পঁয়তাল্লিশ
জানলায় কলকাতা ঠিকঠাক, একটুও পালটায়নি। ট্রাম বাস চলছে যেমন চলত ওরা আন্দোলন শুরু করার আগে, মানুষজনেরা ঠিক তেমনি অলস কিংবা ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। মেট্রো সিনেমার সামনে বিরাট লাইন পড়েছে টিকিটের। ফুটপাতে বিদেশি জিনিস কিনবার জন্য জনস্রোত বইছে। অর্থাৎ কলকাতা ঠিক কলকাতাতেই আছে। এত বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল, এত ছেলে মরে গেল কিংবা বেঁচে মরে থাকল তাতে কলকাতার কিছু এসে গেল না। অনিমেষের বুক হঠাৎ টনটন করে উঠল। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে এই কলকাতা দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে সে নিজের পঙ্গু পায়ের ওপর হাত রাখল।
দলের লোকজন কে কোথায় আছে সে জানে না। যারা বাইরে আছে তারা এখন কী ভাবনাচিন্তা করছে, আদৌ করছে কি না তাও অজানা। এই কলকাতার চেহারা দেখে সে-কথা মনে হয় না। আর এখন তার শরীরের অবস্থা যেরকম, কেউ যোগাযোগ করবে বলে মনে হয় না। কার কী প্রয়োজনে সে লাগতে পারে! প্রয়োজন শব্দটা মনে আসতেই সে সচকিত হল। মাধবীলতা তার পাশে বসে আছে। যদিও দু’জনের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব তবু মাধবীলতা তাকে কী প্রয়োজনে ওর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে? অনিমেষের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। শেষ দেখার সময়, লালবাজারে পুলিশের সামনের স্মৃতি অনুযায়ী মাধবীলতা সন্তানসম্ভবা ছিল। তারপর কী হল? মাধবীলতার কি সন্তান হয়েছে? একা একা এই কলকাতা শহরে কোনও কুমারী মেয়ে কী ভরসা ও সাহসে সন্তানবতী হয়ে তাকে মানুষ করে অন্য কারও অপেক্ষায় থাকতে পারে? হঠাৎ অদ্ভুত একটা হীনন্মন্যতাবোধ অনিমেষকে ঘিরে ধরল। তার মনে হতে লাগল, মাধবীলতা তাকে হারিয়ে দিয়েছে সর্বক্ষেত্রেই। বোলপুরে ক্ষণিকের উত্তেজনা তাকে মাঝে মাঝেই বিদ্ধ করত। তার ক্ষেত্রে শুধু এই যন্ত্রণাটুকু যা কিনা বাইরের নানান কাজের চাপে মাঝে মাঝেই চাপা পড়ে যায়। কিন্তু মাধবীলতাকে সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তাকে একা একা লড়াই করতে হয়েছে এই সমাজের সঙ্গে, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে এবং প্রতীক্ষা করেছে কবে অনিমেষ মুক্তি পাবে। এবং এখন অনিমেষ পরিচিত সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল যে হীনতাবোধে ঠিক তার বিপরীত চিন্তায় মাধবীলতা অনিমেষকে গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর। সে-অনিমেষ সুস্থ কিংবা পঙ্গু যাই হোক তাতে মাধবীলতার কিছুই এসে যায় না। এখানেই মাধবীলতার জিত। হঠাৎ অনিমেষের মনে একটা আলোড়ন এল। মাধবীলতা একা এসেছে। ওর সন্তান—! কথাটা ভাবতেই আর-একবার লজ্জিত হল অনিমেষ। সে তো ভাবতে পারল না আমাদের সন্তান! এ কি শুধু অনভ্যাসেই! সে মেয়ে না ছেলে তা অনিমেষ জানে না। তবে ক্রমশ তাকে দেখার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল।
এবার মাধবীলতার দিকে স্পষ্টচোখে তাকাল অনিমেষ। অন্যমনস্ক কিনা বোঝা যাচ্ছে না, মাধবীলতা জানলার বাইরে দৃষ্টি রেখেছে। ট্যাক্সিটা এখন হ্যারিসন রোডের মুখে দাঁড়িয়ে। সার দিয়ে গাড়িগুলো অনড় হয়ে আছে। মাধবীলতার মুখে এখন কয়েকটা গাঢ় রেখা, চুল পাতলা হয়েছে, শাড়িটাও বেশ আটপৌরে। এরকম মেয়েকে পথেঘাটে অজস্র দেখা যায়। খুব ক্লান্ত একটা ছায়া ওদের ঘিরে রাখে। হঠাৎ মাধবীলতা সোজা হয়ে বসল। মুখ বাড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। তারপর একটা বিরক্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘যাচ্চলে, আবার মিছিল বেরিয়েছে।’
ততক্ষণে অনিমেষ দেখতে পেয়েছে। কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে অনেকটা রাস্তা জুড়ে একটা মিছিল বিপরীত দিক থেকে আসছে। তারা চিৎকার করে নানারকম দাবি জানাচ্ছে। ভঙ্গিটা খুবই চেনা, যে-কোনও রাজনৈতিক দল এই একই ভঙ্গিতে বিক্ষোভ জানায়। ওদের যাত্রা শেষ হবে এসপ্লানেড ইস্ট-এ। তারপর মিছিলের লোক ফুচকা খাবে কিংবা সিনেমা দেখবে। এক ধরনের ঘেন্না হল অনিমেষের। এ যেন ঈশ্বরের কাছে গিয়ে হত্যে দেওয়া, দয়া করো, দয়া করো বাবা, তারপর জলটল মুখে দিয়ে মেলা দেখতে যাওয়া। যারা নিয়ে যায় তারা জানে নিয়ে যেতে হবে, যারা যায় তারা জানে যেতে হবে এবং যাদের কাছে যাওয়া হয় তারাও জানে ওরা আসবে। এইরকম ন্যাকামিতে শরীর গুলিয়ে ওঠে।
হাজার হাজার মানুষ ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে ঘাম ঝরাতে ঝরাতে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে কখন এই মহৎ পদযাত্রা শেষ হবে এবং তারা তাদের প্রয়োজনে যেতে পারবে। অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাতে যেতেই ড্রাইভারের আয়নায় দৃষ্টি গেল। সেখানে মাধবীলতার চোখ, এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিমেষ বলল, ‘আমি তোমার কথা কিছুই জানি না।’
‘কী কথা?’
‘তুমি কেমন ছিলে?’
‘ছিলাম, এই পর্যন্ত।’
‘আমি তোমার চিঠির উত্তর দিইনি, তোমার সঙ্গে দেখা করিনি, কেন করিনি তা নিয়ে তুমি কিছু ভেবেছ?’
‘তুমি ভাল মনে করেছ তাই ওইরকম করেছ, আমি কী বলব।’
‘তবু তুমি আমাকে নিতে এলে?’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছ।’
‘কিন্তু কেন?’
‘তুমি বুঝবে না।’
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধার পর অনিমেষ কথাটা তুলল। মাধবীলতার মুখ জানলার দিকে ফেরানো। ট্যাক্সিটা এখনও নড়ছে না। জিভ ভারী হয়ে আসছিল অনিমেষের, শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল, ‘তুমি কি একা আছ?’
‘একা?’ যেন চমকে উঠল মাধবীলতা, ‘না একা থাকব কেন? আমি আর আমার ছেলে থাকি।’ কথাটা বলে মাধবীলতা পূর্ণদৃষ্টিতে অনিমেষের দিকে তাকাল।
অনিমেষের মনে হল কেউ যেন একটা লোহার বল ওর হৃৎপিণ্ডে বেঁধে দিল। এইসময় গাড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলা শুরু করল। চোখের পাতা অকস্মাৎ ভারী হয়ে এল, অনিমেষ প্রাণপণে চেষ্টা করছিল যাতে জল গড়িয়ে না-আসে।
কিছুক্ষণ বাদে সে বলতে পারল, ‘ও এখন কত বড় হয়েছে?’
হেসে ফেলল মাধবীলতা, ‘তোমার হিসেব নেই?’ তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘স্কুলে পড়ছে।’
‘কোথায়?’
‘আমাদের পাড়াতেই। বড় স্কুলে পড়াবার সামর্থ্য আমার নেই।’
‘তুমি এখনও পুরনো স্কুলেই পড়াচ্ছ?’
‘না, নতুন স্কুল খুঁজে নিতে হয়েছে।’
‘কোনও অসুবিধে হয়নি?’
‘কীসের?’
অনিমেষের ইচ্ছে হচ্ছিল বিশদভাবে মাধবীলতার সব কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু একটা আড়ষ্টতাবোধ তাকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলছিল যে সহজভাবে কথা বলতে পারছিল না। এই ব্যাপারটা বুঝতে মাধবীলতার একটুও বিলম্ব হল না। সে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘এই দেশে একটা কুমারী মেয়ের শরীরে সন্তান এলে তাকে কী কী সমস্যায় পড়তে হয় তা তুমি জানো না? আমি নিজেকে কুমারী মনে না-করলেও পাঁচজনে সে-কথা মানবে কেন?’
শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলতে পারল, ‘আমাকে সব কথা খুলে বলো।’
‘কী বলব! আমার কিছুই বলার নেই।’
‘কিন্তু—’
‘অনিমেষ! আমি যা করেছি সেটা খুব সামান্য। নিজের মুখে সেসব কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না। তুমি তো অনেক কিছু ভাবতে— দেশের কথা, অনেক মানুষের কথা; আমার মতো একটা সাধারণ মেয়ের কষ্টের কথা তুমি ভেবে নিতে পারবে না?’
অনিমেষ নিশ্বাস ফেলল, ‘তুমি ‘আমার ছেলে’ বললে কেন? আমার পরিচয়—।’
মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘তুমি এখনও ছেলেমানুষ রয়েছ, মুখে যাই বলো না কেন।’
‘মানে?’
‘যে-কোনও সন্তান প্রথমে তো মায়েরই। তা ছাড়া, তুমি তো কিছুই জানো না, খোঁজও রাখোনি, তোমার ছেলে বলি কোন সাহসে?’
‘কিন্তু আমিই তো ওর, মানে, আমি—।’
‘বলতে পারছ না, আমি ওর বাবা!’
‘হ্যাঁ তাই। তোমার পক্ষে যতটা সহজ আমার পক্ষে ততটা নয়। তুমি ওকে জন্ম দিয়েছ, প্রতিদিন মানুষ করেছ, তোমার সমস্ত অভ্যাসে ও মিশে রয়েছে।’
‘সত্যি কথা। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটাকে আমি আকণ্ঠ গ্রহণ করেছিলাম। তারপর তিল তিল করে সেই আনন্দটুকু আমার শরীরে বড় হল। অনেক আঘাত অনেক অপমান সয়েও আমি সেই আনন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। তোমার মনে সেসব চিন্তা হয়তো আসেনি। তোমার কাছে সেটা একটা মুহূর্ত কিংবা একটা রাত হয়েই রইল, তার বেশি কী করে ভাববে? যেমন ধরো, যেতে যেতে কেউ হয়তো কাউকে একটা কথা বলল। যে বলল সে হয়তো নানান কাজের ভিড়ে কী বলেছিল ভুলেই গেল। যাকে বলল সে কিন্তু চিরজীবন সেই কথাটাকে আঁকড়ে ধরে রইল। সেই ধরে থাকাটা কিন্তু অনেক শক্তি দেয়।’
এই মাধবীলতা অন্যরকম। অনেক গভীর খাদের তলায় দাঁড়িয়ে চুড়োর দিকে তাকানোর মতো অনিমেষ মাধবীলতার কথাগুলো শুনল। সে আর কথা বলতে পারল না। ক্রমশ এক ধরনের হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ওর মনে হচ্ছিল সে মাধবীলতার সমান যোগ্যতা নিয়ে কোনওদিন ছেলেটির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এই পঙ্গু শরীর নিয়ে ছেলেটির কোনও উপকারই সে করতে পারবে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে আচমকা অনিমেষের শরীর শিহরিত হল। তার ছেলে এই পৃথিবীতে এসেছে। সরিৎশেখর, মহীতোষ এবং অনিমেষের রক্তস্রোত সেই ছেলেটির শিরায় বইছে। মাধবীলতা তাকে পরম যত্নে বাঁচিয়ে রেখে চলেছে। নিজের সন্তানকে দেখবার প্রচণ্ড আগ্রহ অনিমেষকে উত্তেজিত করল। আজ যদি মাধবীলতা তাকে চিনিয়ে না-দেয় তা হলে কি সে ছেলেটিকে চিনতে পারবে? তার চোখ মুখ হাঁটাচলার ভঙ্গিতে কি অনিমেষ আছে? অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ছুটন্ত ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো ভিজে টসটস করছে, যে-কোনও মুহূর্তে জলের ধারা গড়িয়ে পড়বে গালে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দু’হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ট্যাক্সির সিটের এই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে আর-একবার সজাগ হল সে। দু’হাতে ভর করে শরীরটাকে হিঁচড়ে মাধবীলতার কাছে গিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করা যায় না। নিজের কাছেই বড় দৃষ্টিকটু ঠেকে।
শ্যামবাজার ছাড়িয়ে ট্যাক্সিটা আর জি কর হসপিটালের পাশ দিয়ে সোজা চলে এল বেলগাছিয়ায়। মাধবীলতা ডানদিকের একটা রাস্তায় ড্রাইভারকে ঢুকতে বলল। এদিকে কখনও অনিমেষ আসেনি। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এদিকটা চিনলে কী করে?’
‘আমার স্কুলের একজন টিচার এখানে থাকেন।’
‘তুমি কি তাঁর সঙ্গেই আছ?’
‘না। তিনি এই মুখের বাড়িটায়, আমি ভেতরে।’
দেখতে দেখতে একটা বস্তি মতো এলাকা এসে গেল। রাস্তা খুব সরু। নর্দমার জল উপচে এসে একটা দিক ডুবিয়ে দিয়েছে। অর্ধ-উলঙ্গ ছেলেমেয়েরা রাস্তায় খেলছে। তাদের সামলে ট্যাক্সিটার এগোতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। একটা চায়ের দোকানের সামনে ট্যাক্সিটাকে দাঁড়াতে বলল মাধবীলতা। বোধহয় এই গলিতে গাড়ি খুব কমই ঢোকে কারণ ততক্ষণে একরাশ ছোট ছেলেমেয়ে জুটে গেছে গাড়ির সামনে পেছনে। ড্রাইভার সমানে চিৎকার করেও তাদের সরাতে পারছে না। ভাড়া মিটিয়ে মাধবীলতা দরজা খুলে অসহায়ের ভঙ্গিতে এ-পাশ ও-পাশ তাকাতেই চায়ের দোকান থেকে কয়েকটি ছেলে নেমে এল। অনিমেষ তাদের চেহারা দেখল। টিপিক্যাল মাস্তানদের চেহারা সব পাড়াতে একই ধরনের হয়। সাদা কালো প্যান্টের ওপর চকরা-বকরা শার্ট, মোটা বেল্ট, হাতে বালা, ভাঙাচোরা শীতল মুখগুলো মাধবীলতার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে দিদি?’
মাধবীলতা বলল, ‘একটু বিপদে পড়েছি ভাই। তোমাদের দাদাকে নিয়ে এসেছি। উনি হাঁটতে পারেন না—।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব জানি। পুলিশের অত্যাচার তো! আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা দাদাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
হইহই করে ছেলেগুলো বাচ্চাদের গাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে দিল। তারপর এ-পাশের দরজা খুলে দু’জন খুব সতর্ক ভঙ্গিতে অনিমেষকে গাড়ি থেকে বের করে নিল। মানুষের কাঁধে ওঠার অভিজ্ঞতা এইভাবে প্রথম, অনিমেষ অস্বস্তিতে মাথা নিচু করেছিল। ততক্ষণে বোধহয় চারধারে খবর হয়ে গেছে। পিলপিল করে বস্তি থেকে কাচ্চাবাচ্চা মেয়েরা বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখছে। মাধবীলতার পিছু পিছু ছেলেরা অনিমেষকে নিয়ে এগোচ্ছিল। যেতে যেতে অনিমেষের কানে নকশাল শব্দটা বারবার প্রবেশ করছিল। এরা যে ওকে খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে তা বোঝা যাচ্ছে। মাধবীলতাকেও হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। কবে ছাড়ল দিদি, একদম হাঁটতে পারেন না, আহা— পুলিশ পুলিশ না পশু— এইসব। অনিমেষ বুঝল মাধবীলতা এখানে বেশ পরিচিত এবং তার ইতিহাসের কিছুটা এই বস্তির মানুষ জানে।
বড় গলি থেকে সরু গলিতে ঢুকল মাধবীলতা। দু’পাশে চাপা ঘরের সারি। তার পরই একটা দেওয়াল। সদর দরজার পর চিলতে উঠোন। উঠোনের চারধারে চারটে ঘর। একটা বন্ধ দরজার তালা খুলে মাধবীলতা ইঙ্গিত করতে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা তক্তাপোশের ওপর বসিয়ে দিল। সামনের উঠোনে সমস্ত বস্তি যেন ভেঙে পড়েছে। সবাই মুখ ঢুকিয়ে অনিমেষকে দেখতে চায়। মাধবীলতা ততক্ষণে দুটো বালিশ অনিমেষের পেছনে এনে রেখেছে যাতে সে আরাম করে বসতে পারে।
মাস্তান ছেলেগুলো, যেন একটা বিরাট কাজ করেছে এমন ভঙ্গিতে মাধবীলতাকে বলল, ‘কোনও দরকার হলে বলবেন, আমরা সবসময় আছি।’
মাধবীলতা মুখে কিছু না-বলে ঘাড় নেড়ে হাসল।
একটি ছেলে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, আপনি কীসে স্পেশালিস্ট? পেটো না পাইপ?’
অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘দুটোর একটাতেও না। আিম ওসব কিছুই জানি না।’
‘তা বললে শুনব কেন? শুনেছি আপনি অনেক পুলিশের লাশ শুইয়ে দিয়েছেন। তা কি এমনি এমনি হয়! ঠিক হ্যায়, পরে আপনার কাছ থেকে সব জেনে নেব। এখন চলি।’
ছেলেগুলো আর-একটা উপকার করল। যাওয়ার আগে বাইরের সব ভিড় সরিয়ে বাড়ি খালি করে দিয়ে গেল। শুধু পাশের তিনটে ঘরের বউ বাচ্চারা কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে কৌতূহল মেটানোর পর ঘরটায় শান্তি এল।
দরজা থেকে ফিরে মাধবীলতা বলল, ‘এখানে সবাই সবাইকে এমন করে চেনে-না, না-চাইলেও এইরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়!’
অনিমেষ বুঝতে পারছিল মাধবীলতা তাকে এই পরিবেশ সইয়ে দিতে চাইছে। এখানে আসার পর থেকেই অনিমেষের চোখ সন্ধানে ছিল কিন্তু তেমন কাউকে সে দেখতে পায়নি। অন্তত এই ঘরে যে ছেলেকে মাধবীলতা রেখে যায়নি সেটা তালা খোলা থেকেই বোঝা যায়।
খুবই সাধারণ ঘর। মেঝেটা সিমেন্টের, দেওয়ালও। কিন্তু ছাদ টিনের। এখনই বেশ গরম হচ্ছে। এই ঘরের ভাড়া কত অনুমান করা অসম্ভব। একটা তক্তাপোশের ওপর পাতলা তোশক রঙিন চাদর ঢাকা, শস্তার আলনায় কিছু শাড়ি আর বাচ্চাদের জামাপ্যান্ট ঝুলছে, ওপাশে তক্তাপোশের মাথার কাছে একটা কেরোসিন কাঠের টেবিলে কিছু বইপত্র চিঠি ছাড়া অন্য কোনও আসবাব ঘরে নেই। ঘরের এক কোনায় কিছু হাঁড়িকড়াই, কলাইয়ের থালা, চায়ের কাপডিশ কেটলি আর স্টোভ দেখে বোঝা যায় রান্নাবান্না এখানেই সারতে হয় মাধবীলতাকে। মাধবীলতা বলল, ‘আমাদের খেতে একটু দেরি হবে আজকে। এখনও তেল পাইনি।’
‘তেল?’
‘কেরোসিন। আমার তো স্টোভই ভরসা। মোড়ের দোকানে বলে রেখেছি। তেল না-পেলে হোটেল থেকে খাবার আনতে হবে।’
‘তা হলে তো মুশকিল।’
‘এইসব মুশকিল নিয়েই তো আমাকে থাকতে হয়। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।’
‘তুমি কখন বের হও স্কুলে?’
‘সকালে। রান্না করে দু’জনে খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।’
‘দু’জনে?’
‘ও স্কুলে যায়। ছুটির পরে দু’ঘণ্টা যাতে স্কুলে বসে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করেছি। তার মধ্যে চলে আসি আমি। ও অবশ্য থাকতে চায় না, কী করা যাবে!’
‘তোমরা একা থাকো, এখানে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলে না?’
‘না। সমাজের উঁচু তলায় যেমন মানুষ মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না, ঠিক এই নিচুতলার মানুষেরা তেমনি ঘোঁট পাকায় না। যত কিছু গোলমাল তা ওই মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে। আমি এখানে বেশ আছি।’
‘ছেলের কোনও অসুবিধে হয় না?’
‘হয়। গালাগালি শুনছে দিনরাত। শিখছেও নিশ্চয়ই। আমি যেটুকু পারি সামলে রেখেছি। কদ্দিন পারব জানি না।’
‘বুঝলাম।’
‘কী বুঝলে?’
‘আমার কোনও ভূমিকা নেই!’
‘সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি যদি এখানে না-থাকতে চাও তা হলে আমার কী সাধ্য তোমাকে আটকে রাখি। আমি তোমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এলাম কারণ আমি চাই ছেলে তোমাকে একবার দেখুক। তুমি যদি বলো ওর পিতৃত্বের কোনও দায়িত্ব তুমি নেবে না, আমি কি তোমাকে জোর করতে পারি! চা খাবে?’
‘না।’
‘যা তেল আছে দু’কাপ চা হয়ে যেত।’
‘ভাল লাগছে না।’
মাধবীলতা এগিয়ে এসে অনিমেষের সামনে বসল। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, ‘অনিমেষ, আমাদের আইনসম্মত বা সামাজিক বিয়ে হয়নি। তুমি সেগুলোকে মানো কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু যে মেয়ে এত বছর ধরে সন্তানকে বড় করেছে তার কাছে ওসবের কোনও মূল্য নেই। এখন আমি নতুন করে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি ভেবে দেখো, আমি জোর করব না।’
‘কী ভাবতে বলছ?’ অনিমেষ হেসে ফেলল।
‘হাসির কথা নয়। তুমি কি আমাকে স্ত্রী বলে মনে করো?’
‘এ প্রশ্ন কেন? আমি কি তোমাকে সেভাবে পরিচয় করাইনি?’
‘তা হলে আমার জন্যে অপেক্ষা না-করে তুমি ওদের সঙ্গে চলে গেলে কেন? আমি যে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি তুমি জানতে না?’
এই প্রথম অনিমেষ মাধবীলতাকে থরথর করে কেঁপে উঠতে দেখল। মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখল সে। মাধবীলতা খাদের শেষপ্রান্তে এসে অনেক চেষ্টার পর নিজেকে সামলে নিল। অনিমেষ বলল, ‘কোনওদিন তোমাকে কিছু দিতে পারিনি, শুধু দু’হাত ভরে তোমার কাছ থেকে নিয়েই চলেছি। এ যে আমার কী লজ্জা—!’
মাধবীলতা মুখ তুলল। সেই মুখ, যা কিনা শত পদ্মের চেয়ে উজ্জ্বল, বলল, ‘তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না। আমি তো তোমার কাছ থেকে কিছুই চাইনি কোনওদিন, শুধু তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে মনে হয় তা আমার জন্যেই করছি— এইটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করবে কেন?’
অনিমেষ দু’হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল। বোধহয় এইরকম মুহূর্ত মাধবীলতার জীবনে অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষায় ছিল। সে শিশুর মতো অনিমেষের বুকে মুখ রাখল। ওরা অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না। পেছনে দরজা হাট করে খোলা এই খেয়াল এখন ওদের নেই। অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল, ‘লতা, আমাকে ক্ষমা করো।’
সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল মাধবীলতা। তারপর অনিমেষের চোখে ভেজা চোখ রেখে বলল, ‘ছি! আমাকে এভাবে তুমি ছোট কোরো না।’
তারপর একটু সজাগ হয়ে বলল, ‘দেখেছ কাণ্ড, দরজাটা খোলা রয়েছে সে-কথা মনেই নেই। তুমি বসো, আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
অনিমেষ বলল, ‘আমার খিদে নেই।’
মাধবীলতা হাসল, ‘আমার আছে। আর তিনি তো এখনই এক পেট খিদে নিয়ে আসছেন। তুমি বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘সে কোথায়?’
‘স্কুলে। আজকে হাফ ছুটি। আসবার সময় আমি নিয়ে আসব। তুমি ততক্ষণ একটু জিরিয়ে নাও।’
‘ঠিক আছে।’
‘আচ্ছা, তুমি ক্রাচ নিয়ে চলতে পারবে কিনা জানো?’
‘না।’
‘তা হলে একটা হুইল চেয়ার কিনতে হয়।’
‘তার অনেক খরচ। তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। আমার যা করে হোক চলে যাবে। শুধু ভাবছি, একা এমনভাবে বসে বসে সারা দিনরাত কী করব!’
‘একা কেন, আমি আছি, আমরা আছি। তুমি কিন্তু এখনও মেনে নিতে পারছ না!’
‘না, তা নয়। এ ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না।’
মাধবীলতা ধীরে ধীরে খাটের এ পাশে চলে এল। তারপর অনিমেষের চুলে হাত রেখে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ‘হয়তো আমি অনেক কিছু বুঝি না। কিন্তু এইটুকু অন্তত বুঝি, আমাকে যা করতে হবে তা আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে করব। যে জানবে সে জানবে, আমি কিন্তু কাউকে জানাতে যাব না।’
‘কী কথার কী জবাব হল!’
‘একটু ভাবো তা হলে জবাবটাকে খুঁজে পাবে। নাঃ, আর দেরি করলে চলবে না। আমি এক্ষুনি ঘুরে আসছি, কেমন?’
‘লতা, তুমি যেরকম পরিশ্রম করছ—।’
‘এই পরিশ্রমের একটা আনন্দ আছে। এবার আমি বলি, সেই আনন্দটা তুমিও বুঝবে না।’
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মাধবীলতা ব্যাগ আর টিন নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ বালিশটাকে সামান্য সরিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আঃ, কী আরাম। কিছুক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইল সে। বস্তিতে নানারকমের চিৎকার উঠছে। এই ঘরে ঢোকার পর থেকেই বোঝা গেছে এখানে এক মুহূর্ত কেউ চুপচাপ কাটাতে পারে না। মাধবীলতার পক্ষে নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিল। আশেপাশের মানুষ, এই ঘর— কোনওটাই ওর রুচির সঙ্গে মানানসই নয়। অথচ কী চমৎকার মানিয়ে আছে ও। স্বর্গছেঁড়া কিংবা জলপাইগুড়িতে থাকতে অনিমেষ স্বপ্নেও ভাবেনি তার স্ত্রী এবং ছেলে বস্তির এই পরিবেশে দিন কাটাবে।
ঘুম আসছিল না। মিনিট দশেক বাদে অনিমেষ দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল। দুটো পা-কে সযত্নে সামনের দিকে ছড়িয়ে দিল সে। যত দিন যাচ্ছে তত লিকলিকে হয়ে যাচ্ছে ওগুলো। চিমটি কাটলে লাগে কিন্তু নিজের ইচ্ছেমতো ওগুলোকে নাড়ানো যায় না। কাতর চোখে কিছুক্ষণ নিজের দুটো পা চেয়ে চেয়ে দেখল অনিমেষ। তারপর হঠাৎ সচেতন হতেই ঘরের চারপাশে নজর বোলাল। খাটের পাশে মেঝেতে যেটা রয়েছে সেটা যে একটা বেডপ্যান তা বুঝতে অসুবিধে হবার নয়। মাধবীলতা আগে থেকেই সেটা আনিয়ে রেখেছে। ঠোঁট কামড়াল অনিমেষ।
টেবিলের ওপর কোনও ছবি নেই। কিছু বইপত্র আর চিঠি। অনিমেষ একটা খাম তুলে ধরল। খামের ওপর নাম লেখা মাধবীলতা মিত্র। নামটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল অনিমেষ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা মেয়ের মুখ ফুটে উঠল চোখের সামনে। যে মেয়ে এই পৃথিবীর কাউকে কেয়ার করে না অথচ একটুও উদ্ধত নয়, যে অকারণে কোনও বাধার কাছে মাথা নোয়ায় না অথচ একটুও দাম্ভিক নয়, সেই মেয়ে একটা সুখের পরিমণ্ডল ছেড়ে শুধু ভালবাসার জন্যে একা একা লড়ে গেল, কখনও কোনও আপস করল না। শান্তিনিকেতনের সেই রাতের ঘটনা অনিমেষের মনে কিছুটা গ্লানি ছিটোলেও তা স্পর্শ করেনি এই মেয়েকে। পরম যত্নে সেই রাতটাকে সে অক্ষয় করেছে। এই কলকাতায় একা একটি অল্পবয়সি মেয়ে সেই রাতের ফসল দশমাস শরীরে ধরে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছে আইনের কোনও অধিকার ছাড়াই, কোনও প্রত্যাশা মনে না-রেখেই। এটা এমন এক ধরনের লড়াই যা নিজেকে পরিশুদ্ধ করে। কোনওরকম ব্যাকরণ না-মেনে এইভাবে লড়াই করে যাওয়া বোধহয় রাজনীতিতে সম্ভব নয় কিন্তু একটি মেয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব বলা যাবে না কেন? মাধবীলতা কারও কাছে সফলতা ভিক্ষে করেনি, সাফল্য সে আদায় করে নিয়েছে। সেটা পেরেছে বলেই সে নামের পাশে মিত্র লিখতে পারে, অনিমেষ তার পাশে থাকুক কিংবা না-থাকুক, এই মানসিকতা কিছুতেই পালটাবে না।
আলনায় ছোট ছোট জামাপ্যান্ট ঝুলছে। নীচে একটা রবারের শস্তা হাওয়াই চটি। অনিমেষের সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল মাধবীলতাকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কী নাম রেখেছে মাধবীলতা? সে টেবিলের ওপর আর-একবার খোঁজ করল। না, কোনও শিশুর বইপত্র নেই। যা আছে মাধবীলতার। ছেলেটার বই কোথায় রাখে? ঘরে তো আর কোনও রাখার জায়গা নেই। এই ঘরে একা বসে থাকা অনিমেষের উপকারে এল। এলোমেলো ভাবনা চিন্তাগুলো একসময় গুটিয়ে গিয়ে সে কিছুটা সুস্থ হতে পারল। সে আত্মহত্যা করতে পারবে না। পৃথিবীতে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। অনেকদিন আগে সে একটা রাশিয়ান গল্প পড়েছিল। মরুভূমির মধ্যে একটা পাহাড়ে বছরে একবার বৃষ্টি হত কিনা সন্দেহ। সেখানে জমি পাথুরে, কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। বাতাস সারা দিনই তেতে থাকত, শুধু শেষ রাতে একটু শীতল ছোঁয়া লাগত তাতে। জলের চিহ্ন নেই কয়েকশো মাইলের মধ্যে। পাখি দূরের কথা, হায়েনারাও এই পাহাড়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না। এরকম এক জায়গায় হঠাৎ একটা বীজ এসে পড়ল পাথরের খাঁজে। পাথরের আড়াল বলেই বোধহয় হাওয়ার দাপটে সেই বীজটা উড়ে গেল না। কোত্থেকে এল সেটা কে জানে, হয় কোনও পথিক ফেলে গেছে নয় ঝড়ো বাতাস উড়িয়ে এনেছে। বীজটার গায়ে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া লাগতেই তার শরীর টানটান হল। তার তলায় মাটি নেই কিন্তু ধুলো রয়েছে। দেখা গেল, বাতাস, সেই ভোরের বাতাস থেকে সে নিশ্বাস এবং আহার খুঁজে নিয়ে একটু একটু করে মুখ তুলছে, সারাদিনের রোদ ও গরম হাওয়া তাকে যতই পুড়িয়ে মারতে চায় তত সে ভোরের ঠান্ডা বাতাসকে জড়িয়ে ধরে। এইরকম লড়াই চলল কিছুদিন। বীজ থেকে ছোট্ট গাছ হল। পাথরটার আড়ালে আড়ালে সে বড় হল। সূর্য আর গরম হাওয়া ঠিক করল আর-একটু বড় হলেই ওটাকে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তখন ওরা জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু যেই গাছটা মুখ তুলল দেখা গেল সেটা পাতা বা ডাল নয়, সূর্যের মুখ চাওয়া ফুল। ছোট্ট সুন্দর। সূর্যের স্পর্শ পেয়ে সুন্দরতর হল। এই ঊষর মরুভূমিতে সে একদিন মৌমাছি ডেকে আনল।
অনিমেষের মনে হল তাকেও এমনিভাবে লড়তে হবে। এই ঘরে বসে সে নিঃশব্দে লড়াই করে যেতে পারে। শুধু সেই লড়াইয়ের জন্যে তাকে মনে মনে প্রস্তুত হতে হবে। না, আর ভেঙে পড়া নয়। জীবনটা বড্ড ছোট, বাকি দিনগুলো সুন্দরভাবে খরচ করা দরকার। খুব ছোটবেলা থেকেই, যেদিনের কথা তার জ্ঞানে আছে সেদিন থেকেই সে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভাল এবং মন্দ দুটোই একসঙ্গে চিন্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটা মাধবীলতার মধ্যে একদম নেই। মাধবীলতা যদি কারও সাহায্য ছাড়াই একা লড়াই করে যেতে পারে তা হলে সে কেন পারবে না? পঙ্গুও তো পাহাড় পার হয়। একটু একটু করে নিজেদের ভুলগুলো ত্রুটিগুলো নিয়ে চিন্তা করা দরকার। আজকের এই হেরে যাওয়া থেকে যে অভিজ্ঞতা হল তাকে কাজে লাগানো দরকার। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই দেশে কখনওই সর্বাত্মক বিপ্লব হয়নি। স্বাধীনতার পর এই প্রথম একটা চেষ্টা হয়েছিল। কয়েকটা ভুল-পা হেঁটে এলেও হাঁটা তো হয়েছিল। এরপরে যারা হাঁটবে তারা সেই ভুলটা করবে না।
জেলখানা থেকে বেরিয়ে দলের কারও সঙ্গে দেখা করার কথা মাথায় আসেনি। নিজে থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি। অনিমেষ ঠিক জানে না তাদের দলের ছেলেরা এখনও সক্রিয় কি না। গোপনে কেউ আবার আগুন জ্বালাবার কথা ভাবছে কি না। কিন্তু যারাই সেই ভাবনা-চিন্তা করুক তাদের আগে মাটিতে পা রাখতে হবে।
তন্দ্রা এসেছিল। দরজায় শব্দ হতেই চোখ খুলল অনিমেষ। মাধবীলতা ফিরেছে। হাতে কেরোসিনের টিন, কাঁধে বাজারের ব্যাগ আর মুখ পেছন দিকে ফেরানো। খুব সহজ গলায় ডাকল, ‘ওদিকে যেয়ো না, ঘরে এসো।’
দরজাটা হাট করে খুলে দিল সে। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। অনিমেষ দু’হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে কোনওরকমে সোজা করে নিল। তারপর সতৃষ্ণ চোখে বাইরের দিকে তাকাল।
মাধবীলতা এখনও দরজা থেকে সরেনি। তার চোখ অনিমেষের মুখের ওপর স্থির। কয়েক মুহূর্ত বাদে অনিমেষ ওকে দেখতে পেল। দেখে চমকে উঠল।
অনিমেষের বুকের মধ্যে এখন একশোটা হিরোশিমা দুলছে। চারপাশ ভেঙেচুরে গলে জ্বলে অন্ধকার হয়ে গেল আচমকা। তারপর ক্রমশ ধোঁয়া সরে গেলে সেই স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানের বুক শান্ত করে বয়ে যাওয়া আংরাভাসা নদীর ওপর উপুড় হয়ে থাকা শিশু কিংবা বালকটি সামনে এসে দাঁড়াল। অপার বিস্ময় নিয়ে যে লাল চিংড়ি মাছেদের খেলা করতে দেখত। অবিকল সেই চোখ, সেই মুখ, এমনকী তাকানোর ভঙ্গিটাও একই রকম। অনিমেষের মনে হল অনেক অনেক বছর আগের সে এখনকার তাকে দু’চোখ ভরে দেখছে।
সেই বালক বলছে, ‘কেমন আছ অনিমেষ?’
এই মধ্যবয়স জবাব দিচ্ছে, ‘ভাল না, একদম ভাল না।’
‘তোমার তো এমন হবার কথা ছিল না।’
‘আমি যখন তুমি ছিলাম তখন ছিল না। তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি যখন তুমি ছিলাম তখন সত্যি ভাল ছিলাম।’
‘আমার শরীরটা তোমার মতো হয়ে গেলে—।’
‘না কক্ষনও নয়।’
মাধবীলতার গলা শোনা যেতেই সবকিছু মিলিয়ে গেল আচমকা। দরজার ফ্রেমে ছবির মতো এখনও মাধবীলতা এবং সে। মাধবীলতা বলল, ‘অমন করে কী দেখছ? ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’
অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর হাসবার চেষ্টা করল, ‘এসো।’
ডাকটা যার উদ্দেশে সে তখন মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুটো বড় চোখ মেলে এদিকে তাকিয়ে আছে। পায়ে ময়লা সাদা মোজা জুতো, প্যান্টশার্টের ওপর দীনতার ছাপ। পিঠে বই-ভরতি স্কুলের ব্যাগ।
মাধবীলতা বলল, ‘ডাকছেন, যাও।’
একটু দ্বিধা কাটাতে সময় লাগল। তারপর মাধবীলতার আড়াল ছেড়ে সে ছোট ছোট পা ফেলে খাটের দিকে এগিয়ে এল। এসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিমেষ দেখল ওর চোখ এখন তার পায়ের দিকে। চোখ কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণে ভাঁজ।
সহজ হবার চেষ্টায় অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘বলো তো আমি কে?’
সে চোখ তুলল, তুলে আবার পায়ের ওপর নজর রাখল, ‘তুমি হাঁটতে পারো না?’
অনিমেষ ওই এক চিলতে দৃষ্টিতে বুঝে নিল মাধবীলতা ওর কাছে কিছু গোপন রাখেনি। তার গলা ভারী হয়ে গেল, ‘না।’
‘পুলিশ করে দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
বুকের ঝড়টাকে কোনওরকমে শান্ত করছিল অনিমেষ। দু’হাত বাড়িয়ে বলল, ‘অত দূর থেকে কি গল্প করা যায়? আমি তো তোমার কাছে যেতে পারব না, তুমি আমার কাছে এসো।’
মাধবীলতার শরীরটা কাছে চলে এল। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে দিল দু’হাতের আলিঙ্গনে। এখন অনিমেষের দু’হাতে এক তাল নরম কাদা, যা নিয়ে ইচ্ছেমতন মূর্তি গড়া যায়।
______