে চেহারার মিল নেই একেবারেই, করেণুকা কুশাঙ্গী, অনেক ননী-মাখন খেয়েও তিনি মোটা হতে পারেননি, মহারাজের পাশে তাঁকে যেন ঠিক মানায় না। ইদানীং স্বামী-সন্দর্শন তাঁর ভাগ্যে খুব কমই ঘটে, গত ছ’মাসের মধ্যে মহারাজ একবারও তাঁর খোজ নেননি। হঠাৎ আজ অন্য রানীদের ছেড়ে মহারাজ কেন তাঁর মহলেই অন্ন গ্রহণের ইচ্ছা প্ৰকাশ করলেন, এটা ভেবে ভেবেই তিনি সারা হয়ে যাচ্ছেন।
মহারাজের প্রশ্নের উত্তরে করেণুকা কম্পিত কণ্ঠে বললেন, সবই আমি রেঁধেছি প্রভু!
মহারাজ জোড়াসনে বসে বললেন, দেখি তোর হাতের গুণ।
প্রথমে একটুক্ষণ চক্ষু বুজে তিনি ইষ্ট দেবতার নাম স্মরণ করলেন। তারপর গেলাস থেকে এক গুন্ডুষ জল নিয়ে ছোঁয়ালেন মুখে। এই রীতি তিনি ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে শিখেছেন কিন্তু ব্রাক্ষণরা এই সময়ে যে মন্ত্র পাঠ করে তা তা মনে নাই।
থালায় যুঁই ফুলের মতন ভাত, মহারাজ প্রথমে একটু ভাত ভাঙলেন, তাতে কোন ব্যঞ্জন মাখার আগে, এক একটি থেকে একটু একটু তুলে চোখে দেখতে লাগলেন। বাটির পর বাটি ঠেলে সরিয়ে দিতে লাগলেন এক পাশে, অর্থাৎ সেইসব ব্যঞ্জন তাঁর পছন্দ নয়, কোনও কোনওটি ঠেলে সরাবার আগে বললেন, মন্দ না। একটি ব্যঞ্জন দু’বার মুখে দিয়ে বললেন, এটা কী রে?
করেণুকা বললেন, চিতল মাছের মুইঠ্যা!
অন্য কয়েকজন রানী আড়াল থেকে উঁকি মারছিলেন, কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে তাঁরা ক্রমশ সামনে চলে এলেন। মহারাজ মুখ তুলে দেখলেন তাঁদের, আপত্তি জানালেন না।
তিনি বললেন, চিতল মাছের মুইঠ্যা! তোরটা হয়েছে বটে একপ্রকার, কিন্তু বড়রানী ভানুমতী এটা যা রান্না করত, তার সঙ্গে তুলনাই হয় না। সেই স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে। তোরা কী বলিস, ঠিক না? অন্য রানীরা তো করেণুকার হেনস্থা দেখতেই এসেছেন, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ওঃ বড়দিদির হাতের রান্না, অমৃত, অমৃত!
অন্য একটি তরকারি আঙুলের ডগায় তুলে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? করেণুকা বললেন রসুনবাটা দিয়ে বেগুন! মহারাজ ভাল-মন্দ মন্তব্য না করে রানীদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিয়ে বললেন, এই তুই এটা খা।
সেই রানী সারা শরীর মুচড়ে বলল, না, আমি খাব না। আমি খেতে পারব না।
অন্য রানীরা থুতনিতে আঙুল দিয়ে গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, সে কী রে, সুদক্ষিণা, স্বয়ং মহারাজ আদেশ করেছেন, তুই তবু খাবি না? মহারাজের প্রসাদ, খা, খা, খা!
সবাই জানে, সুদক্ষিণা রসুনের গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারে না। একবার ভুল করে কোনও রসুন মিশ্রিত তরকারি মুখে দিয়ে সে বমি করে ফেলেছিল। অন্য রানীরা সুদক্ষিণাকে জোর করে খাওয়াতে গেল, সে ছুটে পালাল সবার হাত ছাড়িয়ে। বীরচন্দ্ৰ হা-হা করে হাসতে লাগলেন।
করছেন।
বীরচন্দ্র যে-সব বাটি উচ্ছিষ্ট করে সরিয়ে দিচ্ছেন, তার জায়গায় আসছে অন্য বাটি। সব বাটি একসঙ্গে সাজানো হয়নি। অন্তত বত্ৰিশ ব্যঞ্জনের কমে মহারাজকে সেবা করার কথা চিন্তাই করা যায় না। তিনি রুইমাছের ঝাল বাদ দিয়ে পুঁটি মাছের টক খাচ্ছেন, ঝিঙের তরকারিতে কুমড়োর টুকরো দেখে নাক কুঁচকোচ্ছেন।
সব কটি পদ চাখবার পর বললেন, এঁচোড় রাধিসনি, করেনু? এখন, কাঁঠাল গাছগুলো একেবারে নুয়ে আছে, এই তো সময়। ভালো করে গরম মশলা দিয়ে রাঁধলে মাংসের মতন… বাঙালিরা কি সাধে এঁচোড়কে গাছ-পাঁঠা বলে?
করেণুকার মুখখানি বিবৰ্ণ হয়ে গেল। তাঁর এত সাধ, এত শ্রম, সব ব্যর্থ! মহারাজ যে-টা নিজের মুখে চাইছেন, সেটাই নেই। তিনি জানবেন কী করে, মহারাজ তো তাঁর আঙিনায় আগে কখনও খেতে আসেননি।
অন্য রানীরা ঠোঁট টিপে হাসছে। বীরচন্দ্ৰ বাঁ হাত বাড়িয়ে করেণুকার মাথায় হাত রেখে বললেন, যা, তুই পাশ করে গেলি। আমি তোর হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তি হয়েছি। এঁচোড় আমি দু’চক্ষে দেখেতে পারি না। কাঁঠালের নাম শুনলে আমার গা জ্বলে। আর আমার রাজ্যেই কিনা এত কাঁঠাল ফলে! ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ওটা বাদ দিয়েছিস।
এঁটো হাতেই আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে রানীদের সঙ্গে কৌতুক করতে লাগলেন বীরচন্দ্র। একজন তামাক সেজে এনে তাঁকে গড়গড়ার নলটি ধরিয়ে দিল।
বীরচন্দ্রের সচিব রাধারমণ ঘোষ এর মধ্যে একবার খোজ করতে এলেন। বাইরে থেকেই যখন শুনলেন যে মহারাজ আজ এক রানীর মহলে আহার করতে গেছেন, তখন বুঝলেন অন্তত ঘণ্টা দু’একের মধ্যে দেখা পাবার আশা নেই। রাধারমণ নিজের বাড়িতেও ফিরলেন না, শশিভূষণের বাড়ির দরজা খুলিয়ে সেখানে স্নানাহার সেরে নিলেন।
অন্য রানীদের বিদায় করে, করেণুকার কক্ষে এক খিলি পান মুখে দিয়ে পালঙ্কে শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন বীরচন্দ্র। করেণুকা পদসেবা করতে লাগলেন। বীরচন্দ্র বললেন, বাঃ, তোর হাত দুটি তো বেশ নরম। পাটকাঠির মতন চেহারা হলে কী হয়, তোর হাতের গুণ আছে। তোর কাটি ছেলেমেয়ে রে, করেণু। করেণুকা বললেন, প্ৰভু, আপনার দয়ায় আমার দুটি কন্যা। পুত্ৰসৌভাগ্য হয়নি। বীরচন্দ্র কয়েক মুহূর্তে উর্ধনেত্ৰে চিন্তা করলেন। এতগুলি ছেলে মেয়ের সকলের নাম-ধাম যদি মনে রাখতে হয়, তা হলে তিনি রাজকাৰ্যে মন দেবেন। কী করে? রানীদের নামগুলি যে মনে রেখেছেন, তাই-ই যথেষ্ট।
কন্যা দুটিকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পরিচারিকাদের মহলে। বীরচন্দ্ৰ শিশুদের কোলাহল পছন্দ করেন না। করেণুকার দুই কন্যা কখনও তাদের পিতার কোলে বসে আদর খায়নি। দূর থেকে কয়েকবার দেখেছে মাত্র। নাম জানতে চাইলেন না, বীরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, তাদের বয়েস কত? কন্যা দুটির বয়েস আটি আর সাত বৎসর। বিবাহের পর বীরচন্দ্র যখন ঘন ঘন করেণুকার সঙ্গে এক শয্যায় রাত্রিবাস করতেন তখন পিঠোপিঠি ওই দুই বোনের জন্ম। এরপর মহারাজার আরও দুই রানী এসেছে, করেণুকা আড়ালে চলে গেছেন।
বীরচন্দ্র বললেন, তা হলে তো বড়টির এবার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়…
বলতে বলতেই বীরচন্দ্রের চোখ বুজে, এল, নাসিকা গর্জন শুরু হয়ে গেল। করেণুকা, তবু একই জায়গায় বসে স্বামীর পা টিপে দিতে লাগলেন, প্রত্যাশায় তাঁর বক্ষ উদ্বেল, আজ আকস্মিকভাবে তাকে দয়া করেছেন দেবতা। করেণুকা কিছুই খাননি, সারা শরীর এমনই টান টান হয়ে আছে যে আজ কোনও খাদ্যই তাঁর গলা দিয়ে নামবে না।
বেশিক্ষণ ঘুমোলেন না বীরচন্দ্ৰ, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই উঠে বসে হাই তুললেন দু’বার। খোলা মুখের কাছে টুসকি মেরে বললেন, রাধেকৃষ্ণ, রাধেকৃষ্ণ।
পালঙ্ক থেকে নেমে বললেন, বেশ বিশ্রাম হয়েছে। তোর ঘরটি তো বেশ ভালো রে, করেণু! যথেষ্ট আলো হাওয়া বয়। এখানা খুব প্রশস্ত, পাশে আরও দুটি ছোট ঘর আছে, তাই না? সারা ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে, অন্য দুটি কক্ষের দরজা খুলে উকি মেরে, এখানকার একটি জানিলা খুলে বাইরের মেঘলা আকাশ দেখলেন তিনি। তার মুখ প্ৰসন্নতায় ভরা। তিনি করেণুকাকে ডাকলেন, আয় কাছে আয়।
তাঁর প্রশস্ত বক্ষে করেণুকার ক্ষীণ শরীরটি যেন মিলিয়ে গেল। করেণুকা থরথর করে কাঁপছেন। এত সুখ কি সহ্য করা যায়! বহু দিন মহারাজ তাকে স্মরণ করেননি, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি উপেক্ষিতাদের দলে পড়ে গেছেন। পুত্ৰহীনা রানীদের কদর থাকে না বেশিদিন। অন্য কয়েকজন রানীর মতন প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ক্ষমতাও তাঁর নেই। তাঁর পিতৃকুলও শক্তিশালী নয়।
আলিঙ্গনাবদ্ধ করেণুকাকে বীরচন্দ্র বললেন, ভারি লক্ষ্মী মেয়ে তুই। তোর সেবা যত্নে আমি মুগ্ধ হয়েছি। যেমন সুন্দর তোর হাতের রান্না, তেমনই তৃপ্তি পেলাম আজ তোর এখানে ঘুমিয়ে।
এবারে আনন্দের চোটে কেঁদেই ফেললেন করেণুকা।
তাঁর পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বীরচন্দ্র বললেন, এবার আমি তোর কাছে একটা কিছু চাইব, তুই দিবি? করেণুকার অশ্রুসিক্ত দু’ চোখে ফুটে উঠল। দারুণ বিস্ময়! এ কী কথা বলছেন তাঁর পতিদেবতা। তাঁর মতন এক অভাগিনীর কাছে মহারাজ বীরচন্দ্র কী চাইতে পারেন? করেণুকা কী দিতে পারেন, সব কিছুই তো মহারাজের!
করেণুকা অস্ফুট ভাবে বলল, এ কী বলছেন, প্ৰভু? আপনি চাইলে আমি এই মুহূর্তে আমার প্রাণ দিয়ে দিতে পারি।
বীরচন্দ্ৰ সহাস্যে বললেন, না, না, প্ৰাণ-ট্রান দিতে হবে না। আমি যা চাইছি, তা অতি সামান্য!
করেণুকাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে, দু’ হাত দিয়ে তাঁকে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিতে বীরচন্দ্র বললেন, তুই শুনেছিস নিশ্চয়ই আমি আর একটি বিয়ে করছি। তোদের বড়দিদির শেষ সাধ জন্য মনোমোহিনীকে বিয়ে করতেই হচ্ছে বাধ্য হয়ে। বিয়ের পর মনোর জন্য তো একটা পৃথক মহল দরকার। এই রাজপুরীতে আর স্থান-সঙ্কুলান হয় না। ভানুমতীর ঘরখানা তার স্মৃতি বিজড়িত, এত শীঘ্র সেখানে মনোকে থাকতে দেওয়া কি উচিত হয়, তুই বল? করেণুকা বিস্ফারিত চক্ষে চেয়ে রইলেন।
এই আকস্মিক প্রসঙ্গ বদলের হেতু তিনি এখনও বুঝতে পারছেন না।
বীরচন্দ্র বললেন, সেই জন্যই বলছিলাম, তোর এই মহলটা ছেড়ে দিবি? তোর জন্য বিরজা অন্য ঘর ঠিক করে দেবে। তোর কোনও অসুবিধে হবে না। নতুন রানীর জন্য একটা নতুন মহল না হলে যে তার বাপের বাড়ির লোকেরা নিন্দে করবে!
এরপর আর কিছুক্ষণ কোনও কথা না বলে করেণুকার দিকে চেয়ে রইলেন বীরচন্দ্র। তিনি যেন বুঝিয়ে দিতে চান, তিনি কত উদার, কত মহান, তিনি এই রাজ্যের অধীশ্বর। তিনি মুখের কথা না খসিয়ে শুধু ইঙ্গিতে কোনও ইচ্ছা! প্রকাশ করলেও সঙ্গে সঙ্গে তা পালিত হবে। যে-কোনও রানীকে তিনি পাঠাতে পারেন নির্বাসনে। করেণুকার এই মহলটি তাঁর প্রয়োজন, তিনি কি কর্মচারিদের সাহায্যে করেণুকাকে পরিচারিকা মহলে ঠেলে দিতে পারতেন না? তার বদলে তিনি একটি হাড়-জিরজিরে রমণীর জন্য এতখানি সময় ব্যয় করেছেন, তাকে সেবা-যত্নের সুযোগ দিয়েছেন, গ্ৰীতিপূর্ণ বাক্য বলেছেন, তার কাছে প্ৰাখীর মতন হাত পেতেছেন। তাঁর কোনও পূর্বপুরুষ এই ব্যবহার দেখলে হতবাক হয়ে যেতেন নিশ্চিত। একজন রাজার কাছে এরা আর কতখানি মহানুভবতা আশা করে?
করেণুকার অবিশ্বাস ও আতঙ্কমাখা মুখ তার পছন্দ হল না। উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজার দিকে যেতে যেতে বীরচন্দ্র বললেন, তোর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে কাল সকালেই এই ঘর-টর খালি করে দিবি! এ মহলটা অন্যভাবে সাজানো হবে-
রাধারমণ আবার যখন বীরচন্দ্রের খোজ করতে গেলেন, তখন শুনলেন যে মহারাজ দরবারে বসেছেন।
ঠিক যে রাজকার্যের জন্যই মহারাজকে নিয়মিত দরবারে বসতে হয়, তা নয়। বীরচন্দ্র খুব বেশি আড়ম্বর বা রীতিনীতি মানেন না। তিনি দরবারের মন্ত্রী বা সেরেস্তাদারদের বাড়িতেও যখন তখন চলে যান, কখনও বা উদ্যানে বসে গল্প-গুজবের ভঙ্গিতে সরকারি আইনের আলোচনা সেরে নেন। ইংরেজ সরকারের কোনও প্রতিনিধি এলে অবশ্য রাজসভার জাঁকজমক দেখাতেই হয়। এ ছাড়া মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে তাঁর দরবারে বসে রাজা সাজার ইচ্ছে জাগে। কয়েকজন গায়কবাজনাদার কবি-চাটুকার তাঁর পোষ্য, তিনি রাজসভায় বসে তাদের সঙ্গে রহস্য-পরিহাস করেন।
রাধারমণ দরবারে এসে দেখলেন, মহারাজ বীরচন্দ্র মাথায় মুকুট পরে সিংহাসনে বসে আছেন। বহু প্রাচীন এই সিংহাসনটির অষ্টকোণ ষোলোটি সিংহ ধূত। এই সিংহাসনে বসার অধিকার নিয়ে কম রক্তক্ষয় হয়নি। এই মুহূর্তে যে সিংহাসনটি আবার টলমল করছে, তা বীরচন্দ্ৰ জানেন না। কবি মদন মিত্তির মুখে মুখে পদ্য বানিয়ে বলছে, মহারাজও তার উত্তর দিচ্ছেন, আসার বেশ জমে উঠেছে। ধুরন্ধর পঞ্চানন্দ মহারাজকে তোষামোদ করে বাহবা দিচ্ছে বারবার। সম্প্রতি সে শ্যামাদাসীকে উপঢৌকন হিসেবে পেয়েছে মহারাজের কাছ থেকে। আগে যে রমণীটিকে সে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিত, সেই রমণীটি ফিরে গেছে কলকাতায়।
একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাধারমণ মহারাজের কাছ ঘেঁষে কিছু বলতে যেতেই মহারাজ হাত তুলে বললেন, এখন কাজের কথা থাক।
পঞ্চানন্দও সঙ্গে সঙ্গে তাল দিয়ে বললেন, আঃ, ঘোষমশাই, আপনি বড় বেরসিক! এমন কোকিলের গানের মতন কাব্যতরঙ্গ বইছে, এর মধ্যে কি কাকের কা-কা-কা ডাকের মতন কাজের কথা মানায়? আপনিও একটু শুনুন না!
রাধারমণ দৃঢ় স্বরে বললেন, কাজটা অতি জরুরি। কাব্য পরে হবে। তিনি মহারাজের কানের কাছে গোপনে একটি বার্তা শোনালেন। শুনতে শুনতে বীরচন্দ্রের ভুরু উত্তোলিত হল, তিনি দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে ধরলেন, জ্বলন্ত হল চক্ষু। সবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল তো, চল গিয়ে এক্ষুনি দেখি!
বীরচন্দ্র হনহানিয়ে হেঁটে চললেন রাধারমণের বাড়ির দিকে। রাধারমণ ছাড়া অন্য কারুকে সঙ্গে আসতে নিষেধ করা হল।
বৈঠকখানার দরজার তালা বন্ধই আছে, বাইরে রয়েছে বন্দুকধারী প্রহরী। তালা খোলার পর দেখা গেল তক্তপোশের ওপর প্রায় একই ভঙ্গিতে বসে আছেন কৈলাস সিংহ। এর মধ্যে অনেকগুলি চুরুট শেষ করেছেন, সারা ঘরে ছাই ছড়ানো, এখনও তাঁর মুখে একটা অর্ধেক জ্বলন্ত চুরুট।
প্ৰথমে রাধারমণের দিকে তাকিয়ে তিনি সহাস্য কণ্ঠে বললেন, বাঃ। বাঃ ঘোষজা, তোমার আতিথেয়তার নমুনাটি চমৎকার। অতিথিদের না খাইয়ে বন্দী করে রাখাই বুঝি। এ রাজ্যে রেওয়াজ হয়েছে?
তারপর চুরুটটা মুখ থেকে সরিয়ে, তক্তপোশ থেকে নেমে এসে বীরচন্দ্রের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর পা দুটি স্পর্শ করলেন। বিনীতভাবে বললেন, প্ৰণাম মহারাজ। আপনার শরীর গতিক ভালো আছে। আশা করি। রানীদের সর্বাঙ্গীণ কুশল তো? রাজকুমারেরা … এসব ছলনা-বাক্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বীরচন্দ্র কঠোরভাবে বললেন, কী ব্যাপার, কৈলাস? তুমি আবার আমার রাজ্যে এসেছি যে! সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, একটু পিছিয়ে গিয়ে কৈলাসচন্দ্ৰ বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বললেন, এ রাজ্যটা আপাতত আপনার বটে। কিন্তু এখানে কেউ স্বাধীনভাবে আসা যাওয়া করতে পারবে না, এমন কোনও নিয়মের কথা তো শুনিনি!
বীরচন্দ্র বললেন, তুমি আমার সঙ্গে শক্রতা করতে এসেছ! আমার শক্ৰদেরও আমি স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে দেব?
কৈলাসচন্দ্র বললেন, আপনার শক্ৰতা করব কেন? আমি ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি। আপনি ন্যায়নিষ্ঠ, প্ৰজাপালক, আপনি নিশ্চিত আমার দাবির সত্যতা বুঝবেন। স্বৰ্গগত রাজা ঈশানচন্দ্রের নাবালক পুত্রের অছি হয়ে আপনি এই ক’ বৎসর রাজ্য চালিয়েছেন। এখন নবদ্বীপচন্দ্ৰ সাবালক হয়েছেন, এখন তাঁকে সিংহাসনের অধিকার দেওয়া ন্যায়সঙ্গত কি না, তা আপনিই বিচার করুন।
বীরচন্দ্ৰ ক্ৰোধে অস্থির হয়ে চিৎকার করে বললেন, কিসের অধিকার। যে-সে রাজা হতে পারে। রাজা হবার যোগ্যতা লাগে না? এই যে এতগুলো বছর আমি রাজ্য চালালাম, এখানে কত রকম সমস্যা, কত জাত-পাত, কতগুলো উপজাতি, সব দিক আমি সামলেছি! আমার আমলে কেউ বিদ্রোহ করেনি। ঠিক কিনা। ঘোষমশাই, তুমিই বল, ঠিক কিনা! যে-কেউ রাজা হয়ে বসলেই কি সামলাতে পারবে?
কৈলাসচন্দ্র বললেন, নবদ্বীপকে সিংহাসনে বসার সুযোগ দিলে তবেই তো সে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবে। তার আগে দেবে কী করে? তাছাড়া, যোগ্যতার বিচারে ভূ-ভারতে কে কবে রাজা-বাদশা হয়েছে? সবাই তো সিংহাসনে বসে পিতৃপরিচয়ে কিংবা রক্তের জোরে।
বীরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, নবা হারামজাদাটা কোথায়? সে তোমাকে পাঠিয়েছে?
কৈলাসচন্দ্র মুখের হাসিটি বজায় রেখে বললেন, আপনার দাদার ছেলে, পরলোকগত মহারাজের একমাত্র পুত্র, তাকে তো আপনি হারামজাদা বলতেই পারেন। নবদ্বীপ আর তার মাকে আপনি কারারুদ্ধ করে রেখেছিলেন। তারা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে কোথায় এখন আশ্রয় নিয়ে আছে, সে তথ্য আপনাকে আমি জানিয়ে দেব, আমাকে কি এতটাই মুর্খ মনে করেন আপনি?
— তোমাকেও আমি বন্দী করে চাবকাব। তা হলে তুমি ঠিকই মুখ খুলবে!
— সে চেষ্টা করে দেখুনই না, কী হয়!
— তলোয়ারের এক কোপে তোমার মুণ্ডু উড়িয়ে দেব। তোমার লাশ পুঁতে দেব জঙ্গলের মধ্যে, কেউ কোনওদিন আর তোমার সন্ধান পাবে না।
— এ কী মগের মুল্লুক নাকি! তাছাড়া আমাকে নিতান্ত হেঁজিপেঁজি ভাববেন না। আমি তত্ত্ববোধিনীর লোক। সব জানিয়ে শুনিয়ে এসেছি। দু’একদিনের মধ্যে আমি না ফিরলেই আমার খোঁজ পড়বে। তখন কান টানলেই মাথা আসবে।
বীরচন্দ্ৰ চোখ সঙ্কুচিত করে রাধারমণের দিকে তাকালেন। তিনি জানতে চান, তত্ত্ববোধিনীটা আবার কী বস্তু?
রাধারমণ বললেন, তত্ত্ববোধিনী ব্ৰাহ্মদের একটি নামকরা পত্রিকা। ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রবাবু তার মালিক, কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সবাই পত্রিকাটি পড়ে। কৈলাস সে পত্রিকার একজন কর্মী।
কৈলাসচন্দ্র বললেন, তা ছাড়া আমি এখানে মির্জা মহম্মদের বাড়িতে অতিথি, তার ভাই ঢাকা শহরে পুলিশের একজন কর্তা। ওঁরাও সব জানেন। আমার গলা কাটলে ইংরেজ ফৌজ চলে আসবে।
রাধারমণ বললেন, আহা, ওটা কথার কথা। মহারাজ উত্তেজনার বশে বলে ফেলেছেন। আসলে মহারাজ কারুকে কখনও কঠিন শাস্তি দেন না। কিন্তু কৈলাস, তুমি আমাদের বৃথা ভয় দেখাচ্ছ। আগেই তো সব মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মহারাজ বীরচন্দ্রের দাবি স্বীকৃত হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাহাদুর মহারাজের কাছ থেকে নজরানা নিয়েছেন, আবার নতুন কোনও ফ্যাকড়া বার করলেও তাঁরা মানবেন কেন?
কৈলাসচন্দ্ৰ মহারাজের সঙ্গে কথা বলার সময় একবারও গলা চড়াননি, বিনীত ভঙ্গিটি রেখেছিলেন, এবার রাধারমণের দিকে ফিরে গর্জে উঠে বললেন, নজরানা দিলেই সত্যটা মিছে হয়ে যাবে? পরলোকগত মহারাজের আপনি ঔরসজাত সন্তান থাকতেও রাজা হবে…রাজা হবে এক…রাজা হবে অন্য একজন! বিয়ের আয়োজন বন্ধ করো ঘোষজা, উকিল-মোক্তার ডাকো। তোমাদের আমি কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই!
বীরচন্দ্র প্রথম থেকেই ক্ৰোধে ফুঁসছিলেন, এর মধ্যে আবার তাঁর বুক ভরে গেল অভিমানে। কোনও শিশু যখন আঁকাবাঁকা ছবি আঁকে কিংবা গাছের একটা শুকনো ডালকে মূর্তি মনে করে বাবা-মাকে দেখবার জন্য ছুটে আসে, কিন্তু তারা মনোযোগ দেন না, তারিফ করেন না, তখন সেই শিশুর যেমন অভিমান হয়, বীরচন্দ্রেরও প্রায় সে রকম কান্না এসে গেল। তাঁকে কেউ বুঝল না। এই দুর্বল ত্রিপুরা রাজ্যটিকে তিনি নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেন না, তারা কর ফাঁকি দিলে তিনি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেন না। তাঁর পাইক-বরকন্দাজরা কোনও স্ত্রীলোকের ওপর অত্যাচার করলে কঠিন শান্তি পায়। কেউ তাকে এ জন্য মর্যাদা দেবে না? একটা অপদার্থ, দুর্বল, ছোকরা তাঁর বদলে সিংহাসনে বসবে?
মনোমোহিনীকে বিবাহ করবার জন্য তিনি শরীর-মনে প্রস্তুত হয়ে আছেন, তার ঠিক আগেই এই উৎপাত! এখানে অনেকেই যেন এই বিবাহটা পুরোপুরি পছন্দ করছে না। কেন? তিনি আর একটি বিবাহ করতে চাইলে কার কী ক্ষতি? রাজা হয়ে তিনি এই একটা সামান্য সাধও মেটাতে পারবেন না? অন্য রাজাদের মতন তিনি কি দু’তিনটি হারেম বানিয়েছেন? মনোমোহিনীকে বিয়ে করলে তাঁর বৈধ রানীর সংখ্যা হবে মাত্র আটজন। এই বংশেরই এক রাজা প্রতি মাসে একটি বিবাহ করতেন।
নিজেকে প্ৰাণপণে সংযত করে তিনি কৈলাসচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার সম্পর্কে আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলে? বলতে বলতে থেমে গেলে?
কৈলাসচন্দ্ৰ মহারাজের দিকে না ফিরে রাধারমণের দিকেই তীব্ৰ চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলখাল্লার ভেতর থেকে সাদা রঙের লেফাফাটি বার করে দোলাতে দোলাতে বললেন, তোমরা ভাবছ আমি ধাপ্পা দিতে এসেছি? মোক্ষম একটা অস্ত্র এসেছে আমাদের হাতে, নতুন প্রমাণ। শোনো, শুনে নাও! রাজা বীরচন্দ্ৰ এক জারজ সন্তান। তাঁর জন্মের সময় তাঁর মা ছিলেন কুমারী। এটা উনি নিজে না জানতে পারেন, কিন্তু দলিল আছে। সিংহাসনে বসার হক নেই ওঁর।
এ কথা শুনেও বীরচন্দ্ৰ বিচলিত হলেন না। তিনি শান্তভাবে বললেন, এটা নতুন কোনও প্রমাণ নয়। এ কথা আমি জানি। আমার জন্মের পর আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য। ত্রিপুরার আইনে এই বিবাহ অসিদ্ধ নয়, পূর্বজাত পুত্ৰও বারবার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আমার সব কিছুই বৈধ।
কৈলাসচন্দ্ৰ এবার রাজার দিকে ফিরে বললেন, বৈধ কি না তা আদালতেই প্রমাণিত হবে। আপনার অন্য দুই বড় ভাইদের নামে জারজ অপবাদ দিয়েই তাদের সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, মনে নেই? চক্ৰধ্বজ, নীলকৃষ্ণরা আজ সর্বস্বান্ত। গুরু বিপিনবিহারীকে আপনি জেলের মধ্যে দগ্ধে মেরেছেন!
এই মুহূর্তে বীরচন্দ্রের ক্রোধের অগ্নি ও অভিমানের বাষ্প মিশে গিয়ে আগ্নেয়গিরির লাভার মতন বিস্ফোরিত হল। তিনি কৈলাসের দিকে মুষ্টি তুলে বললেন, পা-চাটা কুক্কুর! বেল্লিক! তোর বাপ-পিতামহ আমাদের বংশের নুন খায়নি? তুই নিমকহারামের মতন এমন কথা বলতে পারলি?
একটুখানি সরে গিয়ে কৈলাসচন্দ্র বললেন, আমার বাপ- আপনার বংশের নুন খেয়েছে তা ঠিক। কিন্তু আপনার নুন কেউ খায়নি। সেইজন্যই তো আমি এই বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারীর প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছি! রাধারমণ ওঁদের দুজনের মাঝখানে চলে এসে কৈলাসচন্দ্রের কাঁধে হাত রেখে বললেন, কৈলাস, তুমি নিশ্চয়ই শুধু আমাদের ভয় দেখাতে আসোনি। তোমার অন্য উদ্দেশ্য আছে। কত চাও?
কৈলাসচন্দ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ঘুষ? জানি, ঘুষ-তঞ্চকতা-ফেরেববাজিতে দেশ ছেয়ে গেছে, গোল্লায় গেছে সব নৈতিকতা, তোমরাও এ সবের মধ্যে ডুবে আছ। তাই সব মানুষকেই তোমাদের মতন ভাব। তুমি যে এই কথাটা বললে, সে জন্য তোমাকেও ছাড়ব না, এই মামলায় জড়িয়ে তোমাকে দিয়েও জেলের ঘানি ঘোরাব। ছিঃ, ঘোষের পো, ছিঃ! একটা কথা জেনে রেখো, ঘুষের লোভ দেখিয়ে ব্ৰাহ্মদের বশ করা যায় না। ব্ৰাহ্মরা সত্যের পূজারী, তারা লোভ, বিলাসিতা, মাৎসর্যের অনেক ঊর্ধ্বে।
সগৰ্বে মাথা তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন কৈলাসচন্দ্র।
বীরচন্দ্রের কাঁধ দুটি ঝুলে পড়েছে। তিনি আর কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। রাধারমণ এবার আক্রমণোদ্যত সিংহের মতন শরীর ঝাড়া দিলেন। কৈলাস এতক্ষণ ধমকের সুরে কথা বলেছে, তিনি যথাযোগ্য উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু কৈলাসচন্দ্ৰকে এইভাবে জয়ীর মতন চলে যেতে দেওয়া যায় না।
তিনি হেঁকে বললেন, ওহে নব্য ব্ৰাহ্ম কৈলাস, তুমি আমার আর একটি কথা শুনে যাও। তুমি খুব বারফট্টাই করলে, কিন্তু বেশ কিছু ব্রাহ্মের মহত্ত্বের মুখোসের আড়ালে আমি তাদের লোভী, অর্থ গৃধু, স্বার্থপর, ঈর্ষাপরায়ণ মুখ দেখেছি! ঘোমটার আড়ালে খ্যামটাও কম দেখিনি! আমি ঘুষের প্রস্তাব করিনি তোমার কাছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কুমার নবদ্বীপচন্দ্ৰকে কত ক্ষতিপূরণ দিলে তোমরা খুশি হবে। যদি তা কানে তুলতে না চাও, তা হলে যাও, মামলা করে! ঘোষ বংশের পুরুষরা কখনও মামলা-মোকদ্দমায় ভয় পায় না। কত মামলা তুমি করতে পার দেখব! তোমাদের কত মুরোদ আছে তাও বোঝা যাবে। কত টাকা আছে ওই নবদ্বীপের? আমরা বছরের পর বছর মামলা টানব, হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোটে যাব, দরকার হলে তার পরেও যাব লন্ডনের প্ৰিভি কাউন্সিলে। সেখানে যেতে পারবে ওই ছোকরা নবদ্বীপ? তাকে আমরা পথের ভিখিরি করে ছাড়ব! ত্রিপুরার ঠাকুরলোকেরা কেউ ওই নিঃসম্বল কুমারের হয়ে সাক্ষী দিতে যাবে না। মামলার ভয় দেখাচ্ছ আমাদের?
মহারাজ বীরচন্দ্রও তাঁর সচিবের সতেজ উক্তিতে ভরসা পেয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, আমার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, প্রয়োজনে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়ে মামলা লড়ব। শেষ পর্যন্ত যাব। তার পরেও যদি দৈবাৎ বিচারবিভ্রাটে রায় আমাদের বিরুদ্ধে যায়, তা হলেও রাজমুকুট নবদ্বীপ পাবে না। এ রাজমুকুট আমি নামিয়ে দেব ইংরেজের পায়ের কাছে। ত্রিপুরা শেষ হয়ে যায় যাক।
এই প্রথম একটা জোর ধাক্কা খেলেন কৈলাসচন্দ্ৰ, অবিশ্বাসে অস্পষ্ট হয়ে গেল তাঁর মুখ। আর্ত কণ্ঠে বললেন, সে কি, মহারাজ, ত্রিপুরার স্বাধীনতা আপনি ইংরেজদের কাছে বিকিয়ে দেবেন! আমরা এখনও স্বাধীন বলে কত গর্ব করি। কত সুপ্রাচীন এই রাজবংশের ধারা-
বীরচন্দ্র বললেন, আমি চলে গেলে ত্রিপুরার স্বাধীনতা এমনিতেই যাবে। ইংরেজরা জাল গুটিয়ে আনছে, আমি তাদের এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছি। কুকি বিদ্রোহের ছুতোয় একবার ইংরেজ ফৌজ এ রাজ্যে ঢুকে পড়েছিল। আবার যদি কেউ কুকিদের উস্কানি দেয়, তারা ফুঁসে উঠলে চতুর্দিকে রক্তগঙ্গা বইবে, তা সামলাতে পারবে ওই মুৰ্থ, ভীরু নবদ্বীপ? রাজ্যে অরাজকতা, প্রজার সর্বনাশের চেয়ে ইংরেজ-শাসনও ভালো।
রাধারমণ বললেন, ত্রিপুরার স্বাধীনতা যদি যায়, তা হলে তোমরাই তার জন্য দায়ী হবে, কৈলাস। মহারাজকে সরাবার চেষ্টা করে তোমরা নিজেরাও সর্বস্বান্ত হবে, ত্রিপুরা রাজ্যও ধ্বংস হয়ে যাবে।
সবেগে মাথা নেড়ে কৈলাসচন্দ্র বললেন, না, না, ত্রিপুরার স্বাধীনতা নষ্ট হোক, তা আমি কোনওক্রমেই চাই না। যেকোনও ভাবেই হোক, এ রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করতেই হবে।
রাধারমণ বললেন, তা হলে শোনো, অযথা মামলা-টামলার মধ্যে যেও না। মাথা ঠাণ্ডা করো। তুমি বরাবরই রাগচটা। মহারাজের অনুমতি না নিয়েই বলছি, তোমার ওই নবদ্বীপচন্দ্রের জন্য আমরা মাসিক পাঁচশ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেব। তাই নিয়েই তাকে খুশি থাকতে বলো! ফিরে এসে তক্তপোশের ওপর ধপাস করে বসে পড়ে কৈলাসচন্দ্র বললেন, পা-চ-শ টা-কা।
এর পর আর তর্ক কিংবা হুমকি নয়, আলোচনা এগোল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে।
শেষ পর্যন্ত মনোমোহিনীর সঙ্গে বীরচন্দ্রের বিবাহ সুসম্পন্ন হল নির্বিঘ্নে। আড়ম্বরের আতিশয্য নেই, সেই রাতেই ফুলশয্যা। করেণুকার মহলটিতে নতুন আসবাব ও পালঙ্ক,এসেছে, ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে সব দেওয়াল। ঘরের চারকোণে চারটি উজ্জ্বল লণ্ঠন। মহারানী ভানুমতীর অলঙ্কারে সেজে, লাল মসলিনের শাড়ি পরে পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে আছে মনোমোহিনী। তার দু’কানের হীরের দুল ঠিকরে পড়ছে আলো, নববধুসুলভ ব্রীড়া নেই তার মুখে, দু চোখে শুধু কৌতূহল। মধ্যরাত্রে বীরচন্দ্ৰ প্ৰবেশ করলেন সেই কক্ষে, গায়ের সিস্কের জামাটি গেছে ঘামে, মুখে ক্লান্তির চিহ্ন, সারাদিন অনেক ধকল গেছে, বিবাহের অনুষ্ঠান ছাড়াও হঠাৎ সন্ধ্যাকালে ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্ট এসে উপস্থিত, পরস্পর কাটাকুটি করেছেন কূটনৈতিক চাল। এতক্ষণ পর পাওয়া গেছে বিশ্রামের সময়। নিছক একটি কিশোরীর প্রতি তাঁর লোভ জাগেনি, তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এই বিশেষ দুরন্ত কিশোরীটির প্রতি, সেই জন্যই মনোমোহিনীকে বিবাহের জন্য এত ব্যস্ত হয়েছিলেন।
ভেতরে এসে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে নববধূর রূপ দর্শন করতে লাগলেন। হঠাৎ তার দৃষ্টিবিভ্রম হল। পালঙ্কের ওধারে এই কিশোরীটি কে? এ যে ভানুমতী! ঠিক এই বয়েসেই ভানুমতী এসেছিল বাসরশয্যায়, এই অলঙ্কারগুলিহ ছিল তার অঙ্গে। সেই বয়েসের ভানুমতীর সঙ্গে মনোমোহিনীর মুখের যে আশ্চর্য মিল, তা বীরচন্দ্র এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলেন। অভিমান ভরে ভানুমতী প্রাণত্যাগ করেছিল, আবার সে-ই কি তবে ফিরে এল এই রাতে! না, না। তা কী করে সম্ভব! অথচ বীরচন্দ্র মনোমোহিনীর বদলে স্পষ্ট দেখছেন তার কৈশোরের খুনসুটির সঙ্গিনীকে। চোখ দেখছে এক,, অথচ মন জানে সে নেই, সে নেই।
অবসন্ন ভাবে পালঙ্কে ঠেস দিয়ে মহারাজ অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলেন ;
দেবি! তুমি তো স্বরগ পুরে, জানি নাকো কতদূরে
কোন অন্তরাল দেশে করিতেছ বাস
পশিতে কি পারে তথা মানবের আশালতা…
মনোমোহিনী এগিয়ে এসে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করল, কী বলছেন, প্রভু? বুঝতে পারছিনা।
বীরচন্দ্র দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললেন। এই নতুন বিবাহের রাতে তিনি সত্যিকারের শোকাভিভূত হলেন তাঁর প্রথম রানীর জন্য।